ফেরা

ফেরা

মাঘ মাসের শীতের ভোর। ছ’টা বাজে। আশপাশ ডুবে আছে ঘন কুয়াশায়। চারদিক নীরব, নিস্তব্ধ। শুধু মাঝে-মাঝে ভোরের পাখির কিচির-মিচির শোনা যাচ্ছে।

আম্বিয়া বেগম ঝাড়ু হাতে বেরিয়েছেন বাড়ির উঠান ঝাড়ু দেবার জন্য। প্রতিদিনই ভোরবেলা বাড়ির অন্যরা জেগে ওঠার আগে প্রথমে তিনি উঠানটা ঝাড়ু দিয়ে ফেলেন। এরপর একে- একে ধোয়া-মোছা সেরে সকালের নাস্তার আয়োজন করেন।

উঠান ঝাড়ু দিতে গিয়ে আম্বিয়া বেগম দেখলেন, উঠানের মাঝখানে ময়লা চাদরমুড়ি দিয়ে কে যেন কুকুরের মত কুণ্ডলী পাকিয়ে গুটিসুটি মেরে শুয়ে রয়েছে। তিনি সেদিকে এগিয়ে গেলেন। ভাবলেন, এ আবার কে?! কোত্থেকে এসে জুটল? এমন শীতের মাঝে খোলা উঠানে পড়ে আছে কেন? কোনও ভবঘুরে পাগল-টাগল নাকি?

চাদরমুড়ি দিয়ে পড়ে থাকা মানুষটার কাছে গিয়ে আম্বিয়া বেগম ডেকে উঠলেন, ‘এই, কেডা তুমি? এইখানে মরতে আসছ কোতা থেইকা?’

চাদরমুড়ি দিয়ে পড়ে থাকা মানুষটার কোনও সাড়া মিলল না। মড়ার মত যেমন নিথর পড়ে ছিল তেমনই পড়ে রইল।

আম্বিয়া বেগমের মনে ভয় জাগল, মরে পড়ে আছে নাকি?! তিনি গলার স্বর উঁচু করে, ‘এই, কেডা, কেডা তুমি…’ বলতে-বলতে হাত দিয়ে জোরে-জোরে কয়েকটা ধাক্কা দিলেন।

এবারে মুড়ি দেয়া মানুষটার সাড় এল। আড়মোড়া ভাঙার ভঙ্গিতে হাত-পা সোজা করল। এরপর ধীরে-ধীরে উঠে বসল। মুখ দেখা গেল। খুবই পরিচিত মুখ! বিশ-একুশ বছর বয়সী একটা মেয়ে। মেয়েটা মায়াকাড়া টানা-টানা চোখে বিরক্তি ফুটিয়ে আম্বিয়া বেগমের দিকে তাকাল।

আম্বিয়া বেগম ভয়ঙ্কর রকমের চমকে উঠলেন। তাঁর মুখ হাঁ হয়ে গেল। মাথায় চক্কর মারল। হাতে ধরা ঝাড়টা খসে পড়ল। মনে হলো এখনই তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাবেন।

মেয়েটা ঘুম জড়ানো আদুরে গলায় বলে উঠল, ‘মা, এত ভোরবেলায় ঘুম ভাঙাইলা ক্যান? আরেট্টু ঘুমাইতে দাও।’

উত্তেজনায় কাঁপতে থাকা আম্বিয়া বেগম ভাবলেন, তিনি নিশ্চয়ই স্বপ্ন দেখছেন। এটা সত্যি হতে পারে না! কোনওক্রমেই সত্যি হতে পারে না! সাত বছর আগে মারা যাওয়া মেয়েকে জীবিত অবস্থায় দেখা কিছুতেই বাস্তব হতে পারে না।

মেয়েটা হাই দিতে-দিতে আবার বলে উঠল, ‘ও, মা, তুমি ওইরকম কইরা চাইয়া রইছ ক্যান?! কী হইছে তোমার?! তোমারে কেমন বুড়া-বুড়া দেহাইতেছে! কী হইছে তোমার?’

আম্বিয়া বেগম অপ্রকৃতিস্থের মত ভয়ার্ত গলায় বিকট চিৎকার করে বাড়ির অন্যদের নাম ধরে ডাকতে শুরু করলেন। যেন বাড়িতে আগুন লেগেছে।

আম্বিয়া বেগমের ডাক-চিৎকারে বাড়ির সবাই জেগে উঠল। জেগে উঠল আশপাশের প্রতিবেশীরাও। লোক জমতে শুরু করল।

দেখতে-দেখতে শত-শত লোকে ভরে গেল উঠান। যতই বেলা বাড়ল সেই সঙ্গে লোকের ভিড়ও বাড়তে থাকল। আশপাশের সব গ্রামের লোক দলে-দলে আসতে শুরু করল। সবার উদ্দেশ্য মেয়েটাকে এক নজর দেখা। সাত বছর আগে যে মারা গেছে সে আবার ফিরে এল কীভাবে, এই নিয়ে সবার মনে কৌতূহলের সীমা নেই। এত বড় অলৌকিক ঘটনার সাক্ষী হতে চায় সবাই।

আঞ্চলিক পত্রিকার সাংবাদিকরা এলেন। এলেন স্থানীয় থানার ওসি সাহেবও।

ওসি সাহেব এবং সাংবাদিকরা মিলে ফিরে আসা মেয়েটাকে সহ আম্বিয়া বেগম আর তাঁর অন্যান্য ছেলে-মেয়েদের প্রশ্নে-প্রশ্নে জর্জরিত করছেন। তাঁদের কাছে ব্যাপারটা বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না। কোনওভাবেই মৃত মানুষ আবার ফিরে আসতে পারে না। নিশ্চয়ই এর পিছনে কোনও বড় রহস্য লুকিয়ে রয়েছে। তাঁরা সেই রহস্যের পর্দা ভেদ করতে চাইছেন।

আম্বিয়া বেগম আর তাঁর অন্যান্য ছেলে-মেয়ে প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে এটা নিশ্চিত হওয়া গেছে যে ফিরে আসা এই মেয়ে আম্বিয়া বেগমেরই মেয়ে। আম্বিয়া বেগমের বড় মেয়ে জুলেখা। দীর্ঘদিন ধরে জণ্ডিসে ভুগে সাত বছর আগে এক মাঘ মাসের শীতের রাতে যে মারা গিয়েছিল। মৃত্যুর আগে নাকি তার সমস্ত শরীর একেবারে কাঁচা সোনার মত হলুদ হয়ে গিয়েছিল।

ফিরে-আসা মেয়েটা তার নিজের নাম-পরিচয়, বাবার নাম, মায়ের নাম, ভাই-বোনের নাম সব ঠিকঠাক বলতে পারছে। পুরানো সব ঘটনাও বলতে পারছে। তবে এই সাত বছর সে কোথায় ছিল, কীভাবে ফিরে এল-সেসব সম্পর্কে কিছুই বলতে পারছে না। তার কথাবার্তা এবং হাবভাবে মনে হচ্ছে এই সাত বছরের কোনও স্মৃতিই তার মাথায় নেই। মাঝখানে যে সাতটা বছর পেরিয়ে গেছে এটাই সে বুঝতে পারছে না। সে পড়ে আছে সাত বছর আগের স্মৃতিতেই। সে মনে করছে রোজকার মত গত রাতে ঘুমিয়েছে। সকালে মায়ের ডাকে ঘুম ভেঙেছে। তবে ঘুম ভেঙে বেশ অবাক হয়েছে নিজেকে উঠানে পড়ে থাকতে দেখে। তার তো থাকার কথা ছিল বিছানায় লেপের তলায়। এ ছাড়া এক রাতের মাঝে মায়ের বয়স বেড়ে যাওয়া আর ভাই-বোনেরা বড় হয়ে গেছে দেখেও সে খুবই বিস্মিত।

কিছুতেই হিসেব মিলছে না। আম্বিয়া বেগম আর তাঁর অন্যান্য ছেলে-মেয়েরা দৃঢ় গলায় বলছে, সাত বছর আগে এই জুলেখাই তাদের চোখের সামনে মারা গিয়েছিল। গ্রামবাসীরাও বলছে তারা নিজেদের হাতে এই মেয়েকে বাড়ির পারিবারিক কবরস্থানে কবর দিয়েছে। কবরটাও দেখিয়েছে।

জুলেখার মধ্যে নাকি মাঝে-মাঝে মস্তিষ্কবিকৃতি দেখা দিত। তখন সে বাড়ি থেকে পালাত। তিন-চার দিন পর আবার খোঁজ পাওয়া যেত’। তখন তার মা আর ভাই-বোনেরা গিয়ে সেখান থেকে নিয়ে আসত। অনেক ওঝা-ফকির দেখিয়েছে। ওঝা- ফকিররা বলতেন, অতিরিক্ত রকমের সুন্দরী হওয়ায় জুলেখার উপর জিনের আছর রয়েছে। জিনেরাই তাকে তিন-চার দিনের জন্য নিয়ে যায়। সে নিজের ইচ্ছায় যায় না। অনেক তাবিজ- কবজ-তদবির দিয়েছিলেন ওঝা-ফকিররা। কিছুতেই কোনও লাভ হয়নি। কিছুদিন পর-পর ঠিকই জুলেখা নিখোঁজ হয়ে যেত।

জুলেখা মাঝে-মাঝে নিখোঁজ হত, এটা জানার পর ওসি সাহেব এবং সাংবাদিকরা ধারণা করেন-পরিবারের লোকেরা নিশ্চয়ই শেষ বার জুলেখার বদলে ওরই মত দেখতে অন্য কাউকে নিয়ে এসেছিল। এবং পরবর্তীতে জুলেখার মত দেখতে সেই মেয়েটাই জণ্ডিসে ভুগে মারা যায়। জুলেখা জীবিত অবস্থায়ই কোথাও ছিল। এখন সাত বছর পর ফিরে এসেছে।

কিন্তু আম্বিয়া বেগম গলায় জোর দিয়ে বললেন, তেমন ভুল হতেই পারে না। কোনও মা তার সন্তানকে চিনতে ভুল করতে পারে না। তাঁর একার যদি ভুলও হয়, জুলেখার ভাই-বোন বা পাড়া-প্রতিবেশীদেরও তো একই সঙ্গে ভুল হতে পারে না।

ওসি সাহেব এবং সাংবাদিকরা জানতে চাইলেন, জুলেখার যমজ ছিল কি না।

আম্বিয়া বেগম জানালেন, না, জুলেখা একাই জন্মেছিল। কোনও নার্সিং হোম বা হসপিটালেও নয়, এই বাড়িতেই জন্ম।

জন্মের সময় যে ধাত্রী উপস্থিত ছিল তাকেও ডেকে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলো। সে-ও জানাল জুলেখা একাই জন্মেছিল।

ওসি সাহেব এবং সাংবাদিকরা গভীর চিন্তায় পড়ে গেলেন। তাঁরা কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না, মৃত মানুষ আবার জীবিত হয়ে ফিরে এসেছে। তাঁরা এখনও মনে করছেন সাত বছর আগে যে জুলেখা মারা গেছে সে আসল জুলেখা ছিল না। জুলেখার মত দেখতে অন্য কেউ ছিল। কখনও-কখনও দু’জন মানুষের চেহারা হুবহু একই রকম হয়। এরকম ঘটনা সারা পৃথিবীতে অনেক দেখা গেছে। আসল জুলেখা সাত বছর ধরে অন্য কোথাও ছিল; এখন ফিরে এসেছে, এমনটা ভাবলেও কিছু রহস্য রয়েই যাচ্ছে। বিশ- একুশ বছর বয়সে নিখোঁজ হওয়া আসল জুলেখা, অর্থাৎ যে ফিরে এসেছে, সে সাত বছর পরও সেই বিশ-একুশ বছর বয়সীই রয়ে গেল কীভাবে?!

ওসি সাহেব এবং সাংবাদিকদের মাথায় রোখ চেপে গেছে। তাঁরা এই রহস্যের শেষ দেখতে চান। সবাই মিলে একটা বড় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। ফিরে-আসা জুলেখা, মারা-যাওয়া জুলেখা এবং আম্বিয়া বেগম ও তাঁর অন্যান্য ছেলে-মেয়েদের ডি. এন. এ. পরীক্ষা করে দেখবেন একই ডি. এন. এ. কি না।

.

সাত বছর আগে মারা-যাওয়া জুলেখার ডি. এন. এ. পরীক্ষার নমুনা সংগ্রহের জন্য কবর খোঁড়া হচ্ছে। কবরের ভিতর থেকে কঙ্কালের হাড় নিয়ে ডি. এন. এ. পরীক্ষা করা হবে।

কবরস্থান ঘিরে শত-শত লোক ভিড় জমিয়েছে। দু’জন কোদালী মিলে কবরটা খুঁড়ে চলেছে। পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন ওসি সাহেব এবং সাংবাদিকরা।

এক পর্যায়ে কবর খোঁড়া শেষ হলো। কোদালী দু’জন কবরের ভিতর থেকে এক-এক করে হাড়-গোড়-খুলি উঠিয়ে আনল।

সবাই অবাক হয়ে দেখল ওগুলো কোনও মানুষের নয়! কুকুর বা শিয়াল জাতীয় কোনও জন্তুর!

হাড়-গোড়গুলোর গায়ে লেগে থাকা আলগা মাটি সরানোর পর সবাই বিস্ময়ে আঁতকে উঠল। ওগুলো সাধারণ কোনও হাড়- গোড় নয়-একেবারে খাঁটি সোনার!!!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ফেরা
1 of 2

ফেরা

ফেরা

মা একদিন ফিরে আসবেন বলে
মা’র ঘটিবাটি, দু’জোড়া চটি
বিছানার চাদর, লেপ কাঁথা,
ডালের ঘুটনি, হাতা
ক’টি কাপড়, ক’টি চুরি দুল
চিরুনিখানি, ওতে আটকা চুল
ফুল ফলের ছবি, মা’র আঁকা
যেখানে যা কিছু ছিল, তেমন করেই রাখা।

মা ফিরে আসবেন
ফিরে কলতলায় পায়ের কাদা ধুতে ধুতে বলবেন
খুব দূরে এক অরণ্যে গিয়েছিলাম।
তোরা সব ভাল ছিলি তো!
খাসনি বুঝি! আহা
, মুখটা কেন শুকনো লাগছে এত!
বাঘ ভালুকের গল্প শোনাতে শোনাতে মা আমাদের খাওয়াবেন রাতে
অনেকদিন পর মাও খাবেন মাছের ঝোল মেখে ভাতে,
খেয়ে, নেপথলিনের গন্ধঅলা লালপাড় শাড়ি পরে একটি তবক দেওয়া পান
হেসে, আগের মত গাইবেন সেই চাঁদের দেশের গান।

একদিন ফিরে আসবেন মা
ফিরে আসবেন বলে আমি ঘর ছেড়ে দু’পা কোথাও বেরোই না
জানালায় এসে বসে দু’একটি পাখি,
ওরাও জানে মা ফিরবেন, বিকেলের দুঃখী হাওয়াও,
আকাশের সবকটা নক্ষত্র জানে, আমি জানি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *