সোনালী দুঃখ – ৯

অরণ্যের অন্য প্রান্তে গিয়ে ওরা আবার বাসা বাঁধলো। কয়েক দিন পর ওরা আবার খানিকটা নিশ্চিন্ত হয়ে গেল।

একদিন কুটিরের সামনে ওরা বসে আছে, বসে বসে নানান্ গল্প করছে, এমন সময় সামনে দিয়ে ছুটে গেল একটা সুন্দর হরিণ। হরিণটা একটু অন্যরকম, সবুজ ঘেঁষা রং, সারা গায়ে হলুদ ছিট ছিট। সোনালি বললো, আমায়ঐ হরিণটা ধরে দাও না! মেরো না, জীবন্ত ধরে দাও, আমি ওটাকে পুষবো।

হুজুর, এই জায়গাটা শুনে আপনাদের রামায়ণের কথা মনে পড়ে না? সেই দণ্ডক বনের কুটির প্রাঙ্গণে বসে আছেন রাম আর সীতা, সামনে দিয়ে ছুটে গেল সোনার মায়া হরিণ! কিন্তু ত্রিস্তান তো রামায়ণ গাথা জানে না!

তখনি ত্রিস্তান তীর ধনুক নিয়ে ছুটলো। ছুটতে ছুটতে যে কতদূর চলে গেল তার ঠিক নেই। তরুণ মৃগ বিদ্যুৎ গতিতে ছুটছে, তার সঙ্গে ত্রিস্তান ছুটে পারবে কেন? অথচ ত্রিস্তান বাণও মারতে পারছে না, কারণ সোনালি ওটা জীবন্ত চেয়েছে। ছুটতে ছুটতে ত্রিস্তান ক্লান্ত হয়ে গেল। দূরে মিলিয়ে গেল হরিণটা। ক্লান্ত ত্রিস্তান সেখানেই ঘাসের উপর শুয়ে পড়লো।

মাথার ওপর পরিষ্কার আকাশ। ঠাণ্ডা বসন্তের হাওয়া দিচ্ছে। একদৃষ্টে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ত্রিস্তানের হঠাৎ মনে হলো, রাজা কি সেদিন সত্যিই ভয় পেয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন? কেন, আমি তো ছিলাম ঘুমিয়ে। আমার প্রাণ তো ছিল রাজারই হাতে। অথবা, আমার তলোয়ার সরিয়ে নিয়ে উনি তো আমাকে জীবন্ত অবস্থাতেও বন্দী করতে পারতেন! যদি আমার তলোয়ার সরিয়ে নিলেনই, তবে আবার নিজের বহুমূল্য তলোয়ারটা রেখে গেলেন কেন? মহারাজ, মহারাজ, আমি তোমাকে চিনি। তোমার বুকের স্নেহ মমতা আবার ফিরে এসেছে। আমাকে মারতে গিয়ে তোমার মনে পড়েছে সেই বালকটির কথা, যে তোমার পায়ের কাছে বসে বীণা বাজাতো। তুমি আমাকে ক্ষমা করেছো! কিংবা ক্ষমা হয়তো নয়, রাজা বুঝতে পেরেছেন, ঈশ্বর আমারই পক্ষে। নইলে বারবার আমি বেঁচে গেলাম কেন? গির্জার জানালা দিয়ে লাফিয়েও মরিনি, তার মানে ভগবান আমাকে মারতে চান না। হয়তো আমাকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখে রাজার সব পুরনো কথা মনে পড়েছিল। মোরহল্টের সঙ্গে আমার যুদ্ধ, আয়ার্ল্যান্ড অভিযান, ওঁর জন্য আমার নিজের রাজ্য ছেড়ে আসা।

কিংবা উনি হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন যে উনি অন্যায় করেছেন। আমাকে বিনা বিচারে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন। কেন, আমি কি যে-কোনো লোককে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করিনি? কার সাধ্য ছিল আমার নামে অভিযোগ আনার? রাজা হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন, আমার মতো বন্ধু উনি আর পাবেন না। ওঁর বিপদের সময় আমার মতো নিঃস্বার্থভাবে আর কে ওঁর পাশে দাঁড়াবে? আবার কি উনি আমায় ফিরিয়ে নিতে চান ওঁর রাজ্যে? আবার আমি বর্ম পরে যুদ্ধে যাবো রাজার শত্রুকে জয় করতে? আবার আমি ওঁর সামনে বসে বীণা বাজাবো? না।…এসব আমি কি আবোলতাবোল ভাবছি! আমার কি মাথা খারাপ! রাজার কাছে আমার ফিরে যাওয়া মানেই তো সোনালিকে ফিরিয়ে দেওয়া। আমার কাছ থেকে সোনালিকে নেয় কার সাধ্য!

মহারাজ, মহারাজ, তুমি ঘুমের মধ্যে সেদিন আমাকে হত্যা করলে না কেন? সে যে অনেক ভালো ছিল। এ আমি কি দুর্ভাবনায় পড়লাম! সোনালিকে আমি বারবার জয় করেছি। আয়ার্ল্যান্ড থেকে, তোমার হাত থেকে, কুষ্ঠরোগীদের কাছ থেকে। কিন্তু তুমি সেদিন যে করুণা দেখালে, তাতে এই একবার তুমিও জয় করেছো, তুমিও রানীকে জয় করেছো।…সোনালি ছিল তোমার পাশে রানী, আর এখানে,

আমার পাশে এসে, ও হয়েছে ভিখারিনী। ওর সোনার যৌবন বনে-জঙ্গলে রোদে পুড়ে, জলে ভিজে নষ্ট হচ্ছে। কত মখমল, সিল্কের পোশাক ছিল ওর, আজ ভালো করে লজ্জা নিবারণ করতে পারে না। সোনার পালঙ্কে কি কোমল শয্যায় ও শুয়ে থাকতো, আজ শুয়েছে কঠিন পাথরে। আমারই জন্য। সবই আমার জন্য। আমি ওকে এই দুর্ভাগ্যের মধ্যে টেনে এনেছি। হা ঈশ্বর, আমাকে বাঁচাও। আমার নিজের সুখের জন্যে সোনালিকে এত কষ্ট দেবো কেন? ঈশ্বর, আমাকে শক্তি দাও, শক্তি দাও, আমি সোনালিকে ফিরিয়ে দিয়ে আসি।

রাজাই তার স্বামী, পবিত্র ধর্মমতে ওঁকে বিয়ে করেছেন সকলের সামনে। আমি কে? আমি একটা চোর।

সেদিন সারারাত আর ত্রিস্তান কুটিরে ফিরে গেল না। ঐখানে, বনের মধ্যে মাটিতে শুয়ে একা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো। তার কান্না শুনলো অরণ্যের পশুরা আর আকাশের তারাদল। হয়তো সেই কান্না শুনেই হিংস্র জন্তুরা ত্রিস্তানের ক্ষতি করতেও এলো না।

ওদিকে কুটিরে সোনালি সারারাত জেগে আছেন। এতদিনের মধ্যে এই প্রথম এক রাত্রিতে ত্রিস্তান তাঁর সঙ্গে নেই। নিজের জন্য ভয় নেই তাঁর, ভয় হচ্ছে ত্রিস্তানের জন্য। হরিণ ধরতে গিয়ে কোথায় গেল? রাজা মার্কের ফিরিয়ে দেওয়া আংটিটা দেখে সোনালির অনেক কথা মনে হতে লাগলো। যে লোক আমাকে কুষ্ঠরোগীদের হাতে ছুঁড়ে দিয়েছিলেন, সেই লোকই এবার আমাকে না মেরে, আংটিটা শুধু ফিরিয়ে দিয়ে গেলেন! রাজার মনে ফিরে এসেছে স্নেহ, মমতা। আমাকে উনি কত স্নেহ করেছেন, ভালোবেসেছেন। এই বিদেশে আমাকে কোনো দুঃখ পেতে দেননি। কিন্তু আমি এলাম এ রাজ্যে কুগ্রহ হয়ে। রাজা কত ভালোবাসতেন ত্রিস্তানকে আর আজ! যে ত্রিস্তান রাজা মার্কের জন্য নিজের রাজ্য পর্যন্ত ছেড়ে এলো, আজ সেই রাজ্যই ওর প্রধান শত্রু। কার জন্য? ত্রিস্তানের ছেলেবেলার নাম দুঃখ। সারাজীবন ওকে দুঃখই পেতে হলো কার জন্য? আমার, আমার-। আজ ত্রিস্তানের কোথায় থাকার কথা, সে এই রাজ্যের শ্রেষ্ঠ বীরপুরুষ, তার বীরত্বের খ্যাতি পৃথিবীময়, জমকালো পোশাক পরে সে সাদা ঘোড়ায় রাজপথ দিয়ে যাবে- লোকে তার দিকে তাকাবে গভীর সম্মানের চোখে…তার বদলে, আজ সে ছন্নছাড়ার মতো বনে-জঙ্গলে ঘুরছে, তার পোশাক নেই, তার কোনো আনন্দ নেই। বীরযোদ্ধা কখনও দিনের পর দিন যুদ্ধ না করে, নিজের শক্তির পরিচয় না দিয়ে থাকতে পারে? পাখি যেমন ওড়ে, বীর নাইট তেমনি যুদ্ধের চর্চা করে। তার বদলে এখানে সামান্য জীবজন্তু শিকার করা তার একমাত্র কাজ। রাজার যে সৈন্যরা একসময় তাকে দেখলেই অভিবাদন করতো, আজ তারাও ওকে দেখলে পশুর মতো তাড়া করবে শুধু আমার জন্য। শুধু আমার জন্য! হে ভগবান, আমার জন্য ত্রিস্তানের এই দুর্ভাগ্য! বীরপুরুষকে সামান্য মানুষের মতন জীবন কাটাতে দেখলে মেয়েরা কখনও সুখী হয় না।

এক সময় বাইরে পদশব্দ পাওয়া গেল। ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে ত্রিস্তান ফিরে আসছে। বিষণ্ন তার মুখ। আজ সে এসেই সোনালিকে জড়িয়ে ধরলো না। সোনালি তাড়াতাড়ি এসে ত্রিস্তানের পোশাক খুলে দিতে লাগলেন। তলোয়ারটা যখন ত্রিস্তানের কোমর থেকে খুলেছেন, তখন ত্রিস্তান গম্ভীর স্বরে বললো, এ তলোয়ার রাজার, এটা তিনি আমাদের বুকে বসিয়ে দিতে পারতেন, তার বদলে উপহার দিয়ে গেছেন।

সোনালি সেই তলোয়ারের মুক্তো বসানো বাঁটে চুমু খেলেন। দু’ফোঁটা জল এলো তাঁর চোখে। সেদিন দুজনে কেউ আর কোনো কথা বলতে পারলো না। হয়তো, মনে মনে ওরা দুজনে ভাবছে একই কথা।

দু’তিন দিন পর, ত্রিস্তান ধীরস্বরে সোনালিকে বললো, সখী, আমি ভেবে দেখলাম তোমার রাজার কাছে ফিরে যাওয়াই উচিত। রাজার মন থেকে রাগ পড়ে গেছে, তিনি তোমাকে বোধহয় ফিরে পাবার জন্য কাতর। আমার জন্য তুমি এত কষ্ট সহ্য করবে এ যে আমি আর সহ্য করতে পারি না। তুমি রাজার মেয়ে, তোমার কি এত কষ্ট সহ্য করবার কথা ছিল? আমি ছেলেবেলা থেকেই দুঃখ-কষ্টকে চিনি। কিন্তু, তোমার এই সোনার অঙ্গ-না, না, সোনালি-তোমার রাজার কাছে ফিরে যাওয়াই ঠিক, রাজা যদি আমাকেও ফিরিয়ে নেন, তবে আমি তাঁর সেবা করবো অথবা আমি চলে যাবো অন্য রাজ্যে। আমার ভাগ্যে যা আছে, তাই হবে। কিন্তু আমার জন্য তোমাকে আর কষ্ট সইতে দেবো না।

সোনালি একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন। একটা গোপন দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তারপর বললেন, সত্যি ত্রিস্তান, আমার জন্য তুমি কেন এত কষ্ট সহ্য করবে? আমি এ পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে তোমার দুঃখ যাবে না। ত্রিস্তান, তুলে নাও তোমার তলোয়ার। আমার বুকে বসিয়ে দাও। ত্রিস্তান, ভালোবাসা কোনো মূল্য চায় না। তোমাকে ভালোবেসে আমি স্বর্গ পেয়েছি, কিন্তু তার জন্যে তোমার জীবনে এত মূল্য দিতে হবে কেন। আমার মৃত্যুই একমাত্র সমাধান।

ত্রিস্তান দুই করতলে তুলে ধরলো রানীর মুখ। দেখলো, সে মুখ বড় বিমর্ষ, ম্লান। আস্তে আস্তে সে বললো, সোনালি, মৃত্যু যদি সমাধান হয় তবে মৃত্যু আসা উচিত আমার। সে মৃত্যু তো আমি পেয়েছি, বহুবার, তোমার ঐ বুকের মধ্যে। তোমার বুকে মাথা রেখে আমি সে সুখ পেয়েছি, তা মৃত্যুর মতোই তীব্র। কিন্তু সত্যি সত্যি শারীরিকভাবে মরতে আমি পারি না, তাহলে যে তোমাকে আর দেখতে পাবো না। কিংবা দেখতে যদি নাও পাই, তুমি কোথাও বেঁচে আছো, সুখে আছো, জানতে পারলেই আমার সুখ। তুমি আমার দুঃখের কথা বলছো? দেখো, আমার জন্ম থেকেই আমার সারা শরীরে দুঃখের অজস্র চিহ্ন-যেদিন থেকে আমার মা মারা যান। দুঃখ- কষ্ট আমার অঙ্গের ভূষণ। সোনালি, আমার মায়ের মৃত্যুর কথা আমি অনেক পরে শুনেছি। বড় দুঃখ পেয়ে মরেছেন তিনি। তোমাকে দেখলেও আমার মায়ের কথা মনে পড়ে। তোমাকে আর আমি দুঃখ সইতে দিতে পারি না। দুঃখ তোমাকে মানায় না। আমার সঙ্গে দেখা হওয়ার আগে কখনো তো তুমি দুঃখের মুখ দেখোনি!

—ত্রিস্তান, আমার দুঃখ কোথায়। তোমার সঙ্গে দেখা হবার আগেই তো আমার সারাজীবন দুঃখে কেটেছে। তোমার ভালোবাসা আমাকে যে সুখ দিয়েছে, পৃথিবীতে কোনো নারী সে সুখ কখনও পায়নি!

—না, সোনালি, আমার মনে অপরাধবোধ এসেছে। আমার মনে হয় এখন, রাজার কাছ থেকে আমি তোমাকে ছিনিয়ে এনেছি শুধু আমার নিজেরই স্বার্থে তোমাকে দেবার মতো আমার আছে শুধু ভালোবাসা, আর তো কিছু নেই। তোমার এই জীর্ণ পোশাক, আজ তোমার শরীরের রং জ্বলে যাচ্ছে রোদ্দুরে, শীতে, এ তো আমারই জন্যে।

—আর তোমার রুক্ষ শরীর, ছেঁড়া-পোশাক আজ কার জন্য!

সে তো আমার প্রাপ্য! আমি হীন চোরের মতো পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি-আমাকে এ চেহারাতেই মানায়। কিন্তু তুমি রানী, আমার জন্য তোমার এই দুর্দশা কেন? তুমি রাজার কাছে ফিরে যাও। তাঁর সেদিনের ব্যবহার দেখে মনে হয়, তিনি আমাদের ক্ষমা করেছেন। তিনি আবার তোমাকে ভালোবাসবেন, তোমার যোগ্য সম্মান দেবেন। আমি দূরে সরে যাবো।

সোনালি একটা বিরাট নিশ্বাস ফেললেন। তারপর বললেন, চলো ত্রিস্তান, আমরা ঋষি অগরুর আশ্রমে গিয়ে ঈশ্বরের কাছে দয়া প্রার্থনা করি।

হাঁটতে হাঁটতে ওরা আবার চলে এলো ঋষির আশ্রয়ে। ঋষি ওদের দেখে চমকে উঠলেন। বললেন, ইস্, একি চেহারা হয়েছে তোমাদের? দেখো, ভালোবাসা তোমাদের কতদূর নিয়ে গেছে! ত্রিস্তান, এখনও অনুতপ্ত হও, অনুতাপ ছাড়া মুক্তি নেই।

ত্রিস্তান গম্ভীরভাবে বললো, ঋষি, আপনি রাজার সঙ্গে আমাদের শান্তি স্থাপনের একটা ব্যবস্থা করে দিন। আপনি রাজাকে চিঠি লিখে দিন যে রানীকে ফেরত পাঠাতে প্রস্তুত আমি, যদি তিনি তাঁকে সসম্মানে গ্রহণ করেন। আমি নিজে এ রাজ্য ছেড়ে চলো যাবো-তাঁর আর চক্ষুশূল হবো না, কিন্তু রানীর সম্পূর্ণ সম্মান রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিতে হবে তাঁকে!

সোনালি অগরুকে বললেন, প্রভু, আমি আমার ভালোবাসার জন্য একটি অনুতাপের বাক্যও উচ্চারণ করতে চাই না। কিন্তু আমাদের এ অবস্থার শেষ হোক।

ঋষি অগরু তখন আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, হে রাজার রাজা, শেষ পর্যন্ত তুমি সব মানুষকেই সুমতি দাও! ধন্য তোমার করুণা।

ত্রিস্তান তা দেখে অভিমানী মুখে, মনে মনে বললো, না, আমি ঈশ্বরের ভয়ে সোনালিকে ফিরিয়ে দিতে আসিনি। পাপের জন্য আমি অনুতাপও করছি না। আমি সোনালিকে ফিরিয়ে দিতে চাই অন্য কারণে। ঋষি, তুমি বন বাসী ব্রহ্মচারী, তুমি সে কথা বুঝবে না!

ঋষি তারপর চিঠি লিখতে বসলেন। চিঠি লেখা শেষ হলে তিনি ওদের চিঠিটা পড়ে শোনালেন। ত্রিস্তান চিঠিতে নিজের আংটির ছাপ দিয়ে দিলেন।

ঋষি জিগ্যেস করলেন, কে চিঠি নিয়ে যাবে?

ত্রিস্তান উত্তর দিল, আমি।

—না, না, তা হয় না। তোমাকে দেখলে প্রহরীরা কোনো কথা শোনার আগেই হয়তো হত্যা করবে। না, ত্রিস্তান তুমি না!

—ঋষি, যদি মরার হতো, বহু আগেই তাহলে আমি মরে যেতাম। আমার পক্ষে মরা বড় কঠিন। ও চিঠি আমিই নিয়ে যাবো!

সেদিন সন্ধের অন্ধকার নেমে আসার পর ত্রিস্তান ঋষির কাছ থেকে একটা কালো কাপড় চেয়ে নিয়ে সেটা দিয়ে মুখ ঢেকে ঘোড়ায় চেপে বেরিয়ে পড়লো। বন পেরিয়ে সোজা চলে এলো দুর্গের প্রাচীরের কাছে। ততক্ষণে প্রায় মধ্যরাত। সেখানে ঘোড়া বেঁধে, লাফিয়ে পার হল প্রাচীর। তারপর উদ্যানের মধ্য দিয়ে হেঁটে চলে এলো রাজার শয়ন ঘরের নীচে। কেউ তাকে সন্দেহ করেনি। তাছাড়া সন্দেহ করবেই বা কে? কেউ কি কল্পনা করতে পারে ত্রিস্তান একা এসে ঢুকবে রাজপুরীতে? ওকে কেউ চিনতে পারলেও বিশ্বাস করতো না। হয়তো ভাবতো ভূত দেখছে।

ত্রিস্তান অনুচ্চ স্বরে তিনবার ডাকলো, মহারাজ, মহারাজ, মহারাজ!

সেই ডাক শুনে রাজা মার্কের ঘুম ভেঙে গেল। তিনি ভাবলেন, তিনি কি স্বপ্ন দেখছেন? তাড়াতাড়ি জানলার কাছে এসে বললেন, কে ডাকছো আমায় এত রাত্রে? কে তুমি?

—মহারাজ, আমি ত্রিস্তান।

—কে, কি নাম বললে?

—ত্রিস্তান।

—ত্রিস্তান? কোন ত্রিস্তান? এদিকে আলোর কাছে এসো!

—আমি সেই পুরনো ত্রিস্তান। মহারাজ, আপনার কাছে একটা চিঠি দিচ্ছি, কাল এর উত্তর লিখে ঝুলিয়ে দেবেন বনের সীমান্তে শুকনো ওক গাছে!

ঠক্ করে শব্দ হয়ে একটা তীর এসে পড়লো রাজার পায়ের কাছে। তার মাথায় বাঁধা চিঠি। রাজা ডেকে উঠলেন, ত্রিস্তান, ত্রিস্তান, একটু দাঁড়াও!

কোনো উত্তর নেই আর। রাজা তাড়াতাড়ি ছুটে এলেন বারান্দায়। বাগান তখন শূন্য যতদূর দেখা যায় শুধু চাঁদের আলোর স্তব্ধতা। রাজা আর্তকণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠলেন, ত্রিস্তান, ত্রিস্তান, ওরে একটু দাঁড়া, একবার তোকে দেখি, ত্রিস্তান, ত্রিস্তান-

রাজার আকুল ডাক হাওয়ায় ভেসে বেড়াতে লাগল। ত্রিস্তান তখন বহু দূরে। চিৎকার শুনে প্রহরীরা ছুটে এসে দেখলো রাজা বারান্দায় দাঁড়িয়ে পাগলের মতো কাঁদছেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *