সোনার কাঁটা – ৭

পরদিন। চৌঠা অক্টোবর। শুক্রবার। সকাল

সুবীরের ঘরে এসে হাজির হল আলি। পর্দার বাইরে থেকে বললে, ভিতরে আসতে পারি?

সুবীর একটু অবাক হল, বললে, নিশ্চয়। আসুন মিস্টার আলি। কী ব্যাপার? আলি এসে বসল সামনের চেয়ারটায়। বললে, আপনাকে কয়েকটা কথা বলতে এলাম।

—বলুন?—ঘনিয়ে আসে সুবীর।

—দেখুন মিস্টার রায়, আপনি কাল যখন আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন তখন আমি জোভিয়াল-ডে জবাব দিয়েছিলাম। সত্যিকথা বলতে কি আমি বিশ্বাস করিনি যে, দার্জিলিঙ-এর ঘটনা এই রিপোস-এ রিপিটেড হতে যাচ্ছে—ভেবেছিলাম এসব আপনাদের আষাঢ়ে কল্পনা। কিন্তু এখন আর সেটা ভাবা যাচ্ছে না। দু-নম্বর ঘটনা এখানে কাল রাত্রে ঘটে গেছে। ফলে এখন সিরিয়াসলি ব্যাপারটা আপনার সঙ্গে আলোচনা করতে চাই—

—করুন। আমি কর্ণময়!

প্রথম কথাই বলব যে, আমি জানি—আমি নিজে আপনার সন্দেহের তালিকায় আছি। আই নো ইট! শুধু আমি নই, আপনি হয়তো ডক্টর সেন এমনকি বৃদ্ধ অজয়বাবুকেও সন্দেহের তালিকায় রেখেছেন; মিস্ ডিক্রুজার সন্ধানে আপনি কাবেরী দেবী অথবা মিসেস্ সেনকেও নজরে নজরে রেখেছেন—তাই নয়?

—বলে যান—

—আমার আশঙ্কা হচ্ছে আপনি—এ কেস-এ ইনভেস্টিগেটিং অফিসার—সমস্ত সম্ভাবনা তলিয়ে দেখছেন না, ফলে আপনার সন্দেহের তালিকা থেকে একজন বাদ যাচ্ছেন, যাঁকে ঠিকমত বাজিয়ে দেখা আপনার উচিত। আপনারা কয়েকটি ভুল পূর্বসিদ্ধান্ত করেছেন!

—আর একটু পরিষ্কার করে বলুন—

—আপনারা ধরে নিয়েছেন—পয়লা অক্টোবর ইব্রাহিম নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে শেয়ারের ট্যাক্সি চেপে রমেন দারোগা আর মিস্ ডিক্রুজার সঙ্গে দার্জিলিঙ-এ এসেছিল। তা তো না-ও হতে পারে? এমনও তো হতে পারে যে, রমেনবাবু আর মিস্ ডিক্রুজা নিউ জলপাইগুড়ি থেকে শেয়ারের ট্যাক্সিতে আসছিল আর ইব্রাহিম মাঝপথে ঐ ট্যাক্সিতে ওঠে, ধরুন পাঙ্খাবাড়ি, কার্শিয়াং, সোনাদা কিম্বা এই ঘুম-এই

—এমনটা মনে করার হেতু?

—আপনাদের ধারণা যে, এই ট্যাক্সিতে আসার সময়েই রমেনবাবু আর মিস্ ডিক্রুজার মধ্যে ঘনিষ্ঠতা হয়—সেটা এতদূর নিবিড় হয় যাতে হোটেলে পৌঁছেই রমেনবাবু ডুপ্লিকেট চাবিটা চেয়ে নেয় এবং ডিক্রুজাকে সেটা দিয়ে দেয়। এক্ষেত্রে স্বতঃই ধরে নিতে হয় ট্যাক্সিতে দুজন বেশ কিছুক্ষণ নিভৃত আলাপের সুযোগ পেয়েছিল। নিউ জলপাইগুড়ি থেকে একটা শেয়ারের ট্যাক্সিতে দুটি পুরুষ ও একটি মহিলা একসঙ্গে রওনা হলে এ জাতীয় ঘনিষ্ঠতা কখনো গড়ে উঠতে পারে দুজনের মধ্যে?

—সো হোয়াট?

—তাতে এ-কথাই প্রমাণিত হয় যে, ইব্রাহিম পয়লা তারিখ সকালে ঐ ট্রেনে কলকাতা থেকে আসেনি। সে মাঝ-রাস্তায় ঐ ট্যাক্সিতে উঠেছিল—

সুবীর বলে, কিন্তু মুশকিল কী হচ্ছে জানেন মিস্টার আলি–আমাদের সন্দেহের তালিকায় যে কজন আছেন, যেমন ধরুন ডক্টর সেন, অজয়বাবু এবং

—আপনার ইতস্তত করার কিছু নেই—আমরা অ্যাকাডেমিক ডিস্কাশান করছি, ফলে, ‘এবং মিস্টার আলি’। আমি নিজেকে সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দেবার শুভেচ্ছা নিয়ে আপনার কাছে আসিনি; আমি শুধু বলতে এসেছি যে, সমস্যাটার আরও একটা দিক আছে, আরও একজনকে সন্দেহের তালিকায় আপনাদের রাখা উচিত।

—আর একটু স্পেসিফিকালি বলবেন?

—বলব। আমি এখানে এসে পৌঁছাই পয়লা তারিখ রাত সওয়া ন’টায়। তখন এখানে মিসেস মিত্র একা ছিলেন। মিস্টার কৌশিক মিত্র ফিরে এলেন রাত দশটায় এবং এসেই তাঁর স্ত্রীকে কৈফিয়ত দিলেন যে, তিনি সমস্ত দিন ছিলেন কাঞ্চন ডেয়ারিতে, দার্জিলিঙ-এ তিনি আদৌ যাননি সারাটা দিন—

—তাতে কী হল?

—অথচ আমি নিশ্চিত জানি—কৌশিকবাবু বেলা এগারোটার সময় ঘুম স্টেশনে একটা শেয়ারের ট্যাক্সিতে চেপে দার্জিলিঙ-এ যান। সারাটা দিন তিনি দার্জিলিঙ-এ কী করেছেন তা জানি না। কিন্তু এটুকু জানি যে, তিনি দুপুরে ‘সাংগ্রি-লা’ নামে একটি চিনা হোটেলে লাঞ্চ করেন—একা নন, তাঁর সঙ্গে ছিলেন একটি সুন্দরী মহিলা।

—মহিলা! কে তিনি?

—এ কাহিনির মিসিং লিংক। বয়স পঁচিশ-ছাব্বিশ। সুন্দরী। চমৎকার ফিগার। চুল ছোট, বব নয়। চেহারায় অবাঙালিত্বের ছাপ; কিন্তু চমৎকার বাংলা বলতে পারেন। মহিলাটি কে হতে পারেন তা মিসেস্ মিত্র আন্দাজ করতে পারছেন না, অথচ আমি স্বচক্ষে দেখেছি কৌশিকবাবু তাকে একটি ‘সোনার কাঁটা’ উপহার দিচ্ছেন। আর—যদি না আমার চোখ ভুল করে থাকে, মহিলাটির ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিক্স ঐ রকমই সুবীরের ভ্রুকুঞ্চিত হয়। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সে দেখতে থাকে আলিকে। তার পর বলে, আপনি কেমন করে জানলেন?

—আমি প্রত্যক্ষদর্শী। তিন টেবিল পিছনে আমি ঐ রেস্তোরাঁতেই খাচ্ছিলাম। একা ফলে কৌশিকবাবু আমাকে নজর করেননি। আর তাঁর সুন্দরী সঙ্গিনী থাকায় আমি বার বার ওদিকে তাকিয়ে দেখছিলাম।

সুবীর বললে, অ্যাকাডেমিক ডিস্কাশানই যখন করছি তখন বলি—এমনও তো হতে পারে যে, আপনি আদ্যন্ত বানিয়ে বলছেন। আমার দৃষ্টি বিভ্রান্ত করতে।

—কারেক্ট! সেটাও যেমন সম্ভব তেমনি এটাও সম্ভব যে, আমি আদ্যন্ত সত্যকথা বলছি। আমি কোনোভাবেই আপনার তদন্তকে প্রভাবিত করতে চাই না। আমি শুধু একথা বলব যে, আমি তদন্তকারী অফিসার হলে এটার সত্যতা যাচাই করে দেখতাম। সত্য হলে কৌশিককে সন্দেহ করতাম, আর মিথ্যা হলে আলিকে আরও সন্দেহের চোখে দেখতাম।

সুবীর বললে-থ্যাংক্স, ফর দ্য টিপস্!

আরও আধঘণ্টা পরের কথা। সুবীর এসে উপস্থিত হল কৌশিকের ঘরে। বললে, কৌশিকবাবু এতক্ষণ আপনাকে কিছু প্রশ্ন করা হয়নি, এখন আপনার স্টেটমেন্টটা নিতে চাই-

কৌশিক কী একটা হিসাব লিখছিল। খাতাটা বন্ধ করে বললে, বলুন?

—ঐ পয়লা তারিখ আপনি কোথায় ছিলেন? সকাল থেকে রাত্রি দশটা পর্যন্ত?

কৌশিক চট করে জবাব দেয় না। প্রতিপ্রশ্ন করে, কেন বলুন তো?

—আমি যদি বলি ঐদিন বেলা এগারটা নাগাদ আপনি ঘুম স্টেশন থেকে একটা শেয়ারের ট্যাক্সি নিয়ে দার্জিলিঙ গিয়েছিলেন, সারাদিন দার্জিলিংঙ-এই ছিলেন এবং সন্ধ্যাবেলা ফিরে এসে মিসেস্ মিত্রকে মিথ্যা কথা বলেছিলেন—আপনি কি অস্বীকার করবেন?

এবারও সরাসরি জবাব দেয় না কৌশিক। বলে, কে বলেছে আপনাকে? সুজাতা?

—কে আমাকে বলেছে সেটা বড় কথা নয়। আপনি আমার প্রশ্নের জবাবটা দেননি এখনও।

কৌশিক তবুও সহজ হতে পারে না। এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলে, আপনার অভিযোগ সত্য।

—আপনি দুপুরে সাংগ্রি-লাতে লাঞ্চ করেন। আপনার সঙ্গে একটি মহিলা আহার করেছিলেন—সুন্দরী। চমৎকার ফিগার। অবাঙালি, অথচ তিনি চমৎকার বাংলা বলতে পারেন। টু?

রীতিমত চমকে ওঠে কৌশিক। বলে, আপনি কী বলতে চান? আমি … আমি রমেন দারোগাকে খুন করেছি?

—আমি কিছু বলতে চাই না কৌশিকবাবু। বলবেন তো আপনি। আমি যা বলছি তা সত্য? কৌশিক রুখে ওঠে, হ্যাঁ সত্য! সো হোয়াট?

—সেই মহিলাটি কে?

—আমি বলব না!

—আপনি আমার সঙ্গে সহযোগিতা করছেন না।

—বেশ তাই! তারপর?

সুবীর উঠে দাঁড়ায়। বলে, না, তারপর আর কিছু নেই। ধন্যবাদ।

নিঃশব্দে উঠে চলে যায় সুবীর।

কৌশিকও উঠে পড়ে। তার মনে হয়—এর মূলে আছে সুজাতা। কিন্তু সুজাতা কেমন করে আন্দাজ করল সে কাঞ্চন ডেয়ারিতে যায়নি—গিয়েছিল দার্জিলিঙ? সুজাতা কেমন করে জানবে যে কোথায় কার সঙ্গে লাঞ্চ খেয়েছিল? পায়ে পায়ে ও চলে আসে কিচেন-ব্লকে। ব্যাপারটার ফয়সালা হওয়া দরকার। কেমন করে সুজাতা জানতে পারল এ কথা?

কিচেন-ব্লকে পর্দার সামনে থমকে দাঁড়িয়ে পড়তে হল ওকে। ঘরের ভিতর দুজনে নিম্নস্বরে কথা বলছে। একজন সুজাতা, দ্বিতীয়জন কে? পুরুষকণ্ঠ! ভদ্রলোক তখন বলছিলেন, আপনি আমাকে ভুল বুঝেছেন সুজাতা দেবী, আমি তেমন কোনও উদ্দেশ্য নিয়ে ও প্রশ্ন করিনি।

—তাহলে আমাদের বিবাহিত জীবন নিয়ে আপনার অত কৌতূহল কেন?

—কী আশ্চর্য! আপনি অফেন্ডেড্ হচ্ছেন কেন? আমি শুধু জানতে চাইছি অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ যখন হয়নি তখন কতদিন ধরে আপনি কৌশিকবাবুকে চেনেন। এতে অফেন্স নেবার কী আছে?

—অফেন্স নিচ্ছি প্রশ্নটার জন্য নয়, তার পিছনে যে ইঙ্গিতটা আছে সেটায়! হ্যাঁ, আপনি যা জানতে চাইছেন তা ঠিক। মিস্টার মিত্র একবার মার্ডার কেসে অ্যারেস্টেড হয়েছিলেন, ঐ রমেনবাবুই তাকে গ্রেপ্তার করেন। খবরটা কোথা থেকে সংগ্রহ করেছেন জানি না, কিন্তু সংবাদটা অসমাপ্ত—ঐ সঙ্গে এটুকুও জেনে রাখুন, আমিও ঐ কেসে মার্ডার চার্জে অ্যারেস্টেড হয়েছিলাম! কিন্তু প্লিস মিস্টার আলি, এসব আলোচনা আপনার সঙ্গে আমি করতে চাই না! আপনি এবার আসুন। আমাকে কাজ করতে দিন। আর … কিছু মনে করবেন না, এ কিচেন ব্লকটা বোর্ডারদের জন্য নয়, এটা হোটেলের প্রাইভেট অংশ। আমার সঙ্গে কথা বলার প্রয়োজন হলে কাঞ্চীকে দিয়ে খবর পাঠাবেন দয়া করে—

কৌশিক নিঃশব্দচরণে ফিরে যায় নিজের ঘরে।

.

আরও আট দশ ঘণ্টা কেটে গেছে তারপর। সময় যেন থমকে আছে ঐ অভিশপ্ত বাড়িটায়—যেখানে নতুন জীবনের সুত্রপাত করতে সদ্যোবিবাহিত একটি দম্পতি আনন্দের আয়োজন করেছিল। না। ভুল বললাম। সময় থমকে নেই। রুদ্ধ নিঃশ্বাসে সময় বয়ে চলেছে—ড্রয়িংরুমের পেন্ডুলাম-ওয়ালা ঘড়িটায় তার শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ শোনা যায়। আর শোনা যায় নিরবচ্ছিন্ন ধারাপাতের শব্দে। বৃষ্টি এখনও পড়ছে—কখনও জোরে, কখনও ঝোড়ো হাওয়ার খ্যাপামিতে, কখনও বা ইশে-গুঁড়ির নৈঃশব্দে। বিরাম নেই, বিশ্রাম নেই। টেলিফোন যোগাযোগ নেই, ইলেকট্রিক কারেন্ট নেই—স্তব্ধ হয়েছে কার্ট-রোড দিয়ে গাড়ির আনাগোনা। কোথাও কোনও মানুষজনের সাড়া শব্দ নেই এমনকি পাখিটা পর্যন্ত ডাকছে না।

বিক্ষুব্ধ সমুদ্রের বেষ্টনীতে জাহাজ-ডুবির কজন যাত্রী আশ্রয় নিয়েছে জনমানবশূন্য একটা ছোট্ট দ্বীপে। সংখ্যায় ওরা মাত্র দশজন। চারদিকেই উত্তালতরঙ্গ সমুদ্রের লবণাক্ত বেড়াজাল—পালাবার কোনো পথ নেই। ওদের মুক্তির একমাত্র উপায় হয়তো ছিল— সঙ্ঘবদ্ধতায়। বিশ্বাসে, পারস্পরিক সৌহার্দ্যে। অথচ এমনই দুর্ভাগ্য ওদের—ওরা কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছে না। ভদ্রতা বজায় রেখে একসঙ্গে হাসছে, কথা বলছে, খাচ্ছে, ঘুমোচ্ছে—অথচ প্রত্যেকেই প্রত্যেককে সন্দেহ করছে। ওরা জানে—ওদের মধ্যে আত্মগোপন করে আছে একজন নৃশংস খুনি—জাত ক্রিমিনাল। ওদেরই মধ্যে একজনকে খুন করবার জন্য সে অবকাশ খুঁজছে। কে কাকে? তা ওরা জানে না; কিন্তু ভুলতেও পারছে না সেই মারাত্মক তিন নম্বরের জিজ্ঞাসা চিহ্নটিকে।

কৌশিক ওর ঘরে চুপ করে বসেছিল। জানলা দিয়ে দৃষ্টি চলে গেছে ধারাস্নাত পাইন গাছগুলোর দিকে। সুজাতা ঘরেই আছে। কথাবার্তা হচ্ছে না ওদের। মন খুলে কেউ যেন কিছু বলতে পারছে না এ কদিন। এমনিই হয়। প্রেমের ফুল যখন ফোটে তখন কুন্দর মতো সুন্দর হয়ে ফোটে; আর প্রেমের কাঁটা যখন ফোটে তখন শজারুর কাঁটার মতো সর্বাঙ্গে বিঁধতে থাকে। শজারুর কাঁটা না শোনার কাঁটা? শেষে কী মনে করে সুজাতা এগিয়ে এল পিছন থেকে। আলতো করে একখানা হাত রাখল কৌশিকের কাঁধে। কৌশিক ফিরে তাকাল না। সুজাতার হাতের উপর হাতটা রাখল।

—একটা কথা সত্যি করে বলবে?

এবারও মুখ ঘোরালো না কৌশিক। একইভাবে বসে বলে, বলো?

—তুমি পয়লা-তারিখ কাঞ্চন-ডেয়ারি যাওনি, নয়?

—যাইনি!

—দার্জিলিঙে গিয়েছিলে?

— হুঁ!

—সেখানে সাংগ্রি-লাতে দুপুরে লাঞ্চ করেছিলে?

— হুঁ!

—তোমার সঙ্গে একটি মেয়ে খেয়েছিল। সে কে?

কৌশিক নিরাসক্তভাবে বললে, প্রমীলা ডালমিয়া। আমার সহপাঠী কিশোর ডালমিয়ার স্ত্রী। সাংগ্রি-লাতেই হঠাৎ দেখা হয়ে গিয়েছিল।

সুজাতা এক মুহূর্ত কী ভেবে নেয়। তারপর ওর চুলের মধ্যে আঙুল চালিয়ে বলে, তাহলে সেদিন কেন মিছে কথা বললে আমায়?

কৌশিক ম্লান হাসে। এতক্ষণে ওর দিকে ফিরে বললে, একটা ব্যাপার তোমার কাছে গোপন করতে-

—কী ব্যাপার?

—তোমার জন্য একটা জিনিস কিনতে দার্জিলিঙ গিয়েছিলাম।

—জিনিস? কী জিনিস?

অন্যমনস্কের মতো পকেট থেকে একটা গহনার কেস বার করে কৌশিক টেবিলের ওপর রাখে। সুজাতা সেটা খুলে দেখে না। বলে, হঠাৎ গহনা কেন?

শূন্যের দিকে তাকিয়ে কৌশিক বলে, কাল তোমাকে উপহার দেব ভেবেছিলাম। কাল পাঁচই অক্টোবর।

উদাসীনের মতো সুজাতা বললে, ও হ্যাঁ। ভুলেই গেছিলাম।

হঠাৎ পর্দার বাইরে থেকে কে যেন বললে, ভিতরে আসতে পারি?

কৌশিক প্যাকেটটা আবার পকেটে ভরে নিয়ে বলে, আসুন-

ঘরে ঢোকে সুবীর। একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসতে বসতে বলে, ব্যাড লাক! ঘুম-অঞ্চলের সমস্ত টেলিফোন বিকল। দার্জিলিঙ থানার সঙ্গে যোগাযোগ করা গেল না।

—তাহলে?

—না, ব্যবস্থা একটা হয়েছে। ঘুম আউটপোস্ট থেকে একজন বিশেষ সংবাদবহ পাকদণ্ডী পথে আমার চিঠি নিয়ে এই বৃষ্টি মাথায় করেই দার্জিলিঙ চলে গেছে। আজ রাত্রের মধ্যেই সার্চ-ওয়ারেন্ট নিয়ে ও.সি. মিস্টার ঘোষাল হয়তো নিজেই এসে পড়বেন।

সুজাতা প্রশ্ন করে, আপনি কি কিছুই আন্দাজ করতে পারছেন না?

একটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে সুবীর বলে, এখনও ডেফিনিট হতে পারিনি। ইব্রাহিম যদি সহদেব স্বয়ং হয় তবে মিস্টার আলি অথবা ডক্টর সেনের মধ্যে একজনকে বেছে নিতে হবে। আর ইব্রাহিম-ডিক্রুজা যদি পার্টনার-ইন-ক্রাইম হয় তাহলে ডক্টর অ্যান্ড মিসেস্ সেন অথবা আলি-কাবেরী গ্রুপকে সন্দেহ করতে হয়। অজয়বাবু একটু রগচটা প্রকৃতির—কিন্তু তাঁকে সন্দেহ করার কোনো কারণ দেখছি না। আচ্ছা, ভাল কথা—বাসু-সাহেব আমাকে বলেছেন যে তিনি ইব্রাহিম আর ডিক্রুজাকে নিশ্চিতভাবে স্পট করেছেন। আপনাদের কিছু বলেছেন তিনি?

সুজাতা বলে, বাসু-সাহেব কখন কী ভাবছেন বোঝা মুশকিল; কিন্তু উনি আমার সাহায্যে একটা ছোট্ট তদন্ত করিয়েছিলেন—

—কী তদন্ত?

—কাবেরী দেবীর ঘরের অ্যাশট্রেটা আমাকে দিয়ে আনিয়ে উনি কী-যেন পরীক্ষা করেন।

হঠাৎ লাফ দিয়ে উঠে পড়ে সুবীর। একটানে পর্দাটা সরিয়ে দেয়। দেখা গেল পর্দার ও পাশে ডক্টর সেন্ দাঁড়িয়ে ছিলেন। থতমত খেয়ে ডক্টর সেন বলেন, ইয়ে, আজ আর থার্ড কাপ চা পাওয়া যাবে না, না মিসেস্ মিত্র?

ভ্রুকুঞ্চিত করে সুজাতা বললে, চা-য়ের সন্ধানে এখানে?

—না, মানে রান্নাঘরে আপনাকে দেখতে না পেয়ে

—আসুন।

—সুজাতা ডক্টর সেনকে নিয়ে নিচে নেমে গেল।

ও.সি. দার্জিলিঙের উপস্থিতি অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল অন্য একটি কারণে

: কাল রাত্রেই সুবীর জানতে চেয়েছিল কার কার কাছে আগ্নেয়াস্ত্র আছে। বাসু-সাহেব তৎক্ষণাৎ স্বীকার করেছিলেন। তাঁর কাছে আছে।

সুবীর প্রশ্ন করে, অরূপরতন যখন গুলিবিদ্ধ হয় তখন রিভলভারটা কোথায় ছিল?

—আমার ডান হাতে। আমি রিভলভারটা হাতে নিয়ে বসেছিলাম ঐ ইজিচেয়ারে। পশ্চিমমুখো–

ভ্রুকুঞ্চিত হয়েছিল সুবীরের। বলেছিল, কেন? রিভলভার হাতে বসেছিলেন কেন?

—একটা প্রিমনিশান হয়েছিল আমার। মনে হচ্ছিল এখনই এই মুহূর্তেই একটা দুর্ঘটনা ঘটবে। আমি সহদেবের প্রতীক্ষা করছিলাম।

বাসু একে একে সকলের দিকে তাকিয়ে দেখেন—আলি, অজয়, ডাক্তার সেন, কৌশিক—সকলেই পাথরের মূর্তি। সুবীর বললে, আপনার রিভলভারটা দেখি?

অম্লানবদনে বাসুসাহেব হস্তান্তরিত করলেন আগ্নেয়াস্ত্রটা। বললেন ওটা লোডেড। সুবীর সেটা শুঁকে দেখল। চেম্বারটা খুলে কী যেন দেখল। যন্ত্রটার নম্বর নোটবুকে টুকে নিয়ে ফেরত দিল সেটা। তারপর এদিকে ফিরে বললে, আর কার কাছে রিভলভার আছে?

কেউ জবাব দেয়নি।

—এ-ক্ষেত্রে বাধ্য হয়ে প্রত্যেকের মালপত্র আমাকে সার্চ করতে হবে।

প্রতিবাদ করেছিলেন অজয় চট্টোপাধ্যায়। বলেছিলেন, আগে থানা থেকে সার্চ ওয়ারেন্ট করিয়ে আনুন তারপর আমার বাক্স ঘাঁটবেন। তার আগে নয়।

—কেন? আমি তো প্রত্যেকের বাক্সই সার্চ করতে চাইছি। আর কেউ তো তাতে আপত্তি করছেন না। আপনি একাই বা কেন—

—করছি। আমারও আপত্তি আছে। —বলেছিল আলি।

বাসু-সাহেব বলেছিলেন—সার্চ ওয়ারেন্ট ছাড়া তুমি হোটেল তল্লাশি করতে পার না। গুম মেরে গিয়েছিল সুবীর। আলি হেসে বলেছিল, অর্থাৎ অবজেকশান সাসটেইন্ড। তাই সকালে উঠেই সুবীর চলে গিয়েছিল ঘুম-আউটপোস্ট-এ। সেখানে গিয়ে জানতে পারে ঘুম অঞ্চলের সমস্ত টেলিফোন বিকল। বাধ্য হয়ে সে নাকি দার্জিলিঙে স্পেশাল মেসেঞ্জার পাঠিয়েছে। রাত্রের মধ্যেই ও.সি. দার্জিলিঙে এসে যাবেন। সার্চ ওয়ারেন্ট আসবে। আর হয়তো আসবে কাঞ্চনজঙ্ঘা হোটেলের রুম সার্ভিসের বেয়ারা বীর-বাহাদুর। যে রিপোস-এর আবাসিকদের দর্শনমাত্র বলে দিতে পারে মহম্মদ ইব্রাহিম বেয়ারা বীর-বাহাদুর। যে রিপোস-এর আবাসিকদের দর্শনমাত্র বলে দিতে পারে মহম্মদ অথবা ডিব্ৰুজা এখানে আছে কি না।

সন্ধ্যাবেলায় সুবীর রায়ের আহ্বানে সকলে সমবেত হলেন ড্রয়িংরুমে। সুবীর নাকি সকলকে সম্বোধন করে কিছু জানতে চায়। সবাই এসে গুটিগুটি বসেছে ড্রয়িংরুমে।

দিনের আলো নিবে গেছে। গোটা তিনচার মোমবাতি জ্বলছে ঘরের এ-প্রান্তে ও-প্রান্তে। এলোমেলো হাওয়ায় মোমবাতির শিখা কাঁপছে। সেইসঙ্গে কাঁপছে আতঙ্কতাড়িত আবাসিকদের অতিকায় ছায়া-মিছিল।

গলাটা সাফা করে নিয়ে সুবীর বললে, অপ্রিয় সত্যটা অস্বীকার করে লাভ নেই—আমাদের মধ্যেই একজন আছেন যিনি মিস্টার মহাপাত্রের দুর্ঘটনার জন্য দায়ী। রমেনবাবুর মৃত্যুর সঙ্গে তাঁকে যুক্ত করা যায় কি না সে কথা ঠিক এখনই বলা যাচ্ছে না; কিন্তু অরূপ মহাপাত্রকে যে লোকটা পিছন থেকে গুলিবিদ্ধ করে সে এখন বসে আছে এই ঘরেই। আমাদের মধ্যে আত্মগোপন করে। এ যুক্তিতে আপত্তি আছে কারও?

কেউ কোনো জবাব দেয় না।

সুবীর পুনরায় বলে, আপনারা এ যুক্তি মেনে নিলেন। এবার আরও স্পেসিফিক্যালি বলি : আমরা দশ-বারো জন আছি, তার মধ্যে মিসেস বাসুকে আমরা বাদ দিতে পারি। কারণ তাঁর অ্যালেবাই অকাট্য। তিনি নিজের ঘরে বসে গান গাইছিলেন—সে গান আমরা সবাই শুনেছি, গুলির শব্দের পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত। দ্বিতীয়ত—ওয়েল, আর যুক্তির প্রয়োজন নেই,—মিসেস বাসু অনারেবলি অ্যাকুইটেড। এগ্রিড?

এবারও কেউ কোনো সাড়া দিল না।

—তাহলে বাকি রইলাম আমরা ন-জন। আসুন, এবার আমরা বিচার করে দেখি। এই নয়জন ঘটনার মুহূর্তে কে কোথায় ছিলেন। কারও কোনো অ্যালেবাই আছে কিনা। একে একে আপনারা বলুন-

—নয়জন বলতে? প্রশ্ন করেন অজয়বাবু

—মিস্টার কৌশিক মিত্র, মিসেস মিত্র, ডক্টর অ্যান্ড মিসেস সেন, মিস্টার অজয় চ্যাটার্জি, কাবেরী দেবী, মিস্টার আলি, মিস্টার বাসু এবং কালীপদ।

—অ্যান্ড হোয়াই নট মিস্টার সুবীর রয়?—প্রশ্নটা অজয় চাটুজ্জের।

—আলি উৎফুল্ল হয়ে বলে, পার্টিনেন্ট কোশ্চেন। হিন্দু-দর্শনে ‘দশমস্তমসি’ বলে একটা কথা আছে না?

সুবীর হেসে বলে, আছে। আমরা দশজন। আমিই বা বাদ যাই কেন অঙ্কের হিসাব থেকে? তাহলে আমিই আগে কৈফিয়তটা দিই : আমি ছিলাম বাথরুমে। হট বাথ নিচ্ছিলাম। গান আমি শুনতে পাইনি, তবে গুলির শব্দটা শুনেছি। জামাকাপড় পরে বের হয়ে আসতে আমার মিনিট দুই দেরি হয়েছিল। আমিই বোধহয় সবার শেষে ড্রয়িংরুমে এসে পৌঁছই। এবার আপনারা সবাই বলুন। কৌশিকবাবু।

—আমি ছিলাম ছাদে। গান শুরু হতেই শুনতে পেয়েছিলাম। আমি তখন নেমে আসি।

—ছাদে! ছাদ তো ঢালু ছাদ-সুবীর প্রশ্ন করে।

—না, ঠিক ছাদে নয়, মই বেয়ে উঠে আমি রেনওয়াটার পাইপটা বন্ধ হয়ে গেছে কি না দেখছিলাম। দোতলায় নেমে এসে দেখি–দক্ষিণ বারান্দার ও-প্রান্তে একজন মহিলা অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছেন জানি না—তিনি কাবেরী দেবী অথবা মিসেস সেন। সুজাতা নয়, কারণ আমি তাকে মিট করি একতলায়, কিচেন-ব্লকের সামনে-

ওর বক্তব্যের সূত্র ধরে কাবেরী বলে ওঠে, ওখানে আমিই দাঁড়িয়েছিলাম। গান শুনছিলাম। আমি কৌশিকবাবুকে নেমে আসতে দেখেছিলাম। কৌশিকবাবুই কি না হলপ করে বলতে পারব না। কারণ আলো ছিল খুব কম। একজন পুরুষ মানুষকে বর্ষাতি গায়ে এবং টর্চ হাতে দেখেছিলাম মাত্র।

ডক্টর সেন বলেন, অর্থাৎ আপনারা দুজন দুজনের অ্যালেবাই। কেমন?

আলি বলে ওঠেন, ব্যারিস্টার-সাহেব কী বলেন? ওঁরা তো কেউ কাউকে চিনতে পারেনি। ইনি দেখেন নারী মূর্তি, উনি দেখেছেন পুরুষ মূর্তি! তাতে কী প্রমাণ হয়? বাধা দিয়ে সুবীর বলে, সে বিশ্লেষণ থাক। আপনি তখন কোথায় ছিলেন?

—নিজের ঘরে। একটা ডিকেটটিভ গল্প পড়ছিলাম। আগাথা ক্রিস্টির ‘মাউসট্র্যাপ’।

—অর্থাৎ আপনার কোনো অ্যালেবাই নেই?

—আগাথা ক্রিস্টি আমার অ্যালেবাই!

অজয় চট্টোপাধ্যায় চটে উঠে বলেন, এই কি আপনার রসিকতা করবার সময়?

—কেন নয়? আমরা তো এসেছি বেড়াতে, ফুর্তি করতে, পাহাড় দেখতে, তাই নয়? সুবীর অজয়বাবুকে প্রশ্ন করে, আপনি কোথায় ছিলেন?

—কে আমি?—সচকিত হয়ে ওঠেন অজয় চাটুজ্জে। তারপর সামলে নিয়ে বলেন, আমি ইয়ে, আহ্নিক করছিলাম।

—আহ্নিক! মানে?—প্রশ্ন করে সুবীর রায়।

আবার চটে ওঠেন অজয়বাবু : আপনি হিন্দুর ছেলে, তাই আহ্নিক বোঝেন না। আলি-সাহেবকে জিজ্ঞাসা করবেন, উনি বুঝিয়ে দেবেন সন্ধ্যাহ্নিক বলতে কী বোঝায়! সুবীর এ বক্রোক্তি গলাধঃকরণ করে ডাক্তার সেনকে বলে, আপনি কী বলেন?

—ঐ সন্ধ্যাহ্নিক বিষয়ে?—জানতে চান ডক্টর সেন।

ধমক দিয়ে ওঠে সুবীর, আজ্ঞে না। আপনারা দুজন তখন কোথায় ছিলেন?

—তাস খেলছিলাম। উনি আর আমি। আমরা দুজন দুজনের অ্যালেবাই।

আলি হেসে ওঠে : অবজেকশান ইয়োর অনার! স্বামী-স্ত্রী দুজনেই সাপেক্‌টেড। এক্ষেত্রে কি ওঁরা পরস্পরের অ্যালেবাই হতে পারেন?

মিসেস্ সেন চীৎকার করে ওঠেন, সাপেডে মানে? হাউ ডেয়ার য়ু—

সুবীর তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বলে, ব্যারিস্টার-সাহেব কাউকে কিছু প্রশ্ন করবেন? বাসু-সাহেব বলেন, হ্যাঁ করব। তোমাকেই করব। আজ রাত্রে কি নৃপেন এখানে এসে পৌঁছতে পারবে?

—তাই তো আশা করছি।

—কাঞ্চনজঙ্ঘা হোটেলের বেহারা বীর বাহাদুরও কি আসবে?

—হ্যাঁ, আসবে। আমাদের মধ্যে ইব্রাহিম অথবা মিস্ ডিক্রুজা আছে কি না সেটা আজ রাত্রেই জানা যাবে।—বলেই সুবীর একে একে সকলের দিকে তাকায়। এ ঘোষণায় শ্রোতৃবৃন্দের কার মুখে কী অভিব্যক্তি হচ্ছে জেনে নিতে চায়! তারপর সে আবার বলে, আপনাদের সকলের সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ। এবার আমার একটি প্রস্তাব আছে। আমি একটা পরীক্ষা করতে চাই। আশা করি সকলের সহযোগিতা পাব।

—কী জাতের পরীক্ষা?—জানতে চান অজয়বাবু।

জবাবে সুবীর বলে, একটা কথা তো মানবেন না, আমাদের মধ্যে অন্তত একজন মিথ্যা কথা বলেছেন! ঘটনার মুহূর্তে তিনি বাস্তবে ছিলেন অরূপবাবুর পিছনে! তিনি কে, তা আমরা জানি না—কিন্তু জানতে চাই। তাই আমার প্রস্তাব—আজ রাত ঠিক সাড়ে আটটায় আমরা প্রত্যেকে গতকালকার পজিশানে ফিরে যাব। ড্রয়িংরুমের ঘড়িতে সাড়ে আটটার শব্দ হতেই রানি দেবী তাঁর ঘরে বসে ঐ গানটাই গাইবেন। আমরা এইমাত্র আমাদের জবানবন্দিতে যে কথা বলেছি ঠিক তাই তাই করে যাব আটটা তেত্রিশ পর্যন্ত! ঠিক আটটা তেত্রিশে আমি ড্রয়িংরুমে একটা ব্ল্যাঙ্ক ফায়ার করব। আপনারা গতকালকের মতো সবাই ছুটে আসবেন ড্রয়িংরুমে।

অজয়বাবু বলেন, তাতে কোন চতুর্বর্গলাভ হবে?

—যারা সত্য কথা বলেছে, তারা গতকালকার আচরণ অনুযায়ী আজকেও কাজ করে যেতে পারবে। কিন্তু যে মিথ্যা কথা বলেছে তার ব্যাপারটা গুলিয়ে যাবেই। সে এমন একটা কিছু করে বসবে যাতে সে ধরা পড়ে যাবে। এটা ক্রাইম ডিটেকশানের একটি সাম্প্রতিক পদ্ধতি। অনেক সময়েই এতে সুফল পাওয়া গেছে। না কি বলেন, বাসু-সাহেব?

বাসু-সাহেব বলেন, হতে পারে। আমি ব্যাক-ডেটেড। আমি এ পদ্ধতির কথা শুনিনি।

আলি বলে ওঠে, আমি শুনেছি মিস্টার রায়, আগাথা ক্রিস্টির ‘মাউসট্র্যাপে’ ঠিক ঐ ধরনের একটা পরীক্ষার কথা আছে—

অজয়বাবু বলেন, দূর মশাই। তাই কি হয় নাকি? কাল যদি আমিই গুলি করে থাকি, তাহলে আজ কি আর সারা বাড়ি দাপাদাপি করে বেড়াবো? আজ তো গ্যাটসে নিজের ঘরে বসে সীতারাম জপ করব

সুবীর বলে, তাই করবেন। তাহলে তো আপনার আপত্তি নেই?

কাবেরী বলে, তবু একটা তফাত হবে কিন্তু মিস্টার রায়। আজ আর গানের সঙ্গে পিয়ানো বাজবে না।

—বাজবে!—সুবীর ওকে আশ্বস্ত করে।

—বাজবে?—কেমন করে? কে বাজাবে আজ?

—আমি বাজাব! আমার ঘরে জলের কলটা খোলা থাকবে; কিন্তু আমি বাথরুমে থাকব না। আমি আজ অভিনয় করব অরূপরতনের চরিত্রটা। অর্থাৎ গান অন্তরায় পৌঁছলে আমি পিয়ানো বাজাতে শুরু করব। আপনি, রানি দেবী, গত কালকের মতই এক লাইন আমাকে ‘সোলো’ বাজাতে দেবেন। তারপর মিউজিকে যোগ দেবেন। কেমন?

আলি বললে, আপনি পিয়ানো বাজাতে জানেন?

—জানি।

—অত ভাল?

—রাত সাড়ে আটটায় এ প্রশ্নের জবাব পাবেন!

আলি বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে বলে, বুঝেছি, মহাভারতে আছে আত্মশ্লাঘা আত্মহত্যার নামান্তর!

মিসেস সেন বলেন, আপনি কথায় কথায় মহাভারত পাড়েন কেন বলুন তো?

—মহাভারত আর রামায়ণ হচ্ছে আমার প্রিয় গ্রন্থ। আর বিভীষণ হচ্ছে আমার হীরো! মন্দোদরী বিভীষণকে নিকা করেছিল কিনা ঠিক জানি না। সুজাতা দেবী বলতে পারবেন!

আলোচনা প্রসঙ্গান্তরে যাচ্ছে দেখে সুবীর বলে ওঠে, থ্যাঙ্ক ইউ অল। রাত আটটা হয়েছে। এবার তাহলে আমরা সবাই প্রস্তুত হই।

ডক্টর সেন গম্ভীর হয়ে ঘাড় নাড়লেন

—কিন্তু একটা কথা!—সতর্ক করে দেয় সুবীর—কোনো কারণেই আজ ঐ তিন মিনিটের জন্য আপনারা অন্য রকম আচরণ করবেন না। ঠিক কাল যা করেছেন, তাই করবেন। অন্যরকম আচরণ করতে বাধ্য হবে অবশ্য ক্রিমিনাল নিজে!

মিসেস সেন হঠাৎ হাততালি দিয়ে ওঠেন : গ্র্যান্ড আইডিয়া। খেলাটা জমবে! ঠিক পার্টিতে যেমন হয়।

সবাই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে।

.

রাত আটটা পঁচিশ।

বাসু-সাহেব রিভলবারটা নিয়ে উত্তরের বারান্দায় চলে গেলেন। বসলেন গিয়ে ইজিচেয়ারে। অরূপ অঘোরে ঘুমাচ্ছে। রানি দেবী তাঁর হুইল চেয়ারে বসে আছেন জানলার দিকে মুখ করে—উৎকর্ণ হয়ে আছেন, কখন ঢং করে বেজে উঠবে হলঘরের দেওয়াল ঘড়িটা।

কৌশিক টর্চ নিয়ে মই বেয়ে ছাদে উঠে গেল। আলি-সাহেব পড়া বইয়ের শেষ কটা পাতা আবার পড়তে বসেছেন। কাবেরী উৎকর্ণ হয়ে বসে আছে তার বিছানায়—কখন শুরু হয় গান। সুজাতা রান্নাঘরে। ডক্টর সেন বললেন, কাল ঠিক সাড়ে আটটার সময় তুমি ডিল করছিলে, তাসটা ধর।

অজয় চাটুজ্জে আহ্নিকে বসেছেন। অন্তত আজকের রাতে।

আটটা আঠাশ। সুবীর রায়ের রাথরুমে কলের জল পড়তে শুরু করল।

.

দু-নম্বর ঘর।

রানি দেবী নিজের মণিবন্ধে ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখলেন : আটটা উনত্রিশ। খুট করে শব্দ হল পিছনে। রানি হুইল চেয়ারটা ঘুরিয়ে অবাক হয়ে গেলেন। ওঁর থেকে হাত তিনেক দূরে দাঁড়িয়ে আছে সুবীর রায়

—কী ব্যাপার? আপনি?

—আপনাকে আর গান গাইতে হবে না মিসেস বাসু!

—হবে না! সেকি? বাড়িসুদ্ধ সবাই যে আমার গান শুনতে—

—আপনার গান নয়, ওঁরা উদগ্রীব হয়ে আছেন সত্যিকারের রানি দেবীর গান শুনতে।

—মানে?

—মানে এ সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। সহদেব হুই কে তা জানা গেছে!

—আপনি জানেন!

—জানি! আপনিও এখনই জানবেন—

.

দো-তলায় সাত নম্বর ঘর।

কাবেরী বসেছিল খাটে। শুনল শুরু হয়ে গেল :

“যদি জানতেম আমার কিসের ব্যথা তোমায় জানাতেম।”

এক লাইন গান হতেই ঢং করে সাড়ে আটটা বাজল। রানি দেবী কয়েক সেকেন্ড আগেই শুরু করেছেন তাহলে। শুরু হতেই বেজে উঠল পিয়ানো। কালকের মতই রানি দেবী চুপ করে গেলেন। এক লাইন শুধু পিয়ানো বেজে গেল। তারপর শুরু হল যৌথ সঙ্গীত। কণ্ঠসঙ্গীত আর যন্ত্রসঙ্গীত। কাবেরী খাট থেকে নামল, ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল বারান্দায়। ঠিক কালকের মতো রেলিঙে ভর দিয়ে দাঁড়াল। গান তখন পৌঁছেছে সঞ্চারীতে :

“এই বেদনার ধন সে কোথায় ভাবি জনম ধরে,
ভুবন ভরে আছে যেন, পাইনে জীবন ভরে।”

হঠাৎ সচকিত হয়ে কাবেরী লক্ষ্য করে বিদ্যুৎগতিতে মই বেয়ে নেমে আসছে কৌশিক। দ্বিতলে সে মুহূর্তের জন্যও দাঁড়াল না, কালকের মতো। যেন তাকে পিছন থেকে তাড়া করেছে উদ্যত-পিস্তল এক খুনি আসামি। প্রাণপণে সে ছুটে নেমে গেল এতলায়। কী ব্যাপার! কৌশিক তো নিয়ম মানছে না। গতকালকার আচরণের পুনরাভিনয় তো সে করল না! চকিতে কাবেরীর মনে হল তবে কী কৌশিক—

কৌশিকের দোষ নেই। বেচারি নির্দেশমত মই বেয়ে ছাদে উঠে গিয়েছিল ঠিকই! কিন্তু গান শুরু হতেই ওর কেমন যেন সব গুলিয়ে গেল। ওর মনে হল ইব্রাহিমের পরিত্যক্ত সেই ‘এক : দুই : তিন’ লেখা কাগজখানার কথা। ওর মনে হল—আততায়ী কাল যে সুযোগ পেয়েছিল ঠিক সেই সুযোগ ওরা যৌথভাবে তাকে পাইয়ে দিচ্ছে! হুবহু এক পরিবেশ! খুনিটা কি এই সুযোগ নেবে না? যদি নেয়? কে তার তিন নম্বর টার্গেট?

ভেসে আসছে অস্ফুট সঙ্গীত :

“কোথায় যে হাত বাড়াই মিছে ফিরি আমি কাহার পিছে
সব কিছু মোর বিকিয়েছে, পাইনি তাহার দাম।”

কৌশিকের মনে হল এই মুহূর্তেই বুঝি তার সব কিছু বিকিয়ে যেতে বসেছে! হয়তো এতক্ষণে খুনিটা কিচেন-ব্লকে ঢুকে—!

সব কিছু ভুল হয়ে গেল কৌশিকের। সে বিদ্যুৎবেগে নেমে এল একতলায়!

.

আবার ঐ দু-নম্বর ঘর। রানি দেবী আর সুবীর রায়। মুখোমুখি। রানি রীতিমত আতঙ্কতাড়িত। বলছে, এসব কী বলছেন আপনি! আমি… আমি কী দোষ করলাম?

নেপথ্যে তখন শোনা যাচ্ছে গান এবং যন্ত্রসঙ্গীত।

সুবীর বললে, দোষ করেছেন ব্যারিস্টার পি. কে. বাসু! প্রায়শ্চিত্ত করবেন তাঁর স্ত্রী! আপনি!

পকেট থেকে একটা রিভলভার বার করল সুবীর।

রানি আর্তনাদ করতে গেলেন। স্বর ফুটল না তাঁর কণ্ঠে।

.

কিচেন-ব্লকটা অন্ধকার। মোমবাতি নিবে গেছে ঝোড়ো হাওয়ায়। কৌশিক টর্চ জ্বেলে চারিদিক দেখল। সুজাতা কোথাও নেই। অস্ফুটে একবার ডাকল, ‘সুজাতা!’

কেউ সাড়া দিল না।

কৌশিক ঘুরে দাঁড়ায়। ছুটে বেরিয়ে আসে দক্ষিণের বারান্দায়। পর্দা সরিয়ে ঢুকে পড়ে ডায়িনিংরুমে। সেখানেও কেউ নেই—কিন্তু ও কী! পিয়ানোর টুলে তো সুবীর রায় বসে নেই। অথচ কী আশ্চর্য! গান হচ্ছে! পিয়ানো বাজছে! যন্ত্রসঙ্গীত আর কণ্ঠসঙ্গীত যৌথভাবে ফিরে এসেছে স্থায়ীতে :

“যদি জানতেম আমার কিসেরি ব্যথা—”

হঠাৎ কে যেন স্পর্শ করল ওর বাহুমূল। চমকে উঠল কৌশিক। দেখে সুজাতা। ঠোঁটে আঙুল ছুঁইয়ে সুজাতা ওর বাহুমূল ধরে আকর্ষণ করছে! কৌশিক ওকে অনুসরণ করে এগিয়ে আসে। চার-নম্বর ঘরের পর্দা সরিয়ে সুজাতা প্রবেশ করল সুবীর রায়ের ঘরে। কৌশিক তার পিছন পিছন। ঘর নীরন্ধ্র অন্ধকার—কিন্তু সেই ঘরই হচ্ছে সঙ্গীতের উৎস। টর্চ জ্বালল সুজাতা :

টেবিলের উপর একটা ব্যাটারি-সেট টেপ-রেকর্ডার চক্রাবর্তনের পথে গাইছে : “–তোমায় জানাতেম!
কে যে আমায় কাঁদায় আমি কি জানি তার নাম।।”

—কী?

—বাসু-সাহেব অথবা রানি দেবী!

ওরা ছুটে বেরিয়ে আসতে চায়। ঠিক তখনই হল একটা ফায়ারিঙের শব্দ! ঠিক পাশের ঘর থেকে। কৌশিক দাঁড়িয়ে পড়ে। গুলিটা যেন তারই পাঁজরে বিঁধেছে।

সুজাতা শুধু বললে, সব শেষ হয়ে গেল!

গুলির শব্দ শুনে সকলেই নেমে এসেছে। ডক্টর আর মিসেস সেন, কাবেরী, আলি আর অজয়বাবু প্রায় একই সঙ্গে প্রবেশ করলেন ডাইনিং রুম পার হয়ে ড্রয়িংরুমে। আলি টর্চ জ্বাললেন। আশ্চর্য! পিয়ানোর টুলে কেউ নেই। ভূতলেও নেই!

ঠিক তখনই চার-নম্বর ঘর থেকে ছুটে বের হয়ে এল কৌশিক আর সুজাতা। কৌশিক বললে, কুইক! আসুন আপনারা

ওরা হুড়মুড়িয়ে বার হয়ে এল উত্তরের বারান্দায়। টর্চের আলো পড়ল বাসু-সাহেবের চিহ্নিত ইজিচেয়ারে। সেটা ফাঁকা। এবার ওরা সদলবলে ঢুকে পড়ে বাসু-সাহেবের ঘরে।

ভাগ্যক্রমে ঠিক তখনই লাইট কানেকশানটা ফিরে এল। আলোয় ঝলমলিয়ে উঠল ‘দ্য রিপোস’।

অরূপরতন শুয়েছিল বাসু-সাহেবের খাটে। বালিশে ভর দিয়ে মাথাটা তুলেছে সে। দু-হাতে মুখ ঢেকে রানি দেবী নিথর হয়ে বসে আছেন তাঁর চাকা দেওয়া চেয়ারে! ড্রেসিং রুমের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন তাঁর চাকা দেওয়া চেয়ারে! ড্রেসিং রুমের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন ব্যারিস্টার পি. কে. বাসু। তাঁর হাতে উদ্যত রিভলভার।

আর মেজেতে লোটাচ্ছে সুবীর রায়। রক্তে ভেসে যাচ্ছে সে।

হঠাৎ হুমড়ি খেয়ে পড়েন ডাক্তার সেন। পরমুহূর্তেই মুখ তুলে বলেন, থ্যাঙ্ক গড!

গুলিটা পেলভিক বোনে লেগেছে। ফেটাল নয়!

গতকালকার উক্তির সজ্ঞান অভিনয় নয়। অরিজিনাল ডায়ালগ!

সুবীরের জ্ঞান ছিল। যন্ত্রণায় সে কাতরাচ্ছে।

কৌশিক সবিস্ময়ে বাসু-সাহেবকে বলে, কী ব্যাপার?

বাসু-সাহেব গম্ভীরমুখে বলেন, আস্ক সহদেব!

—সহদেব! মানে?

রিভলভারটা দিয়ে ভূলুণ্ঠিত সুবীর রায়কে নির্দেশ করে বাসু বলেন, সহদেব হুই! আর্চ-গ্যাংস্টার, বাফেলো, ‘মারিকা’!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *