জয়রামবাবু

জয়রামবাবু

জয়রাম বোস নস্যির ডিবেটা মঙ্গলগ্রহে ফেলে এসেছেন। কিন্তু ফেরার উপায় নেই। তাড়াহুড়োয় পৃথিবীতে ফিরে আসার জন্য যে রকেটটা ভাড়া করেছেন, সেটা আন্তঃ নক্ষত্রমণ্ডল খেয়া পারাপারের। সৌরমণ্ডলের জন্য আলাদা ধীরগতির রকেট পাওয়া যায়। কিন্তু ফেরার সময় এটাকেই কাছেপিঠে দেখতে পেয়ে হাতঘড়িতে লাগানো ট্রানসরিসিভারের সংকেতে নামিয়ে এনেছিলেন। পাইলট ফাঁকতালে ছোট খেপের সওয়ারি পেয়ে কিছু বাড়তি লাভের আশায় আপত্তি করেনি বটে, তবে সে নস্যির ডিবের জন্য এখন ফিরে যেতেও নারাজ। জয়রাম কথাটা তুলতেই লোকটা বলল, ”ও বাবা, আমাকে আর সাত মিনিটের মধ্যে নেবুলার ওধারে রওনা হতে হবে। আমার এ রকেট সেকেন্ডে মাত্র দু কোটি মাইল যায়। সৌরমণ্ডল বলে আরও আস্তে চালাচ্ছি। দেরি করতে পারব না।”

জয়রাম খিঁচিয়ে উঠতে গিয়েও সামলে নিলেন। মেজাজ খারাপ করে লাভ নেই। আন্তঃ নক্ষত্রমণ্ডল খেয়ার মাঝিরা একটু ডাঁটিয়াল হয়েই থাকে। তবে নস্যির ডিবের জন্য জয়রামের একটু উসখুস রয়েই গেল।

জয়রামের বাড়ি একটি ভাসমান বাসগৃ। পৃথিবীতে আর বাড়ি করার জায়গা নেই। মাটির তলাতেও আধমাইল গভীরতা পর্যন্ত গিজগিজ করছে বাড়িঘর। অবশেষে একবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে মাধ্যাকর্ষণ—নিরোধী বাড়ি তৈরি করে আকাশে ছাড়া হয়েছে। তা বলে বাড়িগুলো ভেসে বেড়ায় না, শূন্যের একটি নির্দিষ্ট জায়গায় একদম স্থির হয়ে থাকে। এইসব বাড়িতে বাতাস থেকে জল এবং সৌরশক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ভালো ব্যবস্থা আছে। শুধু মাঝে—মাঝে হাটবাজার করতে পৃথিবীতে নামতে হয়।

জয়রামের বাড়ির সামনে একটা খোলা রক। তার ওপর দাগ কেটে জয়রামের ছোট মেয়ে বুঁচি এক্কাদোক্কা খেলছে। রকেটটা সেই রকের পাশ ঘেঁষে দাঁড়াতেই জয়রাম ভাড়া মিটিয়ে লাফ দিয়ে নামলেন। বুঁচি ‘বাবা” বলে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল গায়ে।

মেয়ে আচমকা ঝাঁপিয়ে পড়ায় জয়রাম টাল সামলাতে না পেরে পড়ো—পড়ো হয়ে পড়েই গেলেন নিচে। নিচে বলতে যদি সত্যিই পৃথিবীর বুকে গিয়ে পড়তে হয়, তবে সে প্রায় পঞ্চাশ হাজার ফুট। কিন্তু আকাশবাড়িতে যারা থাকে, তাদের সকলকেই মাধ্যাকর্ষণ—নিরোধী পোশাক পরতে হয়। জয়রাম তাই পড়েও পড়লেন না। শূন্যে একটু ভেসে সাঁতরে আবার বাড়ির রকে এসে উঠলেন। মেয়ের মাথায় একটু হাত বুলিয়ে ঘরে ঢুকে মহাকাশের বিশেষ পোশাক ছেড়ে একটা লুঙ্গি পরে দেয়ালজোড়া টেলিভিশনের পর্দার সামনে বসে বললেন, আমি এখন টেলিভিশন দেখব। চ্যানেল চার, ব্যান্ড সাত। বলার সঙ্গে সঙ্গে ধ্বনিপ্রতিক্রিয়ায় টেলিভিশনে ছবি ভেসে উঠল। জোর খেলা চলছে। বৈজ্ঞানিক রাখোহরির টিমের সঙ্গে যন্ত্রবিদ ফসটারের টিমের ফুটবল ক্যালকুলেশন ম্যাচ। দু’দলে এগারো জন করে বাইশ জন বাঘা কমপিউটার রয়েছে। তারা বলটাকে এক বিশাল আয়তক্ষেত্রের বিভিন্ন জায়গায় চালনা করছে। রাখোহরির লেফট উইং বেঁটে কমপিউটার গদাই বলটাকে নিউট্রাল জোনে ঠেলে দিতেই ফস্টারের গোল কমপিউটার ব্যারেল সেটাকে ধরে লেফট হাফ মজবুত—গড়নের গরডনের কাছে পাঠাল। রাখোহরির চকিত—চিন্তা কমপিউটার বলটাকে ধরে পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রির কোণে নিখুঁত ঠেলে দিতেই ফস্টারের পাগলা কমপিউটার মুনস্ট্রাক আর রাখোহরির ঠান্ডা—মাথার কমপিউটার শীতলচন্দ্রের জোর সংঘর্ষ।

জমে উঠেছিল খেলাটা। কিন্তু জয়রামের গিন্নি সৌরচুল্লিতে কয়েক সেকেন্ডের ভিতর এক বাটি সুজি করে এনে দিয়ে বললেন, ”এক ছিটে আনাজপাতি নেই। বাজারে যাবে না?”

জয়রাম উঠলেন! অতিবেগুনি রশ্মি ও অন্যান্য রশ্মি দিয়ে হাতমুখ পরিষ্কার করে সুজি খেয়ে পোশাক পরে বেরিয়ে পড়লেন। আসল সুজি নয়, কৃত্রিম সুজি, তাই মুখটা বিস্বাদ ঠেকছিল।

গ্যারেজে ঢুকে ছোট ভারটিকাল বিমানটি বের করে নিয়ে পৃথিবীর বুকে রওনা হলেন। তাড়া নেই। আস্তে—আস্তে যাচ্ছেন। আশেপাশে আরও অনেক বাড়ি ভাসছে। দত্তগিন্নি একটা মহাজাগতিক রশ্মি আটকানোর ছাতা মাথায় দিয়ে বাড়ির ছাদে উঠে ডালের বড়ি শুকোতে দিচ্ছেন। বুড়ো চাটুজ্যের বড় বদভ্যাস। রকে দাঁড়িয়ে নাক ঝাড়ল নিচে। পড়শি খলিলভাই বাজার করে ছেলেমেয়ে নিয়ে একটা কাচের হেলিপ্লেনে ফিরছিলেন। তাকে বেতারে জয়রাম চাটুজ্যে বুড়োর বদভ্যাসের কথাটা জানিয়ে দিয়ে বললেন, ”এইভাবেই একদিন দেখো আকাশবাসী আর পৃথিবীবাসীর মধ্যে একটা ঝগড়া পাকিয়ে উঠবে। এখনই সাবধান না হলে—”

নস্যির জন্য নাকটা উসখুস করছে তখন থেকে। কিন্তু কিছু করার নেই। দুঃখিত মনে জয়রাম প্লেন নিয়ে নিউ ইয়র্কের সুপার মারকেটে নামলেন। নামে সুপার মারকেট হলেও সবজি বা আনাজ বলতে প্রায় কিছুই পাওয়া যায় না। পৃথিবীতে জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় চাষের জমিতে টান পড়েছে। তাই টাটকা সবজির বদলে আজকাল সিনথেটিক খাবারেরই বেশি চলন, সবজি যাও বা কিছু পাওয়া যায়, তা আসে নীহারিকা পুঞ্জের প্রথম পর্যায়ের এক সৌরমণ্ডলের দুটি বাসযোগ্য বড় গ্রহ থেকে। কিন্তু তাতে খরচও কম পড়ে না আর পরিমাণেও তা পৃথিবীর কোটি কোটি লোকের তুলনায় নেহাতই তুচ্ছ।

জয়রাম ভিড়ে থিকথিক—করা বাজারে ঢুকে দেখলেন এক জায়গায় কিছু টাটকা মানকচু বিক্রি হচ্ছে। তার সামনে বিশাল লাইন। জয়রাম ঘণ্টাখানেক লাইনে দাঁড়ালেন। কিন্তু অর্ধেক পথেই কচু ফুরিয়ে গেল। ছুটলেন অন্য জায়গায়, সেখানে কিছু তেলাকুচোর চালান এসেছে। কিন্তু তেলাকুচোও কপালে জুটল না। নস্যির জন্য নাকটা সুড়সুড় করছে কখন থেকে। মঙ্গলগ্রহে হাজার হাজার মাইল খাল খোঁড়ার কাজ তদারক করতে করতে অন্য সব কথা খেয়াল থাকে না। অথচ খাঁটি নস্যি এখানে কিনতে পাওয়া যায় না। নীহারিকাপুঞ্জের সবুজ গ্রহে কিছু তামাকের চাষ হয়। সেখান থেকে তাঁর বন্ধু পাড়ুরাম বড় একটা ডিবে এনে দিয়েছিল। দামও পড়ে যায় বিস্তর।

কাঁচা সবজি না পেয়ে জয়রাম টিনের সিল—করা প্যাকে কৃত্রিম খাবার কিনলেন। গিন্নি ভারি রেগে যাবেন। কিন্তু কী আর করা!

ছাদের দিকে এসকেলেটরে উঠছেন এমন সময় দোকলবাবুর সঙ্গে দেখা।

”কী খবর হে? বাসা কোথায় করলে?” দোকলবাবু জিজ্ঞেস করলেন।

”আজ্ঞে আকাশপুরীর তায়েবগঞ্জে। উত্তর রাশিয়ার ঠিক ওপরেই!”

”বাঃ, সে তো খুব ভালো জায়গা শুনেছি। এখন সেখানে জায়গার দাম কত করে বলো তো? আমার মেজো জামাই একটা জায়গা খুঁজছে।”

”আজ্ঞে তায়েবগঞ্জে আর জায়গা নেই। পাশে নতুন একটা কলোনি হচ্ছে। নাম চিউ মিং স্যাটেলাইট টাউনশিপ, সেখানে জায়গা পেয়ে যাবেন। তবে প্রতি ঘনফুট বোধ হয় এক লক্ষ ডলার করে পড়বে।”

”তা পড়ুক। জায়গা পাওয়া গেলেই হল।” বলতে—বলতে দোকলবাবু পকেট থেকে একটা রুপোর কৌটো বের করে এক টিপ নস্যি নিয়ে ‘আঃ’ বলে আরামের একটা আওয়াজ করলেন।

ডিবেটার দিকে অবিশ্বাসের চোখে চেয়েছিলেন জয়রামবাবু। এ যে নিজের চোখকে বিশ্বাস করা যায় না। নস্যি, নস্যি!

”একটু দেবেন? ওই নস্যিটা?”

দোকলবাবু বললেন, ”হ্যাঁ, হ্যাঁ, নাও না। আমার বড় জামাই তো সবুজ গ্রহে বাস করে, সে আমাকে পিপে—পিপে নস্যি পাঠায়। যত খুশি নাও।” বলে দোকলবাবু উঁকি মেরে জয়রামের থলিটা দেখে বললেন, ”শাকসবজি কিছু পেলে না দেখছি!”

জয়রাম পরপর দু’টিপ নস্যি টেনে আরামে নাকের জলে চোখের জলে হয়ে এক গাল হাসলেন। বললেন, ”নাঃ। গিন্নির কাছে আজও বকুনি খেতে হবে।”

ছাদে এসে যে যার যানবাহন খুঁজতে যাবেন, তখন দোকলবাবু বললেন, ”এখনো ঢের সময় আছে। আমার বাড়ি তো কাছেই গ্রিসে। চলো একটু বিশ্রাম করে যাবে।”

নিউইয়র্ক থেকে গ্রিসের দূরত্ব এয়ার কারে মাত্র আধ মিনিট। তাই জয়রামবাবু আপত্তি করলেন না। দোকলবাবু তাঁর এয়ার কারের দরজা খুলে বললেন, ”উঠে পড়ো।”

পুরোনো অ্যাথেন্সের বাইরে দোকলবাবুর ছোট বাড়ি। তবে খুব বড়লোক ছাড়া বাড়িতে কারো বাড়তি জমি থাকে না। দোকলবাবুর আছে। কাজটা বে—আইনিও বটে। দোকলবাবু খুব লুকিয়ে পাঁচিল ঘিরে দশ হাত বাই দশ হাত একটু জমি রেখেছিলেন বাড়ির পিছনে।

জয়রামকে কফি খাইয়ে দোকলবাবু বললেন, ”এসো, তোমাকে তাজ্জব জিনিস দেখাব একটা।” বলে প্রায় হাত ধরে টেনে পিছনের ফালি জমিটায় নিয়ে এলেন জয়রামকে।

জয়রাম থমকে দাঁড়ালেন। বিস্ময়ে থ তিনি।

পৃথিবীতে অতীত কালের মানুষরা মাটিতে কেমিক্যাল সার দিয়ে মাটিকে পাথরের মতো শক্ত আর জমাট করে দিয়ে গেছে। তাতে আর চাষ হয় না, সেচ চলে না, লাঙলই ঢুকতে চায় না। গাছপালা বলে কিছুই প্রায় নেই। ফালতু জমিও নেই যে গাছ লাগানো যাবে। তবে এ কী? দশ বাই দশ হাত জায়গাটায় কচি—কচি ঢেঁকিশাকের মাথা জেগে রয়েছে। কী সবুজ! কী সরস! কী অদ্ভুত!

”ঢেঁকিশাক!” জয়রাম চেঁচিয়ে উঠলেন।

দোকলবাবু তৎক্ষণাৎ তাঁর মুখ চেপে ধরে বললেন, ”উঁহু, শব্দ কোরো না। টের পেলেই বারোটা বাজিয়ে দেবে!”

জয়রাম এবার চাপা স্বরে প্রচণ্ড উত্তেজনায় বলে উঠলেন, ”এ যে ঢেঁকিশাক!”

”ঢেঁকিশাকই বটে। অনেক কষ্টে দশ বছরের চেষ্টায় ফলিয়েছি। নেবে ক’টা? নাও। দাঁড়াও, আমি তুলে দিচ্ছি। খবর্দার, কাউকে বলো না কিন্তু!”

‘আজ্ঞে না না।” বিগলিত জয়রাম বললেন।

”আর শোনো, ওই চিউ মিং স্যাটেলাইট টাউনশিপে আমার জামাইয়ের জন্যে শ পাঁচেক ঘনফুট জায়গা জোগাড় করে দিতে হবে।”

ঢেঁকিশাকের দিকে চেয়ে জয়রাম মন্ত্রুগ্ধের মতো বললেন, ”নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই।”

বারোগাছি ঢেঁকিশাক নিয়ে জয়রাম যখন বাড়িতে ফিরলেন তখনো তাঁর চোখমুখ অস্বাভাবিক সম্মোহিত। বিড়বিড় করে কেবল বলছেন, ”ঢেঁকিশাক! ঢেঁকিশাক!”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *