1 of 2

ভুলোমন ভুলোদা

ভুলোমন ভুলোদা

মায়ের মুখে কথাটা শুনে আমার আক্কেলগুড়ুম হয়ে গেল। ভুলোদার সঙ্গে নেমন্তন্নে যাওয়া!

ওরে বাবা, সে আমি পারব না! মউ পাশেই দাঁড়িয়েছিল। হাততালি দিয়ে বলল, ঠিক হয়েছে, ভুলোদার সঙ্গে গেলে মজাটি টের পাবে।

আমার মুখে একটা হতাশ ভাব ফুটে উঠেছিল। হয়তো সেটা লক্ষ করেই মা বললেন, ভয় কী রে! তুই তো ভুলোর সঙ্গে-সঙ্গেই থাকবি। দরকার হলে ওকে খেয়াল করিয়ে দিবি।

মউ এখনও আমার দিকে চেয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। মা ওকে ধমক দিয়ে বললেন, দাদার সঙ্গে ফাজলামো হচ্ছে! চল, পড়তে বসবি।

মা ওকে নিয়ে পড়াতে বসলেন। কাল মউয়ের ইংরেজি পরীক্ষা। আমার অ্যানুয়াল পরীক্ষা শেষ হয়েছে গত পরশু। আর তার জন্যেই পড়তে হল এমন বিপদে। কারণ পরীক্ষা শেষ না হলে ভুলোদার সঙ্গে নেমন্তন্ন খেতে যাওয়ার কোনও প্রশ্নই উঠত না। এ যেন অ্যানুয়াল পরীক্ষার চেয়েও কঠিন পরীক্ষা।

ভুলোদাকে এ-পাড়ার প্রায় সব্বাই ভয় পায়। বিশেষ করে আমি। কারণ, সে সব কিছু শুধু ভুলে যায়। আর এই ভুলে যাওয়ার ব্যাপারটা ঘটে যখন-তখন। একবার নাকি রাত দেড়টার সময় উঠে হাত-মুখ ধুয়ে চেঁচিয়ে পড়তে বসে গিয়েছিল। বাড়ির সবাই তো জেগে উঠেছে ভুলোদার ভারী গলার চিৎকারে। তারপর তাকে জিগ্যেস করে জানা গেল, তখন যে রাত সেটা ভুলোদা ভুলে গেছে। ভেবেছে ভোর হয়েছে, তাই হাত-মুখ ধুয়ে পড়াশোনায় মন দিয়েছে।

ভুলোদার আসল নাম বিপ্রদাস সরকার। আমার বড়মাসির ছেলে। থাকে আমাদের বাড়ির পাঁচটা বাড়ি পরে। তার ওই ভুলো মনের কাণ্ডকারখানা দেখে কবে যে ভুলো নামটা চালু হয়ে গেছে জানি না। এখন তার আসল নামটাই বেশ কষ্ট করে মনে রাখতে হয়।

ভুলোদা আমার চেয়ে চার বছরের বড়। গত বছরে হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করেছে। এত ভুললামন নিয়ে কী করে যে ঠিক-ঠিক উত্তর লিখতে পারল, কে জানে! সবাই যখন একথা জিগ্যেস করে তখন ভুলোদা বলে, কী জানি ভাই, ওই একবারই হয়তো ভুল করে ঠিক-ঠিক উত্তর লিখে ফেলেছি।

হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করার পর ভুলোদা কলেজে ভরতি হয়েছে। একইসঙ্গে আবার ব্যায়াম করতে শুরু করেছে। মাঝে-মাঝে বলে, পড়তে ভালো লাগছে না–অথচ সময় পেলেই আমাকে পড়া-টড়া দেখিয়ে দেয়। এমনিতে ভুলোদা সত্যি খুব ভালো। শুধু ওই ভুলে যাওয়ার ব্যাপারটুকু ছাড়া।

আজকের নেমন্তন্ন ছোটমাসির ছেলের মুখে-ভাত উপলক্ষ্যে। বাবা অফিসের কাজে কলকাতার বাইরে। মা মউকে পড়াতে ব্যস্ত থাকবেন। একমাত্র আমিই পরীক্ষার পাট চুকিয়ে খেলাধুলো নিয়ে মেতে আছি। অতএব আমাকেই যেতে হবে। যেতে রাজিও ছিলাম। কারণ, জানতাম বড়মাসির বাড়ির অনেকে যাবে। কিন্তু একটু আগেই মায়ের মুখে শুনলাম, ওরা কেউ যেতে পারবে না। কীসব ঝামেলায় পড়ে গেছে। যাওয়ার লোক বলতে রয়েছে শুধু ভুলোদা। ব্যস, এখন আর আমার নিস্তার নেই।

ছোটমাসিদের বাড়ি সেই খিদিরপুর, আর আমাদের বাড়ি বরানগর। শ্যামবাজার পেরিয়ে গেলে রাস্তাঘাট আমি কিছু চিনি না। স্রেফ ভুলোদা ভরসা। যদি নেমন্তন্নে যাওয়ার সময় ভুল করে অন্য দিকে চলে যায়! কিংবা আমাকে ফেলে রেখে বাস থেকে কোথাও নেমে পড়ে! ভুলোদা কোথায় যে কী করে বসবে তার কোনও ভরসা নেই। তার ওপর গত সপ্তাহেই যে-দুটো ঘটনা ঘটেছে তাতে আমার ভয়টা অনেক বেড়ে গেছে। যাকে বলে একেবারে বুক ঢিপঢিপ করছে।

গত সপ্তাহের প্রথম ঘটনা আমার সাইকেল নিয়ে।

ক্লাস সেভেন থেকে এইটে ওঠার পর বাবা আমাকে একটা সাইকেল কিনে দিয়েছেন। বেশ বড়সড় সাইকেল। আগে একটা ছোট সাইকেল ছিল। সেটার চাকা ছিল মোট চারটে। দুটো বড়, আর পেছনের চাকার দু-পাশে দুটো রডের মাথায় খুদে-খুদে দুটো চাকা–যাতে চালাতে গিয়ে ব্যালান্স হারিয়ে কাত হয়ে পড়ে না যাই। ছোট সাইকেলটা এখন মউ চালায়, বড়টা আমি।

বড় সাইকেলটা একদিন ধার চাইতে এল ভুলোদা। বলল, বাবান, তোর সাইকেলটা একটু দে তো। চিড়িয়ামোড়ের কাছে একটা জরুরি কাজ আছে, ঝটপট সেরে আসি।

আমি সাইকেলটা ভুলোদাকে দিয়ে বললাম, মনে করে আবার দিয়ে যেয়ো কিন্তু।

আরে সে নিয়ে ভাবিস না–। বলে সাইকেলে চড়ে ভুলোদা রওনা হয়ে গেল।

তারপর থেকে তিন-তিনটে দিন ভুলোদার আর পাত্তা নেই। সুতরাং গেলাম বড়মাসির বাড়ি। ধরলাম ভুলোদাকে। বললাম, আমার সাইকেল কী হল, ভুলোদা?

মাথায় হাত দিয়ে জিভ কেটে ভুলোদা বলল, এই রে, একদম ভুলে গেছি! শিগগিরি চ, শিগগিরি চ–।

আমার হাত ধরে টানতে-টানতে সোজা রাস্তায়। সেখান থেকে বাসে চেপে চিড়িয়ামোড়। চিড়িয়ামোড়ে নেমে একটা কাপড়ের দোকানে গিয়ে ঢুকল ভুলোদা। দোকানদারকে বলল, বিকাশদা, আমার সাইকেলটা…।

ভদ্রলোক হেসে দোকানের এক কোণ থেকে সাইকেলটা এনে ভুলোদার হাতে দিলেন। তার হাসি দেখেই বুঝেছি ভুলোদাকে তারা ভালো করেই চেনেন।

বাড়ি ফেরার পথে ভুলোদার মুখে সব শুনলাম। তিনদিন আগে সাইকেলটা বিকাশবাবুর দোকানে রেখে সে কী একটা কাজে গিয়েছিল। বলেছিল, একটু বাদে এসে সাইকেলটা নিয়ে যাবে। তারপর ভুল করে বাসে চড়ে সোজা বাড়ি চলে গেছে। ব্যস, সেদিন থেকে বেমালুম ভুলে গেছে সাইকেলের কথা।

দ্বিতীয় ঘটনা আরও সাঙ্ঘাতিক।

ভুলোদার কলেজের এক বন্ধু ভুলোদাকে ডাকতে এসেছিল বাড়িতে। দুজনে মিলে কোথায় যেন যাওয়ার কথা। বন্ধুর ডাকে ভুলেদা নেমে এসেছে সদর দরজায়। বলেছে, দাঁড়া, জামাকাপড় পরে এক্ষুনি আসছি। তারপর একছুটে দোতলায় উঠে গেছে পোশাক পালটাতে।

দশ মিনিট। পনেরো মিনিট। অবশেষে আধঘণ্টা কেটে গেল, তবুও ভুলোদার পাত্তা নেই। তখন অধৈর্য হয়ে সেই বন্ধু ডাকাডাকি করতে শুরু করল ভুলোদার নাম ধরে। বড়মাসি দেখা দিলেন দোতলার বারান্দায়। বন্ধুটি বলল, মাসিমা, বিথকে আসতে বলুন। জামা-প্যান্ট-ছেড়ে আসছি বলে সেই যে গেছে পুরো আধঘণ্টা হয়ে গেল দেখা নেই। যেখানে যাওয়ার কথা সেখানে দেরি হয়ে যাবে।

ছেলের বন্ধুর কথা শুনে বড়মাসি তো হাঁ। অবাক গলায় বললেন, সে কী, বাবা! ভুলো যে জামাকাপড় পরে মিনিট কুড়ি আগে খিড়কি দিয়ে বেরিয়ে গেল! বলল, শঙ্করদের বাড়ি যাব, ভীষণ জরুরি দরকার।

বন্ধুটি আরও অবাক। কারণ তারই নাম শঙ্কর। তাকে সদরে দাঁড় করিয়ে রেখে খিড়কি দরজা দিয়ে চলে গেছে ভুলোদা! গেছে আবার তাদেরই বাড়িতে, তার সঙ্গে দেখা করতে।

মাসিমা, আমারই নাম শঙ্কর– এ-কথা চেঁচিয়ে বলে সে তখন ছুটতে শুরু করেছে বাস স্টপের দিকে। যদি কোনওরকমে ভুলোদাকে ধরা যায়।

ভুলোদাকে ধরা গিয়েছিল। তখন জিভ কেটে মাথায় হাত দিয়ে সে বলে উঠেছিল, ইশ! একদম ভুলে গেছি রে!

সুতরাং এইরকম ভুলোদার সঙ্গে নেমন্তন্ন বাড়ি যেতে ভয় করবে না। কিন্তু এখন তো আর উপায় নেই।

সুতরাং সন্ধেবেলা রওনা হয়ে গেলাম দুজনে। মা বারবার করে বলে দিলেন, ভুলো, তোর ছোট ভাইটিকে ভুলে যাস না যেন।

ভুলোদা হেসে বলল, তুমি কিছু ভেবো না, মাসি। ভুল আমার হয়, তবে বাবানকে ভুলে যাব, এতবড় ভুলো আমি নই। মউ তখন মুচকি মুচকি হাসছে। আমিও রেগে গিয়ে বলে দিলাম, কাল পরীক্ষায় লাড্ডু পাবি।

মউ নাকিসুরে প্রতিবাদ করতেই মা বললেন, কী হচ্ছে বাবান। ও-কথা বলতে নেই।

সন্ধেবেলা রওনা হওয়ার পর থেকেই আমি ভুলোদার সঙ্গে আঠার মতো লেগে আছি। যদি হঠাৎই কিছু ভুল করে বসে! কপাল ভালো যে, যাওয়ার পথে বা ছোটমাসির বাড়িতে সময়টুকু বেশ ভালোয়-ভালোয় কেটে গেল। তারপর আমরা রওনা হলাম বাড়ির দিকে। তখন রাত প্রায় দশটা।

পাড়ার বাসস্টপে যখন নামলাম তখন রাত এগারোটা পেরিয়ে গেছে। চারপাশ বেশ অন্ধকার। অর্থাৎ, লোডশেডিং। নির্জন অন্ধকার রাস্তায় চলতে গিয়ে গা-টা বেশ ছমছম করে উঠল। চাঁদের আলোয় পথ দেখে আমি আর ভুলোদা এগিয়ে চলেছি। হঠাৎই একটা দোকানের আড়াল থেকে অন্ধকার কুঁড়ে দুটো লোক বেরিয়ে এল। দুটো কালো ছায়া। সোজা এসে একেবারে আমাদের পথ আটকে দাঁড়াল। ওদের মুখগুলোও ভালো করে দেখা যাচ্ছে না। কর্কশ গলায় একজন বলল, মালকড়ি যা আছে ঝটপট দিয়ে দে।

ঠিক তক্ষুনি দ্বিতীয় লোকটা একটা রিভলভার বের করল। ছবিতে যেমন দেখেছি ঠিক সেইরকম, সত্যিকারের রিভলভার। তারপর রিভলভারটা ভাজ করে গুলির চেম্বারটা দেখিয়ে বলল, দেখেছ তো, চেম্বারে গুলি ঠাসা আছে! গোলমাল করলেই খুলি উড়ে যাবে!

আমি পকেট থেকে কটা টাকা আর কিছু খুচরো পয়সা বের করে প্রথম লোকটার হাত তুলে দিলাম। কাঁপা গলায় ভুলোদাকে বললাম, ভুলোদা, যা দেওয়ার দিয়ে দাও।

দ্বিতীয় লোকটা তখন রিভলভার ঠেকিয়ে ধরেছে ভুলোদার বুকে? জলদি!

সেই মুহূর্তেই ভুলোদা এক অদ্ভুত কাণ্ড করল। রিভলভার ধরা লোকটার নাকে সপাটে বসিয়ে দিল এক বিরাশি সিক্কার ঘুসি। লোকটা ব্যায়াম করা হাতের ঘুসি খেয়ে ছিটকে পড়ল মাটিতে। আর ভুলোদা সঙ্গে-সঙ্গে, বাবান, কুইক। বলে দে ছুট। চমক ভেঙে আমিও ছুটতে লাগলাম ভুলোদার পেছনে। মুখ ফিরিয়ে দেখি, প্রথম গুন্ডাটা ছুটে পালাচ্ছে। দুনম্বরটা বোধহয় তখনও সেন্সলেস হয়ে পড়ে আছে।

ছুটতে ছুটতে খেয়াল হওয়ায় হঠাৎ ভুলোদা চিৎকার শুরু করে দিল, পুলিশ! পুলিশ!

আমিও তার দেখাদেখি চিৎকার শুরু করলাম। তারপর দু-চারজন মানুষের সাড়া পেতেই আমরা থেমে পড়লাম। আরও লোক জড়ো হতে লাগল। নাইট ডিউটির দুজন পুলিশ কনস্টেবলও হাজির হল সেখানে।

সবাই মিলে যখন অকুস্থলে হাজির হলাম, তখনও গুন্ডাবাবাজি অজ্ঞান। টর্চের আলোয় দেখলাম তার নাক দিয়ে রক্ত গড়াচ্ছে। রিভলভারটা পড়ে আছে পাশেই। আমাদের নামধাম লিখে নিয়ে বলা হল পরদিন থানায় দেখা করতে।

পরদিন একেবারে হুলুস্থুল কাণ্ড! সারা পাড়ায় রটে গেল, ভুলো ডাকাত ধরেছে। একেবারে যে-সে ডাকাত নয়, রিভলভার-ধরা সাঙ্ঘাতিক ডাকাত। থানার অফিসারও ভুলোদাকে পিঠ চাপড়ে বারবার বাহবা দিলেন। বললেন, ওই কুখ্যাত ফেরারি গুন্ডাটিকে তারা বেশ কিছুদিন ধরেই খুঁজছিলেন।

থানা থেকে বাড়ি ফেরার পথে ভুলোদাকে আমি বললাম, ভুলোদা, তোমার এত সাহস! ছ-ছটা তাজা কার্তুজ ভরা রিভলভারওলা লোকটাকে তুমি এক ঘুসিতে শুইয়ে দিলে! তোমার কি প্রাণের ভয় নেই!

ভুলোদা উদাস মুখে বলল, ভয় কি আর নেই রে, বাবান। আসলে তুই যখন বললি, ভুলোদা, যা দেওয়ার দিয়ে দাও, আমি ভাবলাম তুই বোধহয় গুন্ডাগুলোকে ধোলাই দেওয়ার কথা বলছিস। ব্যস, দিলাম একখানা হুক সামনেরটাকে বসিয়ে। তখন কি আর রিভলভারের কথা আমার মনে আছে রে! সে তো একদম ভুলেই গেছি!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *