চোর ধরার গল্প
আজ শুক্রবার। প্রতিটা শুক্রবারের মত আজও বিকালে ঋভু আর রিচাদের বাড়িতে রাই, অর্না, অদ্রিজা, ঋতজা, অবন্তি, শ্রাবন্তী আর রাইয়ের কাকুর ছেলে ঋক এসে জুটেছে। রিচাদের বাড়িটা বেশ বড় আর ড্রয়িংরুমটা তো মস্ত বড় । দামী সোফা, বড় বড় অয়েলপেন্টিং আর সুন্দর সুন্দর শোপিস্ দিয়ে ঘরটা সাজানো। মেঝেতে দামী কার্পেট, এক কোণে দাদানের আমলের দামী সেগুন কাঠের একটা উঁচু টেবিলের ওপর সুদৃশ্য পটে বটগাছের বনসাই। ঘরে হাত পা ছড়ানোর অনেক জায়গা। ওরা সবাই শহরের নামী দামী ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ছাত্রছাত্রী। শনি আর রবি দুদিন স্কুল ছুটি। তাই শুক্রবার সন্ধ্যেটা ওরা সবাই পড়ার ছুটি নেয়। সারা সপ্তাহ ভোরে উঠে স্কুলে যাওয়া, তিনটে, সাড়ে তিনটেয় বাড়ি ফিরে খেয়েই একটু ঘুম। ছটায় উঠেই রুটিন মাফিক গান, আঁকা, এ্যাবাকাস আর স্কুলের হোমটাস্ক করতে করতে ওরা ক্লান্ত। তাই একটা সন্ধ্যা ওরা মুক্তির নিঃশ্বাস ফেলতে এখানে আসে।
নিজেদের মত ওরা গল্পগুজব করে। নিজেদের নিজেদের স্কুলের বন্ধুদের কথা, কোন মিস্ খুব রাগী, কোন্ মিস্ কাকে খুব ভালোবাসেন, আবার কোন মিস্ ক্লাসওয়ার্ক করতে দিয়ে টেবিলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েন, কার কটা বার্বি আছে, কার কোন ক্রিকেটারকে পছন্দ এসবই ওদের আলোচ্য বিষয়।
রিচা রিভুর আম্মা ওদের সবার আম্মা। অন্যান্য দিন টি.ভি. সিরিয়াল দেখার অভ্যাস থাকলেও শুক্রবার টি.ভি. বন্ধ করে সোফায় বসে ওদের আলোচনা শোনেন। কখনও বা কাউকে নাচ, গান অথবা আবৃত্তি করে শোনাতে বলেন। এদিনের সন্ধ্যাটা বাচ্চাদের সাথে কাটাতে তাঁর খুব ভাল লাগে।
আজ অদ্রিজা হঠাৎ বলে উঠল, জানিস আমাদের ক্লাসে একটা চোর আছে।
কী রকম, কী রকম, সবাই সমস্বরে বলে উঠল। অদ্রিজা জানাল, চোরটা না সুযোগ পেলেই সবার ভাল ভাল টিফিন খেয়ে নেয়।
তোরা চোর ধরতে পারিস নি? ঋক বলল।
কী করে ধরব? কখন যে চুপিসাড়ে খেয়ে নেয় বুঝতেই পারি না। ওদের মধ্যে শ্রাবন্তী বয়সে বড়। সে ক্লাস ফাইভে পড়ে। সে বলল। তোদের টিফিন আবার কাক কিংবা বিড়ালে খেয়ে নেয় না তো? ভাল করে নজর করেছিস্?
দূর, তা কী করে হবে? তারা শক্ত করে আটকানো টিফিন বক্সের ঢাকনা খুলবে কেমন করে? জানবেই বা কী করে কে ভাল টিফিন এনেছে? কই রুটি আলুভাজা বা চিঁড়ের পোলাও তো চুরি হয় না? মনজিনিসের ভাল কেক, পিজা, ম্যাগি বা চিকেন চাউমিন আনলেই তা সাবাড় হয়ে যাবে।
এতক্ষণ আম্মা মনযোগ দিয়ে সব শুনছিলেন। উলকাঁটাটা হাত থেকে সরিয়ে এবার বললেন, তাহলে তোদের আজ একটা চোর ধরার গল্প শোনাই। আমার স্কুল জীবনের গল্প।
তোমরা সত্যি সত্যি চোরকে ধরেছিলে? কী করে চোর ধরা পড়ল? বড় বড় চোখ করে অবাক দৃষ্টিতে সবাই জানতে চাইল।
সে অনেক কাল আগের কথা। আমি তখন আজিমগঞ্জের একটা স্কুলে ক্লাস সিক্সে পড়ি। পূজোর ছুটি পড়তে আর দিন পাঁচেক বাকি। আমাদের বড়দি সব ক্লাসে ক্লাসে নোটিশ পাঠালেন আমরা যেন আয়ামাসী, ঝাড়ুদার কাকু এদের জন্য প্রত্যেকে আট আনা করে আনি। বড়দির আদেশ মত আমরা প্রত্যেকে আট আনা পয়সা এনেছি। আমার বাবা কলকাতায় পূজোর বাজার করতে এসে আমার জন্য একটা জ্যামিতির বাক্স কিনে এনেছিলেন। তখন বোধহয় সবে প্লাস্টিকের চল হয়েছে। চাঁদা, স্কেল, ত্রিভূজ এগুলো সব প্লাস্টিকে তৈরি। আমার তো জিনিসটা খুবই পছন্দ। বন্ধুদের দেখাবার জন্য সেই জ্যামিতির বাক্সের মধ্যেই আট আনাটা নিয়ে স্কুলে গিয়েছি। আমাদের এক সহপাঠী রেবার বাড়ি গন্ডগ্রামে। সেখানে বড়দের স্কুল না থাকায় সে মামার বাড়ি থেকে পড়াশোনা করত। স্কুলে আসার পথে সে বোনেদের জন্য চার পাঁচ রঙের কুড়ি গজ ফিতে কিনে নিয়ে এসেছে।
প্রার্থনার ঘন্টা পড়লে আমরা যে যার বইপত্র রেখে নিচে চলে গেছি। প্রার্থনার শেষে ক্লাসে ফিরে গেলাম। রোলকল করার পর শ্রেণী শিক্ষিকা মনিটরকে একটা কাগজ দিয়ে বললেন, পয়সাগুলো আমাদের কাছ থেকে তুলে নিতে। ব্যাগ খুলতে গিয়ে সবারই চোখ কপালে ওঠার অবস্থা। পয়সা সমেত আমার জ্যামিতি বক্স, রেবার কুড়ি গজ ফিতে, কারও দামী পেন সব উধাও। খোঁজ খোঁজ খোঁজ। সবার ব্যাগ খোঁজা হল। কোথাও কিছু নেই। ভাল ভাল জিনিস সমেত প্রায় সবারই পয়সা কর্পূরের মত উবে গেছে। বড়দির কাছে নালিশ জানানো হল। আমাদের সবার মন খুব খারাপ। পড়াশোনায় মন বসছে না।
তারপর কী হল?
চতুর্থ পিরিয়ডের পর টিফিনের ঘন্টা পড়বে। এমন সময় বড়দি ষষ্ঠ শ্রেনীর কোন মেয়েকে বাইরে বেরোতে নিষেধ করে নোটিশ পাঠালেন। আমরা সব চুপচাপ বসে আছি। বড়দি একটা বেত নিয়ে শ্রেনী কক্ষে এলেন।
আমাদের লাইব্রেরী ঘরটা ছিল তিনতলার ছাতে, এককোণে। খুব বড় লাইব্রেরী নয়। ছোট্ট একটা ঘরে দু’তিনটে আলমারী। তাতেই বই রাখা থাকত। আমরা নীচু ক্লাসের মেয়েরা কোনদিন ঘরে ঢুকিনি। উঁচু ক্লাসের মেয়েরা যেত কী না মনে করতে পারছি না। বড়দি বললেন, ওই লাইব্রেরী ঘরের এককোণে টেবিলের ওপরে একটা মন্ত্রপুত হাঁড়ি রাখা আছে। মেয়েরা সব রোল নাম্বার অনুযায়ী লাইন করে ওপরে যাও। মন্ত্রপুত হাঁড়িটায় হাত রাখবে। যে চুরি করেছে মন্ত্রপুত হাঁড়িটা তার হাতটাতে ঘুরতে থাকবে, কিছুতেই খোলা যাবে না। হাঁড়িতে হাত দেবার পর আবার সবাই হাত পিছনে রেখে ফিরে আসবে। চোর ধরা পড়বেই।
রোল নাম্বার অনুসারে আমরা একে একে উপরে উঠলাম। প্রথমেই চোখে পড়ল তিন চারজন দিদিমণি ওপরে সিঁড়ির সামনে থেকে লাইব্রেরী ঘর অবধি দাঁড়িয়ে রয়েছেন। শ্রেণীকক্ষেও একজন শিক্ষিকা ছিলেন সব মেয়ে ঠিকঠাক লাইন করে উপরে উঠে যাচ্ছে কীনা দেখার জন্য। মেয়েরা সব লাইব্রেরী রুমের ঠিক সামনে সার দিয়ে দাঁড়ানো। রোলনম্বর এক হবার সুবাদে আমিই প্রথম সুযোগ পেলাম লাইব্রেরী কক্ষে প্রবেশ করার। ঘরে ঢুকে বেশ গা ছম্ ছম্ করতে লাগল। অন্ধকার ঘুটঘুটে ঘর। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। এককোণে একটা টিমটিমে প্রদীপের আলো জ্বলতে দেখে এগিয়ে গেলাম। টেবিলের উপর কালো কুচকুচে একটা হাঁড়ি। তাতে দুটো চোখ আর বের করা দু’পাটি দাঁতের সারি। দু’পাশে বড় বড় ধূপদানিতে এক গোছা করে ধূপ জ্বলছে। সামান্য আলো আর আঁধারিতে বেশ একটা রহস্যময় পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। সাহস ভরে হাঁড়িটাতে হাত বুলিয়ে বেরিয়ে এলাম। হাতটা পিছনেই রাখা ছিল। শিক্ষিকারা একে একে আমাদের হাত পরীক্ষা করে নীচে নামিয়ে দিলেন। নীচে এসে হাত খুলে দেখি আমার ফর্সা হাত কালো হয়ে গেছে।
এতক্ষণ উদ্গ্রীব হয়ে শোনার পর রাই বলে উঠল, “আম্মা, কে চোর তোমরা জানতে পেরেছিলে?” চোরের হাতটা তো হাঁড়ির সঙ্গে আটকে গিয়েছিল তাহলে সেটা কে খুলে দিল? অর্ণা জিজ্ঞাসা করল, “তোমরা চুরি যাওয়া সব জিনিসপত্র ফিরে পেয়েছিলে?” একসঙ্গে সকলের উৎসুক প্রশ্ন। “চোরটার কী শাস্তি হল? ওকে কী স্কুল থেকে রাস্টিকেট করা হয়েছিল?” সপ্রতিভ ঋদ্ধিমা আকুল কন্ঠে জানতে চাইল।
থামো, থামো এত গোলমাল কোর না। তোমাদের সব প্রশ্নের উত্তর তো একসঙ্গে দেওয়া যাবে না ভাই। তোমরা চুপ্টি করে বোস।
আম্মা উত্তর দিতে শুরু করলেন –
হ্যাঁ, চোর ধরা পড়েছিল। সায়নী নামে যে মেয়েটাকে ধরা হয়েছিল সে অবস্থাপন্ন ঘরের মেয়ে। তার বাবা বড় ব্যবসায়ী। তার ঠাকুর্দা সেখানকার প্রতিষ্ঠিত ডাক্তার। আসলে কী জানো–
আমরা মনে করি অভাবে স্বভাব নষ্ট হয়, কিন্তু সবক্ষেত্রে তা হয়না। মেয়েটার হাতটান রোগ ছিল। কারো কিছু ভাল জিনিস দেখলেই সে আর লোভ সামলাতে পারতো না। নিজের অজান্তেই চুরি করে ফেলত।
না- আমরা আমাদের হারানো জিনিস ফিরে পাইনি। জিনিসগুলো ওযে কোথায় লুকিয়ে ফেলেছিল অনেক জেরা করেও তা জানা যায় নি। চুরি করার কথা স্বীকারই করেনি।
“মেয়ে চোরের হাতটা তো হাঁড়ির সঙ্গে ঘুরছিল, ওর ভয় করে নি?” ঋক বলল।
তাহলে তোদের আসল কথাটা বলি শোন্। চোর ধরার জন্য বড়দি মন্ত্রপূত হাঁড়ির কথা বলে সেটাকে অন্ধকার ঘরে রেখে এক গা ছম্ছম্ করা ভুতুড়ে পরিবেশ সৃষ্টি করেছিলেন। হাঁড়িটার গায়ে পুরু করে কালো আলকাতরা লাগানো ছিল। খড়িমাটি দিয়ে চোখ দাঁত আঁকানো হয়েছিল যাতে আমরা ছোট ছোট মেয়েরা ভয় পাই। আমরা যারা মনে প্রাণে জানতাম চোর নই তারা নির্ভয়ে হাঁড়িতে হাত দিয়েছিলাম। তাতেই আলকাতরা আমাদের হাতে লেগে গিয়েছিল। সায়নী তো মনে মনে জানত যে সে চুরি করেছে তাই হাঁড়িতে হাত আটকে যাবার ভয়ে ওতে হাতই দেয়নি। ফলে ওর হাতে আলকাতরাও লাগেনি। ধবধবে পরিষ্কার হাত ও দিদিদের সামনে মেলে ধরেছিল। আর তাতেই বড়দির অভিপ্রায় পূর্ণ হয়েছিল।
সায়নীর অভিভাবককে ডেকে এনে সব ঘটনা বলা হলে উনি মেয়ের হয়ে আন্তরিক ভাবে ক্ষমা চেয়ে নিলেন। জানালেন যে খুব ছোট বয়স থেকেই মেয়ের হাতটান স্বভাব। মেয়েকে নিয়ে লজ্জায় কোন আত্মীয়স্বজনের বাড়ি যেতে পারে না। অনেক ডাক্তার দেখানো হয়েছিল, তারা বলেছেন সায়নী এক মানসিক রোগের শিকার।
একথা জানার পর তাকে আর শাস্তি দেওয়া হয়নি। স্কুল থেকে বহিষ্কার করাও হয়নি। তবে আমরা, সহপাঠীরা সদা সতর্ক থাকতাম যাতে আর কারোর কিছু চুরি না যায়।
কথায় আছে না – “স্বভাব যায় না মলে” ওর ক্ষেত্রে সেই কথাটা অক্ষরে অক্ষরে মিলে গিয়েছিল। পরে শুনেছিলাম, বড় হয়েও ওর স্বভাব বদলায়নি। বিয়ের পর পরই ও ওর নতুন বরের ড্রেসিং টেবিলের উপর রাখা দামী হীরের আংটি চুরি করেছিল। তারপর আর খবর রাখিনি বা রাখার চেষ্টাও করিনি।