সোনার কাঁটা – ৪

দোসরা অক্টোবর, বুধবার। সন্ধ্যা।

ইতিমধ্যে রিপোস-এ এসে হাজির হয়েছেন বেশ কয়েকজন। সুজাতা চোখে অন্ধকার দেখে। কাল রাত্রি থেকে যে বৃষ্টি শুরু হয়েছে তা থামার লক্ষণ নেই। একনাগাড়ে বর্ষণ চলেছে। পাহাড়ে বৃষ্টি। কখন থামবে কেউ জানে না। রেডিওতে তো বলছে সহজে থামবে না। কালীপদ সেই যে শুয়েছে আর ওঠার নাম নেই। সারা রাত প্রবল জ্বরে ছটফট করেছে বেচারি। ওদিকে কাঞ্চী আজ সকালে আসেনি—ওদের বস্তির ঘরে হুড়হুড় করে জল ঢুকছে হয়তো। সেই সামলাতেই ওরা হিমশিম। অথচ এদিকে একে-একে এসে উপস্থিত হচ্ছেন আবাসিকেরা।

সবার আগে এসেছেন মিস্ কাবেরী দত্তগুপ্তা। সকাল ছটায়। তখনও শয্যাত্যাগ করেনি সুজাতারা। কাল রাত্রে সুজাতার ভাল ঘুম হয়নি। কৌশিক একঝুড়ি মিথ্যা কথা বলল তা ও কিছুতেই ভেবে পাচ্ছিল না। অপরপক্ষে কৌশিকও একটু গুম মেরে গেছে। খাবার টেবিলে যে কথোপকথনটা হল সেটার কথাই ওর বার বার মনে পড়ে যাচ্ছে। ভাবছিল—সুজাতা কেন আলি সাহেবকে প্রথম সাক্ষাতেই বলে বসেছিল—বাড়িতে সে একেবারে একা, চাকরটা পর্যন্ত নেই! আর আলি-সাহেব কেন অমন ইঙ্গিতপূর্ণ ভাষায় বললে, ‘আমার বারে বারে মনে পড়ে যাচ্ছে এটা বর্ষণমুখর রাত্রি!’ সুজাতাই বা অমন রাঙিয়ে উঠল কেন হঠাৎ? কৌশিকের ভীষণ জানতে ইচ্ছে করছিল—সে এসে পৌঁছনোর আগে সুজাতা আর আলি নির্জন বাড়িতে কী নিয়ে কথাবার্তা বলছিল। আলি যখন আসে তখন কি সুজাতা গান গাইছিল—’কৈসে গোঁঙাইবি হরি বিনে দিন-রাতিয়া!’ পাশাপাশি খাটে দুজনেই জেগে শুয়েছিল অনেক রাত পর্যন্ত। দুজনেই জেগে আছে। কেউই কিন্তু সাড়া দেয়নি। তারপর কখন দুজনে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুম ভাঙল নিচের কলিংবেলটা আর্তনাদ করে ওঠায়।

—এই, নিচে কে যেন কলিংবেল বাজাচ্ছে। কাঞ্চী এসেছে বোধহয়—কৌশিক সুজাতাকে ডেকে দেয়।

ধড়মড়িয়ে উঠে বসে সুজাতা। কাঞ্চী তো এত সকালে আসে না। নিচে নেমে আসে। দরজা খুলেই দেখে—কাঞ্চী নয়, আগন্তুক একজন নতুন বোর্ডার। বছর পঁচিশ-ত্রিশ বয়সের একজন মহিলা। চিকনের একটি শাড়ির উপর গরম ওভারােট। দেখতে ভালই—সুন্দরীই বলা চলে। মেয়েটি বলে, আমার নাম কাবেরী দত্তগুপ্তা।

—সুপ্রভাত! আসুন, আসুন!—এত ভোরবেলা কোথা থেকে? আপনার না আজ দুপুরে আসার কথা?

—তাই স্থির ছিল। রেলওয়ে রিজার্ভেশান পেলাম একদিন আগে। কাল এসেছি-

—কাল এসেছেন! রাত্রে কোথায় ছিলেন?

—কার্শিয়াঙে। ওখানে আমার একজন বন্ধুস্থানীয় লোক আছেন। তাঁর বাড়িতেই রাত্রে ছিলাম। ভোরবেলা উঠেই একটা ট্যাক্সি নিয়ে চলে এসেছি। যা বৃষ্টি —

—আসুন, ভিতরে আসুন—আপনার জামা-কাপড় একদম ভিজে গেছে।

কাবেরীর সঙ্গে কোনো বেডিং নেই। আছে, একটা সুন্দর সাদা সুটকেস। কালীপদ অসুস্থ। ফলে সুজাতা আর কাবেরী দুজনে ভাগাভাগি করে সেটা টেনে নিয়ে আসে দোতলায়। কাবেরীর জন্য নির্দিষ্ট ছিল দোতলার সাত নম্বর ঘরটা। সেটা পছন্দ হল কাবেরীর। ঘরে পৌঁছে কাবেরী বললে, আপনিই তো হোটেলের মালিক, তাই নয়?

—আমি একা নই। আমরা। স্বামী-স্ত্রী। আজই খোলা হল হোটেলটা। পরে ভাল করে আলাপ করা যাবে। চা খাবেন নিশ্চয়। আমরাও এখনও খাইনি।

—চা তো খাবই। একেবারে বাসিমুখে রওনা হয়েছি—

—ঠিক আছে। মুখ হাত ধুয়ে নিন। গিজার আছে, গরম জল পাবেন।

দুপুরে যে ট্রেনটা শিলিগুড়ি থেকে আসে সেটা এসে উপস্থিত হল বেলা চারটেয়। বৃষ্টির জন্য। কাক-ভেজা হয়ে এসে উপস্থিত হলেন অরূপরতন মহাপাত্র। ছোটরেলের ট্রেনটা যে শেষ পর্যন্ত এসে পৌঁছাবে এ ভরসাই নাকি ছিল না। প্রবল বর্ষণে অনেক জায়গায় ধস নেমেছে। তবে লাইন চালু আছে এখনও। অরূপরতনের জন্য নির্দিষ্ট ছিল দোতলার নয়-নম্বর ঘরটা। কিচেন-ব্লকের উপরে, সিঁড়ির পাশেই। অরূপ ঘুরে ঘুরে বাড়িটা দেখলেন। প্রশংসা করলেন—যতটা না বাড়ির, তার চেয়ে বেশি তার রূপসজ্জার। সুজাতার রুচিকেই তারিফ করলেন বারে বারে। সারা বাড়িটা দেখিয়ে ওঁকে পৌঁছে দিচ্ছিল ওঁর সাত নম্বর ঘরে। হঠাৎ সিঁড়ির মুখে দেখা হয়ে গেল কাবেরীর সঙ্গে। সে নিচে নামছিল। সুজাতা ওঁদের পরিচয় করিয়ে দেয়, মিস্ কাবেরী দত্তগুপ্তা, আজই সকালে এসেছেন। আর ইনি মিঃ অরূপরতন মহাপাত্র, অ্যাডভোকেট। আমাদের পারিবারিক বন্ধু।

কাবেরী কোনো কৌতূহল দেখাল না। মামুলি নমস্কার করল শুধু।

অরূপ প্রতিনমস্কার করে বললে, আপনাকে কোথায় দেখেছি বলুন তো?

—আমাকে! কোথায়?—কেমন যেন চমকে ওঠে কাবেরী।

—মাফ করবেন। আপনি কি ক্রিশ্চিয়ান?

—ক্রিশ্চিয়ান! না তো! এমন অদ্ভুত কথা মনে হল কেন আপনার?

অরূপ হেসে বলে, আমারই ভুল তাহলে। আমার এক খ্রিস্টান বন্ধুর বিয়েতে একবার চার্চে গিয়েছিলাম—বছরখানেক আগে। সেখানে একটি মেয়েকে দেখেছিলাম—

—না না—আমার বংশের কেউ কখনও গির্জায় যায়নি। আপনি ভুল করছেন।

কাবেরী তরতরিয়ে নেমে গেল সিঁড়ি দিয়ে।

অরূপ একটু হকচকিয়ে যায়। সুজাতাকে বলে, ভদ্রমহিলা কি অফেন্স নিলেন?

—অফেন্স নেওয়ার মতো কোনো কথা তো আপনি বলেননি।

—না, তা বলিনি। আমারই ভুল।

সুজাতার মনে পড়ে গেল অনেকদিন আগেকার কথা। সেবারও অরূপরতন একজনকে দেখে বলেছিলেন— আপনাকে কোথায় দেখেছি বলুন তো? আর সেবার কিন্তু অরূপের ভুল হয়নি।

বিকাল নাগাদ এসে উপস্থিত হলেন আর একজন আগন্তুক। আসার ঘণ্টাখানেক আগে দার্জিলিঙ থেকে একটা টেলিফোন করে জানতে চাইলেন—সিঙ্গল সিটেড ঘর পাওয়া যাবে কি না। কৌশিক অবস্থা বেগতিক দেখে আপত্তি করেছিল, কিন্তু সুজাতা শোনেনি। সুজাতার মত বোর্ডার হচ্ছে ওদের ব্যবসায়ের লক্ষ্মী। উদ্বোধনের দিনেই সে কাউকে প্রত্যাখ্যান করবে না—যতই কেন না অসুবিধা হোক। ফলে ঘণ্টাখানেক পরে একটা ট্যাক্সি নিয়ে এসে হাজির হলেন অজয় চট্টোপাধ্যায়। বৃদ্ধ সরকারি অফিসার ছিলেন। বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত। বিপত্নিক। ছেলে-মেয়েরা বিবাহিত এবং জীবনে প্রতিষ্ঠিত। খেয়ালি মানুষ, মেজাজ একটু তিরিক্ষে। অবসরপ্রাপ্ত জীবনে তিনি ছবি এঁকে বেড়াচ্ছেন। পাহাড়ে এসেছেন ছবি আঁকতে। দ্বিতলের আট-নম্বরে তাঁকে থাকতে দেওয়া হল।

বাসু-সাহেব সস্ত্রীক যখন এসে পৌঁছালেন তখন দিনের আলো মিলিয়ে গেছে। বর্ষণক্লান্ত সন্ধ্যায় সবাই জমিয়ে বসেছেন ড্রয়িংরুমে। আলি-সাহেব, কাবেরী, অরূপ, অজয় চাটুজ্জে এবং কৌশিক। শুধু সুজাতা অনুপস্থিত। সে ছিল কিচেন-ব্লকে। এতগুলি প্রাণীর রান্নার জোগাড় করতে বেচারি হিমশিম খাচ্ছে। কালীপদ শয্যাশায়ী। কাঞ্চী আদৌ আসেনি। ডাইনে-বাঁয়ে তাকাবার অবসর নেই সুজাতার। কৌশিক একাবার এসেছিল কোনো সাহায্য করতে হবে কিনা জানতে। রূঢ়ভাবে সুজাতা তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। সুজাতার মেজাজ হঠাৎ এমন বিগড়ে গেল কেন কৌশিক কিছু আন্দাজ করতে পারে না। অতএব সেও গুটিগুটি এসে বসেছে ড্রয়িংরুমে।

বাইরের দিক থেকে পর্দা সরিয়ে ঘরে ঢুকলেন বাসু-সাহেব, চাকা-দেওয়া চেয়ারে সহধর্মিণীকে নিয়ে। কৌশিক সকলের সঙ্গে তাঁর পরিচয় করিয়ে দেয়, আর ওঁদের বলে-আর এঁদের পরিচয় উনি আমাদের মামা আর মামিমা। মিস্টার পি. কে. বাসু, বার-অ্যাট-ল আর মিসেস্ রানি বাসু। লেডিজ অ্যান্ড জেন্টেলমেন! আমার একটা ঘোষণা আছে। এমন জমাট বর্ষার সন্ধ্যায় আপনাদের একটি সুখবর দিচ্ছি—আমাদের বাসুমামুর ঝুলিতে অসংখ্য ইন্টারেস্টিং কেস-হিস্ট্রি আছে। উনি ছিলেন ক্রিমিনাল লইয়ার। ফলে উনি যদি একটা গোয়েন্দা গল্প ফাঁদেন আমরা অজান্তে ডিনার টাইমে পৌঁছে যাব!

আলি বলেন, ভেরি ইন্টারেস্টিং! আপনার ঝুলি ঝেড়ে অতীতদিনের কোনো একটা লোমহর্ষক কাহিনি বার করে ফেলুন বাসু-সাহেব-

বাসু-সাহেব একটা শোফায় সবেমাত্র গুছিয়ে বসেছেন। পাইপ আর পাউচটা বার করে লক্ষ্য করে দেখছিলেন— টোব্যাকোটা ভিজে গেছে কি না। অন্যমনস্কের মতো বলেন, উঁ? অতীতদিনের কোন লোমহর্ষক কাহিনি? নো, আয়াম সরি—

—শোনাবেন না?—হতাশ হয়ে প্রশ্ন করে কৌশিক!

—না! অতীতের কথা থাক! Let the dead past bury its dead! তবে তোমাদের একেবারে নিরাশও করব না। অতি সাম্প্রতিক কালের একটা লোমহর্ষক কাহিনি তোমাদের শোনাব—

—সে তো আরও ভাল কথা—বলে ওঠে কাবেরী।

—উঁ? ভাল? তা ভাল-খারাপ জানি না—আজই—এই ধরো ঘণ্টা চৌদ্দ আগে দার্জিলিঙে একটা হোটেলে একটা মৃতদেহ আবিষ্কৃত হয়েছে। আমি তার প্রত্যক্ষদর্শী!

সবাই চমকে ওঠে খবরটা শুনে।

কৌশিক বলে, দার্জিলিঙের হোটেল? কোন হোটেলে?

—হোটেল—দ্য কাঞ্চনজঙ্ঘা! রুম নাম্বার টোয়েন্টি থ্রি! বাই দ্য ওয়ে—হোটেল কাঞ্চনজঙ্ঘার নাম আপনারা কেউ শুনেছেন?

দৃষ্টিটা উনি বুলিয়ে নেন ওঁর সোৎসুক দর্শকবৃন্দের উপর।

সবাই স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। কেন যেন অস্বোয়াস্তি বোধ করে সবাই। কেউ কোনও জবাব দেয় না। শেষ পর্যন্ত আর্টিস্ট অজয় চাটুজ্জে গলাটা সাফা করে নিয়ে বলেন, আমি চিনি। ইন ফ্যাক্‌ট, ওখান থেকেই আসছি আমি। আমি কাল রাত্রে ঐ হোটেলে ছিলাম, রুম নম্বর একুশে।

—তাই নাকি! তা এতবড় খবরটা শোনেননি?—প্রশ্নটা পেশ করেন আলি-সাহেব। অজয়বাবু একটু নড়ে-চড়ে বসেন। বলেন, শুনব না কেন, শুনেছি। তাই তো চলে এলাম এখানে। ওখানে আর ছবি আঁকার পরিবেশ নেই। সওয়াল-জবাব শুরু হয়ে গেছে!

কৌশিক বলে, কী আশ্চর্য! এতক্ষণ তো আমাদের বলেননি কিছু?

—কী বলব? এটা কি একটা বলার মতো কথা? আমরা এখানে এসেছি পাহাড় দেখতে, বেড়াতে, স্ফূর্তি করতে। তার মধ্যে দারোগা-খুনের খবরটা জনে জনে বলে বেড়াতে হবে তার অর্থ কী?

—দারোগা! যে লোকটা মারা গেছে সে কি পুলিশের দারোগা ছিল?—প্রশ্নটা আবার পেশ করেন আলি-সাহেব।

বাসু-সাহেব অরূপরতনের দিকে ফিরে বলেন, রমেন গুহকে মনে আছে অরূপ?

—নাট্যমোদী রমেন দারোগা? আলবৎ। কেন কী হয়েছে তার?

—রমেন বদলি হয়ে এসেছিল দার্জিলিঙে। গতকাল বেলা বারোটার সময় সে এসে ওঠে ঐ হোটেল কাঞ্চনজঙ্ঘায়। আর আজ সকাল পৌনে ছ-টায় তার মৃতদেহ আবিষ্কৃত হয়েছে। তার নিজের ঘরে, রুদ্ধদ্বার কক্ষে। এ কেস অব পয়েজনিং! ওর ফ্লাস্কে কেউ পটাসিয়াম সায়ানাইড ফেলে গেছে!

সকলে ঘনিয়ে আসে। বিস্তারিত জানতে চায় ঘটনাটা। যতদূর জানা ছিল বাসু-সাহেব আনুপূর্বিক বলে যেতে থাকেন। মাঝে মাঝে পাদপূরণ করছিলেন রানি দেবী। ইতিমধ্যে সুজাতাও মাঝে মাঝে এসে দাঁড়াচ্ছে। আবার ফিরে যাচ্ছে রান্নাঘরে। রমেন গুহ সুজাতার বিশেষভাবে পরিচিত। বাসু-সাহেব সব কথারই উল্লেখ করলেন। কিন্তু জানালেন না দুটি সংবাদ। তেইশ নম্বর ঘরে অ্যাশট্রে থেকে উদ্ধার করা সিগ্রেটের টুকরোর কথা; আর বাইশ-নম্বরের ওয়েস্টপেপার বাস্কেটের কাগজের কথাটা।

আলি-সাহেব বলে, ঐ মহম্মদ ইব্রাহিমের চেহারার কী বর্ণনা পেলেন?

সন্ধানী দৃষ্টি মেলে বাসু-সাহেব বললেন, হাইট এবং স্ট্রাকচার এই ধরুন প্রায় আপনার মতো। তবে লোকটার দাড়ি ছিল এবং চোখে চশমা ছিল—

আলি হেসে বললে, ভাগ্যে আমার তা নেই! না হলে আপনারা হয়তো আমাকেই সন্দেহ করতেন। আমি তো কাল রাত্রে এসে পৌঁছেছি, ইব্রাহিম-সাহেব চেক-আউট করবার ঘণ্টা খানেক পরে।

—এবং লোকটা পাইপ খেত!—পাদপূরণ করেন বাসু-সাহেব।

—পাইপ খেত! সেরেছে!—জ্বলন্ত পাইপটা নিয়ে আলি-সাহেব অভিনয় করেন যেন তিনি অত্যন্ত বিড়ম্বিত—কোথায় পাইপটা লুকোবেন ভেবে পাচ্ছেন না।

কাবেরী বলে, মিস্টার আলি, আপনার ভয় নেই। বাসু-সাহেব পাইপ টানতে থাকেন আবার।

—আর মিস্ ডিক্রুজা?—এবার জানতে চায় অরূপ

প্রশ্নকর্তার দিকে না তাকিয়ে বাসু-সাহেব সরাসরি তাকালেন কাবেরী দত্তগুপ্তর দিকে। যেন তারই একটা দৈহিক বর্ণনা দেখে দেখে দিচ্ছেন সেইভাবে বলে গেলেন, হাইট—মাঝারি, রং—ফর্সা, বয়স কত হবে? এই ধরুন সাতাশ-আঠাশ! সুন্দরী, স্বাস্থ্যবতী। মাপ নাকি—34-28-32।

কাবেরীকে প্রথমটায় একটু নার্ভাস লাগছিল, কিন্তু শেষ বর্ণনাটায় সে খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। রানি দেবীকে বলে, মামিমা, একটু সাবধানে থাকবেন! মামা যেভাবে মেয়েদের দেখামাত্র তাদের ভাইট্যাল স্ট্যাটিসটিক্স বুঝে ফেলছেন-

রানি বললেন, উনি মিস্ ডিক্রুজাকে দেখেননি। শোনা কথা বলছেন!

আলি-সাহেব রসিকতা করে, কী দাদা কানে শুনেই এই? চোখে দেখলে—

বাধা দিয়ে রানি বলে ওঠেন, উনি আর একটা কথা বলতে ভুলেছেন! মিস্ ডিক্রুজা ভার্মিলিয়ান রঙের লিপস্টিক ব্যবহার করে! তবে তোমার ভয় নেই কাবেরী, তুমি একাই তা করনি, সুজাতাও তাই করে। ঐ দেখ—

সুজাতা তখনই এসে দাঁড়িয়েছে পিছনের দরজায়।

চিত্রকর অজয় চাটুজ্জে এতক্ষণ কোনো কথা বলেননি। আপন মনে একটা ম্যাগাজিনের পাতা উলটে যাচ্ছিলেন। তাঁর দিকে ফিরে বাসু-সাহেব এবার বলেন, আচ্ছা চাটুজ্জেমশাই, আপনি কি একুশ নম্বর ঘরটা ছেড়ে আজ বাইশ নম্বরে আসতে চেয়েছিলেন?

—উঁ?—চকে বই থেকে মুখ তুলে অজয়বাবু বলেন, আমাকে বলছেন?

প্রশ্নটা দ্বিতীয়বার পেশ করেন বাসু-সাহেব।

গুছিয়ে জবাব দেবার জন্যই প্রশ্নটা দ্বিতীয়বার শুনতে চাইলেন কি না বোঝা গেল না, চাটুজ্জে মশাই জবাবে বললেন, হ্যাঁ! চেয়েছিলাম। আমার একুশ নম্বর ঘর থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার আনডিস্টার্বড ভিয়ু পাওয়া যাচ্ছিল না, তাই—

—তাহলে শেষ পর্যন্ত মহম্মদ ইব্রাহিমের ঘরটা নিলেন না যে?

—ঐ যে বললাম—আমি ও ঘরে শিফ্ট্ করার আগেই পুলিশে এসে ঘরটা তল্লাশি করল। ভাবলাম—’বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা’। মানে মানে সরে পড়লাম ওখান থেকে—

—মহম্মদ ইব্রাহিম ঘরটা ছেড়ে যাবার পর আপনি ঐ ঘরটা দেখতে গিয়েছিলেন, নয়?

—হ্যাঁ গিয়েছিলাম। দেখতে গিয়েছিলাম ও-ঘরের জানলা থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা কেমন দেখতে পাওয়া যায়। মিনিটখানেক ও-ঘরে ছিলাম আমি। কিন্তু, কেন বলুন তো?

—আচ্ছা, মিস্টার চ্যাটার্জি, এমনও তো হতে পারে ঐ এক মিনিটের ভিতর কোনো অপ্রয়োজনীয় জিনিস আপনি ঐ ঘরের ওয়েস্টপেপার বাস্কেটে ফেলে দেন? যেমন ধরুন, খালি দেশলাইয়ের বাক্স, পুরোনো ক্যাশমেমো অথবা দলাপাকানো একটা কাগজ-

হঠাৎ চেয়ার চেড়ে উঠে দাঁড়ান অজয় চাটুজ্জে। কৌশিকের দিকে ফিরে বলেন, আজ রাত হয়ে গেছে; কাল সকালেই আপনার বিলটা পাঠিয়ে দেবেন। আমি চেক-আউট করব!

অরূপ বলে ওঠে, কী হল মশাই? রাগ করছেন কেন?

—রাগ নয়! আমার এসব বরদাস্ত হয় না—এই গোয়েন্দাগিরি আর পুলিশি প্যাঁচ! আমি একটু আনডিস্টার্বড থাকতে চাই। এখানেও সওয়াল-জবাব শুরু হয়ে গেছে—

রীতিমত রাগ করেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যান অজয়বাবু।

অরূপ একটু ঝুঁকে বসে। বাসু-সাহেবকে প্রশ্ন করে, কী ব্যাপার স্যার? ঐ ইব্রাহিমের ঘরের ওয়েস্টপেপার বাস্কেটে কিছু মালঝাল পাওয়া গেছে না কি?

বাসু-সাহেব পাইপটায় কামড় দিয়ে বলেন, কী দরকার অরূপ, ওসবের মধ্যে আমাদের যাবার? আমরা এসেছি পাহাড় দেখতে, বেড়াতে আর স্ফূর্তি করতে! কী বলেন?

দর্শকদলের উপর একবার দৃষ্টি বুলিয়ে নেন উনি। আলি কী একটা কথা বলতে গেল। তারপর কাবেরীর সঙ্গে চোখাচুখি হতেই চুপ করে গেল হঠাৎ।

বাসু-সাহেব অরূপরতনকেই পুনরায় প্রশ্ন করেন, একটা কথা আমাকে বলো তো অরূপ—ঐ নকুল হুইয়ের কেসটায় তুমি কি ডিফেন্স কাউন্সিলার ছিলে? কেসটার খবর আর আমি কিছু নিইনি

—না। আমি সরকার পক্ষে ছিলাম।

কৌশিক অবাক হয়ে বলে, সরকার পক্ষে! সে কি? মার্ডার কেসএ তো পাবলিক প্রসিকিউটার থাকেন সরকার পক্ষে-

—তাই থাকেন।—বুঝিয়ে বলে অরূপ—নকুল হুইয়ের কেসটায় আমাকে সরকার পক্ষ থেকেই পি.পি.-র সহকারী হিসাবে নিযুক্ত করা হয়। .

—তাই নাকি? এ খবর তো বলোনি আমাকে?—বাসু-সাহেব বলে ওঠেন।

—বলার সুযোগ পেলাম কোথায়? আপনি তো দীর্ঘদিন না-পাত্তা

—তাহলে তুমিই হচ্ছ নকুল হুইয়ের দু-নম্বর শত্রু?

অরূপ অবাক হয়ে বলে, তার মানে? নকুল হুই তো মরে ভূত!

—জানি। কিন্তু শুনেছি নকুল সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত লড়েছিল। এত মামলা-লড়ার খরচ সে পেল কোথায়?

আলি বাধা দিয়ে বলে ওঠে—মাপ করবেন ব্যারিস্টার-সাহেব, নকুল হুই চরিত্রটা এখনও এস্ট্যাব্লিশড হয়নি। আমরা কাহিনির ঠিক রসাস্বাদন করতে পারছি না।

কৌশিক এবং অরূপ ভাগাভাগি করে পূর্ব-কাহিনির মোটামুটি একটা খসড়া পেশ করে। অরূপরতন উপসংহারে বলে, নকুল হুই লোকটাকে আমরা ঠিকমত চিনতে পারিনি। দীর্ঘদিন ধরে সে আগরওয়াল ইন্ডাস্ট্রিস-এ বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। অনেক টাকা সে তলে তলে সরিয়েছিল—যে কথা শেষপর্যন্ত জেনে যেতে পারেনি ময়ূরকেতন আগরওয়াল। নকুল থাকত নিতান্ত গরিবের মতো—কিন্তু বেশ পুঁজি জমিয়ে ফেলেছিল সে। এমনকি ওর এক ভাইকে নাকি আমেরিকা পাঠিয়েছিল খরচ দিয়ে! ভাইটিও দাদার উপযুক্ত! মার্কিন-মুলুকে নাকি নামকরা গ্যাংস্টার হয়েছিল শেষপর্যন্ত। সেই ভাইই ওর মামলার খরচ দেয়। শুনেছি, ফাঁসির দিন মার্কিন-মুলুক থেকে ওর সেই ভাই চলে এসেছিল ভারতবর্ষে!

বাসু-সাহেব নির্বাপিত পাইপটি ধরাতে ধরাতে বলেন, কী নাম নকুলের ভায়ের! সহদেব নাকি?

—হ্যাঁ, আপনি কেমন করে জানলেন?

—জানি না। আন্দাজ করছি। এপিক্যাল ইনফারেন্স—মানে মহাভারতের ঐ রকমই নির্দেশ! তা সেই সহদেব বাবাজীবনের দৈহিক বর্ণনাটা কী?—কাবেরীর দিকে ফিরে যোগ করেন, যাকে বলে ভাইটাল স্ট্যাটিসটিক্স আর কি!

—আমি জানি না। সহদেবকে আমি স্বচক্ষে কোনোদিন দেখিনি, বলে অরূপ। সুজাতা এই সময় এসে ঘোষণা করে, ডিনার রেডি!

সভা ভঙ্গ হল!

.

আহারাদি মিটতে যার নাম দশটা। ইতিমধ্যে, এক মুহূর্তের জন্যও বৃষ্টি থামেনি। ক্রমাগত বর্ষণ হয়ে চলেছে। খরস্রোতা উপলবন্ধুর জলধারা পাহাড়ের মাথা থেকে সর্পিল গতিতে ছুটে আসছে সমতলের সন্ধানে। বাতি এখনও জ্বলছে। যে কোনও মুহূর্তে ইলেকট্রিক অফ্ হয়ে যেতে পারে। সুজাতা ঘরে ঘরে মোমবাতি রেখে এসেছে। আহারাদি মিটিয়ে যে যার ঘরে চলে গেছেন। কৌশিকও শুতে যাবার উপক্রম করছে এমন সময় এসে উপস্থিত হলেন রাতের শেষ অতিথি!

আবার একটি ট্যাক্সি এসে দাঁড়াল পোর্চে।

সুজাতা আর কৌশিক দরজা খুলে বেরিয়ে এল বাইরের বারান্দায়। ট্যাক্সি থেকে নেমে এলেন একজন মাঝ-বয়েসি ভদ্রলোক। গাড়ির ভিতর বসেছিলেন আর একজন সুবেশিনী সুন্দরী মহিলা। ভদ্রলোক নমস্কারের ভঙ্গিতে হাতদুটি এক করে বললেন, রাতটুকুর মতো তলায় একখানা করে বালিশ আর উপরে একখানা পাকা ছাদ মিলবে?… আই মীন, আমি আমাদের মাথার কথা বলছি।

কৌশিক প্রতিনমস্কার করে বলে, এমন দুর্যোগের রাত্রে কোন গৃহস্থ ‘না’ বলতে পারে?

গাড়ির ভিতর থেকে এক-গা-গহনা বলে ওঠেন, তুমি চুপ করো দিকিনি!

কৌশিক আঁতকে ওঠে, আমায় বলছেন?

ভদ্রলোক একগাল হেসে বলেন, আজ্ঞে না, আমায়। ডায়ালগটা ছাড়তে একটু দেরি

হয়েছে ওঁর… আই মীন, আপনার ডায়ালগের আগে ওঁর ডায়লগ!… ই’য়ে উনি, মানে আমার বেটার হাফ’!

ভদ্রমহিলা সে কথায় কর্ণপাত না করে এবার সরাসরি কৌশিককে প্রশ্ন করেন, এটা হোটেল তো?

কৌশিক সম্মতিসূচক গ্রীবা সঞ্চালন করে।

—তবে গৃহস্থের কথা উঠছে কেন? ডবল বেডরুম হবে?

কৌশিক জবাব দেবার আগেই উপরের ধাপ থেকে সুজাতা বলে, হবে না!

ভদ্রমহিলা সুজাতাকে আপাদমস্তক দেখে নেন একবার। তারপর তাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে কৌশিককেই পুনরায় প্রশ্ন করেন, অন্তত দুটো আলাদা সিঙ্গল সিটেড?

কৌশিক যেন শ্রুতিধর। সুজাতার দিকে ফিরে বলে, অন্তত দুটো আলাদা সিঙ্গল সিটেড?

ভদ্রমহিলা ভ্রু কুঞ্চিত করলেন। কৌশিক নিরুপায় ভঙ্গিতে ভদ্রলোককে যেন কৈফিয়ত দেয়, উনি হলেন গিয়ে আবার আমার বেটার হাফ

ভদ্রলোক এবং ভদ্রমহিলা অগত্যা সুজাতার দিকে তাকান।

সুজাতা একই ভাবে বললে, হবে না!

ভদ্রলোক শ্রাগ করলেন। সুজাতা তাঁকে উদ্দেশ করে বললে, তকে নিচে একখানা করে বালিশ এবং উপরে একখানা পাকা ছাদ হতে পারে—

ভদ্রলোক চমকে তাকান সুজাতার দিকে।

সুজাতা পাদপূরণ করে, আই মিন, আমি আপনাদের মাথার কথা বলছি।

—এনাফ!—সোৎসাহে ভদ্রলোক মালপত্র নামাবার উদ্দেশ্যে পিছনের কেরিয়ারটা খুলে ফেললেন। কৌশিক হাত লাগায়। সুজাতাও। এক-গা-গহনা শুধু নিজের ভ্যানিটি ব্যাগটা নিয়ে নেমে আসেন। মালপত্র টানাটানিতে তাঁর কোনো ভূমিকা ছিল না।

কৌশিক কাজ করতে করতেই বলে, আপাতত আসছেন কোথা থেকে?

—Scylla আর Charybdis-এর মধ্যবিন্দু থেকে—মাল নামাতে নামাতে জবাব দেন ভদ্রলোক।

—আজ্ঞে?—কৌশিক ব্যাখ্যা চায়।

—’হর্নস্ অব দ্য ডাইলেমা’ বোঝেন? তারই কেন্দ্রবিন্দু থেকে। এদিকে কার্শিয়াঙের পথে এক বিরাট খাদ, ওদিকে দার্জিলিঙের রাস্তায় এক হোঁড়ল গর্ত! মাঝখানে স্যান্ডুইচ হয়ে পড়েছিলাম। অবস্থাটা বুঝতে পারছেন?

—জলের মতো। মহারাজ ত্রিশঙ্কুর অবস্থা আর কি। ঘুম শহরের এই হাল হয়েছে তা আমরা এখনও টের পাইনি!

—আমরা পেয়েছি। অস্থিতে অস্থিতে। দার্জিলিঙ থেকে কলকাতা যাচ্ছিলাম। বাধা পেয়ে আবার ফিরে যাচ্ছিলাম দার্জিলিঙে। দুদিকেই রোড ক্লোসড।

খানকয়েক দশ টাকার নোট বার করে দিলেন তিনি ট্যাক্সি ড্রাইভারকে, বললেন, তোড়ানি রাখ্ দো ভাইসাব,–তোমার অবস্থাও তো সসেমিরা! আপাতত ঘুমের রাজ্যে কোথায় ঘুমাবে দেখ!

একগাল হেসে ড্রাইভার ব্যাক করল ট্যাক্সিটা।

দ্বিতলের ছয় নম্বর ঘরটা খুলে দিল সুজাতা। এটা সাজানো নেই, ভাড়া দেওয়ার কথা ছিল না। এক গা গহনা এক নজর ঘরটা দেখে নিয়ে বললেন, ও রাম! পর্দা নেই, বেডকভার নেই, ড্রেসিং টেবিল নেই—গুদাম ঘর নাকি?

কৌশিক আমতা আমতা করে বলে, আজ্ঞে না। এটা সবচেয়ে ভাল ডবল্ বেডরুম আকাশ ফাঁকা হলে ঘরে বসেই কাঞ্চনজঙ্ঘার ভিয়ু পাবেন। তবে ইয়ে … এটা ভাড়া দেওয়ার কথা ছিল না। বেডিং পাঠিয়ে দিচ্ছি; কিন্তু পর্দা বা ড্রেসিং টেবিল দিতে পারব না।

ভদ্রমহিলা আড়চোখে একবার সুজাতাকে দেখে নিয়ে বলেন, ভাড়া বোধকরি পুরোই নেবেন?

ভদ্রলোক তাকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, আহাহা ভাড়ার কথা কাল হবে। ইয়ে, আপনাদের কিচেন বোধকরি ক্লোসড্ হয়ে গেছে?

কৌশিক সুজাতার দিকে একটা চোরা চাহনি নিক্ষেপ করে বলে, আজ্ঞে হ্যাঁ। রাত তো বড় কম হয়নি! সব ছুটি হয়ে গেছে। তবে হেড কুক বোধহয় এখনও জেগে আছে, নয়?—শেষ প্রশ্নটা সুজাতাকে।

সুজাতা দাঁতে দাঁত চেপে বললে, হেড-বেহারাও জেগে আছে মনে হয়।

—অ! কৌশিক ঢোক গেলে!

ভদ্রলোক সুজাতার দিকে ফিরে বলেন, লোকে খেতে পেলে শুতে চায়…আই মিন, শুতে পেলে খেতে চায়! হবে কিছু? শুকনো বিস্কুট অবশ্য কিছু আছে আমাদের সঙ্গে।

সুজাতা বললে, ডবল-ডিমের অমলেট আর কফি হতে পারে।

—এনাফ! এনাফ!—ভদ্রলোক খুশিয়াল হয়ে ওঠেন।

তাঁকে আবার থামিয়ে দিয়ে গহনা-ভারাক্রান্ত বলে ওঠেন, তুমি থাম! তারপর কৌশিকের দিকে ফিরে বলেন, তাই বলে রাতের ফুল-মিল চার্জ করবেন না তো?

সুজাতা যাবার জন্যে পা বাড়িয়েছিল। দ্বারের কাছে ফিরে দাঁড়িয়ে বলে, ফুল মিলই চার্জ করা হবে। অসুবিধা থাকে তো দরকার কী?

ভদ্রমহিলাও ঘুরে দাঁড়ালেন। দুই বেটার হাফ দুজনকে দেখে নিলেন। দুই ওয়ার্স-হাফ কণ্টকিত হয়ে ওঠেন। ভদ্রমহিলা কৌশিককে প্রশ্ন করেন, হোটেলের ম্যানেজার কে?

—ইয়ে, আমি!— কবুল করে কৌশিক।

—তবে সব কথায় উনি অমন চ্যাটাং চ্যাটাং করছেন কেন?

কৌশিক আমতা আমতা করে বলে, উনি যে আমার এমপ্লয়ার, হোটেলের মালিক! ভদ্রলোক একগাল হেসে বলেন, আই ফলো! –স্ত্রীকে বলেন, এই তুমি যেমন আমার গার্জেন আর কি?—সুজাতাকে বলেন, তা ফুল-মিল চার্জই দেব। কিচেন যখন বন্ধ হয়ে গেছে তখন এক্সট্রা চার্জ দিতে হবে বইকি। আমার জন্য এক প্লেট পাঠিয়ে দিন। আর ইয়ে… ওঁর যখন এত আপত্তি, উনি না হয় বিস্কুটই খাবেন রাত্রে।

—থাম তুমি! ডাকাতের হাতে যখন পড়েছি, তখন নাচার!—মহিলা ক্ষুব্ধা!

—আমিও তো তাই বলছি—যাহা বাহান্ন তাহা পঁয়ষট্টি! ও—দু’প্লেটই পাঠিয়ে দিন। আর কড়া দু-কাপ কফি!

—না এক কাপ কফি, এক কাপ চা! রাত্রে কফি খেলে ওঁর ঘুম হয় না!

—নিরুপায় ভদ্রলোক শ্রাগ করলেন শুধু।

সুজাতা নেমে আসে কিচেন-ব্লকে। ভদ্রলোক পকেট থেকে নামাঙ্কিত একটা আইভরি-ফিনিশ্ড কার্ড বার করে কৌশিককে দেন। বলেন, আমার নাম ডঃ এ. কে. সেন, প্রাইভেট প্র্যাকটিশনার। আপনার রেজিস্টারে কাল সকালে সই করে দেব। কেমন?

কৌশিকও নেমে আসে। পায়ে পায়ে এসে হাজির হয় কিচেন-ব্লকে। সুজাতা গুম মেরে আছে। কাল থেকেই তার কী যেন হয়েছে। কৌশিক ইতস্তত করে। ঘুরঘুর করে—সান্ত্বনাবাচক কী বলবে ভেবে পায় না। সুজাতা বলে, ডিমটা ফাটাও!

—ফর্ক দিয়ে ডিমগুলো ফাটাতে ফাটাতে কৌশিক একটা স্বগতোক্তি করে— প্রমোশনই হল আমার! স্বাধীন ব্যবসা! বিয়ের আগে ছিলাম হুজুরাইন-এর ড্রাইভার, বিয়ের পরে হলাম হেড-বেয়ারা।

সুজাতা হাসল না পর্যন্ত!

—ওরা ভেবেছিল কর্মব্যস্ত উদ্বোধনের দিনটার বুঝি এখানেই সমাপ্তি। ভুল ভেবেছিল। হেড-কুক অমলেট নিয়ে, আর হেড-বেয়ারা কফি ও চা নিয়ে দ্বিতলে যখন পৌঁছে দিয়ে এল, ভদ্রলোক তখন সৌজন্য দেখিয়ে বললেন, সো সরি! আপনাদের চাকর-বেয়ারা পর্যন্ত শুয়ে পড়েছে দেখছি। খুব কষ্ট দিলাম আপনাদের।

সুজাতা অম্লান বদনে বললে, সঙ্কুচিত হবার কী আছে? এক্সট্রা চার্জ তো সেই জন্যেই দিচ্ছেন!

শুভরাত্রি জানিয়ে ওরা নিজেদের ঘরের দিকে পা বাড়ায়। ঠিক তখনই ঝনঝন করে বেজে উঠল টেলিফোনটা। ঘড়ির দিকে নজর গেল স্বভাবতই। রাত পৌনে এগারোটা।

দুজনেই নেমে আসে আবার। সুজাতাই তুলে নিল টেলিফোনটা : হ্যালো! রিপোস হোটেল। … হ্যাঁ, আছেন। কোথা থেকে বলছেন?

শুনে নিয়ে সুজাতা কৌশিককে বলে, তোমাকে খুঁজছে। ও.সি. সদর, দার্জিলিঙ।

—থানা! কেন কী হল আবার?—শঙ্কিত কৌশিকের প্রশ্ন।

—কী হল তা নিজের কানে শোনো!—রিসিভারটা হস্তান্তরিত করে সুজাতা পা বাড়ায়। যায় না কিন্তু। অপেক্ষা করে।

—কৌশিক মিত্র বলছি। কে বলছেন?

—নৃপেন ঘোষাল। ও.সি. দার্জিলিঙ সদর। ব্যারিস্টার সাহেব জেগে আছেন?

—না। ঘুমোচ্ছেন। কেন কী হয়েছে? ডেকে দেব?

—না, থাক। তা হলে আপনাকেই বলি। সব কথা টেলিফোনে বলা যাবে না। আকারে-ইঙ্গিতে বলব-বুঝে নেবেন। শুনুন : ব্যারিস্টার সাহেবের কাছে শুনেছেন নিশ্চয় আজ সকালে দার্জিলিঙ-এর একটি হোটেলে—

—হ্যাঁ, জানি, কাঞ্চনজঙ্ঘায়—

প্রায় ধমক দিয়ে ওঠে নৃপেন ঘোষাল, প্লিজ ডোন্ট মেন্‌শন এনি নেম! … শুনুন! আশঙ্কা করার যথেষ্ট কারণ ঘটেছে যে, সন্দেহভাজন লোকটা এখন ঘুমে আছে, রিপোস্-এর কাছাকাছি। হয়তো রিপোস্-এর ভিতরেই! দ্বিতীয়ত যে ঘটনা দার্জিলিঙে ঘটেছে অনুরূপ একটি ঘটনা হয়তো ঘুমে ঘটতে যাচ্ছে। হয়তো রিপোস্-এর ভিতরেই! ফলো?

কৌশিক অকপটে স্বীকার করে, না! আমি মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না!

—পারছেন! বিশ্বাস করতে পারছেন না, তাই নয়?—না বোঝার কী আছে?

—এমন সব অদ্ভুত কথা অনুমান করার হেতু?

—সে কথা টেলিফোনে বলা যায় না… শুনুন… আজ রাত্রেও আপনাদের ওখানে ঐ জাতীয় ঘটনা ঘটতে পারে। খুব সতর্ক থাকবেন। বুঝলেন?

কৌশিক বিহ্বল হয়ে বলে, একটু ধরুন। আমার স্ত্রীর সঙ্গে একটু পরামর্শ করে ফের আপনার সঙ্গে কথা বলছি।

টেলিফোনের মুখে হাত চাপা দিয়ে অত্যন্ত সংক্ষেপে কৌশিক সুজাতাকে ব্যাপারটা জানায়। সুজাতা ওর হাত থেকে টেলিফোনটা নিয়ে তার মাউথপিসে বলে, মিসেস্ মিত্ৰ বল্‌ছি। আপনার কথা আমরা বুঝতে পেরেছি। কিন্তু বড় ‘ইনসিকিওর্ড’ বোধ করছি। কিছু করা যায়?

ও-প্রান্ত ইতস্তত করে বলে, মুকিল কী জানেন, কাট-রোড ভেঙে গেছে। ঘুম আউটপোস্টে ব্যাপারটা আমি টেলিফোনে জানিয়েছি। ওরা ওয়াচ রাখবে। আপনারা ওখান থেকে পারতপক্ষে কোনো টেলিফোন কল ইনিশিয়েট করবেন না।

মরিয়া হয়ে সুজাতা বলে, থানা থেকে কেউ এসে থাকতে পারে না, আজ রাত্রে?

—ওখানকার লোকাল ফাঁড়িতে তেমন লোক কেউ নেই।… আচ্ছা এক কাজ করছি… আমার একজন অফিসারকে পাঠাচ্ছি। মিস্টার পি. কে. বাসু. তাকে চেনেন। এখান থেকে জিপে বাতাসিয়া লুপ পর্যন্ত যাবে, বাকি পথ হেঁটে যাবে। আপনারা জেগে থাকবেন, যাতে কলিং বেল বাজাতে না হয়।

—ধন্যবাদ। কী নাম বলুন তো তাঁর?

—সুবীর রায়।

ক্লান্ত অবসন্ন দেহে ওরা অপেক্ষা করতে থাকে। ঘড়ির কাঁটা টিক্‌টিক্ করে এগিয়ে চলেছে। আর বাইরে একটানা ধারাবাত। আর কোথাও কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। বোর্ডাররা যে-যার ঘরে ঘুমে অচেতন। শেষ বাতি নিবেছে ডাক্তার সেন-এর ঘরে। তাও আধঘণ্টা হয়ে গেল। ড্রয়িংরুমের ঘড়িটা সাড়ে এগারোটায় ঢং করে সাড়া দিল। সারা ঘুম ঘুমে অচেতন।

কৌশিক বললে, যাও তুমি শুয়ে পড়! আমি জেগে আছি।

সুজাতা জবাবে বলে, শুয়ে লাভ নেই! ঘুম হবে না। আর আধঘণ্টার মধ্যেই এসে পড়বেন মনে হয়।

ওঁর অনুমানই ঠিক। রাত বারোটায় সদর দরজার কাচের উপর একটা টর্চের আলোর সঙ্কেত হল। নিঃশব্দে উঠে গেল কৌশিক। পাল্লাটা একটু খুলে প্রশ্ন করল, কে?

—সুবীর রায়!

—আসুন।

আগন্তুক ভেজা বর্ষাতিটা খুলে ফেলে। দীর্ঘ বলিষ্ঠ চেহারা। বয়স ত্রিশের কোঠায়। হাতে একটা অ্যাটাচি। ওদের ওপর দৃষ্টি বুলিয়ে বললে, মিস্টার আর মিসেস্ মিত্র নিশ্চয়?

কৌশিক ঘাড় নেড়ে জানায় ওর অনুমান সত্য।

—কোন্ ঘরে আমি থাকব দেখিয়ে দিন। কাল সকালে কথা হবে।

—কিন্তু ব্যাপারটা কী?

—কেন? ও.সি. বলেননি টেলিফোনে?

—বলেছেন। সংক্ষেপে। টেলিফোনে তো সব কথা বলা যায় না। এমন আশঙ্কা করার কারণটা কী?

—সেটা কাল সকালে বলব। আপনাদের জেগে থাকার কোনো প্রয়োজন নেই। যা করার আমিই করব। কিন্তু থাকব কোন ঘরে?

—আসুন দেখিয়ে দিচ্ছি।

কৌশিক ওকে ঘরটা দেখিয়ে দিল। এক তলার চার নম্বর ঘর। সুজাতাও এল পিছন পিছন। ঘরে ঢুকেই সুবীর দরজাটা বন্ধ করে দেয়। অ্যাটাচি কেসটা খুলে একটা ম্যাপ বার করে। বলে, এটা এ বাড়ির প্ল্যান আমরা আছি এই ঘরে। এবার বলুন—কে কোন ঘরে আছেন?

কৌশিক অবাক হয়ে বলে, আমাদের হোটেলের প্ল্যান পেলেন কোথায়?

—সুবীর বিরক্ত হয়ে বলে, অবান্তর কথা বলে রাত বাড়ানোর দরকার আছে কি?

—কৌশিক আর প্রশ্ন করে না। উপস্থিত আবাসিকদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেয়, আর কে কোন ঘরে আছেন তা প্ল্যানে দেখিয়ে দিতে থাকে। সুবীর প্ল্যানের গায়ে নামগুলি লিখে নিল। তারপর বললে, গুড নাইট!

অসহিষ্ণুর মতো কৌশিক বলে ওঠে, একটা কথা অন্তত বলুন-দার্জিলিঙে যে ঘটনা ঘটেছে তা হঠাৎ রিপোস্-এ ঘটতে পারে এমন ধারণা কেন হল আপনাদের?

কাগজটা ভাঁজ করে পকেটে রাখতে রাখতে সুবীর বললে, বিশে ডাকাতের নাম শুনেছেন?

—বিশে ডাকাত! না। কে সে?

—কিম্বদন্তীর বিশে ডাকাত! সে নাকি ডাকাতি করতে যাবার আগে নোটিস দিয়ে আগেভাগেই জানিয়ে দিত। রমেনবাবুকে যে মেরেছে সে ঐ বিশে-ডাকাত-এর উত্তরসূরি! সেও অমন চিঠি লিখে জানিয়ে দিয়েছে তার সেকেন্ড টার্গেট আছে ঘুম-এ, ঘুম-এর এই রিপোস্ হোটেলে!

সুজাতা বলে, কী বলছেন আপনি! বিংশ শতাব্দীর কোনো ক্রিমিনাল এমন মুর্খামি করে?

—তাই তো দেখা যাচ্ছে। মুর্খামি নয়—লোকটা ওভার-কনফিডেন্ট! ইচ্ছা করেই সে এটা করেছে। খুনির একমাত্র উদ্দেশ্য প্রতিশোধ নেওয়া। যাকে প্রাণে বধ করবে তাকে আগে-ভাগে জানিয়ে না দিলে যেন তার তৃপ্তি হচ্ছে না। লোকটা অত্যন্ত পাকা ক্রিমিনাল। আমেরিকায় বাফেলো-অঞ্চলে গ্যাংস্টার দলে তার নাম আছে। বেঙ্গল পুলিশের এই আমাদের সে মনে করে চুনোপুঁটি!

—লোকটা কে তা আপনারা জানতে পেরেছেন?

—অন্তত নামটা আন্দাজ করা গেছে। তার নাম সহদেব হুই।

সুজাতার মুখটা ছাইয়ের মত সাদা হয়ে যায়, সহদেব হুই! নকুল হুইয়ের ভাই?

—হ্যাঁ। তাই আমাদের অনুমান!

একটু ইতস্তত করে সুজাতা বলে, ওর সেকেন্ড টার্গেট কে জানেন?

সুবীর হেসে ফেলে। বলে, না। সহদেব আমাকে বলেনি। তবে নকুল হুইয়ের মৃত্যুর জন্য যারা দায়ী তাদের মধ্যেই কেউ একজন হবেন। আপনারা আন্দাজ করতে পারেন?

কৌশিক গম্ভীর হয়ে বলে, পারি! ব্যারিস্টার পি. কে. বাসু!

সুবীর হেসে বললে, তাও ভাল। আপনাদের মুখ দেখে আমি কিন্তু ভেবেছিলাম বুঝি আপনাদের দুজনের কেউ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *