সোনার কাঁটা – ৬

বেলা প্রায় এগারোটা। নিজের ঘরে বসে কাবেরী তন্ময় হয়ে একখানা ছবি দেখছিল, ওরই ছবি। সিপিয়া রঙে ক্রেয়নে আঁকা। সদ্য সমাপ্ত। হঠাৎ দ্বারের কাছে প্রশ্ন হল, ভিতরে আসতে পারি?

সচকিত হয়ে কাবেরী লক্ষ্য করে দ্বারপথে দাঁড়িয়ে আছেন চার-নম্বরের সুদর্শন ভদ্রলোক।

—আসুন, আসুন। কী ব্যাপার?

—কৌতূহলটা দমন করতে পারলাম না। ছবিটা দেখতে পারি?

—দেখুন না! আপত্তি কিসের—ছবিখানা বাড়িয়ে ধরে কাবেরী।

সুবীর জমিয়ে বসে একখানা চেয়ারে। সমঝদারের মতো ওর ছবিখানা দেখতে থাকে—কাছে ধরে, দূরে ধরে। দু-একবার কাবেরীর দিকেও তাকায়। তারপর বলে, ছবিটা সুন্দর, তবে অরিজিনালের মতো সুন্দর নয়।

কাবেরী একটু রাঙিয়ে ওঠে। কথা ঘোরাবার জন্য বলে, আপনার পরিচয়টা কিন্তু আমি জানি না। আপনি তো আছেন ঐ চার নম্বরে?

—হ্যাঁ। আমার নাম সুবীর রায়। আরে, আপনার সুটকেসটা তো চমৎকার!

—ওপাশে রাখা সাদা রঙের সুটকেসটা লক্ষ্য করে সে। বলে, এগুলোকেই ভি.আই.পি. সুটকেস বলে, তাই নয়?

কাবেরী বলে, শখ করে কিনেছি। যদিও আমি ভি.আই.পি. মোটে নই।

—বেড়াতে এসেছেন বুঝি দার্জিলিঙে?—প্রশ্ন করে সুবীর সিগ্রেট ধরাতে ধরাতে।

—হ্যাঁ। ছুটিতে—

—অত সকালে কোথা থেকে এলেন?

ভ্রু-কুঞ্চিত হল কাবেরীর। বললে, আপনি তো এলেন মধ্যরাত্রে—আমি কখন এসেছি তা জানলেন কেমন করে?

সুবীর মামুলী গলায় বললে, সুজাতা দেবী বলছিলেন আপনি নাকি সেই কাক-ডাকা ভোরে এলেন।

কাবেরীও মামুলি গলায় জবাব দিল, কাক-ডাকা ভোরই বটে। আমি পরশু রাত্রে কার্শিয়াঙে হল্ট করেছিলাম। রাত ভোর হতেই এখানে চলে এসেছি।

—কার্শিয়াঙে কোথায় ছিলেন? হোটেলে?

আবার সচকিত হয়ে ওঠে কাবেরী। বলে, কেন বলুন তো?

—না, আমার ফেরার পথে কার্শিয়াঙে দু-দিন থাকব ভাবছি। তাই জানতে চাইছি কোন হোটেলে ছিলেন, তাদের ব্যবস্থা কেমন-

কাবেরী কৃত্রিম হাসিতে ভেঙে পড়ে। বলে, যদি কোনো হোটেল ছেড়ে রাত থাকতে বোর্ডার পালিয়ে বাঁচে সেটায় থাকবার কথা ভাবছেন ফেরার পথে?

সুবীর বললে, তাহলে ধরে নিন ভুল করে সেটাতে উঠে যাতে নাকাল না হতে হয় তাই নামটা জানতে চাইছি। কার্শিয়াঙে কোন হোটেলে ছিলেন?

কাবেরী আবার প্রশ্নটা এড়িয়ে বলে, আপনি যে পুলিশের মতো জেরা করছেন!

—তাই করছি, কারণ পুলিশ বিভাগেই কাজ করি আমি। ক্রিমিনাল ইন্টেলিজেন্সে। এসেছি একটা খুনের তদন্তে। সেই প্রসঙ্গেই আমি জানতে চাইছি—পয়লা অক্টোবর রাত্রে আপনি কোথায় ছিলেন? রাত দশটার পর থেকে বাকি রাত।

পকেট থেকে একটি নোটবুক বার করে বলে, এবার বলুন–

কাবেরীর মুখটা সাদা হয়ে যায়। ঠোঁট দুটো নড়ে ওঠে, কিন্তু কথা কিছু বলে না। ঠিক সেই মুহূর্তেই বিনা-নোটিসে ঘরে ঢুকে পড়লেন অজয় চাটুজ্জে। সরাসরি কাবেরীকে বললেন, ও ক্রেয়নে ঠিক এফেক্টটা আসেনি, বুঝলে! আমি অয়েলে আর একখানা আঁকতে চাই। তোমার সময় হবে এখন?

কাবেরী তৎক্ষণাৎ সামলে নেয় নিজেকে। বলে, সময় হবে না? কী বলছেন? নিশ্চয় হবে। এখনই বসবেন? চলুন—

এতক্ষণে অজয়বাবু সুবীরকে নজর করেন; বলেন, এঁকে তো ঠিক, মানে—

কাবেরী প্রথম সুযোগেই সুবীরের ট্রাম্প-কার্ডখানা খুলে দেখায়। বলে, উনি ক্রিমিনাল ইন্টেলিজেন্স বিভাগের একজন অফিসার, মিস্টার সুবীর রায়। এসেছেন একটা খুনের তদন্তে।

সুবীর ক্রুদ্ধ আক্রোশে কাবেরীর দিকে তাকায়

চোখ থেকে চশমাটা খুলে কাচটা মুছতে মুছতে অজয়বাবু বলেন—অ!

—বসুন অজয়বাবু। আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করার আছে আমার।

অজয় বসেন না। চশমাটা নাকে চড়িয়ে বলেন, কাঞ্চনজঙ্ঘা হোটেলের সেই দারোগার মৃত্যু সংক্রান্ত প্রশ্ন নিশ্চয়?

—হ্যাঁ, তাই। আপনি তো ঐ হোটেলেই ছিলেন?

—এস কাবেরী—অজয় প্রস্থানোদ্যত।

—আপনি আমার প্রশ্নের জবাব দেবেন না?

—দেব! যখন কোর্টের সমন পাব, সাক্ষীর কাঠগড়ায় উঠে দাঁড়াব, তখন দেব! উঃ হরিবল, এস কাবেরী।

কাবেরীর হাতটা ধরে অসঙ্কোচে টানতে টানতে নিয়ে চলেন অজয় চাটুজ্জে। পিছন থেকে সুবীর বলে, কাজটা কিন্তু ভাল করলেন না। কোর্টের সমন ছাড়াও পুলিস অফিসারের প্রশ্নের জবাব দিতে হয়—

—হয়, জানি। কিন্তু তার একটা স্থান-কাল-পাত্র আছে! পথে-ঘাটে প্রথম সাক্ষাতেই অমন মোড়লি করার কোনো অধিকার পুলিসের নেই! বুঝেছেন!—ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন উনি।

.

বেলা সওয়া এগারোটা।

সুবীর এসে উপস্থিত হল আলি-সাহেবের ঘরে। দরজায় নক করে বললে, আসতে পারি?

আগাথা ক্রিস্টিকে বালিশের উপর উবুড় করে রেখে আলি বললে স্বচ্ছন্দে! ইন ফ্যাক্ট আপনার সঙ্গে আলাপ করতে যাব ভাবছিলাম। আমার নাম এন. আলি।

সুবীর বললে, আমার নাম সুবীর রায়। ক্রিমিনাল ইন্টেলিজেন্সে আছি। এসেছি একটা খুনের তদন্তে। ভেবেছিল প্রতিপক্ষ হকচকিয়ে যাবে। তা কিন্তু গেল না আলি। হেসে বললে, তাস খেলেন?

—কেন বলুন তো?—ভ্রুকুঞ্চিত সুবীরের প্রশ্ন।

—প্রথম ডিলেই রঙের টেক্কা পেড়ে লিড দিচ্ছেন তো, তাই বলছি!

—মানে?

—আগাথা ক্রিস্টি পড়ছিলাম কিনা—গোয়েন্দা গল্পে দেখেছি ডিটেকটিভরা সহজে আত্মপরিচয় দেয় না ওভাবে।

—সকলের পদ্ধতি এক নয়। আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করতে পারি?

—এ বিনয়ও ডিটেকটিভ-সুলভ নয়। নিশ্চয় করতে পারেন। করুন। আমি প্রস্তুত। -আপনি তো এখানে এসেছেন পয়লা তারিখ রাত সওয়া নয়টায়। কোথা থেকে এলেন?

—দার্জিলিঙ থেকে।

—দার্জিলিঙে কবে এসেছিলেন?

—ঐ পয়লা তারিখ বেলা বারোটায়। একটা শেয়ারের ট্যাক্সিতে চেপে।

—ঐ ট্যাক্সিতে একজন পুলিস অফিসার আর একজন ভদ্রমহিলাও এসেছিলেন?

—না। কোনো পুলিস অফিসার বা মহিলা ছিলেন না আমার সঙ্গে।

—কোন হোটেলে উঠেছিলেন আপনি?

হোটেল কুণ্ডুজ। স্বনামেই উঠেছিলাম—হোটেল রেজিস্টার হাতড়ে দেখতে পারেন সত্য কি না।

—কিন্তু এমনও হতে পারে—স্বনামে হোটেল কুণ্ডুজ-এ ঘর বুক করে আপনি বেনামে অন্য কোনও হোটেলে উঠেছিলেন?

আলি হেসে ফেলে। বলে, যেমন ধরা যাক মহম্মদ ইব্রাহিম এই ছদ্মনামে হোটেল কাঞ্চনজঙ্ঘায়।

—আপনি ভুলে যাচ্ছেন—মহম্মদ ইব্রাহিম হোটেলে ছিল মাত্র কয়েক মিনিট। চেক-ইন করেই সে বেরিয়ে যায়। ফিরে আসে রাত সাতটায় এবং এক ঘণ্টার মধ্যেই চেক-আউট করে বেরিয়ে যায়। রাত আটটায় দার্জিলিঙ থেকে রওনা হলে রাত ন’টার মধ্যে তার পক্ষে রিপোস-এ এসে পৌঁছনো সম্ভব!

আলি পাইপ ধরাল। বললে, তাইতো হিসাবে দাঁড়াচ্ছে। এক্ষেত্রে আপনি একটিমাত্র কাজ করতে পারেন। কাঞ্চনজঙ্ঘা হোটেলের রুম-সার্ভিসের বেয়ারা বীর বাহাদুরকে এখানে নিয়ে আসুন। সে শনাক্ত করে যাক–ইব্রাহিম বা মিস ডিক্রুজা এখানে আছে কি না!

সুবীর বলে, বীর বাহাদুর! ও নাম আপনি জানলেন কেমন করে?

—এখানেই কারও কাছে শুনেছি বোধহয়! হোটেল রিপোসে তো দিবারাত্র এই গল্পই হচ্ছে। আসুন—

একটি সিগ্রেট সে বাড়িয়ে ধরে সুবীরের দিকে। পাইপখোর তাহলে সৌজন্যের খাতিরেও সিগ্রেট রাখে!

মোট কথা আলি-সাহেব বিন্দুমাত্র নার্ভাস হন না।

সাড়ে এগারোটায় সুবীর এসে হানা দিল ডক্টর সেনের ঘরে। সেখানেও বিশেষ কিছু সুবিধা হল না। কিন্তু একটা খটকা লাগে সুবীরের। ডক্টর সেনকে অফার করা সিগ্রেটের প্যাকেট থেকে মিসেস সেন অম্লানবদনে একটি সিগ্রেট নিয়ে ধরালেন। দিব্যি হুসহুস করে টানলেন এবং একবারও কাশলেন না। ডক্টর আর মিসেস সেন সুবীরকে অনেক পীড়াপীড়ি করলেন তাসের আড্ডায় যোগ দিতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রাজি করাতে পারলেন না। মিসেস সেন এ হোটেলের ব্যবস্থাপনার ভূয়সী নিন্দা করলেন এবং কথা প্রসঙ্গে জানালেন ওঁর এক ভাই আছেন ‘ম্যারিকায়, এক ভাই পশ্চিম জার্মানিতে। উনি নাকি ডক্টর সেনকে পই-পই করে বলছেন চাটি-বাটি গুটিয়ে বিদেশে পাড়ি জমাতে—কিন্তু ঘরকুনো ডাক্তার সেন কিছুতেই রাজি হচ্ছেন না দেশ ছেড়ে যেতে।

মোট কথা সুবীর হালে পানি পেল না।

ঠিক বারোটার সময় সুবীর এসে হানা দিল বাসু-সাহেবের ঘরে।

এস! আর কিছু ক্লু পাওয়া গেল?—প্রশ্ন করলেন বাসু।

—কিছু না। আপনি কিছু আন্দাজ করতে পারছেন?

—পারছি। আন্দাজ নয়। অকাট্য প্রমাণ!

ঘনিয়ে আসে সুবীর, বলেন কী স্যার? কে?

—কে নয় সুবীর? কারা? দুজনেই! ইব্রাহিম অ্যান্ড মিস ডিক্রুজা।

সুবীর অবাক হয়ে যায়। দরজাটা বন্ধ করে ঘনিয়ে আসে। বলে, নৃপেনদা অবশ্য আপনার খুব প্রশংসা করছিলেন; কিন্তু আপনি যে দুজনকেই… কী ব্যাপার বলুন তো?

বাসু-সাহেব নিবন্ত পাইপে অগ্নি সংযোগ করতে করতে বলেন, আয়াম সরি! এখনই কিছু বলতে পারছি না। আগে জাল গুটিয়ে আনি—সবটা একসঙ্গে ভাঙব।

হতাশ হয় সুবীর। বলে, তাহলে, মানে—আমি এখন কী করব?

তোমার অফিসিয়াল ইনভেস্টিগেশন চালিয়ে যাও।

.

আজও সারাদিনে বর্ষণ ক্ষান্ত হল না। ক্রমাগত বৃষ্টি হয়ে চলেছে। কার্ট রোড দিয়ে গাড়ি যাতায়াত বন্ধ। টেলিফোন তো অনেক আগেই গেছে—এবার গেল ইলেকট্রিক। ব্যাটারি-সেট রেডিও কারও কাছে নেই। রেডিও-র শেষ সংবাদ যা পাওয়া গেল তাতে জানা গেছে যে, সমগ্র উত্তরবঙ্গ একটা ঐতিহাসিক দুর্যোগের কবলে পড়েছে। মিলিটারিকে ডাকা হয়েছে উদ্ধারের কাজে। তিস্তা ব্রিজ নিশ্চিহ্ন। আরও অনেক ব্রিজ ভেঙে গেছে। মহানন্দা, তিস্তা ফুলে ফেঁপে ডুবিয়ে দিয়েছে গ্রামের পর গ্রাম, জেলার পর জেলা।

সন্ধ্যার পর কালীপদ ঘরে ঘরে মোমবাতি রেখে গেল। মিটমিটে আলোয় বাড়িটাতে একটা ভূতুড়ে ভাব এসেছে। সুবীর রায়ের পরিচয় জানতে আর কারও বাকি নেই সকলেই যেন কিছুটা সতর্ক, সন্দিগ্ধ। একঘেয়ে বৃষ্টির মতো রিপোস-এর জীবনযাত্রা বৈচিত্র্যহীন হয়ে পড়েছে একেবারে।

বৈচিত্র্য দেখা দিল রাত ঠিক আটটা তেত্রিশে।

তার তিন মিনিট আগের কথা। কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে আটটায়। ড্রয়িংরুমের ঘড়িটা ঠিক যখন ঢং করে সময়টা ঘোষণা করল।

সুজাতা তখন ছিল রান্নাঘরে। একাই। রাতের রান্না করছিল সে একা। কালীপদ নিজের কাজে ব্যস্ত। কাঞ্চী বাড়ি চলে গেছে।

আলি-সাহেব নিজের ঘর মোমবাতির আলোয় আগাথা ক্রিস্টির ‘মাউসট্র্যাপ’ গল্পের শেষ ক’টা পাতায় ডুবে আছেন।

সুবীর ছিল তার নিজের ঘরের সংলগ্ন বাথরুম। গিজারের জল এখনও কিছুটা গরম আছে। সে হট বাথ নেবার একটা চেষ্টা করছে। গরমজল আর পাওয়া যাবে না।

ডক্টর আর মিসেস সেন জোড়া মোমবাতি জ্বেলে ফিশ্ ফেলছেন। মিসেস সেন সারাদিনে প্রায় সওয়া শ’টাকা হেরে বসে আছেন!

কৌশিক একটা ছাতি আর টর্চ নিয়ে উঠেছে ছাদে। মই বেয়ে জল-নিকাশী গাটারটা সাফা করতে। গাছের পাতায় জল-নিকাশী গাটারটা আটকে গেছে।

বাসু-সাহেব তাঁর ঘরের সামনে উত্তরের বারান্দায় অন্ধকারে বসেছিলেন একটি ইজিচেয়ারে। শুনছিলেন—গাছের পাতা থেকে টুপটুপ করে জরে পড়া বৃষ্টির শব্দ।

ঠিক তখনই ঢং করে ড্রয়িংরুমের ঘড়িতে সাড়ে আটটা বাজল।

রানি দেবী ছিলেন নিজের ঘরে। হুইলচেয়ারটা তাঁর ঘরের উত্তরের জানলার কাছে টেনে নিয়ে আপন মনে তিনি গান ধরলেন। এমন অকালবর্ষণের সন্ধ্যায় তিনি কিন্তু কোনো বর্ষা-সঙ্গীত ধরলেন না। কী জানি কেন আপন খেয়ালে শুরু করলেন অতি পরিচিত একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত :

“যদি জানতেম আমার কিসের ব্যথা তোমায় জানাতেম—”

ঘরে ঘরে বিচিত্র প্রতিক্রিয়া শুরু হল।

সুজাতা তার প্রেশার-কুকারের মুখটা খুলে দিল। সোঁ-সোঁ শব্দটা বন্ধ হল।

মিসেস সেন তাস ডিল করা বন্ধ করে প্রশ্ন করলেন, কে গাইছে বলো তো?

বাসু-সাহেব দেশলাইটা জ্বালাবার উপক্রম করছিলেন থমকে গেলেন তিনি।

সুবীর বোধহয় গানটা শুনতে পায়নি। তার কলের শব্দ বন্ধ হল না।

অরূপ পায়চারি করছিল একতলার দক্ষিণের বারান্দায়। চট করে সে ঢুকে গেল, হল-কামরায়। ডাইনিং হল-এ একটা মোমবাতি জ্বলছে। মাঝের পর্দাটা টানা। তাই ড্রয়িংরুমটা আলো-আঁধারি। অরূপ কিন্তু ভ্রুক্ষেপ করল না। প্রায় হাতড়াতে হাতড়াতে সে সরে এল ড্রয়িংরুমের উত্তর দিকের দেওয়ালের কাছে। বসল গিয়ে পিয়ানোর টুলে।

গান যখন অন্তরায় পৌঁছাল তখন পিয়ানোর মিঠে আওয়াজ যুক্ত হল কণ্ঠ-সঙ্গীতের সঙ্গে। সমের মাথায় একবার থামলেন রানি দেবী। কান পেতে কী শুনলেন। বুঝে নিলেন–পিয়ানো বাজছে। চুপ করে রইলেন পুরো একটি কলি। পিয়ানো বেজে গেল শুধু। তারপর যুক্ত হল যন্ত্র-সঙ্গীতের সঙ্গে কণ্ঠ-সঙ্গীত। রানি দেবী নিশ্চয় বুঝে উঠতে পারেননি কে এমন আচমকা সঙ্গত করতে বসেছে—কিন্তু এটুকু বুঝে নিয়েছিলেন যে সঙ্গতকার একজন দক্ষ যন্ত্রশিল্পী।

“কোথায় যে হাত বাড়াই মিছে ফিরি আমি কাহার পিছে
সব কিছু মোর হারিয়েছে পাইনি তাহার দাম।”

কৌশিক সচকিত হয়ে ওঠে। সঙ্গীতের আকর্ষণে সে নেমে আসে মই বেয়ে। এসে নামে দোতলার বারান্দায়। সেখান থেকে সিঁড়ি দিয়ে নামবার সময় ওর নজরে পড়ল দক্ষিণের বারান্দার ও-প্রান্তে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে। অন্ধকারে ঠিক বোঝা গেল না, মনে হল স্ত্রীলোক। কাবেরীই হবে নিশ্চয়। ঠিক তার ঘরের সামনেই। কৌশিক একটু ইতস্তত করে। তারপর অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে সে নেমে যায় একতলায়।

সঙ্গীতের আকর্ষণে সস্ত্রীক সেনও উঠে এসে দাঁড়িয়েছেন উত্তরের বারান্দায়।

গান শেষ হল। সঙ্গীতমগ্না দ্বিতীয়বার শুরু করলেন ‘স্থায়ী’টা :

“যদি জানতেম আমার কিসের ব্যথা তোমায় জানাতেম”

ড্রয়িংরুমে ঘড়িতে তখন ঠিক আটটা বেজে তেত্রিশ।

হঠাৎ সমস্ত বাড়ি সচকিত করে একটা ফায়ারিং-এর শব্দ হল ড্রয়িংরুমে!

তৎক্ষণাৎ কে যেন ফুঁ দিয়ে নিবিয়ে দিল ডাইনিং হল-এর মোমবাতিটা!

একটা চেয়ার উল্টে পড়ার শব্দ। ঐ সঙ্গে ভেঙে পড়ল একটা ফুলদানি। বিশ থেকে ত্রিশ সেকেন্ড। বাড়িসুদ্ধ সবাই এসে উপস্থিত হল ড্রয়িংরুমে। প্রায় একসঙ্গেই।

অরূপরতন পড়ে আছে উবুড় হয়ে। তার পাশেই একটা ভাঙা ফুলদানি আর কিছু ছড়ানো ছিটানো গ্ল্যাডিওলাই। ডক্টর সেন হুমড়ি খেয়ে পড়লেন। কৌশিক তার হাতের টর্চটা জ্বালল। ডক্টর সেন মুখ তুলে বললেন, থ্যাংক গড। গুলিটা কাঁধে লেগেছে। ফেটাল নয় বোধহয়!

এতক্ষণে সুবীর এসে পৌঁছল তার বাথরুম থেকে। তার গায়ে একটা তোয়ালের তৈরি ড্রেসিং গাউন। তার চুল বেয়ে জল ঝরছে। বললে-পাশেই দু-নম্বর ঘর। ওখানেই ওঁকে নিয়ে যাওয়া যাক।

ধরা-ধরি করে অচৈতন্য অরূপকে ওরা নিয়ে গেল বাসু-সাহেবের ঘরে।

ডক্টর সেন একেবারে অন্য মানুষ। সমস্ত দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিলেন। সুজাতাকে গরম জল আনতে বললেন। আর সবাইকে বললেন, প্লিজ ক্লিয়ার আউট। ঘর ফাঁকা করে দিন। স্ত্রীকে বলেন, আমার ডাক্তারী ব্যাগটা নিয়ে এস চট্‌ করে।

মিসেস সেন ভ্রুকুঞ্চিত করে বলেন, কী দরকার বাপু ওসব খুন-জখমের মধ্যে নাক গলাবার? তুমি চলে এস!

—শাট আপ!!—গর্জন করে উঠলেন ডক্টর সেন। তারপর কৌশিকের দিকে ফিরে বলেন, আমার ব্যাগটা প্লিজ—

হ্যাঁ। ডাক্তার সেন মুহূর্তে বদলে গেছেন।

বারান্দার ও-প্রান্তে ইজিচেয়ারে গিয়ে বসেছিলেন ফের বাসু-সাহেব। সুবীর গট গট করে এগিয়ে আসে তাঁর কাছে। কঠিন স্বরে বলেন, আপনিই এজন্য দায়ী!

—আমি! কেন? কী করে?

—কেন তখন সব কথা খুলে বললেন না? হযতো এ দুর্ঘটনা রোখা যেত! বাসু-সাহেব বেদনাহত দৃষ্টিতে শুধু তাকিয়ে রইলেন। জবাব দিলেন না। দুম দুম করে পা ফেলে সুবীর চলে গেল আবার।

রানি দেবী হুইল-চেয়ারটা নিয়ে এগিয়ে এলেন। সহানুভূতির সুরে বললেন, এ দুর্ঘটনা এড়ানো যেত, তাই নয়!

হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে ওঠেন বাসু-সাহেব : ইয়েস, ইটস্ মাই মিস্টেক! আমি ভেবেছিলাম—আমিই বুঝি ওর টার্গেট! তাই প্রস্তুত হয়েই বসেছিলাম আমি। বুঝতে পারিনি ও অরূপকে —

পকেট থেকে একটা ছোট্ট কালো যন্ত্র বার করে দেখালেন স্ত্রীকে।

রানি দেবী স্তম্ভিত হয়ে যান।

আধঘণ্টা পরে বাসু-সাহেব এসে দাঁড়ালেন রোগীর শিয়রে। অরূপের কাঁধের ওপর ব্যান্ডেজ বাঁধা। অরূপ তখনও অচৈতন্য। প্রশ্ন করলেন ডক্টর সেনকে—কী বুঝছেন?

—বুলেটটা স্ক্যাপুলার খাঁজে আটকে আছে। বার করে দেওয়া দরকার—

—হাসপাতালের অপারেশান থিয়েটার ছাড়া সম্ভব হবে?

—অসম্ভব! থাক, আপাতত বুলেটটা থাক। শকটা কাটিয়ে উঠুন। বেঁচে যাবেন। অন্তত মেডিকেল-সায়েন্স এক্ষেত্রে যতটুকু করতে পারে তা আমি করব। নিশ্চিন্ত থাকুন।

—থ্যাংক্স!

অন্ধকারের মধ্যে এগিয়ে এল সুবীর। বললে, কিছু মনে করবেন না ডক্টর সেন। আমি কয়েকটা খোলা কথা বলব। অরূপবাবুকে কে গুলি করেছে তা আমরা জানি না। কিন্তু আমাদের মধ্যেই কেউ একজন তা করেছে—ইয়েস! এনি ওয়ান! আপনি-আমিও হতে পারি!

—সো হোয়াট?—রুখে ওঠেন ডক্টর সেন।

—আপনি ওঁকে কী ওষুধ দিচ্ছেন, কী ইনজেকশান দিচ্ছেন সব একটা স্টেটমেন্টের আকারে লিখে যাবেন এবং মিসেস বাসুকে দেখিয়ে ওষুধ খাওয়াবেন, ইনজেক্‌শান দেবেন–

—মিসেস্ বাসুকে! কেন? উনি কী বোঝেন ডাক্তারির?

সে জন্য নয়। একমাত্র মিসেস্ বাসুই সন্দেহের অতীত।

ডাক্তার সেন কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বাসু-সাহেব বলেন, ইয়েস ডক্টর সেন। টেক মাই লিগাল অ্যাডভাইস। সুবীর যা বলছে তাই করুন। মেডিক্যাল সায়েন্সে যতখানি সম্ভব আপনি করুন—ক্রিমিনাল জুরিসপ্রুডেন্সে যতখানি সম্ভব আমাকে করতে দিন—

শ্রাগ করলেন ডাক্তার সেন : অ্যাজ য়ু প্লিস্!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *