গুহামানবী
জামাল সাহেব পায়ে হেঁটে অফিস থেকে বাসায় ফিরছেন। সন্ধ্যা হয়েছে অনেকক্ষণ। ইলেকট্রিসিটি নেই। লোডশেডিং চলছে। প্রতিদিনই সন্ধ্যার পর-পর ঘণ্টা দুয়েকের জন্য লোডশেডিং শুরু হয়। চারদিক ডুবে আছে কালিগোলা অন্ধকারে। রাস্তায় লোকজন নেই বললেই চলে। ছোট্ট মফস্বল শহর বলে রাস্তার আশপাশে তেমন একটা দোকানপাটও নেই। এলাকাটা বড্ড নিরিবিলি, গা ছমছমে।
জামাল সাহেবের হাতে বাজারের ব্যাগ। ব্যাগ ভর্তি বাজার। আজ মাসের চার তারিখ। প্রতি মাসের চার-পাঁচ তারিখে তাঁদের অফিসের বেতন হয়। ইন্সুরেন্স কোম্পানির ছোট্ট চাকরি তাঁর। এমনিতে সারাটা মাসই তাঁকে টেনেটুনে চলতে হয়। মাসের এই একটা দিন তিনি ছেলে-মেয়েদের নিয়ে একটু ভাল খাওয়ার চেষ্টা করেন। ভাল-মন্দ বাজার করে নিয়ে আসেন।
আজ তিনি বাজার করেছেন পোলাওয়ের চাল, একটা বাচ্চা মুরগি, মুগ ডাল, লাউ, কুঁচো চিংড়ী, ঘি, দই আর আস্ত একটা গরুর মাথা। মাংসের দোকানের কসাই গরুর মাথাটা কেটেকুটে বানিয়ে দিয়েছে। গরুর মাথাটার দাম পড়েছে পাঁচশো টাকা। এমনিতে এই সাইজের গরুর মাথা সাত-আটশো টাকার নীচে কেনা যায় না। সন্ধ্যার পর বলেই দর-দাম করে অনেক কমে পাঁচশো টাকায় কেনা গেছে।
গরুর আস্ত মাথা কিনলে ভিন্ন-ভিন্ন অনেক কিছু পাওয়া যায়। মগজ, হাড়সহ মাথার মাংস, জিভের মাংস, এ ছাড়া ইচ্ছে করলে মাথার চামড়াটাও অনেক ঝামেলা করে পশম ছাড়িয়ে খাওয়া যায়।
একটা আস্ত গরুর মাথায় যা কিছু পাওয়া যায় সবই অত্যন্ত সুস্বাদু। জামাল সাহেব ভেবে রেখেছেন স্ত্রীকে বলবেন, আজ রাতে আলুর কুচি দিয়ে মগজটা ভাজতে, জিভের মাংস ভুনা করতে, আর অল্প কিছু হাড়-গোড় দিয়ে মুগ ডালের ঘণ্ট করতে। বাকিটা কালকের জন্য রেখে দিতে। কাল বাচ্চা মুরগিটার রোস্ট, পোলাও, বাকি মাংসের রেজালা আর লাউ-কুঁচো চিংড়ীর ঝোল।
খাবারের আইটেমের কথা ভাবতে-ভাবতে জামাল সাহেবের জিভে পানি এসে যাচ্ছে। তিনি ঢোক গিলতে-গিলতে অন্ধকারে জোরে-জোরে পা চালাচ্ছেন। আর পনেরো-বিশ গজ সামনে এগোনোর পর অনেক পুরানো একটা কবরস্থানের পাশ কাটিয়ে তাঁকে যেতে হবে। বিশাল জায়গা নিয়ে কবরস্থানটা। বর্তমানে কবরস্থানটা পরিত্যক্ত। ওই কবরস্থানে এখন আর কোনও লাশ কবর দেয়া হয় না। সবার কাছে ওই কবরস্থান দোষ-লাগা কবরস্থান নামে পরিচিত। রাতের বেলা নাকি ওখানে বিভিন্ন ভৌতিক কাণ্ড-কারখানা ঘটে। তাই যত রাত বাড়ে ওই কবরস্থানের সামনের রাস্তা ধরে লোকজনের যাতায়াত ততই কমে যায়। এমনকী দিনের বেলায়ও সাধারণত ওই কবরস্থানের ভিতরে কেউ ঢোকে না।
পরিত্যক্ত ওই কবরস্থান ঘিরে এই এলাকার লোকদের মধ্যে নানান রটনা ছড়িয়ে রয়েছে। বহু বছর আগে, যখন ওই কবরস্থানে লাশ কবর দেয়া হত তখন নাকি প্রায়ই কবর থেকে লাশ চুরি হয়ে যেত। লাশ চুরির চেয়েও আশ্চর্যজনক ব্যাপার ছিল কয়েক মাস পর আবার লাশটাকে ফেরত পাওয়া। লাশের পেটে, বুকে, মাথায়, শরীরের বিভিন্ন স্থানে সেলাইয়ের দাগ দেখা যেত। পোস্টমর্টেমের পর লাশে যেমন সেলাই করে দেয়া হয় তেমন। তবে ততদিন বাদেও লাশ থাকত একেবারে অক্ষত। অর্থাৎ সামান্যতম পচন ধরার কোনও চিহ্ন দেখা যেত না। কয়েক মাস আগে লাশ যেমন অবস্থায় কবর দেয়া হয়েছিল, ঠিক তেমন।
সবাই ধারণা করে কোনও সংঘবদ্ধ চক্র হয়তো লাশ চুরি করে নিয়ে লাশের শরীরের বিভিন্ন অর্গান, যেমন- ফুসফুস, লিভার, কিডনি, চোখ-এসব খুলে রেখে আবার ফেরত দিয়ে যায়। কিন্তু কারা এভাবে লাশ চুরি করে নিয়ে যায়, আবার ফেরত দিয়ে যায়, অনেক সন্ধান-অনুসন্ধান, চেষ্টা-তদবির চালিয়েও তার কোনও হদিস পাওয়া যায় না। অনেকে আবার তখন এসব জিন-ভূতের কাণ্ড বলে মনে করতে শুরু করে। তাদের মতে জিন-ভূত লাশ চুরি করে নিয়ে শরীরের ভিতরের কলিজা-টলিজা খেয়ে ফেরত রেখে যায়।
একসময় চুরি যাওয়া লাশ আর বুক-পেট চেরা অবস্থায় ফেরত না এসে অন্যভাবে ফেরত আসতে শুরু করে। তা হলো লাশের শরীরের সমস্ত চামড়া ছাড়ানো অবস্থায়। চামড়ার নীচের শিরা- উপশিরাগুলো থাকত একেবারে অক্ষত। যেন কেউ নিপুণ হাতে চামড়াটা ছাড়িয়েছে, চামড়ার নীচের শিরা-উপশিরাগুলোকে গুণে দেখার জন্য।
কবরস্থান থেকে লাশ চুরির ব্যাপারটা ঘটতেই থাকে। ধীরে- ধীরে ওই কবরস্থানে লাশ কবর দেয়া কমে আসে। বলতে গেলে কেউই আর ওই কবরস্থানে কবর দেয় না। শুধুমাত্র গরিব-দুঃখী, অসহায়, রাস্তার ভিখিরি, ভ্রাম্যমাণ পাগল আর বেওয়ারিশ লাশ মাঝে-মাঝে কবর দেয়া হয়। একবার তেমনই এক অল্প বয়সী পাগলি মারা যাবার পর তাকে কবর দেয়া হয়। যথারীতি পাগলিটার লাশও চুরি হয়ে যায়। প্রায় এক বছর পর আবার ফেরত আসে। তবে এবার ভয়ানক আশ্চর্য একটা ঘটনা ঘটে। পেট-বুক চেরা বা চামড়া ছেলা লাশ নয়, একেবারে জলজ্যান্ত অবস্থায় ফেরত আসে। পেটটা অনেক বড় থাকে। দেখেই বোঝা যায় পাগলিটা গর্ভবতী।
মৃত মানুষ আবার জীবিত অবস্থায় ফিরে আসার ব্যাপারটা কেউ মেনে নিতে পারে না। সবাই পাগলিটাকে ডাইনি, প্রেতাত্মা এসব ভাবে। মারধর করে লোকালয় থেকে তাড়িয়ে দেয়। শেষ পর্যন্ত পাগলিটা আশ্রয় নেয় ওই কবরস্থানেই। বেশ কয়েক দিন গভীর রাতে কবরস্থানের ভিতর থেকে পাগলির করুণ সুরের কান্নার আওয়াজ ভেসে আসে। এরপর আর পাগলিকে কোথাও দেখা যায় না। সেই থেকে কবরস্থানটা পুরোপুরি পরিত্যক্ত হয়ে যায়। হতদরিদ্র, অসহায়, বেওয়ারিশ লাশও আর কবর দেয়া হয় না। দীর্ঘদিন ধরে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থেকে- থেকে কবরস্থানটা এখন বিশাল এক ঘন জঙ্গলে পরিণত হয়েছে।
জঙ্গল-ছাওয়া ওই কবরস্থানের পাশ কাটিয়ে যাবার সময় অনেকে বিভিন্ন অদ্ভুত কাণ্ডের মুখোমুখি হয়। কখনও-কখনও রাতের বেলা কবরস্থানের সামনের রাস্তা ধরে যাতায়াত্-করা যানবাহন কোনও কারণ ছাড়াই বন্ধ হয়ে যায়। শত চেষ্টাতেও তখন আর সেই যানগুলোকে সচল করা যায় না। সেই সময় হঠাৎ করেই পুরো এলাকাটা মুহূর্তের মধ্যে ঘন কুয়াশায় ঢেকে যায়। যানবাহনে থাকা লোকেরা চোখের সামনে ধোঁয়ার মত ঘন কুয়াশা ছাড়া আর কিছুই দেখতে পায় না। কিছু সময় পর কুয়াশা কেটে যায়। যানগুলোও আবার সচল হয়ে ওঠে। তবে মাঝে-মাঝে কুয়াশা কেটে যাবার পর দেখা যায় যানগুলো থেকে যাত্রীদের কেউ একজন গায়েব হয়ে গেছে। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তাকে আর সেই সময় খুঁজে পাওয়া যায় না। তিন-চারদিন পর আবার হারিয়ে- যাওয়া সেই লোকটাকে ফেরত পাওয়া যায়-অজ্ঞান অবস্থায়।
কবরস্থানের সামনে যে জায়গা থেকে সে গায়েব হয়েছিল ঠিক সেখানেই। জ্ঞান ফেরার পর লোকটা কিছুই বলতে পারে না। সে কোথায় গায়েব হয়েছিল, কী হয়েছিল, এই তিন-চারদিন কোথায় ছিল-সেই সম্পর্কে কিছুই তার মনে পড়ে না। তবে লোকটার শরীরের কোথাও-কোথাও অনেক দিনের পুরানো সেলাইয়ের দাগ দেখা যায়। বিশেষ করে পেটে-বুকে-মাথায়। যেন বহু বছর আগে তার বড় ধরনের কোনও অপারেশন হয়েছিল। সেই অপারেশনের সেলাইয়ের দাগ।
কেউ-কেউ আবার গভীর রাতে জঙ্গল-ছাওয়া কবরস্থানের ভিতরে অদ্ভুত ধরনের আলো দেখতে পেয়েছে। কেউ বলেছে উজ্জ্বল নীলাভ আলো, কেউ বলেছে উজ্জ্বল লালাভ আলো, কেউ বলেছে চাঁদের আলোর মত হালকা রূপালী আলো। এক-একজন এক-এক রঙের আলোর কথা বলেছে।
অনেকে আবার কিছু শুনতে পেয়েছে। কখনও হাসির শব্দ, কখনও কান্নার শব্দ, কখনও অদ্ভুত বিলাপের শব্দ।
অনেকে আবার লম্বা হাড় জিরজিরে রোগা শীর্ণ দেহের ভয়ঙ্কর চেহারার এক উলঙ্গ নারীকে দেখতে পেয়েছে, যার গলাটা অস্বাভাবিক রকমের লম্বা, সেই তুলনায় মুখটা ছোট, মাথা ভর্তি উষ্কখুষ্ক কোঁকড়ানো চুলের জঙ্গল, চোখ দুটো জ্বলন্ত অঙ্গার, হাত ভর্তি পাখির ঠোঁটের মত সামান্য বাঁকানো লম্বা-লম্বা নখ। চলাফেরা করে চার হাত-পায়ে হামাগুড়ি দিয়ে। আচমকা নাকি সেই নারী মূর্তি কবরস্থানের সামনের রাস্তা ধরে যাওয়া পথচারীদের সামনে মাকড়সার মত চার হাত-পায়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে, পথ আগলে, পথচারীদের হাতে থাকা বাজার-সদাই কেড়ে নিয়ে চোখের পলকে পালিয়ে যায়।
.
জামাল সাহেব পরিত্যক্ত কবরস্থানের সামনে পৌঁছে গেছেন। রাস্তার ডান ধারে কবরস্থান। আর বাম পাশে বিশ-পঁচিশ গজ দূরে খোলা মাঠের মাঝ দিয়ে চলে গেছে রেললাইন। এই জায়গাটা পেরোবার সময় প্রতিদিনই তাঁর বুক অজানা এক আতঙ্কে ধুক ধুক করে। সেটাই স্বাভাবিক। এই জায়গাটা সম্পর্কে এত কিছু জানার পর যে কারওই রাতের বেলা এই জায়গা পাড়ি দেবার সময় বুক ধুক-পুক করার কথা।
চারদিক নিকষ অন্ধকার। জঙ্গল-ছাওয়া কবরস্থানের ভিতর থেকে ভেসে আসছে একঘেয়ে ঝিঁঝি পোকার ডাক। এ ছাড়া আশপাশটা একেবারে সুনসান। জামাল সাহেব হাঁটার গতি আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন। অন্ধকারে এতক্ষণ ধরে পথ চলতে-চলতে তাঁর চোখ সয়ে এসেছে। অস্পষ্টভাবে হলেও অন্ধকারে এখন তিনি অনেকটাই দেখতে পাচ্ছেন।
হঠাৎ তিনি লক্ষ করলেন, তাঁর সামনে দশ-বারো হাত দূরে কী যেন একটা একেবারে মাটির সঙ্গে মিশে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে আসছে। তিনি থমকে দাঁড়িয়ে গেলেন। তাঁর বুকের ভিতর ধক করে উঠল। কিছু বুঝে উঠবার আগেই হামাগুড়ি-দেয়া আকৃতিটা এক লাফে তাঁর হাত থেকে বাজারের ব্যাগটা ছিনিয়ে নিয়ে, চোখের পলকে কবরস্থানের ভিতরের জঙ্গলে হারিয়ে গেল।
.
জোরে-জোরে দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হচ্ছে। জামাল সাহেবের স্ত্রী খাদিজা বেগম অবাক হয়ে ভাবলেন, এত জোরে দরজার কড়া নাড়ছে কে? যেন দরজা ভেঙে ফেলতে চাইছে! এই সময়ে তো জামাল সাহেবের ফেরার কথা। তবে কি অন্য কেউ এসেছে? তিনি তো কখনও এভাবে পাগলের মত দরজার কড়া নাড়েন না!
দরজা খুলে জামাল সাহেবকে দেখে খাদিজা বেগমের চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেল। জামাল সাহেবের সমস্ত শরীর ঘামে ভেজা। তিনি দরজার চৌকাঠে হাত রেখে পাগলা কুকুরের তাড়া-খাওয়া লোকদের মত হাঁপাচ্ছেন। যেন তাঁর দম নিতে অনেক কষ্ট হচ্ছে। চোখে-মুখে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট।
খাদিজা বেগম জামাল সাহেবের অবস্থা দেখে ভড়কে গিয়ে চিৎকার করে ছেলে-মেয়েদের নাম ধরে ডেকে উঠলেন, ‘ওরে হাসান, ওরে, মিনা, শিগগির এদিক আয়। তোদের আব্বার যেন কী হয়েছে! বোধহয় কিছু দেখে ভয় পেয়ে এসেছেন। তাড়াতাড়ি আয় তোরা।’
ছেলে-মেয়েরা চলে আসার আগেই খাদিজা বেগম জামাল সাহেবকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে ঘরে ঢুকিয়ে বসালেন।
জামাল সাহেব হাঁপানির রোগীর মত হাঁপিয়েই যাচ্ছেন। হাঁপাতে-হাঁপাতে ফ্যাসফেঁসে গলায় কোনওক্রমে বললেন, ‘পানি।’ হাত ইশারা করেও বোঝালেন তিনি পানি খেতে চাইছেন।
এরই মধ্যে হাসান আর মিনাও চলে এসেছে। হাসান মাস্টার্স কমপ্লিট করেছে পাঁচ বছর হতে চলল। আর মিনা এ বছর এইচ. এস. সি. দেবে। হাসান মাস্টার্স করেছে পদার্থ বিজ্ঞানে। খুবই ভাল রেজাল্ট তার। তবুও এত দিনে একটা চাকরি জোটাতে পারল না। পারবেই বা কী করে! হাসান শারীরিক প্রতিবন্ধী। ছোট বেলায় পোলিও আক্রান্ত হয়ে তার ডান পা-টা পুরোপুরি পঙ্গু হয়ে গেছে। বাঁ পায়ে কিছুটা জোর আছে। ক্রাচে ভর দিয়ে হাঁটতে পারে।
.
জামাল সাহেবকে পানি-টানি খাইয়ে কিছুটা সুস্থির করা হলো। তিনি স্ত্রী-ছেলে-মেয়েকে কবরস্থানের সামনে তাঁর সঙ্গে কী ঘটেছে সব বিস্তারিত জানালেন।
সব শোনার পর হাসান বলল, ‘আব্বা, আপনি শুধু-শুধুই ভয় পেয়েছেন। আপনি কোনও জিন-ভূতের খপ্পরে পড়েননি। জিন- ভূত বলে কিছু নেই। বোধহয় কোনও ক্ষুধার্ত বানর আপনার হাত থেকে বাজারের ব্যাগ ছিনিয়ে নিয়েছে। বানররা এমন কাজ মাঝে- মাঝে করে।’
জামাল সাহেব দুর্বল গলায় প্রতিবাদ জানালেন, ‘না, ওটা বানর হতে পারে না। অত বড় বানর হয় না। কী লম্বা-লম্বা হাত-পা! লম্বা গলা! হামাগুড়ি দেয়া অবস্থায়ও বোঝা গেছে ওটা আকৃতিতে অনেক লম্বা।
হাসান সহজ গলায় বলল, ‘বানরই। অন্ধকারে দেখেছেন বলে বানরের চেয়ে বড় মনে হয়েছে।’
খাদিজা বেগম বলে উঠলেন, ‘এই এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে আসার পর থেকেই তো ওই কবরস্থান ঘিরে অনেকের মুখে অনেক অদ্ভুত ঘটনা শুনছি। সবই তো আর মিথ্যে হতে পারে না। নিশ্চয়ই ওখানে জিন-ভূত কিছু একটা আছে। আর বানরের কথা যে বলছিস, এই এলাকায় বানর আছে বলে তো কারও মুখে শুনিনি, বা এখন পর্যন্ত দেখিওনি।’
হাসান যেন একটু চিন্তায় পড়ল। সত্যিই এই এলাকায় কোনও বানর নেই। খানিকক্ষণ ভেবে হাসান বলল, ‘এই এলাকায় বানর নেই সত্যি। কিন্তু এই কবরস্থানের জঙ্গলে তো দু’-একটা বানর থাকলেও থাকতে পারে। সেগুলো হয়তো দিনের বেলায় জঙ্গলে লুকিয়ে থাকে বলে কারও চোখে পড়েনি।’
মিনা বলল, ‘ভাইয়া, পথচারীদের হাত থেকে বাজারের ব্যাগ ছিনিয়ে নেয়া না হয় বানরের কাজ বলেই ধরে নিলাম। কিন্তু জঙ্গলের মধ্যে বিভিন্ন রঙের আলো দেখতে পাওয়া, যানবাহন অচল হওয়া, হঠাৎ ঘন কুয়াশায় ঢেকে যাওয়া, যাত্রীদের গায়েব হওয়া-এসবও কি বানরের কাজ?’
হাসান হাসার মত ভঙ্গি করে বলল, ‘এই সবই গাল-গপ্পো, রটনা।’
মিনা বলল, ‘ভাইয়া, যা কিছু রটে, কিছু একটা কিন্তু বটে।’
খাদিজা বেগম বলে উঠলেন, ‘কবরস্থানের ওই জঙ্গলে জিন- ভূত আছে কি নেই, তা নিয়ে মাথা ঘামানোর কোনও দরকার নেই আমাদের। তোদের আব্বাকে তো কবে থেকেই বলে আসছি, বদলি হয়ে এখান থেকে চলে যাবার জন্য। এই শহরটাই আমার পছন্দ হয়নি। কেমন ফাঁকা-ফাঁকা, নির্জন!’
দুই
হাসান সকালে এবং বিকেলে দুটো টিউশনি করে। খুবই সামান্য কিছু আয় হয়। ঢাকায় থাকতে অনেকগুলো টিউশনি করত। মাস শেষে বেশ ভাল একটা রোজগার হত। অবশ্য ঢাকায় খরচও ছিল বেশি। সেই তুলনায় এই মফস্বল শহরে খরচ কম। অকেজো পায়ের জন্য চাকরির আশা সে ছেড়ে দিয়েছে। শুধু-শুধু বসে থাকার চেয়ে দু’-একটা টিউশনি করে তবু যা আয় হয়। এমনিতেই তাদের টানাটানির সংসার। তার বাবার ইন্সুরেন্স কোম্পানির ওই ছোট্ট চাকরিটার উপর তারা চারটা মানুষ নির্ভরশীল। সংসারের বড় ছেলে হয়েও সংসারের জন্য তেমন কিছু করতে পারছে না, এই দুঃখ তাকে প্রতিনিয়ত কুরে-কুরে খায়।
হাসান বিকেলের টিউশনি করে হেঁটে বাড়ি ফিরছে। ক্রাচে ভর দিয়ে। সন্ধ্যা নামতে এখনও অনেক বাকি। কবরস্থানের সামনে পৌঁছনোর পর হাসানের মনে হলো এই কবরস্থানকে ঘিরে এত ভীতিকর গল্প, এত আতঙ্ক ছড়িয়ে রয়েছে-একবার ভিতরে ঢুকে দেখলে কেমন হয়। সত্যিই কি এখানে রহস্যজনক কিছু রয়েছে? নাকি লাশ চুরি যাওয়ার পুরানো ঘটনা আর বর্তমানের এই জঙ্গল- ছাওয়া গা ছমছমে পরিবেশের কারণেই লোকমুখে বিভিন্ন ভীতিকর রটনা ছড়িয়ে পড়ছে?
হাসান মন ঠিক করে ফেলেছে, সে কবরস্থানের ভিতরে ঢুকে অনুসন্ধান চালিয়ে দেখবে আসলে ব্যাপারটা কী।
ক্রাচে ভর দিয়ে ধীর পায়ে হাঁটতে-হাঁটতে কবরস্থানের ভিতরে চলে এসেছে ও। চারদিকটা গাদাগাদি করে বেড়ে ওঠা ঘন গাছ- গাছালিতে ঢাকা। কেমন অন্ধকারাচ্ছন্ন। এটা যে একসময় কবরস্থান ছিল তা মনেই হচ্ছে না। আশপাশে কোনও কবরের চিহ্ন মাত্র নেই। যেন একটা পরিত্যক্ত জঙ্গল।
হাসান সামনে এগিয়েই যাচ্ছে। জঙ্গলটা বিশাল জায়গা জুড়ে। বাইরে থেকে দেখে বোঝা যায়নি জঙ্গলটা যে এতটা বিস্তৃত। পুরোটাই কবরস্থান ছিল বলে মনে হচ্ছে না। এত বড় জায়গা নিয়ে কবরস্থান হবার কথা নয়। মনে হয় আগে থেকেই কবরস্থানের পাশ ঘেঁষে বিশাল জঙ্গল ছিল। বোধহয় পরবর্তীতে সেই জঙ্গল কবরস্থানকেও গ্রাস করে নিয়েছে।
চারদিক অন্ধকার হয়ে আসছে। সন্ধ্যা নামতে আর বেশি দেরি নেই। হাসান জঙ্গল থেকে বেরিয়ে যাবার কথা ভাবছে। পুরোপুরি অন্ধকার নেমে এলে বাইরে বেরনোর পথ গুলিয়ে ফেলতে পারে। আরেক দিন হাতে সময় নিয়ে আসবে।
হঠাৎ ওর চোখ পড়ল সামনে পড়ে-থাকা ছোট্ট একটা পাথরের দিকে। খুবই ছোট্ট একটা পাথর। বড়জোর একশ’ গ্রাম ওজনের। এর পরও পাথরটা হাসানের পুরো নজর কেড়ে নিয়েছে। পাথরটা লাল রঙের। কিছুটা যেন উজ্জ্বল দ্যুতি ছড়াচ্ছে।
হাসান ক্রাচে ভর দিয়ে অনেক কষ্টে নুয়ে পাথরটা তুলল। হাতের তালুতে মুছে পাথরটায় লেগে-থাকা ধুলো-বালি পরিষ্কার করল। কী সুন্দর ঝকঝকে লাল রঙের পাথর। ভাবল, পাথরটা নিয়ে যাবে। হতে পারে এটা কোনও দামি পাথর। রাত সোয়া তিনটা।
উত্তেজনায় হাসানের চোখে ঘুম আসছে না। সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার পর থেকে সে লাল পাথরটাকে অনেকবার ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখেছে। সে পদার্থ বিজ্ঞানের ছাত্র, তার চোখ ভুল করতে পারে না। এটা কোনও সাধারণ পাথর নয়। এটা একটা চুনি পাথর। আনকাট চুনি। যখন এই পাথরটাকে কেটে পলিশ করা হবে, তখন এর দাম হবে লক্ষ-লক্ষ টাকা। এত দামি পাথর ওই জঙ্গলে এল কোত্থেকে? তা হলে কি সত্যিই ওই জঙ্গলের ভিতরে কোনও গোপন রহস্য লুকিয়ে রয়েছে?
তিন
ভর দুপুর।
হাসান ক্রাচে ভর দিয়ে কবরস্থানের জঙ্গলের ভিতর ঘুরে বেড়াচ্ছে। নীরব-নিস্তব্ধ, গা ছমছমে পরিবেশ। পুরোটা জঙ্গল গাছের ডালপালায় ছাওয়া বলে রোদের আলো সরাসরি ভিতরে ঢুকছে না। তাই এই ভরদুপুরেও কেমন অন্ধকারাচ্ছন্ন।
জঙ্গলটা এতই বিশাল যে হাসান বেশ কয়েকবার পথ গুলিয়ে একই জায়গায় ঘুরপাক খেয়েছে। এখন সে একটা ভাঙা ইটের টুকরো হাতে নিয়ে গাছের গায়ে চিহ্ন এঁকে-এঁকে এগোচ্ছে, যাতে আর পথ ভুল না হয়।
হাসান জঙ্গলের ভিতর প্রায় মাইলখানেক পাড়ি দিয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত অস্বাভাবিক কিছু তার চোখে পড়েনি। সেই একই দৃশ্য। গা ঘেঁষাঘেঁষি করে ডালপালা ছড়ানো চেনা-অচেনা বিভিন্ন গাছ-গাছালি। কোথাও খুব ঘন হয়ে জন্মেছে, কোথাও সামান্য পাতলা হয়ে।
আরও অনেকটা চলার পর হাসান জঙ্গলের অদ্ভুত একটা জায়গায় পৌছল। জায়গাটা অন্য জায়গার মত নয়। নেই কোনও গাছ-গাছালি, ঝোপ-ঝাড়, জঙ্গল। এমনকী দূর্বাঘাস বা আগাছাও নেই। চাতালের মত খোলা একটা জায়গা। অনেকখানি জায়গা নিয়ে এই খোলা জায়গাটা। ইচ্ছে করলে এই খোলা জায়গায় একটা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট মাঠ করা যায়।
হাসান সাংঘাতিক অবাক হলো। জঙ্গলের মধ্যে এমন একটা খোলা জায়গা কেন?! কী এমন কারণ যেজন্য এখানে কোনও গাছ- গাছালি জন্মেনি?!
হাসান এই খোলা জায়গায় এসে অনেকক্ষণ বাদে সরাসরি আকাশ দেখতে পেল। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেছে। সূর্যটা পশ্চিমের আকাশে হেলে পড়েছে। এখনই তার ফিরতি পথ ধরা উচিত। নইলে সন্ধ্যা নামার আগে জঙ্গল থেকে বেরোতে পারবে না।
হাসান ফিরতি পথ ধরেছে। তবে সে যে পথে এসেছিল সেই পথে নয়। সেখান থেকে পঁচিশ-তিরিশ হাত বামের একটা পথ ধরে। ইচ্ছে করেই সে ফেরার জন্য অন্য একটা পথ বেছে নিয়েছে। আসার সময় তো পথে অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়েনি। যদি এই ভিন্ন পথে কিছু চোখে পড়ে, সেই আশায়।
হাসান অস্বাভাবিক কিছু দেখতে পেয়েছে। জঙ্গলের ভিতরে একটা ঢিপি। অনেকখানি জায়গা নিয়ে বেশ বড়সড় উঁচু একটা ঢিপি। যেন ছোটখাট একটা পাহাড়। যথারীতি ঢিপির উপরও জন্মেছে গাছ-গাছালির আচ্ছাদন। ঢিপির নীচের দিকে বিশাল একটা গর্ত। গর্ত না বলে গুহা বললেও ভুল হবে না। ঠিক যেন পাহাড়ের গুহা। গুহাটা কমপক্ষে তিন-চার ফুট ব্যাসের।
হাসান গুহার মুখের সামনে দাঁড়িয়ে ভিতরে উঁকি-ঝুঁকি মারছে। কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। ভিতরটা একেবারে ঘুটঘুটে অন্ধকার। তার কেমন ভয়-ভয় লাগছে। ভিতরে হিংস্র জন্তু-জানোয়ার লুকিয়ে থাকতে পারে। তবে এই এলাকায় বাঘ, চিতাবাঘ বা ওই জাতীয় কিছু আছে বলে কখনও শোনেনি। এরপরও ভিতরে ঢুকতে সাহস হচ্ছে না। কোনও হিংস্র জন্তু-জানোয়ার থাকুক আর না-ই থাকুক, অন্ধকার গুহাটাকেই তো ভয় লাগছে।
হাসান গুহার মুখ থেকে সরে আসার জন্য পা বাড়াবে, ঠিক তখন তার চোখ পড়ল গুহার মুখে পড়ে-থাকা ছোট্ট একটা পাথরের দিকে। সবুজ রঙের একটা পাথর। ঝুঁকে পাথরটা হাতে তুলে নিল। গতকালের মত হাতের তালুতে ঘষে পাথরটায় লেগে-থাকা ধুলো-বালি মুছে নিল। কী সুন্দর ঝকঝকে সবুজ রঙের পাথর! নিশ্চয়ই এটাও কোনও দামি পাথর।
সবুজ পাথরটা পকেটে ভরে হাসান ফেরার জন্য দ্রুত পথ চলতে শুরু করল। আর এক মুহূর্তও দেরি করা যাবে না। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে।
.
হাসান রাত জেগে সবুজ পাথরটাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিশ্চিত হয়েছে ওটা একটা আনকাট পান্না। গতকাল পাওয়া ওই চুনি পাথরটার মত এই পাথরটাও অনেক মূল্যবান।
জঙ্গলের ভিতর এমন মূল্যবান পাথর এল কোত্থেকে?! এর পিছনে কী রহস্য?! এমন কি হতে পারে সমস্ত রহস্য ওই গুহাটার মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে? হতেও পারে!
হাসান সারা রাত ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সে ওই গুহার মধ্যে ঢুকে দেখবে, কী রয়েছে ওই গুহায়।
.
ভর দুপুর।
হাসান আজ আবার জঙ্গলে ঢুকেছে। সোজা ঢিপির কাছে চলে এসেছে। সঙ্গে করে টর্চ, মোমবাতি আর দেশলাই নিয়ে এসেছে।
টর্চ জ্বেলে ঢিপির গুহার মধ্যে ঢুকে পড়েছে সে। কেমন গুমোট একটা ভাপসা গন্ধ নাকে লাগছে। গুহাটা সুড়ঙ্গের মত দশ-বারো হাত সোজা গিয়ে ডান দিকে বাঁক নিয়েছে। হাসান ক্রাচে ভর দিয়ে ঠক-ঠক শব্দ তুলে এগিয়ে যাচ্ছে।
ডান দিকের বাঁক ঘুরতেই ওর চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। ঠিক যেন বর্গাকার একটা কামরায় এসে পড়েছে। কামরার মেঝে ভর্তি খড়-কুটোর স্তূপ। কামরার চারধারের দেয়ালে এবং মেঝেতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে নানান রঙের ছোট-ছোট পাথর। লাল, নীল, সবুজ, গোলাপী, বেগুনি, সাদা স্বচ্ছ কাচের মত, পীত বর্ণ, বিড়ালের চোখের মত জ্বলজ্বলে…বিভিন্ন ধরনের।
বিস্ময়ে বিমূঢ় হাসান টর্চের আলো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সমস্ত কামরাটা দেখছে। হঠাৎ কামরার সিলিং-এ মাকড়সার মত চার হাত-পায়ে সেঁটে থাকা বানরসদৃশ একটা প্রাণীকে দেখতে পেয়ে তার বুকটা ধক করে উঠল। জন্তুটা সিলিং-এ সেঁটে থাকা অবস্থায় ঘাড় ঘুরিয়ে ক্রুদ্ধ চোখে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। জন্তু বলা বোধহয় ঠিক হচ্ছে না। ভালভাবে লক্ষ করে ওটাকে মানুষ বলেই মনে হচ্ছে। একটা মেয়েমানুষ। লম্বা লিকলিকে রোগা হাত-পা। মাথা ভর্তি জঙ্গুলে চুল। পরনে পোশাক নেই। গায়ের রঙ মেটে। বোধহয় ওটা সত্যিকারের গায়ের রঙ নয়। হয়তো অনেক দিন ধরে গায়ে ধুলো-ময়লার আস্তরণ পড়ে অমন মেটে রঙ ধারণ করেছে।
জংলি চেহারার মেয়েটা সিলিং থেকে লাফিয়ে সোজা হাসানের সামনে পড়ল। পশুর মত চার হাত-পায়ে থাবা গেড়ে বসে দাঁত খিঁচিয়ে হিংস্র গর্জন করতে শুরু করল।
হাসান ঘটনার আকস্মিকতায় এতটাই হতবিহ্বল হয়ে গেছে যে চেয়ে-চেয়ে দেখা ছাড়া কিছুই তার মাথায় আসছে না। মেয়েটা হিংস্র ডাক ছেড়েই যাচ্ছে আর এমন ভঙ্গি করছে যেন এখনই লাফিয়ে এসে হাসানের গায়ে পড়ে চেপে ধরবে।
হাসান আতঙ্কে বুজে-আসা গলায় কোনওক্রমে বিড়বিড় করে উঠল, ‘আমি তোমার কোনও ক্ষতি করতে আসিনি। আমি এমনিতেই একজন পঙ্গু মানুষ, কারও ক্ষতি করার ক্ষমতা আমার নেই।’
মেয়েটা গর্জন থামিয়ে যেন কান খাড়া করে হাসানের কথা শুনছে। হাসান কিছুটা সাহস ফিরে পেয়ে আবার বলল, ‘আমি তোমার কোনও ক্ষতি করতে আসিনি। আমাকে ভয় পাবার কিছু নেই।’
মেয়েটা কোনও জবাব না দিয়ে অপলকে হাসানের চোখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। বোধহয় হাসানকে বুঝতে চেষ্টা করছে। হাসানও মেয়েটার চোখে চোখ রেখে একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে। সে চোখ সরিয়ে নিতে পারছে না। যেন সে সম্মোহিত হয়ে পড়েছে।
কিছুক্ষণ বাদে হাসান খেয়াল করল তার মাথার মধ্যে ভোঁতা এক ধরনের যন্ত্রণা হচ্ছে। সেই সঙ্গে তার মাথার মধ্যে কেউ যেন কথা বলছে, ‘কে তুমি? এই জঙ্গলে কী চাও?’
হাসানের মনে হলো সামনে-থাকা মেয়েটাই যেন কথা বলছে। অথচ মেয়েটার মুখ নড়ছে না।
হাসান আবার মাথার মধ্যে শুনতে পেল, ‘কে তুমি? এই জঙ্গলে কী চাও?’
হাসান ভীত এবং বিচলিত গলায় বলে উঠল, ‘কিছুই চাই না। তোমার ঠোঁট নড়ছে না, অথচ স্পষ্ট তোমার কথা শুনতে পাচ্ছি-এটা কী হচ্ছে?! তুমি কি মানুষ, না অন্য কিছু?’
হাসান আগের মত আবার মাথার মধ্যে শুনতে পেল, ‘জানি না, আমি কে। জন্মের পর থেকেই আমি এই জঙ্গলে থাকি। এই জঙ্গলের বাইরে আমার কোনও জ্ঞান নেই। জঙ্গলটা ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোনও কিছুই আমার পরিচিত নয়। আমি তোমার মত মুখে শব্দ উচ্চারণ করে ভাব আদান-প্রদান করতেও জানি না। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে হাঁটতেও জানি না। যেহেতু আমি কিছুই জানি না, তাই এই মুহূর্তে আমি আমার মস্তিষ্কের সঙ্গে তোমার মস্তিষ্কের সংযোগ স্থাপন করে, তোমার সাথে যোগাযোগ করছি। তোমার মস্তিষ্কের নিউরনে-নিউরনে জমে থাকা শিক্ষা, জ্ঞান, স্মৃতি, তথ্য, ভাষা…এসব ব্যবহার করেই তোমার সঙ্গে ভাব আদান-প্রদান করছি। এই জন্যে ভাব আদান-প্রদান করতে তোমার মত আমার ঠোঁট নড়ছে না।’
বিস্ময়ে হাসানের মুখ হাঁ হয়ে গেল। দুটি মস্তিষ্কের এভাবে ভাব আদান-প্রদানকে টেলিপ্যাথি বলে। মেয়েটা সেই টেলিপ্যাথি ব্যবহার করে তার সঙ্গে কথা বলছে। শুধু কথাই বলছে না, সেই সঙ্গে তার মস্তিষ্কের জ্ঞানভাণ্ডারও ব্যবহার করছে। তা না পারলে জংলি, অসভ্য, ভাষা-জ্ঞানহীন বন্য এই মেয়ে কোনওভাবেই হাসানকে তার মনের ভাব বোঝাতে পারত না। কে এই মেয়েটা? কোত্থেকে এই জঙ্গলে এসেছে?
হাসান মাথার মধ্যে শুনতে পেল, ‘তুমি আবারও ভাবছ, কে আমি? কোত্থেকে এসেছি? আমি তো আগেই বলেছি, আমি জানি না-আমি কে। জন্মের পর থেকেই একা-একা আমি এই জঙ্গলে থাকি। শুধু জানি কীভাবে জঙ্গলে টিকে থাকতে হয়।’
হাসান মনে-মনে বলল, ‘এতদিনে তুমি এই জঙ্গল ছেড়ে সভ্য মানুষের কাছে চলে যাওনি কেন?’
মেয়েটা টেলিপ্যাথিতে বলল, ‘আমার ধারণা, সভ্য মানুষরা আমাকে মেনে নেবে না। তারা আমাকে সামনে পেলে, মেরে ফেলবে। এই জঙ্গলই আমার নিরাপদ আশ্রয়।’
হাসান ভাবল, মেয়েটা ভুল বলছে না। ওর যেরকম জংলি ভয়ঙ্কর চেহারা, তাতে সভ্য মানুষেরা তাকে অন্য কিছু ভেবে, ভয় পেয়ে মেরে ফেলতেও পারে।
হাসান বলল, ‘আচ্ছা, তোমার এই গুহার মধ্যে এত রঙ- বেরঙের পাথর এল কোত্থেকে?’
মেয়েটা বলল, ‘জঙ্গলের বাইরে মাঠের মাঝ দিয়ে যাওয়া রেললাইন থেকে এই পাথরগুলো আমি কুড়িয়ে এনেছি।’
হাসান ভীষণ অবাক হয়ে বলল, ‘কী বলছ! এগুলো, রেললাইনের পাথর হয় কীভাবে?! রেললাইনে থাকে তো সাধারণ পাথর। এগুলো তো সব দামি পাথর। এগুলোকে বলা হয় রত্ন পাথর। তোমার এই গুহায় যতগুলো রত্ন পাথর আছে, এর মূল্য কোটি-কোটি টাকা।’
মেয়েটা বলল, ‘এই পাথরগুলো রেললাইনের সাধারণ পাথরই। আমি এই পাথরগুলোকে কুড়িয়ে আনি আলো জ্বালবার জন্যে। ছোট সাইজের যে কোনও পাথরই আমি কিছুক্ষণ হাতের মুঠোয় ধরে রাখলে পাথরটায় আলো জ্বলে ওঠে, কোনও পাথরে লাল রঙের আলো জ্বলে, কোনওটায় নীল রঙের, কোনওটায় সবুজ রঙের…আলো নিভে যাবার পর দেখা যায় যে, পাথরে যে রঙের আলো জ্বলেছিল, সেই পাথরটা সেই রঙের হয়ে গেছে।’
মেয়েটার কথা শুনে বিস্ময়ে হাসানের চোখে পলক পড়ছে না। কী বলছে মেয়েটা! মেয়েটা নিজের অজান্তেই শুধুমাত্র হাতের ছোঁয়ায় একটা সাধারণ পাথরকে রত্ন পাথরে পরিবর্তন করে ফেলে!!! এ যেন আধুনিক বিজ্ঞানকে ভেলকি দেখানো।
হাসান বসে-যাওয়া গলায় বলল, ‘এখন বুঝতে পারছি তোমার এই পাথর থেকে বের হওয়া লাল, নীল, সবুজ রঙের আলো দেখেই লোকেরা ভৌতিক আলো মনে করে। আচ্ছা, পথচারীদের হাত থেকে বাজারের ব্যাগ কি তুমিই ছিনিয়ে নাও?’
‘হ্যাঁ, আমিই ছিনিয়ে নিই। সাধারণত আমি এই কাজটা করি না। এই জঙ্গলের ভিতর থেকেই আমি আমার খাবার সংগ্রহ করি। জঙ্গলের ফল-মূল, পোকা, ব্যাঙ, কেঁচো, টিকটিকি, গিরগিটি, মাকড়সা, পাখি, বিভিন্ন ছোট-ছোট জন্তু, এসব দিয়েই আমি আমার খিদে মেটাই। যখন অনেক দিন ধরে কিছুই জোগাড় করতে পারি না, তখন খিদের জ্বালা সইতে না পেরে নিরুপায় হয়ে পথচারীদের বাজারের ব্যাগ ছিনিয়ে নিই।’
হাসান বলল, ‘ভৌতিক আলো দেখতে পাওয়া, বাজারের ব্যাগ ছিনিয়ে নেয়া—এ ছাড়াও আরও একটা অদ্ভুত কাণ্ড ঘটে এই জঙ্গল ঘিরে। তা হলো মাঝে-মাঝে ঘন কুয়াশায় ঢেকে যাওয়া, যানবাহন থেকে যাত্রীদের গায়েব হওয়া…এ সম্পর্কে তুমি কিছু জানো?’
‘না, এ সম্পর্কে আমি বেশি কিছু জানি না। শুধু এটুকুই জানি, মাঝে-মাঝে আকাশ থেকে কারা যেন আসে। তখন কুয়াশার মত সৃষ্টি হয়। তারা এসেছে টের পেলেই আমি গুহার মধ্যে লুকিয়ে পড়ি।’
আকাশ থেকে কারা যেন আসে, এ কথাটা শুনে হাসান বেশ চিন্তায় পড়ে গেল। আকাশ থেকে কারা আসবে?! মেয়েটা কি সত্যি কথা বলছে?
হাসান মাথার মধ্যে শুনতে পেল, ‘আমি সত্যি কথাই বলছি। মিথ্যা বলতে আমি জানি না।’
হাসান সাংঘাতিক বিরক্ত হলো। কী এক অদ্ভুত মেয়ে, তার চিন্তা-ভাবনা সব ধরে ফেলছে।
হাসান গভীর দৃষ্টিতে মেয়েটার পা থেকে মাথা পর্যন্ত নজর বোলাতে শুরু করল। মেয়েটার অনুন্নত উন্মুক্ত বুক জোড়ার দিকে নজর পড়তেই সে থমকে গেল। তার মনের ভিতর কামনার ঢেউ ছলাৎ করে উঠল। তার বয়স আটাশ। আটাশ বছরের কোনও যুবকের সামনে উন্মুক্ত শরীরে কোনও তরুণী বসে থাকলে এমন অনুভূতি হওয়াটাই স্বাভাবিক।
মেয়েটা যেন হাসানের অনুভূতি বুঝতে পেরে লজ্জা পেল। সঙ্গে-সঙ্গে সে দু’হাতে বুক জোড়া ঢেকে ফেলল।
হাসান অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বলল, ‘সন্ধ্যা হয়ে আসছে। আজ আমি তা হলে আসি। কাল আবার আসব। কাল তোমার জন্য খাবার আর পোশাক নিয়ে আসব।’
চার
পরদিন হাসান মেয়েটার জন্য বিভিন্ন ধরনের ফল, শুকনো খাবার, খাওয়ার পানি আর পোশাক নিয়ে আসে। মেয়েটাকে শিখিয়ে দেয় কীভাবে পোশাক পরতে হয়। পোশাক পরার আগে মেয়েটাকে গোসল করে নিতে বলে। গোসলের জন্য একটা সাবানও নিয়ে আসে।
মেয়েটার গুহা থেকে কিছুটা দূরেই ডোবার মত ছোট্ট একটা পুকুর আছে। সেই পুকুর থেকে মেয়েটা গোসল সেরে পোশাক পরে আসে।
হাসান মেয়েটার পোশাক বলতে যা আনে, তা হলো চুরি করে তার বোনের এক সেট পুরানো লাল রঙের সালোয়ার-কামিজ। গোসলের পর লাল রঙের সালোয়ার-কামিজে মেয়েটাকে যেন চেনাই যায় না। তার জংলি চেহারা পুরোপুরি উধাও হয়ে যায়। স্ফটিকের মত ফর্সা গায়ের রঙ ফুটে ওঠে। হাসান একেবারে মুগ্ধ হয়ে যায়। তবে মেয়েটা আগের মত হামা দিয়ে চলাফেরা করায় কিছুটা যেন বুনো ছাপ থেকেই যায়।
হাসান মনে-মনে সিদ্ধান্ত নেয়, এই মেয়েটাকে সে পুরোপুরি সভ্য করে তুলবে। মেয়েটাকে দু’পায়ে দাঁড়িয়ে হাঁটা শেখাবে, মুখে কথা বলা শেখাবে, আদব-কায়দা শেখাবে, ভদ্রতা, সামাজিকতা…সভ্য মানুষের সবকিছুই শেখাবে। মেয়েটা অত্যন্ত বুদ্ধিমতী, মনে হয় না এসব শেখাতে খুব একটা বেগ পেতে হবে।
.
প্রায় তিন মাস কেটে গেছে। সেই থেকে হাসান রোজ গোপনে গুহামানবীর কাছে আসে। গুহামানবীর সম্পর্কে এখন পর্যন্ত কাউকে সে বলেনি। এতদিনে গুহামানবীকে সে প্রায় পুরোপুরি সভ্য করে তুলেছে। কথা বলা শিখিয়েছে, হাঁটা শিখিয়েছে, ভদ্রতা শিখিয়েছে, রান্না করা শিখিয়েছে, সাজতে শিখিয়েছে…
গুহামানবীর রোগা-পাতলা শরীরও পুরোপুরি সেরে উঠেছে। তার মধ্যে এখন আর জংলি চেহারার চিহ্ন মাত্র নেই। সে এখন স্বাস্থ্যবতী, লাবণ্যময়ী, অপরূপা এক তরুণী।
গুহামানবীও হাসানের পঙ্গুত্ব দূর করেছে। অনেক বছর আগে গাছ থেকে পড়ে গিয়ে গুহামানবীর পা ভেঙে গিয়েছিল। তখন গুহামানবী ব্যথায়-যন্ত্রণায় নিজেই নিজের পায়ে হাত বোলাতে থাকে। কয়েক দিন হাত বোলানোর পর তার ভাঙা পা নিজ থেকেই ঠিক হয়ে গিয়েছিল। সেই কথা মনে করে সে হাসানের অকেজো পায়েও রোজ-রোজ হাত বুলিয়ে দিতে শুরু করে। গুহামানবীর হাত বুলিয়ে দেয়ায় দেখা যায় সত্যিই হাসানের পায়ের শুকিয়ে যাওয়া পেশিগুলো আবার ধীরে-ধীরে কর্মক্ষম হয়ে উঠছে।
হাসানের পা এখন পুরোপুরি সেরে গেছে। তারপরও হাসান এখনও ক্রাচে ভর দিয়ে হাঁটে, যাতে এখানকার লোকেরা কেউ বুঝতে না পারে তার পা যে ঠিক হয়ে গেছে। তার পা ঠিক হয়ে গেছে জানলে সবার মনে নানান প্রশ্নের জন্ম নেবে। কী দরকার এখানকার লোকদের নানান প্রশ্নের আর কৌতূহলের মুখোমুখি হবার! এমনিতেই তারা আর বেশিদিন এই শহরে নেই। তার বাবার বদলির অর্ডার হয়ে গেছে। কয়েক দিন বাদেই তারা এই শহর ছেড়ে চলে যাবে। সে ভেবে রেখেছে, তার মা-বাবা-বোনকে গুহামানবীর কথা সব জানিয়ে মেয়েটিকেও তাদের সঙ্গে নিয়ে যাবে।
.
হাসানের বাবা-মা-বোন প্রথমে, গুহামানবীর কথা বিশ্বাস করতে চায়নি। যখন হাসান তার সেরে যাওয়া পা দেখাল তখন সবাই সাংঘাতিক অবাক হলো এবং হাসানের কথা বিশ্বাস করল। তাদের মধ্যে সিদ্ধান্ত হয়েছে গভীর রাতের ট্রেন ধরে তারা এই শহর ছেড়ে চলে যাবে। তখন জঙ্গল থেকে গুহামানবীকেও বের করে সঙ্গে নিয়ে যাবে।
.
গভীর রাত। হাসানরা সপরিবারে এই শহর ছেড়ে চলে যাবার জন্য রওনা দিয়েছে। হাসান তার বাবা-মা-বোনকে জঙ্গলের বাইরে দাঁড় ‘করিয়ে রেখে জঙ্গলের ভিতরে ঢুকেছে গুহামানবীকে নিয়ে আসার জন্য।
হাসান গুহামানবীর গুহায় ঢুকে দেখে সে নেই। তার বুকটা ছ্যাৎ করে ওঠে। কোথায় গেল গুহামানবী?! তাকে তো আগেই বলা ছিল, আজ রাতে তাকে তারা সঙ্গে নিয়ে যাবে।
গুহামানবীকে খুঁজতে হাসান গুহা থেকে বেরিয়ে এল। জঙ্গলের মধ্যে কিছুটা দূরে আলো দেখতে পেয়ে সেদিকে এগিয়ে গেল।
আলোর উৎসের কাছাকাছি পৌঁছে হাসান ভীষণ চমকে গেল। আলোটা আসছে জঙ্গলের ভিতরের চাতালের মত খোলা জায়গাটা থেকে। সেখানে মাটি থেকে দশ-বারো হাত উপরে চাকতির মত বিশাল একটা উড়ো যান ভেসে রয়েছে। সেই উড়ো যানটা থেকেই আলো ছড়াচ্ছে।
ভেসে-থাকা উড়ো যানটার ঠিক মাঝ বরাবর কিছুটা লিফটের দরজার মত দেখতে গোল একটা অংশ খোলা অবস্থায়। সেই খোলা অংশটা থেকে স্টিলের একটা সিঁড়ি নীচে মাটি পর্যন্ত এসে পৌঁছেছে। সিঁড়িটা বেয়ে মানুষের মতই দেখতে অদ্ভুত চেহারার কিছু লোক চার হাত-পায়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে ওঠা-নামা করছে।
বিস্ময়ে বিমূঢ় হাসান তাদের মধ্যে গুহামানবীকেও দেখতে পেল। অদ্ভুত চেহারার লোকেরা গুহামানবীকে চারদিক দিয়ে ঘিরে ধরে উড়ো যানের সিঁড়ির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। গুহামানবীর মুখটা অসম্ভব ভারাক্রান্ত। দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে নিতান্ত অনিচ্ছায় তাদের সঙ্গে যাচ্ছে।
হাসান পাগলের মত দৌড়ে গিয়ে তাদের পথ আগলে দাঁড়িয়ে ক্ষিপ্ত গলায় চিৎকার করে বলতে লাগল, ‘ওকে আপনারা কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? আপনারা কারা? আপনারা কোত্থেকে এসেছেন? আপনাদের তো মানুষ বলে মনে হচ্ছে না! ‘
অদ্ভুত চেহারার লোকেরা হাসানকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে, সবাই একদৃষ্টিতে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। হাসান অনুভব করল তার মাথার মধ্যে ভোঁতা এক ধরনের যন্ত্রণা হচ্ছে, সেই সঙ্গে কতগুলো সম্মিলিত কণ্ঠ মাথার মধ্যে কথা বলছে, ‘আমরা ইয়েন। আমরা এসেছি পৃথিবী থেকে অনেক দূরের এনড্রোমিডা গ্যালাক্সির ইয়েন গ্রহ থেকে। আমরা এই মেয়েটাকে ইয়েন গ্রহে নিয়ে যেতে এসেছি।’
হাসান অসহিষ্ণু গলায় বলে উঠল, ‘কেন আপনারা ওকে নিয়ে যাবেন?! এই পৃথিবীর একজন মানবীকে জোর করে আপনাদের গ্রহে নিয়ে যাবেন কোন্ অধিকারে?’
হাসান মাথার মধ্যে আবার সম্মিলিত কণ্ঠ শুনতে পেল, ‘তুমি যাকে মানবী ভাবছ, সে আসলে মানবী নয়। অবশ্য সে আমাদের মত ইয়েনও নয়। সে মানুষ এবং ইয়েনের সংকর। মানুষের চেহারার সাথে আমাদের ইয়েনদের অনেকটাই মিল রয়েছে। কিন্তু অন্য কোনও দিক থেকেই মানুষের সঙ্গে আমাদের মিল নেই। মানুষ খুবই দুর্বল, আমরা অনেক সবল। মানুষের চেয়ে আমাদের বুদ্ধিও অনেক-অনেক গুণ বেশি। আমাদের জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রযুক্তিও অনেক উন্নত। মানুষ তুচ্ছ সব কারণে খুব অল্প বয়সে মারা যায়। আমরা কমপক্ষে চারশো পাঁচশো বছর বেঁচে থাকি। আমাদের মত একই চেহারা হওয়া সত্ত্বেও মানুষেরা কেন আমাদের চেয়ে এত পিছিয়ে, এই নিয়ে গবেষণায় আগ্রহী হয়ে উঠি আমরা। গবেষণার জন্য পৃথিবী থেকে আমরা মানুষের লাশ চুরি করা শুরু করি। গবেষণায় দেখি, ডিএনএ-র সামান্য একটু রদবদল হলেই মানুষেরা আমাদের মত বুদ্ধিমান, বলবান আর দীর্ঘজীবী হয়ে উঠবে। এ অবস্থায় রাস্তার একটা পাগলির লাশ চুরি করে নিয়ে দেখতে পাই পাগলিটা তখনও মারা যায়নি। কোমায় রয়েছে। আমরা পাগলিটাকে সুস্থ করে তুলি। পাগলির জরায়ুর ডিম্বাণুতে আমাদের শুক্রাণু স্থাপন করি। গবেষণা সফল হয়। পাগলি গর্ভধারণ করে। পাগলিকে ফেরত দিয়ে যাই। ধারণা করি পাগলির গর্ভের ওই সন্তানের মাধ্যমেই পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে উন্নত ডিএনএ-র মানব সম্প্রদায়। কিন্তু পাগলিকে পৃথিবীর মানুষেরা ঠাঁই দেয় না। মৃত মানুষ জীবিত হয়ে ফিরে আসায় ডাইনি-প্রেতাত্মা ভেবে সবাই মিলে তাকে তাড়িয়ে দেয়। পাগলি আশ্রয় নেয় কবরস্থানের এই জঙ্গলে। এখানেই সে উন্নত ডিএনএ-র এক শিশুকে জন্ম দিয়ে মারা যায়। শিশুটা একা-একাই বড় হয়ে ওঠে সাধারণ মানবশিশু খুবই অসহায় থাকে, অন্যের সাহায্য ছাড়া কিছুই করতে পারে না। কিন্তু এই সংকর শিশুটি ততটা অসহায় ছিল না। জন্মের পর থেকেই সে নিজের খাবার জোটানো, নিজের বেঁচে থাকার প্রয়োজন নিজেই মেটাতে পারে। সেই সংকর শিশুটিই হচ্ছে গুহামানবী…’
ইয়েনদের বাধা দিয়ে হাসান বলে উঠল, ‘পৃথিবীতে উন্নত ডিএনএ-র মানব সম্প্রদায় ছড়িয়ে দেবার জন্য সংকর শিশুটিকে জন্ম দিয়েছিলেন, সেই শিশুটি প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে উন্নত ডিএনএ-র মানব জন্ম দেবার পর্যায়ে আসার পর এখন কেন তাকে নিয়ে যাচ্ছেন?’
ইয়েনদের সম্মিলিত গলা শোনা গেল, ‘ভেবে দেখলাম, পৃথিবীতে উন্নত ডিএনএ-র মানব সম্প্রদায় সৃষ্টি হওয়াটা ঠিক হবে না। তাতে পৃথিবীর এত দিনের সব নিয়ম-কানুন বদলে যাবে। পৃথিবীতে আরও হিংসা, বিদ্বেষ, মারামারি, হানাহানি, যুদ্ধ-বিগ্রহ, বিশৃঙ্খলা বাড়বে। কারণ উন্নত ডিএনএ-র মানব সম্প্রদায়ের শক্তি, ক্ষমতা, জ্ঞান সবই বাড়বে, অথচ তাদের মধ্যে বর্তমান মানুষের আবেগ-অনুভূতি, প্রেম-ভালবাসা, লোভ-হিংসা, দেমাক অহংকার এসবই থেকে যাবে। যেমন এই গুহামানবীর মধ্যেও তা রয়েছে। তুমি হয়তো এখনও বুঝতে পারনি, উন্নত ডিএনএ-র এই গুহামানবী এ ক’দিনে তোমার প্রেমে পড়ে গেছে। সে এখন তোমাকে পাগলের মত ভালবাসে।’
গুহামানবী হাসানকে ভালবাসে, এ কথাটা শুনে হাসানের চোখ দুটো ভিজে উঠল। পঙ্গুত্বের কারণে সে তার আটাশ বছরের জীবনে এর আগে আর কোনও তরুণীর মন জয় করতে পারেনি। গুহামানবীই তার জীবনের প্রথম তরুণী, যে তাকে ভালবেসেছে! আজ তাকেও সে হারাতে যাচ্ছে!
হাসান ধরা গলায় বলে উঠল, ‘আমিও গুহামানবীকে খুব ভালবাসি! নিজের থেকেও বেশি! তাকে ছাড়া এখন আর আমি নিজেকে ভাবতেও পারি না! প্লিজ! আপনারা তাকে নিয়ে যাবেন না। প্লিজ! আমার প্রেয়সীকে আমার কাছে থাকতে দিন।
ইয়েনরা বলল, ‘ভালবাসা একটি মিথ্যে মোহ ছাড়া আর কিছুই নয়। মানবদের মত আমাদের মধ্যে আবেগ-অনুভূতি, প্রেম- ভালবাসা, লোভ-হিংসা এসব কিছুই নেই। তাই তো আমরা মানবদের চেয়ে অনেক উন্নত প্রজাতি। আমরা গুহামানবীকে একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য নিয়ে যাচ্ছি। আমাদের বুদ্ধি, জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রযুক্তি সবই মানুষের চেয়ে উন্নত। কিন্তু এখনও আমরা মানুষের মত দু’পায়ে দাঁড়িয়ে হাঁটতে শিখিনি আর মুখে শব্দ উচ্চারণ করে ভাব আদান-প্রদান করতে শিখিনি। তাই এই গুহামানবীর কাছ থেকে আমরা এই দুটো রপ্ত করতে চাই।’
হাসান হাত জোড় করে মিনতি করল, ‘দয়া করে আপনারা আমার প্রেয়সীকে না নিয়ে পৃথিবীর অন্য কাউকে নিয়ে যান, কথা বলা এবং হাঁটা শেখার জন্য। না হয় আমার প্রেয়সীর সঙ্গে আমাকেও নিয়ে যান।’
ইয়েনরা বলল, ‘সেটা সম্ভব নয়। আমাদের গ্রহের বায়ুমণ্ডলে সাধারণ কোনও মানুষ টিকবে না। যেহেতু গুহামানবীর মধ্যে আমাদের ইয়েনদের ডিএনএ-ও রয়েছে, তাই তার জন্যে কোনও সমস্যা হবে না। আমরা অনেক সময় জীবিত মানুষও নিয়েছিলাম পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য। তাদেরকে পৃথিবীর আবহাওয়ার মত বন্ধ গবেষণাগারের ‘বাইরে বের করা যায়নি। অবশ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষেই আবার তাদের ফিরিয়ে দিয়ে গেছি পৃথিবীতে। যানবাহন থেকে মাঝে-মাঝে লোকজন উধাও হওয়ার এটাই কারণ।’
হাসান বুঝতে পারল কোনওভাবেই ইয়েনরা গুহামানবীকে রেখে যাবে না। তারা তাকে সঙ্গে নিয়েই যাবে। হাসান চোখের পানি মুছতে-মুছতে গুহামানবীর কাছে এগিয়ে গেল। গুহামানবীর চোখ বেয়েও অঝোর ধারায় লোনা জল ঝরছে। হাসান হাত বাড়িয়ে আলতো করে গুহামানবীর চোখ মুছে দিতে চাইল। অমনি গুহামানবী হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। কাঁদতে-কাঁদতে বলল, ‘তুমি কেন আমাকে হাঁটা শেখালে, কথা বলা শেখালে—আজ সে কারণেই আমাকে ওরা নিয়ে যাচ্ছে।’
গুহামানবীকে জড়িয়ে ধরে হাসানও কেঁদে ফেলল।
দু’জন দু’জনকে ধরে বেশ কিছুক্ষণ কাঁদার পর গুহামানবী বুজে-আসা গলায় বলল, ‘আমার গুহার মধ্যে নানান রঙের যে পাথরগুলো রয়েছে, তুমি বলেছ সেগুলোর নাকি অনেক দাম-তুমি সেগুলো তোমার সঙ্গে নিয়ে যেয়ো। সেগুলো আমার তরফ থেকে তোমার উপহার। ওগুলো বিক্রি করে তোমাদের সংসারের সব অভাব-অনটন দূর করবে।’
হাসান ভাঙা গলায় বলল, ‘হ্যাঁ, আমি সেই পাথরগুলো নিয়ে যাব। তবে তা বিক্রি করার জন্য নয়। ওগুলো তোমার স্মৃতি হিসেবে সারা জীবন রেখে দেব।’
ইয়েনরা গুহামানবীকে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উড়ো যানে উঠে গেল। সিড়িটা ধীরে-ধীরে উড়ো যানের ভিতরে ঢুকে গেল। লিফটের দরজার মত দেখতে দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল। পরক্ষণেই চাকতির মত দেখতে উড়ো যানটা দ্রুতগতিতে আকাশের দিকে উঠতে শুরু করল। উপরে উঠতে-উঠতে উড়ো যানটা একসময় তারার মত বিন্দুতে পরিণত হয়ে আকাশে মিলিয়ে গেল। হাসান হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে সমস্ত জঙ্গল কাঁপিয়ে চিৎকার করে কাঁদতে লাগল।
***