আম্মানের ছোটবেলা
ঋভু আর রিচা দুই ভাইবোন। একজনের সাত আর একজনের চার। দুজনেই শহরের নামী ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ে। আজ পুলকার ধর্মঘট। তাই ওরা স্কুলে যেতে পারেনি। বাড়িতেই রয়েছে।
গ্রীষ্মকাল। প্রচণ্ড দাবদাহে বয়স্ক, যুবক, শিশু এমনকী পশু পাখীদেরও প্রাণান্তকর অবস্থা। গাছের পাতাগুলো একটুও নড়ছে না, মনে হয় ওরাও ধর্মঘট করেছে। মাঝে দুদিন কালবৈশাখীর ঝড় উঠেছিল, বেশ খানিকটা শিলাবৃষ্টি সমেত ভারী বৃষ্টির দেখা মিলেছিল। কিন্তু আবার যে কে সেই। আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বৃষ্টির ছিটেফোঁটার আভাস মাত্র মিলছে না। বয়স্ক ও শিশুরা অসুস্থ হয়ে পড়ছে। এই রকম পরিস্থিতিতে বেমক্কা ছুটি মিলে যাওয়ায় বাড়ির সবাই খুশি। মা বাচ্চাদুটোকে চিঁড়ে দই দিয়ে প্রাতরাশ করিয়ে দোতলার শোবার ঘরে পাঠিয়ে দিয়েছেন এ.সি. চালিয়ে অ্যাবাকাস করতে। পাশের ঘরে আম্মা স্নান সেরে জপ করছেন। হঠাৎ নাতি নাতনীদের হৈ চৈ শব্দে উঠে এলেন। দরজা খুলে ওদের দুজনকে দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “হ্যাঁরে, তোরা এখানে কী করছিস, স্কুলে যাস্নি”?
ঋভু অবাক হয়ে বলল, “ও-মা, তাও জানো না। আজতো গাড়িই আসেনি। স্কুলে যাব কী করে”?
আম্মা কারণ জিজ্ঞাসা করার আগেই ছোট্ট রিচা চট্পট্ জবাব দিল, “কী করে আসবে শুনি। পেট্রোল ছাড়া তো আর গাড়ি চলবে না, তাই”।
“তুই জানলি কী করে”?
“কেন, নিলয়কাকু, দেবাশীষকাকু, কল্যাণকাকুরা তো বলাবলি করছিল সরকার কথা রাখেনি, আবার পেট্রোল এর দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। গরীব মানুষগুলোর কথা ভাবল না অথচ মুখে পরিবর্তনের কত বুলিই না বলেছিল”।
রিচার মুখে এই সব পাকা পাকা কথা শুনে আম্মা তো হতবাক্ হয়ে গেলেন। বললেন, “বুঝেছি, তোমায় আর বলতে হবে না”।
আম্মার গম্ভীর মুখ দেখে ঋভু সাহস করে বলল, “আম্মা এখন তুমি কী করবে গো? এখন তোমার কী কোন কাজ আছে”?
“কেন”?
“আমাদের কাছে একটু বোসো না আম্মান, একটু গল্প করি”।
আম্মা বুঝতে পারলেন সুযোগ পেয়েই গল্পের পোকা বাচ্চা দুটো এখনই গল্প শোনার আবদার জানাবে। তাই বললেন, “তোমরা ততক্ষণ মা যে কাজগুলো দিয়েছেন চট্পট্ সেরে ফেলো। আমি মুখে কিছু একটা দিয়ে, পান জর্দা খেয়ে আসছি। ঝগড়া করবে না। আমি যাব আর আসব”।
গল্প শোনার প্রবল আগ্রহে ওরা তাড়াতাড়ি অ্যাবাকাসের টাস্কগুলো শেষ করতে লাগল। আম্মা ঘরে ঢুকে দেখলেন ওরা মনযোগ দিয়ে কাজ করছে। তাই আম্মানের ফিরে আসা ওরা টেরই পেল না।
হাতের কাজ শেষ হওয়া মাত্রই দু’ ভাই বোনে বলে উঠল, “তোমার মুখে তো অনেক গল্পই শুনেছি কিন্তু আজ আমরা তোমার ছেলেবেলার গল্প শুনব”।
“ছোটবেলার কথা কী আর মনে আছে ভাই। সে সব কত দিন আগের কথা” আম্মা জানালেন।
সপ্রতিভ রিচার উত্তর “আমার তো ছেলেবেলার সব কথাই মনে আছে”।
আম্মা মনে মনে ভাবতে লাগলেন চার বছরের এক শিশুর আবার ছোটবেলা। তবুও বললেন, “তাই বুঝি? কী কী কথা মনে আছে বলতো”?
এবার রিচা গম্ভীর ভাবে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল, “বলতো দেখি, আমি প্রথম কোন্ কথা বলতে শিখেছিলাম”?
“জানি না তো”?
“ওমা, তাও জান না। গুন্ডা”।
ঋভুও চুপ করে থাকার পাত্র নয়। সে বলে উঠল, “বল্তো দেখি ছেলেবেলায় আমি কেমন করে দোতলায় উঠে আসতাম”?
আম্মা আর ঋভু কিছু বলার আগেই রিচা জানাল, “দাদা, তুই তো হামা দিয়ে দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে আসতিস্, তাই না”?
“তুই কী করে জানলি”?
“তোর অন্নপ্রাশনের ক্যাসেট দেখে”।
আম্মা বললেন, একদম জন্ম থেকে বড় হওয়া অবধি সবকিছুই তোমরা মনে রাখতে পার কেন বলতো? এখন যুগের পরিবর্তন হয়েছে। অ্যালবাম, ডি.ভি.ডি ক্যাসেটে তোমাদের বিভিন্ন বয়সের নানান ছবি, অন্নপ্রাশন, জন্মদিন, পৈতে, বিয়ে এমনকি দেশ ভ্রমণের সব অনুষ্ঠানের ছবিই ক্যাসেটবন্দী করে রাখা হচ্ছে। তাই তোমরা মাঝে মাঝে সেগুলো দেখে ছোটবেলার স্মৃতি মনে রাখতে পার। কিন্তু আমাদের সময় তো সে সুযোগ ছিল না ভাই। তাই দেখতে হবে স্মৃতির পর্দায় কোন্ কোন ছবি ভেসে ওঠে।
ঋভু বলল, “স্মৃতির পর্দা হাতড়ে দেখ না আম্মান্ ছোটবেলার কোন কোন কথা তোমার মনে পড়ে”?
“আর দেরী কোর না আম্মান্, চট্পট্ বলতে শুরু করো” উৎসাহে টগবগ করে ফুটতে ফুটতে বলে উঠল রিচা।
আম্মা শুরু করলেন। একদম শিশুকালের কথা আমার মনেই পড়ে না। তবে চারপাঁচ বছর বয়সের স্মৃতি আমার মনের মণিকোঠায় এখনও সযত্নে রাখা আছে। বাবা রেলে চাকরী করার সুবাদে আমরা অনেক জায়গায় থেকেছি। তার মধ্যে আমার শৈশব কেটেছিল ব্যান্ডেলে আমবাগান কোয়ার্টারে’’।
হঠাৎ ঋভুর প্রশ্ন, “সেটা কোথায় গো আম্মান্”?
“হুগলী জেলায়”।
এবার রিচার পালা। সে বলল, “কোয়ার্টার মানে তো থাকার জায়গা। কিন্তু আমবাগান নাম হয়েছে কেন? ওখানে বুঝি অনেক আমগাছ ছিল”?
“হ্যাঁ, আমরা যেখানে থাকতাম সেখানে সর্বসাকুল্যে তখন দশ বারোটা কোয়ার্টারস ছিল। আর চারপাশে ছিল অসংখ্য আমগাছ। উঠোনের বিশাল আমগাছটার আমগুলো আকারে ফজলি আমের মত। হলুদ রঙের গাছপাকা আম কিন্তু অসম্ভব টক। তাই আমার মা কাঁচা আম ভাইকে দিয়ে পাড়িয়ে এনে আচার বানাতেন আর পাকা আম দিয়ে আমসত্ত্ব বানিয়ে রাখতেন। আমরা ভাইবোনে দুপুরবেলা চুরি করে সে সব খেতাম। আমার থেকে এক বছরের ছোট ভাই, কতই বা বয়স? পাঁচ কী ছয় হবে। সেই বয়সেই গাছে ওঠায় ওস্তাদ। হনুমানের মত তড়তড়িয়ে গাছে উঠে যেত। একবার হয়েছে কী-একটা গাছের মগডালে উঠে প্রচুর আম ছুঁড়ে ছুঁড়ে নীচে ফেলেছে আর পছন্দসই আম নিজের পকেটে পুরেছে। এবার নামার পালা। বারবার নীচে নামতে চেষ্টা করতে লাগল কিন্তু কিছুতেই না পেরে তারস্বরে কান্না জুড়ে দিল। আমরা তো ভয়ে কাঠ। যদি নামতে না পারে তাহলে কী হবে ভেবে কূল কিনারা না পেয়ে সাহায্যের জন্য চিৎকার শুরু করে দিলাম। আবাসনের শেষ প্রান্তে ছিল নেপালী পুলিশদের আবাসন। হৈ হট্টগোল শুনে সেখান থেকে একজন ছুটে এল। তারপর গাছে উঠে ওকে পিঠে তুলে নিয়ে ধীরে ধীরে নীচে নেমে এল। আমরা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম।
ঋভু আর রিচা এতক্ষণ চোখ বড়বড় করে শুনছিল। এবার উদ্গ্রীব হয়ে জিজ্ঞাসা করল, “নীচে এসে ভাইদাদু কী করল”?
“কি আর করবে”? খানিক্ষণ চুপ করে বোকার মত দাঁড়িয়ে রইল। তারপর বীরত্ব ফলিয়ে বলল, “তোদের কেমন ভয় পাইয়ে দিলাম বল্। যে গাছে উঠতে পারে সে নামতে পারবে না এ আবার কখনও হয় নাকী? আমি তো ইচ্ছে করেই নামছিলাম না”।
“তাহলে কাঁদছিলি কেন”? পাশের বাড়ির সুভাষের প্রশ্নের জবাবে বলল, “সবটাই নাটক”।
আম্মা থামতেই ওরা দুজনে বলে উঠল, “আচ্ছা আম্মান্, গাছ থেকে আম পড়লে তোমরা কুড়োতে যেতে”?
“যেতাম না আবার! ঝড় উঠলে লন্ঠন কিংবা টর্চ জ্বেলেই অন্ধকারে চলত আম কুড়োনোর ধূম। জামার কোঁচড়ে করে আম কুড়িয়ে বাড়ি ফিরতাম। বাবা জানতে পারলে খুব বকা দিতেন। একবার কী হয়েছে বলি শোন্–
সেদিন সকাল থেকেই আকাশের মুখটা ভারভার। বিকাল বেলাতেই অকাল রাত ঘনিয়ে এল। কালবৈশাখীর ঝড় শুরু হল, আর মাঝে মাঝে বিদ্যুতের ঝলকানি। আমি, আমার ভাই আর ছোট মামা মহানন্দে আম কুড়োতে বেরিয়ে পড়লাম। দমকা বাতাসে গাছের ডালপালা ভেঙে পড়ছে। ধূলোর ঝড়ে আমাদের চোখ মুখ ঢেকে যাচ্ছে। সঙ্গের হাত লন্ঠনটা হঠাৎ নিভে গেল। অন্ধকারে কিছুই ঠাহর হয় না। তাও আমরা হার না মানা মনোভাব নিয়ে টর্চের আলো আর বিদ্যুতের ঝলকানিতে আম কুডিয়ে সঙ্গে আনা থলেতে ভরতি করতে লাগলাম। হঠাৎ আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে শুরু হল বৃষ্টি। বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটায় গাছের নীচে দাঁড়িয়েও আমরা ভিজে জবজবে হয়ে গেলাম। অকালবর্ষণ তার সঙ্গে ঝড়ো হাওয়ায় আমাদের শীত করতে লাগল। বেশ খানিকক্ষণ পরে বৃষ্টি ধরে এলে আমরা ছুট্টে বাড়ি ফিরে এলাম। ভাগ্য ভাল সেদিন নাইট ডিউটি থাকায় বাবা বাড়ি ছিলেন না বলে বকার হাত থেকে বেঁচে গেলাম। আমাদের ঐ অবস্থায় দেখে মা তাড়াতাড়ি করে ভিজে জামা ছাড়িয়ে গা মাথা মুছিয়ে দিয়ে গরম গরম গ্লাস ভরতি দুধ খেতে দিলেন। চাঙ্গা হতে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি রাত সাড়ে নটা বাজে।
ঝড়ে অনেক উঁচু থেকে আম পড়ত বলে বেশির ভাগ আমই ফেটে যেত। মা সেই সব আম থেকে বেছে নিয়ে কিছু আম কেটে নুন হলুদ মাখিয়ে আমতেল করার জন্য রোদে দিতেন। কিছু আমের চাটনি বানাতেন আর বেশি ফেটে যাওয়া আমগুলোর খোসা ছাড়িয়ে সরষে, কাঁচালঙ্কা দিয়ে বেটে নুন আর সরষের তেল দিয়ে যে আমবাটা বানাতেন তার স্বাদ এখনও জিভে লেগে আছে। শুধু আম কেন, সজনে ফুল কুড়িয়ে আনা, শিউলি ফুল, বকুল ফুল তুলে মালা গাঁথা এ সবের জন্যও যে কত কানমলা, বকা খেয়েছি তার ঠিক ঠিকানা নেই। মনে মনে দোষারোপ করে বাবাকে বলতাম, “বুড়ো মানুষ এসবের আনন্দ তুমি আর বুঝবে কেমন করে? শহুরে মানুষ, আমাদের মত তো আর গ্রামে থাকো না তাই তুমি এ রসে বঞ্চিত”।
ঋভু হঠাৎ বলে বসল। “আচ্ছা, আম্মান্ তোমার বাবা বুঝি বুড়ো ছিলেন”?
“দূর বোকা! তা হবে কেন? আসলে আমরা তো তখন খুব ছোট তাই লম্বা চওড়া বাবাকে দেখে বুড়ো ভাবতাম”।
“আচ্ছা, আম্মান্ তুমি বুঝি স্কুলে যেতে না”?
“কেন”? আম্মা অবাক বিস্ময়ে বললেন।
“না এমনি বলছি। এত মজা করে ফুল পাড়তে, আম কুড়োতে যেতে তাই”। রিচা বলল।
ঋভু সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, “আম তো গ্রীষ্মকালে হয় আর তখন তো ‘সামার ভ্যাকেশন’ চলে তাই না আম্মান্।
আম তো গ্রীষ্মে পাকে, তার অনেক আগেই ফাল্গুন, চৈত্র মাসে কাঁচা আম বড় হয়, চোত বোশেখে কালবৈশাখীর ঝড় উঠলে আমরা কাঁচা আম কুড়োতাম”।
“ ‘সামার ভ্যাকেশন’ তো হয়, মে জুন মাসে তাহলে চৈত্র বৈশাখ বলতে ইংলিশে কোন্ মাস হয় গো”? ঋভু মাথা চুলকোতে চুলকোতে অপ্রতিভভাবে জিজ্ঞাসা করল।
আম্মা একটু হেসে বললেন, একদম মনে ছিল না ভাই যে তোমরা বাংলা মাসের নাম বুঝতে পারবে না। ইংরাজী নামের সঙ্গেই তোমাদের বেশি পরিচয়। চোত্ বোশেখ বলতে ইংরাজীর মার্চ, এপ্রিল, মে মাসকে বোঝায়।
রিচা বলল, “রবি ঠাকুরের জন্মদিন তো ২৫ শে বৈশাখ। আমরা স্কুলে মে মাসের আট তারিখে রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন করি, ঠিক বললাম তো”?
আম্মা বলতে লাগলেন, ‘‘তোমাদের মত আড়াই, তিন বছর বয়সে আমরা স্কুলে যাই নি ভাই। সারাদিন ভাইবোন, বন্ধুদের সঙ্গে মস্তি করেছি, লুকোচুরি খেলেছি, পুতুল খেলায় মেতেছি আর সন্ধ্যাবেলা বাবার কাছে অ-আ-ক-খ, এ-বি-সি-ডি শিখেছি, মুখে মুখে শুনে বাংলা ছড়া, ইংরাজী রাইমস্ মুখস্ত করেছি। সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশে কীভাবে স্বাধীনতা এল, বীর শহীদদের আত্মত্যাগের কাহিনী, গান্ধীজী, নেতাজীর জীবনের গল্প জেনেছি। তাছাড়া রামায়ণ, মহাভারত, রামকৃষ্ণ, সারদা মা, বিবেকানন্দ, বিদ্যাসাগর, জাতকের গল্প – কখনও মা, তবে বেশির ভাগ সময় বাবার কাছেই শুনে শুনে মনে রাখার চেষ্টা করেছি’’।
‘‘তোমাদের ছোটবেলাটা তো খুব আনন্দের ছিল। বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে কেমন খেলতে, মজা করতে, বাবা মায়ের মুখে কত গল্প শুনতে। আর আমরা তো খেলতেই পাই না’’।
আম্মার এবার একটা দীর্ঘ নিশ্বাস পড়ল। মনে মনে ভাবতে লাগলেন সত্যি এখনকার ছোট ছোট শিশুগুলোর শৈশব পড়াশোনা, স্কুল, অ্যাবাকাসের অংক, সাঁতার, ড্রইং, নাচ গানের তালিম এসবের চাপে একেবারে হারিয়ে গেছে। তারা সব এক একটা ক্ষুদে রোবটে পরিণত হয়েছে। ওদের আনন্দ শুধু সময় পেলে টি.ভি. তে কার্টুন ফিল্ম দেখা আর মাঝে মাঝে মায়ের স্মার্ট ফোন চুরি করে গেমস খেলা। একটু যে ছুটোছুটি করে খেলবে তার জায়গা কোথায়? মাঠই তো নেই। বিশাল বিশাল ফ্ল্যাট বাড়ির আড়ালে ওদের শৈশবের আনন্দ হারিয়ে গেছে।
আম্মাকে অন্যমনস্ক দেখে রিচা বলল,”তোমাদের অনেক ভাল ভাল পুতুল ছিল তাই না”?
“না-না তোমাদের মত এত দামী দামী খেলনা সফট্ টয়, টেডিবিয়ার, বার্বিডল আমাদের ছিল না”।
“তাহলে তোমাদের কী ধরণের খেলনা ছিল”?
“আমাদের সময় মাটির, চীনা মাটির আর আলুর (প্লাস্টিক) পুতুল ছিল। আর ছিল চা খেয়ে ফেলে দেওয়া মাটির ভাঁড়, ইতু পূজোর ঘট। তবে তোমরা অনেক খেলনা পাও বলে অযত্নে ফেলে রাখ, দম দেওয়া পুতুল, গাড়ির অর্ধেকই ভেঙ্গে নষ্ট করে ফেল। কিন্তু আমরা এসব যত্ন করে রেখে দিতাম”।
“এমা! লোকেদের ফেলে দেওয়া এঁটো ভাঁড়, ঘট কুড়িয়ে আনতে তোমাদের ঘেন্না করত না” রিচার প্রশ্ন।
“দূর বোকা! কুড়িয়ে আনব কেন? তখন তো সবে ইলেকট্রিক ট্রেন চালু হয়েছে। তাই চেপে আমরা প্রায়ই কলকাতায় মামাবাড়ি আসতাম। তখনকার দিনে সুন্দর সুন্দর শেপের মাটির ভাঁড়ে চা বিক্রি হত। বাবা মা যখনই চা খেতেন চোখের ইশারায় মাকে সেগুলো রেখে দিতে বলতাম। বাবার আড়ালে মা সেগুলো লুকিয়ে আমাদের জন্য রেখে দিতেন। আর ইতুপূজোর ঘট তো মামার বাড়িতেই পেতাম। তখন বাড়ির মেয়েরা সকলেই ইতুপূজো করত যে। দিদিমা কুমোরটুলি ঘাটে গঙ্গাস্নান করতে গিয়ে আমাদের জন্য মাটির রাজারানি, রাজপুত্র, রাজকন্যা, রান্নাবান্নার বাসন কোশন, পুতুলের শোবার খাট, তোষক, বালিশ কিনে আনতেন। খেলনাবাটির সময় বনফুলের বীজকে ডিম বানাতাম, মিছিমিছি শাকসবজী কুড়িয়ে আনতাম। কী যেন একটা গাছের পাতার লুচি বানাতাম এখন আর মনে পড়ছে না। আবার অনেক সময় মায়ের আড়ালে আটামাখা থেকে একটা গোলা চুরি করে এনেও খেলনাবাটির চাকীবেলনায় বেলে রুটি বানাতাম। তখন তো এখনকার মত মাটির অভাব ছিল না তাই নিজের হাতে থালা, গেলাস, বাটি, পুতুল বানিয়ে উনুনের নিভুনিভু আঁচে পুড়িয়ে নিতাম।
মামাবাড়িতে এলে আমাদের খুব মজা হোত। তখন সন্ধ্যে হলে পাড়ায় পাড়ায় গোলাপছড়ি, বুড়ির চুল, মাংসের ঘুগনি, কুলপি মালাই নিয়ে পসারিরা আসত। কেউ কেউ আবার বেল কুঁড়ি, জুঁইয়ের মালাও আনত। দু’পাঁচ দিনের জন্য আসতাম তো তাই দাদুর কাছে আবদারেরও দরকার ছিল না। আমাদের যার যেটা পছন্দ দাদু নিজেই কিনে দিতেন।
তোমরা তো এখন ক্যাডবেরিস, এক্লেয়ারস খেতে ভালবাসো। আমাদের সময় পাওয়া যেত কীনা জানিনা। তবে মামার বাড়ির দু’তিনটে বাড়ির পরেই ছিল লজেন্সের কারখানা। সেখানে গিয়ে দাঁড়ালেই একটা তামার পয়সার বিনিময়ে গরম গরম লজেন্সের টুকরো আমাদের হাতে চলে আসত। তার যে কী স্বাদ তা তোমাদের বোঝাতে পারব না।
একবার লুকোচুরি খেলতে গিয়ে কী হয়েছিল বলি শোন। বন্ধুবান্ধবরা যে যার পছন্দমত জায়গায় লুকিয়ে পড়েছে আর আমি একটা ঝাঁকড়া আমগাছের আড়ালে লুকিয়ে আছি। হঠাৎ নজরে পড়ল একটা মস্ত বড় মাটির ঢিবি। এক ছুট্টে মাকে ডেকে এনে দেখাতে মা বললেন ওটা হল বল্মীক-যার মানে উইয়ের ঢিবি। ওর ভেতরে অসংখ্য উইপোকা বাসা বানিয়েছে। রত্নাকর দস্যু ধ্যানে বসলে তার চারপাশে এরকম বল্মীকে ঢেকে গিয়েছিল বলেই তাঁর নাম হয়েছিল বাল্মিকী। আমি অবাক হয়ে ভাবছিলাম রামায়ণের রচয়িতা বাল্মিকীর কী এভাবেই পুনর্জন্ম হয়েছিল?
এতক্ষণ দুজনেই চুপচাপ গল্প শুনছিল। এবার জিজ্ঞাসা করল, “তুমি কবে স্কুলে গিয়েছিলে’’।
আম্মা জানালেন, “আমরা দু’ভাই বোনে ‘ব্যান্ডেল ইনস্টিটিউট’ নামে একটা স্কুলে বাবার সঙ্গে ক্লাস থ্রিতে ভর্ত্তি হতে গিয়েছিলাম। ভর্ত্তি পরীক্ষা দিতে গিয়ে একটা ঘটনা ঘটেছিল।
“কী ঘটনা বলনা আম্মান্” দু’জনেই বলে উঠল।
আম্মা বলতে শুরু করলেন-বাবা আমাদের আগেই বলে রেখেছিলেন যে স্কুলের প্রিন্সিপ্যাল খুব কড়া ধাঁচের মানুষ, গম্ভীর প্রকৃতির। অফিসে ঢুকে প্রথমেই তাঁকে প্রণাম করে আমরা যেন শান্তভাবে তাঁর সব কথার যথাযথ উত্তর দিই। বাবার কথামত আমরা তাঁকে প্রণাম করলাম। তিনি আমাদের দিকে তাকিয়ে প্রথমে নাম জিজ্ঞাসা করলেন। তারপর রাশভারী গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, “শট্কে জানিস”? আমরা ভয়ে ভয়ে জানি না বলায় তিনি বললেন তাহলে তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্ত্তি হতে এসেছিস্ কেন? এগুলো তো ছোট ছোট বাচ্চারাও জানে। বাবা একটু অপ্রতিভভাবে বললেন, “তোমরা শতকিয়া, গন্ডাকিয়া, কড়াকিয়া জানো না? শতকিয়াকেই উনি শট্কে বলছেন”।
এরপর উনি আমাদের এ সব বিষয় প্রশ্ন করলে ভয়ে ভয়ে আমরা তাঁর সব প্রশ্নের উত্তরই যথাযথ দিলাম। এবার দু’জনকে দুটো শ্লেটে যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ করতে দিলে আমরা চট্পট্ করে ফেললে উনি খুব খুশি হয়ে আমাদের ভরতি করে নিলেন। কিন্তু এত বয়সেও তাঁর সেই বাঁজখাই গলার আওয়াজ আমার কানে ভেসে আসে।
এবার দুজনেই সমস্বরে বলে উঠল, “তোমরা কীসে করে স্কুলে যেতে? স্কুলবাস না পুলকার”?
আম্মা জানালেন তখনকার দিনে মফস্বল শহরে স্কুলবাস, পুলকার নিদেন পক্ষে রিকশার প্রচলন ছিল না বললেই চলে। তাই আমরা পা গাড়িতেই যেতাম। স্কুল যাওয়া আসা ছিল তেঁতুলতলা দিয়ে। বাড়ি থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়ে থাকা পাকা তেঁতুল কুড়িয়ে স্কুল যেতাম আবার ফিরতি পথেও তেঁতুল নিয়ে আসতাম। মা সেগুলো কেটে, বীজ ছাড়িয়ে তেল মাখিয়ে রোদে শুকিয়ে রেখে দিতেন। তেঁতুল কুড়োনোর উত্তেজনায় কোনও দিনই স্কুল কামাই করতাম না।
পড়া না পারলে, হোমওয়ার্ক করে না নিয়ে গেলে তোমাদের শাস্তি দেওয়া হত? এই প্রশ্নের উত্তরে আম্মা জানালেন, আজকালকার দিনে তো শাস্তি দেওয়া উঠেই গেছে। শাস্তি দিলেই তো তা খবরের কাগজের শিরোনামে চলে আসে। থানা, পুলিশ, স্কুল ঘেরাও, শিক্ষক শিক্ষিকাকে হেনস্থা সবই করা হয়। তখন কিন্তু রীতিমত শাস্তি দেওয়া হত। নীল ডাউন, কানধরে ওঠবোস, গাঁট্টা খাওয়া, চড় চাপ্পড়, বেতের বাড়ি খাওয়া, বেঞ্চের ওপর দাঁড়ানো এসব তো ছিল নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। একদিন তো চতুর্থ শ্রেণীর একটা ছেলেকে ইংরাজীর শিক্ষক বেত দিয়ে বেধড়ক পিটিয়েছেন। মার খেয়ে ছেলেটা তো অজ্ঞান হয়ে গেল। তাড়াতাড়ি চোখে মুখে জল ছিটিয়ে জ্ঞান ফিরলে তাকে স্থানীয় হাসপাতালে ভর্ত্তি করাতে হল। শিশির স্যার তো দু’বেলা তাকে দেখতে যেতেন। সুস্থ হয়ে স্কুল ফিরলে সবাই লক্ষ্য করলাম সে স্যারের খুব অনুগত হয়ে গেছে। আর স্যারও তাকে অন্যদের চেয়ে বেশি স্নেহের চোখে দেখছেন।
“অভিভাবকরা এসে কমপ্লেন করেনি” ঋভু জিজ্ঞাসা করল। প্রশ্নই ওঠে না বরং ছেলেটির অভিভাবক এসে বলেছিলেন, বেতের ঘা না খেলে ছেলে মানুষ হয় না। নিশ্চয়ই আমাদের ছেলে এত বড় অন্যায় করেছিল যে স্যার শাসন করতে বাধ্য হয়েছেন।
আসলে কী জানতো, তখন আমরা শিক্ষক শিক্ষিকাদের গুরু হিসাবে মান্য করতাম। তাঁদের প্রতি আমাদের ভয় মিশ্রিত শ্রদ্ধা, ভালবাসা ছিল। তাঁরাও আমাদের নিজের সন্তানের মত ভালবাসতেন, স্নেহ করতেন। পারস্পরিক শ্রদ্ধা ভালবাসা দিয়ে মানুষ হতাম বলে আমরা বাধ্য, বিনীত, সত্যিকারের মানুষ হতে পারতাম। এখনকার বেশির ভাগ ছেলেমেয়ের মত অবাধ্য, দুর্বিনীত, স্বার্থপর হতে শিখিনি।
“আচ্ছা, আম্মান তোমরা স্কুলে শিক্ষকদিবস, স্বাধীনতা দিবস, রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন করতে”? ছোট্ট রিচা জানতে চাইল।
“তোমার বাবা, মা, ভাইবোনেদের কথা কিছু বলবে না আম্মান্” ঋভু বলল।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আম্মা বললেন, ‘‘আজ থাক্, কথায় কথায় অনেক বেলা হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি খেয়ে নেবে চল। আমার ঘটনাবহুল জীবনের ইতিহাস তোমাদের আবার একদিন সময় পেলে জানাব’’।