সোনার কাঁটা – ১

ক্রিররং-ক্রিং…ক্রিররং-ক্রিং!

কোনো মানে হয়? দার্জিলিঙ-এর শীত। সকাল ছটা বেজে দশ। ছুটির দিন—দোসরা অক্টোবর, 1968। গান্ধীজির জন্মদিবস। সব সরকারি কর্মচারী আজ বেলা আটটা পর্যন্ত ঘুমোবে—শুধু ওরই নিস্তার নেই! এই সাত-সকালে টেলিফোনটা চিল্লাতে শুরু করেছে।

ক্রিররং ক্রিং… ক্রিররং-ক্রিং!

লেপটা গা থেকে সরিয়ে খাটের উপর উঠে বসে নৃপেন ঘোষাল—দার্জিলিঙ সদর থানার দারোগা। দেখে, পাশের খাটে লেপের ফাঁক থেকে সুমিতাও একটা চোখ মেলে তাকাচ্ছে। ঘোড়া দেখলেই মানুষে খোঁড়া হয়। নৃপেন আবার সটান শুয়ে পড়ে বলে—দেখ তো?

সুমিতা লেপটা টেনে দেয় মাথার উপর। স্বগতোক্তি করে একটা, দেখতে হবে না, রং নাম্বার!

অগত্যা আবার উঠে বসতে হয়। সুমিতা লেপের মায়া ত্যাগ করবে না। রং নাম্বার ধরে নিয়ে নিশ্চিন্ত হতে পারলে তো বাঁচা যেত। ডি-সি-র ফোন হতে পারে, পুলিস সুপারের হতে পারে—কে জানে, ট্রাঙ্ক-কল কি না! হাড়-কাঁপানো শীত অগ্রাহ্য করে উঠে পড়ে নৃপেন। হাত বাড়িয়ে হুক থেকে গরম ড্রেসিং-গাউনটা নামায়। গায়ে চড়াতে চড়াতে চটিটা পায়ে গলাতে থাকে।

সুমিতা মুখটা বার করে বলে, বেচারী!…কেন ঝামেলা করছ। শুয়ে থাক। ও আপনিই থেমে যাবে। কোথায় কোন সিঁধেল চুরি হয়েছে—

—সিঁধেল চুরিই হোক, আর বউ-চুরিই হোক—আরও বারো ঘণ্টা এ নরক যন্ত্রণা আমাকেই ভোগ করতে হবে—

ড্রেসিং গাউনের ফিতেটা বাঁধতে বাঁধতে ঘর ছেড়ে ‘হল’-কামরায় পৌঁছনোর আগেই টেলিফোনটা দাঁত কিড়মিড় করা বন্ধ করল।

—যা বাব্বা! ঠান্ডা মেরে গেলি?—মাঝপথেই দাঁড়িয়ে পড়ে নৃপেন।

অনেকক্ষণ বাজছিল অবশ্য। হয়তো ও পক্ষের মানুষটা ভেবেছে—যাগে; মরুগকে—এখন আর ও-লোকটা কী ভেবেছে তা নিয়ে নৃপেনের কী মাথা-ব্যথা? লোকটা যখন টেলিফোন নামিয়ে রেখেছে তখন নৃপেনের দায়িত্ব খতম। ঘরে ফিরে আসে সে। ড্রেসিং গাউনটা খুলে আবার হ্যাঙারে টাঙিয়ে রাখে। হঠাৎ ওর দৃষ্টি চলে যায় কাচের জানলা দিয়ে উত্তর দিকে। অপূর্ব দৃশ্য। নির্মেঘ আকাশে কাঞ্চনজঙ্ঘার মাথায় মাথায় লেগেছে আবিরের স্পর্শ। উদয়-ভানুর প্রথম জয়টীকা। এ দৃশ্য দেখতে এতক্ষণে নিশ্চয় ভিড় জমেছে টাইগার হিলের মাথায়—দূর দূরান্তর থেকে এসেছে যাত্রীদল, নৃপেনের কিন্তু কোনো ভাবান্তর হল না। স্ত্রীকে ডেকে জানাল না পর্যন্ত খবরটা। একটা হাই তুলল সে। জানলার পর্দাটা টেনে দিয়ে’ উঠে বসল খাটে। লেপটা নিল আবার নৃপেনের ঘোষাল আজ একাদিক্রমে চার বছর আছে এই দার্জিলিঙে। সে হাড়ে হাড়ে জানে রোজ সকালে ভিখারি কাঞ্চনজঙ্ঘা মাথার ঐ দগদগে ঘা ব্যান্ডেজ-খোলা কুষ্ঠ রুগীর মতো সব্বাইকে দেখায়!

দার্জিলিঙ ওদের কাছে পচে গেছে। ঝাঁকার তলায় চেপটে যাওয়া টমেটোর মতো লাল ঐ কাঞ্চনজঙ্ঘার রঙের খেলায় আর ওদের কোনো আকর্ষণ নেই। দু’বছর ধরে ক্রমাগত বদলির জন্য তদবির আর দরবার করে এসেছে। এতদিনে মা কালী মুখ তুলে চেয়েছেন। বদলির অর্ডার এসেছে। মায় ওর সাবস্টিট্যুট পর্যন্ত এসে হাজির। এই হতভাগা দার্জিলিঙে আজই ওর শেষদিন। আর মাত্র বারো ঘণ্টা—হ্যাঁ, ম্যাক্সিমাম্ বারো ঘণ্টা এ নরক যন্ত্রণা ওকে ভোগ করতে হবে। ফোরনুনেই রমেন গুহ ওর কাছ থেকে চার্জ বুঝে নেবে। আঃ! বাঁচা গেল। বদলি হয়েছে খাস কলকাতায়—একেবারে লালবাজারে। বলা যায় একরকম প্রমোশনই। নৃপেন লেপের নিচে অবলুপ্ত হয়ে যায়।

সুমিতা বিজ্ঞতা প্রকাশ করে, দেখলে তো? বললাম রং-নাম্বার!

—কোথায় আর দেখলাম? লোকটা তো বিরক্ত হয়ে ছেড়েই দিল।

—গরজ থাকলে ছাড়ত না। আর একবার ঘুমোবার চেষ্টা করো দিকিন। কাল রাত দুটো পর্যন্ত যা দাপাদাপি করেছ!

তা করেছে। মালপত্র প্যাকিং হয়ে পড়ে আছে ঘর জুড়ে। ঘরে, হল-কামরায়, করিডরে। নানান আকারের প্যাকিং কেস আর ক্রেট। চার বছরের সংসার, গুছিয়ে তোলা সোনার কাঁটা কি সহজ কথা? আজই ও-বেলায় নৃপেনরা নামবে। নামবে মানে কলকাতা-মুখো রওনা দেবে। মালপত্র যাবে ট্রাকে। হরি সিং-এর ট্রাক ঠিক এগারোটার সময় এসে দাঁড়াবে। ওরা যাবে জীপে। শিলিগুড়ি পর্যন্ত। তারপর ট্রেনে। রিজার্ভেশন করানোই আছে।

ওর সাক্‌সেসার রমেন গুহ এসে পৌঁছেছে গতকাল। রমেন ছেলে ভাল, নৃপেন একথা স্বীকার করবে। টেলিগ্রাফিক ট্রান্সফার অর্ডার পেয়ে তৎক্ষণাৎ রওনা দিয়েছে। বস্তুত মাসের শেষদিনে। আর কেউ হলে অন্তত একটা দিন অপেক্ষা করত। মাসমাহিনাটা নগদে হাতে নিয়ে চেয়ার ছাড়ত। রমেন তা করেনি। বেচারি লাস্ট পে সার্টিফিকেট কবে পাবে কে জানে? হীরের টুকরো ছেলে! কাল দুপুরেই এসে পৌঁছেছিল দার্জিলিঙে। হোটেলে মালপত্র নামিয়ে এসে দেখা করেছিল নৃপেনের সঙ্গে। নৃপেন বলেছিল, আবার হোটেলে উঠতে গেলে কেন রমেন? এ ফ্ল্যাটে তো তিনখানা ঘর। অসুবিধা কিছুই হবে না। তুমি হোটেল ছেড়ে এখানে চলে এস।

রমেন গুহ রাজি হয়নি। জবাবে বলেছিল, কেন ঝামেলা বাড়াচ্ছ ভাই? তুমি বাঁধাছ্যাদায় ব্যস্ত থাকবে, মিসেস ঘোষালও তাঁর বড়ি-আচারের বয়াম নিয়ে বিব্রত থাকবেন—এর মধ্যে উটকো গেস্ট—

বাধা দিয়ে সুমিতা বলেছিল, আমাদের কিছুমাত্র অসুবিধা হবে না। আমরা যদি ভাতে-ভাত খাই, আপনাকেও তাই খাওয়াব।

—আমি তা খাব কেন?—জবাবে হেসে ও বলেছিল, রীতিমত বিরিয়ানি পোলাও আর মুরগির রোস্ট চাই আমার। কলকাতায় বদলি হচ্ছেন! ইয়ার্কি নাকি?

এক গাল হেসে সুমিতা বলেছিল, বেশ তাই খাওয়াব। হোটেলের ঘরটা ছেড়ে দিয়ে আসুন আপনি।

রমেন মাথা নেড়ে আপত্তি জানয়েছিল; আমারও বদলির চাকরি মিসেস ঘোষাল। শেষ দিনটা কীভাবে কাটে তা কি আমি জানি না? আপনার হাতে পোলাও-মাংস নিশ্চিত খাব, তবে এখানে নয়! আপনারা কলকাতায় গিয়ে গুছিয়ে বসুন; আমি যখন সরকারি কাজে কলকাতায় ট্যুরে যাব, তখন ডবল্ ডি.এ. ক্লেম করব আর আপনার হাতের রান্না খাব। বুঝলেন?

নৃপেন জিজ্ঞাসা করেছিল, কোথায় উঠেছ তুমি? কোন হোটেলে?

—’হোটেল কাঞ্চনজঙ্ঘা’। ম্যাল-এর ওপাশে। চেন?

—খুব চিনি। দার্জিলিঙ আমার নখদর্পণে। ওর ম্যানেজার তো একজন সিন্ধি ভদ্রলোক, নয়? কী যেন নাম?

—ম্যানেজারকে দেখিনি, তবে কাউন্টারে যে ছোকরা বসেছিল সে বাঙালি। মালপত্র নামিয়ে রেখেই আমি তোমার এখানে চলে এসেছি—

সুমিতা আবার বলে, বেশ, হোটেলে রাত কাটাতে চান কাটান, রাত্রে কিন্তু আমার এখানেই খেতে হবে।

—কেন ঝুট-ঝামেলা পাকাচ্ছেন শখ করে?

—ঝামেলা নয় মোটেই। শুনুন, আমি আজ রাঁধব না। বাসন-পত্রও সব প্যাক হয়ে গেছে। হোটেলে খাবার অর্ডার দেব। আপনার মুখ ফসকে যখন কথাটা বেরিয়ে গেছে তখন আজই আপনাকে খাওয়াব—ঐ বিরিয়ানি পোলাও আর মুরগির রোস্ট! আজই! এখানেই—

রমেন তবু বলে, কিন্তু আমার শর্তটা ছিল অন্যরকম। হোটেলের রান্না নয়, আপনার শ্ৰীহস্তপক—

বাধা দিয়ে সুমিতা বলে ওঠে, না শর্ত মোটেই তা ছিল না। শর্ত ছিল—আপনি যখন কলকাতায় গিয়ে ডবল্ ডি. এ. ক্লেম করবেন তখন আমার হাতের রান্না খাবেন। তাই নয়?

রমেন হেসে ফেলেছিল; ঠিক কথা! আমারই ভুল!

—ক্রিররং-ক্রিং—ক্রিররং-ক্রিং!

আবার উৎপাত! এ তো মহা বখেড়া হল দেখা যাচ্ছে। নৃপেন কাতরভাবে সুমিতার দিকে তাকায়। সুমিতা উঠে বসে এবার। চিৎকার করে বলে—না, নৃপেনকে নয়, টেলিফোনকে—মশাই শুনছেন! ঘণ্টাছয়েক পরে ফোন করবেন! ও.সি-সাহেব এখন ব্যস্ত আছেন, তখন থাকবেন না!

যন্ত্রটা এ উপদেশে কান দিল না। একগুঁয়েমি চালিয়ে চলে, ক্রিররং-ক্রিং!

—দুত্তোর নিকুচি করেছে! উঠে পড়ে সুমিতা! দুম দুম করে পা ফেলে চলে আসে হল-কামরায়। টেলিফোনটা তুলে নিয়ে বলে, বলুন?…হ্যাঁ, আছেন। না, ঘুমোচ্ছেন না। আপনি কোথা থেকে বলছেন?

নৃপেন কৰ্ণময়।

—কাঞ্চনজঙ্ঘা হোটেল থেকে? মিস্টার গুহ বলছেন?… না? কী!… সে কী!!

এবার খাট থেকে লাফ দিয়ে নেমে পড়ে নৃপেন। ড্রেসিং গাউনটা গায়ে জড়াবার কথা আর মনেই থাকে না। সুমিতার কণ্ঠস্বরে এমন একটা কিছু ছিল যাতে নৃপেন দৌড়ে এসে বলে, কী হয়েছে সুমিতা?

সুমিতা জবাব দেয় না। সে যেন পাথর হয়ে গেছে! শীতেই কি না বোঝা গেল না, সে রীতিমত কাঁপছে। দ্রুতহাতে নৃপেন রিসিভারটা কেড়ে নেয়, বলে, ও.সি. সদর বলছি। কে আপনি?… ইয়েস! কী? কী বলছেন মশাই! অসম্ভব!!

সুমিতা ইতিমধ্যে বসে পড়েছে সামনের চেয়ারখানায়।

দীর্ঘ সময় নৃপেন আর কিছু বলে না টেলিফোনে, শুধু শুনে যায়। তারপর বলে, কোনো কিছু ছোঁবেন না। ঘরটা তালাবন্ধ করে রাখুন। আমি পনের মিনিটের ভিতর আসছি।

রিসিভারটা নামিয়ে রেখে সে ঘুরে দাঁড়ায়। সুমিতার মুখোমুখি। বলে, শুনলে? সুমিতা জবাব দেয় না। মাথাটা নাড়ে শুধু।

—কী হতে পারে বলো তো? হার্টফেল? থ্রম্বোসিস?

—আমি…আমি এখনও বিশ্বাসই করে উঠতে পারছি না। কাল রাত্রেও ভদ্রলোক কত হাসি-মশকরা করে গেলেন। ওঁর এঁটো প্লেটটা পর্যন্ত এখনও—

নৃপেনের দৃষ্টি চলে যায় ডাইনিং টেবিলে। তিনটি ভুক্তাবশিষ্ট প্লেট। রমেন গুহর প্লেটে পাশাপাশি দু’খানা ঠ্যাং! রাত পৌনে দশটা নাগাদ রমেন হোটেলে ফিরে যায়। আর আজ সকাল ছ’টা দশে সে লোকটা বেঁচে নেই? ইম্পসিবল!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *