সোনার কাঁটা – ৮

অক্টোবরের পাঁচ তারিখ, শনিবার।

ঝলমলে রোদ উঠেছে আজ। মেঘ সরে গেছে। গাঁইতা আর কোদাল নিয়ে গ্যাংকুলিরা নেমেছে কার্ট-রোড মেরামত করতে।

উৎপাটিত টেলিগ্রাফ পোল আবার মাথা তুলে খাড়া হচ্ছে। মিলিটারি জিপ নাচতে নাচতে চলতে শুরু করেছে, গর্তে-ভরা কার্ট-রোড দিয়ে অনেক কষ্টে অ্যাম্বুলেন্স ভ্যান এসে নিয়ে গেছে দু-জন আহত মানুষকে রিপোস থেকে হাসপাতালে।

আজ মেঘভাঙা সকালে সবাই আবার গোল হয়ে বসেছে ড্রয়িং রুমে। বাসু-সাহেবকে ঘিরে। পরিচিত দলের মধ্যে যোগ হয়েছে একটি নতুন মুখ-দার্জিলিং থানার ও. সি. নৃপেন ঘোষাল। সে কোনো টেলিফোন পেয়ে আসেনি। রাস্তায় জিপ চলতে শুরু করা মাত্র নৃপেন চলে এসেছিল ঘুমে। খবর নিতে, রিপোসের অবস্থা। নৃপেন প্রশ্ন করে, আপনি স্যার ঠিক কখন বুঝতে পারলেন?

—একেবারে প্রথম সাক্ষাৎ মুহূর্তেই!

—প্রথম সাক্ষাতেই!—চমকে উঠে কৌশিক : কেমন করে?

—মারাত্মক একটু ভুল করে বসেছিল সুবীর, আই মীন সহদেব। দোসরা তারিখে রাত এগারোটায় সে নিজেই ফোন করে তোমাদের বলেছিল—’আমি নৃপেন ঘোষাল, ও. সি. দার্জিলিং বলছি।’ তারপর মধ্যরাত্রে এখানে আসবার আগে সে বাড়ির বাইরে টেলিফোনের লাইনটা ছিঁড়ে ফেলে, যাতে আমরা আর থানার সঙ্গে যোগাযোগ না করতে পারি।

কৌশিক বাধা দিয়ে বলে, সে তো বুঝলাম; কিন্তু আপনি কেমন করে বুঝলেন— ও জাল?

—বলছি। পরদিন সকালে তার সঙ্গে আমার পরিচয় হল। প্রথম সাক্ষাতেই আমি ইব্রাহিমের সেই ‘এক : দুই : তিন’ লেখা কাগজটার প্রসঙ্গ তুললাম। সুবীরবেশী সহদেব তখন একটা দুঃসাহস দেখিয়ে বসে। ও চেয়েছিল আমাদের, মানে তোমাদের ভয় দেখাতে। ভয়ে নার্ভাস করে দিতে। বেড়াল যেমন খেলিয়ে নিয়ে ইঁদুরছানাকে মারে! তাই সে ঐ ‘এক : দুই : তিন’ লেখা লেখা কাগজখানা তোমাদের দেখাতে চাইল। আগে থেকেই সেটা ও নতুন করে লিখে এনেছিল। ও তাই কাগজখানা সকলকে দেখাবার লোভ সামলাতে পারল না। হয়তো ও আমাকে ঐ ভাবে ঠকাতে চেয়েছিল। পাছে আমি ওর আইডেন্টিটি কার্ড দেখতে চাই, তাই ওভাবে ওর অভিজ্ঞানঅঙ্গুরীয় মেলে ধরেছিল আমার কাছে—প্রমাণ করতে চেয়েছিল যে, ও নৃপেনের কাছ থেকে আসছে। আর তাতেই ও ধরা পড়ে গেল।

সুজাতা বলে, কেমন করে? কাগজখানা তো আমরাও দেখেছি—

—দেখেছ। কিন্তু তোমরা দেখেছ মাত্র একবার। আমি দেখেছি দুবার। আমার ক্রিমিনাল লইয়ারের চোখ ভুল করেনি। কাগজখানা দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম–ওই লোকটাই সহদেব! ও নৃপেনের সহকারী সুবীর রায় নয়!

—কেমন করে?

—নৃপেন যে কাগজটা দেখিয়েছিল সেখানা আর এই কাগজটা হুবহু এক। দুটোই চব্বিশ পাউন্ডের ব্যাঙ্ক পেপার, একই কালো কালি, একই হস্তাক্ষর, একইভাবে উপর দিকে পারফোরেটেড এবং ডান কোনায় ছেঁড়া। তবু একটি অতি সূক্ষ্ম তফাত ছিল। প্রথমবার ‘দার্জিলিঙ’ শব্দটার শেষ অক্ষরটা ছিল ঙ’; দ্বিতীয়বার ‘ং’। ব্যস! চূড়ান্ত ভাবে ধরা পড়ে গেল সহদেব।

সুজাতা আবার বলে, কিন্তু কেমন করে?

—বুঝলে না ‘ঙ’ মুছে গিয়ে ‘ং’ এল কেমন করে? ফলে এখানা নতুন করে লেখা। কে লিখেছে? নিঃসন্দেহে যে সেটা দাখিল করছে। কিন্তু দুটি কাগজের হস্তাক্ষর এক হয় কী করে? অর্থাৎ ঐ লোকটাই আবার ইব্রাহিম-যে লোকটা পয়লা তারিখ কয়েক মিনিটের জন্য ঐ মাস্টার কী দিয়ে তেইশ নম্বর ঘরে ঢোকবার সুযোগ পেয়েছিল! রানু, তোমার মনে আছে আমি তখনই বলেছিলাম সহদেবকে আমি চিনতে পেরেছি, কিন্তু প্রমাণ এমন পাক্কা নয় যাতে খুনি আসামি কনভিকশান হতে পারে।

মিসেস সেন বলেন, ঈস্! তাই সব জেনে-শুনে আপনি ঘাপটি মেরে বসেছিলেন?

—ইয়েস্ ম্যাডাম! তাই সব জেনে-শুনে আমি ঘাপটি মেরে বসেছিলাম। কিন্তু আমার ভুল কোথায় জান? আমি ভেবেছিলাম—আমিই ওর সেকেন্ড টার্গেট। অরূপ নয়। ওখানেই সে আমাকে টেক্কা মেরেছে। কিন্তু তৃতীয়বার আমি আর ভুল করিনি, বুঝতে পেরেছিলাম—এবার ওর টার্গেট হচ্ছে রানু।

কাবেরী প্রশ্ন করে, কেন? মিসেস বাসু কেন?

—কারণ সহদেব জানত আমি সশস্ত্র আছি। ও বুঝতে পেরেছিল, আমি ওর নাগালের বাইরে, গুলি করতে গেলে গুলি খেতে হতে পারে! তাছাড়া ও জানত রানুর মৃত্যু আমার কাছে মর্মান্তিক যন্ত্রণাদায়ক হবে, কারণ—

—কারণ?—সুজাতা জানতে চায়।

বাসু-সাহেব রানির দিকে ফিরে বলেন, সবার সামনে বলব?

হতচকিত হয়ে রানি বলেন, কী?

—রানুকে আমি ভীষণ ভালোবাসি!

সবাই হেসে ওঠে ওঁর ভঙ্গিতে। মিসেস বাসুও রাঙিয়ে ওঠেন। বলেন, ছাই বাসো! আচ্ছা ঐ লোকটা আমাকে বলেছিল যে, সে আমাকে খুন করতে চায় তখন পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে তুমি কী করে চুপ করে ছিলে! তুমি পারলে ঐ খুনিটার সামনে আমাকে ওভাবে বসিয়ে রাখতে?

বাসু-সাহেব মুখটা সুচালো করেন। নীরবে মাথাটা নাড়েন সম্মতিসূচকভাবে।

—তোমার একটুও মায়া হল না?

—কই আর হল রানু? মিস ডিক্রুজাকে যখন খুঁজে পাওয়া গেল না, তখন একমাত্র অস্ত্র হচ্ছে ওর নিজ মুখে কনফেশান। সেটা তোমার কাছে স্বীকার করার আগে কি আর ওকে নিরস্ত্র করতে পারি? যতই কেন না ভালোবাসি তোমাকে—আমি যে ক্রিমিনাল লইয়ার!

কৌশিক জানতে চায়, আচ্ছা সহদেবের প্ল্যানটা কী ছিল?

—এখনও বুঝতে পারনি? রানি প্রথমবার যখন গানটা গায় তখন সহদেব ছিল তার নিজের ঘরে। চট করে সে গানটা টেপ রেকর্ড করতে শুরু করে। তখনও ওর তৃতীয় এমনকি দ্বিতীয় খুনের পরিকল্পনাও করা ছিল না। গানটা রেকর্ড করার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল প্রয়োজনমত আমাদের ভবিষ্যতে বিভ্রান্ত করা। মিনিটখানেক পরেই সহদেব শোনে অরূপ এসে পিয়ানো বাজাচ্ছে। মুহূর্তমধ্যে সে মনস্থির করে—বাথরুমের কলটা খুলে দেয় এবং অরূপকে গুলি করে বাথরুমে ঢুকে যায়। তারপর ধীরে-সুস্থে সে তৃতীয় খুনের পরিকল্পনা করে। ও চেয়েছিল—দ্বিতীয়বার রানীর গান টেপ-রেকর্ডে “তোমায় জানাতেম” শব্দটায় পৌঁছানোমাত্র সে রানীকে গুলি করে ছুটে বেরিয়ে যাবে ড্রয়িংরুমে ও যেখানে দাঁড়িয়েছিল সেখান থেকে পিয়ানোর টুলটা ফুট চারেক দূরে, পাশের ঘরে। তোমরা এসে ওকে দেখতে পেতে ড্রয়িংরুমে পড়ে থাকতে। পরে রানির মৃত্যুর তদন্ত যখন হত তখন ওর মোক্ষম অ্যালেবাই থাকত পিয়ানোর শব্দ। রানি যে আদৌ গায়নি আর ও বাজায়নি তা কেউ কোন দিন জানতে পারত না—একমাত্র রানিই হতে পারত সে ঘটনার সাক্ষী; কিন্তু তৃতীয় হত্যাকাণ্ডের তদন্ত যখন হত তখন রানির এজাহার আর নেওয়া যেত না—

নৃপেন বলে, কিন্তু ওর টেপ রেকর্ডার আর ডিসচার্জড রিভলবারটা তো আমরা তদন্তের সময় খুঁজে পেতাম। ও যে আদৌ পিয়ানো বাজাতে জানে না এটা প্রমাণ করতাম!

—না, দারোগা-সাহেব, তা পেতে না! ওর পরিকল্পনা অনুযায়ী পেতে না। সে রাত দশটার মধ্যেই ‘থানায় যাচ্ছি’ বলে বেরিয়ে যেত। তাকে আমরা সবাই পুলিশ-অফিসার বলে মেনে নিয়েছিলাম—ফলে আমরা তাতে আপত্তি করতাম না। সহদেব অনায়াসে হাওয়ায় মিলিয়ে যেত!

কাবেরী বলে, উঃ! কী ভীষণ!

বাসু-সাহেব বলেন, তুমিই কিন্তু আমাকে সবচেয়ে বেশি ভুগিয়েছ কাবেরী!

—আমি! ওমা, কেন! কী করে?

—কার্শিয়াঙে তোমার বান্ধবী অথবা বন্ধুর সঙ্গে ঝগড়া করে!

কাবেরী অবাক বিস্ময়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকে। শেষে সামলে নিয়ে বলে, আপনি কেমন করে জানলেন?

—জানি না। আন্দাজ করছি। তুমি নিজেই সুজাতাকে বলেছিলে যে, কার্শিয়াঙে তুমি আশ্রয় নিয়েছিলে ‘বন্ধু স্থানীয় একজনের’ কাছে। রাত থাকতেই বাসিমুখে কেউ বন্ধুস্থানীয় লোকের বাড়ি ছেড়ে ট্যাক্সি নিয়ে বের হয় না। তাই অনুমান করতে অসুবিধা হয় না—একটা রাগারাগি নিশ্চয় হয়েছিল। অবশ্য ‘রাগ’ শব্দটা বাংলা না সংস্কৃতে সেটা হলপ করে বলতে পারব না। ওটা ‘অভিমান’ ও হতে পারে। তিনি ‘বান্ধবী’ না ‘বন্ধু’ তা জানা না থাকায় সঠিক কনক্লুশনে আসা যাচ্ছে না—

কাবেরী একেবারে লাল হয়ে যায়।

বাসু-সাহেব তাড়াতাড়ি প্রসঙ্গটা বদলে বলেন, তাছাড়া এখানে ঘর ছেড়ে বাইরে যাবার সময় নিজের ঘরটা তালাবন্ধ না করেও তুমি ব্যাপারটা গুলিয়ে তুলেছ। তুমি জান না—তোমার ঘরে অ্যাশট্রের ভিতর সহদেব ক্রমাগত ফিল্টার টিপড সিগারেটের স্টাম্প ফেলে গেছে?

—সে কী! কেন?

—যাতে তোমাকে মিস্ ডিক্রুজা বলে আমি ভুল করি।

—আপনি আমাকে তাই ভেবেছিলেন?

—না ভাবিনি। অরূপ তোমাকে চার্চে দেখা একটি ক্রিশ্চিয়ান মেয়ের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলায় একটু বিভ্রান্ত হয়েছিলাম অবশ্য—কিন্তু ক্রমশ আমি বুঝতে পারলাম সহদেব নিজেই লুকিয়ে ঐ সিগারেটের স্টাম্প ফেলে আসছে। তাই সহদেবকে বুঝতে দিয়েছিলাম যে, আমি ওর ফাঁদে পা দিয়েছি। তাকে তাই বলেছিলাম—মিস্ ডিক্রুজাকেও আমি শনাক্ত করেছি এই হোটেলে!

নৃপেন বলে, মিস্ ডিক্রুজা তাহলে নিরপরাধ?

—একটা অপরাধ সে করেছে। মেয়েটা ছিল কল কার্ল। রমেনের সঙ্গে তার একটা ব্যবস্থা হয়েছিল। তাই রমেন তোমার বাড়িতে রাতে থাকতে রাজি হয়নি। পয়লা তারিখ গভীর রাত্রে ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে মেয়েটা রমেনের ঘরে ঢোকে হয়তো অনেকক্ষণ বসেও ছিল। সিগ্রেট যে খেয়েছিল তার প্রমাণই তো আছে। হয়তো তার চোখের সামনেই মদ্যপান করতে গিয়ে রমেন গুহ মারা যায়। মিস ডিক্রুজার একমাত্র অপরাধ তৎক্ষণাৎ পুলিসে খবর না দিয়ে সে রাত ভোর হতেই পালিয়ে যায়।

নৃপেন গম্ভীরভাবে বলে, গুরুতর অপরাধ!

বাসু-সাহেব বলেন, কিন্তু তার অবস্থাটাও বোঝা! বেচারি ডুপ্লিকেট চাবির সাহায্যে ঘরে ঢুকেছে—খুনের দায়ে সে নিজেই জড়িয়ে পড়ত। তাছাড়া অমন মেয়ে নিশ্চিত মদ খায়–হয়তো একচুলের জন্য সে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছে—যাকে বলে Slip between the cup and the lip!

অধিবেশন ভঙ্গ হলে নৃপেন বাসু-সাহেবকে জনান্তিকে বলে, আপনার সঙ্গে একটা প্রাইভেট-কথা ছিল স্যার-

বাসু-সাহেব ওকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, মনে আছে! আমি বলব!

নৃপেন অবাক হয়ে বলে, মানে! কাকে কী বলবেন?

—বিপুলকে তোমার সাবস্টিটুটের কথা তো? বলব আমি!

—নৃপেন যেন দাঁতের ডাক্তারের কাছে এসেছে! লোকটা কি অন্তর্যামী!

.

ঘণ্টাখানেক পরে।

সুজাতা কিচেনে ব্যস্ত। আজ পোলাও হবে! জবর খানার আয়োজন। কৌশিক নিঃশব্দে প্রবেশ করল পিছন থেকে! সুজাতা তখন কাজ করতে করতে গুনগুন করে তান ভাঁজছিল : মেঘের কোলে রোদ হেসেছে বাদল গেছে টুটি—

—এতক্ষণে গান বেরিয়েছে গলায়?

চমকে ঘুরে দাঁড়ায় সুজাতা। বলে, ও তুমি! আমি ভেবেছি—বিভীষণ!

—বিভীষণ!

সে কথার জবাব না দিয়ে সুজাতা ঘনিয়ে আসে। বলে, এই! আজ না পাঁচুই অক্টোবর?

—হুঁ! তাই কি?

—বা-রে আমার সেই সোনার কাঁটাটা?

—ও আয়াম সরি। ওটা আমার পকেটেই রয়ে গেছে, নয়?

কৌশিক পকেট থেকে বার করে গহনার বাক্সটা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *