সোনালী দুঃখ – ২

নিজের রাজ্য ছেড়ে ত্রিস্তান চলে এলো কর্নওয়ালে। একমাত্র গুরু গরভেনালই এতদিন পর প্রিয় শিষ্য ত্রিস্তানকে পেয়ে আর ঐ শত্রু যে সে নয়, আয়ার্ল্যান্ডের দুর্ধর্ষ সৈন্যবাহিনী, যাদের অধিপতি স্বয়ং মোরহল্ট। মোরহল্টকে লোকে মানুষ বলে না, বলে দৈত্য, দৈত্যের মতোই চেহারা অস্বাভাবিক লম্বা প্রায় আট ফুট, আর সেই রকম স্বাস্থ্য। দেখলে মনে হয় একটা চলমান পাহাড়। তার বিক্রম আর শক্তির সামনে দাঁড়াতে পারে এমন কেউ নেই।

এর আগে রাজা মার্ক একবার আয়ার্লান্ডের কাছে বশ্যতা স্বীকার করে, প্রতি বছর তিন মণ ওজনের সোনা দিতে রাজী হয়েছিলেন। কিন্তু কয়েক বছর পর আর দেননি। ভেবেছিলেন, আবার ফিরে এদেশ আক্রমণ করার শক্তি আইরীশদের নেই। রাজা মার্ক যুদ্ধ বিগ্রহে নিপুণ নন। তিনি সঙ্গীতপ্রিয়, শান্তিপ্রিয় রাজা। এবারের আক্রমণে তিনি মুহ্যমান হয়ে পড়লেন।

সৈন্য মোরহল্ট আয়ার্ল্যান্ডের রাজার শালা। সে রাজা মার্কের সামনে এসে ভীমের মতন কঠিন বুক ফুলিয়ে বললো, মহারাজ, খুব সোনা ফাঁকি দিয়েছেন। এক বছরের ফাঁকি পরের বছর তা দ্বিগুণ হয়ে যায়। এ তো পাঁচ বছর হয়ে গেল! এবার ইচ্ছে করলে আমি আপনার রাজ্য ধ্বংস করে দিতে পারি। কিন্তু দয়া করে তা দেব না। আমি এবার সোনা-দানা চাই না। আমি এবার চাই চুনী-পান্নার চেয়েও দামী রত্ন। আমি আপনার রাজ্য থেকে তিনশো যুবতী মেয়েকে ধরে নিয়ে যাবো। আমাদের দেশে দাসীর বড় অভাব। তা আপনার দেশের মেয়েরা দাসী হিসেবে মানাবে ভালো! যে কোনো মেয়ে কিন্তু আমি চাই না। আমি নিজে বেছে নেবো। আজ থেকে তিনদিন পর আপনার রাজ্যের সব মেয়ে সকালবেলা এসে যার যার বাড়ির সামনে দরজার কাছে দাঁড়াবে রাজবাড়ি, মন্ত্রীবাড়ি, সেনাপতিবাড়ি, সব বাড়ির মেয়েরা। আমি একজন একজন করে বেছে নেবো। তিনশো মেয়ে!

অথবা…এবার দৈত্য মোরহল্ট অট্টহাসি করে উঠলো। অথবা, আমি কিছুই করবো না, আপনার রাজ্য ছেড়ে আমার সৈন্যরা চলে যাবে কিছুই না নিয়ে, যদি আপনার রাজ্যের কোনো বীরপুরুষ একা যুদ্ধ করে আমাকে হারাতে পারে। কি, আছে কেউ সে রকম বীর? তিন দিন সময় দিলাম, যা ঠিক করার ভেবে নিন। হয় যুদ্ধ, নয় তিনশোজন দাসী!

অধোবদন রাজা চুপ করে রইলেন। তারপর ডেকে পাঠালেন মন্ত্রী, সেনাপতি, রাজ্যের সব সম্ভ্রান্ত লোকদের। অপমানে বিবর্ণ মুখে তাঁদের সামনে মোরহল্টেন সব কথা বর্ণনা করে জিগ্যেস করলেন, আপনাদের মধ্যে কে আজ মোরহল্টের সঙ্গে যুদ্ধে রাজী। কে আজ দেশের সম্মান বাঁচাতে এগিয়ে আসবেন? আমি রাজা, আমারই এগিয়ে যাওয়া উচিত। কিন্তু আমি স্বীকার করছি, আমার সে শক্তি নেই।

সভাসদরা সকলে চুপ! সকলেই মনে মনে বলতে লাগলেন, হায়, হায়, কে যাবে? মোরহল্টের ঐ চেহারা, ওর ক্ষমতা আর তেজের কথা কে না জানে? ওর সামনে যে যাবে তাকেই তো প্রাণ দিতে হবে। প্রাণ দিতে পারি কিন্তু তাতে তো উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে না, দেশের সম্মান বাঁচবে না। তবে শুধু প্রাণ দিয়ে লাভ কি?

রাজা আবার জিগ্যেস করলেন কম্পিত গলায়, বলুন, কে যাবেন? সভাসদরা তখনও চুপ। মনে মনে তাঁরা কেঁদে বলতে লাগলেন, আমাদের মেয়েদের কি এতদিন মানুষ করলুম পরদেশে গিয়ে দাসী-বাঁদী হবার জন্যে? মেয়েগুলোর মুখ মনে করতে গেলেই বুউক মুচড়ে ওঠে। ওদেশে নিয়ে গিয়ে কত অত্যাচার করবে কে জানে! পিতা হয়ে নিজের মেয়েকে এইভাবে ত্যাগ করতে হবে? নিজের প্রাণ দিয়ে ও তো তাদের বাঁচাতে পারবো না।

রাজা তৃতীয়বার জিগ্যোস করলেন, আপনাদের মধ্যে কেউ এগিয়ে কি আসবেন না?

সভাসদরা তখনও নিরুত্তর। রাজা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, তবে আমাদের সব মেয়েদের বিষ খাইয়ে মেরে ফেলা হোক!

একজন সভাসদ হাহাকার করে উঠলেন, মহারাজ, তা কি করে হয়? নিজের সন্তানদের কি করে বিষ খাওয়াবো? তা ছাড়া, তাতেও কি মোরহল্টের রাগ কমবে? সে রাজ্য ধ্বংস করে দিয়ে যাবে!

রাজা বললেন, এ ছাড়া আর কি উপায় আছে, বলুন? মোরল্টের সঙ্গে একা যুদ্ধ করতে পারে এমন কেউ নেই যখন-

এই সময় ধীর পদে এগিয়ে ত্রিস্তান রাজার পায়ের কাছে হাঁটু গেড়ে বসে শান্ত গলায় বললো, রাজা, আপনি অনুমতি দিলে আমি একবার চেষ্টা করতে পারি।

—ত্রিস্তান তুমি! না, না, তোমাকে আমি ছাড়তে পারবো না। তোমার এই তরুণ বয়েস, না ত্রিস্তান, তুমি না!

—না মহারাজ, আপনি অনুমতি দিন। আমি মনে মনে ঠিক করে ফেলেছি, এখন মোরহল্টের মুখোমুখি একবার অন্তত না দাঁড়ালে আমার আর কোনোদিন রাত্রে ঘুম হবে না! কোনো কিছু একবার ঠিক করলে, আমি তার শেষ দেখতে চাই!

রাজা দেখলেন ত্রিস্তানের শান্ত মুখে দৃঢ়প্রতিজ্ঞা। রাজা অনুমতি দিলেন। রাজার হৃদয় তখন গ্রীষ্মকালের দীঘির মতো, উপরের জল গরম, নিচের জল ঠাণ্ডা। একদিকে ত্রিস্তানের এই অসীম সাহসের জন্য রাজার গর্ব, অন্যদিকে ত্রিস্তানকে হারাবার ভয়।

ঠিক হলো একটু দূরে একটা দ্বীপে যুদ্ধ হবে। দু’পক্ষের যোদ্ধাই যাবে একা। যুদ্ধে জয়ী হয়ে দুজনের মধ্যে একজনই শুধু ফিরে আসবে। অস্ত্রে বর্মে সজ্জিত হয়ে ত্রিস্তান একটি ছোট নৌকোয় চেপে চললো সেই দ্বীপের দিকে। তার সেই সুকুমার তরুণ মূর্তি দেখে রাজ্যের প্রতিটি লোক মনে মনে বলে উঠলো, হায় হায়, ত্রিস্তানকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেবার আগে আমরা নিজেরা কেন মরলুম না! রাজ্যের লোক ভেঙে পড়েছে সমুদ্রের পাড়ে।

ত্রিস্তান সেই দ্বীপে পৌছবার সঙ্গে সঙ্গে মোরহল্টও তার বিশাল পাল তোলা বিলাস নৌকো নিয়ে উপস্থিত হলো। ত্রিস্তান নিজের নৌকোটা ঠেলে ভাসিয়ে দিল জলে। তখন মোরহল্ট বিদ্রূপের সঙ্গে বললো, ওকি হে ছোকরা, নৌকোটা ভেসে গেল যে! পাড়ে বেঁধে রাকলে না? ভয়ে এখনই হাত কাঁপছে বুঝি?

ত্রিস্তান সরলভাবে হেসে বললো, বাঃ, বুঝতে পারলেন না? ফেরার সময় তো আমরা একজনই ফিরবো। একটার বেশি দুটো নৌকো লাগবে কিসে? আসুন, বরং দেরি না করে, শুরু করা যাকে।

সে যুদ্ধ কেউ দেখেনি। তবে তিনবার সেই দ্বীপ থেকে বিকট আওয়াজ ভেসে এসেছিল-সেই আওয়াজে রাজ্যের লোকের বুক কেঁপেছে আর মোরহন্টের সৈন্যদের মধ্যে উঠেছে জয়ধ্বনি। মোরহল্ট শক্তিমান, ত্রিস্তান ক্ষিপ্র। এ যুদ্ধ পশু-শক্তির বিরুদ্ধে মানুষের আত্মবিশ্বাসের।

প্রায় দু ঘণ্টা পর দ্বীপ থেকে একটা নৌকো ভেসে আসতে লাগলো। পাল তোলা বিশাল নৌকো। তা দেখে সমুদ্রপাড়ের লোকেরা বিষাদে আর্তনাদ করে উঠলো, হায়, হায়, মোরহল্টের নৌকো, মোরহল্ট জিতেছে! নৌকো যখন আরও একটু সামনে এলো, দেখা গেল ছাদের ওপর একজন নাইট দাঁড়িয়ে আছে। দু’হাতে দু’খানা তরবারি। লোকে চিনতে পারলো, ত্রিস্তান!

তখন সে উল্লাসের তুলনা হয় না! দেশের মুখরক্ষা করেছে তাদের প্রিয় ত্রিস্তান। শুধু তাহি নয়, অতবড় বীরপুরুষ মোরহল্টকে হত্যা করে আশাতীত কীর্তি স্থাপন করছে। অসংখ্য লোক ঝাঁপিয়ে পড়লো, সাঁতরে তার নৌকো আগে নিয়ে আসবে।

রাজ্যের সমস্ত লোক এলো ত্রিস্তানকে অভিনন্দন জানাতে। সমস্ত তরুণী মেয়েরা ছুটে এলো ত্রিস্তানকে চুম্বন দিতে। সবাইকে থামিয়ে দিয়ে, একটা হাত তুলে ত্রিস্তান বললো, আপনারা শুনুন, মোরহল্ট সত্যিই বীরের মতো যুদ্ধ করেছে। এই দেখুন আমার তলোয়ার, এর আগা ভেঙে মোরহল্টের মাথার মধ্যে ঢুকে গেছে। আয়ার্ল্যান্ডের সৈন্যদের বলুন, আমাদের দেশ থেকে সেই তলোয়ারের টুকরোটাই উপহার নিয়ে এবার ওরা ফিরে যাক।

তারপর ত্রিস্তান চললো রাজার সঙ্গে দেখা করতে। পথের দু’পাশ দিয়ে অসংখ্য ফুল এসে পড়ছে তার মাথায়। হাজার হাজার যুবক-যুবতী চিৎকার করে ডাকছে তার নাম ধরে। কিন্তু ত্রিস্তান যেন কিছুটা উদাসীন। কোনো দিকে তার দৃষ্টি নেই। রাজার সামনে এসে ত্রিস্তান বললো, মহারাজ, আমি এ দেশের সম্মান রাখতে পেরেছি তো? মহারাজ, আমি আপনার…এই কথা বলতে বলতেই ত্রিস্তান ধপ করে পড়ে গেল রাজার বুকের ওপর। সারা শরীর তার রক্তে রক্তময়। রাজা দেখলেন ত্রিস্তান অজ্ঞান হয়ে গেছে।

মোরহল্টের সৈন্যরা, শপথ অনুযায়ী বিনা যুদ্ধে রাজ্য ছেড়ে চলে গেল। সঙ্গে নিয়ে গেল দৈত্যাকার মোরহল্টের মৃতদেহ। আয়ার্ল্যান্ডের রানী-ঐ মোরহল্টের আপন বোন। অন্যবার রানী আর রাজকুমারী বীর মোরহল্ট যুদ্ধ থেকে ফিরলে সেবা শুশ্রূষা করে শরীরের ক্ষত সারিয়ে তোলেন, কারণ রানী আর রাজকুমারী অনেক রকম বুনো ওষুধ-পত্তর জানেন, কিন্তু এবার শত ওষুধ লাগিয়েও কিছু হলো না। মৃত্যু মৃত্যুই, তার আর চিকিৎসা হয় না। মৃত মোরহল্টের মাথায় বিঁধে রয়েছে সেই তলোয়ারের ভাঙা টুকরোটা। রাজকুমারী সেটা খুলে যত্ন করে রেখে দিলেন একটা হাতির দাঁতের বাক্সে। তারপর দুজনে প্রাণ উড়াজ করে কাঁদতে লাগলেন মোরহল্টের জন্য। সেই সঙ্গে তাঁরা অভিসম্পাত দিতে লাগলেন মোরহল্টের হত্যাকারী ত্রিস্তানকে। লিওনেসের ত্রিস্তানের নাম সেদিন থেকে হলো রানী ও রাজকুমারীর দু’কানের বিষ। রানী ঘোষণা করলেন, ত্রিস্তানের মৃত্যুসংবাদ যে আনতে পারবে, তাকে রানী নিজের গলার মুক্তামালা উপহার দেবেন।

এদিকে ত্রিস্তানও তখন মৃত্যুমুখে। তার শরীরের প্রত্যেকটি ক্ষতে দগদগে ঘা হয়ে গেল। সেখান থেকে অনবরত ঝরছে পুঁজ আর রক্ত। ডাক্তার কবিরাজ এসে বললে, নিশ্চয়ই মোরহল্টের তলোয়ারে বিষ মাখানো ছিল। তাদের হাজার ওষুধেও ত্রিস্তানের ক্ষত সারলো না। বরং তার সারা শরীর ফুলে পচে বিশ্রী গন্ধ বেরুতে লাগলো। ত্রিস্তানের ক্ষতের গন্ধ এমন জঘন্য যে কেউ আর তার সামনে থাকতে পারে না। শুধু গুরু গরভেনাল, রাজা মার্ক এবং দিনাস নামে এক জমিদার ত্রিস্তানের পাশে থাকতেন-দুর্গন্ধ সহ্য করেও। কারণ, ওঁদের ভালোবাসা ঘৃণাকে জয় করতে পেরেছিল।

কিন্তু ত্রিস্তান বুঝতে পারলো, লোকে তাকে করুণা করছে। বহু লোক তাকে দেখতে এসে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে নাকে রুমাল চাপা দেয়। রাজা যখন পাশে বসে থাকেন, তখনও তাঁর মুখ অবিকৃত। কিন্তু ত্রিস্তান বুঝতে পারে তিনি নিজেই টলতে টলতে অতিকষ্টে চুপি চুপি বেরিয়ে এলো দুর্গ থেকে, তারপর সমুদ্রের পাড়ে গিয়ে প্রায় গড়াতে গড়াতে এলো জলের কিনারায়। তখন রাত্রির অন্ধকার, কোথাও কেউ নেই, ক্ষতস্থানে বালি লেগে অসহ্য যন্ত্রনা হচ্ছে ত্রিস্তানের। নিজেকে তার চরম অসহায় ও একা লাগলো। ত্রিস্তান কেঁদে ফেললো। অভিমান নিয়ে একবার ভাবলো, এই দেশেরই সম্মান বাঁচাবার জন্য আমি মৃত্যুর মুখে গিয়েছিলাম, অথচ আজ আমি একা। এ দেশের কেউ আমার সঙ্গে নেই। রাজা মার্ক আমাকে ত্যাগ করতে চান? না, না, এখনও তিনি আমাকে ভালোবাসেন, আমার জন্য প্রাণও দিতে পারেন, কিন্তু প্রাণের বিনিময়েও তো প্রাণ পাওয়া যায় না। যাক্, আমাকে মরতেই হবে। আর আমার উপায় নেই। তা হলে এখানে থেকেই সূর্যোদয় বা সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে মরি। বন্ধ ঘরে শুয়ে শুয়ে মরার চেয়ে সে মৃত্যু আমার অনেক ভালো। অথবা আত্মহত্যা করলে কেমন হয়? এই জলের মধ্যে ঝাপিয়ে পড়ে? কিংবা এই সময়ে তার মাথায় অন্য চিন্তা এলো। বরং জলে ভাসতে ভাসতে আমি চলে যাই-যেদিন মৃত্যু আসবে সেদিন মরবো, লোকচক্ষুর আড়ালে।

খানিকক্ষণবাদে রাজা মার্ক দলবল নিয়ে ত্রিস্তানকে খুঁজে পেলেন। ত্রিস্তান বললো, মহারাজ, আমি আর বাঁচবো না, বুঝতে পেরেছি। আমাকে ছোট নৌকোয় করে জলে ভাসিয়ে দিন। রাজা বললেন, ত্রিস্তান, তুমি কেন অভিমান করে আমাকে ছেড়ে যেতে চাও! আমি নিজের প্রাণের বিনিময়েও তোমাকে বাঁচাবো। অথবা, দুজনেই মরবো একসঙ্গে!

কিন্তু ত্রিস্তান বারবার নৌকোর কথা বলতে লাগলো। নৌকোয় ভাসতে ভাসতেই সে মরতে চায়! সে নৌকোয় দাঁড় থাকবে না, কারণ ত্রিস্তানের বাইবার ক্ষমতা নেই। পাল থাকবে না- কারণ সে পাল গুটোতে পারবে না। অস্ত্র থাকবে না- কারণ অস্ত্র ধারণক্ষমতা আর তার নেই। থাকবে শুধু বীণা, সে ভাসতে ভাসতে চলে যাবে বীণা বাজিয়ে।

তাই চলে গেল ত্রিস্তান। ছোট্ট ডিঙি নৌকোয় চেপে সে মৃত্যুর দেশে যাত্রা করলো। সাত দিন সাত রাত্রি ধরে ভেসে চললো নৌকো। তারপর ঠেকলো এসে এক অজানা দেশের পাড়ের কাছে। জেলেরা মাছ ধরছিল, হঠাৎ শুনতে পেল টুং টাং শব্দ। একটা নৌকোয় একটা মরা মানুষ, অথচ বীণা বাজছে। আসলে ত্রিস্তান তখনও মরেনি, আর একটু পরেই মৃত্যু হবে কিন্তু একটা হাত তবু বীণায় শেষ সুর তোলার চেষ্টা করছে।

জেলেরা প্রথমে ভেবেছিল বুঝি অলৌকিক কিছু। প্রথমে ভূতের ভয় পেয়েছিল তারা। তারপর একটু একটু করে এগিয়ে এসে ত্রিস্তানের অবস্থা বুঝতে পেরে মায়া হলো ওদের। ওরা ধরাধরি করে ত্রিস্তানকে নিয়ে গেল সামনের দুর্গে। সেখানে রানী ও রাজকুমারী আছেন। ওরা নানা রকম ওষুধ জানেন, যদি এই বিদেশীকে দয়া করেন। যদিও রানী ও রাজকুমারী তখন শোকে ডুবে আছেন!

ভাগ্যের কি পরিহাস। এরাই আয়ার্ল্যান্ডের রানী ও রাজকুমারী, মোরহল্টের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়া। ওদের কাছে এসে পৌঁছলো মোরহল্টের হত্যাকারী ত্রিস্তান। কিন্তু তখন ত্রিস্তানকে চেনার কোনো উপায় নেই। মোরহল্টের সৈন্যরাও তাকে চিনতে পারবে না। এমন মুমূর্ষু বিকৃত চেহারা হয়েছে তার।

রাজকুমারী জানতেন নানারকম লতাপাতার ওষুধ। মুমূর্ষ বিদেশীকে দেখে দয়া হলো, তিনি তাকে ওষুধ দিয়ে বাঁচিয়ে তুললেন। অথচ তিনি যদি জানতেন ওর সত্যিকারের পরিচয়, তবে ওষুধের বদলে বিষ দিয়ে মেরে ফেলতেন নিশ্চয়।

সাতদিন পর জ্ঞান হলো ত্রিস্তানের। কোথায় সেই সমুদ্রের কল্লোল, তার বদলে সে শুয়ে আছে দুধের ফেনার মতো নরম বিছানায়। মাথার কাছে এক পরমাসুন্দরী কুমারী। কিন্তু অল্পক্ষণের মধ্যেই ত্রিস্তান বুঝতে পারলো, সে এসেছে শত্রুপুরীতে। তাকে বাঁচতে হবে। ত্রিস্তানের শরীর দুর্বল, কিন্তু বুদ্ধি নষ্ট হয়নি। চট্ করে সে বানিয়ে গল্প বললো, সে একজন পর্যটক, স্পেনে যাচ্ছিল নক্ষত্রবিদ্যা শিখতে, জলদস্যুরা জাহাজ আক্রমণ করার পর অতিকষ্টে সে ছোট নৌকোয় চড়ে পালাতে চেয়েছিল।

ত্রিস্তানের মধুর গলার আওয়াজ শুনে রাজকুমারী তার কথা বিশ্বাস করলেন। সুন্দর মুখে সকালের আলোর মতো হাসি হেসে বললেন, আচ্ছা বিদেশী, তোমাকে আমি সম্পূর্ণ সুস্থ করে দেবো। কিন্তু তার বদলে তুমি কি দেবে আমায়?

ত্রিস্তান বললো, রাজকুমারী, আমি তো নিঃস্ব। আপনাকে প্রতিদান দেবার মতো আমার কিছুই নই।

চাপা হাসির সঙ্গে রাজকুমারী বললেন, যতদিন প্রতিদান না দিতে পারো তুমি এখানেই থাকো। তোমার যদি অন্য দেশ না থাকে, তুমি এদেশেই থেকে যাও না চিরকাল! রাজকুমারীর অপরূপ, উজ্জ্বল মুখের দিকে তাকিয়েও ভয়ে ত্রিস্তানের বুক কাঁপতে লাগলো। তার সত্য পরিচয় শুনলে, এই সুন্দর মুখও এই মুহূর্তে ভয়ংকরভাবে বদলে যাবে। না, তার এখানে থাকা হবে না। এই মধুর হাতের সেবা ছেড়েই তাকে চলে যেতে হবে। তার নিজের মুখের আসল চেহারা ফিরে আসার আগেই। সম্পূর্ণ সুস্থ হবার আগেই চলাফেরা করার একটু ক্ষমতা যেই পেল ত্রিস্তান, ধরা পড়ার ভয়ে গোপনে পালিয়ে এলো সেখান থেকে। রাজকুমারী তখন ঘুমিয়ে, শেষবার ত্রিস্তান তাঁর ঘুমন্ত মুখের দিকে চেয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে এলো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *