নীল নয়না

নীল নয়না

প্রস্তাবনা

আমজাদ হোসেন নতুন একটা বাড়ি কিনেছেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের ছোট্ট পাহাড়ের বুকে একতলা বাংলো বাড়ি। বাড়িটা কেনা হয়েছে অবসর যাপনের জন্য।

আমজাদ হোসেন একজন নামকরা শিল্পপতি। তাঁর টাকার কোনও অভাব নেই। অভাব শুধু সময়ের। অবসর যাপনের জন্য এই বাড়িটা কেনা হলেও, তাঁর নিজের কোনও দিনও অবসর যাপন হবে কি না সে নিশ্চয়তা নেই।

তাঁর একমাত্র ছেলে রাতুল। রাতুল ঢাকা ভার্সিটি থেকে পাশ করে বেরিয়েছে। আমজাদ হোসেন রাতুলকে তাঁর সঙ্গে ব্যবসার দেখাশোনায় লেগে পড়তে বলেছেন। রাতুল রাজি হয়নি। রাতুলের কোনও কাজেই মন নেই। সারাক্ষণ কেমন মনমরা হয়ে থাকে। আমজাদ হোসেনও ছেলের উপর তেমন জোর করেন না। একমাত্র ছেলে তাঁর, এত ধন-সম্পদ-সারা জীবনে ছেলে কিছু না করলেও রাজার হালে চলতে পারবে।

রাতুলের মা নেই। বলা যায় মা থাকতেও নেই। রাতুলের বয়স যখন আট-ন’ বছর তখন তার মা আমজাদ সাহেবকে ডিভোর্স দিয়ে আমজাদ সাহেবের এক বন্ধুর হাত ধরে চিরদিনের জন্য অস্ট্রেলিয়া পাড়ি জমায়। সেই থেকে রাতুল মায়ের আদর- ভালবাসা ছাড়া একা-একা বড় হয়েছে। চাকর-বাকরদের হাতে ছিল তার দেখাশোনার দায়িত্ব। আমজাদ সাহেবও তেমন একটা খেয়াল নিতে পারেন না। তাঁর সেই সময় কোথায়? তাঁকে সব সময় ডুবে থাকতে হয় ব্যবসা পরিচালনায়।

মায়ের ভালবাসা আর বাবার স্নেহ ছাড়া বড় হওয়া রাতুল অন্য সবার চেয়ে একদম আলাদা। তার স্বভাব অসম্ভব রকমের চুপচাপ, গম্ভীর ধরনের। তার কোনও বন্ধু-বান্ধব নেই। নেই কোনও শখের কাজ। সারাক্ষণ শুধু বিষণ্ন-উদাস হয়ে থাকে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের বাংলো বাড়িটা কেনার পর আমজাদ সাহেব রাতুলকে কিছু দিনের জন্য নতুন বাড়িটায় বেড়িয়ে আসতে বলেছেন। রাতুল প্রথমে রাজি হতে চায়নি। তখন তিনি অনেকভাবে ছেলেকে বোঝালেন-

পাহাড়ের বুকে কিছু দিন কাটাতে খুব ভাল লাগবে তার। বিষণ্নতা দূর হবে। মনে ফুরফুরে ভাব আসবে। এ ছাড়া জায়গাটাও একেবারে নিরিবিলি। পাহাড়ের চারশ’ ফুট উপরে। আশপাশে আর কোনও বাড়ি-ঘর নেই। পরিবেশও খুব মনোরম। নীরব-নির্জনতার মাঝে পাখিদের কলকাকলি, বাতাসের ফিসফিসানি, সবুজ বনানীর ছায়া, পাহাড়ি বুনো ফুলের সৌরভ-যেন স্বর্গীয় প্রকৃতি।

শেষ পর্যন্ত রাতুল রাজি হয়ে গেল। যে বিষয়টা তাকে আকৃষ্ট করেছে তা হলো জায়গাটা নিরিবিলি। নির্জনতা তার খুবই পছন্দের। মাঝে-মাঝেই সে ভাবে, যদি সে কোনও এক অচেনা, নিঝুম দ্বীপে চলে যেতে পারত! সেখানে সঙ্গে থাকবে না কেউ থাকবে না সভ্য পৃথিবীর কোনও কিছুই। আদিম মানুষের মত গুহায় বাস করবে। পাথরে পাথর ঘষে আগুন জ্বালবে। জঙ্গল থেকে ফল পেড়ে, বুনো জন্তু শিকার করে, সমুদ্র থেকে মাছ ধরে খাবারের চাহিদা মেটাবে। কথা বলবে গাছের সঙ্গে, সমুদ্রের সঙ্গে, মেঘের সঙ্গে, আকাশের সঙ্গে-অথবা নিজের সঙ্গে।

এক

ভাদ্র মাসের মাঝামাঝি সময়। রাতুল এখন পার্বত্য চট্টগ্রামের হিলামছড়িতে। বিরংকোট পাহাড়ের নীচে। বাস এখানেই তাকে নামিয়ে দিয়েছে। তার গন্তব্য এই পাহাড়েরই চারশ’ ফুট উপরে তাদের নতুন কেনা বাংলো বাড়িতে।

এই পাহাড়ে কোনও যানবাহন ওঠে না। যানবাহন ওঠার মত বাঁধানো রাস্তাই নেই। একমাত্র উপায় পায়ে হেঁটে ওঠা। ফিতের মত আঁকাবাঁকা সরু পথ উপরে উঠে গেছে।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। আগে থেকেই আকাশ কালো মেঘে ভারী হয়ে ছিল। এখন বিজলি চমকাতেও শুরু করেছে। সেই সঙ্গে দমকা হাওয়া ছেড়েছে।

রাতুলের কাঁধে একটা বিশাল ব্যাগ। ব্যাগ ভর্তি তার নিত্য প্রয়োজনীয় কাপড়-চোপড়, টুথব্রাশ, টুথপেস্ট, শেভ করার সরঞ্জাম সহ অনেকগুলো বই। বই-ই তার একমাত্র বন্ধু। সে যেখানেই যাক সঙ্গে বই থাকবেই।

রাতুল ভেবে কূল পাচ্ছে না, কারও সাহায্য ছাড়া এত ভারী ব্যাগ কাঁধে নিয়ে সে কী করে পাহাড়ের চারশ’ ফুট উপরে উঠবে। ওদিকে দমকা হাওয়ার বেগ ক্রমেই বাড়ছে। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিজলি চমকাচ্ছে। ঝড়-বৃষ্টি শুরু হতে আর বোধহয় বেশি দেরি নেই। পাহাড়ি পথে হাঁটা এমনিতেই খুব কঠিন। তার উপর বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলে প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে।

রাতুল আর দেরি না করে কাঁধের ভারী ব্যাগটা বয়ে অতি দ্রুত হাঁটা শুরু করল। বৃষ্টি শুরু হওয়ার আগেই তাকে বাংলোতে

[৩৪-৩৫নং পাতা মিসিং]

মেয়েটা রাতুলের ব্যাগটা হাতে নিয়ে বলল, ‘আমার পিঠে হাত রেখে এগোন। না হলে আবার পড়ে যাবেন। ‘

রাতুল মেয়েটার পিঠে হাত রাখতে-রাখতে বলল, ‘তোমার নাম কী?’

মেয়েটা কিছুই বলল না। শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।

.

জঙ্গলের মধ্যে ছোট্ট একটা কুটির। একেবারে ঝকঝকে পরিষ্কার- পরিচ্ছন্ন। একটা পিদিম জ্বলছে। ঘরে তেমন কিছুই নেই। শুধু মাত্র তোশকবিহীন একটা চৌকি, একটা পানি রাখার পাত্র, দুটো মাটির হাঁড়ি, বেড়ায় টাঙানো ছোট্ট একটা আয়না, মেয়েদের সাজসজ্জার কিছু সরঞ্জাম আর পোশাক।

রাতুল কুটিরে ঢুকে প্রথমেই প্রশ্ন করল, ‘তুমি ছাড়া এই কুটিরে আর কেউ থাকে না?’

মেয়েটা বলল, ‘না, আমার বাবা-মা কেউ নেই।’

রাতুল বলল, ‘এই জঙ্গলে একা-একা ভয় লাগে না?’

মেয়েটা বলল, ‘না, ভয় লাগে না। রহস্যময় হাসি দিয়ে বলল, ‘বরং অন্যরা সবাই আমাকে ভয় পায়।’

রাতুল লক্ষ করল, মেয়েটাকে প্রথম দেখায় যতটা সুন্দর মনে হয়েছে, সে তারচেয়েও সুন্দর। টানা-টানা হরিণী চোখ। চোখের মণি নীল। প্রথমে এটা সে খেয়াল করেনি। পিদিমের আলোতে এখন সে মায়াকাড়া নীল চোখজোড়া দেখতে পাচ্ছে।

মেয়েটা বলল, ‘আমি ঘরের বাইরে গিয়ে দাঁড়াচ্ছি, আপনি ব্যাগ খুলে শুকনো পোশাক বের করে পোশাক পাল্টে নিন।’

রাতুল পোশাক পাল্টে নিল। শুকনো পোশাক পরেও তার শীত লাগার অনুভূতি কমছে না। এখনও শীতে অল্প-অল্প কাঁপছে।

মেয়েটা রাতুলকে শীতে কাঁপতে দেখে কুটিরের মধ্যে ছোট্ট করে আগুন জ্বালল। রাতুলকে সেই আগুনের পাশে বসতে বলল।

রাতুল আগুনের পাশে এসে বসল। মেয়েটা লালচে এক ধরনের তরল ভরা ছোট্ট একটা কাচের বয়াম এনে রাতুলের হাতে দিয়ে বলল, ‘নিন, এটা একটু খেয়ে নিন। এটা মধু। ধুতরা ফুলের মধু। এই মধু খেলে আপনার শীত লাগা কমবে। সেই সঙ্গে শরীরের ব্যথার যন্ত্রণাও কম টের পাবেন।

মেয়েটা বয়ামের মুখ খুলে ছোট-ছোট চুমুক দিয়ে মধু খেতে শুরু করল। কী দারুণ স্বাদ! যেন স্বর্গীয় সুরা।

মেয়েটা আগুনের পাশে বসে বুনো আলু পোড়াতে লাগল। বুনো আলু পুড়িয়ে রাতুলকে খেতে দিল। রাতুল আলুর পোড়া খোসা ছাড়িয়ে ভেঙে-ভেঙে খেতে শুরু করল। ভীষণ খিদে পেয়েছে তার। খিদের সময় সব কিছুই খেতে ভাল লাগে। রাতুলের মনে হচ্ছে এই আলুর স্বাদ পৃথিবীর যে-কোনও সুস্বাদু খাবারকেও হার মানাবে।

বৃষ্টি থেমে গেছে। মেয়েটা বলল, ‘চলুন, আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।’

রাতুল জড়ানো গলায় বলল, ‘আচ্ছা, চলো।’

ধুতরা ফুলের মধু খাওয়ায় রাতুলের কেমন নেশা-নেশা লাগছে। তবে এখন আর মোটেও শীত লাগছে না। শরীরের ব্যথা-যন্ত্রণাও তেমন টের পাচ্ছে না।

কুটির থেকে বেরিয়ে তারা পথ চলতে শুরু করল। এখনও পথ যথেষ্ট পিচ্ছিল। রাতুল ঠিক মত হাঁটতে পারছে না। তাই দেখে মেয়েটা বলল, ‘আপনি আগের মত আমার পিঠে হাত রেখে হাঁটুন।’

মেঘ কেটে গিয়ে আকাশে চাঁদ উঠেছে। রূপালী চাঁদের আলোতে সব কিছু কেমন অপার্থিব লাগছে। মেয়েটার পিঠে হাত রেখে হাঁটতে-হাঁটতে রাতুলের মনে হলো, সে এই মেয়েটার প্রেমে

[৩৮-৩৯নং পাতা মিসিং]

‘চাচা, আপনি নাস্তা করেছেন?’

‘হয়, বাবাজী, তা কহন! ফজরের আজানের সময়ই তো ঘুম থেইক্যা উঠি। নামাজ-কালাম কইরা ঘণ্টাখানিকের মইধ্যেই নাস্তা সাইরা নি। বুড়া মানুষ, বেশিক্ষণ খালি প্যাটে থাকতে পারি না।

রাতুল বলল, ‘তা সেই কখন খেয়েছেন, এখন নিশ্চয়ই আবার খিদে পেয়েছে। এখন আবার কিছু খেয়ে নিন।

‘জী, বাবাজী, আফনের খাওয়া শেষ হইলে কিছু একটা খাইয়্যা বাজারের দিকে যামু। ঘরে চাউল-ডাইল অনেক কিছুই নাই।’

রাতুল বলল, ‘আচ্ছা, ঠিক আছে, বাজারে যাবার আগে আমার কাছ থেকে বাজার করার টাকা নিয়ে নিয়েন।’

.

জব্বার মিয়া বাজারে যাবার পর রাতুলও বাংলো থেকে বেরিয়ে পড়ল। রাতুলের মনের মাঝে শুধু গতরাতের নীল নয়নার ভাবনাই ঘুরছে। সে নীল নয়নার সঙ্গে দেখা করতে যাবে। নীল নয়নাকে সে ভালবেসে ফেলেছে! খুউব ভালবেসে ফেলেছে! তাকে না দেখে এখন আর একটি মুহূর্তও থাকতে ইচ্ছে করছে না। ইচ্ছে করছে সারাক্ষণ তার হাত ধরে পাশে বসে থাকতে, চোখে চোখ রেখে না বলা কথাগুলো বলতে, বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরতে।

কী চমৎকার রূপবতী, সহজ, সরল, মমতাময়ী একটা মেয়ে! সে এই নীল নয়নাকেই বিয়ে করবে! আজই সে বিয়ের কথা বলবে। আচ্ছা, তার বাবা কি রাজি হবেন? নিশ্চয়ই হবেন। তার বাবা কখনও তার কোনও কাজে বাধা দেন না। ছেলের সুখকেই তিনি নিজের সুখ মনে করেন।

আশ্চর্য! গতরাতে জঙ্গলের ভিতরের যে জায়গাটায় নীল নয়নার কুটির ছিল সেখানে জঙ্গল ছাড়া আর কিছুই নেই। রাতুল কি পথ ভুল করেছে? পথ গুলিয়ে পাহাড়ের অন্য কোনও জায়গায় এসে পড়েছে?

রাতুল ঘণ্টাতিনেক ধরে অনেক খোঁজাখুঁজি করেও নীল নয়নার কুটিরের খোঁজ পেল না। যেন রাতারাতি কুটিরটা অদৃশ্য হয়ে গেছে। রাতুলের খুব মন খারাপ লাগছে। এমন সময় বাজার নিয়ে জব্বার মিয়াকে আসতে দেখা গেল।

জব্বার মিয়া রাতুলকে দেখে অবাক হওয়া গলায় বললেন, ‘বাবাজী, এহানে আফনে কী করতেছেন?! জানেন পাহাড়ি জঙ্গলে কত জাতের সাপ-কোপ থাহে!’

রাতুল নীল নয়নার চেহারার বর্ণনা দিয়ে বলল, ‘চাচা, সেই মেয়েটার কুটিরটা খুঁজছি।’

জব্বার মিয়া বললেন, ‘এই পাহাড়ে আফনে কুটির পাইবেন কোতায়? এই পাহাড়ে আমাগো বাংলোডা ছাড়া আর কোনও বাড়ি-ঘরই নাই।’

রাতুল অবাক হয়ে বলল, ‘কী যে বলেন, গতরাতে আসার পথে বৃষ্টিতে এখানেই মেয়েটার কুটিরে আমি আশ্রয় নিয়েছিলাম। মেয়েটাই তো আবার বৃষ্টি থামার পর আমাকে বাংলো পর্যন্ত পৌছে দিয়েছিল।’

‘বাবাজী, আমার কথা আফনের বিশ্বাস হয় না! এই পাহাড়ে * আমাগো বাংলোডা ছাড়া আর কোনও বাড়ি-ঘর নাই।’

তিন

এক সপ্তাহ কেটে গেছে। রাতুল আর নীল নয়নার দেখা পেল না। রাতুল সমস্ত হিলামছড়ি উপজেলা ঘুরে-ঘুরে নীল নয়নাকে

[৪২-৪৩নং পাতা মিসিং]

করেই হোক সে নীল নয়নার খোঁজ বের করবে। কিন্তু এতদিনেও সে আর নীল নয়নার দেখা পেল না।

.

মাঝ রাত। ঝড়-বৃষ্টির শব্দে রাতুলের ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম ভাঙতেই মনে পড়ল সেদিনের কথা, যেদিন সে এই বাংলোতে এসেছিল। সেদিনও এমন ঝড়-বৃষ্টি হয়েছিল, নীল নয়নার দেখা পেয়েছিল, নীল নয়নার কুটিরে আশ্রয় নিয়েছিল-নীল নয়না তাকে বাংলো পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে গিয়েছিল।

এসব ভাবতে-ভাবতে হঠাৎ রাতুলের মনে হলো, ঝড়-বৃষ্টির সেই রাতে যেহেতু নীল নয়নার দেখা পেয়েছিল, আজও আবার হয়তো নীল নয়নার দেখা পেতে পারে। কারণ, আজও তো সেদিনের মত একই রকম ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছে। মনের এই ভাবনা একসময় দৃঢ় বিশ্বাসে রূপ নিল। নিশ্চয়ই আজ সে নীল নয়নার দেখা পাবে। খুঁজে পাবে তার কুটির।

রাতুল বিছানা ছেড়ে উঠে ছাতা হাতে বাইরে বেরিয়ে পড়ল। বাইরে ভয়াবহ ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছে। ছাতায় বৃষ্টি মানছে না। বরং ঝড়ো হাওয়া ছাতাটা উড়িয়ে নিতে চাইছে।

সেদিনের মত পাথুরে পথ একেবারে পিচ্ছিল হয়ে গেছে। পা পিছলে অনেক নীচে পড়ে গিয়ে মৃত্যুর সম্ভাবনাও রয়েছে। রাতুল মৃত্যু-ভয়কে পিছনে ফেলে খুব সাবধানে এগিয়ে চলেছে। ছাতাটাকে বন্ধ করে লাঠির মত ভর দিয়ে-দিয়ে পা ফেলছে।

রাতুল সেই রাতে নীল নয়নার কুটিরটাকে যেখানে দেখেছিল, সেখানে পৌঁছতে-পৌঁছতে পথে বেশ কয়েকবার হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। পানি-কাদায় মাখামাখি হয়ে হাঁচড়ে-পাঁচড়ে কোনওক্রমে এগিয়ে এসেছে। শরীরের বিভিন্ন জায়গা ছড়ে-ছিলে গেছে। বেশ কয়েক জায়গায় কেটেও গেছে। মাথা ফেটেছে। প্রায় পুরো শরীর রক্তাক্ত। বাম পা-টা মচকেছে।

বিধ্বস্ত, রক্তাক্ত রাতুল শেষ পর্যন্ত নীল নয়নার কুটিরের দেখা পেল।

নীল নয়না কুটিরের দরজায় পিদিম হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে। যেন সে রাতুলের আসারই অপেক্ষা করছিল।

নীল নয়নাকে দেখতে পেয়ে রাতুলের চেহারায় একই সঙ্গে বিস্ময়, আনন্দ আর অভিমান ফুটে উঠল। কিছুক্ষণ শুধু হতভম্বের মত তাকিয়ে রইল। এরপর লেংচাতে-লেংচাতে নীল নয়নার কাছে ছুটে গেল। বুজে আসা বাষ্পরুদ্ধ গলায় বলল, ‘এতদিন কোথায় ছিলে?!’

নীল নয়না ধরা গলায় বলল, ‘আমাকে পেতে তুমি নিজের এই অবস্থা করেছ?!’

রাতুল নীল নয়নার হাত দুটো নিজের বুকের সঙ্গে চেপে ধরে বলল, ‘কেন তুমি আমার কাছ থেকে এভাবে লুকিয়ে ছিলে?! কেন এত দুঃখ দিলে আমাকে?!’

নীল নয়না ভাঙা গলায় বলতে লাগল, ‘আমি তোমাকে দুঃখ দিতে চাইনি। আমি নিরুপায়। আমার কিছুই করার নেই। সেদিন আমি তোমার চোখে আমার জন্য ভালবাসা দেখেছিলাম। কিন্তু আমার কিছুই করার নেই। আমি কাউকে ভালবাসতে পারি না। সেই ক্ষমতাই আমার নেই। আমি যে নিয়তির হাতে বন্দি।’

রাতুল বলল, ‘আবার যখন পেয়েছি, আর আমি তোমাকে হারাতে দেব না! তা তুমি আমাকে ভালবাসো আর না-ই বাসো!’

নীল নয়না বলল, ‘শত চাইলেও তুমি আমাকে আটকে রাখতে পারবে না। আমাকে যে হারিয়ে যেতেই হবে। আমি নিয়তির কাছে বন্দি।’

রাতুল নীল নয়নার ঠোঁটে আঙুল চেপে ধরে বলল, ‘একবারও তুমি আর হারিয়ে যাবার কথা বলবে না! তোমার কি আমার ভালবাসায় বিশ্বাস নেই?!’

[৪৬-৪৭নং পাতা মিসিং]

পরে গায়ে সুগন্ধী পারফিউম মেখে ঝড়-বৃষ্টির অপেক্ষা করতে থাকে।

ঝড়-বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। ঝড়ো হাওয়ায় রাতুলের শোবার ঘরের দরজাটা ধীরে-ধীরে খুলে যাচ্ছে। না, ঝড়ো হাওয়ায় নয়-কে যেন ভেজানো দরজাটা ঠেলে ভিতরে ঢুকছে। তার ফর্সা মখমলের মত কোমল হাতটা দেখা যাচ্ছে। হাত ভর্তি কাচের চুড়ি আর অনামিকায় নীল পাথর বসানো আংটি। ঝড়ো হাওয়ায় তার গায়ের মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসছে। সমস্ত ঘর ভরে যাচ্ছে মিষ্টি সৌরভে। এখনই তার অপরূপ সুন্দর মুখখানা দেখা যাবে। দেখা যাবে মায়াকাড়া নীল চোখজোড়া।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *