কৌটোর ভূত
জয়তিলকবাবু যখনই আমাদের গাঁয়ের বাড়িতে আসতেন তখনই আমরা, অর্থাৎ ছোটরা ভারি খুশিয়াল হয়ে উঠতুম।
তখনকার, অর্থাৎ প্রায় ত্রিশ বছর আগের পূর্ববঙ্গের গাঁ—গঞ্জ ছিল আলাদা রকম, মাঠ—ঘাট, খাল—বিল, বন—জঙ্গল মিলে এক আদিম আরণ্যক পৃথিবী। সাপখোপ জন্তু—জানোয়ার তো ছিলই, ভূত—প্রেতেরও অভাব ছিল না। আর ছিল নির্জনতা।
তবে আমাদের বিশাল যৌথ পরিবারে মেলা লোকজন, মেলা কাচ্চাবাচ্চা। মেয়ের সংখ্যাই অবশ্য বেশি। কারণ বাড়ির পুরুষরা বেশির ভাগই শহরে চাকরি করত, আসত কালেভদ্রে। বাড়ি সামাল দিত দাদু—টাদু গোছের বয়স্করা। বাবা—কাকা—দাদাদের সঙ্গে বলতে কি আমাদের ভালো পরিচয়ই ছিল না, তাঁরা প্রবাসে থাকার দরুন।
বাচ্চারা মিলে আমরা বেশ হই—হুল্লোড়বাজিতে সময় কাটিয়ে দিতাম। তখন পড়াশুনার চাপ ছিল না। ভয়াবহ কোনো শাসন ছিল না। যথেষ্ট স্বাধীনতা ছিল। কিন্তু অভাব ছিল একটা জিনিসের। আমাদের কেউ যথেষ্ট পাত্তা বা মূল্য দিত না।
জয়তিলকবাবু দিতেন, আত্মীয় নন, মাঝে মধ্যে এসে হাজির হতেন। কয়েকদিন থেকে আবার কোথায় যেন উধাও হতেন। কিন্তু যে কয়েকটা দিন থাকতেন বাচ্চাদের গল্পে আর নানারকম মজার খেলায় মাতিয়ে রাখতেন।
মাথায় টাক, গায়ের রং কালো, বেঁটে, আঁটো গড়ন আর পাকা গোঁফ ছিল তাঁর। ধুতি আর ফতুয়া ছিল বারোমেসে পোশাক, শীতে একটা মোটা চাদর। সর্বদাই একটা বড় বোঁচকা থাকত সঙ্গে। শুনতাম তাঁর ফলাও কারবার। তিনি নাকি সবকিছু কেনেন এবং বেচেন। যা পান তাই কেনেন, যাকে পান তাকেই বেচেন। কোনো বাছাবাছি নেই।
সেবার মাঘমাসের এক সকালে আমাদের বাড়ি এসে হাজির হলেন। এসেই দাদুকে বললেন, গাঙ্গুলিমশাই, এবার কিছু ভূত কিনে ফেললাম।
দাদু কানে কম শুনতেন, মাথা নেড়ে বললেন, খুব ভালো। এবার বেচে দাও।
জয়তিলক কাঁচুমাচু মুখ করে বললেন, সেটাই তো সমস্যা। ভূত কেনে কে? খদ্দের দিন না।
—খদ্দর? না বাপু ওসব আমি পরি না, স্বদেশিদের কাছে যাও।
—আহা, খদ্দর নয়, খদ্দের, মানে গ্রাহক।
—গায়ক! না বাপু, গান বাজনা আমার আসে না।
জয়তিলক অগত্যা ক্ষান্ত দিয়ে আমাদের সঙ্গে এসে জুটলেন। তিনি ভূত কিনেছেন শুনে আমাদের চোখ গোল্লা গোল্লা। ঘিরে ধরে ‘ভূত দেখাও, ভূত দেখাও’ বলে মহা শোরগোল তুলে ফেললুম।
প্রথমে কিছুতেই দেখাতে চান না। শেষে আমরা ঝুলোঝুলি করে তাঁর গোঁফ আর জামা ছিঁড়ে ফেলার উপক্রম করায় বললেন, আচছা আচ্ছা, দেখাচ্ছি। কিন্তু সব ঘুমন্ত ভূত, শুকিয়ে রাখা।
সে আবার কী?
আহা, যেমন মাছ শুকিয়ে শুঁটকি হয় বা আম শুকিয়ে আমসি হয় তেমনই আর কী। বহু পুরনো জিনিস।
জয়তিলক তাঁর বোচকা খুলে একটা জংধরা টিনের কৌটো বের করলেন। তারপর খুব সাবধানে ভেতরে উঁকি মেরে দেখে নিয়ে ফিসফিস করে বললেন, বেশি গোলমাল কোরো না, এক এক করে উঁকি মেরে দেখে নাও। ভূতেরা জেগে গেলেই মুশকিল।
কী দেখলুম তা বলা একটা সমস্যা। মনে হল শুকনো পলতা পাতার মতো চার—পাঁচটা কেলেকুষ্টি জিনিস কৌটোর নিচে পড়ে আছে। কৌটোর ভিতরটা অন্ধকার বলে ভালো বোঝাও গেল না। জয়তিলক টপ করে কৌটোর মুখ এঁটে দিয়ে বললেন, আর না। এসব বিপজ্জনক জিনিস।
বলাবাহুল্য, ভূত দেখে আমরা আদপেই খুশি হইনি। আমরা সিদ্ধান্ত নিলুম যে, ওগুলো মোটেই ভূত নয়। জয়তিলকবাবুকে ভালোমানুষ পেয়ে কেউ ঠকিয়েছে।
জয়তিলকবাবু মাথা নেড়ে বললেন, না হে, ঠকায়নি। চৌধুরি বাড়ির বহু পুরনো লোক হল গোলোক। সারাজীবন কেবল ভূত নিয়ে কারবার। তার তখন শেষ অবস্থা, মুখে জল দেওয়ার লোক নেই। সেই সময়টায় আমি গিয়ে পড়লাম। সেবা—টেবা করলাম খানিক, কিন্তু তার তখন ডাক এসেছে। মরার আগে আমাকে কৌটোটা দিয়ে বলল, তোমাকে কিছু দিই এমন সাধ্য নেই। তবে কয়েকটা পুরনো ভূত শুকিয়ে রেখেছি। এগুলো নিয়ে যাও, কাজ হতে পারে। ভূতগুলোর দাম হিসেব করলে অনেক। তা তোমার কাছ থেকে দাম নেবই বা কী করে, আর নিয়ে হবেই বা কী। তুমি বরং আমাকে পাঁচ টাকার রসগোল্লা খাওয়াও। শেষ খাওয়া আমার।
এই বলে জয়তিলকবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।
আমরা তবু বিশ্বাস করছিলুম না দেখে জয়তিলকবাবু বললেন, মরার সময় মানুষ বড় একটা মিছে কথা বলে না।
তবু আমাদের বিশ্বাস হল না। কিন্তু সেকথা আর বললুম না তাঁকে।
দুপুরবেলা যখন জয়তিলকবাবু খেয়ে দেয়ে ভুঁড়ি ভাসিয়ে ঘুমোচ্ছেন ঠিক সেই সময়ে আমি আর বিশু তাঁর ভূতের কৌটো চুরি করলুম। এক দৌড়ে আমবাগানে পৌঁছে কৌটো খুলে ফেললুম। উপুড় করতেই পাঁচটা শুকনো পাতার মতো জিনিস পড়ল মাটিতে। হাতে নিয়ে দেখলুম, খুব হাল্কা। এত হাল্কা যে জিনিসগুলো আছে কি নেই তা বোঝা যায় না। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে মনে হল, এগুলো পাতা—টাতা নয়। অনেকটা ঝুল জাতীয় জিনিস, তবে পাক খাওয়ানো, বেশ ঠান্ডাও।
বিশু বলল, ভূত কিনা তা প্রমাণ হবে যদি ওগুলো জেগে ওঠে।
—তা জাগাবি কী করে?
—আগুনে দিলেই জাগবে। ছ্যাঁকার মতো জিনিস নেই।
আমরা শুকনো পাতা আর ডাল জোগাড় করে কিছুক্ষণের মধ্যেই আগুন জ্বেলে ফেললুম। আঁচ উঠতেই প্রথমে একটা ভূতকে আগুনের মধ্যে ফেলে দিলুম।
প্রথমে একটা উৎকট গন্ধ উঠল। তারপর আগুনটা হঠাৎ হাত দেড়েক লাফিয়ে উঠল। একটু কালো ধোঁয়া বেরিয়ে এল। তারপরই হড়াস করে অন্তত সাড়ে পাঁচ ফুট উঁচু একটা কেলে চেহারার বিকট ভূত আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল। চোখ দু’খানা কটমট করছে।
ওরে বাবা রে! বলে আমরা দৌড়তে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলুম। পড়ে গিয়ে দেখলুম জ্যান্ত ভূতটা আর চারটে ঘুমন্ত ভূতকে তুলে আগুনে ফেলে দিচ্ছে।
চোখের পলকে পাঁচ পাঁচটা ভূত বেরিয়ে এল। তারপর হাসতে হাসতে তারা আমবাগানের ভেতর দিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়তে লাগল।
ঘটনাটির কথা আমরা কাউকেই বলিনি। জয়তিলকবাবুর শূন্য কৌটোটা যথাস্থানে রেখে দিয়ে এলুম।
সেই রাত্রি থেকে আমাদের বাড়িতে প্রবল ভূতের উপদ্রব শুরু হয়ে গেল।
রান্নাঘরে ভূত, গোয়ালে ভূত, শোয়ার ঘরে ভূত, পুকুরে ভূত, কুয়োপাড়ে ভূত। এই তারা হিঁ হিঁ করে হাসে, এই তারা মাছ চুরি করে খায়। এই ঝি—চাকরদের ভয় দেখায়। সে ভীষণ উপদ্রব। ভূতের দাপটে সকলেই তটস্থ।
জয়তিলকবাবু এইসব কাণ্ড দেখে নিজের কৌটো খুলে মাথায় হাত দিয়ে বসলেন, বললেন, এঃ হেঃ, ভূতগুলো পালিয়েছে তাহলে: ইস, কী দারুণ জাতের ভূত ছিল, বেচলে মেলা টাকা পাওয়া যেত। নাঃ, ভূতগুলোকে ধরতেই হয় দেখছি।
এই বলে জয়তিলকবাবু মাছের জাল নিয়ে বেরোলেন। ভূত দেখলেই জাল ছুড়ে মারেন। কিন্তু জালে ভূত আটকায় না। জয়তিলকবাবু আঠাকাঠি দিয়ে চেষ্টা করে দেখলেন। কিন্তু ভূতের গায়ে আঠাও ধরে না। এরপর জাপটে ধরার চেষ্টাও যে না করেছেন তাও নয়। কিন্তু কিছুতেই ভূতদের ধরা গেল না।
দুঃখিত জয়তিলকবাবু কপাল চাপড়ে আবার শুঁটকি ভূতের খোঁজে বেরিয়ে পড়লেন।
পাঁচ পাঁচটা ভূত দাপটে আমাদের বাড়িতে রাজত্ব করতে লাগল।