চড়াই, শালিক গেল কোথায়?
বেশ কদিন ধরেই তাতানের মনটা ভালো নেই। ওর সবচেয়ে প্রিয় দিদানকে নিয়ে মা আর মেজমেসো প্লেনে চেপে মুম্বাই চলে গেছে। ও-বাবা, দাদু, বম্মা আর গিট্টুদিদির কাছে রয়েছে। দিদানের নাকি এক কঠিন অসুখ করেছে, তাই ওখানকার হাসপাতালে দেখিয়ে সুস্থ করাতে হবে। এখানকার হাসপাতাল থেকে দেখিয়ে বাড়ি আসার পর থেকেই দাদু কেমন যেন মনমরা হয়ে পড়েছেন। বম্মা, মাম্মাম্, মা সকলের চোখেই জল দেখে তাতানের খুব ভয় করতে লাগল। দিদান ভালো হবে তো? মুম্বাই যাবার আগে মা আর দিদান ওকে অনেক অনেক আদর আর হামি দিয়ে বলে গেছেন দুষ্টুমি না করতে, বম্মার কথা শুনতে, প্রতিদিন স্কুলে যেতে, ঠিক মত হোমটাস্ক করে নিতে। এবারই ও অক্সিলিয়াম কনভেন্টে নার্শারি ওয়ানে ভর্ত্তি হয়েছে। ছোট থেকেই ও দিদানের হাতে খায়। দুপুরে গল্প শুনতে শুনতে ঘুমোয়। গল্প বলার সাথে সাথে দিদান ওকে গাছগাছালি, পাখপাখালিদের সঙ্গে পরিচয় করান।
ওদের বাড়িটা ভারি সুন্দর পরিবেশে। দু’পাশে দুটো হেজেমজে যাওয়া পুকুর আর এক পাশে একটা খাটাল। বাড়িটার চারদিক ঘিরে রয়েছে আম, জাম, নারকেল, সুপারি, বাতাবিলেবু, নিম, শিমূল, কদম ও আরও অনেক নাম না জানা ছোট বড় গাছ, ঝোপঝাড়, সেই সব গাছে হরেক রকমের পাখি। ট্যাঁ ট্যাঁ করতে করতে যখন এক ঝাঁক সবুজ টিয়া উড়ে যায় তখন ওর ভারি আনন্দ হয়। হলুদ রঙের পাখিদের গাছের ডালে দোল খাওয়া ও অবাক হয়ে দেখে। মাছরাঙা, বক, জলপিপিদের পুকুরের পাড়ে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে ও দিদানকে জিজ্ঞাসা করায় বলেছিল, “দেখে তোর মনে হচ্ছে না ওরা ধ্যান করছে? আসলে ওরা ওদের খাবার জল থেকে খুঁজে বার করার চেষ্টায় আছে। জলচর কোন প্রাণীকে পেলেই ওরা ছোঁ মেরে নিয়ে উড়ে যাবে”। কাঠঠোকরা পাখিকে গাছে বসে মোটা গুঁড়িতে ঠোঁট দিয়ে ঠক ঠক করে আওয়াজ করতে, টুনটুনি, বুলবুলি, টিয়া, চন্দনা, কোকিলদের পেয়ারা, জাম, জামরুল গাছে বসে ফলাহার পর্ব সারতে ও স্বচক্ষে দেখেছে। আমগাছে মুকুল ধরলে সেখানে মৌমাছিদের আনাগোনা শুরু হয়। ঐ মুকুল থেকে কীভাবে ছোট ছোট আম হয়, সেই আম ধীরে ধীরে বড় হয়ে কীভাবে পাকলে খাবার উপযুক্ত হয় সবই ও চোখের সামনে দেখতে পায়। বসন্তকাল শেষ হয়ে গ্রীষ্মকালের শুরুতে এক ধরনের বড় বড় পাখিকে ও দেখেছে গাছগুলোতে বাসা বেঁধে থাকতে। সারাদিন রাত পাখিগুলোর ডাকে চারদিক মুখরিত হয়ে ওঠে। কিন্তু দু’তিন মাস বাদেই পাখিগুলো কোথায় যেন হারিয়ে যায়। তাতান মন খারাপ করে বসে থাকে। ওগুলো যে পরিযায়ী বা যাযাবর পাখি, ঋতুতে ঋতুতে ওরা যে স্থান বদল করে এসবই দিদানের কাছে জানা।
ফাগুন, চৈত্রমাসে গাছের সবুজ পাতা হলুদ হয়ে ঝরে পড়লে গাছগুলোকে কেমন যেন ন্যাড়ান্যাড়া দেখতে লাগে। তাতানের একটুও ভালো লাগেনা। দোলের আগের দিন সব ঝরা পাতা এক জায়গায় জড়ো করে পাড়ার দাদারা ন্যাড়াপোড়ায়। ও জানলায় বসে বসে সব লক্ষ্য করে আর ভাবে পাখিরা সব গেল কোথায়? তারপর সব গাছ কচি পাতায় ভরে গেলে গাছগুলোকে খুব মিষ্টি দেখতে লাগে। তাতান অবাক হয়ে দেখে কাকেরা সারাদিন মুখে করে গাছের শুকনো সরু ডাল, ঘাসপাতা, তার, প্লাস্টিক জড়ো করে বাতাবি গাছের ডালে বাসা তৈরি করছে। দিদান বলেছেন, ওদের এখন ডিম পাড়ার সময়। ডিম পাড়ার পর সারাদিন মা কাককে ডিমে তা দিতে, ডিম ফুটে বাচ্চা বেরলে মা, বাবা দুই কাককেই পালা করে খাবার এনে ওদের খাওয়াতে, আর বিচ্ছিরি দেখতে বাচ্চাগুলোকে লম্বা গলা বাড়িয়ে সেই খাবার গিলে খেতে ও জানলায় বসে আপনমনে দেখত।
দিদানের অসুখ হবার আগে বাড়ি সারানোর সময় ওদের সব গাছগুলো কেটে ফেলা হয়েছে। তাই ও আর এখন কাছ থেকে সব পাখিদের দেখতে পায় না। কিন্তু কাক, শালিখ, চড়াই এদের উৎপাত ওদের সহ্য করতে হত। দাদান কাকেদের ভাত, মাছের কাঁটা, মাংসের হাড় এসব খেতে দিলে শালিখ, চড়াই ও জুটত ভাতগুলো খুঁটে খাবার জন্য। সকালবেলায় বারান্দার গ্রীলে বসে শালিখদের ঝগড়া ও খুব উপভোগ করতো। ওদের সুন্দর করে সাজানো ড্রইং কাম ডাইনিং রুমের টেবিলে বসে ও যখন দিদানের সামনে ছবিতে রঙ করতো তখন দেখত একটা চড়াই বেসিনের ওপর লাগানো আয়নাটাতে ঠোকর মারছে। দিদানকে দেখানোয় বলেছিলেন যে, “তোমরা যখন আয়না দেখ তখন কী দেখতে পাও”? উত্তরে তাতান জানিয়েছিল “কেন, আমাকেই”। দিদান তখন বলেছিলেন চড়াইটাও নিজের ছবি দেখছে আর ভাবছে ওখানে ওর মতই একটা চড়াই বসে আছে, তাই ঠোকর মেরে সেটাকে তাড়িয়ে দিতে চাইছে। তাতান বলে উঠেছিল, “চড়াইটা আচ্ছা বোকা তাই না দিদান। ঠিক সেই বোকা সিংহটার মত”।
একবার তো ওদের বসার ঘরের ঘুলঘুলির একটু ফাঁকে দুটো চড়াই পাখিকে সারাদিন মুখে করে শুকনো ঘাস পাতা এমনকি ওদের কারিপাতা গাছের কচি কচি ডাল ভেঙে এনে বাসা বাঁধতে দেখে ও ঝোঁক ধরে বলেছিল, “দিদান, ওদের বাসাটা দেখার খুব ইচ্ছে আমার। কিন্তু এত উঁচুতে করলে তো দেখাই হবে না”। তাই রাগ করে ও জানলা বন্ধ করে দিত। কিন্তু অবাক হয়ে দেখত পাশের ঘরের খোলা জানলা দিয়ে কিম্বা ছাতের দরজা দিয়ে ওরা ঠিক এসে হাজির হত। এর বেশ কিছুদিন পরে ঘুলঘুলি দিয়ে কেবলের তার ঢোকানোর সময় গোপাল মামা চড়াই পাখির বাসাটা নামিয়ে এনে তাকে দেখিয়েছিল। ওর বাসাটা একটুও পছন্দ হয়নি। বলে উঠেছিল, “এ মা! এরা এত নোংরা বাসায় থাকে কী করে? ওদের কী প্রাণে একটুও ইনফেকশনের ভয় নেই”?
দিদান উত্তরে জানিয়েছিলেন, “ওরা তো ওখানে থাকে না, গাছেই থাকে। শুধু ডিমগুলো ঝড়ে পড়ে ভেঙ্গে যেতে পারে, কিম্বা বিড়াল, সাপ গাছে উঠে ডিমগুলো খেয়ে ফেলতে পারে ভেবে ওদের বাবা মা লোকের বাড়ির কোন নিরাপদ জায়গায় ডিম পাড়ে, তা দিয়ে বাচ্ছা বড় করে। তারপর একদিন ফুড়ুৎ করে বাচ্ছা নিয়ে গাছে ফিরে যায়, পড়ে থাকে ওদের শূন্য বাসাখানা।’’ দিদান মুম্বাই চলে যাবার বেশ কিছুদিন পর তাতান লক্ষ্য করল যে চড়াই রা আর আসছে না। ছোট্ট তাতান ভাবল। ওদেরও কী আমার মতই দিদানের জন্য মন খারাপ করছে? তাতান ওর গিট্টুদিদিকে সব বলল। এবার শুরু হল চড়াই খোঁজার পালা। না-কোথাও ওদের দেখা যাচ্ছে না, তাহলে ওরা সব গেল কোথায়? এবার ওদের জন্য তাতানের খুব মন খারাপ করতে লাগল। ভাবল দিদান ফিরে এলেই বোধহয় ওরাও ফিরে আসবে।
প্রায় চল্লিশ দিন বাদে দিদান বাড়ি ফিরলেন। মা বলে দিলেন, “দিদানকে বেশি জ্বালাতন করবে না, বেশি কথাও বলাবে না। দিদানের শরীর কিন্তু খুব খারাপ”। তাই ভয়ে ও আর চড়াইদের না আসার কথা দিদানকে বলতে পারেনি। নিজের পড়া, নাচ, আঁকা আর দিদানকে নিয়ে ব্যস্ত থেকেছে। তারপর একদিন মা, বাবা, দুজনেই কিছু কেনাকাটা করতে শ্যামবাজারে গেলে তাতান বলেই ফেলল, “জানো দিদান, তুমি মুম্বাই গেলে শুধু আমারই মন খারাপ হয় নিগো। চড়াই, শালিখ এদেরও মন খারাপ হয়েছে। তাই না, ওরা আর আসে না, বাসা বানায় না, ঝগড়াও করে না”। সব শুনে দিদান এত কষ্টের মধ্যেও হেসে ফেললেন। বললেন, “দূর বোকা, ওদের কী আমার জন্য তোর মত মন খারাপ করবে? এমনিই আসছে না বোধ হয়”।
এর কিছুদিন পরেই ছোট দিদুন তাঁর বড়দিকে দেখতে এলেন। কথা প্রসঙ্গে তাতান তাঁকে বলেই ফেলল, “আচ্ছা দিদুন, তোমাদের বাড়িতে শালিখ, চড়াইদের দেখতে পাও”? তখনই রহস্যটা ফাঁস হল। ছোট দিদুন বললেন, “এখন চারদিকে মোবাইল ফোনের চল হয়েছে না। তার টাওয়ারের তারগুলো খুব নিচু দিয়ে গেছে। ওতেই ধাক্কা খেয়ে চড়াই শালিখের মত ছোট ছোট পাখিগুলো বেশির ভাগই শেষ হয়ে গেছে। শুধু তাই নয়রে, কাকেদের বাসায় ডিম থেকে বাচ্ছা ফুটে বড় হবার আগেই মরে যাচ্ছে”।
দিদান বললেন, “সেদিন ওদের পারুল ঘর মুছতে মুছতে বলছিল নারকেল গাছের ডাল, বেলগাছের বেলগুলো নাকী মোবাইল তারের জন্য বাড়তে পারছে না। ছোট অবস্থাতেই শুকিয়ে পড়ে যাচ্ছে”।
এতক্ষণ তাতানের দিদি সব চুপ করে শুনছিল। ও এবার নবম শ্রেনীতে উঠেছে। ও বলল, “তোমরা বুঝি ‘কালান্তর’ পত্রিকাটা ভালো করে পড়নি। ওখানে তো একটা আর্টিকল বেরিয়েছিল, মৌমাছিরা মৃত্যু মিছিলে, ওদের জীবনে আকস্মিক এই বিপন্নতার অন্যতম কারণ মোবাইল ফোনের টাওয়ার”।
এইবার তাতান বলেই ফেলল, “আধুনিককালের বেশিরভাগ জিনিসই তো তাহলে খুব বাজে, সবকিছু শেষ করে দেয়। তাহলে এসব ব্যবহারের দরকার কী’’। দিদানই তো বলেন বেশি টিভি দেখলে দৃষ্টিশক্তি ও শ্রবণশক্তি নষ্ট হয়ে যায়। বোকা বাক্স মানুষের ব্রেনও নষ্ট করে। অতিরিক্ত মোবাইল ফোনের ব্যবহার মানুষের পক্ষে ক্ষতিকারক এমনকী প্রাননাশকও।
তাতানের এই কথার উত্তর কী দেবে বুঝতে না পেরে দুই দিদান শুধু একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইলেন।