১৩
নব দম্পতির দিন যে কত দুঃখে কাটছে কেউ জানে না। সকলে ভাবে, আহা ওদের কি সুন্দর মানিয়েছে! যেন কোন জোড়া স্বর্গের হংস-হংসী। অথচ, প্রত্যেক দিন ওরা এক ঘরে, এক শয্যায় শোয়, শুয়ে দুজনেই কাঠ হয়ে পরে থাকে। সখীরা যখন হাসাহাসি করে ওঁর রাত্রের গল্প বলার জন্য-তখন রুপালি বুকের চাপা কান্না গোপন করেন, বইতে পড়া সমস্ত গল্প ওদের বানিয়ে বলেন। সকলে ভাবে, ত্রিস্তানের মতো স্বামী পেয়েছে, রাজকুমারীর জীবন ধন্য।
একদিন রাজপুরীর সকলে শিকারে বেরিয়েছে। রুপালিও এসেছেন। ঘোড়ায় চড়ে চলেছে সকলে। বনের মধ্যে এক জায়গায় বৃষ্টির জল জমেছে। রুপালির ঘোড়া সেই জলের ওপর দিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ জল ছিটকে এসে ওর পোশাক ভিজিয়ে দিল। খল খল্ করে হেসে উঠলেন রুপালি। ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে এনে আবার সেই জলের ওপর দিয়ে গেলেন—এরার জল ছিটকে এসে পোশাকের নিচে ওঁর উরু পর্যন্ত ভিজিয়ে দিল। হা-হা করে অনেকক্ষণ হাসতে লাগলেন রাজকুমারী। কি রকম অস্বাভাবিক সেই হাসি। বারবার রাজকুমারী ফিরে আসতে লাগলেন সেই জলের ওপর। ঘোড়ার পায়ের ধাক্কায় জল ছিটকে এসে ভিজিয়ে দিতে লাগলো রুপালির অর্ধেক শরীর। রাজকুমারী হাসতে লাগলেন উন্মাদের মতো। সকলেই অবাক। তখন যুবরাজ কাহারডিন নিজের ঘোড়া রুপালির পাশে এসে জিগ্যেস করলেন, ও কি বোন, তুই এত হাসছিস কেন?
—কি মজার, কি মজার জিনিস দাদা।
—এতে কিসের মজা?
—আমি জলের সাহস দেখে অবাক হচ্ছি। মহাবীর ত্রিস্তানও আজ পর্যন্ত যেখানে হাত ছোঁয়াতে সাহস পায়নি, এই সামান্য জলের কি সাহস, সে-ই আমার ঊরু পর্যন্ত ছুঁয়ে যাচ্ছে। মজার না দাদা? হা-হা-হা-হাসতে হাসতে রাজকুমারী ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন।
কাহারডিন তখন অবাক হয়ে ওকে জিগ্যেস করলেন, তোর কিসের দুঃখ বল্?
রাজকুমারী চোখের জল মুছে বললেন, না, কিছু না। ও এমনি।
তখন কাহারডিন খুব জোরাজুরি করার পর রাজকুমারী খুলে বললেন সব কথা। এক বছরেরও বেশি হয়ে গেল-তাঁর অমন রূপবান গুণবান স্বামী তাঁকে একদিনের জন্য ছুঁয়েও দেখেননি।
এই কথা শুনে উৎকট গম্ভীর মুখে কাহারডিন এলো ত্রিস্তানের পাশে। তাকে আড়ালে ডেকে বললে, ত্রিস্তান, তুমি আমাদের পরিবারের সকলকে অপমান করছো। তুমি রুপালিকে ঘৃণা করেও তাকে বিয়ে করেছো। এখন তাকে করছো চূড়ান্ত অবহেলা। এ অপমান আমি সহ্য করবো না। আমি তোমাকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করছি। তাতে আমি মরবো জানি-তবু আমি এ অপমান সইবো না।
ত্রিস্তান ক্লিষ্টভাবে বললো, জানতুম এ রকমই হবে। আমারই দোষ। কিন্তু যুবরাজ, তুমি যদি আমার এ দুর্ভাগা জীবনের কথা শোনো, হয়তো তুমি আমাকে ক্ষমা করতে পারবে।
ঘোড়া থেকে নেমে ওরা বসলো একটা গাছের নিচে। ত্রিস্তান একে একে বলে গেল তার সমস্ত জীবনের কথা। তার বাল্যকাল, অভিশপ্ত যৌবন, তার সর্বনাশা ভালোবাসা, বনবাস, তার উদাসীন ভ্রাম্যমান জীবন। তারপর বললো, রাজকুমার, সোনালি হয়তো আমাকে ভুলে গেছে! কিন্তু আমি ওকে ভুলতে পারি না যে! আমার নিদ্রায়-জাগরণে প্রতি মুহূর্তে সোনালি। মুহূর্তের ভুলে আমি তোমার নিষ্পাপ বোনকে বিয়ে করে, সারাজীবন পাপের ভাগী হয়েছি। মৃত্যু ছাড়া আমার আর মুক্তি নেই।
অবাক বিস্ময়ে কাহারডিন এ কাহিনী শুনলেন। যেন এক রূপকথা! সেই রূপকথার নায়ক তার সামনে বসে আছে। তারপর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে কাহারডিন বললে, ত্রিস্তান, একটিমাত্র উপায় আছে। চলো, তুমি আর আমি দুজনে লুকিয়ে কর্নওয়ালে যাই। গিয়ে দেখি, সত্যি রানী সোনালি তোমাকে ভুলে গেছে কিনা। যদি সত্যিই তিনি তোমাকে ভুলে গিয়ে সুখে থাকেন- তাহলে ফিরে এসে আমার বোনকে গ্রহণ করতে আপত্তি থাকা তোমার উচিত নয়।
ত্রিস্তান চুপ করে রইলো। কাহারডিন আবার বললে, ত্রিস্তান, আমি সারা জীবন তোমার বন্ধু হতে চাই।
ত্রিস্তান বললো, সারাটা জীবন তো আমার একজন বন্ধু খুঁজতে খুঁজতেই কেটে গেল। আমার সত্যিকারের বন্ধু ছিলেন গুরু গরভেনাল। তারপর এই তোমাকে পেলাম। চলো, আমরা কর্নওয়ালে যাই।
তীর্থযাত্রার নাম করে ত্রিস্তান আর কাহারডিন একটা জাহাজ সাজিয়ে বেরিয়ে পড়লো। অনুকূল হাওয়ায় জাহাজ এসে পৌঁছুলো কর্নওয়ালের সীমান্তে। ত্রিস্তান বললো, এ রাজ্যে নামা আমার পক্ষে বিপজ্জনক। চলো, লিডানের জমিদার দিনাসের কাছে যাই। তিনি আমাদের খুব ভালোবাসতেন।
একদিন ভোর রাত্রে ওরা এসে উপস্থিত হলো দিনাসের প্রাসাদে। দিনাস একটু গম্ভীরভাবে ওদের প্রাসাদে অভ্যর্থনা করলেন। যথোচিত আহার ও পোশাক দিলেন। তারপর তিনি থমথমে মুখে বললেন, ত্রিস্তান তুমি আবার কেন এদেশে এসেছো? তোমার ও সোনালির মধ্যে যে সত্যিকারের তীব্র ভালোবাসা ছিল তাকে আমি সম্মান করতুম। কিন্তু, তুমি সে ভালোবাসার তো সম্মান রাখোনি। আমি শুনতে পেয়েছি, তুমি বিয়ে করেছো। তোমার সম্বন্ধে আর আমার শ্রদ্ধা নেই।
ত্রিস্তান দিনাসের পা জড়িয়ে ধরে বললো, আপনার তুলনা নেই। আমি বিয়ে করেছি ঠিকই, কিন্তু সে আমার মুহূর্তের ভুল। দিনাস, আমি একটা দিনের জন্যেও আমার স্ত্রীকে স্পর্শ করিনি, সোনালি ছাড়া এক মুহূর্তও আমি অন্য কারুকে মনে স্থান দেইনি। এই কাহারডিন আমার স্ত্রীর ভাই, ও সাক্ষী আছে। ওকে জিগ্যেস করে দেখুন। দিনাস, আপনি বলুন, সোনালি কেমন আছে? সে কি আমাকে ভুলে গেছে? আমি শুনেছি, সে আমাকে ভুলে সুখে আছে?
দিনাস বললেন, ত্রিস্তান, বাইরে থেকে কতটুকু দেখা যায়! আমি জানি, সে প্রত্যেকদিন তোমার জন্যে গোপনে কাঁদে। আমি চোখে দেখলে চিনতে পারি। কিন্তু বাইরে তাকে সুখের ভান করতে হয়। সে তো তোমারই জন্য। নইলে তোমাকে লোকে আবার বদনাম দেবে। তার দুঃখ অনেক বেশি। কিন্তু ত্রিস্তান, তুমি আবার কেন এসেছো? তোমাদের মিলন তো অসম্ভব। তুমি নিজেই তো তাকে তুলে দিয়ে গেছ রাজার হাতে। তোমার দাবী শেষ হয়ে গেছে। আবার তবে কেন এসেছো রাজার শান্তি বিঘ্ন করতে।
চোখের জলে দিনাসের পা ভিজিয়ে ত্রিস্তান বললো, একবার, শুধু একবার আমি ওর সঙ্গে দেখা করে যাবো। শুধু একবার দুটো মুখের কথা শুনে যাবো। আপনি ব্যবস্থা করে দিন। আমি একটি বার দেখা করেই চলে যাবো।
ত্রিস্তান সেই সবুজ পাথরের আংটিটা দিনাসের হাতে পরিয়ে দিল। দিনাস চলে গেলেন। সেদিনই বিকেলবেলা টিন্টাজেল দুর্গে। রাজা আর রানী তখন পাশা খেলছিলেন। দিনাসকে দেখে রাজা বললেন, বলো দিনাস। খেলাটা শেষ হয়ে যাক্। তারপর আবার পাশার চাল দিতে লাগলেন। দিনাস রানীর সঙ্গে আলাদা কথা বলার কোনো সুযোগই পেলেন না। শুধু রানীকে একবার খেলার চাল দেখিয়ে দেবার জন্য হাতটা বাড়ালেন। হাতে সেই আংটি। আংটি দেখেই দারুণ চমকে উঠলেন সোনালি। জিজ্ঞাসু চোখে তাকালের দিনাসের দিকে। দিনাস চোখেই সম্মতি জানালেন যে, ত্রিস্তান এসেছে। তারপর রাজা মুহূর্তের জন্য একবার উঠে বাথরুমে যেতেই দিনাস জিগ্যেস করলেন, রানী তুমি দেখা করবে ত্রিস্তানের সঙ্গে?
সোনালি বললেন, দিনাস, ত্রিস্তানের ডাক এলে আমি রাজপুরীর এক হাজার দেওয়াল ভেঙেও বেরিয়ে যাবো। কেউ আমাকে আটকাতে পারবে না।
রাজা আবার ফিরে এলেন, তারপর দিনাসকে সঙ্গে নিয়ে চলে গেলেন সভাগৃহে। রানী কিভাবে দেখা করবেন, কখন-কিছুই শোনা হলো না।
দিনাস ফিরে এসে ত্রিস্তানকে সব বললেন। আর একটা খবরও দিলেন, দু’দিন পর রাজা আর রানী টিন্টাজেল দুর্গ ছেড়ে পাহাড়ের মাথায় গ্রীষ্মাবাসে যাবেন। সে কথা শুনে সেদিনই ত্রিস্তান গ্রীস্মাবাসে যাবার পথের ধারে জঙ্গলের মধ্যে লুকিয়ে বসে রইলো। সঙ্গে কাহারডিন। দুজনেই সশস্ত্র।
বিরাট শোভাযাত্রা বেরুলো রাজা ও রানীর সঙ্গে। প্রথমে বাদকবৃন্দ। তারপর প্রহরীর দল। তারপর পাত্রমিত্রদের সঙ্গে রাজার বিশাল রথ। পরে ছোট ছোট রথে রাজপুরীর মেয়েরা। একটি সুন্দরী মেয়ের দিকে তাকিয়ে কাহারডিন বললো, ঐ তো রানী?
ত্রিস্তান হেসে বললো, না, ও তো রানীর দাসী!
—তবে ঐ যে সাদা পোশাক পরা পরীর মতো, ঐ নিশ্চয়ই রানী? সত্যি, কি রূপ!
—না, না, ও তো রানীর সখী বিরজা!
তারপর একটি স্বর্ণমণ্ডিত রথে এলেন সোনালি। কি রূপের দ্যুতি তাঁর। এতদিনে একটুও ম্লান হয়নি। হুজুর, চাঁদের কি বয়েস বাড়ে? না, চাঁদ কোনো বছর কম সুন্দর হয়ে যায়! রানী সোনালির রূপ পূর্ণচন্দ্রের মতো অমলিন জ্যোৎস্নাময়।
রানীর রথ যখন ঝোপের পাশ দিয়ে যাচ্ছে, তখন মিষ্টি পাখির ডাক ভেসে উঠলো। যেন পর পর সুর মিলিয়ে দোয়েল, বুলবুলি, চাতক পাখি ডেকে উঠেছে। মিষ্টি অথচ কি করুণ সেই সুর। রানী সঙ্গে সঙ্গে চিনতে পারলেন, এ ডাক ত্রিস্তানের। এ ডাক বিরহের ডাক। পৃথিবীর একটিমাত্র পাখির পক্ষেই এমন ডাক সম্ভব।
রানী রথ একটু থামাতে বললেন। তারপর উচ্চস্বরে বললেন, বনের পাখি, তোমার গান শুনে আমার মন ভরে যাচ্ছে। আমি পাহাড় চূড়ায় গ্রীষ্মাবাসে যাচ্ছি। তুমি সেখানে এসে আমায় গান শোনাবে? বনের পাখি তুমি আমাকে ছেড়ে যেও না। এই দারুণ গ্রীষ্মে তোমার গান আমায় শান্তি দেবে। তুমি এসো ঠিক।
রথ আবার চলতে লাগলো। শোভাযাত্রা শেষ হয়ে গেলে ওরা দুজনে আবার ফিরে এলো দিনাসের প্রাসাদে।
ত্রিস্তান গোপনে গ্রীষ্মাবাসে যাবার জন্য তৈরি হতে লাগলো।
এদিকে ঘটল আরেক ঘটনা। রাজা মার্ক প্রায় বৃদ্ধ হয়েছেন বলেই সুযোগ পেয়ে কয়েকজন নাইট রানীর পাশাপাশি এসে ঘরঘর করে-যদি রানীর কিছু কৃপা পাওয়া যায়! রানী কারুকে গ্রাহ্য করেন না। সেদিন গ্রীষ্মাবাসে পৌঁছুবার পর, একজন নাইট একটু আড়াল পেয়ে রানীর কাছে এসে ভালো মানুষের মতো মুখ করে বললো, সত্যি, আমাদের এমন সুন্দরী রানীর জন্যই রাজ্যের এত শ্রীবৃদ্ধি! রাজা মিথ্যাই রানীকে সন্দেহ করেছিলেন। এই তো, রানী কেমন সুখে আছেন এখানে! আর ত্রিস্তানও অন্য মেয়েকে বিয়ে করে সুখে আছে বিদেশে।
—মিথ্যে কথা! ত্রিস্তান বিয়ে করেনি! রানী বলে উঠলেন।
—বাঃ, রানী আপনি জানেন না? সকলেই তো জানে। ত্রিস্তান ব্রিটানির রাজকুমারী রুপালিকে বিয়ে করেছে।
রানী তখনই উঠে নিজের ঘরে চলে এলেন। শরীরের পোশাকের ভারও যেন অসহ্য লাগলো এমন জ্বালা। ছটফট করে কয়েক প্রস্থ পোশাক খুলে ফেললেন। আয়নার সামনে দাঁড়ালেন একবার। তারপর হঠাৎ দু’হাতে মুখ ঢেকে হু-হু করে কেঁদে ফেললেন। অনেকক্ষণ ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদলেন। তারপর ভাবলেন, আমি কেন কাঁদছি! আমি তো চেয়েই ছিলাম, ত্রিস্তান সুখী হোক! কিন্তু তাহলে সে আবার আমার কাছে এসেছে কেন? আমাকে নিয়ে খেলা করতে চায়? না, না, ত্রিস্তানের বিয়ে হয়নি। মিথ্যে কথা! হে ঈশ্বর, এ খবর শোনার আগেই আমার মৃত্যু হলো না কেন? এত দীর্ঘ জীবন আমার কি প্রয়োজন? মুখে যাই বলি, ত্রিস্তানের বিয়ে করা যে আমি সহ্য করতে পারবো না, ঈশ্বর, তুমি তা জানো। কিন্তু আমিও তো স্বামীর ঘর করছি। সে দোষ কি আমার? ত্রিস্তানেরই। ও আমাকে নিজে বিয়ে করতে পারতো তার বদলে প্রভুভক্তির জন্যে সেই প্রথমবারই কেন রাজার হাতে তুলে দিল? কেন? ত্রিস্তান এমন বিশ্বাসঘাতক! ওঃ ভগবান!
রানী তখন ডাকলের সখী বিরজাকে। বললেন, সখী তুই আমাকে বিষ দে। আমি আর পারি না, আমার বুক জ্বলে যাচ্ছে!
বিরজা সব শুনে ঈষৎ হাস্যে বললো, রানী, একি ছলনা তোমার? তুমিও তো স্বামী পেয়েছো, রাজরানী হয়েছো, আর সেই হতভাগ্য একটি স্ত্রী পেতে পারে না!
দৃপ্ত ভঙ্গিতে সোনালি বললেন, আমাকে স্বার্থপর বলিস আর যাই বলিস, আমি পারবো না, পারবো না, ত্রিস্তানের পাশে অন্য কোনো মেয়েকে আমি সহ্য করতে পারবো না। তুই আমাকে বিষ দে।
বিরজা তখন বললেন, আচ্ছা, আগে দেখা যাক খবরটা সত্যি কিনা। ত্রিস্তান তো দিনাসের বাড়িতে লুকিয়ে আছে। ওখানে পেরিনিসকে পাঠানো যাক না। বিরজা ডাকলো বিশ্বাসী অনুচর পেরিনিসকে!
রানী জ্বলন্ত চোখে তাকে বললেন, পেরিনিস, তুই নিজে শুনে আয় ত্রিস্তানের বিয়ের খবর সত্যি কিনা। যদি সত্যি হয় বলিস, সে যেন এ রাজ্যের সীমানাতে আর না আসে। কোনোদিন আর আমার সঙ্গে দেখা করবার চেষ্টা না করে। যদি করে, আমি নিজে ওকে প্রহরী দিয়ে ধরিয়ে দেবো। নিজে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওর মৃত্যু দেখবো!
পেরিনিসকে দেখেই ত্রিস্তান বুকে জড়িয়ে ধরলো। বললো, বন্ধু, বলো বলো, রানী কি খবর পাঠিয়েছে, কোথায় সে আমার সঙ্গে দেখা করবে?
পেরিনিস বললো, ত্রিস্তান একথা কি সত্যি যে আপনি বিয়ে করেছেন? যদি হয়, তবে রানী আর কোনদিন আপনার সঙ্গে দেখা করবেন না!
—এ কি কথা বলছো পেরিনিস? রানী কি জানে না যে তাকে ছাড়া আর কোনো নারীকে কোনোদিনই আমার পক্ষে ভালোবাসা অসম্ভব? আমরা দুজনে যে একসঙ্গে সেই তীব্র সুরা পান করেছিলাম! হ্যাঁ, একথা সত্যি, আমার বিয়ে হয়েছে। কিন্তু সে তো মুহূর্তের ভুলে! আমি আজও সোনালির প্রতি অবিশ্বাসী হইনি। আমি আজও তাকে ছাড়া অন্য কোনো নারীকে স্পর্শ করিনি। পেরিনিস, তুমি আবার যাও, গিয়ে রানীকে জিজ্ঞেস করে এসো, কখন আমি রানীর সঙ্গে দেখা করতে পারবো। একবার ও আমাকে দেখলেই সব বুঝবে! খবর নিয়ে তুমি আবার ফিরে এসো পেরিনিস। আমি তোমার জন্য প্রতীক্ষায় থাকবো!
কিন্তু পেরিনিস আর ফিরে এলো না। রানী যে মুহূর্তে শুনলেন ত্রিস্তানের বিয়ের খবর সত্যি, সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গিয়ে নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে দিলেন। বললেন, তোমরা সব যাও। আমি কারুর মুখ দেখতে চাই না! আমি আর কোনোদিন আয়নাতেও নিজের মুখ দেখবো না!
ত্রিস্তান বৃথাই ক’দিন গোপনে ঘুরলো রানীর গ্রীষ্মাবাসের চারিদিকে। রানীর সঙ্গে দেখা হবার কোনো উপায় নেই। তখন ত্রিস্তান বেপরোয়া হয়ে গেল। সে ঠিক করলো দেখা করবেই। শুনতে পেল পরের দিন রানী যাবেন মা মেরীর মন্দিরে প্রার্থনা জানাতে। ত্রিস্তান ভিখারী সেজে মন্দিরের পথে দাঁড়িয়ে রইলো।
পথের লোক সত্যিকারের ভিখারী ভেবে ত্রিস্তানের হাতে ভিক্ষে দিয়ে যাচ্ছে। ত্রিস্তান নুয়ে নুয়ে সবার কাছ থেকেই ভিক্ষে নিচ্ছে। তারপর এলো রানীর রথ-সঙ্গে বহু দাস-দাসী ও এক ডজন প্রহরী। ভিখারী ছুটে এসে রথের সামনে দাঁড়িয়ে বললো, রানী, আমাকে একবার দয়া করো!
সোনালি সেই ভিখারীর কুৎসিত ছদ্মবেশ সত্ত্বেও, উন্নত দেহ ও মুখের রেখা দেখেই ত্রিস্তানকে চিনতে পারলেন। চিনতে পারলেন ত্রিস্তানের কণ্ঠস্বর। কিন্তু ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিলেন। ভিখারী রথের আরও সামনে এসে বললো, রানী, একবার, শুধু একবার দয়া করো!
রানী মুখ কুঞ্চিত করে বললেন, চালাও রথ।
ভিখারী তখন রথের চাকা ধরে বললো, রানী একবার আমার অবস্থা দেখো! আমি সত্যিই ভিখারী হয়েছি। আমাকে তুমি সামান্য দয়া করলে, তোমার কিছুই ক্ষতি হবে না-কিন্তু আমার সারা জীবনটা ভরে যাবে। রানী, মাত্র একবার জীবনের শেষবার-
সোনালি প্রহরীদের বললেন, সরিয়ে দাও লোকটাকে। সঙ্গে সঙ্গে পনের কুড়িটা সবল হাত ভিখারীকে চেপে ধরলো। তারপর হিঁচড়ে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে যেতে লাগলো ওকে। ভিখারী সেখান থেকেই করুণ, আর্ত গলায় চেঁচাতে লাগলো, রানী, দয়া করো, দয়া করো, একবার-
রানী হা-হা করে হেসে উঠে বললেন, দয়া চাইবার স্পর্ধা কতখানি। আবার হাসতে লাগলেন হা-হা করে। রানীর সেই হাসির শব্দ প্রতিধ্বনিত হলো মন্দিরের দ্বার পর্যন্ত। সেই হাসির শব্দে মন্দিরের ঘণ্টাগুলোও যেন দুলে উঠে ঠুং ঠুং করে বাজতে লাগলো। হাসির শব্দে ভয় পেয়ে উড়ে গেল ডানা ঝটপটিয়ে এক ঝাঁক পায়রা। আশেপাশের লোকেরা সেই হাসি শুনে একটা শব্দও উচ্চারণ করতে ভুলে গেল। ভিখারী মুখ তুলে কিছুক্ষণ দেখলো সেই হাসি, রানীর গর্বোদ্ধত মুখ-তারপর সে ধীর পদক্ষেপে পিছন ফিরে চলে গেল।
সেই রকম হাসতে হাসতেই রানী মন্দিরের সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগলেন। কয়েক ধাপ ওঠার পরেই শরীর দুলে উঠলো তাঁর। শূন্যে কিছু যেন একটা আঁকড়ে ধরার ব্যর্থ চেষ্টা করে রানী সোনালি ঝুপ করে সেই মন্দিরের সিঁড়িতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন।