1 of 2

সাত ঋতুর জীবন

সাত ঋতুর জীব

০১. এসো, জলধারা এসো

আজ সকাল থেকেই দিনটা শ্রাবণে শ্রাবণ।

তাই যতই সময় গড়াতে লাগল আদিত্যর মন খারাপ ততই বাড়তে লাগল। অথচ মন খারাপ হওয়ার তেমন কোনও কারণ নেই। গতকাল রাতে ওর বেশ ভালোই ঘুম হয়েছে। অনেকক্ষণ ধরে অনুরাধাকে স্বপ্ন দেখেছে। অবশ্য স্বপ্নের অনেকক্ষণ বাস্তবের নাকি কয়েকটা মুহূর্তমাত্র। কিন্তু যা-ই হোক, ওকে স্বপ্নে দেখতে আদিত্যর ভালোই লাগছিল। অনুরাধার কথা ভাবলেই ওর মন ভালো হয়ে যায়। আদিত্য ওকে বলে মন-ভালোকরা মেয়ে।

তারপর ঘুম ভাঙতেই মায়ের আদেশে ছাতা মাথায় দিয়ে বাজারে দৌড়োনো।

বাজার করার ব্যাপারটা সাংঘাতিক বিরক্তিকর। অনুরাধাকে ও এ-কথা বহুবার বলেছে। অনুরাধা অবাক হয়ে বলেছে, সে আবার কী! বাজার না করলে আমরা খাব কী!

তুমি কাছে থাকলে আমার খাওয়ার কোনও প্রবলেম হবে না। আদিত্য হেসে বলেছে, তুমি তোমার ব্যাপারটা ভাবো।

অনুরাধা মুখ গম্ভীর করে বলেছে, হুম্। বিয়ের পর আমাদের দেখছি অনেক ঝামেলা হবে। দু-চার বছর পর সেপারেশান না হয়ে যায়!

সে সেপারেশান হয় তোক গে। শুধু বাজার করতে পারব না, আর তোমাকে ছাড়তে পারব না।

অনুরাধা চোখ কপালে তুলে বলেছে, তার মানে!

এসব কথা ভাবতে-ভাবতে আপনমনেই হেসে ফেলল আদিত্য। বৃষ্টির তেজ বাড়ছিল, কিন্তু ওর মনটা ধীরে-ধীরে ভালো হতে শুরু করল।

ঠিক দশটার স্নান করতে ঢুকল আদিত্য। এগারোটার মধ্যে সায়েন্স কলেজে পৌঁছোতে হবে। রিসার্চের কাজে ঢিলে দিলে চলবে না। পি-এইচ. ডি.-টা তাড়াতাড়ি দরকার। তার ওপর ওর গাইড বড় খিটখিটে লোক। লেখাপড়া ছাড়া আর কিছু জানে না মানুষটা।

বাথরুমে ঢুকে শাওয়ারের কল শেষ প্যাঁচ পর্যন্ত খুলে দিয়ে আদিত্য স্বপ্ন দেখতে শুরু করল। ও আর অনুরাধা সিনেমা দেখে ফেরার পথে বৃষ্টিতে ভিজছে।

বাইরে মেঘ ডাকছিল। ফলে শাওয়ারের নীচে চোখ বুজে দাঁড়িয়ে স্বপ্নটাকে বাস্তবের অনেক কাছাকাছি মনে হচ্ছিল।

ঠিক তখনই একটা চাপা কান্নার শব্দ শুনতে পেলে ও। কে যেন ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদছে।

 চমকে উঠে চোখ খুলল আদিত্য।

অবাক হয়ে দেখল, বাথরুমের এককোণে হাঁটু মুড়ে উবু হয়ে বসে একজন বৃদ্ধ কাঁদছে। তার ফরসা পিঠ স্থির কম্পাঙ্কে ফুলে-ফুলে উঠছে। চামড়ার ভাঁজগুলো কখনও আবছা হচ্ছে, কখনও গম্ভীর হচ্ছে।

শাওয়ারের জলধারা আদিত্যর ওপরে অঝোরে ঝরে পড়ছিল। সে কথা ভুলে গিয়ে আদিত্য শীর্ণ ফরসা বৃদ্ধকে দেখতে লাগল। শাওয়ারের জলের ফোঁটা ছিটকে পড়ছে তার মাথায়, পিঠে। অথচ সেদিকে তার কোনও খেয়ালই নেই।

কে আপনি? এখানে বসে এভাবে কাঁদছেন কেন?

আদিত্যর প্রশ্নে চোখ তুলে তাকাল বৃদ্ধ। প্রশান্ত গভীর চোখ। চোখের কোণে জল চিকচিক করছে।

বৃদ্ধ বাথরুমের দেওয়াল ধরে উঠে দাঁড়াল। পরনে শুধু একটা ধুতি–তার বেশ খানিকটা ভিজে গেছে। বাথরুমের আয়নায় বৃদ্ধের মুখের পাশটা দেখতে পাচ্ছিল আদিত্য। তার ডান কানের নীচে একটা লালচে তিল।

এভাবে কাঁদছেন কেন আপনি? আদিত্য আবার জিগ্যেস করল।

এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল বৃদ্ধের ঠোঁটে। তাতে কান্নাটা আরও ব্যথাতুর হয়ে উঠল। ছোট্ট করে কেশে বৃদ্ধ বলল খসখসে গলায়, কাঁদছি তোমার কথা ভেবে।

আদিত্য কিছুক্ষণ কোনও কথা খুঁজে পেল না।

 আমার কথা ভেবে!

হ্যাঁ, কী কষ্টের তোমার জীবন।

কোথায় কষ্ট! কীসের কষ্ট? অনুরাধার কথা ভাবল আদিত্য। ওর মন ভালো হয়ে গেল নতুন করে।

বৃদ্ধ কাপড়ের খুঁট দিয়ে চোখের জল মুছে নিল। তারপর বলল, এখন তো কষ্ট টের পাওয়ার বয়েস নয়, বাবু। টের পাবে আমার বয়েসে পৌঁছেলে।

আদিত্য বৃদ্ধের কথার মাথামুন্ডু কিছুই বুঝে উঠতে পারছিল না। কে এই লোকটা? কোথা থেকেই বা ঢুকে পড়ল এই কলঘরে!

আমার জীবন নিয়ে আপনি মাথা ঘামাচ্ছেন কেন? আদিত্যর গলা একটু রুক্ষই শোনাল নিজের কানে।

হাসল বৃদ্ধ। দড়ির মতো শিরা বের করা হাত নেড়ে বলল, তোমার জীবন আর আমার জীবনে কোনও তফাত নেই গো–শুধু সময়ের তফাত। তুমি বর্তমান–আর আমি ভবিষ্যৎ। তোমার জীবনের কষ্ট আমি আর সইতে পারছি না। নাকি আমার জীবনের কষ্ট আমি আর সইতে পারছি না?

আমি নির্ঘাত স্বপ্ন দেখছি, ভাবল আদিত্য। সন্ধেবেলা যদি ও অনুরাধাকে এই ব্যাপারটা বলে তা হলে আর দেখতে হচ্ছে না। লেগ পুল করে করে ওকে একেবারে শেষ করে দেবে।

আপনাকে, আমি আগে কখনও দেখেনি– আদিত্য যেন আপনমনেই মন্তব্য করল।

দ্যাখোনি কারণ আমি দেখা দিইনি।

 আজ তা হলে হঠাৎ এলেন কেন?

তোমাকে সাবধান করতে। তোমার জীবনে অনেক কষ্ট আছে। অথচ তুমি কিছুদিন ধরেই দারুণ সুখী জীবনের স্বপ্ন দেখছ–।

স্বপ্ন দেখা কি অন্যায়?

মোটেই না। আমরা স্বপ্ন দেখি সেই সব জিনিসের, যা সত্যি হলেও হতে পারে। পুরোপুরি যা অবাস্তব বা অলীক সেগুলো আমরা স্বপ্ন দেখি না, কারণ সেগুলো যে আগাপস্তলা স্বপ্ন তা আমরা সেই মুহূর্তেই বুঝতে পারি। যেমন, তুমি নিশ্চয়ই এখন নোবেল প্রাইজ পাওয়ার স্বপ্ন দ্যাখো না?

না, দেখি না, কিন্তু তাই বলে মানুষ কি স্বপ্ন দেখবে না!

তা কেন, তা কেন– হাত নেড়ে হাসল বৃদ্ধ, বলল, স্বপ্ন দেখার অসুখ কি সহজে যেতে চায়! কিন্তু তুমি সাবধানে স্বপ্ন দেখো–সে কথাই আমি বলতে এসেছি। তুমি যদি একটু কম স্বপ্ন দ্যাখো, তা হলে আমার কষ্ট একটু কম হয়, আমাকে একটু কম চোখের জল ফেলতে হয়।

বৃদ্ধের কথায় আদিত্য বেশ অবাক হচ্ছিল। একটা অদ্ভুত ঘোর লাগছিল ওর মনে। শাওয়ারের তলায় ভিজতে ভিজতেই ও বলল, আমি তো খুব বেশি কিছু চাই না–শুধু সুখী হতে চাই।

ওর কথা শুনে হাসল বৃদ্ধ। হাসতে-হাসতে কাশি পেয়ে গেল তার। বেশ কয়েকবার কেশে লাল হয়ে যাওয়া চোখ-মুখ মুছে নিয়ে সে বলল, বেশ বলেছ। সুখী হতে চাই। এ যেন ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার মতোই সহজ-সরল ব্যাপার। ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার কাকে বলে তুমি জানো। তাই সেটা হতে চাওয়া তেমন কঠিন ব্যাপার নয়। কিন্তু তুমি কি জানো, সুখী কাকে বলে?

আদিত্য কোনও জবাব দিতে পারল না।

তখন হেসে বৃদ্ধ বলল, যা তুমি জানো না, চেনো না, তা কি কখনও হওয়া যায়! একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাত দিয়ে মুখ মুছে নিল । আমি জানি, তোমার খুব ইচ্ছে তোমার দেখা সুন্দর সুন্দর স্বপ্নগুলো সত্যি হয়ে উঠুক। কিন্তু বিশ্বাস করো, সেগুলো সত্যি হলেই দেখবে ব্যাপারটা আর ততটা সুন্দর লাগছে না।

আপনি আমাকে ভয় দেখাতে এসেছেন? প্রতিবাদের ঢঙে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিল আদিত্য, আমি বেশ ভালো আছি। আমি ভালো থাকতে চাই। দরকার হয় জোর করে ভালো থাকব। কিছুতেই মন খারাপ করব না। আমার ভেতরে-বাইরে যত দুঃখ কষ্টই থাক, আমি সেগুলোকে ভুলে থাকব ভালো থাকব।

তোমার মনের জোর আছে। অন্তত তুমি মনের জোর দেখাতে চেষ্টা করছ। ভালো। কিন্তু অনুরাধার সঙ্গে যদি পর-পর তিনদিন দেখা না হয় তুমি ভালো থাকতে পারবে? তুমি পারবে একটানা তিনদিন ওকে ফোন না করে থাকতে?

অনুরাধা! অনুরাধার কথা লোকটা জানল কেমন করে?

সন্দেহের চোখে বৃদ্ধকে দেখল আদিত্য। জিগ্যেস করল, আপনি কি অনুরাধার কেউ হন?

না, তুমি যেরকম ভাবছ সেরকম কেউ না– একটু হাসল বৃদ্ধ, বলল আসলে তুমি একটু ভুল করছ। তোমাকে তো প্রথমেই বললাম, তোমাতে আমাতে কোনও তফাত নেই–শুধু সময়ের তফাত ছাড়া…তুমি কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর এখনও দাওনি।

অনুরাধাকে তিনদিন না দেখে থাকা! তিনদিন ফোন না করে থাকা! ওর সঙ্গে একদিন দেখা না হলেই আদিত্যর বুকের ভেতরটা কেমন করে। পরপর দুদিন ফোন না করতে পারলে ওর শ্বাসকষ্ট হয়। কিন্তু এই দুর্বলতার কথা বৃদ্ধকে বলা ঠিক হবে না।

তাই আদিত্য বলল, হ্যাঁ, পারব।

একথা শুনে বৃদ্ধের মুখ আবেগে ভেসে গেল। সে বলল, বাঃ, খুব ভালো। আমার কষ্ট তা হলে অনেক কমবে। এখন যে অনুরাধা তোমার কাছে থাকলেই তোমার ভালো লাগে, এমন দিন হয়তো আসতে পারে যখন ও কাছে থাকলেই তুমি বিরক্ত হবে।

শাওয়ারের বৃষ্টির মধ্যেই হো-হো করে হেসে উঠল আদিত্য। কিছুক্ষণ পর অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে বলল, আপনার কল্পনাশক্তির প্রশংসা করতে হয়। আর-একটু আগে আপনিই আমাকে স্বপ্ন দেখতে বারণ করছিলেন!

বিষণ্ণ গলায় বৃদ্ধ বলল, আমি তো চাই তুমি সবসময় ভালো থাকো। তুমি ঠিক যেমনটা চাও তোমার জীবনটা ঠিক সেইরকম হোক। গ্রীষ্ম-বর্ষা-শরৎ-হেমন্ত-শীত-বসন্ত–এই ছটা ঋতু পরপর নিয়মমাফিক বয়ে যাক তোমার জীবনে। কিন্তু… একটু থেমে বৃদ্ধ নীচু গলায় বলল, কিন্তু তা তো হয় না! কারও জীবনে বর্ষা খুব দীর্ঘ হয়ে যায়, কারও জীবনে শীত। আবার কারও জীবনে বসন্ত বেশিক্ষণ থেকে যায়। আসলে ব্যাপারটা কী জানো! একটা পয়সা নিতে হলে তার দুটো পিঠই নিতে হয়। এক পিঠ নেওয়া যায় না। তাই শুধু বসন্ত দিয়ে জীবন তৈরি করা যায় না– তার সঙ্গে অল্পবিস্তর শীত অথবা বর্ষা থেকে যায়। এদের তুমি বাদ দিতে পারো না। তুমি ভাবছ তোমার জীবনে বসন্ত খুব বেশি। অথচ চল্লিশ বছর পর আমার জায়গায় পৌঁছেলে তুমি বুঝতে পারবে, তোমার জীবনে শীতও কিছু কম ছিল না। অবশ্য সেই শীত তুমি এখন টের পাচ্ছ না– কারণ, শীত এখনও তোমাকে জানান দেওয়ার কাজটা শুরু করেনি। কিন্তু আমি তো জানি!

বৃদ্ধের চোখে বোধহয় জল এসে গিয়েছিল। হাত দিয়ে সেটা মোছার চেষ্টা করে সে আবার বিড়বিড় করতে শুরু করল, তারপর..শীতের পর…বাকি জীবনটা চলে যাবে বর্ষার দখলে। তখন তোমার এক চোখে থাকবে আষাঢ়, অন্য চোখে শ্রাবণ। ঠিক আজকের দিনটার মতন। তাই তোমাকে আজ সাবধান করতে এসেছি। শুধু বসন্ত দিয়ে জীবন তৈরি করা যায় না।

কথা শেষ করে বৃদ্ধ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তার বুকের খাঁচাটা হাপরের মতো ওঠা নামা করছিল।

আদিত্য কেমন একটা ঘোরের মধ্যে ডুবে যাচ্ছিল। সাঁতরে ভেসে ওঠার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছিল, কিন্তু কিছুতেই যেন পেরে উঠছিল না।

বৃদ্ধ আবার কাঁদতে শুরু করেছিল। কান্না-ভাঙা গলায় আর্তস্বরে সে বলল, আজ আমি যাই। তুমি একটু সাবধানে থেকো। এই বসন্তটাকে যতদিন পারো আঁকড়ে ধরে রেখো।

কী করে ধরে রাখব? উদ্ভ্রান্তের মতো প্রশ্ন করল আদিত্য।

তুমি অনুরাধাকে আঁকড়ে ধরে রেখো। তোমার মা-কে আঁকড়ে ধরে রেখো। এটা মনে রেখো, হাতের মুঠো আলগা হলেই ওরা সরে যাবে আর বসন্তও তোমাকে ফাঁকি দিয়ে পালাবে। তারপর…তারপর..শীত আসবে। আর বর্ষা তার পেছন থেকে উঁকি দেবে…।

আদিত্য কোনও কথা বলতে পারল না। ও ভাবছিল, অতীত বর্তমান তৈরি করে। আর বর্তমান থেকেই তৈরি হয় ভবিষ্যৎ। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই তিনটের মধ্যে এত তফাত কেন!

ভাবতে-ভাবতে আদিত্য আনমনা হয়ে পড়েছিল। হঠাৎ খেয়াল হতেই দেখল বৃদ্ধ আর নেই। ও একা-একা শাওয়ারে নীচে দাঁড়িয়ে ভিজছে।

আদিত্যর স্নান শেষ হতে অনেক সময় লাগল। ও মনে-মনে ঠিক করল, মাকে আর অনুরাধাকে ও আঁকড়ে ধরে রাখবে। ওরা ছাড়া তো ওর জীবনে আর কেউ নেই!

.

০২. এই ভালোবাসা অকারণ

হ্যালো, অনুরাধা?

হ্যাঁ, বলছি।

এখন কী করছিলে?

মাম্মির সঙ্গে গল্প করছিলাম।

কী গল্প?

সেরকম কিছু না–টিডবিটস–।

জানো, আজ একটা ফ্যানট্যাসটিক ব্যাপার হয়েছে।

কোথায়?

বাথরুমে।

ওরে বাবা! না, না, আমি শুনতে চাই না!

না, না–তুমি যেরকম ভাবছ নাথিং লাইক দ্যাট।

কে জানে! তোমার মুখে তো কিছু আটকায় না!

একটা ওল্ড ম্যান ঢুকে পড়েছিল বাথরুমে। আমি তখন শাওয়ারের নীচে।

তার মানে?

মানে আর কী! আমিও ভীষণ সারপ্রাইজড হয়ে গিয়েছিলাম। লোকটা হেভি উলটোপালটা কথা বলছিল। আমার জন্য কাঁদছিল–

ইজ নট আ জোক?

না, অনুরাধা, না। লোকটা দেখলাম আমার ব্যাপার-ট্যাপার সবই জানে। তোমার কথা বলছিল, মায়ের কথা বলছিল। বলছিল এই রিলেশানগুলোকে হাত মুঠো করে আঁকড়ে ধরে রাখতে কিছুতেই যেন মুঠো আলগা না হয়।

লোকটা কাঁদছিল কেন?

ঠিক জানি না। বলছিল যে, আমার জন্যে কাঁদছে। তারপর…তারপর ছটা ঋতুর কথা বলছিল। বলছিল, এখন বসন্ত চলছে। তারপর শীত আসতে পারে…তারপর বর্ষা। আমি লোকটার কথার মাথামুন্ডু কিছু বুঝতে পারিনি, তবে লোকটা আমার মুড অফ করে দিয়ে গেছে।…লোকটা তোমার কথাও বলছিল…।

কী বলছিল আমার কথা?

বলছিল, তোমাকে তিনদিন না দেখে আমি থাকতে পারব কি না। একটানা তিনদিন ফোন করে থাকতে পারব কি না!

তুমি কী বললে?

বললাম, পারব।

তা হলে এখন ফোন করেছ কেন?

তুমি কি চিরকাল ছেলেমানুষ থেকে যাবে? মানুষের কিছু-কিছু উইকনেস গোপন রাখা দরকার। তোমার কাছে গোপন করি না, কারণ, তোমাকে আমি আলাদা বলে ভাবি না। কিন্তু লোকটা আমার কে যে ওকে সব বলতে যাব!

ওই লোকটা কে তুমি বুঝতে পারোনি?

না। তা ছাড়া তুমি তো জানো, অনেক কিছুই আমি ঠিকমতো বুঝতে পারি না।

যেমন?

যেমন, তোমাকে আমি কেন এত ভালোবাসি জানি না। কখনও এর কোনও কারণ খুঁজে পাই না। তাই মনে-মনে বলি ও সম্পূর্ণ অকারণে তোমাকে আমি এত ভালোবাসি। এতে আমার খুব আনন্দ হয়।

কেন?

ভালোবাসার কোনও কারণ খুঁজে পেলেই তা থেকে স্বার্থের গন্ধ বেরোতে চায়। মা-কে যে আমি ভালোবাসি তারও সেরকম কোনও কারণ নেই।…তোমার ভালোবাসার কি কোনও কারণ আছে, অনুরাধা?

আগে কখনও এভাবে ভাবিনি। তবে মনে হচ্ছে, আমারটাও ঠিক তাই সম্পূর্ণ অকারণে।

তোমাকে ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছে।

বুঝতে পারছি, কিন্তু কিছু করার নেই।

 জানো, আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেলের কাছে আমি আপাদমস্তক ঋণী–?

 হোয়াট? আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল!

হ্যাঁ–টেলিফোন আবিষ্কার করার জন্যে। নইলে তোমাকে রোজ ফোন করতাম কী করে!

 ধন্য ইমাজিনেশান!

ইমাজিনেশান নিয়েই তো আমি বেঁচে আছি, অনুরাধা। ছোট-বড় স্পষ্ট-অস্পষ্ট কতকগুলো স্বপ্ন। আলটপকা বুড়োটা স্বপ্ন নিয়েও অনেক কথা বলছিল। বলছিল, সুন্দর স্বপ্ন যখন সত্যি হয়ে ওঠে তখন নাকি আর ততটা সুন্দর থাকে না।

সরি, একমত হতে পারলাম না।

জানো, আমার কাছে গোটা ব্যাপারটা কেমন মিস্টিরিয়াস মনে হচ্ছে। যদি শুধু স্বপ্ন নিয়েই আমাকে বাঁচতে হয়, তা হলে যে-স্বপ্ন কোনওদিন সত্যি হতে পারে না সেরকম অলীক স্বপ্ন নিয়েই বাঁচব।

এসব কী বলছ!

ওই লোকটার কথা মনে পড়লেই আমার মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। একা-একা কেমন দিশেহারা লাগছে। সেইজন্যেই তোমাকে আরও বেশি করে দেখতে ইচ্ছে করছে।…আমি এখন চলে যাব তোমাদের বাড়ি? জানলা দিয়ে শুধু তোমাকে একটিবার উঁকি মেরে দেখব, তারপর ফিরে আসব–

পাগল নাকি!

পাগল তো দু-বছর আগেই হয়েছি। দ্বিতীয়বার কি আর পাগল হওয়া যায়! একা-একা আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে…আমার কিছু ভাল্লাগছে না…।

মাম্মি তোমার রিসার্চের প্রগ্রেস জানতে চাইছিল।…এই তো, মাম্মি আমার সামনে বসে আছে।

আমার কিচ্ছু ভাল্লাগছে না…তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করছে…।

মাম্মিকে বলছি কাল সায়েন্স কলেজে গিয়ে তোমার রিসার্চের প্রগ্রেস রিপোর্ট নিয়ে আসব।

একা-একা আমি আর পারছি না…।

রিসার্চ নিয়ে এত আপসেট হওয়ার কিছু নেই। কাল তো তোমার সঙ্গে দেখা হচ্ছে, তখন সব ঠিক হয়ে যাবে।

আমাকে বাঁচাও, অনুরাধা…।

এত আপসেট হলে আমার খারাপ লাগে। প্লিজ।

কাল আসবে তো?

বললাম তো, যাব। এখন একটু মন দিয়ে পড়াশোনা করে দেখি।

 রাখছি তা হলে…।

হ্যাঁ—

 টা-টা, লাভ য়ু…।

.

০৩. জড়িয়ে ধরো, মাতৃস্নেহলতা

বারান্দায় বসে রাতের আকাশ দেখছিল আদিত্য। বিধাতা বীজধান ছড়ানোর মতো নক্ষত্র ছড়িয়ে দিয়েছেন আকাশে। আর হতবাক সুন্দর চাঁদ নয়ন মেলে সেই অনুপম দৃশ্য দেখছে। কে বলবে আজ সারাটা দিন মেঘ-বৃষ্টির দখলে ছিল!

বারান্দায় লাগোয়া ঘর অন্ধকার। ডানদিকের দেওয়াল ঘেঁষে রাখা খাটে মা শুয়ে আছে। খাটের মাথার কাছে রাখা ছোট টেবিলে টেপরেকর্ডার চলছে।

আমার সাধ না মিটিল, আশা না পুরিল, সকলি ফুরায় যায় মা– পূর্ণ-আশা, পূর্ণ-সাধ কোনও মানুষ কখনও দেখেনি আদিত্য।

প্রায় তেরো বছর আগে বাবা যখন ক্যানসারে মারা যান তখন তার সাধ অপূর্ণ ছিল। পরিণাম নিশ্চিত জেনে বাবা অপারেশনে রাজি হননি। ভাঙা গলায় দিনরাত শুধু অস্পষ্ট স্বরে বলতেন, তোমাদের ছেড়ে যেতে মন চায় না। কিন্তু কী যে করি…নিয়তির টান…।

আদিত্য মেঝেতে বসে বই পড়ত, আর বাবা কখন যেন নিঃশব্দে ওর কাছটিতে এসে দাঁড়াতেন। তারপর উবু হয়ে বসে ওর মাথায় হাত বোলাতেন।

দিতু, আমার সময় হয়ে এল রে…।

আদিত্য অবাক হয়ে দেখত বয়স্ক পুরুষমানুষটা নিলজ্জের মতো কাঁদছে।

অনেক কেঁদেছি কাঁদিতে পারি না বুক ফেটে ভেঙে যায় মা / সকলি ফুরায়ে যায় মা…।

শ্যামাসংগীত মায়ের খুব প্রিয়। প্রায়ই রাতে ঘর অন্ধকার করে মা গান শোনে। মন ভেঙে গিয়েছিল তেরো বছর আগেই–তারপর, এই তেরো বছরে, শরীরটাও ভেঙে গেছে। কিন্তু তাই বলে আদিত্যকে নিয়ে চিন্তা-ভাবনায় কখনও এতটুকু টান পড়েনি। প্রতিমুহূর্তেই আদিত্য শেকড়টা টের পায়। এখনও পাচ্ছিল।

বারান্দা ছেড়ে ঘরে এসে ঢুকল আদিত্য।

দেখল, মা বিছানায় টান-টান হয়ে শুয়ে আছে। জানলা দিয়ে ছিটকে আসা কয়েক টুকরো আলোয় মাকে ভারি অদ্ভুত দেখাচ্ছে।

মা, তোমার মনে পড়ে ছোটবেলার দিনগুলো? উনুনে বসানো কড়াইয়ে মশলার আঁঝ, তোমার ঘামতেল মুখ, খেলনা মোটরগাড়ি ভেঙে গিয়ে আমার কান্না, বাবা অফিস বেরোবেন, তোমার ছুটোছুটি, পাশের বাড়ির ছুটকির মা এসে তোমাকে ডাকাডাকি, ছুটকির কান বেঁধাতে হবে তোমাকে, আমাকে স্কুলে দিয়ে আসা নিয়ে আসা, রাতে কত গল্প শোনানো…। এই করে করে এক ক্লাস ডিঙিয়ে আর এক ক্লাসে, বড় হয়ে ওঠা, কত গ্রীষ্ম-বর্ষা-শরৎ-হেমন্ত পার করে দেওয়া। ঋতুরা আসা-যাওয়া করেছে। ছায়াছবির মতো।

আদিত্যর মনে পড়ল, এক শীতের রাতে তিন-চার জ্বরে কপালে মায়ের ঠান্ডা হাত। সেই স্পর্শ আজও টের পায় ও।

এইভাবে তিলতিল করে গড়ে উঠেছে সম্পর্ক, আর সবকিছু ছেড়ে চলে যাওয়ার ক্ষণটিও এগিয়ে এসেছে কাছাকাছি। কিন্তু তবুও তো মানুষ সম্পর্ক আঁকড়ে ধরে রাখতে চায়!

আদিত্য হাত মুঠো করল প্রাণপণ শক্তি দিয়ে। আধো-আঁধারিতে ওর মুঠো করা হাত ঘিরে এক আকুল মায়া জড়িয়ে ছিল। ভালোবাসা দিয়ে এই সম্পর্কও আঁকড়ে ধরে রাখবেকিছুতেই আঁকড়ে ধরা মুঠো খুলবে না–যতই গ্রীষ্ম-বর্ষা-শরৎ-হেমন্ত-শীত-বসন্ত আসুক। ভালোবাসা এইসব ঋতুর চেয়ে কিছু কম নয়। ছটা ঋতুই মাত্র দু-মাস করে থাকে–যায়, আবার আসে। কিন্তু ভালোবাসার ঋতু কখনও যায় না–থেকে যায় চিরকাল।

আমার সাধ না মিটিল, আশা না পুরিল…।

পূর্ণর্সাধ কোনও মানুষ আদিত্য কখনও দেখেনি, দেখতে চায় না। যে-জীবনে কোনও আকাঙ্ক্ষা নেই, তাকে জীবন বলতে ইচ্ছে করে না আদিত্যর। সামান্য মানুষ হিসেবে যৎসামান্য আকাঙ্ক্ষা বুকের ভেতরে লুকিয়ে রাখাটা কোনও পাপ নয়।

অন্ধকারে অন্ধকার ছবির মতো দাঁড়িয়ে আদিত্য তাই ভালোবাসার ঋতুর কথা ভাবছিল– আর ভাবছিল, যদি সেই আলটপকা বুড়ো আবার ওকে দেখা দেয়, তা হলে তাকে ও কেমন মুখের মতো জবাব দেবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *