পুনর্জন্ম
ঘুটঘুটে অন্ধকার রাত। পৌনে বারোটার মত বাজে। সমস্ত গ্রাম ঘুমিয়ে পড়েছে। চারদিক একেবারে সুনসান। শুধু মাঝে-মাঝে নিশাচর পাখির ভীতিকর গা ছমছমে ডাক আর থেমে-থেমে বেওয়ারিশ কুকুরের আর্তনাদের শব্দ শোনা যাচ্ছে।
মর্জিনা দু’পাশে জঙ্গলে ছাওয়া কাদা ভরা গ্রাম্য রাস্তা ধরে খালি পায়ে পা টিপে-টিপে এগিয়ে যাচ্ছে। বার-বার ভীত চোখে পিছন ফিরে তাকাচ্ছে। মনে শঙ্কা জাগছে কেউ বুঝি দেখে ফেলছে! অবশ্য এত রাতে গ্রামের কারোরই জেগে থাকার কথা নয়। মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। এমন বৃষ্টির রাতে কেউ জেগে থাকলেও বাইরে বেরোবার কথা নয়।
মর্জিনার গন্তব্য গ্রামের পুরানো কবরস্থান। বিশাল জায়গা নিয়ে কবরস্থানটা। শত-শত কবর রয়েছে সেখানে। সেই শত কবরের মাঝে মর্জিনার স্বামীর কবরও রয়েছে।
মর্জিনার স্বামী মারা গেছে আজ থেকে বারো বছর আগে। বারো বছর ধরে মর্জিনা প্রতি ভাদ্র মাসের অমাবস্যার রাতে স্বামীর কবরের কাছে আসে, বিশেষ একটা উদ্দেশ্য নিয়ে। আজ রাতেই সেই এক যুগের সাধনা সফল হবার কথা।
মর্জিনা তার স্বামীকে খুব ভালবাসত। খুউব! নিজের জীবনের চেয়েও বেশি!
স্বামীর মৃত্যু সে কোনও মতেই মেনে নিতে পারেনি। পাগলের মত আচরণ করতে শুরু করে। বলা যায়, পাগলই হয়ে যায়।
স্বামীর লাশ সে কবর দেবার জন্য নিয়ে যেতে দিতে চায় না। লাশ আঁকড়ে ধরে বসে থাকে। সবাইকে অনুরোধ করে লাশটা কবর না দেবার জন্য। লাশটা সে ঘরেই রেখে দিতে চায়। লাশের সঙ্গেই ঘর-সংসার করবে সে। বাকি জীবন লাশের সঙ্গেই কাটিয়ে দেবে।
পাগলামীকে পাত্তা না দিয়ে গ্রামবাসীরা যখন লাশ দাফন- কাফনের জন্য ঘর থেকে নামাতে চায়, তখন মর্জিনা ভয়ঙ্কর রকমের খেপে ওঠে। হিংস্র পশুর মত হামলে পড়ে। আঁচড়, খামচি, কামড় বসিয়ে দেয় যাকে সামনে পায় তাকেই। চার- পাঁচজনে মিলেও মর্জিনাকে আটকে রাখতে পারে না। যেন মর্জিনার গায়ে অসুরের শক্তি ভর করেছে।
শেষ পর্যন্ত মর্জিনাকে বেঁধে রেখে লাশ ঘর থেকে নামানো হয়। বাঁধা অবস্থায় মর্জিনা আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে আহত পশুর মত চিৎকার করতে থাকে। চিৎকার করতে-করতে একসময় অজ্ঞান হয়ে পড়ে। জ্ঞান ফিরে পাবার পর আবার চিৎকার শুরু করে।
লাশ দাফন-কাফনের কাজ শেষ হবার পর মর্জিনাকে বাঁধনমুক্ত করা হয়। তখনও মর্জিনা সুস্থির হয় না। মুক্ত হতেই ছুটে যায় কবরস্থানের দিকে। স্বামীর কবরের উপর গিয়ে আছড়ে পড়ে। ভেউ-ভেউ করে কাঁদতে-কাঁদতে দু’হাতে আঁচড়ে কবরের মাটি সরাতে চায়। লোকজন এসে ধরে নিয়ে গিয়ে আবার বেঁধে রাখে।
স্বামীর মৃত্যুর পর মাস খানিকের মত মর্জিনাকে বেঁধেই রাখতে হয়। কারণ, ছাড়া পেলেই সে কবরস্থানে ছুটে গিয়ে কবরের মাটি সরাতে শুরু করে। তার উদ্দেশ্য বোঝা যায়। কবর থেকে লাশ উঠিয়ে আনতে চায়।
মাস খানিক পর মুক্তি পেয়েও মর্জিনা ঠিকই এক গভীর রাতে সবার অজান্তে কবরস্থানে গিয়ে তার স্বামীর কবর খুঁড়ে ফেলে। কিন্তু কবরের বাঁশগুলো সরিয়ে দম বন্ধ হওয়া বিকট দুর্গন্ধ আর গলিত কালো থিকথিকে আঠাল তরলের মাঝে কঙ্কাল দেখে সে যেন পুরোপুরি উন্মাদ হয়ে যায়’। তার চিৎকার করে কান্না আর বিলাপের শব্দে সেরাতে সমস্ত গ্রাম জেগে ওঠে।
সেই থেকে মর্জিনা আর কোনও পাগলামী করে না। কেমন চুপচাপ হয়ে যায়।
অল্প বয়সে বিধবা হওয়া মর্জিনা আর বিয়ে-থা-ও করে না। স্বামীর ভিটেতেই একা-একা বাস করে। জীবিকা নির্বাহের জন্য একটা ম্যাটারনিটি ক্লিনিকে নার্সের চাকরি নেয়।
.
মর্জিনা কবরস্থানে পৌঁছে গেছে। চারপাশটা গাঢ় অন্ধকার একেবারে গিলে নিয়েছে। তাতে মর্জিনার তেমন একটা অসুবিধা হচ্ছে না। একটু গা ছমছমও করছে না।
সঙ্গে থাকা ছোট টর্চের আলো ফেলে খুঁজে-খুঁজে স্বামীর কবরের পাশে গিয়ে দাঁড়াল সে। বাম হাতে করে বয়ে আনা শাবলটা কবরের উপরে রাখল। এবার ডান কাঁখে আঁচলের নীচে ঢেকে রাখা ছোট্ট পোঁটলাটা অতি সাবধানে বের করে সযত্নে একটা ঝোপের তলায় গুঁজে রাখল। যেন ওটা বৃষ্টি থেকে রক্ষা পায়। এই পোঁটলার মধ্যে যা আছে সেটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। পোঁটলার মধ্যে থাকা ওই জিনিসটাই তার উদ্দেশ্য সফল করবে।
মর্জিনা শাবল দিয়ে কবরের মাটি খুঁড়তে লেগে পড়ল। সমস্ত কবরটা খুঁড়বে না। শুধু কবরের মাথার দিকটায় একটা গর্তের মত করে খুঁড়ে যাবে, যতক্ষণ না তার স্বামীর কঙ্কালের খুলিটার দেখা মেলে।
খুঁড়তে-খুঁড়তে শেষ পর্যন্ত মর্জিনা খুলির দেখা পেল। তবে
খুলিটা কবরের ভিতর থেকে উঠাল না। কবরের ভিতরেই রইল। একেবারে হাঁপিয়ে উঠেছে সে। একটু জিরিয়ে নেয়া উচিত। কিন্তু জিরানোর সময় নেই। ওদিকে ঝোপের আড়ালে রাখা পোঁটলার ভিতরের জিনিসটা ওঁয়া-ওঁয়া করে কেঁদেই যাচ্ছে। অবশ্য কান্নার আওয়াজ খুবই মৃদু। বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়ে সে আওয়াজ কারও কানে যাওয়ার কথা নয়।
ঝোপের আড়াল থেকে পোঁটলাটা নিয়ে এল মর্জিনা। কবরের মাথার দিকে খোঁড়া গর্তের পাশে রাখল ওটা। তার কোমরে ছোট্ট একটা স্টীলের চাকু গোঁজা রয়েছে। ওটা বের করল। চাকুটায় ব্লেডের মত ধার। অন্ধকারেও ঝিকিয়ে উঠছে।
মর্জিনা এক-এক করে গায়ের সমস্ত পোশাক খুলে উলঙ্গ হয়ে গেল। এবার হাঁটু ভেঙে বসল। চাকুটা দু’হাতে চেপে ধরে, কপালে ঠেকিয়ে চোখ বুজে তার প্রভুর নাম স্মরণ করল। এরপর চোখ খুলে পোঁটলার ভিতরের জিনিসটাকে বের করল। জিনিসটার মুখ দেখা যাচ্ছে। কী ফুটফুটে চেহারা! ফুটফুটে চেহারার জিনিসটাকে কবরের গর্তের মুখে শুইয়ে দিল। ভেজা মাটির স্পর্শে ওটার কান্না আরও বেড়ে গেছে। ছোট-ছোট হাত- পা ছুঁড়ছে আর কাঁদছে। কান্নার দমকে যেন দম বন্ধ হয়ে আসছে।
মর্জিনা বিড়বিড় করে তার প্রভুর নাম জপতে-জপতে ক্ষিপ্র ভঙ্গিতে ফুটফুটে ছোট্ট জিনিসটার গলায় চাকুটা বসিয়ে দিল। থেমে গেল কান্নার আওয়াজ। নেমে এল নিস্তব্ধতা। ফিনকি দিয়ে গরম রক্ত বেরোতে লাগল। রক্তের ধারা ঝরে পড়ছে গর্তের নীচে থাকা খুলিটার উপর।
মর্জিনার চেহারায় আত্মতৃপ্তির ছাপ দেখা গেল। বারো বছর ধরে সে সাধনা করে আসছে। আর মাত্র কিছুক্ষণের অপেক্ষা!
স্বামীর মৃত্যুর এক মাস পর কবর খুলে স্বামীর পচা-গলা লাশ দেখে মর্জিনা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল আত্মহত্যা করবে। ঘরের আড়ার সঙ্গে দড়ি বেঁধে গলায় ফাঁস নিতেও গিয়েছিল। শেষ মুহূর্তে তার দাদীর বলা কিছু কথা মনে পড়ায় আর আত্মহত্যা করেনি। সিদ্ধান্ত পাল্টে ফেলে।
মর্জিনার দাদী ওঝাগিরি করতেন। অনেক নাম-ডাক ছিল তাঁর। দূর-দূরান্ত থেকে বিভিন্ন রোগী আসত তাঁর কাছে। ভূতে পাওয়া, জিনে পাওয়া রোগীদের আছরমুক্ত করতে তাঁর জুড়ি ছিল না।
মাঝে-মাঝে দাদী বলতেন, ‘যারা আত্মহত্যা করে, তারা শয়তান হয়ে যায়। কোনও দিনও তাদের আত্মার মুক্তি মেলে না। শয়তান আত্মা হয়ে পৃথিবীতেই রয়ে যায়। আর সব শয়তানের প্রভু হচ্ছে ইবলিস। ইবলিস শয়তান। অবশ্য জীবিতরাও ইবলিসকে প্রভু হিসেবে গ্রহণ করতে পারে। তাতে তাদের সৃষ্টিকর্তার আনুগত্য অস্বীকার করে ইবলিসের বশ্যতা স্বীকার করে নিতে হয়। কালো জাদু যারা করে তারা তো এই ইবলিসকেই প্রভু হিসেবে গ্রহণ করে, ইবলিসের সাহায্যে অসম্ভবকে সম্ভব করে। ইবলিসের অনেক ক্ষমতা। এমনকী মৃতকেও জীবিত করতে পারে।
মর্জিনা দাদীর কাছ থেকে এটাও জেনেছিল, কীভাবে ইবলিসকে ডেকে আনতে হয়। অনেকগুলো নিয়ম আছে, এর মধ্যে সবচেয়ে সহজ নিয়ম হচ্ছে: ভাদ্র মাসের অমাবস্যার মাঝরাতে উলঙ্গ অবস্থায় তিন রাস্তার মুখে বসে ছয় ধরনের প্রাণী বলি দিয়ে, সেই বলির রক্ত সারা গায়ে মেখে, ছয় ধরনের জলাশয়ের পানি দিয়ে গোসল করে, ছয় ধরনের সুগন্ধি গায়ে লাগিয়ে ওই স্থান থেকে উলঙ্গ অবস্থায়ই বাড়ি ফিরে আসতে হয়। ফেরার পথে একবারও পিছনে ঘুরে তাকানো যাবে না। সব কিছু ঠিকঠাকভাবে পালন করতে পারলে ওই রাতেই ইবলিসের দেখা পাওয়া যায়।
ইবলিস ছয় সংখ্যাকে খুব পছন্দ করে। যখন তিনটা ছয় একত্রিত হয় তখন ইবলিস সেখানে চলে আসে। এজন্যেই ছয় ধরনের প্রাণীর রক্ত, ছয় ধরনের জলাশয়ের পানি আর ছয় ধরনের সুগন্ধি ব্যবহার করতে হয়।
মর্জিনা দাদীর বলা এসব কথা মনে করে ভাবে, আত্মহত্যা করে শয়তান হয়ে যাবার চেয়ে জীবিত থেকে ইবলিসকে ডেকে এনে স্বামীকে ফেরত চাইলে কেমন হয়। ইবলিসের অনেক ক্ষমতা, নিশ্চয়ই ইবলিস তার স্বামীকে জীবিত করে দিতে পারবে।
কিছু দিন পরেই আসে ভাদ্র মাসের অমাবস্যার রাত। মর্জিনা পূর্বপ্রস্তুতি মত মাঝরাতে তিন রাস্তার মুখে গিয়ে সমস্ত নিয়ম- কানুন পালন করে বাড়ি ফিরে আসে। ফেরার পথে একবারও পিছনে ঘুরে তাকায় না। তবে সে বুঝতে পারে কিছু একটা তার পিছু-পিছু অনুসরণ করছে। ভয়ঙ্কর কিছু একটা
মর্জিনা বাড়ি ফিরেই কেমন ঘোরাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। উলঙ্গ অবস্থায়ই বিছানায় শুয়ে পড়ে। কেমন স্বপ্ন আর জাগরণের মাঝামাঝি চলে যায়। শুনতে পায় ঝড়ের শব্দ। যেন শোঁ-শোঁ করে ভয়ানক ঝড় হচ্ছে। বিদঘুটে একটা গন্ধ নাকে লাগে। চোখের সামনে ভেসে ওঠে আবছা মত ভয়ঙ্কর কুৎসিত একটা মুখাবয়ব।
মুখাবয়বটা তার দিকে ঝুঁকে এসে ফ্যাসফেঁসে চাপা গলায় জিজ্ঞেস করে, ‘আমাকে ডেকে এনেছিস কেন? কী চাস আমার কাছে?’
মর্জিনা বুজে আসা কাঁপা-কাঁপা গলায় কোনওক্রমে বলে, ‘আমার স্বামীকে ফেরত চাই। তাকে আবার জীবিত করতে চাই।’
মুখাবয়বটা খ্যাক-খ্যাক করে চাপা গলায় হেসে উঠে বলে, ‘তা হলে আগে আমাকে প্রভু হিসেবে স্বীকার করে নে।’
মর্জিনা বলে, ‘হ্যাঁ, এখন থেকে আপনিই তো আমার প্রভু। প্রভু, আপনার সাহায্য নেবার জন্যেই আপনাকে ডেকে এনেছি। দয়া করুন, প্রভু!
ইবলিস আত্মতৃপ্তির হাসি হেসে বলে, ‘তোর স্বামীকে আবার জীবিত করতে হলে কী করতে হবে, শোন। আজকের এই অমাবস্যার রাত থেকে প্রতি ভাদ্র মাসের অমাবস্যার রাতে আমার নামে বলি দেয়া সদ্য জন্মানো শিশুর রক্ত দিতে হবে তোর স্বামীর কঙ্কালের খুলিতে। এভাবে যেদিন বারো বছর পূর্ণ হবে সেদিন তোর স্বামী পুনর্জন্ম লাভ করবে। তবে আজ এই প্রথম রাতে তার নিজের রক্তই তাকে দিতে হবে।’
মর্জিনা বলে উঠল, ‘তার নিজের রক্তই তাকে দিতে হবে, মানে?!’
‘মানে হচ্ছে, তুই এখনও বুঝতে পারিসনি তুই যে দুই মাসের গর্ভবতী। তোর স্বামী মৃত্যুর আগে তোর গর্ভে তার সন্তান রেখে গেছে। তার সন্তান মানে তার রক্ত। সেই রক্তই আজ তোকে দিতে হবে।
মর্জিনা অবাক হওয়া গলায় বলে, ‘যে সন্তানের জন্ম হয়নি তার রক্ত দেব কীভাবে?!’
ইবলিস খ্যাক-খ্যাক করে হাসতে-হাসতে বলে, ‘আমি এখন তোর সঙ্গে সহবাস করব। এই সহবাসের কিছুক্ষণের মধ্যেই তোর গর্ভপাত হবে। সহবাসের পরপরই তুই গিয়ে তোর স্বামীর কবরের মাটি খুঁড়ে, খুলিটা বের করে খুলির উপর গর্ভপাত করবি। তা হলেই হবে।’
সেই থেকে মর্জিনা গ্রামের সবার অজান্তে প্রতি ভাদ্র মাসের অমাবস্যার রাতে একটা সদ্য জন্মানো শিশুকে বলি দিয়ে রক্ত দেয় তার স্বামীর খুলিতে। বলির জন্য সদ্য জন্মানো শিশু যাতে সহজে জোগাড় করতে পারে সেজন্যই সে ম্যাটারনিটি ক্লিনিকে নার্সের চাকরি নেয়। তবে প্রতিবারই বাচ্চা চুরি করে আনতে বিরাট ঝুঁকি নিতে হয়েছে তাকে। আজ বারো বছর পূর্ণ হলো। অত্যন্ত প্রশান্তি অনুভব করছে সে। ইবলিসের কথা মত আর কিছুক্ষণের মধ্যেই তার স্বামী জীবিত হয়ে কবর ফুঁড়ে উঠে আসবে। এর চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে! ভালবাসার মানুষটাকে আবার সে কাছে পাবে!
.
মর্জিনা তার স্বামীর কবর থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। এখনও উলঙ্গ অবস্থায়। গভীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে কখন কবর ফুঁড়ে উঠে আসবে তার প্রাণপ্রিয় মানুষটা। তার মনের ভিতর উত্তেজনার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। তর সইছে না আর!
হঠাৎ ভীষণ ঝড় শুরু হয়ে গেল। সে সঙ্গে ভয়ানক বজ্রপাত। আগে থেকেই বৃষ্টি হচ্ছিল, সেই বৃষ্টি আরও প্রচণ্ড রূপ নিয়েছে।
মর্জিনা তুমুল ঝড়-বৃষ্টির মাঝেও স্বামীর কবর থেকে একটু দূরে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। তার মন বলছে এখনই তার স্বামী জেগে উঠবে।
আচমকা মর্জিনা বিজলির নীল আলোতে দেখতে পেল সত্যিই কবরের খোঁড়া গর্তটার ভিতর থেকে কিছু একটা মাথা তুলে উঠে আসছে। তার বুক ঢিপঢিপ করে উঠল। মনের ভিতর একই সঙ্গে ভয় ও আনন্দ-দুটোই কাজ করছে। সত্যি-সত্যিই কি সে তার স্বামীকে ফেরত পাচ্ছে?! নাকি ওটা অন্য কিছু?
দেখে তো মানুষের শারীরিক অবয়ব বলেই মনে হচ্ছে। সারা গায়ে আঠাল কাদা মাখা, তাই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না।
বিচিত্র অবয়বটা এক পর্যায়ে হামাগুড়ি দিয়ে কবরের গর্তের ভিতর থেকে বাইরে বেরিয়ে এল। ধীরে-ধীরে উঠে দাঁড়াল। ভারী বৃষ্টিতে ধুয়ে যেতে লাগল গায়ের আঠাল কাদা। সেই সঙ্গে মর্জিনার মনের আকাশও খুশিতে ভরে যেতে লাগল। সেই মুখ! সেই লম্বা গলা! সেই চওড়া কাঁধ! সেই পেশিবহুল শরীর!
মর্জিনা আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরল পুনর্জন্ম লাভ করা স্বামীকে। চুমু খেল কপালে, দু’গালে, থুতনিতে। স্বামীর দিক থেকে কোনও সাড়া মিলল না। সে এখনও তার চোখই মেলেনি। মূর্তির মত শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
মর্জিনা চুমুর পর চুমু খেয়েই যাচ্ছে। একসময় স্বামীর একটা হাত তাকে আগলে ধরল। ধীরে-ধীরে তার চোখ দুটোও মেলল।
মর্জিনা চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে ভীষণ চমকে উঠল। ভয়ে কেঁপে উঠল তার অন্তরাত্মা। এ কোনও মানুষের চোখ হতে পারে না! ভয়ঙ্কর কোনও দানবের চোখ যেন।
মর্জিনা বন্ধনমুক্ত হতে চাইল। কিন্তু স্বামীর আগলে থাকা হাতটার কারণে পারল না। হাতখানা যেন ইস্পাতের তৈরি।
মর্জিনা বন্ধনমুক্ত হবার জন্য জোরাজুরি শুরু করল। আর তখনই তার বুকের বাম পাশে একটা তীব্র খোঁচা অনুভব করল। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠল। বিস্মিত চোখে দেখতে পেল স্বামীর অন্য হাতটা তার বুকের ভিতর ঢুকে গেছে। হাতটা মট-মট করে পাঁজর ভেঙে হৃৎপিণ্ডটা টেনে ছিঁড়ে বের করে আনছে।
চোখে অন্ধকার নেমে আসছে, এসময় মর্জিনা বুঝতে পারল, বারো বছর ধরে সাধনা করে সে তার স্বামীকে পুনর্জন্ম দেয়নি—জন্ম দিয়েছে একটা পিশাচের।