২
সকাল সাড়ে সাতটা। হোটেল কাঞ্চনজঙ্ঘার ম্যানেজারের ঘরে জমিয়ে বসেছিল নৃপেন। এখন আর ঘুম-ঘুম-চোখ স্লিপিং-সুট পরা নৃপেনবাবু নয়, ধরা-চূড়া-সাঁটা দার্জিলিঙ সদর থানার জাঁদরেল ও.সি.। সমস্ত হোটেলটা সে ইতিমধ্যে মোটামুটি ঘুরে দেখেছে। তন্নতন্ন করে তল্লাশী করেছে দোতলার তেইশ নম্বর কামরাটা। রমেন গুহর মৃতদেহ এখনও অপসারিত হয়নি। ওর মৃত্যুশীতল পা দুটো দেখে নৃপেনের মনে পড়ে গেল একটু আগে দেখা একটা ডিনার প্লেটে পাশাপাশি শোয়ানো ভুক্তাবশিষ্ট মুরগির ঠ্যাং-জোড়া। পুলিশ ফটোগ্রাফার এসে ফটো নিয়ে গেছে। দেহটা ময়না-তদন্তের জন্য পাঠানো হয়নি এখনও। ইতিমধ্যে টেলেক্স চলে গেছে কলকাতায়, লালবাজার কন্ট্রোলরুমে হয়তো রমেন গুহর পরিবারেও এতক্ষণে দুঃসংবাদটা পৌঁছে গেছে। যতক্ষণ না কেউ এসে পৌঁছচ্ছে ততক্ষণ দেহটা ঠান্ডা ঘরে রাখতে হবে। কেসটা আত্মহত্যাই— থ্রম্বোসিস্-টম্বোসিস নয়—যদিও এখনও কিছু নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তবু বড়কর্তার হুকুম ছাড়া দেহটা দাহ করাও চলবে না। সুবীর হেড-কোয়ার্টার্সে থাকলে ভাল হত। ছোকরার মাথাটা এসব বিষয়ে বেশ খেলে। দুর্ভাগ্যবশত সুবীর রায় দিন-তিনেক আগে একটা তদন্তে কার্শিয়াঙে নেমেছে। সুবীর ওর অধীনে পোস্টেড বটে, তবে ক্রিমিনাল-ইনভেস্টিগেশন বিষয়ে সে বিশেষ ট্রেনিং নিয়েছে। তুখোড় ছোকরা! এসব বিষয়ে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডকে টেক্কা দিতে পারে।
হার্টফেল যে নয়, কেসটা যে আত্মহত্যাই তা অনুমান করার যথেষ্ট কারণ আছে। মৃত রমেন গুহ আধশোয়া হয়ে পড়ে আছে তার খাটে; আর তার ডান হাতে ধরা আছে একটা কাচের গ্লাস। আশ্চর্য! গ্লাসটা কাত হয়ে যায়নি—বস্তুত নৃপেন যখন ওকে পরীক্ষা করে তখনও মৃতদেহের ডান হাতে বজ্রমুষ্টিতে ধরা ছিল ঐ গ্লাসটা—ঐ যে ‘রিগর মর্টিস্’ না কী যেন বলে! নৃপেনের দৃঢ় বিশ্বাস গ্লাসের তরল পানীয়ে কোনো তীব্র বিষ মিশিয়ে রমেন পান করেছে। বিষটা এতই তীব্র যে, তৎক্ষণাৎ ওর মৃত্যু হয়েছে! কিন্তু হঠাৎ এভাবে আত্মহত্যা কেন করল রমেন? কই গতকাল রাত্রেও তো সে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ছিল। যে লোক মধ্যরাত্রে বিষপানে আত্মহত্যা করতে যাচ্ছে সে কি সন্ধ্যারাত্রে ওভাবে হাসি-মশকরা করতে পারে? কিন্তু হত্যাই বা হবে কী করে? রমেনের ঘর ছিল তালাবন্ধ! হোটেলে সে সবেমাত্র এসেছে। তার হাতের ঘড়ি, পকেটের পার্স পর্যন্ত খোয়া যায়নি। এখানে কেউ তাকে চেনে না, জানে না। কে, কোন উদ্দেশ্যে তাকে খুন করবে? তাছাড়া তালাবন্ধ ঘরে সে ঢুকবেই বা কী করে?
—স্যার!
—উ?—সম্বিত ফিরে পায় নৃপেন দারোগা।
হাত দুটি গরুড় পক্ষীর মতো জোড় করে ওর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে হোটেলের ম্যানেজার। বিনীতভাবে বলে, মুর্দাকে এবার হটাবার হুকুম দিয়া যায় সাব। পূজা মরশুম। হমার সব বোর্ডার ভাগিয়ে যাবে!
একটা বজ্রদৃষ্টি নিক্ষেপ করে নৃপেন বলে, মুর্দা! ও লোকটা কে জান? বেঁচে থাকলে
ও আজ বসত আমার চেয়ারে! ও একজন দারোগা!
ম্যানেজার যোগিন্দর কাপাডিয়া একটি তিনদুর্গ-আঁকা সবুজ টিন বাড়িয়ে ধরে! তার গর্ভে সাদা সিগারেট। যোগিন্দর গলাটা সাফা করে, মুর্দার যে জাত নেই এমন একটা দার্শনিক উক্তি করবে কি না বুঝে উঠতে পারে না।
পাশ থেকে ওর অফিস ক্লার্ক মহেন্দ্র বলে, সে আমরা জানতাম স্যার! দেখুন দেখি, কী কাণ্ড হয়ে গেল!
নৃপেন ত্রি-দুর্গ আঁকা টিন থেকে একটি সিগারেট নিয়ে ধরায়। একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে বলে, এখন বল দিকিনকে ওকে প্রথম ঐ অবস্থায় আবিষ্কার করে?
—রুম-বেহারা স্যার। বীর বাহাদুর। বেড-টি দিতে গিয়ে—
বাধা দিয়ে নৃপেন বলে ওঠে, নো সেকেন্ড-হ্যান্ড স্টোরি প্লিজ! রুম-বেহারোকো বোলাও!
শুধু রুম-সার্ভিসের বেহারার নয়, ডাক পড়ল অনেকেরই। ক্রমে ক্রমে এল তারা—এজাহার দিতে। কুক, হেডকুক, গেট-কিপার, কাউন্টার ক্লার্ক ইত্যাদি। টুকরো টুকরো জবানবন্দি থেকে সংগৃহীত হল সম্পূর্ণ কাহিনিটা। হোটেল-রেজিস্টার অনুযায়ী রমেন গুহ এসে পৌঁছায় পয়লা তারিখ বেলা বারোটায়। দোতলার তেইশ নম্বরে আশ্রয় নেয়। সাড়ে বারোটায় সে মালপত্র রেখে বেরিয়ে যায়। ফিরে আসে রাত দশটায়। কোনও ‘মিল’ নেয়নি সে। এমনকী, এককাপ চা পর্যন্ত খায়নি। তার মৃতদেহ আবিষ্কৃত হয়েছে পরদিন সকাল ছটায়।
কাউন্টার-ক্লার্ক মহেন্দ্রের জবানবন্দি অনুসারে কাল দুপুরে একটি ট্যাক্সি চেপে রমেন গুহ আসে। শেয়ারের ট্যাক্সি। নিউ জলপাইগুড়ি থেকে এসেছে। ট্যাক্সিতে তিনজন লোক ছিল। তিনজনেই কাঞ্চনজঙ্ঘা হোটেলে ওঠে। দ্বিতলের পাশাপাশি তিনখানা সিংগল সিটেড রুম ভাড়া নেয়। অথচ ওরা তিনজন পৃথক যাত্রী। ওরা পরস্পরকে চিনত না।
বাধা দিয়ে নৃপেন প্রশ্ন করেছিল, তুমি কেমন করে জানলে ওরা পরস্পরকে চিনত না?
—স্বচক্ষে দেখলাম স্যার! ট্যাক্সি থেকে মালপত্র নামিয়ে ট্যাক্সি-ড্রাইভার এসে দাঁড়াল। ওঁরা তিনজনে ট্যাক্সি ভাড়ার এক-তৃতীয়াংশ দিলেন। তারপর আমার হোটেল-রেজিস্টারে পর পর নাম লেখালেন। ঠিকানা সব আলাদা। একজন হিন্দু, একজন মুসলমান, একজন খ্রিস্টান।
—ঠিক আছে। এবার বল—রমেন গুহর সহযাত্রী দু’জন কত নম্বরে আছেন? মহেন্দ্ৰ মাথা চুলকে বলে, সেইখানেই তো ঝামেলা হয়েছে স্যার। দু’জনেই ইতিমধ্যে চেক-আউট করে বেরিয়ে গেছেন।
—বলো কী! কাল বেলা বারোটায় চেক-ইন করে আজ সকাল সাতটাতেই চেক-আউট?
—দু’জনেই নয় স্যার। মিস্টার মহম্মদ ইব্রাহিম চেক-আউট করেছেন কাল রাত সাড়ে আটটায় আর মিস্ ডিক্রুজা আজ ভোর পাঁচটায়!
—মিস্ ডিক্রুজা! মেমসাহেব?
—না স্যার। দিশি মেমসাহেব। দেখলে বাঙালি বলেই মনে হয়।
—ভোর পাঁচটায়! অত ভোরে?
—হ্যাঁ, স্যার। টাইগার-হিলে সানরাইজ দেখতে গেলেন যে। বললেন আজই নামবেন। মালপত্র নিয়েই চেক-আউট করে বেরিয়ে গেলেন।
সন্দেহজনক! অত্যন্ত সন্দেহজনক! রমেন গুহ মারা গেছে রাত দশটার পরে। তেইশ নম্বর ঘরে। আর ঠিক তার পাশের ঘরের বাসিন্দা কাকডাকা ভোরে হোটেল ছেড়ে দিল! পরবর্তী ঠিকানা না রেখে? অবশ্য মহম্মদ ইব্রাহিমকে সন্দেহ করার কিছু নেই। সে চেক-আউট করেছে রাত সাড়ে আটটায়—রমেন তখনও নৃপেনের বাড়িতে। বহাল তবিয়তে। মহম্মদ ইব্রাহিম আর মিস্ ডিক্রুজার স্থায়ী ঠিকানা দুটো নৃপেন লিখে নিল তার নোট বইতে। খোদায় মালুম সেগুলো আদৌ সত্য কি না। কাউন্টার-ক্লার্ক ছোকরাটি বেশ চলতা-পূর্জা! অনেক খবর দিতে পারল সে ঐ দু’জনের সম্বন্ধে। ছোকরা লক্ষ্য করেছে অনেক কিছুই। মিস্ ডিক্রুজার বয়স সাতাশ-আটাশ, যদিও সাজে-সজ্জায় সে নিজেকে বাইশ-তেইশ বলতে চায়। সুন্দরী। চমৎকার ফিগার। বিজ্ঞের মতো বললে—ভাইট্যাল স্ট্যাটিসটিক্স হবে, এই ধরুন 34-28-32। চুল ছোট, বব্ নয়। রঙ মাজা, ফর্সা ঘেঁষা। খুব ভাল বাংলা বলতে পারে—নাম না বললে বাঙালি বলে ভুল হতে পারে। সিগারেট খায়। ‘প্রফেশান’-এর ঘরে লেখা আছে ‘হাসিফ’। মিস্ কী করে গৃহকর্ত্রী হয় তা জানে না মহেন্দ্র। তবে সে তাতে আপত্তি করেনি। তার সঙ্গে আছে একটা ভি. আই. পি. মার্কা সাদা সুটকেস। অপর পক্ষে মহম্মদ ইব্রাহিমের বয়স ত্রিশের উপর, চল্লিশের নিচে। দীর্ঘকায়, বলিষ্ঠ গঠন। ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি ও গোঁফ আছে, চোখে চশমা। পাইপ খান। প্রফেশান—তাঁর স্বীকৃতি মতো—বিজনেস।
হেড-কুক সবিনয়ে নিবেদন করল খাবারে কোনক্রমেই কোনো বিষাক্ত পদার্থ মিশে যেতে পারে না। তার যুক্তি প্রাঞ্জল, তাহলে তো হুজুর হোটেল সুদ্ধু লোক আজ মরে ভূত হয়ে থাকত।
নৃপেন ধমক দেয়, বাজে কথা বোলো না। কে বলেছে খাবারে বিষ ছিল? রমেন তোমার কিচেনের খাবার খায়নি। কিন্তু ওর ঘরে থার্মোফ্লাস্কে জল রয়েছে দেখলাম। গরম জল তুমি সাপ্লাই করেছিলে?
হেডকুক সভয়ে নিবেদন করে, বোর্ডারের ঘরে থার্মোফ্লাস্কে জল থাকলে তা আমার কিচেন থেকেই সাপ্লাই হয়েছে নিশ্চয়ই। কিন্তু জল তো আমি স্রেফ কল থেকে নিয়ে গরম করেছি স্যার!
—জানি! নর্দমা থেকে নাওনি! কিন্তু জলটা ওর ঘরে কে রেখে এসেছিল?
—তার জিম্বাদারী আমার নয় হুজুর। রুম-সার্ভিস বেহারার কাজ ওটা।
—হুঁ! কী নাম সেই রুম-সার্ভিসের বেহারার?
—বীর বাহাদুর, স্যার!
—বীর বাহাদুর কার নাম?
কেউ সাড়া দেয় না।
নৃপেন প্রচণ্ড ধমক লাগায়; আধঘণ্টা থেকে ডাকছি, বীর বাহাদুর আসছে না কেন? এরা ভেবেছে কি, দারোগা খুন করে পার পাবে! সব কটার মাজায় দড়ি বেঁধে চালান দেব আমি!
একটা রীতিমত শোরগোল পড়ে যায়। দু’তিনজন ছোটে বীর বাহাদুরের খোঁজে। যোগীন্দর কাপাডিয়া কী করবে ভেবে না পেয়ে আবার থ্রি-কাস্লস্-এর টিনটা বাড়িয়ে ধরে। নৃপেন আবার একটা সিগারেট নিয়ে ধরায়।
তিনচার জনে ইতিমধ্যে পাকড়াও করে নিয়ে এসেছে বীর বাহাদুরকে। বেচারির পিতৃদত্ত নামের শেষ চিহ্নটুকু পর্যন্ত অবলুপ্ত। বীরত্ব এবং বাহাদুরি। নবমীর পাঁঠার মতো কাঁপতে কাঁপতে এসে দাঁড়ালো দারোগা সাহেবের সামনে!
—তোমার নাম বীর বাহাদুর?
—জী, হুজুর!
—তোম বীর হ্যায় হয়া বাহাদুর হ্যায়?
বেঁটে লোকটা কী জবাব দেবে ভেবে পায় না।
অনেক জেরার পরে লোকটা হলফ্ খেয়ে বললে, সে থার্মোফ্লাস্কে বিষ-টিষ কিছু মেশায়নি। তার বিশ বছরের নোকরি! এমন কি এর আগে কখনও হয়েছে?
—তুমি ফ্লাস্কটা নিয়ে কিচেন থেকে সোজা ঐ তেইশ নম্বর ঘরে গিয়েছিলে, না কি ফ্লাস্কটা আর কারও হাতে ধরতে দিয়ে বিড়ি-টিড়ি খেয়েছিলে?
—জী নেহি সাব! ম্যায় বিড়ি নেহি পীতা!
—হেত্তেরি! যা জিজ্ঞাসা করছি তার জবাব দাও। সিধে তেইশ নম্বরমে গয়া থা ক্যা?
—জী সাব!
—ঠিক আছে! এবার আজ সকালের কথা বলো। কখন তুমি প্রথম জানতে পারলে? বীর বাহাদুর যে বর্ণনা দিল তা সংক্ষেপে এই :
হোটেলের আইন অনুসারে রাত সাড়ে দশটার পর রুম-সার্ভিস বন্ধ হয়ে যায়। ভোর সাড়ে চারটের আগে আর রুম-সার্ভিস পাওয়া যায় না। টাইগার-হিলে যাবার বায়নাক্কা থাকায় প্রায় প্রতিদিনই কিছু-না কিছু বোর্ডারকে ভোর সাড়ে চারটেয় বেড-টি দিতে হয়। তাই শেষরাত্রে অন্ধকার থাকতেই কিচেনটি কর্মব্যস্ত হয়ে পড়ে।
বাধা দিয়ে নৃপেন প্রশ্ন করে, রুম নাম্বার চব্বিশে বেড-টির অর্ডার ছিল আজ?
—জী নেহি! চব্বিশ মে থী বহু মেমসাব। উস্নে বেড-টি নেহী লি-থি।
নৃপেন মহেন্দ্রর দিকে ফিরে বললে, তবে যে তখন তুমি বললে—মিস্ ডিক্রুজা আজ সকালে টাইগার-হিলে গেছে?
মহেন্দ্ৰ আমতা আমতা করে বললে, ইয়ে, টাইগার হিলে যেতে হলে চা যে খেয়ে যেতে হবে, এমন কোনো আইন নেই স্যার!
—আমি জানি। বাজে কথা বোলো না!—ধমক দেয় নৃপেন দারোগা। তারপর বীর বাহাদুরের দিকে ফিরে বলে, তেইশ নম্বরে বেড-টির অর্ডার ছিল?
—জী সাব। পৌনে ছে বাজে!
ব্যাপারটা বিস্তারিত করে বুঝিয়ে দেয় বীর বাহাদুর। তেইশ নম্বরে ছিলেন এক দারোগা সাহেব। মানে যিনি মারা গেছেন। তিনি পৌনে ছটায় চা চেয়েছিলেন। বীর বাহাদুর ঠিক সময়ে চায়ের ট্রে নিয়ে ওঁর দরজার সানে এসে নক্ করে। কেউ সাড়া দেয় না। ঐ সময় ওদিককার খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে এক সাহেব পাইপ খাচ্ছিলেন। তিনি বাহাদুরকে বলে ওঠেন, ‘কেন হোটেলশুদ্ধ লোকের সুখনিদ্রায় বাধা দিচ্ছ বাবা? তোমার ঐ কুম্ভকর্ণ-সাহেবের ঘুম যখন ভাঙবে তিনি নিজেই চা চাইবেন।’ তখন বাহাদুর সেই পাইপ-মুখো সাহেবকে বলেছিল, ‘এমন কাণ্ডটা ঘটলে ম্যানেজার রাগ করবেন স্যার। উনি ভাববেন, আমি মিছে কথা বলছি—সময়মত বেড-টি দিতে আসিনি আমি।’ তখন সেই পাইপমুখো সাহেব বললেন, ‘তুমি আমাকে সাক্ষী পেলে, বাবা। আমি দরকার হলে আদালতে হলফ নিয়ে বলব—তোমার চেষ্টার ত্রুটি ছিল না।’
নৃপেন প্রশ্ন করে, উনি অত ভোরে ঐ ঠান্ডার মধ্যে দাঁড়িয়ে কী করছিলেন? –বহ্ নেহি জানতা সাব!
মহেন্দ্র উপর পড়া হয়ে বলে, ঐ বারান্দা থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার সান-রাইজ দেখা যায় স্যার। উনি বোধহয়-
—তুমি চুপ করো!—ধমক দিয়ে ওঠে নৃপেন। তারপর বাহাদুরের দিকে ফিরে বলে, তারপর বলে যাও—
বীর বাহাদুর তার জবানবন্দি শুরু করে। ঠিক ঐ সময়েই নাকি সেই তেইশ নম্বর ঘরের ভিতর একটা অ্যালার্ম ক্লক বেজে ওঠে। পুরো এক মিনিট সেটা বাজে। তাতেও ঘরের ভিতর কোনো সাড়া শব্দ জাগে না। পাইপমুখো সাহেব এবার কৌতূহলী হয়ে নিজেই এগিয়ে আসেন। চাবির ফুটোয় চোখ লাগিয়ে বলে ওঠেন, আশ্চর্য! ঘরে আলো জ্বলছে! এরপর উনি একটা দেশলাই জ্বেলে দরজার উপর কার্ড আটকানো খোপটা দেখে বলে ওঠেন, ‘রমেন গুহ! পুলিশের লোক নাকি?” বীর বাহাদুর জবাবে বলেছিল, ‘জী সাব!’ পাইপমুখো তখন বলেন, “তবে তো আমার চেনা লোক মনে হচ্ছে। তুমি এক কাজ করো তো হে! কাউন্টারে গিয়ে এ ঘরের ডুপ্লিকেট চাবিটা নিয়ে এস।’ বীর বাহাদুর অগত্যা ট্রেটা নামিয়ে রেখে একতলায় কাউন্টারে ফিরে যায়। কাউন্টার-ক্লার্ক মহেন্দ্ৰ বাহাদুরকে একটা ‘মাস্টার-কী’ দেয়। সেটা নিয়ে বাহাদুর-
—দাঁড়াও! দাঁড়াও—এখানেই বীর বাহাদুরের জবানবন্দি থামিয়ে নৃপেন মহেন্দ্রের দিকে ফিরে প্রশ্ন করে—’মাস্টার-কী’ বস্তুটা কী?
—প্রতি ঘরের ‘ডুপ্লিকেট-কী’ ছাড়াও আমার কাছে দুটো মাস্টার-কী আছে। তার একটা চাবি দিয়ে এক তলার সব ঘর খোলা যায়।
—আই সী। তা তুমি বাহাদুরকে ঐ তেইশ নম্বর ঘরের ডুপ্লিকেট চাবিটা না দিয়ে ফস করে ‘মাস্টার-কী’ দিয়ে বসলে কেন?
—তেইশ নম্বর ঘরের দুটো চাবিই ঐ গুহ-সাহেব আমার কাছ থেকে নিয়ে রেখেছিলেন।
—দুটো চাবিই তোমরা বোর্ডারকে দাও?
—না স্যার। তবে আমি জানতাম ঐ গুহ-সাহেব আপনার জায়গায় বদলি হয়ে আসছেন। তাই—
—বুঝেছি!—নৃপেন এবার বাহাদুরের দিকে ফিরে বললে, প্রসিড!
বুঝতে অসুবিধা হল না বাহাদুরের। সে তার জবানবন্দির সূত্র তুলে নেয়।
মাস্টার-কী দিয়ে দরজা খুলে ওরা দুজনে ঘরে ঢোকে—বাহাদুর আর সেই পাইপ-মুখো সাহেব। দেখে, টেবিল ল্যাম্পটা জ্বলছে। টেবিলের উপর মুখ-বন্ধ-করা একটা জলের ফ্লাস্ক, একটা হুইস্কির বোতল, এক প্যাকেট ক্যাপ্স্টান সিগারেট, একটা দেশলাই একটা অ্যাশট্রে আর একটা অ্যালার্ম ক্লক। রমেনের হাতে দৃঢ় মুষ্টিতে ধরা আছে একটা কাচের গ্লাস—তাতে ঈষৎ পীতাভ কিছু তরল পানীয়। সম্ভবত গরম জলে মেশানো হুইস্কি ছিল ঘণ্টাকতক আগে—তখন বরফ-ঠান্ডা। বীর বাহাদুর কোনক্রমে চায়ের ট্রেটা নামিয়ে রাখে। পাইপ-মুখো সাহেব রমেনকে পরীক্ষা করেন। নাড়ি দেখেন, কানের নিচে চোয়ালের তলায় কী একটা পরীক্ষা করেন। তারপর বাহাদুরের দিকে ফিরে বলেন, “মারা গেছে। তোমার ম্যানেজারকে খবর দাও।’—বাহাদুর হুড়মুড়িয়ে নেমে আসে নিচে।
—সে কী! ঐ পাইপ-মুখো সাহেবকে ঐ ঘরে একা রেখে?
—জী হুজুর। ইয়ে তো বাতায়া বহ। কহা কি ম্যানেজারকে সেলাম দো!
—সেলাম দেওয়াচ্ছি!— নৃপেন ঘুরে দাঁড়ায় যোগিন্দরের মুখোমুখি। বলে, কী মশাই, তবে যে বললেন মৃতদেহ আবিষ্কারের পরে ও ঘরে কেউ ঢোকেনি? ওটা তালাবন্ধ পড়ে আছে।
যোগিন্দর আমতা আমতা করে। মহেন্দ্র বলে, ইয়ে—বাহাদুর নিচে এসে খবর দেওয়া মাত্র আমি দৌড়ে ঐ ঘরে উঠে যাই। মিনিট তিন-চারেক বেশি ঐ বোর্ডার-ভদ্রলোক ও ঘরে একা ছিলেন না।
—থাম তুমি! হু! তিন-চার মিনিট! চার-মিনিট কি কম সময়? ওর ভিতর অনেক কিছু করে ফেলা যায়, বুঝেছ! সব কটার মাজায় দড়ি বাঁধব আমি।
যোগিন্দর সিগারেটের টিনটা বাড়িয়ে ধরবে কি না ভেবে পায় না। নৃপেনের আগের সিগারেটটা তখনও শেষ হয়নি।
—ঐ পাইপ-মুখো কি হোটেলে আছেন, না কি তাঁকেও চেক-আউট করিয়ে দিয়েছে?
মহেন্দ্ৰ হাত কচলে বলে, না স্যার, উনি আছেন। একতলায় একটা ডবল-বেড রুম নিয়ে আছেন। সস্ত্রীক।
—দেখবে, যেন তিনি না ইতিমধ্যে কেটে পড়েন। তাঁকে খবর দাও—আমি দশ মিনিটের মধ্যে তাঁর ঘরে যাচ্ছি। তাঁর এজাহারটা নিতে হবে।—
যোগিন্দরের ইঙ্গিতে একজন তখনই চলে গেল পাইপ-মুখোকে রুখতে।
—তারপর? ওপরে এসে কী দেখলে? না, তুমি নয়—বাহাদুর তুমি বলো। পাঁচ মিনিট পরে যখন তুমি উপরে এলে তখন কী দেখলে? পাইপ-মুখো কী করছিলেন তখন?
—তামাম কামরাঠো তালাশ করতা থা!
—বাঃ বাঃ বাঃ!—চমৎকার!—নৃপেন দারোগা দগ্ধাবশেষ সিগারেটটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে যোগিন্দরের দিকে ফেরে। বলে, কী মশাই? আপনি অম্লানবদনে বললেন ঘরটা বরাবর তালাবন্ধ আছে! কেউ কিছু টাচ করেনি, ট্যাম্পার করেনি?
যোগিন্দর তৎক্ষণাৎ সিগারেটের টিনটা বাড়িয়ে ধরে।
—দূর মশাই! সিগারেট নিয়ে কী করব? যা জিজ্ঞাসা করছি তার জবাব দিন!
যোগিন্দর হাত দুটি জোড় করে বললে, স্যার! বাসু-সাহেবকে আমি বিশ বরিষ ধরে জানি। নাম করা ব্যারিস্টার! উনি কোনো কিছু ট্যাম্পার করতেই পারেন না।
—বাসু-সাহেব! কে বাসু-সাহেব?
—ঐ যাঁকে বীর বাহাদুর পাইপ-মুখো সাহেব বলছে। ওঁর নাম পি. কে. বাসু আছে। উনি বহুবার আমার হোটেলে উঠেছেন। একদম শরিফ আদমি! এককালে ক্রিমিনাল ল-ইয়ার হিসাবে লাখ লাখ টাকা খিঁচেছেন। এখন প্র্যাকটিস্ ছেড়ে দিয়েছেন।
—লাখ লাখ টাকা খেঁচার সঙ্গে গোয়েন্দাগিরির কোনো সম্পর্ক নেই, বুঝেছেন? যাক তাঁর সাথে তো এখনই কথা বলব। তারপর কী হল বলুন?
জবাব দিল মহেন্দ্ৰ—তারপর আর কী? আমরা ঘরটা তালাবন্ধ করে নেমে এলাম। আপনাকে ফোন করলাম। ঠিক ছটা বেজে দশে।
ইতিমধ্যে একজন বেহারা এসে দাঁড়ায়। তার হাতে একটা খালি ব্র্যান্ডির শিশি। নৃপেন সেটা হাতে নিয়ে জিজ্ঞাসা করে, খুব ভাল করে ধুয়েছিস তো?
—হ্যাঁ স্যার! খুব ভাল করে বার বার ধুয়েছি।
—ঠিক আছে। এবার আর একবার ঐ তেইশ নম্বর ঘরে যেতে হবে। চলুন।
তেইশ নম্বর ঘরে এসে নৃপেন স্বহস্তে ঐ কাচের গ্লাস থেকে তরল পদার্থটা শিশিতে ভরে নিল। তারপর ঘরে তালা দিয়ে বেরিয়ে এল। নেমে এল নিচে। সকলকে বিদায় দিয়ে একাই চলে এল নির্দেশমত একতলায় এক নম্বর ঘরে। সব ঘরেই ইয়েল-লক, ছিটকিনি নেই। অর্থাৎ দরজা ঠেলে বন্ধ করলে চাবিছাড়া দরজা খোলা যায় না। এক-নম্বর ঘরের দরজা খোলাই ছিল। ভারী পর্দা ঝুলছে। নৃপেন খোলা দরজায় ‘নক্’ করল। ভিতর থেকে আহ্বান এল, ইয়েস! কাম ইন প্লিজ!
পর্দা সরিয়ে নৃপেন প্রবেশ করল ঘরে।
ডবল-বেড় বড় ঘর। একজন ভদ্রমহিলা বসেছিলেন একটা চাকা-ওয়ালা চেয়ারে। তাঁর হাতে একজোড়া উলের কাঁটা। উলের সোয়েটার বুনছিলেন। তাঁর মুখোমুখি একজন প্রৌঢ় ভদ্রলোক ড্রেসিং গাউন পরে বসেছিলেন ইজি-চেয়ারে। বোধকরি কী একখানা বই পড়ে শোনাচ্ছিলেন স্ত্রীকে। বইটা মুড়ে এদিকে ফিরে বললেন, বসুন। মিস্টার ঘোষাল আই প্রিসিউম? ও. সি. সদর?
—হ্যাঁ। আপনাকে বিরক্ত করতে হচ্ছে বলে দুঃখিত।
নট দ্য লীস্ট, নট দ্য লীস্ট! বলুন, কী ভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি। বাই দ্য ওয়ে, আপনার হাতে ওটা কী? ব্র্যান্ডি?
—না! মৃতের হাতের গ্লাসে যে তরল পদার্থটা ছিল সেটা নিয়ে যাচ্ছি। কেমিক্যাল অ্যানালিসিস্ করাতে হবে।
—ও! তা করান। তবে কী পাবেন তা আগেই বলে দিতে পারি। অ্যালকোহল, অ্যাকোয়া আর কে সি এন!
‘কে সিয়েন’ মানে?
পটাসিয়াম সায়ানাইড!
প্রৌঢ় ভদ্রলোকের এই বিদ্যে জাহির করবার প্রচেষ্টা দেখে নৃপেন মনে মনে হাসে। কিন্তু ভদ্রলোকের চেহারায় এমন একটা আভিজাত্য আছে যে, সে প্রকাশ্যে হেসে উঠতে পারল না। বললে, আপনি ব্যারিস্টার মানুষ। নিশ্চয় বুঝবেন, অমন আপ্তবাক্যে কোনও কোর্টে কখনও কনভিকশন হয় না। এটা এভিডেন্স হিসাবে তখনই গ্রাহ্য হবে যখন কোনো বিশেষজ্ঞ রাসায়নিক তাঁর ল্যাবরেটারিতে পরীক্ষা করে একটা রিপোর্ট দেবেন।
—কারেক্ট! কোয়াইট কারেক্ট! এ-ক্ষেত্রে অবশ্য বিশেষজ্ঞের রিপোর্ট সত্ত্বেও ওটা এভিডেন্স হিসাবে গ্রাহ্য হবে না!
হাসি-হাসি মুখে বাসু-সাহেব তাকিয়ে থাকেন নৃপেন দারোগার দিকে। অর্থাৎ এবার আপনি জানতে চান—কেন গ্রাহ্য হবে না? তা কিন্তু জানতে চাইল না নৃপেন। সে মনে মনে রীতিমত চটে উঠেছে এ ভদ্রলোকের অহেতুক মোড়লিতে। ওকে নীরব থাকতে দেখে বাসু-সাহেব নিজেই বলে ওঠেন—কেন গ্রাহ্য হবে না জানেন?
এতক্ষণ রুখে ওঠে নৃপেন, না, জানি না। জানতে চাইও না!
বাসু-সাহেব কিন্তু রাগ করেন না। হেসেই বলেন-গ্র্যাটিস্ লিগ্যাল অ্যাডভাইস্ আমি দিই না; কিন্তু আপনার ক্ষেত্রে না হয় ব্যতিক্রমই করলুম! আপনার উচিত ছিল যে-সব সাক্ষীর সামনে ঐ তরল পানীয়টা সংগ্রহ করেছেন তাঁদের উপস্থিতিতেই ওটা সিলমোহর করা! ডিফেন্স কাউন্সিলারগুলো ভারি পাজি হয়, বুঝেছেন—তারা কিছুতেই মানতে চাইবে না বিশেষজ্ঞের রিপোর্টে যে লিকুইডটার পরিচয় লেখা আছে সেটাই ঐ মৃত ব্যক্তির হাতে পাওয়া গেছে! বলবে, সিল যখন করা নেই তখন অ্যাকিউসড়কে ফাঁদে ফেলতে আপনি নিজেই ওতে কিছুটা পটাসিয়াম সায়ানাইড মিশিয়ে দিয়েছেন। ইন ফ্যাক্ট আপনি ইচ্ছে করলে এখনও তা মেশাতে পারেন। তাই নয়?
কর্ণমূল পর্যন্ত আরক্ত হয়ে ওঠে নৃপেনের!
—যাক ও কথা। আমার কাছে কী জানতে চান বলুন?
অপমানটা গলাধঃকরণ করে নৃপেন আরও মরিয়া হয়ে ওঠে। বলে, আপনিই মৃতদেহটা প্রথম আবিষ্কার করেন?
—নট একজ্যাক্টলি! আমরা দুজন। আমি আর বীর বাহাদুর।
—এবং তার পরেই আপনি বীর বাহবাদুরকে নিচে যেতে বলেন?
—অ্যাফার্মেটিভ!
—আপনি কতক্ষণ ঐ ঘরে একা ছিলেন?
—পাঁচ থেকে সাত মিনিট।
—ঐ পাঁচ-সাত মিনিট ধরে আপনি ঘরটা তন্নতন্ন করে সার্চ করেছেন?
—পাঁচ-সাত মিনিটে একটা ঘর তন্ন তন্ন করে সার্চ করা যায় না। মোটামুটি তল্লাশি করেছিলাম।
—কাজটা ভাল করেননি।
মিসেস বাসু তাঁর হুইল চেয়ারটা চালিয়ে পিছনের বারান্দার দিকে চলে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ থেমে পড়েন এ-কথায়। বাসু-সাহেব হাসি হাসি মুখেই বলেন, য়ু থিংক সো?
রূঢ়তর কণ্ঠে নৃপেন বলে, হ্যাঁ, তাই মনে করি আমি। আপনি হয়তো কিছু ফিঙ্গার-প্রিন্ট নষ্ট করে ফেলেছেন, তল্লাশি করতে গিয়ে।
—করিনি। আমার হাতে গ্লাস পরা ছিল। তা ছাড়া এ-সব কেস কীভাবে হ্যান্ডেল করতে হয় আমার জানা আছে!
এবার আর আত্মসংবরণ করতে পারে না নৃপেন। রীতিমত ধমকের সুরে বলে, না! আপনি অন্যায় করেছেন! আপনি ক্রিমিনাল লইয়ার, ডিটেকটিভ নন! তবু লইয়া হিসাবে আপনার জানা থাকা উচিত যে, পুলিস এসে পৌঁছনোর আগে কোনো কিছু পরীক্ষা করার অধিকার আপনার নেই!
মিসেস বাসু শঙ্কাভরা দু’চোখ মেলে বাসু-সাহেবের দিকে তাকালেন। তাঁর স্বামীকে তিনি ভালমতই চিনতেন। বাসু-সাহেবের সঙ্গে তাঁর চোখচোখি হল। বোধ করি সেজন্যই কোনো বিস্ফোরণ হল না। বাসু-সাহেব শান্ত কণ্ঠে শুধু বললেন, লুক হিয়ার মিস্টার ও. সি. হেড কোয়াটার্স! আমার অধিকার সম্বন্ধে আমি সম্পূর্ণ সচেতন। হিয়ার্স মাই কার্ড! আপনি যা ভাল বোঝেন করতে পারেন!
নৃপেন হাত বাড়িয়ে কার্ডটা গ্রহণ করে না। চেয়ার ছেড়ে সে উঠে দাঁড়ায়।
বাসু-সাহেব বলেন, আগেই বলেছি গ্র্যাটিস্ লিগাল অ্যাডভাইস দেওয়া আমার স্বভাব নয়। এ ক্ষেত্রে তবু দিতে বাধ্য হচ্ছি এজন্য যে, রমেন গুহ ছিল আমার অত্যন্ত স্নেহভাজন!
—রমেন গুহ আপনার পরিচিত?—প্রশ্ন করে নৃপেন।
বাসু-সাহেব সে প্রশ্নের জবাব না নিয়ে বলেন, এটা যে আত্মহত্যা নয়, বরং একটা ফার্স্ট ডিগ্রি ডেলিবারেট মার্ডার তার অকাট্য এভিডেন্স আমি পেয়েছি। যেহেতু কেসটা রমেন গুহর, তাই কতকগুলো ব্লু আপনাকে দিতে চাই। আপনি কি দয়া করে বসবেন?
নৃপেন বসে না। একগুঁয়ে ছেলের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বলে, কী ক্লু? বাসু-সাহেব পাইপটা ধরালেন। বললেন, মাথা ঠান্ডা করে ব্যাপারটা শুনলেই কিন্তু
আপনি ভাল করতেন। তাতে আপনার নেহাৎ আপত্তি থাকলে আমি বিপুলকেই সব কথা জানাব। আফটার অল, এটা রমেন গুহর কেস!
—বিপুল! বিপুল কে!
—ডি. সি. দার্জিলিঙ। বিপুল ঘোষ, আই.এ.এস.। তার স্ত্রী মণির মামা হই আমি নৃপেন বসে পড়ে। পথে নয়, চেয়ারে। বলে, বলুন, কী বলবেন?
—আপনি তদন্ত করে কী বুঝেছেন? এটা আত্মহত্যার কেস?
—না! রমেনের আত্মহত্যার কোনো কারণ খুঁজে পাইনি আমি। গতকাল রাত্রি প্রায় দশটা পর্যন্ত সে আমার বাড়িতেই ছিল। দিব্যি স্বাভাবিক মানুষ। আমাদের সঙ্গেই রাত্রে খেয়েছে, হাসি-গল্প করেছে—হোটেলে ফিরে এসে সে তার স্ত্রীকে যে চিঠি লিখেছে তাতেও কোনো ইঙ্গিত নেই!
—সুতরাং…?
—কিন্তু ওকে এখানে কে হত্যা করতে চাইবে? ওর হাতঘড়ি, মানিব্যাগ পর্যন্ত খোয়া যায়নি!
—রমেন গুহ দারোগা ছিল। যেখান থেকে ও বদলি হয়ে এসেছে সেখানকার কোর্টে এমন দশ-বিশটা কেসে হয়তো তাকে সাক্ষী দিতে যেতে হত। অন্তত একডজন আসামি খুশি হবে লোকটা বেমক্কা মারা গেলে, নয়? তাদের মধ্যে অন্তত আধডজন পাকা ক্রিমিনাল! খুনি-ডাকাত-ওয়াগনব্রেকার-ব্ল্যাকমার্কেটিয়ার! তাদের মধ্যে কেউ—
—কিন্তু তাদের মধ্যে কেউ ওর রুদ্ধদ্বার ঘরে মদের পাত্রে বিষ মিশিয়ে দেবার সুযোগ পাবে কেমন করে? রমেন কাল বেলা বারোটায় হোটেলে ঢুকেছে, সাড়ে বারোটায় ঘরে তালা মেরে বেরিয়ে গেছে। ফিরেছে রাত দশটায়! এর মধ্যে তার ঘরে কেউ ঢোকেনি।
—য়ু থিংক সো?
—নিশ্চয়! আপনি হয়তো জানেন না, ও তার ঘরের দুটো চাবিই চেয়ে নিয়েছিল।
—জানি। কিন্তু কেন? দুটো চাবি নিয়ে সে কী করবে? সে তো একা মানুষ!
নৃপেন একটু ইতস্তত করে। তারপর বলে, আমি জানি না।
—আই সী! জানেন না!
আবার রুখে ওঠে নৃপেন, কেন, আপনি জানেন?
—জানি। কিন্তু ও কথা থাক। তার আগে বলুন তো—বীর বাহাদুর ঠিক কটার সময় গরম জল ভর্তি ফ্লাস্কটা ওর ঘরে রেখে আসে?
নৃপেন আবার অস্বোয়াস্তি বোধ করে। বলে, আমি জানি না।
—আই সী! জানেন না! সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায়। আমি জিজ্ঞাসা করে জেনে নিয়েছিলাম। রমেন যখন সাড়ে বারোটার সময় বেরিয়ে যায় তখনই বলে যায়, তার ঘরে যেন এক ফ্লাস্ক গরম জল রেখে দেওয়া হয়। ফ্লাস্কটা তার নিজের। এখন বলুন তো, দুটো চাবিই যখন রমেনের কাছে তখন বীর বাহাদুর কেমন করে ও-ঘরে ঢুকল?
এ সমস্যা অনায়াসে সমাধান করে নৃপেন। বলে, জানি। ঐ মাস্টার-কী দিয়ে।
–ও! জানেন! তাহলে আপনার ঐ আগেকার স্টেটমেন্টটা তো ঠিক নয়। ঐ যে বললেন—বেলা সাড়ে বারোটা থেকে রাত দশটার মধ্যে ও-ঘরে কেউ ঢোকেনি!
নৃপেন অসহিষ্ণুর মতো বলে ওঠে, কী আশ্চর্য! বীর বাহাদুর কেন বিষ মেশাবে? সে এ হোটেলে বিশ বছর চাকরি করছে—তার কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে?
—কারেক্ট! কিন্তু বীর বাহাদুর তার মাস্টার-কী দিয়ে যখন ঘরটা খুলেছিল তখন আর কেউ কি ঐ ঘরে ঢুকেছিল তার সঙ্গে?
নৃপেন বিহ্বল হয়ে পড়ে। এ-জাতীয় অনুসন্ধান সে করেনি।
বাসু-সাহেব নিজে থেকেই বলেন, ঢোকেনি। আমি বীর বাহাদুরকে জিজ্ঞাসা করে জেনে নিয়েছি। সে তালা খুলে একাই ঘরে ঢোকে। ফ্লাস্কটা নামিয়ে রেখে বেরিয়ে আসে। ঘরটা আবার তালাবন্ধ করে। পুরো এক মিনিটও সে ছিল না ঐ ঘরে। সুতরাং আর কেউ কোনো সুযোগই পায়নি।
—তার মানে আপনি বলতে চান, বীর বাহাদুরই একমাত্র সন্দেহজনক ব্যক্তি?
—আমি মোটেই তা বলছি না। কারণ আমার কাছে এভিডেন্স আছে—বীর বাহাদুর ছাড়াও অন্তত দু’জন ঐ ঘরে ঢুকবার সুযোগ পেয়েছিল, গতকাল বেলা বারোটার পরে এবং আজ সকাল ছ’টার আগে।
ভ্রু কুঞ্চিত হয় নৃপেনের। বলে, কী বলছেন! দু’জন ঐ ঘরে ঢুকেছিল?
—ডিড আই সে দ্যাট? আমি বলেছি ঢুকবার সুযোগ পেয়েছিল।
—অর্থাৎ তারা যে ঢুকেছিল তার প্রমাণ নেই?
—আছে! একজন যে ঢুকেছিল তার একটা প্রমাণ আছে। দ্বিতীয়জনও খুব সম্ভবত ঢুকেছিল। কনক্লুসিভ প্রুফ্ নেই, কিন্তু অত্যন্ত জোরালো যুক্তি আছে।
নৃপেন বুঝতে পারে এ ভদ্রলোক সহজ মানুষ নন। উনি অনেক কিছু জেনে ফেলেছেন, বুঝে ফেলেছেন। চোখ তুলে দেখে মিসেস বাসু কখন অলক্ষ্যে চলে গেছেন ঘর ছেড়ে, পিছনের বারান্দায়। সাগ্রহে সে বলে, বলুন স্যার, কী প্রমাণ পেয়েছেন! বাই দ্য ওয়ে, রমেন গুহকে আপনি কেমন করে চিনলেন?
—আপনার দ্বিতীয় প্রশ্নটা আপাতত মুলতুবি থাক। প্রথম প্রশ্নটার জবাব দিই। একটা অনুমান, একটা প্রমাণ। অনুমানের কথাটাই আগে বলি। মহেন্দ্র আমার কাছে স্বীকার করেছে যে গতকাল রাত সাতটা নাগাদ বাইশ-নম্বর ঘরের বোর্ডার মহম্মদ ইব্রাহিম এসে তাকে বলে যে, তার ঘরের চাবিটা ঘরের ভেতর থাকা অবস্থায় সে ভুল করে ইয়েল-লক-ওয়ালা দরজাটা বন্ধ করে ফেলেছে। মহেন্দ্র তখন ওকে মাস্টার কীটা দেয়। ইব্রাহিম মিনিট পাঁচেক পরে ফিরে এসে চাবিটা ফেরত দেয়। ফলো?
— ইয়েস!
—এনি কোসচেন?
—কোসচেন! না কোসচেন কিসের?
—তাহলে আমিই প্রশ্ন করি! মহেন্দ্র মাস্টার-কীটা কেন দিল? কেন নয় ঐ বাইশ নম্বর ঘরের ডুপ্লিকেট চাবিটা?
নৃপেন বলে, ও তো একই কথা।
—আজ্ঞে না দারোগা-সাহেব! মোটেই এক কথা নয়! মহেন্দ্র আমার কাছে স্বীকার করেছে চেক-ইন করবার সময় রমেন যখন তার ঘরের ডুপ্লিকেট চাবিটা চেয়ে নেয়, তখন ইব্রাহিমও তার ঘরের ডুপ্লিকেট চাবিটা চেয়ে নয়। একজনকে সেটা দিয়ে দ্বিতীয়জনের ক্ষেত্রে মহেন্দ্ৰ সেটা প্রত্যাখ্যান করতে পারেনি।
—সো হোয়াট? তাতে হলটা কী? ডুপ্লিকেট চাবিতেও বাইশ-নম্বর ঘর খোলা যায়, মাস্টার-কীতেও খোলা যায়! ও তো একই ব্যাপার!
—না! ডুপ্লিকেট চাবিতে শুধু বাইশ-নম্বর ঘরের দরজা খোলা যায়, আর মাস্টার কী’তে দোতলার সব কটা ঘর খোলা যায়! ইব্রাহিম ঐ পাঁচ মিনিটের ভিতর তেইশ-নম্বর ঘরে ঢুকে থাকতে পারে। তার আধঘণ্টা আগে কিন্তু বীর বাহাদুর ফ্লাস্কটা রেখে গেছে। ফ্লাস্কটা খুলে তার ভিতর একটা ক্রিস্টাল ফেলে বেরিয়ে আসতে বিশ থেকে ত্রিশ সেকেন্ড লাগার কথা।
নৃপেন জবাব দিতে পারে না। অনেকক্ষণ পরে বলে, আশ্চর্য! মহেন্দ্র তো এসব কথা আমাকে বলেনি।
—আপনি প্রশ্ন করেননি, তাই বলেনি। সে এখনও জানে না ব্যাপারটার ইমপ্লিকেশন আপনার মতো সেও বিশ্বাস করে ডুপ্লিকেট চাবি আর মাস্টার-কী একই কথা। দুটোতেই বাইশ নম্বর ঘর খোলা যায়।
একটা ঢোক গিলে নৃপেন বলে, আর আপনার দ্বিতীয় অনুমানটা, স্যার?
—দ্বিতীয়টা অনুমান নয়, আগেই বলেছি—সেটা এভিডেন্স! অকাট্য প্রমাণ। আসুন— নৃপেনকে নিয়ে বাসু-সাহেব দ্বিতলে উঠে আসেন। তালা খুলে দু’জনে ঐ তেইশ নম্বর ঘরে ঢুকে পড়েন। রমেন গুহ একইভাবে পড়ে আছে। বাসু-সাহেব পকেট থেকে একটা লোহার সোন্না বার করলেন। এগিয়ে এলেন টেবিলটার কাছে। অতি সাবধানে সোন্না দিয়ে অ্যাশট্রের গর্ভ থেকে উদ্ধার করলেন একটি দগ্ধাবশিষ্ট ফিলটার টিল্ড সিগারেটের স্টাম্প। আগুনের উপর ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে যেমনভাবে শিককাবাব ভাজা হয় তেমনি ভাবে সোন্নাটা টেবিল-ল্যাম্পের আলোয় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখান। নৃপেন বিস্ফারিত নেত্রে দেখতে থাকে। কী দেখছে তা সেই জানে।
—দেখলেন?—প্রশ্ন করলেন বাসু-সাহেব।
নৃপেন আমতা আমতা করে বললে, হুঁ!
—কী দেখলেন?
এবার নৃপেন বিরক্ত হয়ে বলে, কী আবার দেখব? সিগারেটের স্টাম্প! অ্যাশট্রের ভিতর আবার কী থাকবে?
মাথা নাড়েন বাসু-সাহেব। বলেন, থাকে দারোগা সাহেব, থাকে! চোখ থাকলে দেখবেন অ্যাশট্রের খোপে সিগারেটের স্টাম্পের মধ্যে লুকিয়ে বসে আছে একটি অভিসারিকা! তার নয়নে মদির কটাক্ষ, সর্বাঙ্গে উদগ্র যৌবন, বিম্বৌষ্ঠে লিপস্টিক— বোধকরি ম্যাক্সফ্যাকটার-ভার্মিলিয়ান!
নৃপেনের সন্দেহ জাগে। প্রৌঢ় ভদ্রলোকের কি মাথায় দু-একটা স্ক্রু আলগা! নাকি এই সাত সকালেই মদ্যপান করেছেন? কিন্তু এতক্ষণ তো ওঁকে প্রতিভাবান গোয়েন্দার মতো মনে হচ্ছিল।
বাসু-সাহেব নৃপেনের দিকে চোখ তুলে চাইলেন। ওর বিহ্বল অবস্থাটা বুঝে নেবার চেষ্টা করলেন। আবার মাথা নাড়লেন। তারপর বললেন, একটা কথা খোলাখুলি বলব দারোগা সাহেব?
—বলুন স্যার!
—আপনার কম্মো নয়!
মিসেস ডি. সি.-র মামা! কী বলতে পারে নৃপেন? একজন সিনিয়ার আই. এ. এস. যাঁকে মামা ডাকেন তাঁর অধিকার আছে এ কথা বলার। সংবিধানের কত নম্বর ধারায় ওটা বলা আছে নৃপেন তা ঠিক জানে না, কিন্তু এটুকু মনে আছে—কম্পিটিটিভ পরীক্ষা দেবার সময় অ্যাব্রিভিয়েশান মুখস্থ করেছিল : IA.S. শব্দের বিস্তারিতরূপ In Anticipation of Sword! অর্থাৎ এমন একটি শাসকগোষ্ঠী যাঁদের তরোয়ালের প্রয়োজন নেই—যাঁরা হাতে-মাথা-কাটেন! বিপুল ঘোষ সেই আই.এ.এস. গোষ্ঠীর একজন সিনিয়র অফিসার—দুদিন পরে হয়তো ডিভিশনাল কমিশনার হবেন। এ ভদ্রলোক হচ্ছেন তাঁর বেটার-হাফের মামা!
নৃপেন ঢোক গেলে!
বাসু-সাহেব ওর পিঠে একখানা হাত রেখে বলেন, দুঃখ করবেন না মিস্টার ঘোষাল লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। ক্রিমিনোলজি ইজ এ সায়েন্স! দারোগা মানেই ডিটেকটিভ নয়! আপনাদের আই.জি.-ও এ ভুল করতে পারেন, যদি না তিনি ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশনে বিশেষ ট্রেনিং নিয়ে থাকেন। আমার পরামর্শ শুনুন—এ বিষয়ে অভিজ্ঞ কোনো লোক জানা আছে আপনার? থাকলে তাকেই পাঠান। কেসটা ঘোরালো! এসব কথা তো আর আমি বিপুলকে জানাতে যাচ্ছি না!
নৃপেন মনস্থির করে। একেবারে আত্মসমর্পণ। বলে, অমন লোক আমার কাছেই আছে স্যার। আমার সেকেন্ড অফিসার সুবীর রায়। আজই তার কার্শিয়াং থেকে ফিরে আসার কথা। তাকেই পাঠিয়ে দেব আপনার কাছে—
—না, না আমার কাছে নয়। আমি শীঘ্রই এ হোটেল ছেড়ে চলে যাব।
—কেন স্যার? আর দু-একটা দিন—
—উপায় নেই ঘোষাল। আমি আজই চলে যাব অন্য একটা হোটেলে। ঘুম-এর কাছে। ‘দ্য রিপোস’-এ। পরশু তার উদ্বোধন। আমাদের সস্ত্রীক নিমন্ত্রণ আছে ওখানে।
উনি যে ‘আপনি’ ছেড়ে ‘তুমি’ ধরেছেন এতে খুশিই হল নৃপেন। বললে, কিন্তু ঐ ‘ম্যাক্সফ্যাকটার ভার্মিলিয়ান’ না কী যেন বললেন, ওটা কী? সিগারেটের স্টাম্পে কী দেখতে পেলেন আপনি?
—প্রমাণ! এভিডেন্স! গতকাল রাত্রে এ ঘরে একজন অভিসারিকা প্রবেশ করেছিলেন। দেখছ না? টেবিল-এর উপর পড়ে রয়েছে রমেনের সিগারেটের প্যাকেট। ক্যাস্টান! এটা ফিলটারটিড স্টাম্প! রমেন যখন ঘরটা ভাড়া নেয় তখন অ্যাশট্রেটা নিশ্চয় শূন্যগর্ভ ছিল। সে ক্যাপস্টান খেয়েছে। তাহলে অ্যাশট্রেতে ফিলটার টিপড় সিগারেটের স্টাম্প আসে কেমন করে? তাছাড়া এই লাল স্পটটা? ওটা লিপস্টিকের চিহ্ন। ফরেনসিক এক্সপার্ট করোবরেট করবে—তুমি দেখে নিও। আর এই সূত্রেই বোঝা যাচ্ছে কেন রমেন গুহ দুটো চাবিই চেয়ে নেয়, কেন সে কিছুতেই রাজি হয়নি তোমার বাড়িতে রাত্রিবাস করতে!
নৃপেন এখনও একবাঁও মেলে না।
—বুঝলে না? রমেন কিছু ঋষ্যশৃঙ্গ মুনি ছিল না। মিস্ ডিক্রুজা ছিল কলগার্ল। রমেনের সঙ্গে তার ভালই আলাপ হয়েছিল ট্যাক্সিতে আসার পথে। ডুপ্লিকেট চাবিটা রমেন দিয়ে রেখেছিল ঐ মিস্ ডিক্রুজাকে। বিশ্বাস না হয় মহেন্দ্রকে জিজ্ঞাসা করে দেখে—মিস্ ডিক্রুজা কাল সন্ধ্যাবেলায় যে লিপস্টিক ব্যবহার করেছিলেন সেটা ভার্মিলিয়ান রেড!
নৃপেন বলে, এখানে আমার আর কিছু করণীয় আছে স্যার?
—আছে। দুটো কাজ। প্রথমত তেইশ নম্বর ঘরে যে ফ্লাস্কটা আছে ওটাও এভিডেন্স হিসাবে নিয়ে যাও। তবে এবার আর ভুল কোরো না। সাক্ষী রেখে ওটা সিল করিয়ে নিও আমার অনুমান ঐ জলেও পটাসিয়াম সায়ানাইড পাওয়া যাবে। দু-নম্বর কাজ—ঐ তেইশ-নম্বর ঘরের দু-পাশের দুটি ঘর সার্চ করা। বাইশ নম্বরে ছিল ইব্রাহিম আর চব্বিশে মিস ডিক্রুজা। দুজনেই সন্দেহভাজন।
নৃপেন বলে, ইব্রাহিম তো রাত সাড়ে আটটার সময় চেক-আউট করে বেরিয়ে যায়। তখন তো রমেন গুহ জীবিত।
—আহ্! তুমি বড় জ্বালাও! বললাম না তোমাকে? রাত সাড়ে আটটায় সে হোটেল ত্যাগ করে বটে, কিন্তু রাত সাতটায় সে মাস্টার-কী নিয়ে দোতলায় উঠে গিয়েছিল। সে সময় ফ্লাস্কটা রাখা ছিল রমেনের টেবিলে।
—আয়াম সরি! ঠিক কথা! আচ্ছা, ঐ দুটো ঘরই সার্চ করছি আমি; কিন্তু আপনিও সঙ্গে থাকলে ভাল হত না?
—না! আমরা দার্জিলিঙে এসেছি বেড়াতে। আমার স্ত্রী অনেকক্ষণ একা বসে আছেন নিচের ঘরে। ওঁর কাছেই আমি ফিরে যাব এখন। তুমি বরং যাবার আগে আমাকে জানিয়ে যেও ঐ দুটো ঘরে উল্লেখযোগ্য কিছু পেলে কি না
বাসু-সাহেব নেমে এলেন একতলায়। নিজের ঘরে ফিরে এসে দেখলেন ওঁর স্ত্রী রানি দেবী চুপ করে বসে আছেন চাকা-দেওয়া চেয়ারে। কোলের উপর পড়ে আছে কণ্টকবিদীর্ণ অসমাপ্ত উলের সোয়েটারখানা। উলের গুলিটা পোষমানা বেড়ালছানার মতো হাত পা গুটিয়ে বসে আছে ওর পায়ের কাছে। বিষাদের মূর্তি যেন!
—অনেকক্ষণ একা একা বসে আছো? নয়?
রানি দেবীর চমক ভাঙে। ম্লান হেসে বলেন, দারোগাবাবা বিদায় হল?
—আপাতত। আবার আসবেন যাবার আগে।
—আমরা কখন রিপোস এ যাচ্ছি?
—হয় আজ বিকালে, নয় কাল সকালে।
—তুমি বরং আগে একবার হোটেলটা দেখে এস। একেবারে দোর পর্যন্ত ট্যাক্সি যদি না যায়-
বাক্যটা উনি শেষ করেন না। প্রয়োজন ছিল না। ওঁরা দুজনেই জানেন মিসেস বাসু চলৎশক্তিহীনা। একটা মারাত্মক অ্যাকসিডেন্টে রানি দেবীর শিরদাঁড়া ভেঙে গেছে। উনি খাড়া হয়ে উঠে দাঁড়াতে পারেন না। বস্তুত ঐ দুর্ঘটনার পর থেকেই বাসু-সাহেবের জীবন অন্য খাতে বইছে। প্র্যাকটিস ছেড়ে দিয়েছেন। এখন ওঁর একমাত্র কাজ পঙ্গু স্ত্রীকে সঙ্গদান করা। সন্তান একটি মাত্রই হয়েছিল ওঁদের। ঐ দুর্ঘটনায় মারা যায়
বাসু-সাহেব হেসে বলেন, খবর নিয়েছি। গাড়ি যাবার রাস্তা আছে। না থাকলেও বাধা ছিল না। তোমাকে কোলপাঁজা করে নিয়ে যাবার ক্ষমতা আমার আজও আছে। বিশ্বাস না হয় তো বলো এখনই পরখ করে দেখাই।
এত দুঃখেও হেসে ফেলেন রানি দেবী।
প্রায় মিনিট পনের পরে ফিরে এল নৃপেন। যথারীতি দরজায় নক্ করে ঘরে ঢুকল। বললে, মিস ডিক্রুজার ঘরে কিছুই পাওয়া গেল না স্যার; কিন্তু মহম্মদ ইব্রাহিমের ঘরে একটা জিনিস উদ্ধার করেছি। মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না। একটু দেখুন তো স্যার-
একটা কাগজের দলা। সেটা হাতের মুঠোয় নিয়ে বাসু-সাহেব বলেন, কোথায় পেলে এটা?
—বাইশ নম্বর ঘরে, ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে।
—কাল রাত্রে ইব্রাহিম ঘরটা ছেড়ে যাবার পর ও-ঘরে নতুন বোর্ডার আসেনি?
—না। তবে শুনলাম এখনই আসবে। একুশ নম্বর ঘরের বোর্ডার নাকি ঐ ঘরে শিফ্ট করছেন!
চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন বাসু-সাহেব। কাগজটা ওঁর মুঠিতে ধরাই থাকে। বলেন কে ঐ একুশ নম্বরের বোর্ডার?
—নামটা জিজ্ঞাসা করিনি। তবে শুনলাম তিনি আর্টিস্ট। একুশ নম্বর ঘরের জানলা থেকে নাকি কাঞ্চনজঙ্ঘা ভাল দেখা যায় না, গাছের আড়াল পড়ে। তাই উনি বাইশ নম্বরে সরে আসতে চান। একটু আগে ঘরটা দেখে পছন্দ করে গেছেন। এখনই শিফ্ট্ করবেন।
—বুঝলাম। ধীরে ধীরে কোঁকড়ানো কাগজের দলাটা খুলে ফেলেন। কাগজটা মেলে ধরেন টেবিলের উপর। হঠাৎ চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন বাসুসাহেব। চোখ দু’টি বুজে যায়। রানি দেবী ছিলেন পিছনেই। কৌতূহল দমন করতে পারেন না। ঝুঁকে পড়েন কাগজটার উপর। তাতে কালো কালিতে লেখা ছিল :