ইচ্ছেমৃত্যু
এনায়েত হোসেন ইদানীং নিজেকে সুখী মানুষ মনে করেন। তিনি সরকারি ব্যাংকে উচ্চ পদে চাকরি করতেন। পাঁচ বছর আগে রিটায়ার করেছেন। গ্র্যাচুইটি, জিপি ফাণ্ড, প্রভিডেণ্ট ফাণ্ড সহ সব মিলিয়ে একসঙ্গে মোটা অঙ্কের টাকা পেয়েছিলেন। সেই টাকা দিয়ে পোস্ট অফিসে সঞ্চয়পত্র কিনে রেখেছেন। তিন মাস অন্তর মুনাফা ওঠান। এ ছাড়া প্রতি মাসে পেনশনও পান। পেনশনের টাকা এবং সঞ্চয়পত্রের মুনাফা সব মিলিয়ে যা পান তাতে তাঁর ভালই চলে যায়। বেশ কিছু টাকা বেঁচেও যায়। সেই টাকা আবার ব্যাংকে সেভিংস অ্যাকাউন্টে জমান। ছোট-খাট বিপদ-আপদ বা অসুখ-বিসুখে টাকাটা কাজে দেবে। সঞ্চয়পত্রের মূল টাকায় হাত দিতে হবে না। অবশ্য তাঁর স্বাস্থ্য বেশ ভাল। রোগ-ব্যাধি নেই। ডায়াবেটিস, ব্লাড প্রেশার, হার্টের সমস্যা—এই জাতীয় বয়স কালের কোনও রোগই তাঁকে এখনও ধরেনি।
চাকরিরত অবস্থায়ই শহরতলির নিরিবিলি পরিবেশে একতলা ছিমছাম বাড়ি করেছিলেন। ব্যাংকারদের বাড়ি করায় সুবিধা আছে। সহজ শর্তে ঋণ পাওয়া যায়। বাড়ির ঋণের টাকা বেতন থেকে কেটে অনেক আগেই শোধ হয়ে গেছে। দুটি মেয়ে তাঁর। মেয়ে দুটোকেও ভাল বিয়ে দিয়েছেন। একজন বরের সঙ্গে ইতালি থাকে, অন্যজন স্পেনে। মেয়ে দুটোকে পার করার দু’বছরের মাথায়ই তাঁর স্ত্রী মারা যান। সেই থেকে তিনি একা-একা থাকেন। একা থাকতে তাঁর খারাপ লাগে না। অবশ্য প্রথম দিকে কিছুটা মন খারাপ হত। এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। এখন মনে হয় স্ত্রী মারা যাওয়ায় ভালই হয়েছে। আল্লাহ যা করেন ভালর জন্যেই করেন। একেবারে ঝাড়া হাত-পা! না হলে সারাদিন কানের কাছে ঘ্যানর ঘ্যানর, প্যানর-প্যানর শুনতে হত। এটা করলে কেন, এটা করলে না কেন, এটা কি ঠিক হলো…হাজারও কৈফিয়ত। এখন কী সুন্দর স্বাধীন জীবন! নিজের মত করে থাকা যায়।
দু’মেয়েই এনায়েত হোসেনকে তাদের নিজেদের কাছে নিয়ে রাখতে চায়। বয়স্ক মানুষ, একা-একা থাকাটা ঠিক নয়। যে কোনও সময় গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন। তখন কে তাঁকে দেখাশোনা করবে? এই নিয়ে দু’মেয়ের দুশ্চিন্তার অন্ত নেই।
এনায়েত হোসেন বিদেশে যেতে রাজি হন না। নিজের বাড়ি, নিজের শহর, নিজের দেশ ছেড়ে তিনি কোথাও যেতে চান না।
এনায়েত হোসেনের রোজকার রুটিন-
অনেক রাত পর্যন্ত টিভি দেখে ঘুমান বলে একটু বেলা করে ঘুম ভাঙে তাঁর। দশটা-সোয়া দশটার দিকে। ঘুম থেকে উঠেই প্রথমে ‘ভাই-ভাই’ রেস্টুরেন্টে ফোন করে সকালের নাস্তা পাঠানোর কথা বলেন। এরপর বাথরুমে ঢোকেন। বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বেরোতে বেরোতে রেস্টুরেন্ট থেকে নাস্তা চলে আসে।
পরোটা অথবা তন্দুর রুটির সঙ্গে কখনও ডিমের অমলেট, কখনও কলিজা ভুনা, কখনও ভুনা গরুর মাংস, কখনও মুরগির চামড়া-গিলা-কলিজা দিয়ে বানানো লটপটি, কখনও-বা খাসী বা গরুর নেহারি। সেই সঙ্গে আদা-দারুচিনি-এলাচি দিয়ে বানানো এক ফ্লাস্ক স্পেশাল র-চা।
দুটো খবরের কাগজ রাখেন। একটা আঞ্চলিক, অন্যটা জাতীয়। নাস্তা সেরে চা পান করতে-করতে, খবরের কাগজ পড়েন।
দুটো খবরের কাগজের মধ্যে আঞ্চলিকটা পড়ে তিনি বেশি মজা পান। আঞ্চলিক খবরের কাগজটিতে এমন কোনও দিন নেই যেদিন দু’-একটা ধর্ষণ আর পরকীয়ার খবর থাকে না। মাঝে- মাঝে তো পুরো খবরের কাগজ জুড়েই ধর্ষণ আর পরকীয়া। খবরগুলোর বর্ণনাও এমন রগরগে যে একবার পত্রিকা হাতে নিলে আর রাখতে ইচ্ছে করে না।
খবরের কাগজ · পড়া শেষ করে উঠতে-উঠতে সাড়ে এগারোটা-বারোটা বেজে যায়। এসময় তিনি রাস্তায় হাঁটা-হাঁটি করতে বেরোন।
শুনতে হয়তো অবাক লাগছে বেলা বারোটার সময় কেউ কি রাস্তায় হাঁটতে বেরোয়? তিনি বেরোন। তিনি অনেক দিন ধরে লক্ষ করেছেন এসময়ে রাস্তায় স্কুল-কলেজ ফিরতি অনেক মেয়েকে দেখতে পাওয়া যায়। উঠতি বয়সী মেয়েদের দেখার মজাই আলাদা!
আজকালকার মেয়েরা ওড়নার ব্যবহার প্রায় ভুলেই গেছে। বুক উঁচু করে কেমন দাম্ভিক ভঙ্গিতে হাঁটে। যে দু’-একজন ওড়না ব্যবহার করে তারা বুকের উপর কাপড়টা ঠিকঠাক মত রাখে না। হয়তো এক পাশে কাঁধের উপর ফেলে রাখে। নয়তো মাফলারের মত করে গলায় পেঁচিয়ে নেয়। কেউ আবার ঘোমটার মত করে মাথা সহ মুখমণ্ডল পেঁচিয়ে নেয়। কিন্তু বুক থাকে ওড়না ছাড়া। বলা যায় বুক খোলা, চেহারায় তালা। কেউ-কেউ আবার বোরখা পরে। তারাও তাঁর ‘সুদৃষ্টি’ থেকে রেহাই পায় না। আর খানিকটা আঁটসাঁট হলে তো কথাই নেই!
তাদেরকে তাঁর মনে হয় যেন কাচের বয়ামে ভরা আচার। দেখলেই জিভে জল এসে যায়।
রাস্তায় ঘোরাঘুরি শেষে বাসায় ফিরতে পৌনে দুটো-দুটো বেজে যায়। বাসায় ফিরে ‘নিরিবিলি’ হোটেলে ফোন করে দুপুরের খাবার পাঠাতে বলেন। গোসল করে বেরোতে বেরোতে দুপুরের খাবার চলে আসে।
প্রতি বেলাতেই তিনি হোটেলের খাবার খান, তবে বাড়িতে আনিয়ে খান। হোটেলে গিয়ে খেতে তাঁর ভাল লাগে না। অবশ্য বাড়িতেও রান্নার ব্যবস্থা আছে। ঘরে চাল-ডাল-তেল-নুন সহ ফ্রিজে মাছ-মাংস সবই রাখা আছে। কোনও-কোনও দিন ইচ্ছে হলে বাসায় নিজেও রান্না করে খান। তাঁর রান্নার হাত জঘন্য। হয় লবণ পোড়া, না হয় একেবারে লবণ ছাড়া, নয়তো মসলার গন্ধ, আর না হয় ঝালে মুখে ছোঁয়ানো যায় না। তাই তিনি সচরাচর নিজে রান্না করেন না।
দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার পর বিছানায় শুয়ে শুয়ে সিনেমা ম্যাগাজিন পড়েন। পড়ার চেয়েও সিনে ম্যাগাজিনে দেয়া নায়িকাদের ছবি দেখায় বেশি আগ্রহ তাঁর। সংক্ষিপ্ত পোশাকে নায়িকাদের উন্নত বক্ষ দেখতে-দেখতে তাঁর চোখে ঘুম নেমে আসে।
ঘুম ভাঙে বিকেলে। তখন তিনি হাঁটার জন্য পার্কে চলে যান। পার্কে হাঁটার মাঝেও এক ধরনের মজা আছে।
একটা সময় ছিল যখন শুধু বয়স্করাই পার্কে হাঁটতে আসত। এখন সব বয়সীরাই হাঁটার জন্য পার্কে আসে। তিনি বেছে বেছে ভারী নিতম্বের কোনও অল্প বয়সী মেয়ের পিছু নিয়ে হাঁটেন। নিতম্বের দোলা দেখতে-দেখতে হাঁটার ফলে হাঁটার কষ্টটা গায়ে লাগে না।
সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরে আসেন। ফেরার পথে ভিডিওর দোকান থেকে একটা পর্নো ভিডিওর সিডি নিয়ে ফেরেন। তাঁর একজন পছন্দের পর্নো তারকাও রয়েছে। সানি লিওন। সানি লিওনের খুবই ভক্ত তিনি।
সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে টিভি ছেড়ে খবর দেখতে বসেন। রিমোট টিপে চ্যানেল ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে ঠিক করেন কোন্ চ্যানেলের খবর দেখবেন। যে চ্যানেলের খবর পাঠিকাকে বেশি আকর্ষণীয় মনে হয় সে চ্যানেলে স্থির হন। আর কোনও চ্যানেলে পুরুষ পাঠক দেখলে সেসব চ্যানেলের খবর দেখার তো কোনও প্রশ্নই ওঠে না। অবশ্য বেশির ভাগ চ্যানেলে খবর পাঠিকাই দেখা যায়। রূপবতী সব পাঠিকা! বেছে-বেছে এমন সব মেয়েদের দিয়ে খবর পড়ানো হয় চোখ ফেরানো যায় না। হাঁ করে চেয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। খবর শোনার জন্য না হলেও রূপবতী পাঠিকাকে দেখার জন্য চ্যানেল পাল্টাতে মন চায় না।
রাত দশটা পর্যন্ত খবর দেখা শেষে মিউজিক চ্যানেলে চলে যান। খুঁজে-খুঁজে হট সং বের করেন। হট সং মানেই নায়ক- নায়িকার বৃষ্টি ভেজা দৃশ্য, না হয় সমুদ্রে অথবা সুইমিংপুলে দাপাদাপি, নয়তো বাথরুমে ঝর্নার নীচে অথবা বাথটাবে জড়াজড়ি। এ ছাড়া বেড সিনের সং, আইটেম সং এসব তো আছেই। বোম্বের একজন নায়ক আছে তাঁর খুব পছন্দের। নায়ক ইমরান হাশমি। এই নায়কটা ঠোঁটের ব্যবহার ভাল জানে। অত্যন্ত গুণী নায়ক।
রাত ঠিক বারোটার সময় কিছুক্ষণের জন্য টিভি বন্ধ করে উঠে পড়েন রাতের খাবারের ব্যবস্থা করতে। রাতে তিনি শুধু আধ লিটার দুধ ছাড়া আর কিছুই খান না। দুধ গরম করে নিয়ে এসে আবার টিভির সামনে বসেন। ডিভিডি অন করে পর্নো সিডি চালু করে দেন। শুরু হয়ে যায় মিডনাইট শো।
গ্লাসে অথবা মগে দুধ নিয়ে বিছানায় শুয়ে আরাম করে খাওয়া যায় না। এজন্য তিনি বাচ্চাদের একটা ফিডার কিনে নিয়েছেন। আধলিটারের ফিডার। বিছানায় শুয়ে ফিডার চুষতে-চুষতে পর্নো ভিডিও দেখার মজাই অন্যরকম! বেশির ভাগ সময়ই ফিডার মুখে পর্নো ভিডিও দেখতে-দেখতেই তিনি গভীর ঘুমে তলিয়ে যান। ঘুমে তলিয়ে যেতে-যেতে তাঁর মনে হয় জীবনটা খুব একটা মন্দ নয়। বেশ সুখেই আছেন তিনি।
এক
পরপর দু’বার কলিংবেলটা বেজে উঠল। সেই শব্দে এনায়েত হোসেনের ঘুম ভেঙে গেল।
এনায়েত হোসেন বালিশের নীচে হাতড়ে মোবাইল ফোনটা বের করলেন। ফোনের একটা বাটনে চাপ দিয়ে চোখের সামনে এনে দেখেন, মাত্র ছয়টা বাজে। তিনি ভেবে পাচ্ছেন না, এত ভোরে কে জ্বালাতন করতে এসেছে। তিনি অত্যন্ত আত্মকেন্দ্রিক মানুষ। নিজেকে নিয়েই থাকেন। কারও সঙ্গেই তেমন মেশেন না। আত্মীয়-স্বজন-পরিচিতজন যারা আছে দীর্ঘদিন তাদের কারও সঙ্গে যোগাযোগ নেই। শুধু বিদেশে থাকা দু’মেয়ের সঙ্গে মাঝে-মাঝে মোবাইল ফোনে কথা হয়।
এই অসময়ে কে আসবে? বেআক্কেলটা কে? ভোরবেলার স্বর্গীয় ঘুমটা ভাঙিয়ে দিল! কী সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখছিলেন! পড়ন্ত বিকেলে সানি লিওনের সঙ্গে হাত ধরাধরি করে পার্কে হাঁটছেন। সন্ধ্যার পর সানি লিওনকে নিয়ে বাসায় ফিরলেন। রাতটা একসঙ্গেই কাটাবেন। অবশ্য সানি লিওনকে সন্তুষ্ট করার বয়স তাঁর নেই।
কলিংবেলটা আবার পরপর দু’বার বেজে উঠল।
এনায়েত হোসেন আলস্য ঝেড়ে উঠে বসলেন। হাই দিতে- দিতে আড়মোড়া ভাঙলেন। বেড সাইড টেবিলের উপর থেকে চশমাটা নিয়ে পরলেন।
দরজা খুলে দেখেন, সামনে দাড়িওয়ালা, পাঞ্জাবি পরা এক লোক দাঁড়িয়ে রয়েছে। কাঁধে কবিদের মত ঝোলানো ব্যাগ। ধূর্ত চেহারা। বয়স আনুমানিক ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ।
এনায়েত হোসেনের মেজাজটা আরও বিগড়ে গেল। নিশ্চয়ই সাহায্য-টাহায্য কিছু একটা চাইতে এসেছে। আজকাল এ ধরনের লোকের অভাব নেই। পথে-ঘাটে, বাসা-বাড়িতে, যেখানে- সেখানে এদের মুখোমুখি হতে হয়। টাকার অভাবে মেয়ের বিয়ে দিতে পারছে না। অথবা চিকিৎসা করাতে পারছে না। কিডনি নষ্ট, ব্লাড ক্যান্সার আরও কত কী। অনেকে আবার বলে আত্মীয়- স্বজন কেউ মারা গেছে, টাকার অভাবে দাফন-কাফন করতে পারছে না। যত সব ভেলকিবাজি। তাই বলে একেবারে কাক ডাকা ভোরে!
এনায়েত হোসেন ভুরু কুঁচকে বিরক্ত মুখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী চাই?’
লোকটা ধপ করে নুয়ে তাঁর পা ছুঁয়ে সালাম করে উঠে বলল, ‘আমি হুসেইন জুলকার।’
এনায়েত হোসেনের বিরক্তি আরও বেড়ে গেল। অনেক কষ্টে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রেখে আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘তা কী চাই?’
লোকটা বলল, ‘নারিন্দাপুর থেকে এসেছি। সিরাজ ছার আফনেরে একখানা চিঠি পাঠাইছেন। নারিন্দাপুর হাইস্কুলের হেডমাস্টার সিরাজ ছার।’
নারিন্দাপুর এনায়েত হোসেনের গ্রামের বাড়ি। আর নারিন্দাপুর হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক সিরাজউদ্দিন তাঁর ছোটবেলাকার বন্ধু।
এনায়েত হোসেন বললেন, ‘কই, দেখি চিঠিটা।’
লোকটা তার কাপড়ের ব্যাগের ভিতর হাতড়ে চিঠি বের করে এনায়েত হোসেনের হাতে দিল।
এনায়েত হোসেন ভাঁজ করা কাগজটা খুলে পড়তে শুরু করলেন-
‘প্রিয় এনায়েত,
আশা করি ভাল আছিস। অনেক দিন হলো দেখা-সাক্ষাৎ নেই। হয়তো ভুলেই গেছিস। আমাদের কথা না হয় বাদই দিলাম, বাবা-দাদাদের কবর জেয়ারত করার জন্যও তো মাঝে- মধ্যে গ্রামে আসতে পারিস। গত দশ-বারো বছরেও গ্রামে আসিসনি। সে যা-ই হোক, মূল কথায় আসি। তোর কাছে জুলকার নামে একজনকে পাঠালাম। লোকটা গ্রামের বাজারে আমার বইয়ের দোকানের কর্মচারী ছিল। ছোট মেয়েটাকে বিয়ে দিতে গিয়ে দোকানটা বিক্রি করে দিতে হয়েছে। তাই জুলকার শহরে চলে যাচ্ছে অন্য কোনও কাজের খোঁজে। শহরে অন্য কোনও কাজ না মেলা পর্যন্ত সে কোথায় থাকবে, কী খাবে—এই ভেবে তোর ঠিকানা দিয়ে পাঠালাম। সম্ভব হলে কিছুদিনের জন্য তাকে একটু আশ্রয় দিস। খুবই বিশ্বস্ত লোক। প্রায় দশ বছর আমার দোকানের কর্মচারী ছিল। কোনও দিনও একটা কানা- কড়িও এধার-ওধার করেনি।
তোর সার্বিক মঙ্গল কামনা করে এখানেই শেষ করছি।
ইতি
তোর বন্ধু সিরাজ
প্রধান শিক্ষক
নারিন্দাপুর হাইস্কুল।
বি. দ্র.: তোর মোবাইল নম্বর জানা নেই বলেই চিঠি পাঠালাম। আমার মোবাইল নম্বর ০১৯১২… ফোন করে যোগাযোগ করিস।’
এনায়েত হোসেন চিঠি থেকে মুখ তুলে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার নাম জুলকার?’
লোকটা হড়বড় করে বলতে লাগল, ‘জে, চাচাজান। হুসেইন জুলকার। আফনের ‘নুনু ফ্রেণ্ড’ আদর করে ডাকতেন জুলু। জুলু সর্দার। আফ্রিকায় নাকি জুলু নামে এক দল উপজাতি আছে। সেই উপজাতিদের সর্দার বানিয়ে দিছিলেন। হা-হা-হা। বহুত সুন্দর নাম। বড় ভাল লাগত। আফনেও ইচ্ছে হইলে আমারে জুলু সর্দার নামে ডাকতে পারেন।’
এনায়েত হোসেনের মেজাজ চটে গেল। লোকটা বেশি কথা বলছে। বাচাল প্রকৃতির লোক তাঁর মোটেই পছন্দ নয়।
তিনি চটা গলায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘নুনু ফ্রেণ্ড মানে কী?’
জুলকার মুখ হাসি-হাসি করে বলল, ‘নুনু ফ্রেণ্ড মানে লেংটা কালের বন্ধু। সিরাজ ছারের কথা বলতেছি। বড় ভাল মানুষ। আমারে বহুত আদর করতেন। তাঁর ছোট মেয়েডারে আমার কাছে বিবাহ দিতে চাইছিলেন। মেয়েডা রাজি হয় নাই। সে নাকি আমার গা থেকে বিচ্ছিরি গন্ধ পায়। আমার ধারে-কাছে আইলেই তার নাকি বমি আসে। আমার সঙ্গে বিয়া হইলে সে নাকি বমি করতে-করতেই মারা যাইত। কন, চাচাজান, এইটা কোনও কথা হইল? বিয়ার কিছুদিন পর এমনিতেই তো মাইয়া লোকের বমির ব্যারাম হয়। বাচ্চা-কাচ্চা পেটে আইলে পর।
সত্যিই জুলকার লোকটার গা থেকে এক ধরনের গন্ধ আসছে। যদি কেউ অনেক দিন ধরে গোসল না করে থাকে, তা হলে যেমন গন্ধ পাওয়া যায় তেমন। ঝাঁজাল টক-টক, বাসি গন্ধ।
এনায়েত হোসেনের ইচ্ছে করছে, ঘাড় ধাক্কা দিয়ে লোকটাকে তাড়িয়ে দিতে। কিন্তু ভদ্রতার খাতিরে পারছেন না। তাতে তাঁর ছোটবেলার গ্রাম্য বন্ধুকে অপমান করা হবে।
এনায়েত হোসেন গম্ভীর গলায় বললেন, ‘শোনো, জুলকার না ফুলকার, আমার সঙ্গে বেশি কথা বলার চেষ্টা করবে না। আমি বেশি কথা পছন্দ করি না। আরও একটা কথা মনে রাখবে…’
এনায়েত হোসেনকে বলে শেষ করতে না দিয়েই জুলকার বলে উঠল, ‘চাচাজান, এক্কেবারে খাঁটি কথা বলছেন। বেশি কথা বলা মোটেই ভাল না। তাতে আয়ু কমে। আয়ু ধরে রাখতে হইলে কম কথা বলা উচিত। কথা যত কম আয়ু তত বেশি। খেয়াল করে দেইখেন, দরকারি কথার চেয়ে অদরকারি কথাই আমরা বেশি বলি। যত সব ফাও প্যাচাল। প্যাঁচাল পাড়তে পাড়তে মুখের ছেপ শুকাইয়া যায়, তারপরও প্যাচাল বন্ধ করি না। মাইয়া লোকে প্যাচাল পাড়ে আরও বেশি। কান ঝালাপালা হইয়া যায়। এই জন্যেই কবি বলে গেছেন, নো ওমেন নো ক্রাই। নাই মেয়ে লোক, নাই কান্না। বহুত দামি কথা। একজন দার্শনিক আবার বলেছেন, পৃথিবীর সব পুরুষরা বোকা নয়, কিছু-কিছু পুরুষ অবিবাহিত। বলদা দার্শনিক বিয়ার বুঝবে কী? বিয়ায় যে কত্ত মজা, খালি খাওন আর খাওন! চাচাজান, সত্যি কইরা বলেন, এই বয়সেও আফনের আবার বিয়া করতে মন চায় না?’
এনায়েত হোসেন ধমকে উঠলেন, ‘চুপ, একদম চুপ। আর একটা কথা বললে মুখ সেলাই করে দেব। বাচাল কোথাকার! থাকার ঘর দেখিয়ে দিচ্ছি। এখানে যত দিন থাকবে চেষ্টা করবে আমার সামনে কম পড়তে।’
.
বসার ঘরের পাশে একটা ঘরে জুলকারকে থাকতে দিলেন এনায়েত হোসেন।
জুলকার তার থাকার ঘরে ঢুকে প্রথমেই বলল, ‘চাচাজান, বেশুমার খিদা লাগছে। কাইল ভোরে নারিন্দাপুর থেকে রওনা দিয়া হাঁটতে-হাঁটতে এই আইসা পৌছাইলাম। এইর মইধ্যে পেটে আর কিছুই পড়ে নাই। খিদায় এখন জান যায়। ঘরে কিছু থাকলে খাইতে দেন।’
এনায়েত হোসেন বললেন, ‘তুমি হেঁটে এসেছ?’
‘জে, চাচাজান।’
‘বাসে বা লঞ্চেও তো আসতে পারতে। সঙ্গে টাকা ছিল না?’
‘টাকা ছিল। আফনের ফ্রেণ্ড সিরাজ ছার যাতায়েত খরচের জন্য পাঁচশো টাকা সঙ্গে দিয়ে দিছিলেন। আমিই ইচ্ছা কইরা হাঁইটা আসছি। যন্ত্রের ব্যবহারে আমার নিষেধ আছে।’
‘কার নিষেধ আছে?’
জুলকার মিটমিট করে হেসে বলল, ‘আছে, একজনের নিষেধ আছে। আফনে বোঝবেন না।’
এনায়েত হোসেন বিরক্ত গলায় বললেন, ‘নয়টা-সাড়ে নয়টার দিকে রেস্টুরেন্ট থেকে নাস্তা আসবে। তার আগে খেতে চাইলে রান্নাঘরে চলে যাও। আলু-পিঁয়াজ-ডিম-ময়দা-নুডল্স্ সবই রাখা আছে। যা খুশি রান্না করে খাও।’
জুলকার বলে উঠল, ‘আগুনের কাছে যাওয়ায়ও নিষেধ আছে।’
এনায়েত হোসেন অসহিষ্ণু গলায় বললেন, ‘আগুনের কাছে যাওয়ায়ও নিষেধ আছে?’
‘জে, চাচাজান, আগুন-পানি সব কিছুতেই নিষেধ আছে।’ এনায়েত হোসেন ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ‘সব কিছুতেই যখন নিষেধ আছে তা কী আর করবে? বসে-বসে আঙুল চোষো। আঙুল চুষতে না চাইলে অন্য কিছুও চুষতে পারো।’
জুলকার আহ্লাদী গলায় বলল, ‘চাচাজান, যদি কিছু মনে না নেন-আমারে যদি একটা ডিম পোস, এক গেলাস গরম দুধ আর সঙ্গে দু’-এক পিচ বিস্কুট দিতেন বড়ই আনন্দ পেতাম। আপাতত পেটটারে জামিন দিতাম।’
এনায়েত হোসেন কিছু না বলে বড় করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চলে গেলেন। বোঝাই যাচ্ছে এই উজবুকটা তাঁকে জ্বালিয়ে মারবে। আহাম্মকটাকে যত দ্রুত বাড়ি থেকে তাড়ানো যায় সে চিন্তা করতে হবে।
দুই
সপ্তাহ খানিক কেটে গেছে।
জুলকারের জ্বালাতনে এনায়েত হোসেন পাগলপ্রায়। সারাক্ষণ বক-বক করতেই থাকে। সে সঙ্গে আরও কিছু কাজ করে যাতে এনায়েত হোসেনের মেজাজ ঠিক রাখতেই কষ্ট হয়।
জুলকার তার পরিধেয় পোশাক খুলে বসার ঘরের সোফায় মেলে রাখে। হয়তো সোফার টি-টেবিলের উপর রাখে তার ক্ষয়ে যাওয়া জুতো জোড়া। সোফার হাতলে ঝোলে রঙজ্বলা বিবর্ণ আণ্ডারওয়্যার আর বিকট দুর্গন্ধযুক্ত মোজা জোড়া। সোফার গদিতে বিছানো পাঞ্জাবি-পাজামা আর শত ব্যবহৃত তিল পড়া স্যাণ্ডো গেঞ্জি। স্যাণ্ডো গেঞ্জি থেকে আসে কটু ঘামের গন্ধ।
আরেকটা কাজ করে যা সহ্যসীমার বাইরে। হয়তো এনায়েত হোসেনের সঙ্গে বক-বক করছে, হঠাৎ একটু থেমে চোখ-মুখ কুঁচকে শক্ত করে ভ-ভ-দ শব্দে বায়ু ত্যাগ করে। সে কী বিচ্ছিরি দুর্গন্ধ! গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়। রুম ছেড়ে পালাতে হয় এনায়েত হোসেনকে।
এনায়েত হোসেন ধমক দিয়ে বলেছিলেন, ‘এই কাজটা তুমি অন্য রুমে বা বাথরুমে গিয়ে করতে পারো না? আমার সামনেই করতে হয়!’
জুলকার মুখ হাসি-হাসি করে বলে, ‘চাচাজান, কী করমু বলেন, এই এক বদ অভ্যেস-কেউ সামনে না থাকলে একলা- একলা বাতাস আসে না। বাতাস ছাড়ার পর কী যে আরাম পাই বইল্যা বুঝাইতে পারমু না। বহুত আরাম! পেটটা হালকা-হালকা লাগে। চাচাজানেরও নিশ্চয়ই মাঝে-মইধ্যে এইভাবে পেট হালকা করতে হয়, ঠিক না, চাচাজান?’
আরও একটা কুৎসিত কাজ করে। নাকের ফুটোয় আঙুল ঢুকিয়ে হাতড়ে পট করে লোম ছিঁড়ে আনে। সেই লোম চোখের সামনে ধরে গভীর মনোযোগে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে। এরপর কায়দা করে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে ফেলে দেয়। গা ঘিন-ঘিন করে ওঠে এনায়েত হোসেনের।
এ ছাড়া ঘরের যেখানে-সেখানে, থুথু-কফ ফেলা। বিছানার চাদরে, জানালার পর্দায়, পাঞ্জাবির হাতায় যেখানে ইচ্ছে সর্দি মোছা। টয়লেটের প্যানের উপরে টয়লেট করে মেখে রাখা। ঘরের দেয়ালে পানের পিক ফেলা। জ্বালাতনের আর শেষ নেই!
এনায়েত হোসেন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কিছু টাকা-পয়সা দিয়ে হলেও এই আপদ তিনি বিদেয় করবেন। বনমানুষ ঘরে নিয়ে বাস করার কোনও মানে হয় না।
জুলকার এই মুহূর্তে এনায়েত হোসেনের সামনে সোফায় বসে আছে। হাতে সিনেমা ম্যাগাজিন। বিশাল বক্ষা এক নায়িকার ছবি চোখের সামনে মেলে ধরা। আরও একটা কাজ করছে। মেঝেতে থুথু ফেলে পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলের ডগা দিয়ে সেই থুথু ডলছে আর দার্শনিকদের মত করে বলছে, ‘চাচাজান, একটা বিষয় লক্ষ করেছেন, পুরুষলোকের নজর মাইয়া লোকের বুকের দিকে যাইবেই। কী আছে ওই বুকে? খালি চাইয়া থাকতে ইচ্ছা করে।’
এনায়েত হোসেন ভারী গলায় বললেন, ‘শোনো, জুলকার, আমি তোমাকে এক মাসের থাকা-খাওয়ার খরচ দিয়ে দিচ্ছি। সেই টাকা নিয়ে এই মুহূর্তে তুমি আমার বাড়ি থেকে বিদেয় হবে।’
জুলকার চোখ বড় করে বলল, ‘কী কইলেন, চাচাজান, টাকা নিয়া বিদেয় হমু! টাকা দিয়া কী হইব?! টাকা হইল হাতের ময়লা! ময়লা দিয়া পকেট ভরার কোনও মানে হয় না।’
এনায়েত হোসেন মরিয়া গলায় বললেন, ‘তুমি, বাপু, টাকা নাও আর না নাও, বিদেয় হও। আমার ঘাড় থেকে নামো।’
জুলকার স্বাভাবিক গলায় বলল, ‘এতদিন ধরে আফনের নুন খাই, ঋণ শোধ না কইরা বিদেয় হই ক্যামনে?! ঋণ শোধ হইলেই বিদেয় হমু।’
‘তোমার ঋণ শোধের দরকার নেই। আমার কোনও দাবি নেই। বিদেয় হলেই খুশি হব।’
‘না, চাচাজান, ঋণ শোধ না কইরা যাওন যাইবে না। নিষেধ আছে। মারেন-কাটেন যা-ই করেন, ঋণ শোধ না কইরা যামু না।’
এনায়েত হোসেন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘তা তুমি কীভাবে ঋণ শোধ করতে চাও? আগুন-পানি সব কিছুতেই তোমার নিষেধ আছে। কোনও কাজ করে যে ঋণ শোধ করবে সে উপায়ও তো নেই।’
জুলকার ভাব নিয়ে বলল, ‘চাচাজান, আমি কিন্তু ছবি আঁকতে জানি।’
এনায়েত হোসেন টিপ্পনি কেটে বললেন, ‘মানে আর্টিস্ট! লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি!’
‘চাচাজান, আর্টিস্ট-ফার্টিস্ট বুঝি না, ছবি আঁকতে জানি।’ ‘তা হলে ছবি এঁকে ঋণ শোধ করতে চাইছ?’
‘জে, চাচাজান।’
‘কাগজ-কলম এনে দিচ্ছি, এখনই একটা ছবি এঁকে বিদেয় হও।’
‘কাগজ-কলম-পেন্সিল-রঙ-তুলি এসব কিছুই আমি ছবি আঁকতে ব্যবহার করি না। আমার পদ্ধতি সম্পূর্ণ ভিন্ন।
‘তুমি কি তা হলে ইটের টুকরো দিয়ে দেয়ালে ছবি আঁকো?’ ‘না, চাচাজান, আমার ছবি আঁকতে জাফরান কালি, মেশকে আম্বর, কস্তুরী, সাদা কাকের পালক, আয়না এসব লাগে।’
‘শোনো, বাপু, তোমার ছবি আঁকার দরকার নেই। ভালয়- ভালয় বিদেয় হও।’
জুলকার নাছোড়বান্দা গলায় বলল, ‘চাচাজান, আফনেরে একটা ছবি এঁকে না দিয়ে আমি কিছুতেই যামু না। তা মারেন- কাটেন যা-ই করেন।’
এনায়েত হোসেন দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ভুল যা করার আগেই করেছেন, আপদটাকে ঘরে জায়গা দিয়ে। লোকজন ডেকে এনে কান ধরে হিড়-হিড় করে টানতে-টানতে বাড়ি থেকে বের করে দিলে কেমন হয়?
এনায়েত হোসেন বসে-যাওয়া হতাশ গলায় বললেন, ‘ছবি আঁকতে কী-কী যেন লাগবে বললে?’
‘জাফরান কালি, মেশকে আম্বর, কস্তুরী, আয়না। ছোট্ট পকেট আয়না হলেই চলবে। আর সাদা কাকের পালক আমার কাছেই আছে।’
‘এসব পাওয়া যাবে কোথায়?’
‘চকবাজার গিয়ে খোঁজ করবেন। পেয়ে যাবেন।’
‘ছবি আঁকা হলে তুমি চলে যাবে তো?’
‘আলবত, চাচাজান, ছবি আঁকা শেষ হইলেই চইল্যা যামু। এক দিনও আর থাকমু না।’
তিন
এনায়েত হোসেন জুলকারের দেয়া লিস্ট মোতাবেক জাফরান কালি, মেশকে আম্বর, কস্তুরী, ছোট্ট পকেট আয়না-এসব কিনে এনেছেন। এগুলোর যে এত দাম তা তাঁর ধারণায় ছিল না। অনেকগুলো টাকা চলে গেছে। তাতেও তাঁর আফসোস নেই, ছবি এঁকে যদি আপদ বিদেয় হয় সেটাই বড় পাওয়া।
এনায়েত হোসেন ওসব জুলকারের হাতে দিয়ে বললেন, ‘সব কিছু জোগাড় করে এনেছি, এখন যা ইচ্ছে একটা এঁকে বিদেয় হও।’
‘না, চাচাজান, যা ইচ্ছা তা তো আঁকা যাবে না। নিে আছে।’
এনায়েত হোসেন অসহিষ্ণু গলায় বললেন, ‘ছবি আঁকতেও বিধি-নিষেধ আছে?! তোমার পায়ে পড়ি আমায় রেহাই দাও।’
‘চাচাজান, এইটা আফনে কী কইলেন! আফনে মুরব্বি মানুষ, আফনে পা ধরতে যাইবেন ক্যান? ছিঃ! আমি ছবি এঁকেই চলে যামু। কথা দিচ্ছি ছবি আঁকা শেষ হইলে এক মুহূর্তও আর থাকমু না।’
এনায়েত হোসেন শান্ত গলায় বললেন, ‘আচ্ছা, ঠিক আছে, তুমি তোমার মন মতন ছবি আঁকো। আমি আর কিছুই বলব না।’
‘চাচাজান, আমি শুধু মানুষের ছবি আঁকি। অন্য কোনও কিছুর ছবি আঁকি না।’
এনায়েত হোসেন ফোড়ন কাটার ভঙ্গিতে বললেন, ‘তুমি কি এখন সুন্দরী মডেল কন্যা চাইছ? সেই মডেলকে ব্রা-প্যান্টি পরিয়ে সামনে বসিয়ে ছবি আঁকবে?’
‘না, চাচাজান, মডেল-ফডেল লাগবে না। যার-তার ছবি আমি আঁকি না। শুধু যারে পছন্দ হয় তার ছবি আঁকি। আমি আফনের ছবি আঁকমু। আফনেরে আমার পছন্দ হইছে। বহুত পছন্দ হইছে।’
‘আচ্ছা, আমার ছবি আঁকো। যত ইচ্ছে আঁকো। তারপর বিদেয় হও।’
‘তিন দিন পর পূর্ণিমা। সেই রাইতেই আফনের ছবি আঁকমু।’
‘ছবি আঁকতে আবার পূর্ণিমা লাগবে কেন?’
‘পূর্ণিমা রাইত ছাড়া ছবি আঁকায় নিষেধ আছে।’
এনায়েত হোসেন নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ‘ও, আচ্ছা!’
চার
পূর্ণিমা রাত।
এনায়েত হোসেন ছাদে চাঁদের আলোয় বেতের চেয়ারে বসে আছেন। জুলকার তাঁর কাছ থেকে ছয়-সাত হাত দূরে। ছোট্ট পকেট আয়নাটা এনায়েত হোসেনের দিকে তাক করে, আয়নার পিছনে পারার উপর সাদা কাকের পালকের ডগা দিয়ে ছবি আঁকছে।
রাত আড়াইটার মত বাজে। এনায়েত হোসেনের ঘন-ঘন হাই উঠছে। ঘুমে তাঁর চোখ জড়িয়ে আসছে। জেগে থাকতে খুব কষ্ট হচ্ছে। জুলকারের ছবি আঁকা শেষ করতে নাকি সারা রাত লেগে যাবে। আঁকা শেষ হলেই ভোরবেলা সে চলে যাবে। এজন্য এনায়েত হোসেনের মনে এক ধরনের চাপা আনন্দ হচ্ছে। আনন্দের কারণেই এখনও তিনি জেগে থাকতে পারছেন।
শত চেষ্টা সত্ত্বেও শেষ রাতের দিকে এনায়েত হোসেন ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। ঘুম ভাঙল জুলকারের ডাকে। চোখ মেলে দেখেন চারদিক ফর্সা হয়ে গেছে। পুবের আকাশে লাল সূর্যটা জেগে উঠছে।
জুলকার বলল, ‘আপনার ছবি আঁকা হয়ে গেছে।’
এনায়েত হোসেন আড়মোড়া ভাঙতে-ভাঙতে বললেন, ‘কই দেখি, সারা রাত ধরে কী আঁকলে?’
জুলকার আয়নাটা এনায়েত হোসেনের হাতে দিল।
জুলকারকে কেমন চুপচাপ গম্ভীর দেখাচ্ছে। আগের মত চেহারায় বাচাল ছাপটা আর নেই। সে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে আছে। যে পোশাকে এসেছিল সেই পোশাক পরেছে। কাঁধে ঝোলানো কাপড়ের ব্যাগটা।
এনায়েত হোসেন আয়নার পিছনে পারার উপর লাল কালিতে ধোঁয়ার মত কুণ্ডলী পাকানো এক গুচ্ছ আঁকিবুকি দেখতে পাচ্ছেন। যেন কোনও বাচ্চা আপন মনে লাল কলম দিয়ে দাগিয়েছে। এর মানে কী! রাম ছাগলটা কি তাঁর সঙ্গে রসিকতা করল?
এনায়েত হোসেন রাগান্বিত গলায় বললেন, ‘এ কোন্ কাকের ঠ্যাং-বকের ঠ্যাং এঁকেছ?! ফাজলামির আর জায়গা পাওনি! বেরো, হারামজাদা, এখনই আমার বাড়ি থেকে বেরো।’
জুলকার গম্ভীর গলায় বলল, ‘আপনার ছবি তো আয়নার পিছনে পারায় দেখা যাবে না, দেখা যাবে আয়নার সামনে। আয়নাটা ঘুরিয়ে মুখের সামনে ধরে দেখুন, নিজেকে দেখতে পাবেন।’
এনায়েত হোসেন আয়নাটা ঘুরিয়ে আয়নায় নিজেকে দেখতে পেলেন। সাধারণত আয়নায় যেভাবে নিজের চেহারা দেখতে পাওয়া যায় তেমন। তিনি গর্জে উঠলেন, ‘আবার ইয়ার্কি মারিস, ফাজিল? আয়নায় চেহারা দেখতে পাওয়া তো স্বাভাবিক ব্যাপার। এটা ছবি হয় কীভাবে? দূর হ, হারামজাদা, এখনই আমার সামনে থেকে দূর হ।’
জুলকার বলল, ‘ভাল করে খেয়াল করে দেখুন, অন্য সব আয়নায় নিজেকে যেমন দেখায়-এই আয়নায়ও কি নিজেকে সেরকম লাগছে? সাধারণ আয়নায় দেখা যায় নিজের প্রতিবিম্ব। অর্থাৎ মিরর ইমেজ। এই আয়নায় দেখতে পাচ্ছেন আপনি যেমন, তেমনই। প্রতিবিম্ব নয়। পার্থক্যটা ধরতে না পারলে আরেকটি আয়না এনে পাশাপাশি রেখে চেহারা মিলিয়ে দেখুন।’
এনায়েত হোসেন হাতে ধরা আয়নায় নিজের মুখ ভাল করে লক্ষ্য করে দেখলেন, সত্যিই কিছু একটা পার্থক্য রয়েছে। নিজেকে কেমন নতুন-নতুন লাগছে। যেন অপরিচিত কেউ।
এনায়েত হোসেন নরম গলায় বললেন, ‘এই আয়নাটায় নিজেকে অন্য রকম লাগার কারণ কী?’
জুলকার থমথমে গলায় বলতে লাগল, ‘এটা এখন আর সাধারণ কোনও আয়না নয়। মন্ত্রপূত আয়না। দেবতা আনুবিসের আশীর্বাদপুষ্ট আয়না। মৃতদের সংরক্ষক দেবতা আনুবিস। সাধারণত দেবতা আনুবিস শুধু মৃতদের সংরক্ষণ করে। বংশ পরম্পরায় আমরা সেই আনুবিস দেবতার উপাসনা করে কীভাবে জীবিতদের সংরক্ষণ করা যায় সেই ক্ষমতা অর্জন করেছি। আপনার এই আয়না আপনাকে সংরক্ষণ করবে। যতদিন এই আয়নাটা থাকবে আর এই আয়নায় আপনি মুখ দেখবেন, ততদিন আপনার মৃত্যু নেই। এবং এই মুহূর্তে নিজেকে যেমন দেখতে পাচ্ছেন তেমনই থাকবেন। বয়স আর বাড়বে না। ফটো অথবা ছবিতে যেমন কারও বয়স বাড়ে না। যে বয়সের ফটো বা ছবি আঁকা হয় তেমনই রয়ে যায়। হাজার বছর পরও একই রয়ে যায়। অবশ্য আরও কিছুদিন সময় পেলে আপনার বয়স কমিয়ে দিতে পারতাম। যুবক বানিয়ে দিতেও পারতাম। চিত্রশিল্পীরা যেমন অনেক সময় বয়স্ক কারও বর্তমান চেহারা দেখে অনেক খেটেখুটে তার অল্প বয়সের ছবি এঁকে দেয়।’
এনায়েত হোসেন মনে-মনে বললেন, যত্ত সব বুজরুকি! ছবি এঁকে অমর বানিয়ে দেয়! বয়স কমিয়ে যুবক করে দেয়। ধান্ধাবাজির আর জায়গা পায়নি!
জুলকার আবার বলতে লাগল, ‘আপনার বোধহয় আমার কথা বিশ্বাস হয়নি।’ তার কাঁধে ঝোলানো কাপড়ের ব্যাগের ভিতর হাতড়ে আর একটা ছোট্ট আয়না বের করে বলল, ‘এই দেখুন, আমার নিজেরও একটা আয়না আছে। এই আয়নায় যতদিন মুখ দেখব ততদিন আমার মৃত্যু নেই। আমি একজন মিশরীয়। ছয়শো অথবা পাঁচশো বছর আগের কথা। অনেক দিন আগের কথা তো, তাই বছরের হিসেবটা ঠিক মত বলতে পারছি না। মিশর থেকে পালিয়ে আপনাদের এই ভারতবর্ষে চলে এসেছিলাম। মিশরের এক ফারাও আমাকে দিয়ে তাঁর ছবি আঁকিয়েছিলেন। এরপর তাঁর আর মৃত্যু নেই। ওদিকে তাঁর সন্তানেরা বড় হয়ে ক্ষমতার লোভে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। কিছুতেই ফারাও মারা যাচ্ছেন না আর তারাও ক্ষমতা পাচ্ছে না। এক সময় তারা এই অমরত্বের আয়নার কথা জানতে পারে। আয়নাটাকে নষ্ট করে ফারাওর মৃত্যু নিশ্চিত করে। সেই সঙ্গে আমাকেও খুঁজতে শুরু করে মেরে ফেলার জন্য। যাতে কেউ আর নিজের অমরত্বের আয়না বানাতে না পারে। আমি তখন নিজ দেশ ছেড়ে পালিয়ে চলে আসি।
এনায়েত হোসেন বললেন, ‘বুজরুকি অনেক শুনলাম। এখন তোমার দাবি-দাওয়া বলো। টাকা-পয়সা কত চাও?’
জুলকার স্মিত হেসে বলল, ‘আগেই তো বলেছি, টাকার কোনও মূল্য নেই আমার কাছে। আপনার ছবি এঁকেছি আপনাকে পছন্দ হয়েছে বলে। আপনার ভিতরে আছে প্রবল ইচ্ছেশক্তি। বেঁচে থাকার প্রাণশক্তি। আজকালকার বেশিরভাগ মানুষই হচ্ছে হতাশাগ্রস্ত। প্রত্যেকেই জীবনের কোনও না কোনও সময় হতাশায় জর্জরিত হয়ে ভাবে, বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াটাই ভাল। ভেবে দেখুন তো, আপনি কি কখনও এমনটা ভেবেছেন? না, ভাবেননি। এজন্যেই আপনাকে বেছে নিয়েছি। আপনার ছবি এঁকেছি। আপনার মৃত্যুকে আপনার হাতে বন্দি করে দিয়েছি। আপনি এখন যতদিন ইচ্ছে নিজের মৃত্যুকে ঠেকিয়ে রাখতে পারবেন।’
পরিশিষ্ট
জুলকারের বলা কোনও কথাই বিশ্বাস করেননি এনায়েত হোসেন। এরপরও রোজই সেই ছোট্ট আয়নাটায় তাঁর মুখ দেখা হচ্ছে। কোনও অজ্ঞাত কারণেই যেন হচ্ছে। সত্যি কথা বলতে অন্যান্য আয়নার চেয়ে ওই আয়নাটায় মুখ দেখতে কেন জানি ভাল লাগে। নিজেকে ভিন্ন মানুষ মনে হয়।
.
বহু বছর কেটে গেছে। এনায়েত হোসেনের মেয়েরা বুড়ো হয়ে মারা গেছে। এনায়েত হোসেনের বয়স একশো ছাড়িয়েছে অনেক আগেই। এখন আর তিনি বয়সের হিসেব রাখেন না। কিন্তু আজও তিনি সেই একই রকমের রয়ে গেছেন। যেন তাঁর বয়স ষাট বছরেই আটকে গেছে।
আজকাল মাঝে-মাঝে এনায়েত হোসেনের খুব অনুশোচনা হয়। জুলকার লোকটার সঙ্গে অতটা খারাপ ব্যবহার করা তাঁর মোটেই ঠিক হয়নি। ওভাবে দূর-দূর করে তাড়িয়ে না দিলেও পারতেন। সাংঘাতিক ভুল হয়ে গেছে! আরও কয়েকটা দিন থাকতে দিলে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হত! সময় দিয়ে তাঁর যুবক চেহারার ছবি আঁকিয়ে নিলেই পারতেন। কত ভাল হত!
আরেকবার কি জুলকার লোকটার দেখা পাওয়া যায় না? কোথায় রয়েছে লোকটা? ভারতবর্ষে, না তার নিজ দেশ মিশরে চলে গেছে?
এনায়েত হোসেন আশায় বুক বেঁধে আছেন, নিশ্চয়ই কোনও এক দিন আবার জুলকার লোকটার দেখা পাবেন। তিনি হতাশায় ডুবে থাকার মানুষ নন। আশা নিয়ে বেঁচে থাকতে পছন্দ করেন।