ছোট বলে অবহেলার পাত্র নয়
পাহাড় ঘেরা অসম অঞ্চলের প্রত্যন্ত এক গ্রাম। সেখানে কয়েকঘর গারো উপজাতির বাস। মেষপালন তাদের জীবিকা। সমতল অঞ্চলে সুযোগ সুবিধা মত ফসল ফলানোর চেষ্টাও করে তারা। এই গ্রামের গা ঘেঁষে কুলকুল বেগে বয়ে চলেছে খরস্রোতা এক পাহাড়ী নদী। এই নদীর খাঁজে খাঁজে ছানা পোনা নিয়ে বাস করে ব্যাঙ আর ব্যাঙাচির দল। নদীতে ভেসে আসা পোকামাকড় খেয়ে তারা সুখেই দিন কাটায়। গ্রামের অপর প্রান্তে ঘন জঙ্গল। মাঝে মাঝে জঙ্গল থেকে নদীতে ভেসে আসা সাপের দল তাদের উপর উৎপাত চালায়। তাদের ভয়ে ভেকের দল সদাসন্ত্রস্ত। সাপেদের সামনে পড়ে যাওয়া ব্যাঙেদের জীবিত অবস্থায় টপাটপ গিলে ফেলে তারা। সতর্ক ব্যাঙেরা পাহাড়ের খাঁজে লুকিয়ে পড়ে নিজেদের প্রাণ বাঁচায়। কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরে এক মস্ত বিপদ তাদের সামনে উপস্থিত হয়েছে। ফসলের লোভে হাতির পাল জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসছে। গ্রামের লোকেদের বহু কষ্টে তৈরি করা ফসল খেয়ে, খেত তছনছ করে ফিরে যাবার সময় তারা দলবেঁধে নদীতে জল খেতে আসছে। কোন কিছু টের পাবার আগেই পায়ের তলায় পিষ্ঠ হয়ে অনেক ব্যাঙ মরে যাচ্ছে। এই মহা বিপদ থেকে রক্ষা পাবার জন্য তারা উপায় খুঁজতে লাগল। এক মা ব্যাঙ নিজে পালিয়ে বাঁচতে পারলেও তার ছানারা হাতির পায়ের চাপে শেষ হয়ে গেছে। সন্তান হারা মা ব্যাঙ কাঁদতে কাঁদতে তার স্বামীকে বলল, “তোমরা যদি এর বিহিত করতে না পার আমরা সব মায়েরা একসঙ্গে আত্মঘাতী হব। কেননা সন্তান ছাড়া বেঁচে থাকা বৃথা”। মায়ের চোখে জল দেখে বিগলিত পুরুষ ব্যাঙেদের দল সভা ডাকল। কিন্তু কারোর কোন পরামর্শ ঠিক উপযুক্ত বলে মনে হল না। এক বয়স্ক ব্যাঙ বলল, “আমরা হাতিদের খুব একটা দোষ দিতে পারিনা কেননা ওরা আকারে এত বড় যে নীচের দিকে তাকিয়ে ছোট খাটো প্রাণীদের দেখতে পায় না”। একজন বলে উঠল, “তাহলে আর কী? আমরা যখন ওদের নজরেই পড়ব না তবে সকলে সবংশে মরে যাওয়াটাকেই বিধির বিধান বলে মেনে নিই”। সদ্য সন্তান হারা মা ব্যাঙ জানাল, “আমার মাথায় একটা ভাবনা এসেছে। দেখি সবার হয়ে আমি এর বিহিত করতে পারি কিনা”। সকলে সমস্বরে বলে উঠল। “কী উপায় বের করেছ তাড়াতাড়ি আমাদের জানাও”। মা ব্যাঙ বলল,
“সে রহস্যটা গোপনই থাক্ না। কার্যসিদ্ধি হলেই জানতে পারবে”।
চোখের সামনে সবকটা বাচ্ছাকে এইভাবে প্রাণ হারাতে দেখে মা ব্যাঙ শোকে কাতর হয়ে পড়েছিল। তার আর কোন পিছুটান ছিল না। তাই সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সে পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে পা রেখে অতি সন্তর্পনে অনেকটা উঁচুতে উঠে গেল। সেখান থেকে জঙ্গলটা পরিষ্কার দেখতে পাওয়া যায়। কয়েকদিন অপেক্ষা করার পর একদিন সে হাতির দলকে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসতে দেখল। তাদের আসার পথের ধারে পাহাড়ের উপর এক বড়সড় পাথরের উপর উঠে সে তাদের দলপতিকে ডেকে বলল, “গড় হই মহারাজ! আমি সদ্য সন্তানহারা এক মা ব্যাঙ। আপনাদের অসাবধানতার জন্য আমি আমার সন্তানদের খুইয়েছি। তাই আপনার কাছে আমার এক নিবেদন আছে”। দলপতি বলল, “দেখছিস না আমরা এখন খাবারের সন্ধানে বেরিয়েছি, যা বলার জল্দি জল্দি বলে ফেল”।
মা ব্যাঙ বলল, “আপনারা জাতে কুলে মানে আমাদের থেকে অনেক শ্রেষ্ঠ। তাই আমাদের মত নীচু তলার বাসিন্দাদের নজরেই পড়ে না। তবে আমার বিশ্বাস যে আপনাদের বিশালাকার দেহের মত মনটাও বিশাল। আপনারা যদি আমাদের প্রতি একটু বদান্যতা দেখান তাহলে আমরা সুখে শান্তিতে বাস করতে পারি”। দলপতি শান্তভাবে বলল, “কীভাবে তোদের কোন বিঘ্ন না ঘটিয়ে জলপান করতে পারব জানিয়ে দে”।
মা ব্যাঙ বলল, “আপনারা সত্যই নির্দোষ। আমরাই আপনাদের জলখেতে আসার সময়টা ঠিক বুঝে উঠতে পারি না। তাই মহানুভব আপনারা নদীতে উপস্থিত হবার আগে যদি কোন বিশেষ সতর্কবার্তা আমাদের উদ্দেশ্যে জ্ঞাপন করেন তাহলে কৃতার্থ হই। আর হ্যাঁ, ছোট বলে আমাদের অবজ্ঞা করবেন না প্রভু। কে জানে! হয়তো কখনও বিপদের সময় আমরাও আপনার সহায় হতে পারি”।
দলপতি একটু হেসে জানাল যে, নদীতে আসার অনেক আগে থেকেই তারা একসঙ্গে শুঁড় তুলে ডাকতে শুরু করবে যাতে তারা সতর্ক হয়ে যায়।
দলপতির কথা মত কাজ শুরু হল। মা ব্যাঙ নিশ্চিন্তে নদীতে ফিরে এল। এখন থেকে তারা সন্তান সন্ততিদের নিয়ে সুখে বাস করতে লাগল।
এইভাবে একে একে দিন, মাস, বছর গড়িয়ে গেল। পাহাড়ী অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ এমনিতেই বেশি। কিন্তু এবছর যেন লাগাম ছাড়া বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ব্যাঙেদের খুব আনন্দ। সারাক্ষণ তারা ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ করে গান গেয়ে চলেছে। এমন সময় মা ব্যাঙ তার অনুরোধ মত হাতির দলের সতর্কতামূলক ডাক শুনতে পেল। সে ভাবল, “সর্বনাশ! এখন তো নদীতে হড়্কা বানের সময়। হাতির পালকে সতর্ক না করে দিলে ওরা সব বানের তোড়ে অকূলে ভেসে যাবে। তাই তার পরামর্শে সব ব্যাঙ একযোগে জোরে জোরে ডাকতে শুরু করল। তাদের সেই ডাক শুনে দলপতি নিজে থমকে দাঁড়িয়ে তার দলকে থামতে বলল। তারপর নিজে সেই ডাক অনুসরণ করে নদীর সামনে গিয়ে বিপদ বুঝতে পারল। ছোট্ট বন্ধুদের এই উপকারের কথা সে তার দলের বন্ধুদের জানাল। মনে মনে অসংখ্য ধন্যবাদ জানিয়ে তারা সদলবলে জঙ্গলে ফিরে গেল।