স্বপ্নের দেশে পঞ্চমী
“মা, মাগো, ওমা বড্ড খিদে পেয়েছে”। মেয়ের ডাক শুনতে পেয়েও না শোনার ভান করে মা একমনে গোবর দিয়ে উঠোন নিকোচ্ছিল।
“মা,বড্ড খিদে, কিছু খেতে দেবে”?
“ঘুম থেকে উঠেই খালি খাই খাই। দেখছিস্ না কাজ করছি”।
“কী করব? কাল রাতে তো কটা শুকনো মুড়ি ছাড়া কিছুই দাওনি। তাই তো খিদের চোটে পেট জ্বালা করছে মা”।
“দাঁড়া দেখি, ঘরে কিছু আছে কীনা”। মা গোবরমাখা হাত ধুতে ধুতে বলল। তারপর ঘরে ঢুকে এ কৌটো, ও কৌটো হাতড়ে কিছুই না পেয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগল ছোট্ট মেয়েটার মুখে কী তুলে দেবে। নিজের ওপর আর তার সোয়ামীর উপর খুব রাগ হতে লাগল ভারতীর। লোকটা বিয়ে করে আর বাচ্চার জন্ম দিয়েই খালাস। রোজগারের কোন চেষ্টাই করতে চায়না। আর যেদিন কিছু হাতে করে আনে তো বাড়ি ফিরেই যেন নবাবের মত মেজাজ। এ সব তবুও সহ্য হত কেননা সে দু’একদিন তবু মেয়েটার মুখে ভাল মন্দ না হোক শাকভাত তুলে দিতে পারত। কিন্তু আজকাল আবার টাকা হাতে আসলেই নেশাভাং করে, জুয়ো খেলে সবটাই উড়িয়ে দেয়। তাই তো ওদের সংসা্রে নুন আনতে পান্তা ফুরানোর অবস্থা। “আহারে! মেয়েটার খিদে লেগেছে। ওকে যে কী দি এখন”।
“মা। ওমা, কই খেতে দাও”। বলতে বলতে পঞ্চমী ঘরে ঢুকল। রাগে, দুঃখে, ক্ষোভে, অভিমানে ভারতী মেয়েকে বলে ফেলল, “এত লোকের মেয়ে মরে তুই মরতে পারিস্ না। তাহলে আমার সব জ্বালা জুড়োয়”।
ফ্যাল ফ্যাল করে মায়ের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে পঞ্চমী ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ছুটতে ছুটতে নদীর ধারে এসে পৌঁছাল। আঁজলা ভরে নদীর জলই খানিকটা খেয়ে নিয়ে নদীর কিনারে চুপ করে বসল। ওর বয়স ৭-৮ হবে। গ্রামের একটা প্রাইমারী স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ে। স্কুলে মিড্ডে মিল প্রকল্পে ছেলেমেয়েদের খেতে দেবার ব্যবস্থা আছে। পঞ্চমী বসে বসে ভাবতে লাগল আগের হেডস্যারের উদ্যোগে ছেলেমেয়েরা পেটভরে কোনদিন ডিমের ঝোল ভাত, কোনদিন খিচুড়ি আর মাছভাজা খেতে পেত। গ্রামের বেশিরভাগ ছেলেমেয়েই খাবার লোভে স্কুল যেত। হেডস্যার তাদের দাঁড়িয়ে থেকে যত্ন করে খাওয়াতেন। পঞ্চমী কিন্তু শুধু খাবারের আশায় স্কুলে যেত না। ওর পড়াশোনা করতে, লিখতে, শিখতে, নতুন নতুন জিনিস জানতে খুব ভালো লাগত। তাই সে কোনদিনই স্কুল কামাই করত না। বাড়ি ফিরেই সে স্যারেদের পড়াশোনা ঝালিয়ে নিত। কিন্তু সেই হেডস্যার অবসর নেবার পর যে হেড দিদিমণি এসেছেন তাঁর খুব মেজাজ। এখন ওদের ভাত, ডাল, আলুসেদ্ধ কিংবা খিচুড়ি ছাড়া কিছুই জোটে না। তা, যাই হোক পেটটা তো সবার ভরতো। কিন্তু হঠাৎ একদিন ষাঁড়াষাঁড়ির বানে নদী ফেঁপে ফুলে উঠে ওদের গ্রামের নদীবাঁধ ভেঙে অনেক বাড়ি ধসে পড়ল। বরাতজোরে ওদের কয়েকটা কুঁড়েঘর রক্ষা পেল। সর্বস্য হারানো ঘরছাড়া মানুষগুলোর মাথা গোঁজার ঠাঁই হল ওদের স্কুলে। তাই খাওয়া দাওয়া, পড়াশোনা সব শিকেয় উঠেছে। আর মায়ের মেজাজ মরজিও যেন বদলে গেছে। হঠাৎ ওর খুব কান্না পেল। ভাবল, মা তো মরতেই বলেছে, তাহলে আজ সে জলে ডুবেই মরবে। কিন্তু মরে যাবার কথা ভাবতেই ওর বুকের ভেতর কেমন একটা কষ্ট হতে লাগল। আবার খুব ভয়ও হল। এখন ও যে কী করে? সাতপাঁচ ভেবেও কুলকিনারা করতে পারল না। হঠাৎ ও অবাক হয়ে দেখল একটা সবুজ রঙের বোতল ভাসতে ভাসতে তার দিকেই এগিয়ে আসছে।
এরকম বোতল আগে কোথায় দেখেছে মনে করার চেষ্টা করল পঞ্চমী। আর তখনই মনে পড়ে গেল ওদের গ্রাম পঞ্চায়েতের ছোট মেয়ে ইভার হাতে এরকম বোতল ও দেখেছিল। সাহস করে কিসের বোতল জানতে চাওয়ায় সে বলেছিল ওটা মিরান্ডা না স্প্রাইট কিসের যেন বোতল। ও ঠিক নামটা মনে করতে পারল না। ভাবল ওর কান্নায় দয়াপরবশ হয়ে কোন দেবদেবী বোধহয় ওকে এই বোতলটা পাঠিয়েছে। বোতলটা কাছে আসতেই পঞ্চমী সেটা ধরে ফেলল। হাতে করে ওপরে তুলে দেখল বোতলের ভেতরে নরমনরম ছোট্ট কোন একটা কিছু নড়ছে। সাহসে ভর করে বোতলটা খুলে ফেলতেই ভুস্ করে ধোঁয়ার মত কুন্ডলী পাকিয়ে কী যেন বেরিয়ে এল। তারপর ও অবাক হয়ে দেখল ওর সামনে একটা বেঁটে বামন দাঁড়িয়ে আছে। বামনটা ওকে বলল, “কীরে, বোতলটা খুললি যে, কী দরকার বল্। ও বলল, “আমার খুব খিদে তেষ্টা পেয়েছে। তাই সবুজবোতল দেখে ভাবলাম ওতে বুঝি কোন ঠান্ডা পানীয় আছে। তাই খুলে ফেলেছি”।
“তুই বুঝি Cold drinks খেতে খুব ভালবাসিস”?
“না-না, আমি জীবনেও ওসব খাইনি। কী করে খাব বলতো? আমরা তো খুব গরীব। বাবা মা আমার ভাতের জোগাড়ই করতে পারেনা। তা আবার পেপসি না স্প্রাইট ওসব কোথা থেকে কিনে দেবে”।
“ঠিক আছে, তুই আমার সাথে চল্। আমি তোকে মিরিন্ডা খাওয়াব”।
“তুমি কোথায় পাবে”?
“চল্ না, দেখি” বলেই বামনটা ওকে কাঁধে তুলে নিয়ে হাঁটতে শুরু করল। তারপর নদীনালা, গ্রাম প্রান্তর পার হয়ে ওরা এসে পৌঁছাল একটা বড় রাস্তায়। একটা ম্যাটাডোরে তখন পিচ্বোর্ডের বাক্স করে কী যেন ওঠানো হচ্ছিল। বামনটার কাঁধের ওপর থেকে পঞ্চমী দেখলে ওগুলো তো Colddrinks এর বোতল। বামনটা চোখের নিমেষে অনেক লম্বা হয়ে গেল। তারপর বাক্স থেকে একটা বোতল তুলে নিয়ে ওকে দিয়ে বলল, “চল, ওদিকটায় যাই। সেখানে গিয়ে মজা করে খাবি”। ওর তো খুব আনন্দ হল। কোনদিন ও এসব খায়নি আজ খেয়ে দেখবে কেমন খেতে। বামনটা বোতলের ছিপিটা খোলামাত্রই বুদ্বুদের মত কী যেন বেরিয়ে এল। ও গলায় খানিকটা ঢেলেই বলল, “ম্যা গো। এ সব লোকে কী করে খায়। কেমন ঝাঁজ। খেতে একটুও ভাল নয়, বিস্বাদ”। এই বলে সে বোতলটা ছুঁড়ে ফেলে দিল।
“চল, তোকে অন্য কিছু খাইয়ে নিয়ে আসি” বলেই লোকটা একটা বড়সড় ঈগল পাখি হয়ে গেল। পঞ্চমীকে পিঠে বসিয়ে উড়তে উড়তে এবার ওরা এল একটা জঙ্গলে। সেখানে অনেক নারকেল গাছ, আমগাছ, আতা গাছ, আরও অনেক ধরণের গাছ। নারকেল গাছ থেকে নারকেল পেড়ে শক্ত ঠোঁট দিয়ে গর্ত করে ওকে দিয়ে বলল, “খেয়ে দেখ, কী মিষ্টি খেতে”। পঞ্চমী খেয়ে দেখল সত্যিই কী অপূর্ব স্বাদ। ওর সমস্ত শরীর যেন জুড়িয়ে গেল। তারপর আতা গাছ থেকে কয়েকটা পাকা আতা ছিঁড়ে এনে ওর হাতে দিয়ে বলল, “পেটভরে এগুলো খেয়ে নে”। বলে ঈগলটা ওকে মাটিতে নামালো। নরম নরম পাকা আতা খেতে খেতে পঞ্চমী জিজ্ঞাসা করল, “তুমি কী বহুরূপী? আমি ছিনাথ বহুরূপীর কথা পড়েছি। ঠিক তারই মতো তুমিও তো দেখছি অনেক রূপ বদল করতে পার”।
“আমার কথা জিজ্ঞাসা না করে তুই তোর দুঃখের কারণগুলো বল্ দেখি”।
“শুনে কী করবে? আমার অনেক দুঃখ। তুমি দূর করতে পারবে না”।
“বলেই দেখ্ । দেখি দূর করতে পারি কিনা”।
পঞ্চমী এক নিঃশ্বাসে ওর দুঃখ দুর্দশার কথা, ওর দুঃখী মায়ের কথা, ওর পড়াশোনা করার আগ্রহের কথা সব বলে ফেলল, এবার বামন বলল, “আমি জিন্। আয় দেখি তোর দুঃখকষ্ট দূর করতে পারি কিনা”। বলে ঈগলবেশী জিন্ ওকে নিয়ে উড়ে চলল কোন্ এক অচিন দেশে। দুপুর গড়িয়ে সুর্য প্রায় পশ্চিমে হেলে পড়েছে। ঠান্ডা হিমেল বাতাস বইতে শুরু করেছে। ওর বেশ শীতশীত করতে লাগল। ও ভাবতে শুরু করল, “কী জানি বাবা, জিন্টা আবার ওকে নিয়ে কোথায় চলেছে। এসব দিকে তো ও আগে কখনো আসেনি। অজানা আশঙ্কায় ওর বুক দূরু দূরু করে উঠল। যাক্গে, যা হবার হবে। ও তো আর এতদূর থেকে একা ফিরতে পারবে না। ধৈর্য্য ধরে দেখাই যাক্ না কী হয়। এই ভেবে ও চুপটি করে ঈগলের গলাটা আঁকড়ে ধরে বসে রইল। হঠাৎ ঈগলটা একটা পাহাড়ের উপর এসে বসল। তারপর ওকে বলল, “তুই এখানে একটু অপেক্ষা কর। আমি যাব আর আসব। ভয় পাস্ না যেন”। বলেই ঈগলটা ধীরে ধীরে নীচে নামতে শুরু করলে। তারপর নিমেষের মধ্যে পিঠে একটা থলে নিয়ে ওপরে উঠে এল। পঞ্চমী সাহস করে জিজ্ঞাসা করলে, “তুমি কোথায় গেছিলে? থলেটাতেই বা কী আছে”?
ঈগল বলল, “আগে তুই আমার পিঠে ওঠ। তারপর থলেটা চেপে ধরে বসে থাক”।
যেতে যেতে ঈগল বলতে শুরু করলে, “আমি ছিলাম একজন বণিক, ব্যবসার কাজে ঘোড়ায় চড়ে অনেক দূর দূর দেশে যেতে হত। একবার হয়েছে কী”-
“কী হয়েছে , তাড়াতাড়ি বলনা”।
ঈগল জানাল, “একদিন এই পাহাড়ের পাশ দিয়ে আমি চলেছি ঘোড়ায় চেপে। যেতে যেতে হঠাৎ নজরে পড়ল একটা গুহা থেকে কতকগুলো ইয়া ষন্ডা মার্কা লোক বেরিয়ে আসছে। দেখেই বুঝলাম ওরা দস্যু। তাই আমি একটা গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়লাম। কিন্তু ওদের মধ্যে একজন আমার ঘোড়াটাকে দেখে ঘোড়ার মালিককে খুঁজতে লাগল। ওদের হাতে ধরা পড়ে গেলাম। গুপ্তধন দেখে ফেলার অপরাধে ওরা আমাকে মেরে আমার আত্মাটাকে একটা বোতলে ভরে পাহাড়ী খরস্রোতা নদীতে ফেলে দিল। সেদিনই আমি প্রতিজ্ঞা করলাম ওদের ওই গুপ্তধন আমি দুঃখী মানুষের দুঃখকষ্ট দূর করতে কাজে লাগাব। এই থলেতে যা মোহর আছে তাতে তোদের সারাজীবনের দুঃখ ঘুচে যাবে”। ঈগল এবার চুপ করল। তারপর তাড়াতাড়ি ডানা মেলে উড়তে উড়তে ওদের গ্রামে এসে পৌঁছে গেল। নদীর ধারে পৌঁছে বলল, “আমি তোদের বাড়ির উঠোনে থলেটা রেখে আসছি। তুই এখানেই অপেক্ষা কর”। চোখের পলকে ঈগল পাখি ফিরে এসে বলল, “এবার আমার কাজ শেষ। তুই আবার বোতলের মুখটা খোল্। আমার আত্মাটা বোতলে ঢুকে গেলে নদীতে ফেলে দিস্। আবার যদি সত্যিকারের কোন দুঃখী লোকের সন্ধান পাই তবে তাকে সাহায্য করার জন্য ফিরে আসব। না হলে এভাবেই ভেসে ভেসে এদেশ থেকে ও দেশে ঘুরে বেড়াব। সমস্ত গুপ্তধন ভালো কাজে শেষ না করা পর্যন্ত আমার মুক্তি নেই। যা- যা বললাম তাই কর। তারপর চট্পট্ বাড়ি ফিরে যা। ভালো থাকিস্। সুখে থাকিস্”। বোতলের মুখটা খোলার সঙ্গে সঙ্গে ঈগল পাখিটা বামনের রূপ ধরল। তারপর ছোট হতে হতে ধোঁয়ার মত ভেতরে ঢুকে গেল। বুকভরা একরাশ কান্নাকে গোপন করে পঞ্চমী বোতলটাকে তার ছোট্ট ছোট্ট দু’হাত দিয়ে জলে ভাসিয়ে দিল।
এদিকে সারাদিন মেয়েকে এখানে ওখানে পাগলের মত খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়ে গেল ভারতী। শেষে হাটফেরতা এক গ্রামবাসীর মুখে খবর পেল যে সে নাকি যাবার সময় পঞ্চমীকে নদীর ধারে দেখেছিল। অজানা আশঙ্কায় বুক কেঁপে উঠল ভারতীর। কী জানি নদীর ধারে গিয়ে কী দেখবে। কোন অঘটন এতক্ষণে ঘটে যায়নি তো। কাঁদতে কাঁদতে ছুটতে লাগল সে। গিয়ে দেখে মেয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। মৃদুমন্দ শীতল বাতাসে তার রুক্ষ চুলগুলো উড়ছে। দু’গাল বেয়ে ঝরে পড়া কান্নার শুকনো দাগ তার মুখে চোখে। ভয়ে ভয়ে মেয়েকে ঠেলতে লাগল ভারতী। আচ্ছন্নের মতো দু’চোখ মেলল পঞ্চমী। তারপর মাকে দেখে অবাক হয়ে গেল সে। মেয়েকে খুঁজে পাবার আনন্দে মা মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, “তোর জন্য মাছভাত রান্না করে রেখেছি। শিগ্গির চল্, খাবি”। পঞ্চমীর কানে যেন কোন কথাই ঢুকছে না। সে ইতিউতি তাকিয়ে সবুজ বোতলটা খুঁজতে লাগল। তারপর কোথাও দেখতে না পেয়ে ভাবল তাহলে এতক্ষণ ওর জীবনে যা যা ঘটে গেল সেগুলো কী নিছকই কল্পনা না অলীক স্বপ্ন? সারাটা পথ একটা কথাও না বলে পঞ্চমী ধীরে ধীরে মায়ের সঙ্গে বাড়ি ফিরে এল।