মৎস্যকন্যা
শ্রাবণের এক বর্ষণমুখর সন্ধ্যা। সকাল থেকেই থেমে-থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। কখনও ভারী, কখনও হালকা।
আনিস গলির মুখের চায়ের দোকানে বসে আছে। দোকানে খরিদ্দার সে একাই। ইলেকট্রিসিটি নেই। চারপাশ ডুবে আছে গাঢ় অন্ধকারে। দোকানে টিম-টিম করে একটা সরু মোমবাতি জ্বলছে। সেই আধো আলোতে মধ্যবয়স্ক দোকানদার অলস ভঙ্গিতে টুংটুং শব্দ তুলে আনিসের জন্য চা বানাচ্ছে।
দোকানদার লোকটা খুবই গম্ভীর ধরনের। চেহারায় কেমন সুফি-সুফি ভাব। মুখ ভর্তি কাঁচা-পাকা চাপ দাড়ি। চোখে সুরমা। মাথায় টুপি। গা থেকে আসছে আতরের গন্ধ।
আনিস এই দোকানে যতবারই চা খেতে এসেছে, লক্ষ করেছে লোকটা খুব কম কথা বলে। খোশগল্প করতে চাইলে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে রাখে।
আনিসের আজ দোকানদার লোকটার সঙ্গে আলাপচারিতা করা খুব দরকার। সে চা পান করতে বসেছে অথচ তার পকেটে একটি টাকাও নেই। শুধু চা হলেও হত, চায়ের সঙ্গে দু’পিস নোনতা বিস্কিটও খেতে হবে। নইলে সারা দিনের উপোস পেটে শুধু মাত্র চা পড়ার পর পেটে মোচড় দিয়ে বমি আসতে পারে। চা শেষে একটা সিগারেটও খেতে হবে। সারা দিনে সিগারেট খাওয়া হয়নি।
আনিস বি. এ. পাস করে হন্যে হয়ে চাকরি খুঁজছে। চাকরির দেখা মিলছে না। টিউশনি পড়িয়ে কোনওক্রমে জীবনটা অতিবাহিত করছে। স্বল্প ভাড়ায় একটা জরাজীর্ণ মেসে থাকে। বলা যায় তিন কুলে তার কেউ নেই। ছোট বেলায়ই মা-বাবাকে হারিয়েছে। থাকার মধ্যে এক মামা আছেন। সেই মামার কাছেই বড় হয়েছে। বি. এ. পাস করার পর মামা একদিন বলেন, ‘বাবা, আনিস, কত দিন আর মামার ঘাড়ে চেপে থাকবে? এবার নিজের পথ দেখো।’
সেই থেকে আনিস নিজের পথ দেখছে। মামার বাড়ি থেকে নেমে গিয়ে মেসে ওঠে। আয়-রোজগারের পথ খোঁজে। টিউশনি পড়ানো শুরু করে।
আজকাল বি. এ. পাস করে ভাল টিউশনিও পাওয়া যায় না। সবাই চায় অনার্স, মাস্টার্স, বি. বি. এ., এম. বি. এ.। ক্লাস ওয়ানের ছাত্র-ছাত্রীর জন্যও খোঁজা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফার্স্ট ক্লাস নিয়ে পাস করে বেরনো কাউকে। আনিস এখন ছল- চাতুরির আশ্রয় নেয়। টিউশনি খুঁজতে গিয়ে নিজের পরিচয় দেয়, বুয়েট থেকে পাশ করে বেরনো একজন বলে। তা-ও আবার যেন-তেন রেজাল্ট নয়, ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। মুখের কথায় সবাই আবার বিশ্বাস করতে চায় না। তাই ভুয়া সার্টিফিকেটও বানিয়ে নিয়েছে। এত কিছুর পরও তার কোনও টিউশনিই বেশি দিন টেকে না। দু’-এক মাস যেতেই তাকে বিদেয় করে দেয়। সে নাকি ভাল পড়াতে পারে না। কিছুই জানে না। নলেজ কম।
আনিস নোনতা বিস্কিট আর চা খাওয়া শেষে সিগারেট ধরিয়েছে। নোনতা বিস্কিট দু’পিসের জায়গায় চার পিস খেয়েছে। ভাবছে সিগারেট শেষ হলে এক পিস কেকের সঙ্গে আরেক কাপ চা খাবে। চায়ের শেষে আবার একটা সিগারেট। যা থাকে কপালে! দোকানের বিল মিটাতে না পারলে দোকানী নিশ্চয়ই তাকে বেঁধে রাখবে না। আর যদি বেঁধে রাখতে চায়, রাখুক! লোকজন ডেকে মারধরও করতে পারে। কী আর করা, পকেটে টাকা না থাকলে খিদের জ্বালা মেটাতে মার খাওয়াটা তেমন কিছু দোষের নয়। কথায় বলে না, পেটে খেলে পিঠে সয়।
দোকানদার বিরস মুখে আনিস যা চাইছে এগিয়ে দিচ্ছে। আনিস মনে-মনে বলছে, ব্যাটার মুখ দেখে মনে হচ্ছে ও বোধহয় আগেই বুঝতে পেরেছে তার পকেটে যে টাকা নেই। ফাও খাওয়া পাবলিক। বিল দেবার সময় পকেটে হাত ঢুকিয়ে নাটকীয় কায়দায় বলবে, হায়, হায়, আমার মানিব্যাগ পকেটমার হয়েছে।
আনিস তৃতীয়বারের মত সিগারেট ধরিয়ে দোকানীকে উদ্দেশ্য করে মধুর গলায় বলল, ‘ভাইজানের শরীরটা ঠিক আছে তো? কেমন জানি লাগছে!’
দোকানী কোনও জবাব দিল না। আনিস একটু অপেক্ষা করে আবার বলল, ‘ভাইজানের হাতের চায়ের কোনও তুলনা হয় না। যেন অমৃত!’
দোকানী এবারও কিছু বলল না।
আনিস আবার একটু অপেক্ষা করে বলল, ‘ভাইজানের মত সুফি, নূরানী, পবিত্র চেহারার মানুষ খুব কমই দেখা যায়।’
এবারও লোকটা কিছু বলল না। তবে ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। আনিস মনে-মনে গালি দিয়ে উঠল, ‘বদমাশের বাচ্চা বদমাশ, আগেই বুঝে বসে আছে পকেটে যে টাকা নেই। তিন কাপ চা, চার পিস নোনতা বিস্কিট, দু’পিস কেক, দুইটা সাগর কলা আর তিনটা সিগারেটের কতই বা বিল হয়েছে। সেই টাকার দুঃখে বদমাশটা মুখটা হাঁড়ির মত করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছে। হাতে টাকা এলে বিল সহ বিলের টাকার দশগুণ বখশিশ দিয়ে ওর চায়ের কেতলিতে মুতে যেতে হবে। বদমাশের বাচ্চা, তুই তখন মুতের পানি দিয়ে চা জ্বাল দিয়ে দেখবি তোর চা যদি একটু ভাল হয়।
আনিস মনে-মনে রাগটা সামলে নিয়ে মাথা ঠাণ্ডা করে আবার মন ভুলানো গলায় বলল, ভাইজানের চেহারা দেখলে মনে হয় আপনার মত দিল দরিয়া লোক দুনিয়ায় কমই আছে। কম বললেও ভুল হবে, নাই বললেই চলে।
এমন সময় হুশ করে কালো রঙের একটা প্রাইভেট কার এসে দোকানের সামনে থামল। দোকানদার এবং আনিস দু’জনেই সেদিকে তাকাল। গাড়ির পিছনের জানালা খুলে গেল। সেই খোলা জানালা দিয়ে ষাটোর্ধ্ব সৌম্য চেহারার এক লোক মুখ বের করলেন। লোকটি বৃষ্টির শব্দের কারণে কিছুটা চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বেনসন সিগারেট আছে?’
দোকানী মুখে জবাব না দিয়ে মাথা উপর-নীচ করে বোঝাল, আছে।
গাড়িতে থাকা ভদ্রলোক আবার চেঁচিয়ে বললেন, ‘এক প্যাকেট বেনসন দিন তো। বলতে-বলতে মানিব্যাগ খুলে টাকা বের করে গাড়ির জানালা দিয়ে বাড়িয়ে ধরলেন।
আনিস দোকানের বেঞ্চে বসা অবস্থায়ই হাতটা লম্বা করে বাড়িয়ে দিয়ে টাকাটা আনল। এক হাজার টাকার একটা নোট নোটটা দোকানীর হাতে দিল। দোকানী নোটটা হাতে নিয়ে এক প্যাকেট বেনসন আনিসের হাতে দিল গাড়িতে থাকা ভদ্রলোককে দেবার জন্য। আনিস আবার একই ভঙ্গিতে লম্বা করে হাত বাড়িয়ে বেনসনের প্যাকেটটা গাড়িতে ভদ্রলোকের হাতে পৌঁছে দিল। এরপর দোকানদারের দিকে ফিরল, দাম রাখার পর যে টাকা ফেরত দেয়া হবে সেটা এনে ভদ্রলোকের হাতে পৌছে দেবার জন্য।
দোকানদার আনিসের হাতে সিগারেটের দাম রেখে বাকি ৭৯০ টাকা ফেরত দিল। আনিস পিছনে ফিরে হাত বাড়িয়ে টাকাটা ভদ্রলোকের হাতে পৌঁছে দেবে তার আগেই গাড়ির জানালার কাচ উঠে গেল। এবং গাড়িটা সচল হয়ে উঠল।
আনিস ডেকে উঠল, ‘এই যে, আপনার টাকা নেবেন না?!’
গাড়ির সব জানালা বন্ধ থাকায় আনিসের ডাক বোধহয় গাড়ির ভিতর অবধি পৌঁছয়নি। গতি তুলে গাড়িটা চলে গেল।
আনিস টাকা হাতে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দোকানদারের দিকে তাকাল। তার ভঙ্গিটা এমন এখন সে এই টাকা দিয়ে কী করবে? কী বিপদে পড়ল অন্যের টাকা হাতে নিয়ে! অথচ মনে-মনে সে মহাখুশি। দোকানদার ব্যাটাকেও ভাগ দিতে হবে এই ভেবে কিছুটা মন খারাপ লাগছে। অবশ্য টাকাটা নিতে গাড়িটা আবার ফেরত আসতেও পারে। তার আগেই এখান থেকে কেটে পড়া উচিত।
আনিস কাঁচুমাচু মুখে দোকানদারকে জিজ্ঞেস করল, ‘ভাইজান, এই টাকাগুলোর কী করা যায়?’
দোকানদার কোনও আগ্রহ না দেখিয়ে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল। আনিস মনে-মনে গালি দিয়ে উঠল, ‘হারামজাদা, বজ্জাতের বাচ্চা, সুফিগিরি দেখায়। ফেরেস্তা সাজে। তোর মত ভণ্ড ফেরেস্তার মুখে আমি … করি।’
আনিস আর দোকানদারকে না ঘাঁটিয়ে টাকাটা গুনে মানিব্যাগে ভরে রাখল। টাকার গায়ে কোনও নাম লেখা থাকে না। টাকা যখন যার মানিব্যাগে থাকে তখন তার। এখন এই টাকা তার। সে দোকানদারের কাছে আরেকটা সিগারেট চাইল। বেনসন সিগারেট। দামি সিগারেটের স্বাদই আলাদা।
দোকানদার সিগারেট দিল। আনিস সিগারেট ধরিয়ে ফুর্তিবাজের মত ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করল। ওটা থেকে একশো টাকার একটা নোট বের করে দোকানীর দিকে বাড়িয়ে ধরে বলল, ‘এই যে, আপনার বিল রাখুন।’ ভাবল, খুচরো টাকা আর ফেরত নেবে না। দোকানদার যখন খুচরো টাকা ফেরত দিতে চাইবে, বলবে ওটা আপনার বখশিশ।
দোকানদার একশো টাকার নোটটা না নিয়ে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়েই থাকল। আনিসের মেজাজটা আবার চটে গেল। ‘হালার পুতে সারাক্ষণ ভাব ধরে থাকে। ভান করে যেন এক্কেবারে সুফি সাধক। ভণ্ড কোথাকার! ভণ্ডটার গা থেকে আসে মুর্দা আতরের গন্ধ। গায়ে মুতে দিতে হয়।
দোকানদার মুখ ফিরিয়েই থাকল। আনিস আর সাধাসাধি না করে টাকাটা আবার মানিব্যাগে ভরে রাখল। মনে-মনে বলল, ‘হারামজাদা, বদের বাচ্চা বদ, ভালমানুষী দেখায়! গাড়িওয়ালা বুড়ো মিয়ার ফেলে যাওয়া টাকায় বিল নেবে না!’ গাড়িওয়ালা বুড়ো মিয়ার মত ধনী লোকেরা যদি মাঝে-মাঝে ভুল না করে তা হলে তার মত ভবঘুরে টাইপের লোকেরা তো না খেয়েই মারা পড়বে। এই যে বুড়ো মিয়া ভুলে টাকা না নিয়ে চলে যাওয়ায় এখন সে সেই টাকায় পেট পুরে কিছু খেতে পারবে। নইলে সারাটা দিনের মত রাতটাও উপোস কাটাতে হত।
আনিস সরাসরি চলে এসেছে মদিনা বিরিয়ানি হাউসে। মদিনা বিরিয়ানি হাউসের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় বিরিয়ানির মন মাতানো গন্ধে রোজই ওর জিভে জল এসে যায়। কিন্তু কখনওই তার পকেটে বিরিয়ানি খাওয়ার মত বাড়তি টাকা থাকে না। ঢোক গিলতে গিলতে চলে যায় চটের বস্তা দিয়ে ঘেরা আলি বাবার ঝুপড়ি হোটেলে। সেখানে রিকশাওয়ালা, ঠেলাওয়ালা, শ্রমিক শ্রেণীর লোকদের সঙ্গে আলু ভর্তা, কুমড়োর ঘণ্ট, পাতলা ডাল বা বড় জোর পুঁটি সাইজের তেলাপিয়া অথবা টেংরা সাইজের চাষ করা পাঙ্গাসের একটা টুকরো দিয়ে পেটের খিদে মেটায়। আজ সে ফাও পাওয়া টাকায় বিরিয়ানির স্বাদ একটু চেখে দেখবে। মাঝে-মাঝে এমন ফাও টাকা পেলে মন্দ হত না! ভাল- মন্দ খাওয়া যেত।
দুই
সকাল পৌনে ছয়টা।
আনিস সুফি চেহারার সেই চায়ের দোকানীর দোকানের বেঞ্চিতে বসা। চারদিক একেবারে নীরব-নিস্তব্ধ। এখনও শহর জেগে ওঠেনি। রাস্তায় লোকজন নেই বললেই চলে।
দোকানটা মাত্র খুলেছে। দোকান খোলার আগে থেকেই আনিস বেঞ্চিতে বসা ছিল। ভোর পাঁচটা থেকে।
আনিস আছে মহা বিপদে। তিন মাসের ভাড়া বকেয়া হওয়ায় মেস মালিক গত রাতে তাকে বিছানা-বেডিং সহ বের করে দিয়েছে। রাতটা কাটিয়েছে মেসের বারান্দায়। চারদিক একটু ফর্সা হতেই বেরিয়ে পড়েছে। এই মুহূর্তে তার পকেটে একটি ফুটো পয়সাও নেই। এখন সে কোথায় যাবে? কী করবে? ভেবে কূল পাচ্ছে না।
দোকানদার স্টোভে চায়ের কেতলি চাপিয়ে, কাপ-পিরিচগুলো ধোয়া-মোছা করছে। তার চেহারা বরাবরের মত ভাবলেশহীন। এই যে আনিস এত ভোরবেলায় বিছানা-বেডিং সহ তার দোকানের বেঞ্চিতে বসে আছে তা দেখেও তার চেহারায় বিন্দু মাত্র কৌতূহল দেখা যাচ্ছে না। এটা যেন খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। রোজই ভোরবেলা বিছানা-বেডিং সহ লোকজন এসে তার দোকানের সামনে বসে থাকে।
বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেছে। কেতলিতে চায়ের পানি বিজ-বিজ করে ফুটছে। দোকানদার কেতলির মুখ খুলে ভিতরে লিকার ফেলল। আনিস গালে হাত দিয়ে বসে আছে।
কিছুক্ষণের মধ্যে চা হয়ে গেল। দোকানদার এক কাপ চা বানিয়ে আনিসের সামনে দিল। সঙ্গে একটা বনরুটি, খোসা ছাড়ানো একটা সিদ্ধ ডিম, আর দুটো কাঁঠালি কলাও।
আনিস একটু অবাক হলো। না চাইতেই চা, বনরুটি, ডিম আর কলা। অথচ আগের বিল এখনও দেয়া হয়নি। দোকানদার কি তাকে দয়া দেখাচ্ছে? সে কি ভিখারি নাকি? তার মাথাটা গরম হয়ে গেল। মনে-মনে বলে উঠল, ‘বদের বাচ্চা বদ, দানবীর সাজে! দুধ কম দেয়া নর্দমার ঘোলা জলের মত চা, থুথুড়ে বুড়ো মানুষের গালের মত চুপসানো বনরুটি, বিচির সাইজের ডিম আর পোলাপানের ‘ইয়ে’-র সাইজের কলা খেতে দিয়ে বড় দাতাগিরি দেখানো হচ্ছে।’
আনিসের মেজাজটা দপ করে জ্বলে উঠে পরক্ষণেই নিভে গেল। কোনও কিছু না বলে চুপচাপ কলা দিয়েই গোগ্রাসে বনরুটি খেতে শুরু করল। এরপর একে-একে বিচির সাইজের সিদ্ধ ডিম আর নর্দমার ঘোলা জলের মত চা তৃপ্তির সঙ্গে খেয়ে শেষ করল। গত রাতটাও তার উপোস গেছে। পেটে কুমিরের খিদে! খিদের সময় পান্তা আর পোলাও! একটা কিছু পেলেই হলো!
দোকানদার একটা বেনসন সিগারেট আর দিয়াশলাই আনিসের দিকে বাড়িয়ে ধরে মৃদু গলায় বলল, ‘আপনি কি অবিবাহিত?’
আনিস এতটাই অবাক হলো যে তার মুখ খাবি খাওয়া মাছের মত হাঁ হয়ে গেল। যে লোক সহজে কোনও কথা বলে না, এমনকী কোনও প্রশ্ন করলেও জবাব দেয় না, সে আজ নিজেই আগ বাড়িয়ে আলাপ করতে চাইছে-ব্যাপার কী?! তা-ও আবার বউ আছে কি না জানতে চাইছে। বউ থাকলে কি বউয়ের সাথে ফষ্টি-নষ্টি করে বিলের টাকা ওঠাবে? হারামজাদা, বদের বাচ্চা বদ, পরের বউয়ের খোঁজ-খবর জানতে চায়!
আনিস সিগারেট আর দিয়াশলাই হাতে নিল। সিগারেট ধরিয়ে নাকে-মুখে ধোঁয়া ছাড়তে-ছাড়তে ভাব নিয়ে বলল, ‘না, এখনও বিয়ে করা হয়ে ওঠেনি। অবশ্য মানানসই মেয়ে কোথায়! মনে-মনে বলল, একার চলাই দায়! আবার বিয়ে! আর মানানসই মেয়ে? তার কাছে তো দুনিয়ার তাবৎ মেয়েমানুষকেই মানানসই মনে হয়। জিনিস তো একই! আলো নিভালে সিনেমার নায়িকাও যা বাড়ির কাজের মেয়েও তা। তার তেত্রিশ বছরের জীবনে চেনা-পরিচিত এমন কোনও মেয়েলোক নেই যাকে সে প্রেমের প্রস্তাব দেয়নি।
দুর্ভাগ্য! আজ পর্যন্ত কেউ রাজি হয়নি। সর্বশেষ মেসের মুটকি বুয়াটাও না। মুটকি বুয়াটার সঙ্গে ভাব জমানোর চেষ্টা চালানোর পর মুটকিটা একদিন বলে, ‘ভাইজান, আফনেরে দ্যাখলেই একজনের কথা মনে পইড়া খালি হাসি আয়।’
আনিস জিজ্ঞেস করে, ‘কার কথা?’
‘আমাগো গ্রামের চোট্টা বাবুলের কথা। চোট্টাডায় পুকুরঘাটে মাইয়া মাইনষেরে গোসল করতে দ্যাখলেই গাছের মাথায় উইঠ্যা বইস্যা থাকত। হি-হি-হি…হের চেহারার লগে আফনের চেহারার হুবাহুব মিল! হেই লুইচ্চা চউখ! হেই চাউনি! হেই রহমের পাতি শিয়ালের লাহান নজর…
দোকানদার গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘মানানসই মেয়ে পেলে বিয়ে করবেন?’
আনিস তাচ্ছিল্যভরা গলায় বলল, ‘সব কিছু দেখে-শুনে পছন্দ হলে করতেও পারি। তা কোথাকার মেয়ে?’
দোকানদার একটা ভাঁজ করা কাগজ বাড়িয়ে ধরে বলল, ‘এতে মেয়ের নাম-ঠিকানা, বাবার নাম লেখা আছে।’
তিন
আনিস দোকানদারের দেয়া ঠিকানা মোতাবেক এসেছে। তার বার-বারই মনে হচ্ছে সে ঠিকানা ভুল করেছে। দোকানদার তাকে যে ঠিকানা দিয়ে পাঠিয়েছে এটা সেই বাড়ি নয়!
চারপাশ উঁচু পাঁচিলে ঘেরা দোতলা বিশাল বাড়ি। পাঁচিল সমানই উঁচু ভারী লোহার গেট। গেট দিয়ে ভিতরে ঢোকার পর লনের মত খোলা জায়গা। জায়গাটা ছেয়ে আছে কার্পেটের মত নরম দূর্বা ঘাসে। বাম পাশে গ্যারাজ। ডান পাশে এক চিলতে ফুলের বাগান। বাগানে ফুলে-ফুলে ভরা বেশ কয়েকটা লাল গোলাপ গাছ রয়েছে। শুধু গোলাপই। অন্য কোনও ফুলের গাছ নেই। এ বাড়ির কারও মনে হয় লাল গোলাপ খুব পছন্দের।
আনিস বেশ ভড়কে গেছে। দোকানদার ব্যাটা তার মত দেড় টাকার মানুষকে এত বড় বাড়িতে পাঠিয়েছে কোন্ সাহসে?! ও কি না এ বাড়ির মেয়েকে বিয়ের প্রস্তাব দেবে? বদমাশটার মনে কোনও মতলব আছে নাকি?! তার সঙ্গে মস্করা মারতে এই ঠিকানা দিয়েছে কি? তাই যদি হয়, আর এখন যদি এ বাড়ি থেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে তাকে বের করে দেয় তা হলে সত্যি-সত্যিই সে গিয়ে বদমাশটার চায়ের কেতলিতে মুতে দেবে। মুতবেই মুতবে! কী মনে করে ব্যাটা! এতটুকু ক্ষমতাও যদি না দেখাতে পারে তা হলে তার নিজের নাম পাল্টে আনিসের জায়গায় ফিনিশ রাখবে। শুধু মুতবেই না, সেই মুতের পানি দিয়ে চা বানিয়ে হারামিটাকে গেলাবে। কেতলির নল দিয়ে গরম চা সরাসরি হারামিটার গলায় ঢালবে।
আনিস দুরু-দুরু বুকে কলিংবেল টিপল। কিছুক্ষণের মধ্যেই কারুকাজ করা ভারী দরজা খুলে গেল। দেখা গেল খুনখুনে এক বৃদ্ধার মুখ। বৃদ্ধা তাঁর ঘোলাটে চোখে সন্দেহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কাকে চাই?’
আনিস বলল, ‘আমজাদ সাহেব আছেন? আমাকে একজন পাঠিয়েছে আমজাদ সাহেবের সঙ্গে দেখা করার জন্য।’
বৃদ্ধা বললেন, ‘আছেন। আপনার পরিচয়?’
আনিস বলে উঠল, ‘আমার নাম ফিনিশ, না, মানে…’ জিভে কামড় দিয়ে বলল, ‘…আনিস। আনিস আমার নাম। সৈয়দ আনিস মিয়া।’
বৃদ্ধা শীতল গলায় বললেন, ‘ভিতরে এসে বসেন। বড় সাহেবকে ডেকে দিচ্ছি।’
আনিস বৃদ্ধার পিছু-পিছু ভিতরে ঢুকে বসার ঘরে বসল।
সুপরিসর ঘর। নানান আসবাবে সুসজ্জিত। দেয়ালে শোভা পাচ্ছে নানান ধরনের পেইণ্টিং আর সাবেকি আমলের একটা দেয়াল ঘড়ি। ঘড়িটা বন্ধ। রুমের এক কোনায় একটা অ্যাকুয়ারিয়াম। ওটা খালি। কোনও মাছ নেই। এসি রুম। তবে এসি চালু নয়। এসি চালু না থাকলেও ঘরের তাপমাত্রা বেশ আরামদায়ক। এবং খুব মিষ্টি একটা সুবাস ঘরের বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে।
আধঘণ্টা হতে চলল। সেই যে বৃদ্ধা আনিসকে বসিয়ে রেখে গেলেন আর কারও মুখ দেখা গেল না। আনিসের কেমন ঘুম-ঘুম পাচ্ছে। বেশ কয়েকবার হাই দিল। ভাবছে, উঠে বেরিয়ে পড়বে নাকি? আবার ভাবছে, এতক্ষণ যখন বসল, না হয় আরেকটু বসে দেখাটা করেই যায়। ধনী লোকদের সঙ্গে চিন-পরিচয় হওয়া একটা সৌভাগ্যের ব্যাপার। বিপদে-আপদে কাজে লাগে।
আনিস সোফায় হেলান দিয়ে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল তার খেয়াল নেই। চোখ মেলে দেখল, অত্যন্ত সৌম্য চেহারার বয়স্ক এক লোক তার সামনে বসা। লোকটাকে সে চিনতে পারল। কয়েক মাস আগে কালো রঙের গাড়িতে এসে যে ভদ্রলোক এক প্যাকেট বেনসন সিগারেট কিনে এক হাজার টাকার নোট দিয়ে বাকি ৭৯০ টাকা না নিয়েই চলে গিয়েছিলেন তিনিই ইনি।
আনিসের বুকের ভিতর ধুকধুক করে উঠল। ভদ্রলোক সেই টাকা দাবি করবেন নাকি? কী বলবে সে, সেই টাকায় ভরপেট বিরিয়ানি খেয়েছে? বিরিয়ানি খেয়ে ওঠার পর এক সঙ্গে দুই খিলি পান আর একটা বেনসন সিগারেটও খেয়েছে?
ভদ্রলোক গলা খাঁকারি দিয়ে ঝুঁকে এসে বললেন, ‘বাবা, তোমার ঘুম ভাঙল? অনেকক্ষণ ধরে তোমার ঘুম ভাঙার অপেক্ষা করছি। ঘুম হচ্ছে এবাদতের মত। বিনা কারণে, কারও ঘুম ভাঙানো উচিত নয়।’
আনিস লজ্জিত গলায় বলল, ‘ক্ষমা করবেন! কীভাবে যে ঘুমিয়ে পড়েছি বুঝতে পারিনি।
ভদ্রলোক বললেন, ‘না, বাবা, তাতে কোনও সমস্যা নেই।‘
আনিস বলল, ‘আঙ্কেল, আপনি কি আমজাদ হোসেন?’
‘জি, বাবা, আমিই আমজাদ হোসেন।’
‘আঙ্কেল, আমাকে একজন পাঠিয়েছে। বলেছে, আপনার একমাত্র কন্যার জন্য পাত্র খুঁজছেন। আমার খোঁজে একজন পাত্র আছে। আমি সেই পাত্রের খোঁজ নিয়ে এসেছিলাম।’
আমজাদ সাহেব অত্যন্ত আগ্রহী হয়ে উঠে বললেন, ‘তা, বাবা, কোথাকার পাত্র? নাম-পরিচয় কী? কী করে?’
আনিস ঢোক গিলে বলল, ‘আপনি যেমন পাত্র খুঁজছেন, পাত্র তেমনই। শিক্ষিত, নম্র, ভদ্র, লাজুক, মার্জিত, রুচিশীল…চেহারা- সুরতও মাশাল্লাহ ভাল। গায়ের রঙ শ্যামলা। তবে চাল-চুলোহীন। তিন কুলে কেউ নেই। মেসে থাকে। টিউশনি পড়িয়ে কোনওক্রমে জীবন চালায়।’
আমজাদ সাহেবের আগ্রহ যেন আরও বেড়ে গেল। তিনি উৎসাহিত গলায় বললেন, ‘পাত্রের চাল-চুলো নেই এটা কোনও সমস্যাই নয়। নম্র-ভদ্র হলেই চলবে। আমি তো মনে-মনে এমন ছেলেই খুঁজছিলাম। একমাত্র মেয়ে আমার, বিয়ে দিয়ে ঘরজামাই রাখব এমনটাই মাথায় ছিল। তা, বাবা, পাত্র কে? পাত্রকে নিয়ে এসো, সামনা-সামনি দেখি।’
আনিস মাথা নুইয়ে লাজুক গলায় আমতা-আমতা করে বলল, ‘না, মানে, আঙ্কেল, কী বলব-পাত্র আমি নিজেই।’
আমজাদ সাহেব হাসতে-হাসতে বললেন, ‘এতে এত লজ্জা পাওয়ার কী আছে? তোমার মা-বাবা কেউ নেই, নিজের বিয়ের প্রস্তাব তো নিজেকেই দিতে হবে।’
আনিস মাথা নুইয়েই রইল। আমজাদ সাহেব আবার বললেন, ‘তোমাকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। বুদ্ধিমান ছেলে! এখন আমার মেয়েকে তোমার পছন্দ হয় কি না দেখো। তুমি বরং আজ থেকে আমাদের এখানেই থাকা শুরু করো। তোমাদের দু’জনের মধ্যে আলাপ-পরিচয় হোক। এরপর শুভ একটা দিন দেখে বিয়ে পড়িয়ে দেব। এখন আমি উঠি। রহিমাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি, তোমাকে গেস্টরুমে নিয়ে যাবে। গোসল-টোসল করে ফ্রেশ হয়ে খাওয়া-দাওয়া করো।’
চার
বৃদ্ধা মহিলাই রহিমা। এ বাড়ির কাজের লোক। রহিমা বেগম আনিসকে গেস্টরুমে নিয়ে এসেছেন।
ফিটফাট বেশ বড় একটা কামরা। এ ঘরেও এসি আছে। কামরায় প্রয়োজনীয় সব কিছুই রাখা আছে। আলনা, আলমিরা, ড্রেসিং টেবিল, খাট, ওয়ার্ডরোব, লেখার টেবিল, চেয়ার, রকিং চেয়ার-এমনকী পরিধেয় পোশাক-আশাক, টুথপেস্ট, টুথব্রাশ, শেভ করার সরঞ্জামাদি, সাবান-শ্যাম্পু, পারফিউম, প্রয়োজনীয় টুকটাক ওষুধ-পথ্য সহ সব কিছুই।
আনিস লাগোয়া বাথরুমে ঢুকে সুগন্ধি সাবান-শ্যাম্পু দিয়ে অনেকক্ষণ ধরে গোসল করল। নিজেকে এখন খুবই সতেজ লাগছে। এসিটা অন করে দিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াতে লাগল। এমন সময় পিছন থেকে রহিমা বেগমের খনখনে গলার স্বর শুনতে পেল।
‘আপনার খাবার নিয়ে এসেছি। অনেক রাত হয়েছে। খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন।’
আনিস চমকে ঘুরে তাকাল। রহিমা বেগম বিড়ালের মত এমন নিঃশব্দে এসেছেন যে একটুও টের পায়নি।
রহিমা বেগম খাবার নিয়েই আসেননি, আনিসের রুমের টেবিলে খাবার সাজিয়েও ফেলেছেন। আনিস ভেবে অবাক হলো টেবিলে খাবার সাজানোও হয়ে গেছে অথচ এতক্ষণ সে রহিমা বেগমের উপস্থিতি টের পেল না।
রহিমা বেগম আবার বললেন, ‘অনেক রাত হয়ে গেছে, খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন।’
রহিমা বুড়ির মাথায় বোধহয় ছিট আছে। তা না হলে বার- বার কেন বলছেন, অনেক রাত হয়েছে, ঘুমিয়ে পড়ুন।
আনিস এ বাড়িতে যখন এসেছে তখন বেলা এগারোটা কি সোয়া এগারোটা বাজে। ঘণ্টা দেড়েক বসার ঘরে অপেক্ষা করার পর আমজাদ সাহেব আসেন। অবশ্য আমজাদ সাহেব এসে তাকে ঘুমন্ত অবস্থায় পেয়েছিলেন। সে যা-ই হোক, আমজাদ সাহেবের সঙ্গে তার কথা হয়েছে আধ ঘণ্টার মত। এরপর রহিমা বেগমের সঙ্গে এই গেস্টরুমে আসে। গোসল করতে-করতে আরও আধ ঘণ্টা বা পৌনে এক ঘণ্টা গেছে। বড় জোর এখন দুপুর দুটো বা আড়াইটা বাজার কথা। অবশ্য এ বাড়িতে ঢোকার পর সে আর বাইরের আলো দেখেনি। এ বাড়ির সমস্ত জানালা- কপাট আটকানো। এবং জানালায় ভারী পর্দা টানা। জানালা- কপাট আটকে রাখার যথেষ্ট কারণও রয়েছে। যেহেতু বাড়ির প্রতিটাই এসি রুম। সাধারণত এসি রুমের দরজা-জানালা খুলে রাখা হয় না।
বেলা কত হলো বোঝার উপায় নেই। মোবাইল ফোনটা এবং হাত ঘড়িটা দুটোই কখন যেন বন্ধ হয়ে রয়েছে। এ ঘরেও কোনও ঘড়ি নেই।
খেতে বসে আনিসের মন ভরে গেল। অনেক ধরনের পদ তার সামনে দেয়া হয়েছে। পোলাও, রোস্ট, ডিমের কোরমা, কলিজা ভুনা, সরষে ইলিশ, গলদা চিংড়ির মালাইকারি, বাচ্চা মুরগির ঝোল, টমেটোর সালাদ আর পায়েস। খাবারগুলো একেবারে গরম। যেন এই মাত্র চুলো থেকে নামানো হয়েছে।
আনিস সময় নিয়ে আয়েশ করে সব খাবার খেয়ে শেষ করল। অনেক দিন পর তার ভাগ্যে এত ভাল খাবার জুটল। খাবারগুলোও অত্যন্ত সুস্বাদু ছিল। খেতে-খেতে টেরও পায়নি কখন যে পেটের ধারণ ক্ষমতার চেয়েও অনেক বেশি খেয়ে ফেলেছে। এখন কেমন আইঢাই লাগছে। এত ভাল খাওয়া- দাওয়ার পর একটা সিগারেট না ধরালেই নয়।
আনিসের প্যান্টের পকেটে সিগারেট আছে। আসার সময় চায়ের দোকানীর কাছ থেকে বাকিতে দশটা বেনসন সিগারেট নিয়ে এসেছিল। তবে রুমের ভিতরে বসে সিগারেট ধরানো ঠিক হবে না। এসি রুম। সমস্ত রুম গন্ধ হয়ে যাবে।
রুমের সঙ্গে লাগোয়া বারান্দা রয়েছে। আনিস সিগারেট আর দিয়াশলাই হাতে বারান্দায় চলে এল।
বারান্দায় পা রেখেই সে ভীষণ চমকে উঠল। বাইরেটা একেবারে ঘুটঘুটে অন্ধকার। যেন নিশুতি রাত! বুড়ির কথাই তো ঠিক, সত্যি-সত্যিই তো রাত হয়ে গেছে। সেটা কী করে সম্ভব! হিসেব মত তো দুপুর দুটো বা আড়াইটা হবার কথা। এত দ্রুত রাত নেমে এল কীভাবে? তা হলে কি আনিস বসার ঘরের সোফায় অনেক সময় ধরে ঘুমিয়ে ছিল? ঘুমাতেও পারে! গত রাতটা কেটেছে মেসের বারান্দায় বসে-বসে ঝিমিয়ে। মেস মালিক মেস থেকে বের করে দেবার পরও রাস্তায় বেরোয়নি পুলিশের ভয়ে। অত রাতে বিছানা-বেডিং সহ রাস্তায় নামলে নির্ঘাত পুলিশে ধরে নিয়ে গিয়ে হাজতে ঢোকাত। তা ছাড়া এই শহরে তার যাওয়ার জায়গাই বা কোথায়! এক তার মামার বাড়িতে যাওয়া যেত। গেলেও লাভ হত কি না বলা মুশকিল। এক রাতের জন্যও মামা জায়গা দিতেন কি না কে জানে। মামা তার উপর খুব খেপে আছেন। মামার মা মরা ছোট মেয়ে বাথরুমে গোসল করতে ঢুকলেই আনিস দরজার ফুটোতে চোখ রেখে লুকিয়ে-লুকিয়ে গোসল দেখত। একদিন হাতে-নাতে মামার কাছে ধরা পড়ে। সেদিনই মামা তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেন। সরাসরি কিছু না বলে ঘুরিয়ে অন্যভাবে বলেন, ‘অনেক দিন তো মামার ঘাড়ে চেপে রইলে। এখন ঘাড়ে ছুরিও বসাতে চাইছ! তারচেয়ে ঘাড় থেকে নেমে নিজের পথ দেখো।’
আনিস অন্ধকারের মাঝে সিগারেট ধরাল। কেমন গা ছমছমে পরিবেশ। যেমন অন্ধকার, তেমন ঝিম ধরা নিস্তব্ধতা। কোনও নিশাচর পাখি, ঝিঁঝি পোকা অথবা শিয়াল-কুকুরের ডাক পর্যন্ত শোনা যাচ্ছে না। যেন লোকালয়হীন কোনও মরুভূমির মাঝে একাকী রাত কাটাচ্ছে। একটু হাওয়াও বইছে না। সব কিছু কেমন থমথম করছে।
আনিস দ্রুত জোরে-জোরে সিগারেট টানছে। এই সিগারেটটা শেষ হবার পর আরেকটা ধরাবে। পর-পর দুটো সিগারেট টেনে ঘুমাতে যাবার অভ্যাস তার অনেক দিনের।
আনিস দ্বিতীয় সিগারেটটা ধরিয়েছে। এতক্ষণে অন্ধকারে অনেকটাই চোখ সয়ে এসেছে। সে বোধহয় বাড়ির পিছনের দিকের বারান্দায়। একটু দূরেই একটা পুকুর। দিঘির মত বেশ বড়সড় পুকুর। অন্ধকারেও পুকুরের পানির টলমল চোখে পড়ছে।
পুকুরটার চারধারে ঝোপ-ঝাড়-জঙ্গল আর ফাঁকা-ফাঁকাভাবে বেড়ে ওঠা বিভিন্ন বড়-বড় গাছ মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। অন্ধকারে গাছগুলোর ভূতের মত ডাল-পালা ছড়ানো কালো- কালো অবয়ব দেখা যাচ্ছে।
এদিকটায় একটা শান বাঁধানো ঘাটলা।
ঘাটলায় চোখ যেতেই আনিসের বুকটা ধক করে উঠল। ঘাটলায় কে যেন রয়েছে। কোনও মেয়েমানুষ। ঘাটলার সিঁড়িতে মূর্তির মত সোজা হয়ে বসে আছে। পিছন দিক থেকে দেখছে আনিস। পিঠের উপর মেঘের মত ঢেউ খেলানো এক রাশ ছড়ানো চুল। ঝিরঝিরে বাতাসে চুলগুলো একটু-একটু উড়ছে।
আনিস বসে যাওয়া গলায় বলে উঠল, ‘এই, কে? কে ওখানে?!’
নারীমূর্তি ধীর ভঙ্গিতে মাথা ঘুরিয়ে আনিসের দিকে তাকাল। অন্ধকারে মুখ দেখা যাচ্ছে না। তবে চোখ দুটো দেখা যাচ্ছে। ও- দুটো কেমন বিড়ালের চোখের মত জ্বল-জ্বল করছে।
জ্বলজ্বলে চোখ দেখে আনিসের বুকটা আবার কেঁপে উঠল। ভীত গলায় বলল, ‘কে! কে ওখানে?’
নারীমূর্তি কিছুই বলল না। আনিসের দিক থেকে মাথা ঘুরিয়ে আবার সামনে তাকাল। ধীর ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াল। একী অবস্থা! সে তো উলঙ্গ! অন্ধকারেও ছায়ার মত শারীরিক কালো অবয়বের খাঁজ-ভাঁজ বোঝা যাচ্ছে।
দিগম্বরী নারী অবয়বটা ধীর ভঙ্গিতে সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগল। এতটুকুও তাড়া নেই তার মধ্যে। একটা-একটা করে সিঁড়ির ধাপে পা ফেলে-ফেলে নেমে যাচ্ছে।
ধীরে-ধীরে এক পর্যায়ে কালো নারী অবয়বটা পানিতে নেমে অদৃশ্য হয়ে গেল।
আনিস অপেক্ষায় রইল নারীমূর্তির পানির নীচ থেকে উঠে আসার।
এক মিনিট, দুই মিনিট, পাঁচ মিনিট, দশ মিনিট… এভাবে প্রায় ঘণ্টাখানিক পেরিয়ে গেল, কিন্তু নারীমূর্তি আর পানির নীচ থেকে উঠল না। ততক্ষণে আনিস আরও চার-পাঁচটা সিগারেট টেনে ছাই করেছে। উত্তেজনায় তার কপালের দু’পাশের রগ দপ-দপ করছে। কে এই নারী? বিকৃত মস্তিষ্কের কেউ? নাকি মানুষই নয়, অন্য কিছু? কোনও মানুষের পক্ষে এক ঘণ্টা ধরে পানির নীচে ডুব দিয়ে থাকা সম্ভব নয়। নাকি আনিস চোখে বিভ্রম দেখেছে? কেউ ওখানে ছিলই না।
আনিস আরও আধ ঘণ্টার মত অপেক্ষা করল, যতক্ষণ না প্যাকেটের সব সিগারেট শেষ হলো। তার মাথাটা এখন ভীষণ ঘুরছে। সেই সঙ্গে তীব্র ভোঁতা যন্ত্রণা হচ্ছে। স্খলিতচরণে বারান্দা থেকে রুমের ভিতরে ঢুকে বিছানায় শুয়ে পড়ল।
কখন যে ও গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল তা নিজেও জানে না। ঘুম ভাঙল দুঃস্বপ্ন দেখে। অবশ্য এ ধরনের স্বপ্নে সবাই সুখ অনুভব করে। আনিসের কাছে সেই সুখস্বপ্নই দুঃস্বপ্ন হয়ে ধরা দিয়েছে।
আনিস স্বপ্নে এক নারীর সঙ্গে শরীরী খেলায় মেতে ছিল। পরিচিত এক নারী। সে এমন এক নারী যাকে নিয়ে এ ধরনের নোংরা স্বপ্ন দেখার কোনও প্রশ্নই ওঠে না।
আনিস তার মামীকে স্বপ্নে দেখেছে। সেই মামী যিনি তাকে মায়ের স্নেহে লালন-পালন করেছেন।
আনিসকে জন্ম দিতে গিয়েই আনিসের মা মারা যান। মা মরা অতটুকু শিশুকে পৃথিবীতে টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব কাঁধে নেন মমতাময়ী মামী। জন্মদাতা একবার খোঁজ নিতেও আসেনি।
আনিস দশ-বারো বছর বয়স পর্যন্ত মামীর কোলেই বড় হয়। এরপর মামীকেও হারায়। ক্যান্সারে ভুগে মামী মারা যান। মামী বেঁচে থাকলে মামা তাকে আজ কিছুতেই এভাবে বাড়ি থেকে বের করে দিতে পারতেন না।
মায়ের আসনে যে নারীর স্থান সে নারীকে নিয়ে কেউ কি এমন নোংরা স্বপ্ন দেখে? তা-ও আবার বয়স্কা মৃতা এক মহিলাকে নিয়ে!
ছিঃ-ছিঃ-ছিঃ! এমন স্বপ্ন সে কেন দেখল? নিজেকে নিজে ধিক্কার দিচ্ছে। এতটা নীচে নেমে গেছে তার মানসিকতা! মনোবিজ্ঞানীরা বলেন স্বপ্ন নাকি অবচেতন মনের এক ধরনের খেলা। তা হলে কি তার মনের গভীরে মৃতা মামীকে নিয়ে নোংরা ভাবনা লুকিয়ে ছিল? সেটাও বা কী করে হয়! তার দশ-বারো বছর বয়সে মামী মারা যান, সেই বয়সের একটা বাচ্চা ছেলের মনে এমন নোংরা ভাবনা কোনওভাবেই আসার কথা নয়।
আনিস প্রচণ্ড মন খারাপ নিয়ে বিছানা থেকে উঠে বসল। রাত কত হলো কে জানে। টেবিলের উপর রাখা জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে পান করল। সিগারেট খাওয়ার খুব ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু একটা সিগারেটও আর নেই। কী মনে করে টেবিলের দেরাজ খুলল। আশ্চর্য! দেরাজের ভিতরে এক প্যাকেট বেনসন সিগারেট, নতুন একটা লাইটার আর ক্রিস্টালের ছোট্ট অ্যাশট্রে।
বড়লোকদের সব কাজই গোছানো। কী সুন্দরভাবেই না গেস্টরুম সাজিয়ে রেখেছে। যেন গেস্টের যখন যা প্রয়োজন পড়ে তা হাতের কাছেই পায়। এ বাড়ির মেয়েকে বিয়ে করতে পারলে ভালই হত। রাজার হালে থাকা যেত। মেয়ে যদি কানা-নুলোও হয়, তাতেও আনিসের কোনও আপত্তি নেই। আনিসকে পছন্দ হয় কি না সেটাই এখন ভাবনার বিষয়।
পাঁচ
আনিসের ঘুম ভাঙল অনেক বেলায়। বাইরে রোদ ঝলমল করছে। আনিস সিগারেটের প্যাকেট আর লাইটার হাতে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। বাসি মুখে সিগারেট খাওয়ার মজাই আলাদা। এক ধরনের আরামদায়ক ঝিমুনি আসে।
সিগারেট ধরিয়ে আনিস আবার গত রাতের দুঃস্বপ্নটা নিয়ে ভাবতে শুরু করল। কী বাজে একটা স্বপ্ন দেখল! মৃতা, মায়ের বয়সী একজনকে নিয়ে অমন নোংরা স্বপ্ন কীভাবে দেখল সে?! স্বপ্নটাও কী বিচ্ছিরি রকমের জীবন্ত ছিল! মনে হচ্ছিল স্বপ্ন নয়, ব্যাপারটা সত্যি-সত্যিই ঘটছে
আনিসের সমস্ত শরীর কেমন ম্যাজম্যাজ করছে। সিগারেটটা অর্ধেকের মত টানার পর ফেলে দিল। আড়মোড়া ভেঙে রুমের ভিতরে ঢুকল। তোয়ালে হাতে বাথরুমে গেল।
বাথরুম থেকে মুখ-হাত ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে দেখে রহিমা বেগম তার জন্য নাস্তা নিয়ে এসেছেন।
নাস্তার ব্যাপক আয়োজন। পরোটা, ডিমের অমলেট, কলিজা ভুনা, মুরগির চামড়া-গিলা দিয়ে করা লটপটি, মাছের চপ, মাখন লাগানো পাঁউরুটি, এক গ্লাস ধোঁয়া ওঠা গরম দুধ, কমলার জুস, কলা, আপেল, আঙুর, বেদানা। তবে এত কিছুর মধ্যে চা দেয়নি।
আনিস অত্যন্ত তৃপ্তি সহকারে নাস্তা শেষ করে রহিমা বেগমকে চায়ের কথা বলল। রহিমা বেগম চা আনতে চলে গেলেন।
আনিস বারান্দায় এসে দাঁড়াল। অপেক্ষায় রইল, রহিমা বেগম চা নিয়ে এলে পর চা খেয়ে সিগারেট টেনে বাড়িটা ঘুরে দেখবে।
প্রায় ঘণ্টাখানিক কেটে গেছে রহিমা বেগম আর চা নিয়ে এলেন না। বুড়ি কি চায়ের কথা ভুলে গেছেন? সমস্ত বাড়ি কেমন নীরব-নিস্তব্ধ, খাঁ-খাঁ করছে। যেন এ বাড়িতে আনিস ছাড়া আর কেউ নেই। আনিস কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। এত বেলা হয়ে গেল অথচ আমজাদ সাহেবেরও দেখা মিলল না। তিনি কি বাড়িতে নেই? আর আমজাদ সাহেবের মেয়ে, যাকে বিয়ে করার জন্য এসেছে, তাকে তো এখন পর্যন্ত দেখলই না। বাড়িতে ক’জন লোক, কে কোথায় রয়েছে-কে জানে!
আনিস রুম থেকে বেরিয়ে করিডর ধরে হাঁটতে শুরু করল। সমস্ত বাড়ি জুড়ে পিনপতন নীরবতা। টু শব্দটি পর্যন্ত নেই। যেন নিঝুমপুরী।
হাঁটতে-হাঁটতে এক পর্যায়ে বসার ঘরে পৌছে গেল। ঘরের দরজা খুলে বাইরে বেরোল। একা-একা সে বাড়িটা ঘুরে দেখবে। ভাগ্যে থাকলে এই বাড়ির মেয়ে বিয়ে করে, একদিন এই বাড়িটা তার হবে। তাই আগেই বাড়িটা ভাল করে দেখে নেয়া দরকার।
বাড়িটা দু’-তিন একরের কম হবে না। অনেক বড় বাড়ি। বারান্দা দিয়ে দেখতে পাওয়া পুকুরটাকে যতটা বড় ভেবেছিল তারচেয়েও অনেক বড়। বলা যায় একটা দিঘি। তবে সমস্ত বাড়ি জুড়ে অযত্ন আর অবহেলার ছাপ। পুরো বাড়ি জঙ্গল হয়ে রয়েছে। যেন এ বাড়িতে কেউ বাস করে না। পরিত্যক্ত বাড়ি।
কিছুক্ষণ বাড়ির মধ্যে ঘোরাঘুরির পর আনিস আবার রুমে ফিরে এল। তার খুব ঘুম পাচ্ছে। বার-বার হাই উঠছে। সমস্ত শরীর ঘুমে ভেঙে আসছে। বোধহয় নাস্তার পর চা খাওয়া হয়নি বলেই। সকালে চায়ের অভ্যেস তার অনেক দিনের।
.
আনিসের ঘুম ভাঙল রহিমা বেগমের ডাকে। বোধহয় এতক্ষণে রহিমা বেগম চা নিয়ে এসেছেন। বেশ বিরক্ত হলো আনিস। বুড়ি তার কাঁচা ঘুমটা ভাঙিয়ে দিলেন।
চোখ কচলাতে-কচলাতে উঠে বসল আনিস। বসে দেখল, রহিমা বেগম তার জন্য টেবিলে খাবার সাজাচ্ছেন। গরম ধোঁয়া ওঠা খাবার। তেহারি, আস্ত একটা মুরগির রোস্ট, খাসির মাংসের চপ, মগজ ভাজা, কষানো গরুর মাংস-আরও কী-কী যেন।
এরই মধ্যে দুপুরের খাবার নিয়ে এসেছেন, ব্যাপার কী! এ বাড়ির একটা দিক খুব ভাল লাগছে আনিসের, প্রতি বেলায়ই ভরপুর খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা।
রহিমা বেগম টেবিলে খাবার সাজাতে সাজাতে গজগজ করে বলতে লাগলেন, ‘সারাটা দিন পড়ে-পড়ে ঘুমাল! সন্ধ্যা গড়িয়ে এতটা রাত হয়ে গেল, ওঠার নাম নেই। রাতের খাবার দিয়ে গেলাম। গরম-গরম খেয়ে নিন।’
আনিস অবাক গলায় বলল, ‘রাত হয়ে গেছে মানে?! এই একটু আগে মাত্র ঘুমিয়েছিলাম-এরই মধ্যে রাত হয়ে যায় কীভাবে?’
রহিমা বেগম বললেন, ‘মানুষ যখন ঘুমিয়ে থাকে, তখন কি আর সময়ের হিসেব রাখে? সারা দিন ঘুমিয়ে, জেগে উঠে এখন বলছে, একটু আগে মাত্র ঘুমিয়ে ছিলাম।’
রহিমা বেগম চলে যাবার পর বিস্ময়ে হতবাক হওয়া আনিস বারান্দায় বেরিয়ে দেখল সত্যিই রাত হয়ে গেছে। সে নিজেকে অনেকভাবে বোঝাতে শুরু করল।
সাধারণত প্রচণ্ড মানসিক চাপের মুখে মানুষ ঘুমোতে পারে না। কখনও-কখনও আবার উল্টোটাও হয়। নার্ভ চাপ নিতে নিতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে যায়। বলা যায় মড়ার মত ঘুম হয়। তার ক্ষেত্রে সেটাই বোধহয় হয়েছে। গত রাতের নোংরা স্বপ্ন তার মনে ভয়ানক চাপ সৃষ্টি করেছে। এ ছাড়া অপরিচিত একটা বাড়িতে থাকছে, নীরব ছমছমে পরিবেশ, সারাক্ষণ একা-একা—সব মিলিয়ে বেহুঁশের মত ঘুমিয়েছে। ঘুমটা এতই গাঢ় ছিল যে কখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে টেরও পায়নি।
তেহারির মন মাতানো গন্ধে টেকা দায়। আনিস আর দেরি না করে বাথরুম থেকে মুখ-হাত ধুয়ে বেরিয়ে খেতে বসল। বেশ ভালই খিদে লেগেছে। উত্তেজনায় এতক্ষণ টের পায়নি। সকালের নাস্তার পর সারা দিনের উপোসী পেট বলে কথা।
.
আনিস আবার নোংরা স্বপ্নটা দেখেছে। স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে গেছে। তার বুকটা হাপরের মত ওঠা-নামা করছে। জোরে-জোরে নিঃশ্বাস ফেলছে। যেন স্বপ্ন নয়, ব্যাপারটা সত্যিই ঘটেছে।
ক্লান্তিতে আনিসের শরীর ভেঙে আসছে। প্রচণ্ড মানসিক যন্ত্রণা আর ক্লান্ত-বিধ্বস্ত শরীর নিয়ে সে ছটফট করছে। এসব কী হচ্ছে তার সঙ্গে?! বয়স্কা-মৃতা এক মহিলাকে নিয়ে সে এ ধরনের বাজে স্বপ্ন কেন দেখছে? গতকালও দেখল, আজও আবার দেখল। এই স্বপ্নের পিছনে কি কোনও রহস্য লুকিয়ে রয়েছে? কী সেই রহস্য?
ভাবতে-ভাবতে কখন যেন আনিস ঘুমিয়ে পড়েছে। আবার সেই নোংরা স্বপ্ন দেখছে। এবার আর তার মৃতা মামীকে নিয়ে নয়, এক বন্ধুর মৃতা মাকে নিয়ে। যিনি কি না চার-পাঁচ বছর আগে মারা গেছেন। তাঁর জানাজা-দাফনে আনিস উপস্থিত ছিল।
ছয়
মানসিকভাবে আনিস একেবারে ভেঙে পড়েছে। সেই সঙ্গে শারীরিক দিক দিয়েও। চোখের নীচে কালি পড়েছে। কণ্ঠার হাড় জেগে উঠেছে। গাল ভেঙে ভিতরে ঢুকে যাচ্ছে।
আজকাল এমন হচ্ছে…ঘুমোলেই সেই নোংরা স্বপ্ন দেখছে। পারাচত বিভিন্ন মৃতা মহিলাকে নিয়ে। তবে মাঝে-মাঝে এ বাড়ির কাজের মহিলা রহিমা বেগমকে নিয়েও ও-ধরনের নোংরা স্বপ্ন দেখছে।
রহিমা বেগমের সামনে পড়লে লজ্জায় তার মরে যেতে ইচ্ছে করে। অমন বৃদ্ধা একজন মহিলাকে নিয়ে ও-ধরনের নোংরা স্বপ্ন কী করে দেখে সে? ছিঃ-ছিঃ-ছিঃ! এরচেয়ে মরে যাওয়াও ভাল!
প্রতিদিনই ঘুম ভাঙার পর আনিস ভাবে এ বাড়িতে আর নয়। আজই সে এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। তারপর আবার কী করে যেন থেকে যায়। একে তো তার যাওয়ার জায়গা নেই, তারওপর যে কারণে সে এ বাড়িতে পড়ে আছে সেটা এখনও বাকি। মানে এ বাড়ির মেয়ের দেখা পাওয়া। যাকে বিয়ে করার প্রস্তাব নিয়ে এখানে আসা।
গতকাল আমজাদ সাহেব জানিয়েছেন আজ সন্ধ্যায় নাকি তাঁর মেয়ে মালয়েশিয়া থেকে আসবে। এত দিন সে বাড়িতে ছিল না। মালয়েশিয়ায় খালার কাছে বেড়াতে গিয়েছিল।
.
সন্ধ্যা সাতটার দিকে আনিসের ডাক পড়ল বসার ঘরে। মালয়েশিয়া থেকে আমজাদ সাহেবের মেয়ে এসেছে। আর দেরি নয়, দু’জনকে দু’জনার পছন্দ হলে শীঘ্রিই বিয়ের ব্যবস্থা করবেন।
আনিস কমপ্লিট স্যুট পরে যতটা সম্ভব নিজেকে ভদ্রস্থ করে বসার ঘরে এল।
বসার ঘরে আমজাদ হোসেনের পাশে অসম্ভব রূপবতী এক মেয়ে বসে আছে। দুধে-আলতা গায়ের রঙ। পটলচেরা হরিণী চোখ, গোলাপের পাপড়ির মত নরম ভেজা-ভেজা ঠোঁট। মানানসই সুন্দর নাক। চিকন ভুরু। ছোট চিবুক। কাশ্মীরী আপেলের মত লালাভ গাল। প্রশস্ত কপাল। সব মিলিয়ে যেন স্বর্গের অপ্সরা!
মেয়েটা অত্যন্ত লাজুক ভঙ্গিতে জবুথুবু হয়ে বসে আছে। কী নিষ্পাপ লাগছে তাকে! যেন এই মাত্র পবিত্র জল দিয়ে গোসল করে সমস্ত পাপ-পঙ্কিলতা ধুয়ে-মুছে এসেছে। অবাক কাণ্ড! সত্যিই তো তার লম্বা দিঘল চুলগুলো ভেজা-ভেজা। একটু আগেই বোধহয় গোসল করেছে। গোসলের পর সব মেয়েকে কিছুক্ষণ নিষ্পাপ মনে হয়।
আমজাদ হোসেন আনিসকে দেখে বলে উঠলেন, ‘বাবা, আনিস, এই আমার একমাত্র মেয়ে রুহি।’ তাঁর মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘রুহি, মা, এই হচ্ছে আনিস। খুব ভাল ছেলে। তুই যে রকম ছেলের কথা বলেছিস, ঠিক তেমন।
রুহি ভীরু চোখজোড়া তুলে একবার মাত্র আনিসের দিকে তাকিয়েই দৃষ্টি নামিয়ে ফেলল। সে তার বাবার কথায় বোধহয় লজ্জা পেয়েছে। মুখ লাল হয়ে গেছে।
রুহি ইতস্তত গলায় বলল, ‘বাবা, আমি এখন যেতে পারি? তোমাদের জন্য চা-নাস্তা নিয়ে আসি।’
আমজাদ হোসেন হাসতে-হাসতে বললেন, ‘যা, মা, যা, চা-নাস্তার সঙ্গে মিষ্টিও আনিস। শুভ মুহূর্তে মিষ্টি মুখ না করালে হয়!’ আনিস রুহির গমন পথের দিকে তাকিয়ে রইল। রুহি চোখের আড়াল হতেই খুক খুক করে কেশে কাঁচুমাচু মুখে আমজাদ হোসেনের দিকে ফিরল।
আমজাদ হোসেন বললেন, ‘রহিমা আজ বিকেলে ছুটি নিয়ে গ্রামের বাড়ি চলে গেছে। তাই রুহিকেই যেতে হলো চা-নাস্তা আনতে। তা, বাবা, আমার মেয়েকে কি তোমার পছন্দ হয়েছে?’
আনিস থতমত খাওয়া গলায় কোনওক্রমে বলল, ‘জি, হয়েছে।’
আমজাদ হোসেন হাসতে-হাসতে বললেন, ‘রুহির মুখ দেখে বুঝলাম, রুহিরও তোমাকে খুব পছন্দ হয়েছে। এক কাজ করলে কেমন হয়-কাজী ডেকে এনে আজ রাতেই তোমাদের বিয়ে পড়িয়ে দিই।’
.
কাজী ডেকে আনা হয়েছে। কাজী আর কেউ না, সুফি চেহারার সেই চায়ের দোকানী। রেজিস্ট্রি খাতা হাতে সে এখন পুরোদস্তুর একজন কাজী।
আমজাদ হোসেন হাসিমুখে বললেন, ‘আনিস, তুমি তাকে চেনো চায়ের দোকানী হিসেবে-আসলে সে একজন কাজীও। শুধু কাজীই নয়, বিয়ের ঘটকালিও করে। বলতে গেলে তোমাদের বিয়ের ঘটক তো সে-ই। তার কাছ থেকেই তো আমার মেয়ের খোঁজ পেয়েছিলে।’
রাত দশটার মধ্যে রুহি আর আনিসের বিয়ে সম্পন্ন হলো।
.
রুহি লাল রঙের বিয়ের শাড়ি পরেছে। লাল শাড়িতে রুহিকে আরও অপরূপা লাগছে।
আনিস মুগ্ধ চোখে রুহিকে দেখছে। ফিরে-ফিরে বার-বার দৃষ্টি চলে যাচ্ছে রুহির দিকে। কিছুতেই নজর ফেরাতে পারছে না।
সাত
প্রায় মাসখানিক কেটে গেছে।
আনিস আর রুহির দাম্পত্য জীবন বেশ সুখেই কাটছে।
রুহিকে পেয়ে আনিস নিজেকে ধন্য মনে করে। রুহির মত ভাল মেয়ে খুব কমই দেখা যায়। সে দেখতে যেমন সুন্দরী, তেমনি তার কথাবার্তা, আচার-আচরণ সব কিছুই সুন্দর।
রহিমা বেগম আর গ্রাম থেকে ফিরে আসেননি। রুহিই এখন রান্না-বান্না সহ ঘরের যাবতীয় কাজ করে। রুহির রান্নার হাতও দারুণ। যা-ই রান্না করে অত্যন্ত সুস্বাদু হয়। চমৎকার-চমৎকার সব রান্না করে আনিসের সামনে দেয়। আনিস খুবই তৃপ্তি নিয়ে সেসব খায়।
ভাল-ভাল খাওয়া-দাওয়ার পরও পরও দিনে-দিনে আনিস একেবারে রোগা হয়ে যাচ্ছে। নিজেও বুঝতে পারছে না কী কারণে এভাবে শুকিয়ে পাটকাঠির মত হয়ে যাচ্ছে। অথচ সিগারেট খাওয়াও ছেড়ে দিয়েছে। নাওয়া-খাওয়া-ঘুম সবই ঠিক মত হচ্ছে। রাতের বেশিরভাগ দু’জনের ভালবাসা-বাসিতে কাটলেও, সারাটা দিন ঘুমিয়েই পার করছে। এরপরও যতই দিন গড়াচ্ছে শুকিয়ে দড়ি-দড়ি হয়ে যাচ্ছে।
বিয়ের পর আনিস আর সেই নোংরা স্বপ্ন দেখেনি। অবশ্য এখনও মনের উপর সেই স্বপ্নের প্রভাব রয়ে গেছে। প্রতি রাতে ডিম লাইটের আধো আলোতে সে আর রুহি যখন শরীরী খেলায় মেতে ওঠে তখন কখনও-কখনও সেই নোংরা স্বপ্নের কথা মনে পড়ে যায়। রুহিকে তখন কুৎসিত সেই স্বপ্নের বৃদ্ধা মৃতা নারী বলে মনে করে ভয়ানক শিউরে ওঠে। কিছুক্ষণের জন্য মনে করে যেন সেই নোংরা স্বপ্নটাই দেখছে।
রুহির সব কিছু আনিসের ভাল লাগে। শুধু একটা দিক অসহ্য মনে হয়। তা হলো রুহির গায়ের গন্ধ। রুহি সব সময় গায়ে দামী পারফিউম ব্যবহার করে। কাছে গেলেই দামী পারফিউমের মিষ্টি সুবাস নাকে লাগে। কিন্তু যখন দু’জন শরীরী খেলায় মেতে ওঠে তখন রুহির গা থেকে মরা মাছের মত এক ধরনের তীব্র আঁশটে গন্ধ পাওয়া যায়। গন্ধটা এমনিতেই সাংঘাতিক রকমের বিচ্ছিরি লাগে, তারওপর সেই নোংরা স্বপ্নের কথা আরও বেশি মনে করিয়ে দেয়। কারণ, সেই নোংরা স্বপ্নেও মৃতা নারীদের গা থেকে এমন গন্ধ পেত আনিস।
প্রতি রাতে শরীরী খেলা শেষে ক্লান্ত-দুর্বল আনিস যখন গভীর ঘুমে তলিয়ে যেতে থাকে তখন মনে হয়, রুহি তার পাশ থেকে উঠে ধীরে পায়ে কোথায় যেন চলে যাচ্ছে। বিবসনা অবস্থায়ই।
আট
আনিসের শারীরিক অবস্থা খুবই খারাপ। তার শরীরটা শুকিয়ে একেবারে লিকলিকে হয়ে গেছে। দেখলে মনে হয় যেন কঙ্কালের উপর মাংসবিহীন চামড়া লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। চোখ দুটো কোটরে ঢুকে গেছে। চোখের নীচের হাড় ঠেলে বেরিয়ে এসেছে। চোয়াল ও কণ্ঠার হাড়ও একইভাবে বিচ্ছিরি রকমের ঠেলে বেরিয়ে এসেছে। দু’গাল ভেঙে এমনভাবে ভিতরে ঢুকেছে যে চামড়ার উপর থেকে দাঁতের খাঁজগুলো পর্যন্ত দেখা যায়। শরীরের সমস্ত রক্ত, মাংস, রস যেন কোনও অশুভ শক্তি শুষে নিয়েছে।
একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে গিয়েছিল। সব পরীক্ষা- নিরীক্ষা করেও ডাক্তার কোনও রোগই ধরতে পারেননি। আপাতত বলে দিয়েছেন, পুষ্টিহীনতা। কয়েক ধরনের ভিটামিন লিখে দিয়েছেন। তবে তিনি আরেকটা সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, এটি অতি মাত্রার কোনও রেডিয়েশনের প্রভাব কি না। দীর্ঘদিন কোনও মানুষ প্রচণ্ড রেডিয়েশনের মাঝে থাকলে এমন অবস্থা হতে পারে। আনিসের বাড়ির আশপাশে কোনও মিল-কারখানা বা মোবাইল ফোনের টাওয়ার রয়েছে কি না জিজ্ঞেস করেছিলেন।
গত তিন-চার দিন ধরে আনিসের অবস্থা আরও শোচনীয়। হাত-পা সহ তার সমস্ত শরীর অসাড় হয়ে গেছে। সে এখন আর বিছানা থেকে উঠতে পারে না। নড়াচড়া করার ক্ষমতাও নেই। মড়ার মত বিছানায় পড়ে আছে। বাক্শক্তিও হারিয়েছে। শুধু চোখ দুটো মেলে তাকিয়ে থাকে। চোখেও কম দেখে।
.
আমজাদ হোসেন আনিসকে দেখতে এসেছেন। তাঁকে দেখে আনিসের চোখ দুটো যক্ষা রোগীর মত জ্বলজ্বল করে উঠল। যেন তার চোখে হাজারও প্রশ্ন।
আমজাদ হোসেন আনিসের বিছানার পাশে বসলেন। তিনি আনিসের মাথায় হাত রেখে বললেন, ‘আনিস, বাবা, আমাকে ক্ষমা করে দিয়ো। সব জেনে-বুঝেও তোমাকে এই পরিণতির দিকে ঠেলে দিতে হয়েছে। বিশ্বাস করো, আমি নিরুপায়! আমার কিছুই করার ছিল না!’ তাঁর গলা ধরে এল।
আমজাদ হোসেন পাঞ্জাবির হাতায় চোখ মুছে বলতে লাগলেন, ‘আমার স্ত্রীর নাম ছিল রাহেলা। একে-অপরকে ভালবেসে বিয়ে করেছিলাম। বিয়ের পর হানিমুন করতে কুয়াকাটায় যাই। সৈকতের কাছাকাছি মাঝারি মানের একটা হোটেলে উঠি। হোটেলের রুম থেকেও সমুদ্রের গর্জন শোনা যেত। তখন কুয়াকাটা পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে ততটা জমে ওঠেনি বেশ নিরিবিলি। খুব ভালই দিন কাটছিল। তিন দিনের জায়গায় এক সপ্তাহ পেরোবার পরও ভাবি আরও দু’-একদিন পর যাব।
‘পূর্ণিমা রাত। সাড়ে দশটা কি পৌনে এগারোটা বাজে। রাতের খাওয়া-দাওয়ার পর আমরা দু’জন বাইরে হাঁটতে বেরোই। অত রাতে বাইরে লোকজন নেই বললেই চলে। শুধু আমরা দু’জন। হাঁটতে-হাঁটতে সৈকতে চলে যাই। রূপালি চাঁদের আলোতে চারদিক ঝকমক করছিল। বিশেষ করে সমুদ্র। প্রবল হাওয়া বইছিল। কী ভাল যে লাগছিল! আমরা দু’জন হাত ধরাধরি করে সৈকতে হেঁটে বেড়াচ্ছি। হঠাৎ আমাদের চোখে পড়ে বেশ কিছুটা দূরে সমুদ্রের ঢেউয়ের সঙ্গে কী যেন একটা ভেসে এসেছে। দূর থেকে কিছুই স্পষ্ট বোঝা যায় না। রূপালি চাঁদের আলোতে শুধু এটাই বুঝতে পারি, এক হাতের মত লম্বা শুভ্র রঙের জীবন্ত কিছু একটা। ধারণা করি কোনও সামুদ্রিক মাছ। শুনেছি ঢেউয়ের সঙ্গে অনেক সময় গভীর সমুদ্রের মাছ উপরে উঠে আসে। মনে লোভ জন্মায় মাছ হলে মন্দ হবে না! গ্রিল করে খাওয়া যাবে। হানিমুনে এসে নিজেদের হাতে ধরা মাছ গ্রিল করে খাওয়ার ব্যাপারটা খুবই মজার হবে।
‘আমরা দু’জন অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে সেদিকে ছুটে যাই। কাছে গিয়ে বিস্ময়ে আমাদের চোখ কপালে উঠে যায়। মাছ-টাছ কিছুই নয়, ছোট্ট একটা বাচ্চা! একেবারে সদ্য জন্মানো বাচ্চা! মানব শিশু! কী ফুটফুটে চেহারা! ছোট-ছোট হাত-পা নাড়ছে আর ওঁয়াও-ওঁয়াও করে কাঁদছে।
‘রাহেলা আঁতকে উঠে বলে, ‘ও, মা, এত সুন্দর একটা বাচ্চা! এখানে পড়ে রয়েছে কেন?! এর বাবা-মা কোথায়?’
‘আশপাশে তাকাই। কাউকে কোথাও দেখতে পাই না। এরই মধ্যে রাহেলা উলঙ্গ বাচ্চাটাকে উঠিয়ে শাড়ির আঁচলে পেঁচিয়ে নিয়েছে। আর মুখে বিভিন্ন আদরের শব্দ করছে, ‘ও-লে-লে, আমার বাবু কাঁদছে কেন! বাবুটা কাঁদছে কেন! কী হলো আমার সোনার! না, সোনা, কাঁদে না! সোনাটার বোধহয় খিদে লেগেছে! দুদু খাবে, সোনা?… ‘
‘বুঝতেই পারছ, মেয়েদের মন হচ্ছে মায়ের মন। মুহূর্তেই সে বাচ্চার মা হয়ে গেল। বাচ্চাটাকে নিয়ে আমরা হোটেলে চলে এলাম। হোটেলের ম্যানেজারকে জানালাম। ম্যানেজারকে বললাম চারদিকে খোঁজ-খবর করতে কাদের বাচ্চা নিখোঁজ হয়েছে জানার জন্য।
‘চার-পাঁচ দিন পেরিয়ে গেলেও বাচ্চার দাবি নিয়ে কেউই এল না। আমাদের পক্ষে আর কুয়াকাটা থাকা সম্ভব ছিল না।
অফিস থেকে দশ দিনের ছুটি নিয়ে এসেছিলাম। সেখানে পনেরো দিন হয়ে গেছে। ইনশিওরেন্স কোম্পানির ছোট চাকরি আমার। আরও দেরি করলে চাকরি থাকবে না। হোটেলের ম্যানেজারের কাছে ঠিকানা রেখে বাচ্চা নিয়ে চলে এলাম। যদি কেউ বাচ্চার খোঁজে আসে তা হলে যেন আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে।
‘দুই মাস পেরিয়ে গেলেও বাচ্চার খোঁজে আর কেউ এল না। ততদিনে আমার স্ত্রী তার নামের সঙ্গে মিল রেখে মেয়ে বাচ্চাটার নাম রাখল রুহি। রুহিকে নিয়ে আমাদের সুখের সংসার। সামান্য বেতনের চাকরি করি, কিন্তু সুখের অভাব ছিল না। শহরতলীতে নামে মাত্র সামান্য কিছু টাকা ভাড়ায় একটা টিনশেড বাড়িতে থাকি। উঠান, বাগান, পুকুর সহ বেশ বড় বাড়ি। বাড়িটা পুরোই আমাদের দখলে ছিল। আর কোনও ভাড়াটিয়া ছিল না। বাড়ির মালিক সপরিবারে সৌদি প্রবাসী। বাড়ির মালিক আমার এক দূরসম্পর্কের খালাতো ভাই। ভাড়া দেয়ার চেয়েও মূলত তিনি বাড়িটা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আমাদের থাকতে দেন। তিনি ভাড়া নিতেও চান না। ভাড়া দেবার কথা আমিই বলি। বিনে ভাড়ায় অন্যের বাড়িতে আশ্রিত হিসেবে থাকতে লজ্জা লাগে। অবশ্য কখনওই তিনি ভাড়ার টাকা হাতে নেননি। ভাড়ার টাকা দিয়ে তিনি বাড়ির খাজনা, কর, বিদ্যুৎ বিল, পানির বিল, এসব পরিশোধ করতে বলেন।
‘রুহির বয়স যখন ছয়-সাত মাস তখন সে হামা দিয়ে চলা- ফেরা শেখে। হামা দিয়ে সারা ঘরে ঘুরে বেড়ায়। অতটুকু বয়সেই তার মধ্যে একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ করি। সে পানি খুব পছন্দ করে। না, পানি খেতে নয়, পানি নিয়ে খেলতে। কোথাও পানি দেখলেই হলো, সে গিয়ে সেই পানি ধরবে, গায়ে মাখবে, পানিতে নেমে যাবে। হয়তো উঠানে বৃষ্টির পানি জমেছে, সে গিয়ে সেই পানিতে নামবে। বাথরুমের বালতিতে, গামলায় পানি ভরে রাখলে সে গিয়ে সেই পানিতে নামবে, খেলা করবে। বাগানের খানা-খন্দে পানি জমেছে, সে গিয়ে সেই পানিতে দাপাবে। আর আগুন দেখলে ঠিক উল্টোটা হয়। ভয়ে গুটিসুটি মেরে যায়। ছুটে পালায়। চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করে।
‘রুহির পানি নিয়ে খেলার অভ্যাস বাড়তেই থাকে। সারাক্ষণ পানি নিয়েই থাকতে চায়। যতই বড় হতে থাকে ততই তার মধ্যে অস্বাভাবিকতা বাড়তে থাকে। দুই বছর বয়সে নিজ থেকেই সাঁতার শিখে যায়। সারা দিন বাড়ির পুকুরে সাঁতার কাটে। মাঝে-মাঝে ডুব দিয়ে মাছ ধরে ওঠায়। সেই মাছ কাঁচাই চিবিয়ে খেয়ে ফেলে। এক-একবার ডুব দিয়ে দশ-পনেরো মিনিট ধরে পানির নীচে থাকে।
‘একজন সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যাই। সাইকিয়াট্রিস্ট রুহির সঙ্গে কথাবার্তা বলে হাসিমুখে জানান, ‘আপনাদের মেয়ের কোনওই সমস্যা নেই। খুবই বুদ্ধিমতী একটা মেয়ে। সে যা করছে কৌতূহল থেকে করছে। এমনিতেই শিশু মনে কৌতূহলের সীমা থাকে না, তারওপর অতিরিক্ত রকমের বুদ্ধি যাদের, তাদের মধ্যে কৌতূহল আরও বেশি মাত্রায় থাকে। পানিতে নেমে দাপাদাপি, কাঁচা মাছ খাওয়া সবই কৌতূহল থেকে করছে। বয়স বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে সব ঠিক হয়ে যাবে।’
‘বয়স বাড়ার সঙ্গে কিছুই ঠিক হয় না। আরও বেশি করে অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়। মাঝ রাতেও ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে পুকুরে নামে। অনেক গাল-মন্দ করি। কোনওই লাভ হয় না। পানিতে না নামলে তার নাকি খুব গরম লাগে, গায়ে জ্বালা-পোড়া হয়।
‘রুহির আট বছর বয়সে আমার স্ত্রী রাহেলা মারা যায়। ও মারা যায় গর্ভপাত হয়ে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে। তার আগেও রাহেলা আরও বেশ কয়েকবার গর্ভধারণ করেছিল। প্রতিবারই গর্ভপাত হয়ে বাচ্চা নষ্ট হয়ে যায়। শেষের দিকে রাহেলা বলত, ‘বার-বার গর্ভপাত হয়ে বাচ্চা নষ্টের পিছনে রুহিরই কোনও হাত রয়েছে। রুহি চায় না আমাদের সংসারে অন্য কোনও সন্তান আসুক।’ কী কারণে যেন রাহেলা রুহিকে সাংঘাতিক ভয় পেতে শুরু করেছিল। অদ্ভুত-অদ্ভুত কথা বলত, ‘রুহি মানুষ নয়, অন্য কিছু! সমুদ্রের গভীরে থাকা ডাইনি-প্রেতের বংশধর। ওর অশুভ শক্তির প্রভাবেই আমাদের বাচ্চা নষ্ট হয়ে যায়। এখন গর্ভের বাচ্চা মারছে, একদিন আমাদেরও মেরে ফেলবে।’
‘রাহেলার মৃত্যুর পর আমি কেমন ছন্নছাড়া হয়ে যাই। প্রচণ্ড হতাশা ঘিরে ধরে। ঘর-সংসার-চাকরি কোনও কিছুতেই মন বসাতে পারি না। চাকরি চলে যায়। ধার-দেনায় ডুবে যাই। দু’বেলা ঠিক মত খাবারও জোটে না। একদিন রুহি কাপড়ের ছোট্ট একটা পোঁটলা এনে হাতে দিয়ে বলে, ‘বাবা, এটা তোমার প্রয়োজন মিটাবে।’
‘পোঁটলা খুলে বিস্ময়ে আমার চোখ কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চায়। পোঁটলার ভিতর অনেকগুলো মুক্তা। প্রথমে কিছুক্ষণ হাঁ করে চেয়ে থাকি। এরপর কোনওক্রমে বিস্ময়ে বসে যাওয়া গলায় বলি, ‘এগুলো তুমি কোথায় পেলে?! কোথাও থেকে চুরি করে এনেছ?’
‘রুহি কিছুই বলে না, চুপ করে থাকে।
‘ধমকে উঠি, ‘বলছ না কেন, কোথা থেকে চুরি করে এনেছ?’
‘রুহি থমথমে গলায় বলে, ‘চুরি করে আনিনি। পানির নীচ থেকে এনেছি।’
‘রুহির গলায় এমন কিছু ছিল যে আমি আর কিছুই জানতে চাইনি। মুক্তোগুলো নিজের কাছে রেখে দিই। পাওনাদারদের তাগাদায় শেষ পর্যন্ত মুক্তোগুলো বিক্রি করে পাওনা মেটাই। পাওনা মেটানোর পরও অনেকগুলো টাকা হাতে রয়ে যায়। নিজের মধ্যে আবার কর্মোদ্যম ফিরে পাই। ভাবতে থাকি কী করা যায়। ছোট-ছোট ব্যবসা শুরু করলে কেমন হয়?
‘কিছু দিন পর রুহি আবার একটা পোঁটলা এনে আমার হাতে দেয়। আমি অবাক গলায় জিজ্ঞেস করি, ‘আবার কী নিয়ে এসেছ?’
‘রুহি গম্ভীর গলায় বলে, ‘খুলে দেখো।’
‘পোঁটলা খুলে দেখি অনেকগুলো সোনা-রূপার মোহর। কমপক্ষে পাঁচ-ছয়শো বছর আগের পুরনো বিভিন্ন মোহর। বিস্ময়ে আমার মাথা ঘুরে পড়ে যাবার অবস্থা হয়। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে জিজ্ঞেস করি, ‘এগুলো কোথায় পেলে?!’
‘রুহি স্বাভাবিক গলায় বলে, ‘পানির নীচে।’
‘আমি অবিশ্বাসী গলায় বলে উঠি, ‘সত্যি করে বলো, পানির নীচে এত-এত দামি মোহর আসবে কোত্থেকে?!’
‘রুহি বলে, ‘সমুদ্রের তলায় দামি অনেক কিছুই রয়েছে। বিশেষ করে প্রাচীন ডুবে যাওয়া জাহাজের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে এসব মূল্যবান জিনিস পাওয়া যায়।’
‘আমি সাংঘাতিক আশ্চর্য হওয়া গলায় বলি, ‘তুমি সমুদ্রে গেলে কখন?! তুমি তো শুধুমাত্র বাড়ির পুকুরে নেমে ডুব মেরে থাকো। আজকাল যে একসঙ্গে দুই সপ্তাহ, তিন সপ্তাহ ধরে ডুব মেরে থাকো, তা-ও আমি জানি। কিন্তু এর সঙ্গে সমুদ্র থেকে মোহর খুঁজে আনার কী সম্পর্ক?!’
‘রুহি ঠোঁট বাঁকিয়ে রহস্যময় হাসি দিয়ে বলে, ‘বাবা, তুমি এসব নিয়ে না ভেবে, এগুলো দিয়ে তোমার প্রয়োজন মেটাও।’
‘আমি মোহরগুলো বিক্রির ব্যবস্থা করি। মোহরগুলোতে থাকা সোনা-রূপার ওজনের যে মূল্য হয় বেশিরভাগ মোহরই তারচেয়ে দশগুণ বিশগুণ বেশি দামে বিক্রি করি। এত বেশি দাম পাওয়া যায় ওগুলোর অ্যাণ্টিক ভ্যালুর কারণে।
‘রুহি কিছু দিন পর-পর এমন দামি জিনিস দিতেই থাকল। মোহর, হীরা, মুক্তা, চুনি, পান্না সহ বিভিন্ন দামি-দামি পাথর, সেই সঙ্গে প্রাচীন রাজা-বাদশাহদের ব্যবহৃত সোনার আংটি, সোনার হাতলওয়ালা তলোয়ার, ঘোড়ার নাল, বিভিন্ন দেব-দেবীর ছোট- ছোট মূর্তি, থালা-বাসন, পানপাত্র, মোমদানি—আরও অনেক কিছু। শুধু সোনার তৈরি জিনিসপত্রই নয়, মাঝে-মাঝে একেবারে খাঁটি সোনার বারও দেয়। সবই নাকি সমুদ্রের নীচ থেকে আনে। বিভিন্ন সময়ে ডুবে যাওয়া জাহাজের সঙ্গে নাকি এগুলোও ডুবে গিয়েছিল। জলদস্যুদের ডুবে যাওয়া জাহাজের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে এগুলো সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়।
‘আমি আমজাদ জুয়েলারী নামে একটা গয়নার দোকান খুলে ফেলি। অল্প কিছু দিনের মধ্যেই কোটি-কোটি টাকার মালিক বনে যাই। সৌদি প্রবাসী দূরসম্পর্কের খালাতো ভাইয়ের কাছ থেকে বাড়িটা কিনে নিই। সেই সঙ্গে বাড়ির সংলগ্ন আশপাশের ফাঁকা জমি, ফসলের খেত, মাঠ, বাগান, জঙ্গল, বাড়ি-ঘরও কিনে নিই। বিক্রি করতে না চাইলে দ্বিগুণ-তিনগুণ টাকার লোভ দেখিয়ে কিনে নিই। উদ্দেশ্য বাড়ির সীমানা যত বড় করা যায়। রুহির সুবিধার দিকেও নজর দিই। পুকুরটাকে কাটিয়ে বড় করে দিঘি আকৃতির করি। ঘরের প্রতিটা রুম এসি করি। সে যেহেতু গরম সহ্য করতে পারে না।
‘রুহির বয়স তেরো-চোদ্দ হলে তার মধ্যে আর একটা অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়। সে আমার মৃতা স্ত্রী রাহেলার মত করে শাড়ি পরতে শুরু করে। রাহেলার মত সাজগোজ করে। সারাক্ষণ আমার আশপাশে ঘুরঘুর করে। এক রাতে ঘুম ভেঙে দেখি সে আমার মাথায়-গায়ে হাত বোলাচ্ছে। আমি বুঝতে পারি সে কী চাইছে।
‘ছিঃ-ছিঃ-ছিঃ! পালিতা মেয়ে হলেও সে আমার মেয়ে! মেয়ে হয়ে বাবাকে নিয়ে এমন নোংরা ভাবনা তার মাথায় কী করে আসে ভেবে কূল পাই না। ধারণা করি নিশ্চয়ই তার উপর কোনও ভূত-পেত্নীর আছর রয়েছে। সে যা করছে সেই খারাপ জিনিসটার আছরের কারণেই করছে। এই যে দামি-দামি মণি, মুক্তা, হীরা-এসব এনে দিচ্ছে, নিশ্চয়ই সেই অশুভ শক্তির মাধ্যমেই। অনেক হয়েছে, এবারে একটা ওঝা এনে দেখাতে হবে। সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে কোনও লাভ নেই।
‘চান শাহ ফকির নামে এক নামকরা ওঝার খোঁজ পাই। সেই ওঝাকে এনে দেখাই।
‘চান শাহ ফকির ঝাড়-ফুঁক, পানি পড়া, তেল পড়া, তাবিজ- কবজ সহ বিভিন্ন ধরনের তদবির দিতে থাকে। তাতে কোনওই লাভ হয় না। ঝাড়-ফুঁক করার সময় রুহি শুধু খিলখিল করে হাসত।
‘এক পর্যায়ে চান শাহ ফকির বলে, ‘আপনার মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দিন, সব ঠিক হয়ে যাবে। যত দ্রুত সম্ভব বিয়ে দিয়ে দিন।’
‘আমি চান শাহকে বলি, ‘বিকৃত মস্তিষ্কের মেয়েকে বিয়ে করবে কে?’
‘চান শাহ বলে, ‘আপনি চাইলে আমি একটা ভাল ছেলের খোঁজ দিতে পারি। ছেলের বাবা-মা কেউ নেই। এতিমখানায় বড় হয়েছে। দেখতে-শুনতেও ভাল।’
‘দেরি না করে সেই ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিই। কিছু দিনের মধ্যে সেই ছেলেটার পরিণতি তোমারই মত হয়। এক পর্যায়ে মারা যায়। সামনের বাগানে কবর দিই। কবরের উপর রুহি একটা লাল গোলাপের গাছ লাগিয়ে দেয়। গাছটায় এক সময় ফুল ফোটে। গভীর রাতে সেই ফুল খোঁপায় গুঁজে বিবস্ত্র হয়ে রুহি পুকুরে নেমে যায়। আগের মত আবার শাড়ি পরে সেজেগুজে সারাক্ষণ আমার আশপাশে ঘুরঘুর করা শুরু করে।
‘চান শাহ ফকিরকে খবর দিয়ে আনিয়ে সব বলি। চান শাহ বলে, আবার রুহিকে বিয়ে দিতে
‘এবারও চান শাহই বিয়ের জন্য ছেলে জোগাড় করে। এবারের ছেলেটাও কিছু দিনের মধ্যে একই পরিণতিতে মারা যায়। বাগানে কবর দিই। রুহি আগেরবারের মত আরেকটা গোলাপ গাছ লাগায়। সেই একই লাল গোলাপ।
‘এরপর একের পর এক ভবঘুরে, এতিম, বাউণ্ডুলে, ঘর পালানো বিভিন্ন ছেলে নিয়ে আসতে থাকে চান শাহ। আর প্রত্যেকেরই একই পরিণতি হয়। বাগানে লাল গোলাপের গাছও একটা-একটা করে বাড়তে থাকে।
‘আমি বা চান শাহ ফকির যা কিছু করছি তা সবই ওই ডাইনি রুহির ইচ্ছাতেই করছি। বাড়িটাকে বড় করা, পুকুরটাকে দিঘি আকৃতির করা, বিয়ের জন্য একের পর এক ছেলে জোগাড় করে আনা…সবই ওই ডাইনির ইচ্ছাতে হচ্ছে। ডাইনিটা আমাদের সম্মোহন করে রেখেছে। তার ইচ্ছার বাইরে আমাদের কিছুই করার ক্ষমতা নেই। বিয়ের জন্য যেসব ছেলেকে আনা হয় তাদেরও সম্মোহন করে ফেলে। এই যেমন তুমি। এ বাড়িতে আসার পরই বুঝেছিলে এখানে অস্বাভাবিক কিছু আছে। এরপরও সম্মোহিত হয়ে থাকার ফলে বাড়ি ছেড়ে যাওনি।
‘চান শাহ ফকিরই হচ্ছে সেই চায়ের দোকানী। যে চায়ের দোকানী তোমাকে এই ঠিকানা দিয়েছিল। সে চায়ের দোকানী সেজে বসে আছে শুধু মাত্র বিয়ের পাত্র ধরার জন্য। অবশ্য সে তার নিজের ইচ্ছেতে এসব করছে না, করছে ডাইনির ইচ্ছেতে।
‘তোমার মনে হয়তো প্রশ্ন জাগছে ডাইনিটার সঙ্গে যে ছেলেরই বিয়ে হচ্ছে তার পরিণতি কেন এমন হচ্ছে? কারণ, ডাইনিটার সঙ্গে শারীরিকভাবে মিলিত হওয়া মানেই নিজের জীবনীশক্তি বিলিয়ে দেয়া। ডাইনিটা শরীরী মিলনের মাধ্যমে জীবনী শক্তি শুষে নিয়ে ধীরে-ধীরে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। তবে বোধহয় বেশি দেরি নেই এই ডাইনির কবল থেকে মুক্তি পাবার। বছর দুই ধরে বিয়ের জন্য ছেলে পেতে দেরি হলে সে কেমন বুড়োটে হয়ে যায়। মুখমণ্ডল সহ শরীরের সমস্ত চামড়া কুঁচকে ভাঁজ-ভাঁজ হয়ে বুড়ো মানুষের মত ঢলঢল করতে শুরু করে। চুলেও পাক ধরে। চোখ দুটো ঘোলাটে হয়ে যায়। চলা-ফেরা করে বুড়োদের মত কুঁজো হয়ে। আবার নতুন একটা ছেলেকে ভোগ করতে শুরু করার পর জোয়ান হতে থাকে।
‘তুমি আসার পর বাড়িতে রহিমা বেগম নামে যে কাজের মহিলাকে দেখেছ সে আসলে এই ডাইনিই। কাজের মহিলার ছদ্মবেশে ছিল। ঘুমের মাঝে স্বপ্নে কিছু দিন তোমাকে ভোগ করার পর সে জোয়ান হয়ে ওঠে। এরপর রুহি হয়ে সামনে আসে। তুমি কিছুই বুঝতে পারনি।
‘আমাকে ক্ষমা করে দিয়ো, বাবা। আমার কোনও দোষ নেই। আমি ডাইনির প্রভাবে সব করছি। এতক্ষণ ধরে যে তোমাকে সব কিছু জানালাম তা-ও বোধহয় ডাইনির ইচ্ছেতেই। প্রত্যেকটা ছেলেকেই মৃত্যুর আগে-আগে আমি এসে এভাবে- সব জানাই। ডাইনিটা হয়তো চায় মৃত্যুর আগে অন্তত ছেলেগুলো জেনে যাক তার মৃত্যুর কারণ।’
পরিশিষ্ট
গভীর রাত। রুহি বাড়ির বাগানে নতুন লাগানো গোলাপ গাছটার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। গাছটায় আজই প্রথম একটা ফুল ফুটেছে। কী সুন্দর গন্ধ ছড়াচ্ছে! ফুলটা ছিঁড়ে সে খোঁপায় পরবে। এরপর পোশাক খুলে নগ্ন হয়ে পুকুরে নেমে যাবে।
সে তার পালক বাবা আমজাদ হোসেন এবং চান শাহ ফকিরকে মেরে ফেলেছে। তাঁদেরকে আর তার দরকার নেই। এখন থেকে সে তার নিজের প্রয়োজন নিজেই মেটাতে পারবে।
এত বড় বাড়িতে বড্ড একা লাগে তার। বুক ভরা ভালবাসা নিয়ে সে অপেক্ষায় আছে ভালবাসার মানুষের। নিশ্চয়ই কিছু দিনের মধ্যেই ভালবাসার মানুষ পেয়ে যাবে। তাকে সে খুব ভালবাসবে! খু-ব! ভালবাসায়-ভালবাসায় নিঃশেষ করে ফেলবে। এরপর আবার নতুন আরেকজন ভালবাসার মানুষ খুঁজে নেবে। কোনও দিনও এই ভালবাসা ফুরাবে না। চির যৌবনা হয়ে বেঁচে থাকবে সে।