চোর
পটাশের বাবা নব এবং নবর বাবা ভব দু’জনেই ছিল বিখ্যাত চোর। অর্থাৎ পটাশকে নিয়ে তিন পুরুষ ধরে তারা চোর। ভব চোরের নামডাক ছিল সাংঘাতিক। লোকে বলে, ভব নাকি বাজি রেখে এক দুপুরে তার পিসির আহ্নিক করার কম্বলের আসন চুরি করেছিল। কাজটা শুনতে যত সহজ, আসলে তত সহজ নয়। কারণ পিসি তখন স্বয়ং ওই আসনে বসে কাঁথা সেলাই করছিলেন। সেই অবস্থায় আসন চুরি যাওয়ায় পিসি আনন্দাশ্রু বিসর্জন করতে করতে ভবকে আশীর্বাদ করেছিলেন, ”ওর আমার ভব, তোর ওপর স্বয়ং ভগবানের ভর আছে, এ বিদ্যে ছাড়িসনি।”
পিসির আশীর্বাদে ভব বিদ্যে ছাড়েনি। বয়সকালে নিজের ছেলে নবকে তালিম দিয়ে সব বিদ্যে শিখিয়ে গেল। তা নবও কিছু কম গেল না। চোরের তালিম কিছু সহজ কাজ নয়। ভালো দৌড়োতে পারা চাই, উঁচু বা লম্বা লাফে দক্ষ হওয়া চাই, বাঁশের ওপর ভর দিয়ে ভল্ট খেয়ে উঁচু দেওয়াল ডিঙোতে পারা চাই, রণপায়ে চলতে জানা চাই। এছাড়া গায়ে যথেষ্ট জোর না থাকলে দু’দশ জন মানুষের সঙ্গে মোকাবিলা করা তো সহজ নয়। তারপর ভালো অভিনয়, বিনয়ী ব্যবহার ইত্যাদি তো আছেই। চোর বলে যদি সবাই চিনে ফেলে তো চিত্তির। নবর এসব গুণ তো ছিলই তা ছাড়া ছিল দুর্জয় সাহস। সে দু—মণ লোহা তুলত, কুস্তিতে যে—কোনো পালোয়ানকে হটিয়ে দিতে পারত, যন্ত্রবিদ্যা, মন্ত্রতন্ত্রও ছিল তার নখদর্পণে। এমন ঘুমপাড়ানি মন্ত্র জানত যে, গেরস্তের কুকুর পর্যন্ত ঘুমিয়ে থাকত, টুঁ শব্দ করত না। জমিদার তারিণী রায়ের বাড়ি থেকে এক খিলি পান চুরি করেছিল সে। শুনতে যত সহজ, কাজটা মোটেই তত সহজ ছিল না। রায়মশাইয়ের নাতির অন্নপ্রাশনে বাড়িতে সেদিন লোক গিজগিজ করছে। খাওয়াটাও হয়েছিল বেজায় রকমের। সকলের আইঢাই অবস্থা রায়মশাইয়ের খুড়ো বিপিনচন্দ্র এক খিলি বেনারসি পাত্তির স্পেশাল পান নিজের রুপোর বাটা থেকে বের করে মুখে ফেলতে যাচ্ছিলেন। ঠিক সেই সময়ে পানটা চুরি যায়। অবিশ্বাস্য ব্যাপার। খুড়োমশাই নিজেও কিছুক্ষণ বুঝতে পারেননি যে,তাঁর দু আঙুলে ধরা পানটি হাঁ করা মুখের মধ্যে যেতে যেতে কীভাবে হাওয়া হল। কিছুক্ষণ চিবুবার পর তিনি খেয়াল করলেন, যা চিবোচ্ছেন তা পান নয়, নিজের জিবখানা। বেনারসি পান ততক্ষণে নবর গালে জমে বসেছে।
নবর এই হাত সাফাই দেখে তারিণী রায় তাকে সভাচোর করতে চেয়েছিলেন। ঠিক যেমন পুরনো আমলে রাজরাজড়াদের সভাকরি, সভাগায়ক থাকত। অবশ্য সভাচোর হয়নি। হাতজোড় করে রায়মশাইকে বলেছিল, ”আজ্ঞে, এ হল বাপ—দাদার বিদ্যে, এ ছাড়তে পারব না।”
”ছাড়বি কেন? বৃত্তি ছাড়ার জন্য কি তোকে রাখছি? চুরিই করবি, তবে মজার জন্য।”
নব শেষ অবধি রাজি না হওয়ায় তারিণী রায় তাকে আর পীড়াপীড়ি করেননি। তবে একখানা সোনার মেডেল দিয়েছিলেন। বরাবর স্নেহও করতেন খুব।
সেই নবর ছেলে হল পটাশ। ছেলে না বলে অকালকুষ্মাণ্ডই বলা ভালো। সব থেকেও তার কী যেন নেই। এই ছেলেকে এইটুকুন বেলা থেকে নিজে তালিম দিয়েছে নব। ছেলে তৈরিও কিছু কম হয়নি। হরিণের মতো দৌড়োতে পারে, বানরের মতো লাফাতে পারে, গায়ে হাতির জোর, বুদ্ধিও খুব। তবু) চুরিতে একেবারেই মন নেই। নব শেখায়, সেও শেখে, তবে গা লাগায় না, মন দেয় না।
একদিন হল কী, হাত মকশো করতে নব তার ছেলেকে সুদখোর অক্ষয় হাজরার বাড়ি চুরি করতে পাঠাল। পটাশ গেল বটে, কিন্তু চোরের যা যা করতে নেই তার সবকিছুই করতে লাগল। হাজরার চারটে কুকুরই তাকে চেনে, সুতরাং তেড়ে এল না। দু’একবার ভুকভুক করে চুপ মেরে গেল। পটাশের সেটা পছন্দ হল না। ঢিল মেরে মেরে সেগুলোকে খেপিয়ে দিয়ে শোরগোল তুলে ফেলল সে। তারপর দরজা ভাঙতে এমন সব বিকট শব্দ তুলল, যাতে মড়া অবধি উঠে বসে। তাতেও খুশি না হয়ে গুনগুন করে গান গাইতে লাগল।
অক্ষয় হাজরা সর্বদা ভয়ে—ভয়ে থাকে। ঘরে নগদ টাকা, সোনাদানা তো কম নেই। জেগে গিয়ে সে হেঁকে উঠল, ”কে, কে রে?”
”আমি পটাশ।”
”পটাশ? তা কী মনে করে? এই রাত—বিরেতে আমি দোর খুলতে পারব না। জিনিস বাঁধা দিতে এসেছিস তো! জানালা দিয়ে দে। এই হাত বাড়াচ্ছি।”
”হাত বাড়াতে হবে না। আমি দরজা ভেঙে ফেলেছি।”
”ভেঙে ফেলেছিস মানে? করছিসটা কী বল তো?”
”আজ্ঞে চুরি করছি।”
”চুরি করছিস। ইয়ার্কি হচ্ছে, অ্যাঁ? এভাবে কেউ চুরি করে? বেরো, বেরো বলছি।”
পরদিন অক্ষয় হাজরা এসে নবকে সব বৃত্তান্ত জানিয়ে বলল, ”ও কেমনধারা ছেলে তোর? চুরি তো তুইও করতিস, কখনো তো সাড়াশব্দ করিসনি, আস্পদ্দাও দেখাসনি। আর তোর ছেলের আস্পদ্দা দ্যাখ। গেরস্ত জিজ্ঞেস করছে কী করছিস, আর বুক ফুলিয়ে চোর বলছে, চুরি করছি। তার ওপর আবার গুনগুন করে গানও গাইছিল। দিনটি কী পড়ল বল তো নব!”
নব সেদিন পটাশকে জুতোপেটা করল খুব। কিন্তু পেটাতে পেটাতেই নব বুঝতে পারছিল, পটাশকে দিয়ে হবে না। বাপ—দাদার বিদ্যে এর হাতেই নষ্ট হবে।
পটাশ নির্বিকার। খায়—দায়, ঘুরে বেড়ায়। মাঝে—মাঝে বাপের সঙ্গে শাগরেদি করতে বেরোয় বটে কিন্তু কাজের চেয়ে অকাজই করে বসে বেশি। কখনো দুম করে হাত থেকে তার সিঁদকাঠি পড়ে যায়। একদিন ‘সাপ—সাপ’ বলে চেঁচিয়ে উঠে কেলেঙ্কারি করল। আর একদিন একজনের ঘরে ঢুকে নব যখন সিন্দুক বাক্স আলমারি খুলে ফেলেছে, তখন পটাশ একটা ফাঁকা বিছানা দেখতে পেয়ে সোজা গিয়ে তার ওপর শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুমন্ত মানুষজনের মধ্যে যে পটাশও থাকতে পারে, তা নব আন্দাজ করতে পারেনি। তাই ছেলেকে খুঁজে না পেয়ে একাই ফিরে এসে ভাবতে বসল। সকালবেলা হাই তুলতে তুলতে পটাশ ফিরে এলে তাকে একখানা গোদা হাতের চড় কষিয়ে বলল,”কোথায় ছিলি?”
”ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।”
”পাজি নচ্ছার, ঘুমিয়ে পড়লি চোরের ছেলে হয়ে?”
”তা কী করব? ঘুম পেয়ে গেল যে বেজায়।”
”তোকে ওরা ঠেঙায়নি?”
”না। সব বলে দিলাম যে।”
”বললি! কী বললি?”
”বললাম বাবার সঙ্গে চুরি করতে এসে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। বাবার নাম নব চোর। তখন বসিয়ে দুধ চিঁড়ে ফলার করাল।”
”ফলার করাল?”
”করাবে না? এত বড় চুরির হদিশ দিয়ে দিলাম। তারা সব দল বেঁধে লাঠিসোঁটা নিয়ে আসছে।”
নব মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল।
সেই দিনই নব তার বাড়ি থেকে পটাশকে তাড়িয়ে দিল। সবাইকে জানিয়ে দিল, ”ওকে ত্যাজ্যপুত্তুর করলাম।”
পটাশ কোথায় গেল তার খোঁজ আর কেউ রাখল না।
এদিকে নব ধীরে ধীরে বুড়ো হতে লাগল। দাঁত পড়ল, চুল পাকল, শরীরের জোর বল চোখের দৃষ্টি সবই কমতে লাগল, বুদ্ধি একটু ঘোলাটে হল। বেপরোয়া ভাবখানাও তেমন রইল না। পৈতৃকবৃত্তি বজায় রাখা ভারি শক্ত হয়ে উঠল। আগে প্রতি রাতে চুরি করতে বেরোত, আজকাল আর তা পেরে ওঠে না। ফলে সে সঞ্চয়ে মন দিল। একটু—আধটু সুদের কারবার করতে শুরু করল। তাতে আয় মন্দ হল না। স্বভাবটা ভারি কৃপণের মতো হয়ে গেল তার।
ওদিকে বাপের তাড়া খেয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পটাশ পড়ল অথৈ জলে। চুরি ছাড়া তার বাবা তাকে আর কিছুই শেখায়নি বলে কাজকর্মেরও জোগাড় হল না। না খেয়ে খেয়ে চেহারা পাকিয়ে যেতে লাগল। এক বাড়িতে চাকরের কাজ পেয়েছিল কিছু দিন। বাসন মাজত, জল তুলত, ঘরদোর ঝাঁটপাট দিত। বেশ ছিল। একদিন হঠাৎ মাঝরাত্রে যেন নিশির ডাক শুনে উঠে পড়ল। তারপর ভারি অবাক হয়ে দেখল তার দুটো হাত আপনা থেকেই বাক্স প্যাঁটরা হাতড়াচ্ছে।
এই কাণ্ড দেখে পটাশ এমন আতঙ্কিত হয়ে পড়ল যে, তার ”চোর! চোর!” বলে চেঁচিয়ে উঠতেও ইচ্ছে হয়েছিল। ভাগ্যিস চেঁচায়নি। তবে সে অবাক হয়ে দেখল, বিনা আয়াসেই সে তালাচাবি খুলে ফেলছে এবং নিঃশব্দে জিনিসপত্র বের করছে। বাপ—দাদার স্বভাব যাবে কোথায়? রক্তেই বিজবিজ করছে যে!
পটাশ পালাল। আবার আর—এক বাড়িতে কাজ নিল। কিছুদিন পর সেখানেও সেই কাণ্ড। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পটাশ বুঝল, এটা থেকে তার আর নিস্তার নেই। বাপ নব তাকে চুরিতে নামাতে পারেনি বটে, কিন্তু তার ভিতর একটা চোরকে ঢুকিয়ে দিয়েছে। এতকাল সেটা ঘুমিয়ে ছিল, এখন তার ঘুম ভেঙেছে।
তা পটাশ সেয়ানা চোর। এক জায়গায় বেশি দিন থাকে না। ঘন ঘন এলাকা বদলায়। চুরির ধরনও সে পালটে ফেলে। পয়সাকড়ি সোনাদানা যা পায় উড়িয়ে দেয়। চুরি তো শুধু তার রোজগার নয়, একটা নেশাও।
একদিন রাত্রিবেলা একটা গাঁয়ে ঢুকল পটাশ। বেশ সম্পন্ন গ্রাম। অনেক বাড়িঘর! ঘরবাড়ির চেহারা দেখেই তার অভ্যন্ত চোখ বুঝতে পারে, কোন বাড়িতে জিনিসপত্র আছে।
বেছে বেছে একটা বাড়ি তার পছন্দ হল। বাড়ি তো নয়, যেন দুর্গ। মোটা গরাদ, পুরু মজবুত একপাটা কাঠের পাল্লা দেওয়া জানালা—কপাট, চারধারে উঁচু পাঁচিল। পাহারাদার কুকুর। দেখে খুশিই হল পটাশ। যেখানে চুরি করা শক্ত, সেখানেই চুরির আনন্দ।
পাঁচিল ডিঙিয়ে কুকুরটার মুখ বেঁধে জানালা খুলে ঘরে ঢুকতে সে বেশি সময় নিল না। কিন্তু ঘরে পা দিয়েই তার মনে হল, এ বাড়ি, এই ঘর তার চেনা।
ওদিকে নবরও ঘুম ভেঙেছে। ইঁদুরের শব্দ, বেড়ালের শব্দ সব সে চেনে। কিন্তু ও শব্দটা অন্যরকম। নব বাতাস শুঁকল। একটা গন্ধ পেল। তারপর খুব অবাক হয়ে বুঝতে পারল, তার ঘরে চোর ঢুকেছে। নবচোরের ঘরে চোর ঢুকেছে! আশ্চর্য কথা!
লাঠিসোঁটা অন্ধকারে খুঁজে পেল না নব। গায়ে তেমন জোরও নেই যে, চোরকে জাপটে ধরবে। বাঁ পায়ে বাতের সাংঘাতিক ব্যথা। অথচ ঘরে প্রচুর সোনাদানা, টাকাপয়সা। চোর সব নিয়ে যাবে।
নব বিকট স্বরে চেঁচাতে লাগল, ”চোর! চোর! চোর!”