সোনালী দুঃখ – ৮

এবার আরম্ভ হলো ওদের নির্বাসিত অরণ্য-জীবন। গভীর জঙ্গলের মধ্যে সারা দিন ওরা সতর্ক হয়ে লুকিয়ে থাকে। রাত্রিবেলা লতাপাতা বিছিয়ে ঘুমোয়, পরদিন আবার সে জায়গা ছেড়ে চলে যায়। এক জায়গায় কখনো বেশিক্ষণ থাকে না। কিন্তু ওদের কোনো কষ্ট নেই দুঃখ নেই। যারা ভালোবাসাকে জেনেছে তাদের কাছে দুগ্ধফেননিভ বিছানা আর তৃণশয্যায় কোনো তফাত নেই! তাদের কাছে বনের কন্টকও মনে হয় কুসুম। প্রখর রোদ্দুরও মনে হয় চন্দনের মতো ঠাণ্ডা। রাত্রে যখন ত্রিস্তানের বিশাল বুকের মধ্যে মুখ গুঁজে শুয়ে থাকেন সোনালি, তখন মনে হয় ওরা স্বর্গের দুটি গন্ধর্ব, ছদ্মবেশে পৃথিবীতে রয়েছে।

একদিন বনের মধ্যে দুজন শিকারী এসেছিল, ত্রিস্তান আর গরভেনাল গাছের ওপর থেকে বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়লেন তাদের ওপর। ওদের তীর-ধনুক কেড়ে ত্রিস্তান বললো, তোমাদের প্রাণে মারলুম না। কিন্তু দেশে ফিরে গিয়ে সকলকে বলো, কেউ যদি এ অরণ্যে ঢোকে, তাহলে আর প্রাণ নিয়ে ফিরতে হবে না। আমি ত্রিস্তান, এ অরণ্য আমার।

ত্রিস্তানের তীর-ধনুক দরকার ছিল। জঙ্গলে তলোয়ার বেশি কাজে লাগে না। শিকারের জন্য তীর-ধনুক লাগে। হরিণ মেরে সেই মাংস পুড়িয়ে খায়। মাঝে মাঝে ত্রিস্তান ছোটখাটো ডাকাতি করতে লাগলো। জঙ্গলে কখনো দু’একজন শিকারী ঢুকে পড়লেই ত্রিস্তান সঙ্গে সঙ্গে খুব করে অস্ত্রশস্ত্র কেড়ে নিত। সব সময় খুন করার দরকার না হলেও খুন করতো। যাতে তার নামে একটা সন্ত্রাস ছড়িয়ে পড়ে। যাতে আর কেউ এসে তাদের শান্তি বিঘ্ন করতে সাহস না পায়। সত্যিই আশপাশের সব ক’টা রাজ্যে ত্রিস্তানের নামে একটা বিভীষিকা রটে গেল। সে তখন বেপরোয়া নিষ্ঠুর। তার সামনে পরলে আর কারোর নিস্তার নেই।

তবু ওরা এক জায়গায় বেশিদিন থাকে না। জঙ্গলের একদিক থেকে অন্যদিকে চলে যায়। ওদের পোশাক ছিঁড়ে ঝুলি ঝুলি হয়ে গেল, শরীর ক্ষতবিক্ষত, ধূলিমলিন। তবু ওদের কোনো দুঃখ নেই, কষ্ট নেই। সোনালিকে আলিঙ্গন করে ত্রিস্তান যখন চুম্বন করে, তখনই ওর মনে হয় এই চুম্বন যেন মৃত্যু পর্যন্ত স্থায়ী হয়, এই ভাবে আলিঙ্গনে আবদ্ধ অবস্থাতেই যেন ওরা মরতে পারে।

মাঝে মাঝে সোনালি যখন ঝরনার জলে স্নান করে, ত্রিস্তান তীরে বসে পাহারা দেয়, গরভেনাল তখন যান শিকারের সন্ধানে। ঝরনার স্বচ্ছ জলে সোনালির সম্পূর্ণ শরীর দেখতে দেখতে ত্রিস্তানের চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। মনে হয়, সোনালি যেন অলৌকিক মায়া। এত রূপ কি কোন মানুষের হয়? এত রূপ বুঝি এই পৃথিবীতে মানায় না। পৃথিবীতে রূপের সঙ্গে অনেকখানি দুর্ভাগ্য জড়ানো। এ যেন স্বর্গ থেকে কোনো দেবী এসে জলকেলি করছে। এখুনি আবার অদৃশ্য হয়ে যাবে। পাছে অদৃশ্য হয়ে যায়, এই ভয়ে ত্রিস্তান নিজেও জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে সোনালিকে জড়িয়ে ধরে।

একদিন ঘুরতে ঘুরতে ওরা দেখলো বনের মধ্যে একটা পাতার কুঠির। ওটা ঋষি অগরুর আশ্রম। খর্বকায়, বৃদ্ধ ঋষি ওদের দেখে বললেন, বুঝেছি, তোমরাই ত্রিস্তান আর সোনালি। এসো এসো।

ঋষি ওদের ফলমূল খেতে দিলেন। তারপর বললেন, আমি কয়েকদিন আগে নগরে গিয়েছিলাম। তোমাদের কথা শুনে এলাম। শোনো ত্রিস্তান, রাজা ঘোষণা করেছেন, যে তোমাকে ধরতে পারবে, তাকে তিন দশ সহস্র স্বর্ণমুদ্রা পুরষ্কার দেবেন। কর্নওয়ালের প্রতিটি নাইট শপথ করেছে, তোমাকে জীবিত অথবা মৃত অবস্থায় বন্দী করবেই।

এ কথায় ত্রিস্তান সামান্য হাসলো।

ঋষি আবার মৃদুস্বরে বললেন, শোনো ত্রিস্তান, পাপী যদি তার পাপের জন্য অনুতাপ করে, ঈশ্বর তাকে ক্ষমা করেন। ত্রিস্তান, এখনও সময় আছে, তুমি অনুতাপ কর।

ত্রিস্তান অবাক হয়ে বললো, অনুতাপ করবো? কেন? আমি তো কোনো পাপ করিনি। ভালোবাসা কি পাপ? আমি সোনালিকে ভালোবাসি, এ কথা আমি ঈশ্বরের সামনে দাঁড়িয়ে বলবো। আমি সারাজীবন বনে জঙ্গলে ফলমূল কাঁচা মাংস খেয়ে থাকবো, যদি সোনালি সঙ্গে থাকে। সোনালিকে হারিয়ে আমি পুরো পৃথিবীর সম্রাটও হতে চাই না।

—তুমি চঞ্চল, ত্রিস্তান। তোমার ভালোবাসায় তুমি এ জীবনের সুখও হারালে পরপারের জীবনেও সুখ পাবে না। যে লোক তাঁর প্রভুর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে, তার শাস্তি দুই ঘোড়ার মাঝখানে তাকে বেঁধে চিরে ফেলা। মরার পর যেখানে তার ছাই ফেলা হয়, সেখান আর ঘাস গজায় না। আশেপাশের গাছপালা মরে যায়। ত্রিস্তান, এখনো তুমি রানীকে ফিরিয়ে দাও। ফিরিয়ে দাও তার স্বামীর কাছে, ধর্মমতে অগ্নিসাক্ষী করে যার সঙ্গে বিবাহ হয়েছে, তাঁর কাছে ফিরিয়ে দাও।

—রানীর কোনো স্বামী নেই। রাজা ওঁকে কুষ্ঠরোগীদের কাছে বিলিয়ে দিয়েছেন, আমি তাদের কাছ থেকে ওঁকে কেড়ে এনেছি। ওঁর ওপর রাজার আর কোনো অধিকার নেই। এখন ও আমার। কেউ ওঁকে আমার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারবে না।

রানী তখন ঋষির পায়ের কাছে বসে কাঁদতে লাগলেন। অস্ফুট স্বরে বলতে লাগলেন, আমি হতভাগিনী, কিন্তু আমরাও কোনো পাপ করিনি। কোনো পাপ করিনি। আমরা যে দুজনের কাছে দুজনে বাঁধা।

ঋষি বললেন, আবার বলছি, ত্রিস্তান, এখনো অনুতাপ করো।

—না, আমি অনুতপ্ত হবো না। যদি ঈশ্বর আমাকে ক্ষমা না করেন, আমিও ঈশ্বরকে ক্ষমা করবো না। আমি এই জঙ্গলের রাজা হয়ে থাকবো। কারুর সাধ্যি নেই, আমাকে বাধা দেয়। ঈশ্বরেরও না। এসো সোনালি

ওরা দুজনে হাত ধরাধরি করে শুকনো পাতা মাড়িয়ে চলে গেল বনের মধ্যে। কিছুক্ষণ ওদের পদশব্দ শোনা গেল।

এবার গভীর জঙ্গলের মধ্যে ওরা একটা ছোট্ট পাতার কুঁড়েঘর তৈরি করলো। রাত্তির বেলা গরভেনাল আর ত্রিস্তান পালা করে জেগে পাহারা দেয়। অনেকদিন আর কেউ এলো না ওদের ব্যাঘাত করতে।

একদিন গরভেনাল বনের মধ্যে ঘুরছেন, দূরে দেখলেন একজন অশ্বারোহী নাইট। এ সেই বদমাইশ চারজন নাইটের মধ্যে সবচেয়ে বদমাইশটি। রাজার পুরস্কারের ঘোষণা শুনে এবং নিজের বীরত্ব দেখাবার অতি উৎসাহে একা এসেছে বনে। চুপি চুপি চোরের মতো এগোচ্ছে। যদি গোপনে দূর থেতে ত্রিস্তানকে খুন করতে পারে, এই ইচ্ছে। গরভেনাল ওকে দেখে একটা বড় গাছের ওপর উঠে বসে রইলেন। ধনুক বাগিয়ে এক পা এক পা করে আসছে নাইট। ঝুপ করে তার ঘাড়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন গরভেনাল। কিন্তু বয়েস হয়েছে, গরভেনাল শক্তিতে পারলেন না সেই তরুণ নাইটের সঙ্গে। নাইট হঠাৎ গরভেনালকে নিচে ফেলে তলোয়ার বসিয়ে দিলো। গরভেনাল মৃত্যু চিৎকার দিয়ে উঠলেন।

আওয়াজ শুনে ছুটে এলো ত্রিস্তান। গরভেনাল শুধু মরার আগে শেষ কথা বললেন, ত্রিস্তান, প্রতিশোধ! ত্রিস্তান রক্তচক্ষে তাকালেন নাইটের দিকে। তাকে যুদ্ধ করতেও হলো না। নিজের তরবারি দিয় প্রচণ্ড আঘাত করতেই নাইটের হাত থেকে তলোয়ার খসে গেল। ত্রিস্তান পাগলের মতো নাইটকে তলোয়ারে বারবার আঘাত করতে লাগলো। নাইটের মৃত্যুর বহু পরেও থামলো না। তারপর নাইটের মুণ্ডুটা কেট নিয়ে, শুধু ধড়টা বেঁধে দিল ঘোড়ার সঙ্গে। ঘোড়ার পিঠে চাবুক মারতেই ঘোড় ছুটে গেল শহরের দিকে। ত্রিস্তান তার দুঃখ-দুর্দিনের বন্ধু, গুরু গরভেনালের মৃতদেহের ওপর আছড়ে পড়ে কাঁদলে লাগলো শিশুর মতো।

কান্না শুনে সোনালি ছুটে এলেন। দেখলেন, গুরু গরভেনালের রক্তমাখা বুকের ওপর শুয়ে ত্রিস্তান ছটফট করছে। সোনালি অনেক রকম ওষুধ জানতেন। কিন্তু, গরভেনালকে পরীক্ষা করে দেখলেন, তিনি সব চিকিৎসার বাইরে চলে গেছেন। তাঁর মুখ প্ৰশান্ত।

ত্রিস্তানের অবাল্য সঙ্গী গরভেনাল। তিনি বিবাহ করেননি, তাঁর সন্তান নেই বলেই বোধহয় ত্রিস্তানকে তিনি নিজের সন্তানের মতো দেখেছিলেন। ত্রিস্তান যখন নিজের রাজ্য ছেড়ে আসে, তিনিও এসেছেন ওর সঙ্গে। ত্রিস্তানের প্রতিটি কাজে ছিল তাঁর সমর্থন। ত্রিস্তান- সোনালির ভালোবাসার কথা জেনে, তিনি সব সময় ওদের সাহায্য করছেন। তাঁর জীবনের একমাত্র লক্ষ্য ছিল, যাতে ওরা সুখী হয়।

ত্রিস্তান- সোনালির অরণ্য-জীবনে এই প্রথম অমঙ্গল। নির্বাসিত হয়ে ওরা সুখে ছিল, জীবনে এমন সুখ ওরা আর কখনো পায়নি। খাদ্য নেই, বাসস্থান নেই, পোশাক ছিঁড়ে গেছে, তবু ওরা পেয়েছিল পরম সুখ। এই পথম দেখা দিল অশুভ সঙ্কেত।

ত্রিস্তানকে টেনে তুললো সোনালি। তারপর বনের মাটি খুঁড়ে গরভেনালকে কবর দিয়ে অনেকক্ষণ স্থিরশব্দে বসে কাঁদলো দুজনে।

কিছুদিন পর আবার সরল সুখে দিন কাটছিল ওদের। গ্রীষ্ম কেটে গিয়ে শীত এলো। সমস্ত অরণ্য ঢেকে গেল বরফে। ঝুরঝুর করে সারাদিন বরফ পড়ে। ওদের গরম পোশাক নেই, সাধারণ পোশাকও ছিঁড়ে গেছে। তবু ওদের কোনো কষ্ট নেই, শীত নেই। দুজন দুজনকে আলিঙ্গন করলেই মনে হয়, সমগ্র পৃথিবী উষ্ণ হয়ে গেছে।

শীতের পর আবার বসন্ত এলো। নরম রোদ্দুরে ঝক্‌ঝক্ করতে লাগলো অরণ্যের রাশি রাশি ফুল। ত্রিস্তান, ছেলেবেলা থেকেই একটা বিদ্যে জানতো। পাখিদের অনুকরণ করে ও ঠিক পাখির মতো ডাকতে পারতো। কুটিরের দরজায় বসে বসে ও যখন বনের পাখিদের সঙ্গ গলা মিলিয়ে শিস দিয়ে ওদের মতো গান গাইতো, সোনালি হেসে লুটিয়ে পড়তেন। ত্রিস্তানের ডাক শুনে হাজার হাজার পাখি এসে বসতো ওদের কুটিরের সামনে। রানী মাঝে মাঝে অভিমান করে বলতেন, ত্রিস্তান, তোমার ডাক শুনে শুধু মেয়ে পাখিরাই আসে। ত্রিস্তান, তুমি বুঝি অন্য মেয়ে চাও?

ত্রিস্তান হেসে বলতো, না সোনালি, তোমাকে ছাড়া সারা জীবন আমি অন্য কোনো নারীকে স্পর্শ করিনি। করবোও না।

এবার শুনুন প্রভু, এক অদ্ভুত ঘটনা। একদিন ত্রিস্তান সারাদিন শিকারের জন্য ছোটাছুটি করছিল। হঠাৎ এক সময় ত্রিস্তানের পা মচকে গেল। তখন সে শিকার ছেড়ে ফিরে এলো কুঠিরে।

ত্রিস্তান ফিরে আসতেই সোনালি বললেন, একি ত্রিস্তান, তোমাকে এমন ক্লান্ত দেখাচ্ছে? ত্রিস্তান বললো, সখী, আমার শরীরটা বড় খারাপ লাগছে। আমি একটু শুয়ে থাকি। পোশাক খোলারও তর সইলো না, সেই বারান্দাতেই শুয়ে রইলো ত্রিস্তান। তলোয়ারটা পাশে খুলে রাখলো। যখন সব সময় রাখে, যদি হঠাৎ কোনো বিপদ এসে যায়! রানীও ত্রিস্তানের পাশে শুয়ে ওঁর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। এমন সময় ওঁরা দুজনেই ঘুমিয়ে পড়লেন। রানী আর ত্রিস্তান পাশাপাশি

এদিকে হয়েছে কি, একজন কাঠুরে তার আগের দিন দূর থেকে ত্রিস্তানের কুটির দেখতে পেয়েছিল। ত্রিস্তানকে চিনতে পেরেই সে ভয়ে পালিয়েছে। কিন্তু কথাটা গোপন রাখতেও সে ছটফট করেছে। শেষকালে, সন্ধেবেলা রাজা মার্কের কাছে গিয়ে বললো, মহারাজ, আপনার সঙ্গে একটা গোপন কথা আছে। রাজা আড়ালে গিয়ে যখন কাঠুরের কথা শুনলেন, তখন বললেন, তুমি সেই জায়গা আমাকে চিনিয়ে দিতে পারবে? যদি না পারো, তোমার তাহলে মৃত্যু!

পরদিন, রাজা কারুকে কিছু না বলে অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে একা বেরিয়ে পড়লেন কাঠুরের সঙ্গে। কাঠুরে দূর থেকে দেখিয়ে দিয়েই পালালো। রাজা খোলা তলোয়ার হাতে নিয়ে এগিয়ে এলেন, তাঁর অভিমান-ভরা হৃদয়ে তিনি শপথ করলেন, আজ তিনি বা ত্রিস্তান দুজনের একজন মরব।

সেই সময়ই ত্রিস্তান আর সোনালি পাশাপাশি ঘুমিয়ে আছে। মাঝখানে খোলা তলোয়ার। রাজার মুখ কঠিন হয়ে এলো।

রাজা তলোয়ার তুলে ত্রিস্তানকে খুন করতে গিয়েও হঠাৎ এক মুহূর্ত থেমে গেলেন। হঠাৎ তিনি ভাবলেন, ওরা শুয়ে আছে পাশাপাশি, অথচ মাঝখানে খোলা তলোয়ার কেন? প্রেমিক-প্রেমিকা কি এভাবে শুয়ে থাকে?

ওদের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ রাজার বুক দুলে উঠলো। কতদিন পর তিনি দেখছেন ত্রিস্তান আর সোনালিকে যারা এক সময়ে ছিল তাঁর দু’চোখের দুই মণি। ঘুমন্ত মানুষের মুখ বড় সরল দেখায়। ঘুমন্ত মানুষের ওপর অতি পাষণ্ডও রাগ করতে পারে না। রাজা ভাবলেন, তাহলে ওরা কি নিরপরাধ? আমি আগাগোড়াই ভুল ভেবেছি? এ কথা তো সারা পৃথিবী জানে যে, নারী ও পুরুষের মাঝখানে খোলা তলোয়ার রেখে দেওয়া মানে তাদের সম্পর্ক পবিত্র। ওরা যদি উন্মাদের মতো পরস্পরকে ভালোবেসে থাকে, তাহলে কি শুয়ে থাকবে এ রকম নিষ্পাপ ভঙ্গিতে, পাশাপাশি অথচ দুজন দুজনকে না ছুঁয়ে?

যাই হোক, আমি এখন ওদের খুন করতে পারি না। ঘুমন্ত মানুষকে খুন করলে, জীবনে আমার সে অপবাদ দূর হবে না! আর যদি ত্রিস্তানকে জাগিয়ে দন্দ্বযুদ্ধের জন্য ডাকি…তাহলে…তা হলে, ত্রিস্তান যদি আমার প্রতি শ্রদ্ধাটা দেখিয়ে তলোয়ার না ছোঁয়, তবে, তখন আমি ওকে মারতেও পারব না-

আহা কি চেহারা হয়েছে ওদের! ঐ ত্রিস্তান, যে ছিল আমার রাজ্যের সেরা সুপুরুষ, তার আজ কি হতভাগ্যের মতো দশা! আর এই আয়ার্ল্যান্ডের রাজুমারী, ত্রিস্তান ওকে জয় করে এনেছিল আমারই জন্য! ওর মতো রূপসী এ রাজ্যে কেউ কখনো দেখেনি, সে কিনা শুয়ে আছে শুকনো মাটিতে, ছেঁড়া পোশাকে! ঈশ্বর কাকে কোথায় নিয়ে যান কে জানে! যাক্ তোমাদের যেমন ইচ্ছা থাকো, আমি আর বাধা দেবো না। হয়তো তোমরাই সুখী, আমি স্বার্থপর হয়ে তোমাদের বিঘ্ন ঘটাচ্ছি। থাক, তোমরাই সুখে থাকো। আমি চলে যাই!

রাজা হাঁটু মুড়ে বসে আলতোভাবে সোনালির একটা হাত তুলে নিলেন। কত রোগা হয়ে গেছে! বিয়ের দিন রাজা যে আংটি দিয়েছিলেন, সেটা আঙুলে ঢঢল্ করছে। রাজা আস্তে আস্তে আংটিটা খুলে নিলেন। তারপর, বিয়ের দিন যে আংটিটা সোনালি তাঁকে দিয়েছিলেন, নিজের হাত থেকে সেই আংটিটা খুলে রানীর হাতে ধীরে ধীরে পরিয়ে দিলেন। আংটি বদল হবার পর সোনালির হাতে একবার আলতোভাবে চুমু খেয়ে নামিয়ে রাখলেন হাত। ওদের মাঝখান থেকে তলোয়ারটা তুলে নিলেন এবার। এই সেই ডগা-ভাঙা তলোয়ার, যা দিয়ে ত্রিস্তান মোরহল্টকে হত্যা করেছিল, রাজা চিনতে পারলেন। এই তলোয়ার তাঁর রাজ্যের গর্ব। রাজা ত্রিস্তানের তলোয়ারটা নিজের খাপে ঢুকিয়ে, নিজের মণিমুক্তাখচিত তলোয়ার রেখে দিলেন সে জায়গায়।

রাজা নিঃশব্দে উঠে দাঁড়ালেন। অস্ফুট কণ্ঠে বললেন, বিদায়! তোমরা যদি সুখে থাকতে পারো, থাকো। আমি আর তোমাদের বাধা দেবো না। তারপর রাজা বেরিয়ে গেলেন।

ঘুমের মধ্যে সোনালি স্বপ্ন দেখলেন, দুটো সিংহ যেন তাঁকে পাবার জন্য লড়াই করছে প্রচণ্ডভাবে। ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, জড়িয়ে ধরলেন ত্রিস্তানকে। সোনালির চিৎকার শুনে ধড়মড় করে উঠে বসে তলোয়ার চেপে ধরলো ত্রিস্তান। সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলো, একি! ত্রিস্তান তৎক্ষণাৎ চিনতে পারলো রাজার তলোয়ার। সোনালিও নিজের হাতের আংটির দিকে চেয়ে কেঁদে উঠলেন, ত্রিস্তান, আর রক্ষা নেই। রাজা আমাদের খুঁজে পেয়েছেন।

—রাজা আমার তলোয়ার নিয়ে গেছেন! বোধহয় একা এসেছিলেন, ভয় পেয়ে পালিয়েছেন। আবার ফিরে আসবেন সৈন্যসামন্ত নিয়ে। আমাকে ধরে আবার পুড়িয়ে মারতে চান। চলো সোনালি, আর দেরি নয়, আমাদের পালাতে হবে!

সঙ্গে সঙ্গে উঠে পড়ে ওরা ছুটে পালাতে লাগলো। ছুটতে ছুটতে চলে গেল একেবারে সেই অরণ্যের অন্য প্রান্তে, ওয়েলস্ দেশের সীমানার কাছে।

হায়, ভালোবাসা ওদের আর কত দুঃখ দেবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *