সোনালী দুঃখ – ১২

১২

ত্রিস্তান আবার ফিরে এসেছে জঙ্গলে। এবার তাকে চলে যেতে হবে রাজ্য ছেড়ে। রাজার কাছে সে প্রতিজ্ঞা করেছিল। সোনালিরও আর কোনো ভয় নেই, এখন সে সন্দেহের উর্ধ্বে।

দু’তিন দিন কেটে গেল, তবু ত্রিস্তানের যাওয়া হয় না। একা একা সে সেই ভাঙা কুঁড়েঘরে শুয়ে থাকে। শিকারে বেরুতে ইচ্ছে করে না, তাই অনেক সময় খাওয়া হয় না। শুয়ে সে ভাবে, সেই ঝরনার পাশে শেষবার সোনালির পাখির মতো দেহ কয়েক মুহূর্তের জন্য তার বুকে এসেছিল। সোনালির সুডৌল দুই বুক লেগেছিল তার বুকে, তাঁর উত্তেজনার স্পন্দন ত্রিস্তান অনুভব করছিল। এখন যেন সোনালির শরীরের সৌরভ ত্রিস্তানের দেহে লেগে আছে। সেই নেশায় আচ্ছন্ন হয়ে ত্রিস্তান পড়ে থাকে। তার হাতে, সোনালির দেওয়া সেই স্বর্ণমুদ্ৰা।

রোজই ভাবে ত্রিস্তান, আজ চলে যাই। কিন্তু, আজ এমন ছড়া রোদ, আজ কি যাওয়া যায়? পরের দিন ভবে, ইস্, আজ এমন মেঘ ঘনিয়ে এসেছে, আজ তার যাওয়া উচিত নয়। যাবার জন্য পা আর ওঠে না। কি এক প্রবল আকর্ষণ তাকে টেনে রাখে।

এমনি করতে করতে একদিন জ্যোৎস্না রাতে ত্রিস্তান সত্যি বেরিয়ে পড়লো ঘোড়া নিয়ে। বন পেরিয়ে এলো সেই উন্মুক্ত প্রান্তরে। একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস পড়লো, আর দেখা হবে না। এ জন্মের মতো বিদায়, সোনালি! আর দেখা হবে না! একবার শেষ দেখা?

হঠাৎ ত্রিস্তান ঘোড়ার মুখ ফিরিয়ে দিল টিন্টাজেল দুর্গের দিকে। বাইরে ঘোড়া বেঁধে দেয়াল পেরিয়ে এলো। তখন সে যেন অন্ধ, তার কোনো বাধা নেই, কোনো ভয় নেই। আগেকার সেই মিলনকুঞ্জে দাঁড়িয়ে ত্রিস্তান পাখির মতন শিস দিতে লাগলো।

রাজার পাশে শুয়েশুয়ে কোনো দিনই রানীর ভালো করে ঘুম আসে না। হঠাৎ শুনলেন পাখির ডাক। একটা পাখি যেন কাঁদছে। তার করুণ সুর কেঁপে কেঁপে উঠছে হাওয়ায়। রাত্রির বেলা কোন পাখি ডাকে? রানী ভাবতে লাগলেন। হঠাৎ তাঁর শরীর কেঁপে উঠলো। এ তো ত্রিস্তান! বনের মধ্যে ত্রিস্তান তাকে এই সুর শোনাতো। কি করুণ তার ডাক। যেন বসন্তের শেষে কোকিল তার শেষ ডাক ডেকে নিচ্ছে।

রানী মনে মনে বললেন, ত্রিস্তান, কেন ডাকছো এমন ভাবে? আমরা যে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। ঋষির আশ্রমে আমরা প্রতিজ্ঞা করেছি, আর দেখা হবে না। আবার দেখা মানেই তো মৃত্যু। মৃত্যু? আসুক মৃত্যু! ত্রিস্তান, তুমি ডেকেছো। আমি যাবো।

রানী ধড়মড় করে উঠে বসলেন, তারপর ঘুমন্ত রাজার পাশ থেকে নিঃশব্দে নেমে এলেন। কোনোদিকে দৃষ্টিপাত না করে সোজা চলে এলেন বাগানে। বিস্রস্ত বেশ, আলুলায়িত চুল, রানী ছুটে গেলেন ত্রিস্তানের দিকে, ঝাঁপিয়ে পড়লেন ত্রিস্তানের বুকে।

একটিও কথা না বলে ওরা দুজনে পাগলের মতো দুজনকে চুমু খেতে লাগলো। ত্রিস্তান রানীর সমস্ত শরীরে হাজার হাজার ফুলের মতো চুমুতে ভরিয়ে দিল, পদতল পর্যন্ত। তারপর রানী ত্রিস্তানকে আলিঙ্গন করে বললেন, ত্রিস্তান, আমায় জড়িয়ে ধরো। আমাকে এমনভাবে জড়াও যেন আমি এখুনি তোমার বুকের সঙ্গে মিশে যাই। এই রাতই হোক পৃথিবীর শেষ রাত ত্রিস্তান!

ত্রিস্তান আর সোনালির শরীর এক হয়ে মিশে গেল।

সেই কুঞ্জেই ওদের রাত্রি ভোর হলো। সূর্যের আলোয় বনের একটি ফুলও ফোটার আগে, জেগে উঠলো ওরা দুজনে। ত্রিস্তান বুঝলো, এবার সত্যিই তাকে যেতে হবে। সেই রাতই তাদের জীবনের শেষ রাত হয়নি। এখনও অনেক দিন ও রাত্রির সহস্যময় খেলা বাকি আছে। সোনালিকে আবার চুম্বন করে ও বললে, সখী, আমি যাবার সময় কী সঙ্গে নিয়ে যাবো আমার!

রানী বললেন, ত্রিস্তান, আমার শরীর রইলো এখানে, তুমি আমার আত্মা নিয়ে যাবে।

—সোনালি, তোমার সবুজ আংটি দিয়ে কোনো লোককে পাঠিয়ে আমি যদি কোনো অনুরোধ জানাই, তুমি শুনবে তো?

—ত্রিস্তান, যদি কখনও তোমার ডাক শুনি, রাজবাড়ির হাজারটা দেওয়ালও আমাকে আটকাতে পারবে না। ত্রিস্তান তুমি জেনে রেখো, এখানে আমার একটি দিনও সুখে কাটবে না।

এই সময় রাজপুরীতে বেজে উঠলো ভোরের সানাই। ত্রিস্তান আর একটিও কথা না বলে নিঃশব্দে রানীকে চুম্বন করে উঠে চলে গেল।

এরপর অনেক দিন দিশাহারার মতো ত্রিস্তান ঘুরলো নানান রাজ্যে। কোথাও তার শান্তি নেই। কোথাও যদি কোনা যুদ্ধের খবর শোনে, ত্রিস্তান কোনো এক পক্ষ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে সেই যুদ্ধে। ওর সমস্ত শরীরে জ্বালা। কোনো যুদ্ধে ওর মৃত্যু হোক তাই ও চায়। কিন্তু মরণ অত সহজে আসে না। বরং দুর্ধর্ষ বীর হিসেবে ত্রিস্তানের নাম রটে যায় আরো।

ঘুরতে ঘুরতে ত্রিস্তান এলো নিজের রাজ্য লিওনেসে। সত্যবাহন রোহল্ট তাকে প্রচুর সম্মান করে বরণ করে নিল প্রভুর মতো। তাকে ছেড়ে দিল রাজপ্রাসাদ, ফিরিয়ে দিল রাজসম্মান। কিন্তু ত্রিস্তানের রাজ্যলিপ্সা নেই। দীর্ঘদিন বনে-জঙ্গলে ঘুরে সুখভোগেও তার অরুচি এসে গেছে। ভ্রাম্যমাণ হবার জন্য তার রক্ত ছটফট করে। আবার সে বেরিয়ে পড়লো।

মাঝে মাঝে যখনই সে কর্নওয়ালের কোনো বণিক বা পথিককে দেখে, সাগ্রহে জিগ্যেস করে সে দেশের খবর। সবার মুখেই উচ্ছ্বসিত প্রশংসা। ওরকম শান্তিময় দেশ আর হয় না, আর অমন সুন্দর যে দেশের রাজা রানী! মাঝে মাঝে রানী যখন পথ দিয়ে যান, তখন সারা শহরের মানুষ মুগ্ধ বিস্ময়ে ওঁদের দেখে। রানী সোনালি যেন রাজ্যের লক্ষ্মী। অমন প্রাণচঞ্চলা, সকলের সঙ্গে সমান হাসিমুখে ব্যবহার- এমন রানী কে কবে দেখেছে?

ত্রিস্তান ব্যাকুলভাবে জিগ্যেস করে, রানী খুব সুখী?

—বাঃ সুখী হবেন না? অত সৌভাগ্য? কিসের অভাব তাঁর? একদিনের জন্যও কেউ রানীর মুখ গম্ভীর দেখেনি।

সুখী? ত্রিস্তান দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করে। সুখী হবেই তো, আস্তে আস্তে সে ত্রিস্তানের কথা ভুলে যাবে। রানী জানেই না হয়তো, আমি বেঁচে আছি কিনা। জানার তার ইচ্ছেও নেই বোধহয়।

এই দুঃখকে ভোলার জন্যই ত্রিস্তান আবার পাগল হওয়ার মতো ঘুরতে লাগলো এক দেশ থেকে আর এক দেশ। কোথাও সে টিকতে পারে না। সূর্যের আলো তার অসহ্য লাগে, জ্যোৎস্না তার শরীর পুড়িয়ে দেয়। অন্ধকার তার গলা টিপে ধরে। এক মুহূর্তের জন্যেও ত্রিস্তানের নিস্তার নেই। আর ক্রমাগত সে লোকের মুখে শোনে কর্নওয়ালের রানী সোনালি কি সুখী, ভাগ্যবতী। তাঁর পয়মন্তে রাজ্যের সমৃদ্ধি উছলে উঠছে।

একদিন একটা বন পেরিয়ে এসে ত্রিস্তান একটি দুর্গের সামনে দাঁড়ালো। তখন বিকেলবেলা, ত্রিস্তান সারাদিন ঘোড়া ছুটিয়ে ক্লান্ত। ভাবলো, দুর্গে একটু আশ্রয় পাবে। কিন্তু দুর্গটা একটু অদ্ভুত। দুর্গের সামনে সমস্ত জঙ্গল আগুনে পোড়ানো। দুর্গের দেয়ালেও আগুনের আঁচ লেগেছিল। তখনও দিনের আলো আছে অথচ দুর্গের দরজা বন্ধ। কোনো জনপ্রাণীর চিহ্ন নেই। ত্রিস্তান ঘোড়া থামালো একেবারে দুর্গের দরজার সামনে। সঙ্গে সঙ্গে তার পায়ের কাছে এসে দুটো বর্শা পড়লো।

ত্রিস্তান হাত তুলে বললো, আমি শত্রু নই। আমি বিদেশী, অতিথি। এক রাত্রির জন্য আশ্রয় চাই।

সঙ্গে সঙ্গে যেন শত কণ্ঠে গর্জে উঠলো, আমরা কোনো বিদেশী অতিথি চাই না।

ত্রিস্তান আবার বলে উঠলো, আমি ক্লান্ত, আমাকে এক রাত্তিরের জন্যও আশ্রয় দেবে না?

এইবার দুর্গের কেটা জানলা খুলে দেখা গেল একটি যুবাপুরুষের মুখ। সুপুরুষ, অভিজাত। যুবকটি বললো, তুমি বন্ধুই হও আর শত্রুই হও, আমাদের দুর্গে কারুকে আশ্রয় দেবার উপায় নেই।

—কেন? ত্রিস্তান জিগ্যেস করলো।

—আমরা দু’মাস ধরে অবরুদ্ধ হয়ে আছি এই দুর্গে। শত্রুরা আমাদের ঘিরে আছে দূরে। দুর্গে আমাদেরই খাদ্য নেই, অতিথির সেবা করব কি করে?

—আমি লিওনেসের ত্রিস্তান। আমাকে অন্তত এক রাত্তিরের জন্য আশ্রয় দিন হয়তো আমি আপনাদের কোনো কাজেও লাগতে পারি।

ত্রিস্তানের নাম শুনে যুবকের মুখে সম্ভ্রমের চিহ্ন দেখা গেল। সে বললো, আমি আপনার বীরত্বের খ্যাতি শুনেছি। কিন্তু আপনি কেন আমাদের দুর্ভাগ্যের সঙ্গে নিজেকে জড়াবেন?

ত্রিস্তান ম্লান হেসে বললো, কোনো অবস্থাই আমার কাছে আর দুর্ভাগ্য নয়! আপনি দরজা খুলুন।

দুর্গের দরজা খুলে গেল। সেই যুবক ত্রিস্তানের হাত ধরে বললো, আমার নাম কাহারডিন। আমি ছিলাম ব্রিটানির রাজকুমার। আজ রাজ্য হারিয়ে শুধু এই দুর্গটাই আমাদের সম্বল। তাও এটা কতদিন রাখতে পারবো জানি না।

—কে এই অবস্থা করলো?

—আমাদেরই এক ভৃত্য। সে আমার বোনকে বিয়ে করতে চেয়েছিল। আমরা রাজী হইনি বলে, সে বিদ্রোহ করে। সে আজ মহাশক্তিশালী। কিন্তু প্রাণ থাকতে আমি আমার বোনের সঙ্গে ঐ ভৃত্যটার বিয়ে দেবো না!

কাহারডিন ত্রিস্তানকে নিয়ে গেল একেবারে অন্তঃপুরে। সেখানে ওর বাবা মা বোন সকলেই নত মস্তকে বসে আছেন। ত্রিস্তানের ছিপ্‌ছিপ্,ে দীর্ঘ, সুকুমার চেহারার দিকে সকলেই তাকিয়ে রইলো বিস্ময়ে। কাহারডিন ওদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল ত্রিস্তানের। রাজকুমারী যাকে কেন্দ্র করেই এ রাজ্যের এত দুর্ভাগ্য, মুখ নিচু করে উল বুনছেন। তাঁর রূপের আলোয় ঘর ভরা, কিন্তু একটু যেন তীব্র আর প্রখর সেই রূপ। কাহারডিন বললো, এই আমার বোন রুপালি ইসল্ট। আমরা ওকে শুধু রুপালি বলে ডাকি।

নাম শুনে চমকে উঠলো ত্রিস্তান। মনে পড়লো, বহুদিন আগে আয়ার্ল্যান্ডের রাজকুমারীর নাম শুনেছিলাম, সোনালি চুল ইসল্ট। আর আজ এখানে অন্য এক রাজকুমারী, রুপালি ইসল্ট। সোনালির বিপরীত রুপালি। তার ভাগ্যও কি এবার বিপরীত দিকে যাবে? ত্রিস্তান দীর্ঘনিশ্বাস ফেললো, কোথায় সোনালি? সে তো আমাকে ভুলে গিয়ে সুখেই আছে।

ত্রিস্তান বললো, আমার বড় ক্ষিদে পেয়েছে।

সামান্য বজরার রুটি আর খানিকটা তরকারি খেতে দেওয়া হলো ওকে। মাছ বা মাংস বা ডিম নেই। এই কি রাজপরিবারের খাদ্য? বিদ্রোহীরা জঙ্গল ঘিরে রেখেছে-দুর্গ থেকে কেউ বেরিয়ে খাবার আনতে পারে না।

যদি শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে এরা রাজকুমারীকে দিয়ে দিতে রাজী হয় সেইজন্যই বিদ্রোহীরা দুর্গ শুধু অবরুদ্ধ করে রেখেছে, ধ্বংস করছে না। ত্রিস্তান তাকিয়ে দেখলো, রাজকুমারী রুপালি নিঃশব্দে বসে উল বুনছেন।

ক্লান্ত ত্রিস্তান সেদিন ঘুমিয়ে পড়লো। পরদিন সকালে উঠেই কাহারডিনকে বললো, চলো আমার সঙ্গে। খাদ্য লুট করে আনি।

কাহারডিন বললো, ত্রিস্তান, আমাদের দুর্গে মাত্র তিনশো সৈন্য আর ওরা অন্তত দশ পনেরো হাজার। গিয়ে কি লাভ?

ত্রিস্তান বললো, তুমি রাজপুত্র, নিশ্চয়ই যুদ্ধে মরতে ভয় পাও না। এসো আমার সঙ্গে।

অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ওরা দুজনেই বেরিয়ে পড়লো। নিঃশব্দে চললো বনের ছায়ায় ছায়ায়। কিছুদূর গিয়ে একটা বড় গাছের ওপর উঠে বসে রইলো দুজনে। ত্রিস্তান দেখলো দূরে বিদ্রোহীদের তাঁবু। বাইরে সৈন্যরা কুচ করছে। রোদ্দুরে ঝলমল করছে তাদের অস্ত্র। তাই, ত্রিস্তানের সাধ্য নেই একা সেখানে গিয়ে কিছু করে। ত্রিস্তান বললো, আমাকে চিনিয়ে দিতে পারবে কে তোমাদের বিদ্রোহী দাস।

পাতার আড়াল থেকে কাহারডিন আঙুল তুলে দেখালো, ঐ যে দেখছো, যার গায়ে লাল মখমলের পোশাক, মোষের মতো চেহারা, ঐ আমাদের দাস রিওল! লোকটা অসম্ভব শক্তিশালী।

ত্রিস্তান রিওলকে চিনে রাখলো। খানিকটা বাদে শুনলো দূরে বনের মধ্যে গাড়ির ঘড়ঘড় শব্দ। একটা ঘোড়ার গাড়িতে বোঝাই করে মাংস আর মদ আসছে এই সৈন্যদের জন্য। সঙ্গে সঙ্গে আসছে কুড়ি-পঁচিশ জন প্রহরী। ত্রিস্তান কাহারডিনকে নিঃশব্দে ইঙ্গিক করে গাছ থেকে লাফিয়ে পড়লো। তারপর সে আকস্মিক ঝড়ের মতো গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো প্রহরীদের উপর। তার তলোয়ার ঘুরতে লাগলো প্রচণ্ড বেগে। ত্রিস্তান যেন একাই পঁচিশজন লোক হয়ে গেল। কয়েক মুহূর্তে সে প্রহরীদের হত্যা করে-কাহারডিনকে সঙ্গে তুলে নিয়ে গাড়ি চালিয়ে দিল। ওদিকে সৈন্যরা টের পাবার আগেই ওরা দুর্গে পৌঁছে গেছে!

সেদিন দুর্গে অনেকদিন পর বিরাট ভোজ হলো। সৈন্যরা প্রাণ ভরে উৎসব করলো- আর জয়ধ্বনি তুললো ত্রিস্তানের নামে।

সেইদিনই মধ্যরাত্রে দুর্গ আক্রান্ত হলো! রিওলের সৈন্যরা দুর্গের চারপাশে আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে-বিরাট একটা কাঠের গুঁড়ি দিয়ে দুর্গের দরজায় আঘাত করে ভেঙে ফেলছে। দুর্গের সৈন্যরা প্রাণ দিয়ে লড়াই করছে। ত্রিস্তান তলোয়ার হাতে দাঁড়িয়ে আছে দেওয়ালের ওপর। সে তখনও যুদ্ধে যোগ দেয়নি।

হঠাৎ সে দেখলো একটা বিরাট মই ফেলে পিলপিল করে সৈন্য উঠে আসছে দুর্গের ছাদে। তখন শুরু হলো হাতাহাতি লড়াই। যুবরাজ কাহারডিন লড়াই করছে, ক’জন ভীষণ-দর্শন যোদ্ধার সঙ্গে। যথেষ্ট সাহসের সঙ্গে লড়াই করছে কাহারডিন, একসময় লোকটির বুকের মধ্যে তলোয়ার বসিয়ে দিল। এমন সময় যমদূতের মতো রিওল এসে দাঁড়ালো তার সামনে। অট্টহাসি দিয়ে বললো, রাজকুমার, আমার ভাইকে তো মারলে! এবার আমার সঙ্গে একহাত হোক।

তখন ত্রিস্তান একলাফে হাজির হলো সেখানে। বললো, রাজপুত্র কখনও ভৃত্যের সঙ্গে লড়াই করে না! আগে ভৃত্যের সঙ্গে ভৃত্যের লড়াই হোক!

এ লোকটা আবার কে? এই বলেই রিওল বিদ্যুৎবেগে তলোয়ার চালালো ত্রিস্তানের দিকে। ঠক করে ত্রিস্তানের তলোয়ারের সঙ্গে তার তলোয়ার আটকালো। ওরা দুজনে মুখোমুখি। এ সময় তলোয়ার টেনে নেওয়া বিপদ। যার বাহুর জোর- সে-ই জিতবে। শারীরিক শক্তিতে ত্রিস্তান রিওলের সঙ্গে পারবে না। ত্রিস্তান নিচু হয়ে বসে পড়ে তলোয়ার খুলে নিল। ঝোঁক সামলাতে না পেরে রিওল হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল। ত্রিস্তান তখন দ্রুত ছুটে গিয়ে উঠলো দুর্গের সর্বোচ্চ চূড়ায়। রিওলও ক্রুদ্ধভাবে ছুটে গেল সেখানে। তারপর সেখানে যুদ্ধ হতে লাগলো দুজনের। ঠং ঠং শব্দ হচ্ছে তলোয়ারের। আকাশের পটভূমিকায় ওদের সেই লড়াই, চারপাশের জঙ্গলে আগুন জ্বলছে-এ এমনই এক দৃশ্য যে, বহু লোক যুদ্ধ থাকিয়ে দেখতে লাগলো ওদের।

ত্রিস্তানের শরীরে বর্ম নেই, হালকা দেহ- সে ক্রিপ্রভাবে সরে যাচ্ছে আঘাতের সময়। রিওল-বিশাল ভারী। তার ভরসা-শারীরিক শক্তি। এক ফাঁকে ত্রিস্তান তলোয়ার চালিয়ে রিওলের বুকের বর্ম ফাঁক করে দিল। তারপর ত্রিস্তান রিওলের কব্জির কাছে এমন কৌশলে আঘাত করলো যে, তার হাতের দুটো আঙুল কেটে গিয়ে তলোয়ারটা ছিটকে গিয়ে ঘুরতে ঘুরতে পড়লো দূরের বনের মধ্যে। ত্রিস্তান রিওলের বুকে তলোয়ার ছুঁইয়ে বললো, শেষবার ভগবানের নাম করে নাও।

যন্ত্রণায় বিকৃত মুখ, রিওল মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে বললো, আমার প্রাণ ভিক্ষে দাও।

ত্রিস্তান হাসলো। হেসে বললো, ভিক্ষে চাইবার সময় মানুষের আর সময়- অসময় জ্ঞান থাকে না! দু’মিনিট আগে তোমার মুখ অহংকারে টক্ করছিল। আর এই মুহূর্তে সত্যিই ভিখারীর মতো করুণ হয়ে গেল। আচ্ছা, তোমায় ভিক্ষা দিচ্ছি, তার আগে তুমি চেঁচিয়ে তোমাদের সৈন্যদের বলো যুদ্ধ থামাতে। সকলের সামনে শপথ করো, তুমি আমার এ রাজপরিবারের দাসত্ব করবে। রাজকুমারের ঘোড়ার আগে আগে তুমি যাবে পায়ে হেঁটে।

রক্তাক্ত হাত জোড় করে, রিওল চিৎকার করে তার সৈন্যদের ডাকলো। সকলে অবাক হয়ে দেখলো, যন্ত্রণায় তার মুখ বিকৃত। তার বুকের কাছে উঁচু করা ত্রিস্তানের তলোয়ার। রিওল কাঁদতে কাঁদতে বললো, আমি হেরে গেছি। আমি হেরে গেছি। যুদ্ধ শেষ। ত্রিস্তানের আদেশে শৃঙ্খলিত করা হলো তাকে। সে আবার এ রাজবাড়ির দাসত্ব করতে স্বীকার করলো।

ত্রিস্তান ভাবলো, এবার তার কাজ শেষ, আবার তাকে অন্য দেশে চলে যেতে হবে। ততক্ষণে কাহারডিন এসে ত্রিস্তানকে বুকে জড়িয়ে ধরেছে। অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বললো, ত্রিস্তান, তোমার চেয়ে বড় বন্ধু আমার আর কেউ নেই। তোমাকে আর আমি ছাড়বো না। কাহারডিন ত্রিস্তানকে টানতে টানতে নিয়ে গেল বৃদ্ধ পিতার কাছে।

রাজা তার মস্তক আঘ্রাণ করে আনন্দাশ্রু বর্ষণ করতে করতে বললেন, কোথা থেকে তুমি এলে সৌভাগ্যের দূত! আমাদের রাজ্য ফিরিয়ে দিলে। ঈশ্বর তোমাকে দীর্ঘজীবী করুন। তুমি আমাদের রাজ্যের স্থায়ী রক্ষক হলে। বস ত্রিস্তান, তুমি আমার মেয়ে রুপালিকে বিয়ে করো। সে তোমার অযোগ্য হবে না।

ত্রিস্তান চুপ করে রইলো। অভিমানে তার বুক দুলছে। মন বললে, সোনালি, সোনালি। সোনালি আমাকে ভুলে গেছে। আমাকে হারিয়েও সে সুখী। আমি বেঁচে আছি কিনা তা সে জানতেও চায় না।

কাহারডিন ব্যগ্রভাবে বললো, ত্রিস্তান, আমার বোন সত্যিই তোমার যোগ্য। আমরা তোমাকে আত্মীয় হিসেবে চাই।

ত্রিস্তান তবুও চুপ।

—ত্রিস্তান চুপ করে আছো কেন, সাড়া দাও।

ত্রিস্তান শুধু বললো, না।

বৃদ্ধ রাজা ধীরভাবে বললেন, ত্রিস্তান, আমাদের ভৃত্য রিওল লোভ করেছিল রুপালিকে। আমাদের সকলকে হত্যা করার আগে সে রুপালিকে অপহরণ করতে পারত না। কিংবা তখনও সে পেতো রুপালির মৃতদেহ। কিন্তু তুমি তাকে পরাজিত করে রুপালিকে উদ্ধার করেছো। রুপালি এখন আইনত তোমার। নারী সব সময়েই বীরভোগ্যা এবং বীর্যশুল্কা। তোমার বীরত্বে তুমি রুপালির অধিপতি হয়েছো। তুমি যদি তাকে পরিত্যাগ করো, তবে তার আর কোনো উপায় থাকবে না।

কাহারডিন আবার বললো, ত্রিস্তান, বন্ধু, রুপালিকে তোমার পছন্দ নয়? ঐ দেখো, দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে, তুমি ওকে আরেকবার দেখো!

ত্রিস্তান চোখ তুলে তাকালো সেদিকে। দরজার পাশে নীরবে দাঁড়িয়ে আছেন রুপালি। কেউ অস্বীকার করতে পারবে না সেই রূপ। একমাথা রুপালি চুল, উজ্জ্বল মসৃণ মুখ, দীর্ঘ শরীর, একটা সাদা সিল্কের পোশাক পরে দাঁড়িয়ে আছেন। মোমবাতির আলোর মতন তাঁর দাঁড়াবার ভঙ্গিটি স্নিগ্ধ কিন্তু বড় বিষণ্ণ।

রুপালির দিকে তাকিয়ে ত্রিস্তানের তবু মনে পড়লো সোনালির কথা। যে- কোনো জায়গায় কোনো সুন্দর রূপ দেখলেই সে সোনালির কথা ভাবে। যখন সে কোনো ভাল খাদ্য খায়, দেখে কোনো সুগন্ধ ফুল, কোনো হরিণশিশু, অথবা যখন আকাশ ভাসিয়ে জ্যোৎস্না ওঠে, কিংবা সে শোনে ঝরনার ছলছল শব্দ—সবই তাকে সোনালির কথা মনে করিয়ে দেয়। এ পৃথিবীর সব সৌন্দর্যই তার চোখে সোনালি।

কিন্তু অভিমানে ত্রিস্তানের বুকে জ্বালা করতে লাগলো। কোথায় সোনালি? সে আমাকে ভুলে গেছে! রাজাকে পেয়ে সে সুখে আছে! বনে জঙ্গলে আমার সঙ্গে কষ্ট ভোগ করার পর এখন সে পেয়েছে সুখের স্বাদ। আমি তার কেউ নই! শুধু আমিই কি তার স্মৃতি বুকে বয়ে বেড়াব জ্বলন্ত অঙ্গারের মতো? না-না! ত্রিস্তান আবার তাকালো রুপালির দিকে। একটা বিশাল দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার বুক থেকে, যেন সেই দীর্ঘশ্বাসই তার এক জন্মের স্মৃতি।

তারপর মৃদুস্বরে বললো, রুপালিকে বিয়ে করতে পারা তো আমার পক্ষে পরম সৌভাগ্য।

হায়, ত্রিস্তান, তুমি কেন এ কথা বললে? প্রভু, আপনারা এ কাহিনী শুনছেন, আপনারা ত্রিস্তানের দুঃখে এক ফোঁটা চোখের জল ফেলুন। হায়, হায়, ত্রিস্তান, তুমি এ কি করলে? সেদিন থেকেই যে ত্রিস্তানের মৃত্যু শুরু হয়ে গেল। ত্রিস্তানের সঙ্গে সোনালির জীবন-ভালোবাসা ও মৃত্যু-এক সূত্রে বাঁধা। ভলোবাসার একমাত্র বিপরীত জিনিস যে মৃত্যু। আর কিছু নেই। হায় ত্রিস্তান, তোমার অভিমান তোমাকে কোন সর্বনাশের মধ্যে নিয়ে গেল!

কয়েকদিন পর মহা ধুমধামের সঙ্গে বিয়ে হলো। বহুকাল পরে এ রাজ্যে আনন্দ ফিরে এসেছে। বহুকাল পর ত্রিস্তান বহুমলা উজ্জ্বল পরিচ্ছদ পরেছে। তাকে দেখাচ্ছে দেবতার মতো আর রাজকুমারী রুপালি, সলজ্জা সুন্দরী-তার রূপের দিকে তাকালেও চোখের পলক পড়ে না। রুপালি আস্তে আস্তে ত্রিস্তানের হাতে একটা আংটি পরিয়ে দিলেন। টকটকে লাল পাথরের আংটি। সেদিকে তাকিয়ে ত্রিস্তানের চোখ পড়লো নিজেরই হাতের অন্য আঙুলে সবুজ পাথরের আংটির দিকে। সোনালি তাকে দিয়েছিল, অভিজ্ঞান হিসাবে।

হঠাৎ ত্রিস্তানের মাথা ঘুরে উঠলো। যেন সে তখুনিই অজ্ঞান হয়ে যাবে। তখুনি তার এক নিমেষের মধ্যে মনে পড়ে গেল-বনে বনে সোনালির সঙ্গে তার দুঃখ ভাগ করে নেওয়া দিনগুলির সম্পূর্ণ ছবি। সোনালির পাশে বসে তার সেই পাখির ডাক শোনার। মুহূর্তে ত্রিস্তান নিজের ভুল বুঝতে পারলো। এ কি করেছে সে? সোনালি ছড়া অন্য নারীকে সে ছোঁবে কি করে? তার এক জীবনের সম্পূর্ণ ভালোবাসা যে সে আগেই দিয়ে দিয়েছে সোনালিকে। এখন আর তার কিছু অবশিষ্ট নেই।

ফুলশয্যার রাত্রে দুজনে শুয়ে আছে পাশাপাশি। ত্রিস্তান রুপালির অঙ্গে একবার হাতও ছোঁয়ায়নি, একটি কথাও বলেনি। একি ফুলশয্যা! আহা, সরল নির্দোষ রুপালি। নিঃশব্দে প্রতি মুহূর্ত কাটছে। খানিকটা পর রুপালি খুব মৃদুভাবে বললেন, আর্যপুত্র, আমি কি কোন দোষ করেছি? আপনি কি আমার ওপর রাগ করেছেন?

— না, না, না।

—তবে, আপনি আমার সঙ্গে একটাও কথা বলছেন না? আমি কি দোষ করেছি, বলুন? আমাকে কি আপনার পছন্দ হয়নি?

—না, রুপালি, আমাকে ভুল বুঝো না। আমার একটি শপথ আছে। একবার আমি যুদ্ধে বিষমভাবে আহত হয়েছিলাম। আমার বাঁচার কোনো আশা ছিল না। তখন আমি কুমারী মেরির কাছে প্রার্থনা করেছিলাম, মা আমাকে যদি বাঁচিয়ে দাও আমি বিবাহের পর এক বছর ব্রহ্মচর্য পালন করবো। আমার স্ত্রীকে আলিঙ্গন, চুম্বনও করবো না। আমাকে এক বছর সেই প্রতিজ্ঞা রাখতে দাও। আমায় ক্ষমা করো রাজকন্যা।

—বেশ! এই বলে রাজকুমারী পাশ ফিরে শুলেন। ত্রিস্তানের সে রাত বিনিদ্র কাটলো। রুপালিরও।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *