তাথৈ আর তার ছোট্ট বন্ধু
রবিবারের এক সকাল। শীত যাই যাই করে বসন্তের সমাগম ঘটেছে। চারদিক কুয়াশায় ঢাকা। সূয্যিমামা তখনও তার আলস্য কাটিয়ে উঠতে পারেনি। মেঘের সাথে তার লুকোচুরি চলছে। চারদিক থেকে ভেসে আসছে নাম না জানা ফুলের সুবাস। দূরে কোথাও কোন এক গাছে বসে কোকিল তার কুহুতান ধরেছে। তাথৈ তার বিছানায় উঠে বসল। ছুটির দিন। স্কুল যাবার তাড়া নেই। তাই গুটি গুটি পায়ে সে তার আম্মার ঘরের দিকে গেল। উঁকিঝুঁকি মেরে আম্মাকে খোঁজার চেষ্টা করল। আম্মাকে তার ঘরে দেখতে না পেয়ে তাথৈ সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে এল। সদর দরজা খোলা পেয়ে সে সামনের বাগানটার দিকে এগোল। আম্মার ফুল গাছের খুব শখ। বাড়ির সামনের একটুকরো জমিতেই অনেক যত্ন করে টগর, বেল, নানান রঙের জবা, হাসনাহানা ও আরও অনেক ফুলের গাছ লাগিয়েছেন। নিজে হাতেই গাছের পরিচর্যা করেন। ছাতেও টবে অনেক বাহারি গাছ। আম্মা যখন গাছে সার দেন, আগাছা পরিষ্কার করেন তাথৈ তাঁকে সাহায্য করে। সে দেখল আম্মা গান গাইতে গাইতে পূজোর ফুল তুলছেন। তাথৈ অবাক হয়ে আম্মার গান শুনছিল। সাতসকালেই আম্মার চান সারা। এক রাশ কাঁচা পাকা চুল কোমরের কাছে ঝুলছে। কপালে বড় টিপ। লাল পাড় গরদের শাড়ি পরা আম্মাকে দেখে তাথৈ ভাবছিল তার আম্মা এখনও কত সুন্দর। হঠৎ আম্মার চোখ পড়ল তাথৈ এর দিকে। বললেন, “কিরে, সাত তাড়াতাড়ি উঠে পড়লি যে, মুখ ধুয়েছিস? যা,যা, হিম পড়ছে। গায়ে একটা হালকা কিছু দিবি চল্”। আম্মা ও তাথৈ দুজনে হাত ধরাধরি করে ওপরে উঠে এল। হাতমুখ ধুয়ে, দুধ কর্ণফ্লেক্স খেয়ে তাথৈ দেখল আম্মা পূজোয় বসেছেন। তাই ও সবার অলক্ষ্যে নীচের বাগানে একলা একলা ঘুরতে লাগল। হঠাৎ কুকুরের ডাকে ও এক ছুট্টে গেটটার মুখে এসে দাঁড়ালো। আর তখনই নজরে পড়ল একটা ধবধবে সাদা খরগোশ কুকুরের তাড়া খেয়ে প্রাণভয়ে ছুটছে। তাথৈ আর নিজেকে স্থির রাখতে পারল না। গেট খুলে ওদের পেছনে ছুটতে লাগল। কিন্তু কিছুতেই কুকুরটাকে তাড়িয়ে খরগোশটাকে উদ্ধার করতে পারছিল না। হঠাৎ ওর মাথায় একটা মতলব খেলে গেল। যা ভাবা-তাই কাজ। ও দাঁড়িয়ে পড়ে একটা আধলা ইঁট তুলে নিয়ে কুকুরটার পা লক্ষ্য করে ছুঁড়ে মারল। কুকুরের পায়ে সেটা জোরে আঘাত করেছে। কুকুরটা বসে পড়ে চেঁচাতে লাগল। আর খরগোশটা দৌড় থামিয়ে কি ঘটেছে তা যেন বুঝতে চেষ্টা করল। তারপর তাথৈকে দেখে একদৌড়ে তার সামনে চলে এল। তাথৈও তাকে কোলে তুলে নিয়ে তাড়াতাড়ি গেট খুলে ভেতরে ঢুকে গেটটা ভালো করে বন্ধ করে দিল। আর তখনই নজরে পড়ল খরগোশটার কান, লেজ ও আরও অনেক জায়গা থেকে রক্ত ঝরছে। এ নিশ্চয়ই কুকুরটার কাজ। কুকুরটার উপর ভারি রাগ হল তাথৈ এর। মনে হচ্ছিল কুকুরটাকে মেরেই ফেলবে। কিন্তু না-আগে খরগোশটাকে ওষুধপত্র দিয়ে ভালো করতে হবে। তাথৈ একদৌড়ে ওপরে উঠে এল। খরগোশটার ক্ষতস্থান ডেটল দিয়ে ধুয়ে ও মাকে ডাকল, “মা, মা, শিগগির এসো। দেখ, কী এনেছি”। মা রান্না করতে করতে বললেন, “কি রে, এখানে নিয়ে আয়”। তাথৈ খরগোশটা দেখিয়ে মাকে বলল, “মা, এর বোধহয় খুব খিদে পেয়েছে, তাড়াতাড়ি কিছু খেতে দাও তো”। মা গাজর আর ফুলকপি নিয়ে এসে খরগোশটার মুখের কাছে ধরলেন। খরগোশটা কুটকুট করে দাঁত দিয়ে কেটে কেটে যখন সেগুলো খাচ্ছিল তখন তাথৈ এর আনন্দ আর ধরে না। সে বলল, “মা, একে আমি আমার কাছেই রেখে দেব, দেখ দেখ কী সুন্দর। তাই না মা”? মা তো মহাভাবনায় পড়ে গেলেন। বললেন, “তাথৈ, আমার মনে হচ্ছে এটা কারোদের পোষা। তারা চাইতে এলে তো দিয়ে দিতেই হবে”। তাথৈ জোরের সঙ্গে বলল, “না-না আমি একে কখনই ফেরত দেব না। একে আমি কুকুরের হাত থেকে বাঁচিয়েছি। এ এখন আমার”।
খরগোশটাকে বুকে করে নিয়ে তাথৈ নিজের ঘরে চলে এল। পূজো শেষ করে আম্মা তাথৈ এর ঘরে এসে দেখলেন সে খরগোশটাকে নিয়ে মেতে আছে। আম্মা বললেন, “ও মা কী সুন্দর, হ্যাঁরে, একে কোথায় পেলি”? তাথৈ আম্মাকে সব ঘটনা বলল। তাথৈ এর বাবা বাড়ি ছিলেন না। বাজারে গিয়েছিলেন। ফিরে এসে বললেন, “আজ একটা ব্যাপার ঘটেছে। আমাদের পাড়ায় যে ক্লাবটা আছে ওখানে মনোজ কতকগুলো খরগোশ পুষেছিল। খরগোশদের খাওয়ানো, খাঁচা পরিষ্কার করা, ওদের দেখভাল করার দায়িত্ব ছিল বিজয়ের উপর। আজ হয়েছে কী, বিজয় যখন খাঁচার দরজাটা খুলেছে তখন একটা খরগোশ নাকি ওখান থেকে পালিয়েছে। খবরটা পেয়ে মনোজ তো বিজয়কে এই মারে তো সেই মারে। এখন সবাই মিলে খরগোশ খুঁজতে বেরিয়েছে। পাড়ার একজন বলেছে যে, খরগোশটাকে কুকুরে তাড়া করেছিল। প্রাণভয়ে তাকে ছুটতে দেখেছে। এতক্ষণে বোধহয় খরগোশটাকে মেরেই ফেলেছে।
বাবার গলা পেয়ে তাথৈ খরগোশটাকে নিয়ে সেখানে উপস্থিত হলে বাবা তো একেবারে অবাক হয়ে গেলেন। তাথৈ এর কাছে সব ঘটনা শুনে বললেন, “যাই, একবার মনোজদের খবরটা দিয়ে আসি”।
তাথৈ কেঁদে ফেলল। বলল, “বাবা, আমি মিষ্টুকে কিছুতেই দেব না। তুমি যেও না”। বাবা বললেন, “ঠিক আছে। আমি ছেলেগুলোকে খবর দিয়ে দিই যে খরগোশটাকে তাথৈ কুকুরের হাত থেকে উদ্ধার করেছে। সে এখন আমাদের বাড়িতেই আছে”।
কিছুক্ষণের মধ্যেই তাথৈ এর বাড়ির কলিংবেল বেজে উঠল। পাড়ার সব ছেলে দলবেঁধে ওর বাবার সাথে ওদের বাড়িতে এসে হাজির। তাথৈ তার ঘরের দরজা বন্ধ করে মিষ্টুকে কোলে নিয়ে এককোণে বসে কেঁদে কেঁদে বলছে, “তোকে কেউ আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারবে না। প্রাণ থাকতে আমি তোকে কারোকে দেব না”।
মা, বাবা, তাথৈকে দরজা খুলতে বললেও তাথৈ রাজী হল না। অবশেষে আম্মা বললেন, “তাথৈ সোনা, দরজাটা একবারটি খোলো”। তাথৈ দরজা খুলে দিয়েই আম্মার বুকে মুখ গুঁজে বলতে লাগল, “আম্মা, আমার মিষ্টুকে তুমি বাঁচাও। ওকে দিয়ে দিও না। ওকে ছেড়ে আমি থাকতে পারবো না”।
এবার মনোজ এগিয়ে এসে বলল, “তাথৈ, আমরা তো ভেবেই নিয়েছিলাম যে খরগোশটাকে কুকুর মেরে ফেলেছে। বুদ্ধি খাটিয়ে, সাহস করে তুমি ওকে বাঁচিয়েছ। তাই ওটাতে তোমার অধিকার বেশি। আজ থেকে খরগোশটা তোমার কাছেই থাকবে”। আনন্দে তাথৈ এর দু’চোখ জলে ভরে গেল। সাহস করে বলল, “জানো তো কাকু, খরগোশটা খুব সুন্দর দেখতে বলে আমি ওর নামও ঠিক করে ফেলেছিলাম-মিষ্টু”।
“বাঃ। খুব সুন্দর নাম দিয়েছ তো”, বলে মনোজ তাথৈ এর বাবাকে বলল, “বাপিদা, ভাবছি তাথৈকে ওর উপস্থিত বুদ্ধির জন্য আমরা ক্লাবের পক্ষ থেকে সম্বর্ধনা জানাব। তারিখটা আমরা তোমাকে পরে জানিয়ে দেব। তাথৈকে নিয়ে সেদিন তোমরা সকলে চলে আসবে”।
যাবার সময় মনোজ তাথৈ এর মাথায় হাত বুলিয়ে আশীর্বাদ করে বলল, “তুমি অনেক বড় হবে। বন্যপ্রাণীদের রক্ষা করার জন্য আমরা সবাই যদি ছোট থেকেই উদ্যোগী হই, তাহলে আর চিন্তার কিছু থাকবে না। তুমি আজ দৃষ্টান্ত স্থাপন করলে। সুখী হও। ভালো থেকো”। তাথৈ খরগোশটাকে আদর করতে করতে নিজের ঘরে ফিরে এল। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ, সম্বর্ধনা এসব কথা ওর মত ছোট মেয়ের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। তাই এ সব গুরুত্ব না দিয়ে ও তার হঠাৎ পাওয়া মিষ্টুকে নিয়ে আনন্দে মশগুল হয়ে গেল।
তাথৈ ঋভু, রিচার, ছোটকার সবেধন নীলমণি। ওরা সবাই মিলে একই বাড়িতে থাকে। তাদের তিন ভাই বোনের খুব ভাব। স্কুল ছুটি থাকায় ওরা যে যার ঘরে ঘুমিয়ে কাদা। তাই তাথৈ এর কান্ডকারখানা ওরা টেরই পায় নি। পরে ঘুম থেকে উঠে সব কিছু দেখে শুনে ওরা তাজ্জব বনে গেল। মিষ্টুকে নিয়ে তাথৈ এর আনন্দের খেলায় ওরাও মেতে উঠল।