সোনালী দুঃখ – ৭

রাত্রির অন্ধকার থাকতেই ছড়িয়ে পড়লো ত্রিস্তান আর সোনালির কলঙ্কের কথা। লোকে শুনলো রাজা ওদের দুজনকেই প্রকাশ্যে ফাঁসি দেবেন। দলে দলে লোক ছুটে আসতে লাগলো রাজপুরীর দিকে। একি ভয়ানক কথা!

লোকেরা চেঁচিয়ে বিলাপ করতে লাগলো ওদের নাম করে। হায় ত্রিস্তান আমাদের দেশের গর্ব তুমি, তোমাকে মরতে হবে এমন অপমানে, লজ্জায়? হায় রানী সোনালি, তোমার সৌন্দর্য চিরকাল আমাদের দেশের প্রবাদ হয়ে থাকবে পৃথিবীতে যে কেউ কখনো সুন্দরী মেয়ে দেখলে তোমার সঙ্গে তুলনা করবে-আর আজ তোমাকে আমরা চোখের সামনে মরতে দেখবো? তোমাদের নামে এ কলঙ্ক কি সত্যি? নাকি ঐ বদমাস গণৎকার ঠাকুরের কারসাজি সব? জাদুবিদ্যার প্রহেলিকা! মহারাজ, আপনি আগে ওদের প্রকাশ্যে বিচার করুন। আগেই মারবেন না।

ভোরের আলো ফুটতেই রাজা মার্ক বেরিয়ে এসে রথে উঠলেন। সোজা চলে এলেন বধ্যভূমিতে। তাঁর মুখ গনগন করছে। হুকুম দিলেন, দুটো বিশাল গর্ত খোঁড়ো। তার সামনে দুটো দণ্ড পুঁতে দাও। ফাঁতি নয়, আমি ঠিক করেছি ঐ শয়তান শয়তানীকে আমি পুড়িয়ে মারবো। ফাঁসিতে আর কতখানি সাজা হবে?

জনতা চেঁচিয়ে উঠলো, মহারাজ, আগে বিচার হোক! আগে বিচার! আগে ওদের মুখের কথা শুনুন! বিনা বিচারে হত্যা করা যে মহাপাপ! মহারাজ, আপনি ন্যায়পরায়ণ, আপনি-

রাজা মার্ক ধমকে উঠলেন, না, কোনো বিচার নয়, বিচার আমি মনে মনেই শেষ করেছি। আমি আর এক মুহূর্তও ওদের বাঁচিয়ে রাখতে চাই না। কে আপত্তি করছে, দেখি, এগিয়ে এসো সামনে!

কেউ এলো না ভয়ে।

রাজা প্রহরীদের বললেন, যাও, ওদের নিয়ে এসো!

*

প্রহরীরা ছুটে গেল। একদল প্রহরী টানতে টানতে সোনালির সামনে দিয়ে নিতে এলো শৃঙ্খলাবদ্ধ ত্রিস্তানকে। সোনালি শান্ত স্বরে বললো, ত্রিস্তান, আবার দেখা হবে। স্বগত অথবা নরক কোথায় আমরা যাবো জানি না। কিন্তু আবার দেখা হবে। ত্রিস্তান বললো, সোনালি, আবার ঠিক দেখা হবে!

দুর্গ থেকে বরিয়ে পাহাড়ী রাস্তা দিয়ে টানতে টানতে নিয়ে যেতে লাগলো ত্রিস্তানকে, এমন সময় দূরে একজন অশ্বারোহীকে আসতে দেখা গেল। দিনাস নামে এক জমিদার, যিনি বরাবরই ত্রিস্তানকে ভালোবাসতেন। দিনাস এত বেগে ঘোড়া ছুটিয়ে এসেছেন যে, ঘোড়ার মুখ ফেনায় ভরে গেছে। দিনাস বললেন, ত্রিস্তান, আমি খবর পেয়েই ছুটে এসেছি। একি অসম্ভব কথা! না, তোমাদের এভাবে মরা অসম্ভব। আমি রাজার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি।

তারপর দিনাস প্রহরীদের দিকে ফিরে বললেন, হতভাগারা, তোরা ওকে অমন ভাবে শিকল দিয়ে বেঁধেছিস, একটু বিবেক নেই তোদের? কে তোদের রাজ্য বাঁচিয়েছে? খুলে দে শিকল। যদি ত্রিস্তান পালাবার চেষ্টা করে তোদের হাতে তলোয়ার নেই? ও একা নিরস্ত, আর তোরা দশজন। খুলে দে।

প্রহরীরা লজ্জায় শিকল খুলে দিলো। কিন্তু হাতে তলোয়ার নিয়ে তারা ঘিরে রইলো ত্রিস্তানকে। দিনাস ঘোড়া ছুটিয়ে চলে গেলেন।

এবার শুনুন হুজুর, ঈশ্বরের করুণার কথা। আপনারা জ্ঞানী গুণী, আপনাদের কিছুই অজানা নেই। আপনারা জানেন, যে পাপ করে সে রাজার হাত এড়িয়ে পালালেও ঈশ্বর তাকে শাস্তি দেন। আবার যে পাপ করে না, সে রাজার হাতে ধরা পড়লেও ঈশ্বর তাকে বাঁচান। ভালোবাসা কি পাপ? তাহলে পৃথিবীতে পুণ্য বলে কিছু নেই। ভালোবাসা যদি পাপ হয়, তবে গান গাওয়াও পাপ, ঈশ্বরকে পূজা করাও পাপ। প্রেমিককে যদি ঈশ্বর না রক্ষা করেন, তাহলে বুঝতে হবে ঈশ্বর নেই। ঈশ্বর ত্রিস্তানকে রক্ষা করলেন।

পাহাড়ী রাস্তায় যেতে যেতে একটা চূড়ার উপর ছোট্ট একটা গির্জা। তার একপাশে এই রাস্তা, আর একপাশে খাড়া পাহাড়ের খাদ, একেবারে নেমে গেছে সমুদ্র পর্যন্ত! ত্রিস্তান সেখানে এসে বললো, প্রহরী, আমি এই গির্জায় ঢুকে শেষবারের মতো ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতে চাই। কিন্তু আমি একা যাবো। আমার তো পালাবার পথ নেই, একটাই তো দরজা, সেখানে তোমরা পাহারা দেবে।

প্রহরীরা নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করে রাজী হয়ে গেল। ত্রিস্তান ছিল তাদের রাজ্যের চোখের মণি। আজ তাকে সামান্য কয়েদীর মতো বেঁধে নিয়ে যেতে হচ্ছে। সসম্ভ্রমেই তারা ত্রিস্তানকে গির্জার মধ্যে যেতে দিলো। ত্রিস্তান গির্জায় ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দিলো। তারপর ছুটে গিয়ে লাফিয়ে উঠলো গির্জার জানালায়। কাঁধের চাড় দিয়ে দিয়ে বেঁকিয়ে ফেললো শক্ত লোহার শিক। সেখানে দাঁড়িয়ে ত্রিস্তান দেখলো বহু নিচে সমুদ্রের পাড়। এখান থেকে লাফালে নিশ্চিত মৃত্যু।

ত্রিস্তান বুক ভরে নিশ্বাস নিয়ে সেই দেড় হাজার ফুট নিচের সমুদ্রে লাফিয়ে পড়লো। ওখান থেকে কোনো জীবন্ত মানুষ সজ্ঞানে লাফাতে পারে না। অসম্ভব! আজ পর্যন্ত কর্নওয়ালের লোক ঐ জায়গাটাকে বলে ত্রিস্তানের লাফ।

ত্রিস্তান মরতেই চেয়েছিল। সাধারণ চোর-ডাকাতের মতো সকলের সামনে মরার চেয়ে সে নিজেই মরতে চেয়েছিল। কিন্তু তার পরনে ছিল বিশাল আঙরাখা, বাতাসে সেটা ফুলিয়ে তার পড়ার গতি কমিয়ে দিল। সে ঝুপ করে গিয়ে পড়লো সমুদ্রে। পতনের বেগে সমুদ্রের অনেক নিচে ডুবে গেল সে, কিন্তু বুকভরা নিশ্বাস ছিল বলে ভেসে উঠতে খুব অসুবিধে হলো না। তাড়াতাড়ি সাঁতরে এসে পাড়ে উঠলো।

এদিকে গুরু গরভেনাল ত্রিস্তানের বন্দিদশার কথা শুনে তাড়াতাড়ি বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছিলেন যথাসর্বস্ব নিয়ে। ত্রিস্তানের ওপর রাগে, রাজাও তাঁকে হত্যা করবেন নিশ্চিত। ঘোড়া ছুটিয়ে পালাতে গরভেনাল দেখলেন বালির ওপর দিয়ে পাগলের মতো একটা লোক ছুটছে। কাছে এসে দেখলেন ত্রিস্তান। ত্রিস্তান গরভেনালকে দেখেও গ্রাহ্য করলো না। তখনো ছুটলো লাগলো। গরভেনাল তার জামা চেপে ধরে বললেন, কোথায় যাচ্ছো ত্রিস্তান?

উন্মত্তের মতো ত্রিস্তান বললো, আমায় ছেড়ে দিন, আমার আর সময় নেই। গুরুদেব, আমি মরতে চেয়েছিলাম। কিন্তু বেঁচে গেলাম। কিন্তু কেন বাঁচলাম? সোনালিকে যদি ওরা মেরে ফেলে, তবে আমার বেঁচে লাভ কি? গুরুদেব আমাকে আমি যাই, আমি একা খালি হাতেই ওদের ধ্বংস করে দেবো। ওরা পারবে না সোনালিকে মারতে! পারবে না!

গরভেনাল ঘোড়া থেকে নেমে ত্রিস্তানকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, ত্রিস্তানতুমি কি সত্যি পাগল হলে? তোমার যতই শক্তি থাক্, তুমি একা কি করবে। ওখানে রাজার হাজার সৈন্য। তোমার বর্ম, তলোয়ার সব এনেছি আমি, তবু তুমি একা যুদ্ধ করে পারবে না। এসো বরং আমরা একধারে লুকিয়ে বসে তাকি।

—কি হবে চুপ করে বসে থেকে?

—পথ দিয়ে কত মানুষ যাচ্ছে, তাদের কথা শুনে আমরা সব ঘটনা জানতে পারবো।

—সোনালিকে যদি মেরেই ফেলে, তবে আমরা আর কি করবো?

—তুমি পালিয়েছো শুনে রাজা সোনালিকে হয়তো আজই নাও মারতে পারেন। যদি সত্যিই মেরে ফেলেন, তাহলে, ত্রিস্তান, যীশুর নামে, মা মেরীর নামে শপথ করছি, আমরা দুজনে এই রাজ্য ছারখার করে দেবো। যতক্ষণ আমাদের হাতে তলোয়ার থাকবে সোনালির মৃত্যুর প্রতিশোধ না নিয়ে থামবো না! প্রতিশোধ না নিয়ে ক্ষত্রিয় কখনো মরতে চায় না! কিন্তু আগে দেখি, হয়তো ওরা সোনালিকে মারবে না।

অস্ত্রে বর্মে সজ্জিত হয়ে ত্রিস্তান গরভেনালের সঙ্গে পথের পাশে একটা ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে রইলো।

ত্রিস্তানের পলায়নের খবর শুনে রাজা জ্বলে উঠলেন। যেন তাঁর সর্ব শরীরে বিছুটি দংশন করছে। তিনি বিকৃত স্বরে বললেন, আচ্ছা আগে শয়তানীকে আন, তাকে পুড়িয়ে মারি। নিজের চোখে দেখি ওর পুড়ে মরা। তারপর দেখবো সে কুকুরটা কোথায় পালায়! আমি পৃথিবীর শেষ প্রান্ত থেকেও ওকে খুঁজে বার করবো।

মাটি দিয়ে ছেঁচড়াতে ছেঁচড়াতে টেনে আনা হলো সোনালিকে। চুল বিস্রস্ত! একটি সত্যিকারের সোনার প্রতিমাকেই যেন ধুলো মাখিয়েছে ওরা! তাঁকে এনে বাঁধা হলো সেই দণ্ডের সঙ্গে। জনতার কথায় যখন তিনি বুঝতে পারলেন যে ত্রিস্তান পালিয়ে গেছে, এক বিন্দু অশ্রু খসে পড়লো তাঁর চোখ থেকে। সূর্যের আলোয় আগুনের মতো জ্বলছে তাঁর সোনার চুল। তাঁর গড়িয়ে পড়া অশ্রুও যেন মনে হলো এক ফোঁটা গলিত স্বৰ্ণ।

প্রহরীরা আগুন লাগাতে যাবে, এমন সময় দিনাস এসে উপস্থিত হলেন। রাজার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বললেন, মহারাজ, ক্রোধের বশে আপনি এ কি করছেন? বিনা বিচারে কোনো সৎ রাজা কারুকে শাস্তি দেয় না। পরে এজন্য আপনাকে অনুপাপ করতে হবে।

—আমি কোনো কথা শুনতে চাই না!

—মহারাজ, আমি আপনার প্রজা নই। কিন্তু বহু বিপদে আপনার পাশে এসে দাঁড়িয়েছি। তার প্রতিদান হিসাবে আপনি রানীকে আমায় দয়া করুন। আপনি তো ওঁকে মেরে ফেলতেই চান, তার বদলে আমাকে দান করে দিন। অথবা বিচার করুন ওঁর অপরাধ। হয়তো পুরোটাই আপনার বোঝার ভুল। ত্রিস্তান রানীর ঘরে কয়েক মুহূর্তের জন্য গিয়েছিল, তাতে কি প্রমাণ হয়? কিছুই না।

—প্রমাণের দরকার নেই। আমি সব জানি।

—মহারাজ, আর একটা কথাও ভেবে দেখুন। রানীকে যদি পুড়িয়ে মারেন, তবে আর কোনো দিন আপনার রাজ্যে শাস্তি থাকবে না। ত্রিস্তান পালিয়েছে। সে কি প্রতিশোধ নেবে না? এ রাজ্যের পথঘাট, পাহাড়-গুহা জঙ্গল সব তার চেনা। সে এখানেই লুকিয়ে থাকবে। ভয়ংকর ক্রোধে, প্রতিশোধের ইচ্ছায় বারবার সে হানা দিয়ে এ রাজ্য ছার-খার করে দেবে। আপনাকে সে ভালোবাসে, আপনার গায়ে সে হয়তো হাত তুলবে না, কিন্তু এ রাজ্যে আর কে আছে তার তলোয়ারের সামনে দাঁড়াতে পারে।

—এসব কথা পরে শুনবো, আগে এই পাপীয়সী, বিশ্বাসঘাতিনীর শাস্তি হয়ে যাক্।

—মহারাজ, ও যদি আপনার এতই দু’চোখের বিষ হয় তবে সোনালিকে আমায় দিয়ে দিন। আমার সেবার পুরস্কার হিসাবে। আমি ওর জন্য দায়ী থাকবো। আমি ওকে মায়ের সম্মান দিয়ে আমার প্রাসাদে রাখবো। তারপর যদি কখনো আপনার রাগ পড়ে…

—দিনাস, তুমি আমার সময় নষ্ট করো না। আমি কথা দিচ্ছি, এর পর থেকে সকলের ক্ষেত্রে আমি সুবিচার করবো। কিন্তু, এই কুলটা স্ত্রীলোকটাকে আমি এক্ষুনি মেরে ফেলতে চাই। আমি ওকে ভালোবেসেছিলুম, এই তার প্রতিদান।

জমিদার দিনাস তখন উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, মহারাজ, আরকোনো দিন আমি আপনার রাজ্যে পা দেবো না। আজ থেকে আমি আর আপনার বন্ধু নই। ঘোড়ায় উঠে চলে গেলেন দিনাস। সোনালি তাঁর দিকে তাকিয়ে ম্লানভাবে হাসলেন। সেই ক্লিষ্ট হাসিতে অনেক কৃতজ্ঞতার চিহ্ন ছিল।

রাজার হুকুমে সোনালির পায়ের কাছের গর্তের শুকনো কাঠকুটোয় আগুন লাগানো হলো। দাউ দাউ করে পায়ের কাছে জ্বলে উঠলো আগুনের শিখা। স্যোলির মাথার চুল অগ্নিবর্ণ। এমন মূর্তি কেউ কখনো দেখেনি। জনতা হায় হায় করে কেঁদে উঠলো।

এমন সময় একশোজন কুষ্ঠরোগী এলো দল বেঁধে। তারা প্রহরীদের অগ্রাহী করে তাড়াতাড়ি আগুন নিভিয়ে দিল। তাদের নেতা ইভান বললো, মহারাজ, একটু অপেক্ষা করুন। পুড়িয়ে মারতে হয় একটু পরে মারবেন। তার আগে আমার একটা প্রস্তাব আছে। পুড়িয়ে মারলে তো ওঁর যন্ত্রণা এখুনি শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু তার চেয়ে এমন উপায় যদি বলতে পারি যাতে অশেষ যন্ত্রণা পেয়ে দীর্ঘদিন দগ্ধে দগ্ধে-মরবেন উনি, তাহলে-

রাজা বললেন, পুড়িয়ে মারার চেয়েও বেশি যন্ত্রণার শাস্তির কথা যদি কেউ আমাকে বলতে পারে, তবে আমি তাকে পুরস্কার দেবো।

শুনে কুষ্ঠরোগীর দল খিস্থিক্ করে হেসে উঠলো। একশোজন কুঠো সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে- কেউ ক্রাচে ভর দিয়ে, কেউ লাঠি হাতে। সারা শরীরে ঘা, চোখগুলো ফোলা ফোলা, কারুর হাতের আঙুল গলে পড়ে গেছে। ওরা থাকে শহরের বাইরে মানুষ ওদের কাছে ঘৃণায় যায় না।

ওদের নেতা ইভান বললো, মহারাজ, আমরা একশোজন খবর পেয়েই ছুটে এসেছি। রানী সোনালিকে আমাদের হাতে দিন। আমরা সবাই মিলে ওঁকে ভোগ করবো। মহারাজ, আমাদের শরীরে কুষ্ঠ, তা বলে তো আমাদেরভোগ-বাসনা মরে যায়নি। কতদিন আমারা স্ত্রীলোকের স্বাদ পাইনি। রানীর এর চেয়ে বেশি শাস্তি আর কি হতে পারে। রানী আমাদের আলিঙ্গনে ঘৃণায় চোখ বুজবেন। প্রতি মুহূর্তে মরতে চাইবেন। অথচ আমরা ওঁকে সহজে মরতে দেবো না। ওঁরও শরীরে কুষ্ঠ হবে, একটু একটু করে পচে গলে যাবে ঐ রূপ, প্রত্যেকদিন পাপের ফল ভোগ করবেন। মহারাজ, এ শাস্তি আপনার পছন্দ হয় না?

রাজা মার্ক মাথা নিচু করলেন। ক্রোধের চেয়ে বড় শত্রু তো মানুষের নেই। রাজা তখন অন্য মানুষ হয়ে গেছেন। ক্রোধের চেয়েও বেশি তাঁর অপমান! ত্রিস্তান আর রানীকে তিনি সত্যিই ভালোবাসতেন। সে ভালোবাসার অপমানে তিনি হিংস্র হয়ে উঠেছেন। তাই বলে উঠলেন, দাও, রানীর বাঁধন খুলে ওদের হাতে দিয়ে দাও।

সোনালি এতক্ষণ একবারও কাঁদেননি। এবার, বাঁধন খুলে দেবার পর চিৎকার করে ছুটে এসে রাজার পায়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে বললেন, মহারাজ, যদি কখনো আমাকে একটুও ভালোবেসে থাকেন, তবে সে কথা মনে করে, আমাকে এখুনি মারুন। ওদের হাতে দেবেন না। আমাকে আপনি নিজের চোখের সামনে হত্যা করুন। মহারাজ-

রাজা ঘৃণায় রানীকে পা দিয়ে ঠেলে দিয়ে বললেন, যাও, ঐ তোমার যোগ্য জায়গা!

রানী তবু আর্তকণ্ঠে বললেন, মহারাজ, আমি আপনার কাছে দয়া চাইবো না কিন্তু আমাকে বাঁচিয়ে রাখা তো আপনারই কলঙ্ক। লোকে তো বলবে, আপনারই রানী-

রাজা গর্জন করে বললেন, এ রাজ্যে আজ থেকে যে রানীর নাম উচ্চারণ করবে, তাকে আমি কঠিন শাস্তি দবো!

কুষ্ঠীর দল আনন্দে হৈ হৈ করে উঠলো। তারপর সকলে মিলে ঘিরে নিয়ে চললো সোনালিকে। সোনালি তখন প্রতি মুহূর্তে মৃত্যু চাইবেন। ইভান তাঁর গায়ে হাত দিতে এলে তিনি কুঁকড়ে কুঁকড়ে সরে যাচ্ছেন। সমবেত জনতা দীর্ঘশ্বাস, রানীর কান্না আর কুষ্ঠরোগীদের নিষ্ঠুর উল্লাসে কি মর্মান্তিক নিষ্ঠুর পরিবেশ!

হল্লা করতে করতে ওরা নিয়ে চললো রানীকে। জনতার এক অংশও বুক চাপা হাহাকারে চললো সঙ্গে সঙ্গে। সেই শ্মশানভূমিতে নিজের আসনে রাজা চুপ করে বসে রইলেন। একটাও কথা বললেন না। তাঁর মাথা ঝুলে পড়লো বুকের কাছে। সৈন্য- সামন্তরাও বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে! কেউই বুঝতে পারছে না এখন কি করবে। ঘটনার এত দ্রুত পরিবর্তনের ধাক্কা কেউ সামালাতে পারছে না। কাল সকালে এদেশ ছিল কি সুন্দর শান্তির দেশ, আর আজ সকালে এ কী দৃশ্য! সৈন্যরা অনেকে ভয় পেতে লাগলো, রাগে-শোকে-দুঃখে মহারাজ হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন না তো?

কুষ্ঠরোগীরা এসে পৌঁছোলো পাহাড়ের গুহার কাছে। এই গুহার অন্ধকারে তাদের দিন কাটে। গুহার মুখে এসে রানীকে ঘিরে তারা নাচতে লাগলো। চোখ বন্ধ করে রানী দাঁড়িয়ে আছেন মাঝখানে, আর তাঁকে ঘিরে বিকৃতভাবে চিৎকার করছে একশোজন বিকলাঙ্গ মানুষ। এই দৃশ্য দেখেও সূর্য চোখ বোজেননি, বাতাস বন্ধ হয়ে যায়নি, মা বসুমতী কেঁপে ওঠেননি লজ্জায়। প্রকৃতি বড় উদাসীন, মানুষের সুখ-দুঃখ অনুযায়ী প্রকৃতির রূপ বদলায় না।

এদিকে পথের পাশের ঝোপে লুকিয়ে থেকে ছট্‌ফট্ করছে ত্রিস্তান। বারবার গুরুকে বলছে, গুরু, আর কতক্ষণ এই রকম কাপুরুষের মতো বসে থাকবো? যদি সব শেষ হয়ে যায়, তারপর আর আমার বেঁচে থেকে লাভ কি? এতক্ষণে হয়তো সোনালিকে পুড়িয়ে মেরেছে। না গুরুদেব, আমি যাই।

গুরু বললেন, আর একটু ধৈর্য ধরো! ওই যে দূরে একদল লোক আসছে, শুনি, ওরা কি বলে।

একদল লোক নিজের মধ্যে বিলাপ করতে করতে আসছিলো। হায়, হায়! রাজা হঠাৎ এ কি রকম হয়ে গেলেন, তাঁর কি মাথা খারাপ হয়ে গেল! রানী যতই দোষ করে থাকুন, তাঁকে তিনি কুষ্ঠরোগীদের হাতে দিয়ে দেবেন? এতক্ষণ কুষ্ঠরোগীরা হয়তো রানীকে নিয়ে গুহায় পৌঁছেচে ইস, ও নরকে ঢোকার আগে রানীর মরে যাওয়াই ভালো।

হলুদ বাঘ যেমন ঝোপ থেকে বিদ্যুৎ গতিতে লাফিয়ে বেরিয়ে আসে, সেইরকম বেগে গুরুকে নিয়ে অশ্বরোহী ত্রিস্তান বেরিয়ে এলো রাস্তায়-ছুটে চললো পাহাড়ের গুহার দিকে।

নাচ থামিয়ে ইভান তখন সঙ্গীদের বলছে, ভাইসব, আজ আমাদের জীবন ধন্য! কুষ্ঠরোগ দেবার জন্য আজ ভগবানকে ধন্যবাদ দাও। ভাগ্যিস কুষ্ঠরোগী হয়েছিলাম, তাই তো রানী সোনালির মতো পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েকে পেলাম! কিন্তু, আমি তোমাদের সর্দার, প্রথম এক সপ্তাহ রানীকে একা একা ভোগ করবো। তারপর তোমার এক এক করে। প্রথম সপ্তাহ রানী আমার! এসো রানী!

ইভান হাত বাড়িয়ে এগিয়ে গেল রানীর দিকে।

ঠিক সেই মুহূর্তে রুদ্র মূর্তিতে উপস্থিত হলো ত্রিস্তান। চেঁচিয়ে বললো, সাবধান ইভাব! তুই বড় বেশি সময় রানীর পাশে থেকেছিস। বামন হয়ে তুই চাঁদের গায়ে ছায়া ফেলতে চাইছিস। সাবধান! আর এক মুহূর্তও যদি-

এতদিন পরে একজন নারীকে পেয়ে, তাও রানী সোনালির মতো রমণীশ্রেষ্ঠা-আবার হাতছাড়া হবার উপক্রম দেখে কুষ্ঠরোগীর দল ক্ষেপে উঠলো। ইভান চিৎকার করে উঠলো, ভাইসব, হুঁশিয়ার! যুদ্ধ! অমনি সব কটা কুষ্ঠী যে যার ক্রাচ, লাঠিসোঁটা উঁচিয়ে এলো মারবার শব্দে। সে কি হুড়োহুড়ি আর বীভৎস চিৎকার!

আপনারা যাঁরা এ কাহিনী শুনছেন, এবার একটা কথা বিচার করে দেখুন। অনেক অর্বাচীন কবি এইখানে লিখেছে যে, ত্রিস্তান নাকি তলোয়ারের কোপে ইভানের মাথা কেটে ফেলেছিল। আপনারাই বলুন হুজুর, তাও কখনো সম্ভব? ত্রিস্তানের মতো ওরকম মহৎ বীরপুরুষ কখনো একটা খোঁড়া লোকের গায়ে হাত তুলতে পারে? অমন উদার অন্তঃকরণ যার-সে কখনো দুর্বল, অস্ত্রহীন, অশক্তের গায়ে আঘাত করে না। আসল কথাটা আমি জানি হুজুর। ত্রিস্তান নয়, গুরু গরভেনালই রাগের মাথায় একটা ওক গাছের ডাল ভেঙে ইভানের মাথায় এমন জোরে মেরেছিলেন যে, তার মাথাটা সঙ্গে সঙ্গে ছাতু হয়ে যায়। ত্রিস্তান তীব্র গতিতে ঘোড়া ছুটিয়ে এসে রানী সোনালিকে তুলে নিল সামনে, সেই ঘোড়ারই পেছনে তুলে নিল গরভেনালকে। তারপর ঘোড়ার মুখ ফেরালো বিপরীত দিকে। এক ঘোড়াতেই তিনজনে কয়েক মিনিটের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল দূরের জঙ্গলে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *