৩
রাজা মার্কের রাজ্যে এখন নিরবচ্ছিন্ন সুখ। দেশ শত্রুমুক্ত, ত্রিস্তান ফিরে এসেছে। রাজা মুগ্ধ হয়ে ত্রিস্তানের বীণার বাজনা শোনেন।
কিন্তু হুজুর, আপনারা জানেন, দিনের আলোয় যখন সারা দুনিয়াটা ঝমক্ করে, তখনও মানুষের ছায়া পড়ে। জীবন কখনও সরল পথে চলতে জানে না! যতই আলো থাক্, তার মধ্যেও ছায়া থাকবে। রাজা মার্কের রাজ্যে সবাই ত্রিস্তানকে ভালোবাসে, শুধু চারজন নাইট ছাড়া। এই চারজনই রাজার একটু একটু আত্মীয়, আগে ছিল রাজার প্রিয়পাত্র, এখন ত্রিস্তান এসে সে জায়গা কেড়ে নিয়েছে। সুতরাং ত্রিস্তানের ওপর ওদের ঈর্ষা হবে-এ তো মানুষেরই ধর্ম।
এ চারজন সারা রাজ্যে ফিসফিস গুজগুজ করে রটাতে লাগলো যে, ত্রিস্তান একজন যাদুকর। নইলে এরকম অসম্ভব অলৌকিক ঘটনা একটা মানুষের জীবনে বারবার ঘটে কি করে? মোরহল্টের মতো অমন একজন দৈত্যের মতো বীরপুরুষকে মারলো সেটাই আশ্চর্যের কথা। তারপর ওরকম মুমূর্ষু অবস্থায় সমুদ্রে ভাসিয়ে দেওয়া হলো-তবু বেঁচে ফিরে এলো কি করে! রাজার ছেলেপুলে নেই, শেষ পর্যন্ত ত্রিস্তানকেই হয়তো যুবরাজ করবেন। শেষ পর্যন্ত দেশটা চলে যাবে যাদুকরের হাতে। সে যুগের মানুষ মায়াবী বা যাদুকরের নাম শুনলেই ভয় পেতো! কত মেয়েকে ডাইনী মনে করে পুড়িয়ে মেরেছে আপনারা জানেন! হা কপাল, ডাইনীই যদি হবে, তবে সে পুড়ে মরবে কেন?
তখন তারা ধরে পড়লো রাজাকে বিয়ে করতে হবে। রাজার একটি বংশধর চাই। রাজা এ কথাতে কান দিতে চান না। অথচ সেই নাইট চারজন প্রত্যেকদিন রাজসভায় এসে এ-কথা বলতে লাগলো।
যেদিন ত্রিস্তান বুঝতে পারল ঐ নাইট চারজনের উদ্দেশ্য কি, তখনই লজ্জায় তার মরে যেতে ইচ্ছে হলো। ছি, ছি, তাকে এত নীচ ভাবে ওরা! সে কি নিজের রাজ্য ছেড়ে দিয়ে আসেনি? রাজা মার্ককে যে সে ভালোবাসে, সে কি রাজ্যের লোভে? তখন ত্রিস্তান রাজাকে জোর করতে লাগলো বিয়ে করার জন্য। নইলে ত্রিস্তান রাজ্য ছেড়ে চলে যাবে। রাজ্যের লোকের সন্দেহের কারণ সে হতে চায় না।
রাজা মার্ক দেখলেন মহা মুশকিল। কিছুতে এড়িয়ে যাওয়া যায় না। ত্রিস্তান থাকতে তাঁর আর পুত্রের দরকার কি! কিন্তু হঠাৎ উপায় পেয়ে গেলেন। একদিন তিনি স্নান করছেন, এমন সময় জানলায় দুটো দোয়েল পাখি উড়ে এসে বসলো। তারপর ফুরুত করে উড়ে যাবার সময় মুখ থেকে একগাছি সোনালি চুল ফেলে গেল একটা পাখি। রাজা তুলে দেখলেন সাধারণ সোনালি চুল নয় ঠিক যেন সোনার পাতলা সুতো—সেই রকম রং, সেই রকম উজ্জ্বলতা, অথচ চুল যে তাও অবিশ্বাস করা যায় না।
রাজা সেই চুলটা এনে রাজসভায় বললেন, আমি বিয়ে করতে পারি একটি মাত্র মেয়েকে। সে কোথায় আছে আমি জানি না। কিন্তু এই তার মাথার চুল। একে তোমরা খুঁজে দিতে পার তো বিয়ে করবো! এমন মুচকি হাসলেন রাজা, যার মানে, কেমন জব্দ করেছি তোমাদের! এরকম মেয়ে তো আর কোথাও পাবে না কেউ!
এ কথায় নাইটরা সবাই কালো মুখে ত্রিস্তানের দিকে তাকালো। সকলেই ভাবলো, এ নিশ্চয়ই ত্রিস্তানের কারসাজি। ত্রিস্তানই রাজাকে এই পরামর্শ দিয়েছে তাদের ঠকাবার জন্য।
সেই সোনালি চুলটা দেখে ত্রিস্তানের যেন অস্পষ্টভাবে একটা ছবি মনে পড়লো। একটি প্রস্ফুটিত সুন্দর মুখ, দুটি হ্রদের মতো গভীর চোখ আর এক মাথা সোনালি চুল। তার শিয়রের পাশে বসেছিল। হ্যাঁ মনে অরছে, সে যখন মাথা দুলিয়ে হেসেছিল, তখন ঝিলমিল সোনালি চুলের গুচ্ছ কেঁপে উঠেছিল শরৎকালে সোনাঝুরি গাছের মতন! স্বপ্নের মতো মনে পড়ে ত্রিস্তানের সেই মুখ। সেই কন্যা তাকে তাঁর রাজ্যে থাকতে বলেছিলেন। তাঁর চাঁপার কলির মতো আঙুল বুঝিয়েছিলেন ত্রিস্তানের কপালে।
ত্রিস্তান যেন ঘুম ভেঙে উঠে বললে, রাজা, আমি জানি কোথায় আছে সেই কন্যা। কিন্তু সে যে আমার পক্ষে বড় ভয়ঙ্কর দেশ। আমি সেখানে গেলে বোধহয় প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারবো না। তবু আমাকে যেতেই হবে। নইলে আপনার নাইটরা ভাববে, আমি আপনার সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে সোনালি চুলের কথা বলেছি। আপনি আশীর্বাদ করুন, আমি এবারও যেন জয়ী হয়ে ফিরে আসতে পারি।
সঙ্কটের মধ্যে পড়ে রাজার শরীর কাঁপতে লাগলো। তাঁর মুখে ভাষা নেই। ত্রিস্তান নতজানু হয়ে রাজার সামনে বসে বললো, মহারাজ, যদি শেষ পর্যন্ত প্ৰাণ থাকে, আমি সেই রাজকন্যাকে জয় করে এনে আপনার হাতে সঁপে দেবো। এই আমার শপথ!
ত্রিস্তান একশোজন বাছা বাছা সৈন্য সঙ্গে নিয়ে একটা বিরাট জাহাজ সাজালো। সঙ্গে নিল প্রচুর খাদ্য ও মদ, মধু, রেশমী পোশাক, জরির কিংখাব। সৈন্যদের সাজালো ব্যবসায়ীর বেশে। তারপর জাহাজ ছেড়ে দিলো।
দু’দিন যাবার পর সৈন্যরা জিগ্যোস করলো, প্রভু, আমরা কোন দেশে যাচ্ছি?
—আয়ার্ল্যান্ড! সোজা হোয়াইটহ্যাভেন বন্দরের দিকে জাহাজ চালাও।
—আয়ার্ল্যান্ড? সে কি? সৈন্যরা ভয়ে কাঁপতে লাগলো। ত্রিস্তানের কি মাথা খারাপ হয়েছে? এই সেদিন মোরহল্টকে হত্যা করার পর আয়ার্ল্যান্ডের সৈন্যরা অপমানে ফিরে গেছে। এখন ত্রিস্তানকে হাতে পেলে ওরা ছিঁড়ে ফেলবে না? তাও ত্রিস্তান যাচ্ছে মাত্র একশোজন সৈন্য সঙ্গে নিয়ে?
—ভয় কি, আমরা তো যাচ্ছি ছদ্মবেশে! বুকে যদি সাহস থাকে কেউ ছদ্মবেশ ছিঁড়তে পারবে না।
আয়ার্ল্যান্ডের বন্দরে এসে জাহাজ ভিড়লো। সবাই জানলো দূর দেশ থেকে একটা বাণিজ্য জাহাজ এসেছে। অবশ্য এ জাহাজের বণিকরা একটু অদ্ভুত ধরনের। ব্যবসায়ে বিশেষ মন নেই, দিনরাত তাশ পাশা খেলে কাটায়। দিন কাটতে লাগলো, ত্রিস্তান রাজবাড়িতে যাবার কোনো সুযোগ পেল না। কিছুটা অভিমান ও ঝোঁকের মাথায় সে চলে এসেছে, কিন্তু জানে না কি করে শত্রুপুরীর রাজকন্যাকে জয় করবে। কোনো উপায় সে ভেবে পায় না।
হঠাৎ এক সকালে সুযোগ এলো। ভোরবেলা ত্রিস্তান বন্দরের পাড় দিয়ে হাঁটছে, হঠাৎ পালাও রব উঠলো। লোকজন ছুটে পালাতে লাগলো, একজন অশ্বারোহী ভীত মুখে পালিয়ে গেল ঝড়ের বেগে। ত্রিস্তান একজন পলায়মানা রমণীর হাত চেপে ধরে বললো, কি ব্যাপার, পালাচ্ছেন কেন? কি হয়েছে?
রমণী কাতরস্বরে বললো, আমায় ছেড়ে দাও, তোমার পায়ে পড়ি।
—কেন পালাচ্ছেন, না বললে কিছুতেই ছাড়বো না।
—তুমি জানো না? ড্রাগন এসেছে। রোজ এসে শহর থেকে একটা করে মেয়ে ধরে নিয়ে গিয়ে খায়। আজ একেবারে ভিতরে ঢুকে পড়েছে।
—ঠিক আছে, ভয় নেই। আমি যাচ্ছি ওটাকে আটকাতে। -খবরদার, ওরকম মূর্খোমি করো না। তুমি পাগল নাকি! –কেন, ওকে মারা কি মানুষের পক্ষে অসম্ভব?
—তা জানি না, তবে এটুকু জানি কুড়িজন নাইট ওকে মারতে গিয়ে নিজেরাই মরে গেছেন। এদেশের রাজা ঘোষণা করেছে, যে ওটাকে মারতে পারবে, তার সঙ্গেই রাজকুমারীর বিয়ে দেবেন।
একথা শুনে ত্রিস্তান হাসলো। হারলে মৃত্যু জিতলে রাজকুমারী। এই তো সে চেয়েছিল! তারপর জাহাজে ফিরে বর্মে সজ্জিত হয়ে আবার বেরিয়ে এলো। সব লোক যেদিক থেকে ছুটে পালাচ্ছে ত্রিস্তান একা এগিয়ে গেল সেদিকে সাদা ঘোড়ায় চড়ে। তার তরুণ মুখে কোনো ভয়ের চিহ্ন নেই। একটু পরে ত্রিস্তান জানোয়ারটাকে দেখতে পেল। মুখটা শুয়োরের মতো জ্বলন্ত কাঠকয়লার মতো দুটো চোখ, সিংহের মতো থাবা, কিন্তু শরীরটা কুমীরের। এই সেই ভয়ংকর ড্রাগন। ত্রিস্তান সোজা ঘোড়া চালিয়ে গিয়ে বর্শা দিয়ে আঘাত করলো ওকে। ঠক্ করে লেগে বর্শাটা ভেঙে গেল, হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল ঘোড়াটা। ত্রিস্তান তখন খোলা তলোয়ার হাতে দাঁড়ালো। ড্রাগনটা এগিয়ে আসতেই ত্রিস্তান তলোয়ার চালালো, কিন্তু ঠাস করে শব্দ হলো শুধু, একটুও আঘাত লাগল না ওর। ড্রাগনটা থাবা মেরে ত্রিস্তানের বর্ম ধরে টান মারতেই, বর্মটা সামনের দিকে খানিকটা ভেঙে গেল। ত্রিস্তানের বুক তখন উন্মুক্ত। এবার শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে তলোয়ার চালালো ত্রিস্তান, কিন্তু বৃথাই, জন্তুটার শরীর যেন ইস্পাতের তৈরি। জন্তুটা নাক দিয়ে এমন আগুনের হল্কা ছাড়লো যে বুকের কাছটা সম্পূর্ণ ঝলসে গেল ত্রিস্তানের। ত্রিস্তান বুঝলো সে আর দাঁড়াতে পারবে না। কিন্তু মরার আগে প্রতিশোধ নিয়ে যাবে না? আর এক পা সামনে এগিয়ে এলো ত্রিস্তান। ড্রাগনটা এবার হাঁ করে ওকে গিলতে এলে, ত্রিস্তান সোজা তলোয়ার চালিয়ে দিল ওর মুখের মধ্যে। সেই এক আঘাতেই জন্তুটার হৃদপিন্ড চিরে গেল। বিকট চিৎকার করে পড়ে গেল জন্তুটা। ত্রিস্তান ও তখন টলছে। নিচু হয়ে ওটার জিভটা কেটে নিয়ে নিজের মোজার মধ্যে রাখলো। তারপর কয়েক পা এগিয়ে আসতেই হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল ত্রিস্তান। গড়াতে গড়াতে নিচের ঝোপে গিয়ে আটকালো। জন্তুটার বিষ নিঃশ্বাসে ত্রিস্তানের বুক পুড়ে গেছে।
প্রথমেই ত্রিস্তান ঝড়ের বেগে যে অশ্বারোহীকে পালাতে দেখেছিল, সে হচ্ছে লাল-চুলো নাইট। তার মাথার চুল লাল বলে লোকে তাকে লাল-চুলো বলে। লোকটা নাইট হলেও, ভীতুর ডিম আর লোভী। রাজকুমারীকে বিয়ে করার খুব ইচ্ছে ওর, রোজই একবার ড্রাগনটাকে মারার জন্যে সেজেগুজে আসে, তারপর ড্রাগনটার প্রথম ডাক শুনেই পালিয়ে যায়। আবার পরের দিন আসে। ভালোবাসার এমনই টান যে কাপুরুষকেও দুঃসাহসী হতে লোভ দেখায়! সেদিন হঠাৎ কি হলো, প্রথমবার পালিয়ে যাবার পর লাল-চুলোর মনে অনুতাপ এলো। রোজই এরকম পালিয়ে যাওয়া? নাঃ, আজ একটা হেস্তনেস্ত হয়ে যাক্, হয় ড্রাগন মরুক নয় আমি মরি।
লাল-চুলো ফিরে এসে দেখে ড্রাগনটা মরে পড়ে আছে, আশেপাশে আর কেউ নেই। তখন আনন্দে সে একা একাই একটু নেচে নিলো! সে ভাবলো, ভগবানই বুঝি তার হয়ে ড্রাগনটাকে মেরেছেন। লাল-চুলো তখন তাড়াতাড়ি এসে পুচিয়ে পুচিয়ে ড্রাগনটার মাথা কেটে ফেললো, তারপর সেই ছিন্নমুণ্ড হাতে নিয়ে ছুটতে ছুটতে রাজার কাছে গিয়ে বললো, কই মহারাজ, এবার রাজকুমারীকে ডাকুন।
আয়ার্ল্যান্ডের রাজকুমারীর নাম সোনালি চুল ইসল্ট। অনেকে তাঁকে ডাকে সোনালি চুল বলে, অনেকে ডাকে শুধু সোনালি। রাজকন্যা সোনালি যখন শুনলেন ঐ ভীতুর ডিম লাল-চুলো নাইটই ড্রাগনকে মেরেছে এবং সে-ই তাকে বিয়ে করবে-তখন তিনি হাসতে হাসতে আর বাঁচেন না। তারপর নিজের দুর্ভাগ্যের কথা ভেবে হাসতে হাসতেই কাঁদতে লাগলেন। ঐ লাল-চুলো মেরেছে ঐ ড্রাগন। সূর্য তো পশ্চিম দিকে ওঠেনি। পাখিরা তো বোবা হয়ে যায়নি। সমুদ্র তো নিস্তব্ধ হয়নি, হঠাৎ, তবু এই অসম্ভব কাণ্ড হলো কি করে? নিশ্চয়ই কোনো জোচ্চুরি আছে! রাজকন্যা ঠিক করলেন, সখীদের সঙ্গে নিয়ে তিনি গোপনে মরা ড্রাগনটা দেখে আসবেন।
ড্রাগনের পাশে একটা গোড়া মরে আছে। ঘোড়ার এরকম সাজ-পোশাক তো এদেশের নয়। রাজকন্যা বুঝলেন, কোনো বিদেশী এসে ড্রাগনটা মেরেছে, কিন্তু কোথায় সে বিদেশী? সে কি এখনও বেঁচে আছে! সখীরা খোঁজাখুঁজি করতে লাগলো। শেষে প্রিয়সখী বিরজা দেখতে পেল, দূরে ঝোপের মধ্যেকার শিরস্ত্রাণ চক্চক্ করছে। ছুটে গেলেন সবাই। তখন জ্ঞান নেই ত্রিস্তানের, কিন্তু অল্প অল্প নিশ্বাস পড়ছে। ধরাধরি করে গোপনে ত্রিস্তানকে নিয়ে আসা হলো রাজপুরীর মধ্যে। সোনালি তাঁর মাকে শুধু বললেন সব কথা, দেখালেন সেই বীরপুরুষের অজ্ঞান দেহ। ওর মা তাড়াতাড়ি ওষুধ লাগাবার জন্য, ত্রিস্তানের পোশাক খুলতে গিয়ে জুতোর মধ্যেদেখতে পেলেন সেই ড্রাগনের জিভ। মা আর মেয়ে চোখাচোখি তাকালেন। তারপরখুব তেজী ওষুধে অল্প সময়েই জ্ঞান ফেরালেন ত্রিস্তানের।
চোখ মেলতেই রানী বললেন, বিদেশী, তুমি কে জানি না, কিন্তু এ কথা বুঝেছি, তুমিই ড্রাগনকে হত্যা করেছো। এদিকে লাল-চুলো নামে একজন নাইট দাবী করছে সে-ই মেরেছে ড্রাগনটাকে। তুমিই আমার মেয়ের যোগ্য স্বামী, তোমার সঙ্গেই ওকে মানাবে। ঐ কাপুরুষটার সঙ্গে নয়! এমন সোনার প্রতিমা আমার মেয়ে, তার সঙ্গে কি ঐ বাঁদরটাকে মানায়! তুমি দুদিনের মধ্যে সুস্থ হয়ে উঠে ওর সঙ্গে লড়াই করে ওকে হারাতে পারবে? তোমাকে পারতেই হবে। তোমাকে যে আমার খুব পছন্দ হয়েছে!
প্রভুগণ, দেখুন, ঈশ্বরের কি কৌতুক। রানী একপলক দেখেই ত্রিস্তানকে পছন্দ করে ফেললেন। অথচ ওই রানীই ত্রিস্তানের মৃত্যুসংবাদ শুনলে নিজের গলার মুক্তামালা দেবেন, ঘোষণা করেছেন!
রাজপুরীর মধ্যে গোপনে ত্রিস্তানের সেবা করছেন রাজকন্যা সোনালি নিজে! পরদিন সকালে ত্রিস্তানকে স্নান করিয়ে ক্ষতের জায়গায় মলম লাগাতে এসেছেন রাজকুমারী। ত্রিস্তান তখনও ঘুমিয়ে। ত্রিস্তানেরতেজস্বী সুন্দর মুখের দিকে তাকিয়ে রাজকুমারী একটা আদরের দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন। সে মুখ যেন অল্প অল্প চেনা লাগছে। হয়তো, পূর্বজন্মে ওর সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল! ইস্, এর সঙ্গে বিয়ে না হয়ে যদি লাল-চুলোর সঙ্গে বিয়ে হত? লজ্জায় আত্মহত্যা করতে হত তাহলে। এই বিদেশী আমাকে বাঁচিয়েছে। কালকে এর পক্ষে লাল-চুলোকে হারানো তো কিছুই না!
ঘুম ভেঙে ত্রিস্তান দেখলো সোনালিকে। একদৃষ্টে তাঁর মুখের দিকে চেয়ে রইলো। মনে মনে ভাবলো, সোনালি চুল রাজকন্যাকে তাহলে আমি সত্যিই খুঁজে পেলাম। এই ভেবে ত্রিস্তান একটু হাসলো। সেই হাসি কেমন যেন অদ্ভুত রাজকন্যা দেখে চমকে উঠলেন। ওরকম ভাবে হাসলো কেন বিদেশী? আমার কি কিছু ভুল হয়েছে? আমার পোশাক অগোছালো না তো! তবে, ওরকম ভাবে হাসলো কেন? কি জানি!
রাজকুমারী তখন ত্রিস্তানের অস্ত্রশস্ত্র পরিষ্কার করার জন্য বার করলেন। আহা, কি সুন্দর শিরস্ত্রাণ, ওর মতো বীরেরই যোগ্য। কি বিশাল তলোয়ার দিয়ে ড্রাগনকে মেরেছে, কাল লাল-চুলোকেও মারবে! একি, তলোয়ারের ডগাটা ভাঙা কেন? ড্রাগনকে মারতে গিয়ে ভাঙলো! ভাঙা তলোয়ার দেখে সোনালির কি রকম যেন অস্বস্তি লাগলো। যতখানি ভাঙা, সে রকম একটা টুকরো যেন তিনি কোথায় দেখেছেন। কোথায়? ওঃ! শঙ্কায় সোনালির বুক দুলে উঠলো। তাঁর মামা মোরহল্টের মাথার খুলির মধ্যে তো এই রকম একটা টুকরো ঢুকেছিল। হে ভগবান, যেন তা না হয়! তাড়াতাড়ি গিয়ে হাতির দাঁতের বাক্স খুলে টুকরোটা বার করে আনলেন। জোড়ে জোড় মিলে গেল। ওঃ! এই বিদেশীই তবে লিওনেসের ত্রিস্তান! মোরহল্টকে খুন করেছে এই লোকটাই! হায়, আমার ভাগ্য!
রাগে রাজকুমারী তলোয়ার হাতে ছুটে এলেন ত্রিস্তানকে খুন করার জন্যে। ত্রিস্তান তখন স্নান করছে, জলভর্তি বড় গামলার মধ্যে শুয়ে, দুর্বল, অসহায় নিরস্ত্র ত্রিস্তান। তলোয়ার উঁচিয়ে ক্রোধে কঠিন গলায় ত্রিস্তানকে বললেন রাজকুমারী, শয়তান, তুমিই মোরহল্টের হত্যাকারী? সত্যি করে বলো, তুমিই কি লিওনেসের ত্রিস্তান? তাহলে এবার মৃত্যুর জন্য তৈরি হও।
ত্রিস্তানের পালাবার উপায় নেই। সে শুয়ে থেকে মৃদু হেসে বললো, রাজকুমারী, তোমার হাতে মরবো, তাতে আমার দুঃখ কি। এ জীবন তো তোমারই। মরার আগে একটা কথা বলবো। আমার জীবন তুমিই দু’বার বাঁচিয়েছো! মনে আছে সেই মুমূর্ষু বীণাবাদকের কথা? জেলেরা তোমার কাছে এসেছিল? সে আমি। তখনও তুমিই আমাকে বাঁচিয়েছো। এবারও ড্রাগনকে হত্যা করার পর আমি ঝোপের মধ্যে পড়েছিলাম, আমার বাঁচার কথা ছিল না- তুমিই তুলে এনে আমাকে বাঁচিয়েছো। দু’বার আমার প্রাণ বাঁচালে, এখন একবার হত্যা করবে, এ আর বেশি কথা কী আমাকে হত্যা করলেও আমি তোমার কাছে ঋণী থেকে যাবো।
রাজকুমারী বললেন, প্রথমবারই যদি জানতুম তোমার সত্যিকার পরিচয় তখনই তোমাকে মেরে ফেলতাম।
—তার বদলে এখন মারো! এরপর লাল-চুলো নাইটকে বিয়ে করে সুখে থাকবে তুমি। একবারও তোমার দীর্ঘনিশ্বাস পড়বে না এ কথা ভেবে যে একজন বিদেশী তোমাকে পাবার জন্য নিজের জীবন তুচ্ছ করে ড্রাগনের সঙ্গে লড়াই করেছিল। তারপর অসহায় অবস্থায় পেয়ে স্নানের ঘরে তুমি তাকে হত্যা করেছো।
—এসব কি অসম্ভব কথা? তুমি মোরহল্টকে হত্যা করেছো- এদেশ তোমার শত্রুর দেশ। আর তুমিই এসেছো এ দেশের রাজকন্যাকে পেতে। বুঝেছি, মোরহল্ট গিয়েছিল তোমাদের দেশ থেকে ক্রীতদাসী আনতে তার বদলে তুমি এসেছো রাজকন্যাকে ক্রীতদাসী করে নিয়ে যেতে।
—রাজকুমারী, না, না, ও কথা ভেবো না। একদিন একটা দোয়েল পাখি মুখে করে এনেছিল একগাছি সোনালি চুল। তা দেখে আমার মনে পড়েছিল তোমার কথা। তাই তোমাকে পাবার জন্য আমি জীবন তুচ্ছ করে এসেছি এ দেশে। দেখো, আমার জামার সঙ্গে সেই সোনালি চুলটা সেলাই করা আছে। তোমাকে সঙ্গে না নিয়ে আমি আর বেঁচে ফিরতে চাই না!
তলোয়ার হাতে নিয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগলেন রাজকুমারী। এই লোকটাই হত্যা করেছে তাঁর মায়ের একমাত্র ভাইকে। রাজ্যের শ্রেষ্ঠ বীরকে। ওকে মারতে তাঁর হাত কাঁপছে কেন? কেনই বা গলা রুদ্ধ হয়ে আসছে, ডাকতে পারছে না প্রহরীদের?
ত্রিস্তান আবার বললো, দ্বিধা করছো কেন, রাজকুমারী? আমাকে মারো, আমি বুক পেতে দিয়েছি। আমি তোমার হাতেই মরতে চাই। পরের জন্মে আমি আবার আসবো তোমার কাছে, তোমাকে জয় করতে। সেবারও হয়তো আমি মরবো তোমার হাতে। তখনও হয়তো তোমার রাগ যাবে না। কিন্তু আমি বারবার জন্ম- জন্মান্তরে ঘুরে আসবো তোমাকে জয় করতে। আমি তোমাকে চাই।
তলোয়ার ফেলে দিয়ে সোনালি কান্নায় ভেঙে পড়লেন। এই বিদেশী এসেছে তাঁকেই ভালোবেসে, একে কি করে খুন করবেন নিজের হাতে।
—কেন এলে নিষ্ঠুর বিদেশী, কেন এলে এই দেশে? কেন আমাকে এই দ্বিধার মধ্যে ফেললে!
—রাজকুমারী, আমি এসেছি শুধু তোমারই জন্য, আমি আমার নিজের জীবনের কথাও ভুলে গেছি। তুমি অথবা মৃত্যু, এই দুজনের একজন এসো আমার কাছে।
রাজকুমারী আর স্থির থাকতে পারলেন না। এরকম কথা তিনি কখনও শোনেননি। সোনালি এগিয়ে এসে দুর্বল ত্রিস্তানের ওষ্ঠ চুম্বন করে বললেন, আমি হেরে গেলাম। আজ থেকে তুমি আমার চিরদিনের বন্ধু, তুমি আর কখনও আমার ওপর নিষ্ঠুর হয়ো না! ত্রিস্তান তখন আবার সেই আগের মতো অদ্ভুতভাবে হাসলো। তার গৌরবর্ণ মুখে সেই হাসিটুকু যেন অন্ধকারের মতো দেখালো। রাজকুমারী এবারও তার মানে বুঝতে পারলেন না।
রানী ও রাজকন্যা রাজাকে ডেকে সব কথা বুঝিয়ে বললেন। ত্রিস্তানের পরিচয়, তার বীরত্বের কথা। রাজা প্রথমে খুব রেগে উঠলেন সে-ই মোরহল্টের হত্যাকারী শুনে। তারপর বুঝলেন, ত্রিস্তান ন্যায় যুদ্ধেই মোরহল্টকে হারিয়েছে। শেষ পর্যন্ত ত্রিস্তানকে ক্ষমা করলেন তিনি।
লাল-চুলো নাইট ত্রিস্তানের পরিচয় শুনে ভয়ে আর লড়াই করতে চাইলো না। রাজা তাকে জেলে পুরলেন। ঠিক হলো কয়েক দিন পর ত্রিস্তানের সঙ্গে রাজকুমারীর বিয়ে হবে।
বিরাট জমকালো রাজসভায় ত্রিস্তান ও সোনালিকে পাশে নিয়ে রাজা ঘোষণা করলেন বিবাহের কথা। ত্রিস্তান ছাড়া কেউ ড্রাগনকে হত্যা করতে সাহস পায়নি সে-ই রাজকন্যার যোগ্য অধিকারী। রাজসভায় ত্রিস্তানের সেই একশোজন সৈন্য ছদ্মবেশে দাঁড়িয়ে। হঠাৎ রাজার কথার মধ্যেই বাধা দিয়ে ত্রিস্তান বললো- মহারাজ, আমি ড্রাগনকে হত্যা করেছি। এবং আপনার প্রতিজ্ঞা অনুযায়ী আমি রাজকন্রাকে আমার জাহাজে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে পারি। কিন্তু আমার অন্য একটা প্রস্তাব আছে। আমি এসেছি কর্নওয়ালের রাজা মার্কের অনুচর হিসেবে। মহারাজ, আমি কেউ নই। আমি রাজা মার্কের ভৃত্য মাত্র। রাজকুমারীকে আমি বিয়ে করবো না, ওঁকে বিয়ে করবেন রাজা মার্ক। তার ফলে আয়ার্ল্যান্ডের সঙ্গে কর্নওয়ালের চিরকালের বিবাদ মিটে যাবে। সমস্ত কর্নওয়ালের লোক রাজকুমারী সোনালির অনুগত হবে তাদের রানী হিসাবে।
একথা শুনে কেউ আশ্চর্য হলো না। হায়, পদমর্যাদার প্রতি মানুষের এমন ভক্তি। সবাই ভাবলো, এদেশের রাজকন্যার সঙ্গে ওদেশের রাজার বিয়ে হবে, সেই তো স্বাভাবিক! ত্রিস্তান আবার কে? সে তো ভৃত্য মাত্র! সবাই আনন্দে জয়ধ্বনি দিয়ে উঠলো। রাজা এ প্রস্তাবে আন্তরিক ভাবে খুশী হলেন।
রাজা ত্রিস্তানের হাতের ওপর রাজকন্যার হাত রেখে বললেন, ত্রিস্তান, তুমি রাজা মার্কের প্রতিনিধি হিসাবে আমার মেয়েকে গ্রহণ করলে। এখন প্রতিজ্ঞা করো, তুমি সম্পূর্ণ বিশ্বস্তভাবে একে স্বামীর কাছে পৌঁছে দেবে?
রাজকুমারী সোনালি তখন লজ্জায়, অপমানে, রাগে থরথর করে কাঁপছেন। এই ছিল লোকটার মনে? ভণ্ড, মিথ্যাবাদী, জোচ্চোর! সোনালি চুলের কথা, ভালোবাসার কথা সব মিথ্যে। নিজে জয় করে এখন অবহেলায় দিয়ে দিচ্ছে অন্যকে! নিজের হাতে সে তাঁকে অন্যের হাতে তুলে দেবে! ওঃ, এর আগে তাঁর মৃত্যু হলো না কেন? বিশ্বাসঘাতক ত্রিস্তান! ও লোকটার হৃদয় নেই। রাজকন্যা সভার মধ্যেই অজ্ঞান হয়ে পড়লেন!
ত্রিস্তান রাজার সামনে প্রতিজ্ঞা করলো।
যেদিন জাহাজে ত্রিস্তান রাজকুমারীকে নিয়ে যাবে, সেদিন রানী তাঁর মেয়ে সোনালিকে সাজিয়ে দিয়ে বললেন, ঐ অচেনা অজানা দেশে তুই যাবি, তোর সখী বিরজাও তোর সঙ্গে যাক্। যাক্ আরও দাস-দাসী। তাহলে তোর একা একা লাগবে না। ভয় করবে না। সোনালি বললেন, মা, আমাকে তোমরা পাঠাচ্ছো শত্রুর দেশে। আমি আর ক’দিন সেখানে বাঁচবো? আমার কিছু দরকার নেই। রানী বললেন, আমার চোখে জল আসছে, কিন্তু তবু আমি কাঁদবো না। ওরা যে তোকে জয় করে নিয়েছে!