সুবাস

সুবাস

বিকেল সোয়া ছটা। সন্ধ্যা হতে আর বেশি দেরি নেই। সমস্ত আকাশ কালো মেঘে ভারী হয়ে আছে। থেমে-থেমে বিজলি চমকাচ্ছে। চারদিক থমথম করছে। রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে আসছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টি শুরু হবে।

সজীব অফিস শেষে রিকশা করে বাড়ি ফিরছে। রিকশাওয়ালা দুরন্ত গতিতে রিকশাটা নিয়ে ছুটে চলছে। ফাঁকা রাস্তা। ঝড়-বৃষ্টি শুরু হবার আগের শীতল দমকা হাওয়ার ঝাপটা গায়ে লাগছে। সজীবের মনে কেমন ফুরফুরে ভাব চলে এসেছে। আজ সারাদিন ভয়াবহ গরম পড়েছে। গরমে অতিষ্ঠ হয়ে উঠছিল জনজীবন। বিকেল পাঁচটার পর হঠাৎ করে আকাশে মেঘ জমতে শুরু করে। আকাশে মেঘ জমতে দেখার পর থেকেই মনের ভিতর এক ধরনের ভাল লাগার অনুভূতি ছড়িয়ে পড়তে থাকে। সেই অনুভূতি ক্রমেই বাড়ছে। মনে ফুর্তি-ফুর্তি ভাব চলে এসেছে।

সজীব কবি নজরুল সড়কের ছয়তলা এক ফ্ল্যাট বাড়ির পাঁচ তলার দক্ষিণমুখী ছোট্ট একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকে। একার সংসার। এখনও বিয়ে-থা করেনি। বছর দেড়েক হলো চাকরিটা পেয়েছে। চাকরি পাবার পর থেকেই সজীবের বাবা-মা-পরিবারের সবাই তাকে বিয়ে করাতে চাইছে। পাত্রীও খোঁজা হচ্ছে। পছন্দসই পাত্রী এখনও মেলেনি

সজীবের বাবা-মা, বড় ভাই-ভাবী, ছোট বোন গ্রামে থাকে। চাকরির সুবাদে পরিবারের সবাইকে ছেড়ে সজীবের শহরে থাকা হয়। ছুটি-ছাটা পেলেই ও দু’-এক দিনের জন্য গ্রামে বেড়াতে চলে যায়। সজীবের বাবা-মা, বড় ভাই-ভাবী, ছোট বোন তারাও মাঝে-মাঝে ডাক্তার দেখাতে বা বিভিন্ন কাজ নিয়ে সজীবের এখানে চলে আসে। তখন সজীবের খুব ভাল লাগে। না হলে একা-একা এই ফ্ল্যাট বাড়িতে মন টেকে না।

.

সজীবের রিকশা তার ফ্ল্যাট বাড়ির সামনে পৌঁছে গেছে। ততক্ষণে দমকা হাওয়া ঝড়ো হাওয়ায় রূপ নিয়েছে। গুম-গুম করে মেঘ ডাকতে শুরু করেছে। রাস্তার ধুলো-বালি, ছেঁড়া কাগজের টুকরো, নোংরা পলিথিন সব ঘূর্ণির মত হয়ে উড়ছে। চোখে-মুখে ধুলো-বালি ঢুকে যাচ্ছে।

সজীব চোখ-মুখ ঢেকে কোনওক্রমে রিকশাওয়ালার ভাড়া মিটিয়ে দৌড়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকে পড়ল। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগল। দোতলা পর্যন্ত ওঠার পরই শুনতে পেল বাইরে তুমুল ঝড় শুরু হয়ে গেছে। কান ফাটানো বিকট কড়-কড় শব্দে বাজ পড়ছে। যেন বাইরেটা তছনছ হয়ে যাচ্ছে।

ইলেকট্রিসিটি চলে গেছে। সজীব অন্ধকারেই সিঁড়ি বেয়ে উঠে যাচ্ছে। অবশ্য ক্ষণে-ক্ষণে বিজলির নীলচে আলোর ঝলক আসছে।

সজীব পাঁচতলায় পৌছে গেছে। চাবি দিয়ে তার ফ্ল্যাটের নব তালা খুলে ভিতরে ঢুকল। ঘরের ভিতরটা বেশ অন্ধকার। ইলেকট্রিসিটি নেই বলে চট করে আলো জ্বালানোর সুযোগ নেই। পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বের করে জ্বালল। ঝড়ো হাওয়ায় দরজা-জানালার পর্দাগুলো পত-পত করে উড়ছে।

তীব্র মিষ্টি একটা গন্ধ নাকে লাগছে। যেন অচেনা বুনো কোনও ফুলের সৌরভ। সারা ঘর ভরে আছে সেই গন্ধে। এমন মিষ্টি গন্ধের কী কারণ?! ঝড়ো হাওয়া অন্য কোনও ফ্ল্যাট থেকে কারও ব্যবহার করা দামী পারফিউমের গন্ধ কি উড়িয়ে এনেছে? কিন্তু দূর থেকে উড়ে আসা পারফিউমের গন্ধ এত তীব্র হবে কেন? মনে হচ্ছে যেন ঘরের মধ্যেই কেউ আছে যার গা থেকে এমন মিষ্টি সুবাস ছড়াচ্ছে! বন্ধ ফ্ল্যাটে কে আর থাকবে?!

সজীব গন্ধের রহস্য নিয়ে আর না ভেবে চার্জার ল্যাম্পটা জ্বেলে পোশাক পাল্টাতে লেগে গেল। গন্ধের তীব্রতাও ধীরে-ধীরে কমে গেল।

পোশাক পাল্টানো শেষে তোয়ালেটা কাঁধে ফেলে গুন-গুন করে গান গাইতে-গাইতে বাথরুমের দিকে এগিয়ে গেল মুখ-হাত ধোবার জন্য।

‘শ্রাবণের মেঘগুলো জড় হলো আকাশে। অঝরে নামবে বুঝি শ্রাবণী ঝরায়ে। আজ কেন মন উদাসী হয়ে, দূর অজানায় চায় হারাতে…’

বাথরুমের দরজাটা খুলতেই আবার সেই মিষ্টি গন্ধটা ধক করে নাকে ধাক্কা মারল। যেন গন্ধটা এসে বাথরুমে পালিয়ে ছিল। সজীবের বুকটা একটু ঢিপঢিপ করে উঠল। পরমুহূর্তেই ভাবল, ও কিছু না-অনেক সময় ঝড়ো বাতাসে উড়ে আসা গন্ধ কিছুক্ষণের জন্য বদ্ধ রুমে আটকে থাকে।

সজীব বাথরুম থেকে মুখ হাত ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে ভাবল, এক কাপ চা বানিয়ে বারান্দায় ইজি চেয়ারে বসে খাবে। ঝড় থেমে গেছে। তবে ভারী বর্ষণ হচ্ছে। বারান্দার ইজি চেয়ারে বসে চা খেতে-খেতে বৃষ্টি দেখার মজাই আলাদা।

সজীব চা বানানোর জন্য রান্নাঘরে ঢুকল। রান্নাঘরেও আবার সেই মিষ্টি গন্ধ। যেন অদৃশ্য কেউ গায়ে মিষ্টি গন্ধটা মেখে সারা বাসা ঘুরে বেড়াচ্ছে।

সজীবের কেমন ভয়-ভয় লাগছে। শুনেছে জিন-পরীদের গা থেকে নাকি সুন্দর গন্ধ পাওয়া যায়। ঝড়-বৃষ্টি দেখলে জিন- পরীরা নাকি অনেক সময় মানুষের বাসা বাড়িতে আশ্রয় নেয়। কোনও ক্ষতি করে না। যেহেতু তারা অদৃশ্য থাকে তাই মানুষ বুঝতেও পারে না ঘরের ভিতর কোনও জিন অথবা পরী রয়েছে। ঝড়-বৃষ্টি থামার পর নীরবে চলে যায়।

সজীব বুক ঢিপঢিপানি নিয়েই চা বানাল। চায়ের কাপ হাতে এসে বারান্দার ইজি চেয়ারে বসল। বারান্দার ইজি চেয়ারে বসতেই ভয়-ভয় ভাব অনেকটাই কেটে গেল। বারান্দা থেকে দূরে ব্যস্ত মহাসড়ক দেখা যাচ্ছে। প্রবল বর্ষণের মাঝেই যানবাহনগুলো হেডলাইটের আলোতে সারি বেঁধে ছুটে চলছে।

সজীব চা খেতে-খেতে ব্যস্ত সড়কের যানবাহনের ছুটে চলা দেখতে-দেখতে কখন যেন ইজি চেয়ারে মাথা কাত করে ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুমিয়ে পড়ার সঙ্গে-সঙ্গে মনে হলো অদৃশ্য কেউ এসে তার পাশে দাঁড়াল। যে দাঁড়িয়েছে তার গা থেকে সেই মিষ্টি গন্ধটা পাওয়া যাচ্ছে। তীব্রভাবে। মনে হচ্ছে যেন গন্ধটা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে সরাসরি সজীবের নাকের ফুটো দিয়ে মাথার ভিতরে ঢুকে মস্তিষ্কের প্রতিটা রন্ধ্রে-রন্ধ্রে পৌঁছে যাচ্ছে।

অদ্ভুত একটা অনুভূতি হচ্ছে। যেন গন্ধটা মাথার মধ্যে কথা বলছে। মেয়েলী সুরেলা কণ্ঠে।

‘আপনি কি আমাকে শুনতে পাচ্ছেন? শুনতে পাচ্ছেন? শুনতে পাচ্ছেন?…’

সজীব ঘুমের মধ্যেই মনে-মনে বলল, ‘হ্যাঁ, শুনতে পাচ্ছি। কে আপনি?

‘পৃথিবী থেকে কোটি-কোটি আলোক বর্ষ দূরের এক গ্রহের অধিবাসী আমি।’

সজীব অবাক গলায় বলল, ‘তা-ও আবার হয় নাকি?! অত দূরের কেউ পৃথিবীতে আসবে কী করে?!’

‘বিশেষ পদ্ধতি ব্যবহার করে আমরা অনেকে মিলে পৃথিবীতে এসেছিলাম পৃথিবীর কিছু সুন্দর গন্ধের নমুনা সংগ্রহের জন্য। অন্যরা সবাই চলে গেছে, আমি একা আটকে গেছি।’

সজীব বলল, ‘সুন্দর গন্ধের নমুনা সংগ্রহ করে কী করবেন?’

‘সুন্দর গন্ধই তো আমাদের কাছে সব। আমরা দেহধারী নই। অদৃশ্য। আমরা একেক জন তৈরি শুধুমাত্র গন্ধ দিয়ে। একেক জনের একেক রকমের গন্ধ। আমাদের পরিচয় একেক জনের আলাদা-আলাদা গন্ধে।’

আবোল-তাবোল কথা শুনে সজীব কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলল, ‘আপনি আমার কাছে কী চাইছেন?’

‘কিছুই না, একটু আশ্ৰয়।’

সজীব আশ্চর্য হওয়া গলায় বলল, ‘মানে?!’

‘মানে, আমি আপনার কাছে একটু আশ্রয় চাইছি। ওই যে বললাম অন্যরা সবাই চলে গেছে। ঝড়-বৃষ্টি দেখে ভয় পেয়ে আমাকে ফেলে পালিয়েছে। যে বিশেষ পদ্ধতি ব্যবহার করে আমরা এসেছিলাম এবং অন্যরা চলে গেছে, সেই পদ্ধতির ব্যবহার আমি জানি না। তাই আমি এখন আর ফিরে যেতে পারছি না। আমি এখন কী করব?! কোথায় যাব?! আমার কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই! প্লিজ, আমাকে একটু আশ্রয় দিন! প্লিজ!’ বলতে-বলতে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করল।

সজীব সান্ত্বনা দেবার ভঙ্গিতে বলল, ‘কাঁদবেন না, দেখি কী করা যায়।’

এর পরপরই সজীবের ঘুম ভেঙে গেল। বৃষ্টি থেমে গেছে। ইলেকট্রিসিটি চলে এসেছে। পুরো শহর আবার জেগে উঠেছে পাশের ফ্ল্যাট থেকে জোরে-জোরে হিন্দি গানের আওয়াজ ভেসে আসছে।

সজীব ইজি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। হাই দিতে-দিতে আড়মোড়া ভাঙল। মনে-মনে একটু হাসল। কী উদ্ভট একটা স্বপ্ন দেখল! উত্তেজিত মস্তিষ্কের অতি কল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়। ঝড়ো বাতাসে ভেসে আসা মিষ্টি পারফিউমের গন্ধ পেয়েই অমন একটা উদ্ভট স্বপ্ন বোধহয় দেখেছে।

.

সেদিনের পর থেকে সজীবকে সবার কাছ থেকে একটা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। পরিচিত-অপরিচিত যার সঙ্গেই দেখা হয় সবাই একই ধরনের প্রশ্ন করে। প্রশ্নগুলো হচ্ছে—

সজীব গায়ে কী পারফিউম মেখেছে? এত মিষ্টি গন্ধের পারফিউমের নাম কী? কোন্ দেশের পারফিউম? কোথায় পাওয়া যায়? দাম কত? আরও কত-কত প্ৰশ্ন।

সজীব সবার প্রশ্ন শুনে শুধু অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে। কিছুই বলতে পারে না। কারণ, সে কোনও পারফিউম ব্যবহার করে না। তার গা থেকে সবাই কেন মিষ্টি গন্ধ পায় এর কোনও ব্যাখ্যা তার জানা নেই।

বেশ কয়েক বছর কেটে গেছে। সজীব বিয়ে করেছে। সজীবের স্ত্রী প্রায়ই একটা কথা বলে, ‘তুমি যতক্ষণ কাছে থাক মিষ্টি সুবাসে আশপাশটা মৌ-মৌ করে। অথচ আমি অনেকবার তোমার গায়ের গন্ধ নিয়ে দেখেছি, তোমার গা থেকে সেই মিষ্টি সুবাস বেরোয় না! যেন তোমার গা ঘেঁষে অদৃশ্য এমন কেউ থাকে যার শরীর থেকে মিষ্টি সুবাসটা ছড়ায়।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *