1 of 2

সুন্দরী

সুন্দরী

রিঙ্কু বিছানায় বসে বই পড়ছিল। কমলেশ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াতে-আঁচড়াতে জিগ্যেস করল, অ্যাই, খুব সুন্দর একটা কবিতার লাইন শুনবি?

রিঙ্কু আয়নার মধ্যে দিয়ে বাবার দিকে তাকাল। বলল, কী, শুনি?

কমলেশ মুচকি হেসে বলল, পদার্থবিদ্যা পড়ছে একটি অপদার্থ মেয়ে।

রিঙ্কু গম্ভীরভাবে বইয়ের পাতায় মনোযোগ দিয়ে মন্তব্য করল, বুঝেছি, আমাকে অপদার্থ বললে। আমি তো ভৌতবিজ্ঞান পড়ছি, তাই।

কমলেশ হো-হো করে হেসে উঠে বলল, নাঃ, তোর দেখছি বুদ্ধি আছে। আমি তোর বুদ্ধি পরীক্ষা করছিলাম।

একটু দূরে দাঁড়িয়ে রোমি ঠোঁটে লিপস্টিক ঘষছিল। রুক্ষ গলায় বলল, তোমার আয়নার কাজ হয়েছে? তা হলে এ পাশে এসে মেয়ের সঙ্গে কবির লড়াই করো। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।

কমলেশ বউয়ের দিকে তাকাল। সেজেগুজে কোথায় যেন বেরোচ্ছে! বিউটি পারলার, কিংবা হ্যান্ডিক্র্যাফট-এর স্কুল, অথবা কুকিং রেসিপি-র স্পেশাল কোর্স অ্যাটেন্ড করতে। নয়তো অন্য কিছু। কমলেশ ঠিক জানে না। জানার তেমন একটা ইচ্ছেও আর নেই।

কমলেশ কোনও কথা না বলে আয়না ছেড়ে দিল। রোমি চটপট পা ফেলে আয়নার সামনে এসে সাজগোজের শেষ ধাপটুকু মন দিয়ে শেষ করতে লাগল।

কমলেশ আড়চোখে বউকে একবার দেখল।

রোমি দারুণ সুন্দরী। এত সাজগোজের কোনও দরকার নেই ওর। কিন্তু তবুও সাজে। রূপ নিয়ে ঠিক দেমাক না হলেও ওর একধরনের আত্মতুষ্টি আছে। মাঝে-মাঝে কমলেশকে আড়ালে কথা শোনায়, রিঙ্কু তেমন সুন্দর দেখতে হয়নি বলে।

আয়নার মধ্যে দিয়ে রোমিকে দেখতে দেখতেই হঠাৎ কী যেন হয়ে গেল। আয়নার ছায়াটা ঢেউয়ের মতো কাঁপতে লাগল, তারপর সেখানে একটা অদ্ভুত বেঢপ চেহারা দেখা গেল। ধাতুর পাতে তৈরি হাত-পা-ওয়ালা একটা মানুষ যেন!

কমলেশ বুঝতে পারল, ও এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিল। কারণ এই ঘরে রোমি বা রিঙ্কু থাকতে পারে না। অন্তত এখন।

তো চোখ খুলে ভালো করে তাকাল চারপাশে।

মাথা ঝিমঝিম করছে। ঘরের দেওয়ালগুলো দোল খাচ্ছে। বুকের ভেতর কেমন যেন একটা শব্দ হচ্ছে। আয়নাটা মনে হল দুলছে। এমনকী আয়নার সামনে দাঁড়ানো বেঢপ চেহারার বস্তুটাও সামান্য টলছে।

ওইরকম আচ্ছন্ন অবস্থাতেও কমলেশ মোটামুটি শুনতে পাচ্ছিল। ওর কানে এল, বিচিত্র ধাতব গলায় কে যেন সুর করে গাইছে?

ভোর হইল, জগৎ জাগিল
চেতনে চাহিল নারী-নর–।

আর তার ঠিক পরেই সেই ধাতব কণ্ঠ হাঁফ ছাড়ার ভঙ্গিতে বলল, যাক, তোমার ঘুম ভেঙেছে তা হলে! ওঠো দ্যাখো, ভোর হয়ে গেছে। আজি এ প্রভাতে রবির কর কেমনে পশিল। প্রাণের পর কেমনে পশিল গুহার আঁধারে। প্রভাত পাখির গান–

থামো, থামো, থামো! প্রায় চেঁচিয়ে উঠল কমলেশ। বিছানায় উঠে বসে ও হাতের পিঠ দিয়ে চোখ ঘষতে লাগল। তারপর মুখের সামনে ডানহাতের তর্জনী ও মধ্যমা ভি অক্ষরের মতো করে বারকয়েক নাড়ল। না, দুটো আঙুলই দেখতে পাচ্ছে কমলেশ–চারটে নয়। এমনকী পাশের ছোট টেবিলে রাখা ভ্যাট সিক্সটিনাইনের বোতলের গায়ের লেখাটাও বাংলায় নির্ভুলভাবে ভ্যাট উনসত্তর বলে পড়তে পারল। নাঃ, নেশার ঘোের তা হলে আর নেই। শুধু এই হতচ্ছাড়া মস্তক বেদনাটি ছাড়া।

কিন্তু তবুও আয়নার সামনে দাঁড়ানো বিচিত্র রোবটটাকে কমলেশ কিছুতেই বাস্তব বলে মেনে নিতে পারছিল না। একে তো রোবট, তায় আবার নিঝরের স্বপ্নভঙ্গ আওড়াচ্ছে!

রোবটটা আহত গলায় বলল, জানি, আমার পাংচুয়েশানে একটু-আধটু ডিফেক্ট আছে, তা বলে অমন মুখ করে থামিয়ে দেওয়ার কী ছিল! ভোরের রূপ দেখে আমি একটু ইমোশনাল হয়ে পড়েছিলাম!

কমলেশ হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারল না। আয়নার সামনে দাঁড়ানো রোবটটাকে দেখে ওর মনে ঠিক পাঁচটি মৌলিক প্রশ্ন জাগল : কে, কী, কেন, কবে, কোথায়?

এলোমেলো বিছানা থেকে নেমে কোনওরকমে সোজা হয়ে দাঁড়াল কমলেশ। বিরক্ত গলায় পাঁচটি প্রশ্নের প্রথমটা ছুঁড়ে দিল রোবটটার দিকে।

কে তুমি?

ও মা! বিস্ময়ে ডানহাত তুলে গালে ঠেকাল রোবটটা। খনখনে গলায় বলল, আমার জন্মদাতা হয়ে আমাকেই ভুলে গেলে!

জন্মদাতা!

হ্যাঁ, কাল রাতে তুমিই তো আমাকে তৈরি করলে! ঠিক রাত বারোটা বেজে তেতাল্লিশ মিনিটে আমাকে কমপ্লিট করে সুইচ অন করে দিয়েছ তুমি।

কমলেশ এই যন্ত্রপাতিটাকে তৈরি করেছে! হতে পারে, আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। গত ছমাস ধরে যা কিছু ও আবিষ্কার করেছে তার শতকরা নব্বই ভাগই মাতাল অবস্থায়, নেশার ঘোরে। তা ছাড়া, রোবটটার চেহারার মধ্যেও কমলেশের পেটেন্ট ধাঁচ রয়েছে।

কমলেশ বেশিরভাগ সময়েই বাতিল করে দেওয়া জিনিসপত্র ব্যবহার করে নতুন-নতুন আবিষ্কার করে ফেলে। ফলে অল্প খরচে তৈরি করা অভিনব সব মেশিনপত্তর জনগণের কাছে চটজলদি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। যেমন, নিমের ডাল, জামাকাপড় ছড়ানোর প্লাস্টিকের ক্লিপ আর পুঁচকে একটা মোটর দিয়ে ও তৈরি করেছে দন্তধাবন যন্ত্র। এই যন্ত্রের সাহায্যে দাঁত মাজার সময়ে মাথা একটুও নাড়াতে হয় না। শুধু যন্ত্রে দাঁত ঠেকিয়ে দাঁত খিঁচিয়ে থাকলেই কাজ হয়। যন্ত্র নিমেষে বাকি কাজটুকু সেরে দেয়। তা ছাড়া এতে আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নিমের দাঁতনের আয়ুর্বেদিক গুণ। আর দাম মাত্র পঁচাত্তর টাকা। শুধু মাঝে-মাঝে নিমের দাঁতনের একটা নতুন টুকরো ক্লিপের মধ্যে ফিট করে দিতে হয়।

তা এই রোবটটাও সেইরকম। ভাঙা টিনের পাত্রতার মধ্যে মোটর গাড়ির বডি থেকে শুরু করে আমুল স্প্রে-র খালি টিন পর্যন্ত রয়েছে, পুরোনো গিয়ার, সাইকেলের চেন, কয়েকটা টুনি বা, খানিকটা স্বচ্ছ প্লাস্টিক, কয়েকটা মোটর আর আই. সি. চিপ দিয়েই ব্যাপারটা মোটামুটি কমপ্লিট হয়ে গেছে। মেশিনটার বুকের কাছটায় একটা নব লাগানো দরজা রয়েছে। বোধহয় ব্যাটারি ভরার জন্য আর কানেকশান রিপেয়ার করার জন্য।

স্বাভাবিকভাবেই রোবটটা দেখতে তেমন একটা আহামরি কিছু হয়নি। চোখের বা দুটো মাঝে-মাঝেই জ্বলে উঠছে, আর তালপাতার সেপাইয়ের মতো ল্যাকপ্যাক করে টিনের হাত-পা নাড়ছে।

কিন্তু এই মালটাকে কমলেশ তৈরি করল কেন?

ওর এখন বেশ মনে পড়ছে, রোবটটা তৈরির জন্য গত কয়েক সপ্তাহ ধরে খুবই পরিশ্রম করেছে। তারপর গতকালই ফিনিশিং টাচ দিয়ে রোবটটাকে চালু করেছে। কিন্তু কেন?

কমলেশ সেই কথাটাই জিগ্যেস করল, তোমাকে হঠাৎ তৈরি করতে গেলাম কেন বলো তো?

রোবটটা ঘাড় বেঁকিয়ে তাকাল কমলেশের দিকে। বলল, কী করে জানব! হয়তো তোমার একা-একা লাগছিল, সেইজন্যে।

কমলেশ বিরক্তির একটা শব্দ করে ঘরের চারপাশটা দেখল। ছন্নছাড়া বলতে যা বোঝায় ঘরটার অবস্থা এককথায় তাই। একসময় এই ঘরটার নাম বেডরুম ছিল–যখন রোমি-রিঙ্কু ছিল। তারপর, গত আটমাস ধরে এই ঘরটা ধীরে-ধীরে পালটে গেছে। এখন এটা বসার ঘর, শোওয়ার ঘর, ল্যাবরেটরি সবকিছু।

বিছানার পায়ের দিকটায় ড্রেসিং টেবিল, আয়না লাগানো। আর ওদিকের কোণটায় জামাকাপড়ের দুটো স্টিলের আলমারি। একটায় কমলেশের জামাকাপড় উঁই করা। অন্যটায় রোমি আর রিঙ্কুর পোশাক-আশাক। রোমি বলে গেছে, ওর নতুন ফ্ল্যাটে সবকিছু সাজানো-টাজানো হয়ে গেলে তখন এটা নিয়ে যাবে। নিয়ে গেলেই ভালো। নইলে সবসময় পুরোনো কথাগুলো বড় বেশি করে মনে পড়ে। তখন খারাপ লাগে। একা-একা লাগে। কষ্ট হয়।

কমলেশ আয়নার পাশে দেওয়ালে ঝোলানো টুথব্রাশ কিপার থেকে ব্রাশ নিল। নানা রঙের রেক্সিন দিয়ে তৈরি জোকারের হাসি-হাসি মুখ। তার টুপিতে গুড মর্নিং লেখা। রিঙ্কু পছন্দ করে এই টুথব্রাশ কিপারটা কিনেছিল। কমলেশের গোলাপি ব্রাশের পাশেই সবুজ ও নীল রঙের দুটো ব্রাশ। রোমির আর রিঙ্কুর। ওরা কখনও এলে যদি দরকার হয়, তাই ও-দুটো এখনও ফেলে দেয়নি কমলেশ।

মাঝে-মাঝে রোমি আসে, কখনও কখনও সঙ্গে নিয়ে আসে রিঙ্কুকে। তবে এলেও বেশিক্ষণ থাকতে চায় না। একমাত্র সুতপন এলে তেমন একটা তাড়াহুড়ো করে না।

সুতপন বোধহয় কমলেশকে পছন্দই করে। ও কমলেশের সঙ্গে নানা বিষয় নিয়ে গল্প করে। ওর টিভি সিরিয়াল তোলার কোম্পানি আছে। তার ব্যাপারে অনেক সময় কথা বলে। টিভি দর্শকদের তাক লাগিয়ে দেওয়ার জন্য কমলেশ অভিনব কিছু আবিষ্কার করতে পারে কি না, তা জিগ্যেস করে।

রিঙ্কুর পড়াশোনা নিয়ে আলোচনা করে সুতপন। কিন্তু রোমির কথা কখনও তোলে না। রোমির সঙ্গে ওর সম্পর্ক নিয়ে বোধহয় মনে-মনে একটা অস্বস্তি আছে।

কমলেশ সাধারণত নিজের আবিষ্কার নিজে ব্যবহার করে না। তাই সাবেকি পদ্ধতিতে দাঁত মেজে মুখ টুখ ধুয়ে ও চলে গেল রান্নাঘরে। ফ্রিজ খুলে দুটো মিষ্টি আর একটা স্যান্ডউইচ বের করে নিল।

ফ্রিজ খুলতেই সুন্দর একটা মিউজিক বেজে উঠল। এটা কমলেশের বৈজ্ঞানিক কীর্তি। আর ফ্রিজের ভেতরটা যে যেমন-তেমন অগোছালো, সেটাও কমলেশের কীর্তি। ফ্রিজের ভেতরে উলটোপালটা খাবার-দাবারের সঙ্গে এখানে ওখানে আই. সি. চিপ, ইলেকট্রনিক কম্পোনেন্টও খুশিমতো রাখা আছে।

গত সাত-আটমাস ধরে এই ফ্রিজটা কমলেশের তত্ত্বাবধানে আছে। আর রান্নাঘরটা রয়েছে। ছুটির মায়ের তত্ত্বাবধানে। ছুটির মা এখনও আসেনি। দশটা-সাড়ে দশটায় আসবে।

কোনওরকমে খাওয়া শেষ করে শোওয়ার ঘরে ফিরে এল কমলেশ। গা ম্যাজম্যাজ করছে, মাথা দপদপ করেছে। অবশ্য এ ঝামেলাগুলো আজকাল গা-সওয়া হয়ে গেছে।

শোওয়ার ঘরে ঢুকতেই দেখল, রোবটটা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চেহারা বেঁকিয়েচুরিয়ে দেখছে আর বারবার বলে উঠছে, অপূর্ব! মারভেলাস! বিউটিফুল!

কমলেশ হাই তুলল। বিছানায় গিয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে বসল। তারপর আর থাকতে না পেরে মুখ তুলে জিগ্যেস করল, কী ব্যাপার? কী দেখে অমন বারবার অপূর্ব, মারভেলাস আর বিউটিফুল বলছ?

রোবটটা ঢং করে বলল, আ-হা, বোঝে না যেন! নিজের রূপ দেখেই বলছি! এমন সুন্দর একটা রোবট তৈরি করতে পারবে কখনও ভেবেছিলে? এটা তোমার জীবনের সেরা কীর্তি।

কমলেশ এবার সত্যি-সত্যি হো-হো করে হেসে উঠল। সেরা কীর্তি! গত ছসাত মাস ধরে কমলেশের খুব টানাটানি চলছে। রোমি স্কুলে চাকরি করে। সেই আয় তো গেছেই, উপরন্তু নিজের চাকরিটাও ছেড়ে দিয়েছে কমলেশ।

এখন এটা-ওটা আবিষ্কার করে সেগুলো বিক্রি করে দিন চালাচ্ছে।

সুপারটয় করপোরেশন-এর সিনিয়ার ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ার ছিল কমলেশ। কিন্তু ওর মাথায় প্রতি ঘণ্টায়-ঘণ্টায় যেসব চমৎকার আবিষ্কারের আইডিয়া আসে তার জন্য কোম্পানি কোনওরকম টাকা ঢালতে রাজি নয়। ঝগড়াঝাঁটি অনেকদিন ধরেই চলছিল। রোমি রিঙ্কুকে নিয়ে চলে যাওয়ার পর কমলেশ কেমন দিশেহারা আর রগচটা হয়ে পড়েছিল। সেইসময়েই একদিন ম্যানেজিং ডিরেক্টরের সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয়। তখন কমলেশ বুকে আঙুল ঠুকে বলেছিল, সারাজীবন আপনার কোম্পানিতে চাকরি করার জন্যে আমার জন্ম হয়নি। এ-চাকরি আমি করব না। আমি বাড়িতে বসেই কাজ করব। একদিন আপনাকে এসে আমার জীবনের সেরা আবিষ্কার দেখিয়ে তাক লাগিয়ে দেব।

তা এই সেই তাক লাগানোর বস্তু! যেটার কোনদিক সোজা আর কোনদিক উলটো সেটাই ভালো করে বোঝা যাচ্ছে না!

কমলেশের চিন্তায় বাধা দিয়ে রোবটটা বলে উঠল, আস্তে, আস্তে! তুমি যে হাসির চোটে আমার কান ফাটিয়ে দিলে!

কমলেশ খানিকটা অবাক হয়ে জিগ্যেস করল, তোমার কান খুব সেনসিটিভ বুঝি?

হ্যাঁ। আমি সাবসনিক থেকে সুপারসনিক–সবরকম শব্দ শুনতে পাই। দ্যাখো না, তোমার ফ্ল্যাটের বাইরে সিঁড়ির কাছটায় একটা বেড়াল ঘুরঘুর করছে, আমি তার পায়ের ধুপধুপ আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি।

কমলেশের কী যেন হল। ও একছুটে শোওয়ার ঘর পেরিয়ে ঢুকে পড়ল একফালি ড্রইংরুমে। ড্রইংরুমের নানা জায়গায় কমলেশের নানা আবিষ্কারের চেষ্টার ধ্বংসাবশেষ পড়ে আছে। এ ছাড়া মোটর, ট্রান্সফর্মার, পিসিবি, লোহার টুকরো, কাঠের ফ্রেম, আরও কত কী! সেগুলো ডিঙিয়ে পাশ কাটিয়ে ফ্ল্যাটের দরজা খুলতেই দেখল, একটা হুলো বেড়াল লেজ উঁচিয়ে ওর দিকে সবুজ চোখে জুলজুল করে তাকিয়ে আছে।

কমলেশ সদর দরজা বন্ধ করে ফিরে এল রোবটটার কাছে। সে তখন গুনগুন করে তোমার মুখটা কী সুন্দর, আমি বলবই বলব গানটা গাইছে, আর গালে-কপালে আঙুল ঘষে মেকাপে পালিশ দিচ্ছে।

কমলেশের গোল-গোল চোখের দিকে তাকিয়ে রোবটটা বলল, কী মশাই, এবারে বিশ্বাস হল তো!

কমলেশ কোনও উত্তর দিতে পারল না। কে জানে, মদের নেশার ঘোরে কমলেশের অবচেতন বিজ্ঞান প্রতিভা কোন-কোন আশ্চর্য গুণ আর কোন-কোন জটিল প্রোগ্রাম গুঁজে দিয়েছে এই যন্ত্রদাসের মধ্যে!

রোবটটা এবার ঘুরে দাঁড়াল কমলেশের দিকে। ধাতব শব্দ তুলে দু-পা এগিয়ে এসে বলল, আমাকে তুমি সুন্দরী বলে ডেকো। অনেক ভেবে দেখলাম, নামের সঙ্গে মিল থাকাটাই ভালো। নইলে কানা ছেলের নাম পদ্মলোচনের মতো দশা হবে।

কমলেশ সুন্দরীকে দেখছিল।

টিন-লোহা-নাটবল্টু সারাটা শরীর জুড়ে দাঁতখিঁচিয়ে আছে। চোখজোড়া একেবারে বেমানান। কান দুটোও তাই। মাথা প্রায় ন্যাড়া। শুধু পিছনদিকটায় একগোছা পরচুলা। রোমির বাতিল করে দেওয়া নকল কেশরাশি। হাত-পায়ের আঙুলগুলো বেঢপ মাপের। হাঁটু আর কনুইয়ের জোড় কাজের চেয়ে শব্দ করে বেশি। আর এখানে-ওখানে কিছু বৈদ্যুতিক তার চোখে পড়ছে।

শুধু পরচুলাটুকু ছাড়া সুন্দরীর জেন্ডার কনফার্ম করার আর কোনও উপকরণ নেই। ওটা কি কমলেশই নেশার ঘোরে কাল রাতে জুড়ে দিয়েছে? কে জানে! কমলেশের মনে নেই। গত কয়েকমাসে ওর অবচেতন মনের যা হাল হয়েছে তাতে ওটাকে দিব্যি অপারেশন করে বাদ দিয়ে দেওয়া যায়!

কমলেশ সুন্দরীর খুব কাছে এগিয়ে গেল। আর তক্ষুনি রোবটটা এক পা পিছিয়ে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, অ্যাই, কী হচ্ছে! হুট করে কে কখন দেখে ফেলবে। প্লিজ, কমলেশ–

কমলেশ স্তম্ভিত হয়ে গেল। শয়তান মেশিনটা বলে কী! ওর মাথার দপদপানিটা হঠাৎ সাত ডিগ্রি বেড়ে গেল। মাথার ওপরে ঢিমে তালে ফ্যান ঘুরছে, আর ফ্যানের সঙ্গে তালে-তালে লাল নীল-হলদে বাতি জ্বলছে কমলেশের সায়েন্টিফিক মডিফিকেশান। সেই পাখার হাওয়া কমলেশের মাথায় লাগছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও ওর মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল। এসব স্বপ্ন, না সত্যি! কমলেশ জেনুইন জেগে আছে তো!

সামনের রংচটা দেওয়ালে ক্যালেন্ডারের পাতা উড়ছে। ১৯৯৪ সাল। কোনও ভুল নেই। বড় মাপের জানলা দিয়ে সূর্যের আলো ঢুকে পড়েছে ঘরে। পাশের বাড়ির টিভি অ্যান্টেনা দেখা যাচ্ছে। তার মাথায় বাংলাদেশ-টিভি প্রোগ্রাম দেখার জন্য মাছের কাঁটার মতো ছোট অ্যান্টেনা। তাতে একজোড়া পাতিকাক বসে আছে।

কোনওটাই স্বপ্ন নয়। ঘোর বাস্তব।

এমনকী ডানদিকের দেওয়ালে টাঙানো কমলেশ, রোমি আর রিঙ্কুর রঙিন ফটোটাও যে সত্যি!

কমলেশ তাকাল সুন্দরীর চোখে।

সে তখনও বলছে, না, কমলেশ, না–এখন না। তুমি নিজেকে একটু কন্ট্রোল করো, লক্ষ্মীটি।

কমলেশ আর সহ্য করতে পারল না। একেবারে খেঁকিয়ে উঠল, কীসব আবোলতাবোল বকচ্ছ!

না গো, তোমার চোখ দেখেই আমি সব বুঝতে পেরেছি। তোমার আর কী দোষ বলো। সব দোষ আমার। আমার রূপই আমার কাল হয়েছে।

কমলেশ বোধহয় মাথার চুল ছিঁড়তে যাচ্ছিল, এমন সময় দরজায় কলিংবেল বেজে উঠল। ঠিক আড়াইবার। দুটো লম্বা টোন, আর তারপরই একটা হাফটোন।

এরকম বিশেষ স্টাইলে কলিংবেলে সুর তোলেন একমাত্র গুরুপদবাবু। গুরুপদ সরকার। এ ফ্ল্যাটবাড়ির বাড়িওয়ালা। একেবারে ওপরতলার ফ্ল্যাটে থাকেন।

সুন্দরীর দিকে কটমট করে একবার দেখল কমলেশ। তারপর চটপটে পায়ে এগিয়ে গেল দরজার দিকে।

দরজা খুলতেই তাঁকে দেখা গেল।

দশাসই চেহারা। পরনে পাজামা আর গেঞ্জি। হাতে কালচে রঙের শক্তপোক্ত পাচালো লাঠি। মাথার চুল সাদা। দু-ভুরু আর দুকানে যেন একখাবলা করে গ্লাসউল বসানো। মুখের চামড়ায় অনেক ভাজ। চোখ কুতকুতে। কানে একটু কম শোনেন। স্ত্রী গত হয়েছেন অন্তত একযুগ। তবে যাওয়ার আগে অকালকুষ্মাণ্ড একটি পুত্র রেখে গেছেন। গত পাঁচবছর ধরে ভদ্রলোকের একমাত্র খাদ্য বোধহয় চ্যবনপ্রাশ। কারণ, পরিচিত সকলকেই তিনি নিয়মিত এই বস্তুটি সেবনের উপদেশ দেন।

কমলেশকে দেখেই গুরুপদবাবু চেঁচিয়ে বললেন, বাবা কমলেশ, তোমার ভাড়াটা

কমলেশ একটু অবাক হয়ে বলল, এখন তো সবে বিশ তারিখ…।

গুরুপদ সরকার হেসে বললেন, না বাবা, আমি গতমাসের ভাড়াটার কথা বলছি। তুমি যে চেক দিয়েছিলে সেটা বাউন্স করেছে। এই ভাড়া কালেকশান যে কী ঝামেলার! নেহাত ছেলেটা অপোগণ্ড, তাই আমাকেই কালেকশানে বেরোতে হয়।

আমার চেক বাউন্স করেছে? কমলেশ বেশ অবাক হল যেন।

হ্যাঁ বাবা, তুমি যখনই চেক দাও তখনই বাউন্স করে, বারবার বাউন্স করে। কেন বলো তো?

বোধহয় রবারের তৈরি তাই। একটু থেমে আবার বলল, তা ছাড়া ব্যাঙ্ক ব্যালেন্সের ব্যাপারটা সবসময় আমার খেয়াল থাকে না।

শুধু ব্যাঙ্কে কেন, ব্যালেন্স বোধহয় কোথাও ঠিক নেই কমলেশের। সামান্য এই ষোলোশো টাকা মাসে-মাসে দিতে বেশ অসুবিধে হচ্ছে ওর। যখনই কোনও আবিষ্কার বিক্রি করতে পারে তখনই রাজার জীবনযাত্রা শুরু করে দেয়। মনপ্রাণ ঢেলে নেশা করে। এমনকী লাগামছাড়া দাম দিয়ে ভ্যাট সিক্সটিনাইন কিংবা জনি ওয়াকার কিনে ফ্যালে। কিন্তু এখন এই ভদ্রলোককে ঠেকানো যায় কী করে? আচ্ছা, রোবটটা এঁকে বেচে দেওয়ার চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে।

মেসোমশাই, কিছু মনে করবেন না, ভুল হয়ে গেছে। আমি আপনার ছেলের মতো।

না! গুরুপদ সরকার চেঁচিয়ে বললেন, তুমি আমার ছেলের চেয়ে অনেক ভালো। ও ব্যাটা একটা–।

সন্তান সম্পর্কে নামাবলী শুরু হওয়ার আগেই বাধা দিল কমলেশ, কতক্ষণ বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবেন? আসুন, ভেতরে আসুন, আপনাকে একটা নতুন জিনিস দেখাব। একটু সাবধানে আসবেন।

কমলেশকে অনুসরণ করে ফ্ল্যাটের ভেতরে ঢুকে পড়লেন বৃদ্ধ।

শোওয়ার ঘরে ঢুকেই গুরুপদবাবুর নাক কুঁচকে গেল। আমতা-আমতা করে জিগ্যেস করলেন, কীসের একটা গন্ধ পাচ্ছি।

চকিতে কমলেশের চোখ চলে গেল টেবিলে রাখা মদের বোতলের দিকে। একটু আগেই যিনি বলেছেন, তুমি আমার ছেলের চেয়ে অনেক ভালোে তাঁকে এখন কী বলবে কমলেশ!

সুন্দরী বোধহয় কমলেশকে লক্ষ করছিল। ফস করে বলে উঠল, ও কিছু নয়, ওষুধের গন্ধ। আপনার তো দেখছি ঘ্রাণশক্তি বেশ প্রবল।

সুন্দরীর আচমকা কণ্ঠস্বরে রীতিমতো আঁতকে উঠলেন গুরুপদ সরকার। হাতের লাঠিটা দুবার ঠুকলেন মেঝেতে। তারপর কাছে গিয়ে ভালো করে দেখতে লাগলেন সুন্দরীকে। ওঁর মুখচোখের ভাব দেখে মনে হল না তেমন একটা খুশি হয়েছেন।

আপনি এই রোবটটা নিয়ে নিন, মেসোমশাই। কাজে লাগবে। বদলে শুধু আমার চারমাসের ভাড়া ইয়ে করে দেবেন।

সঙ্গে-সঙ্গে মাথা নাড়লেন গুরুপদবাবু? না, বাবা, ওসব ইয়েটিয়ের মধ্যে আমি নেই। আমি বরং ও-সপ্তাহে তোমার কাছে আসব।

সুন্দরীর মুখ দিয়ে হুঃ গোছের একটা তাচ্ছিল্যের শব্দ বেরিয়ে এল। তারপর কী একটা বলতে যাচ্ছিল, কমলেশ গুরুপদবাবুর নজরের আড়ালে হাতজোড় করে অনুনয়ের ভঙ্গি করল। সুন্দরী চাপা গলায় বলল, এবারের মতো ছেড়ে দিলাম।

ছন্নছাড়া ঘরটার চারপাশে চোখ বুলিয়ে গুরুপদবাবু জিগ্যেস করলেন, তোমার ওয়াইফের ট্রেনিং এখনও শেষ হয়নি?

ট্রেনিং? কমলেশ কেমন বিভ্রান্ত হয়ে গেল। তারপরই ওর মনে পড়ল, রোমি ওকে ছেড়ে চলে যাওয়ার পর কমলেশ এই ট্রেনিং-এর গল্পটা তৈরি করেছিল। যারাই ভুরু ওপরে তুলেছে তাদেরই বলেছে, রোমিকে ওর স্কুল থেকে একটা স্পেশাল ট্রেনিং-এর জন্য বাঁকুড়া পাঠিয়েছে। কিন্তু প্রায় আটমাস হয়ে গেল, ট্রেনিংটা এখনও শেষ করতে পারছে না কমলেশ।

ও মিনমিন করে বলল, না, মেসোমশাই, এখনও তো শেষ হয়নি দেখছি…।

এরকম লম্বা ট্রেনিং-এ ভরতি করলে কেন বউমাকে? একবার শুরু হলে আর শেষ হতে চায় না–।

কমলেশের ফ্ল্যাট ছেড়ে বেরোনোর সময় বৃদ্ধ বিড়বিড় করে অনেকটা যেন আপনমনেই বলে উঠলেন, মেয়েসমেত এ বড় অদ্ভুত ট্রেনিং!

দরজা বন্ধ করে শোওয়ার ঘরে ফিরে এল কমলেশ। সত্যি, এ বড় অদ্ভুত ট্রেনিং! স্বামীকে ছেড়ে থাকার প্রশিক্ষণ, বাবাকে ছেড়ে থাকার প্রশিক্ষণ–আর সেইসঙ্গে কমলেশেরও বউ-মেয়েকে ছেড়ে নির্জন বসবাসের প্রশিক্ষণ।

কিন্তু এখনও কমলেশ যে এই নতুন ব্যাপারটাতে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারল না! দেওয়ালে ছবিটার দিকে চোখ গেল ওর। রোমির ছবির দিকে তাকালেই ওর বুকের ভেতরটা হু-হু করে ওঠে এখনও। আর রিঙ্কু! ও যে সবচেয়ে বেশি মিষ্টি।

রোমি-রিঙ্কুর ট্রেনিং ধীরে-ধীরে শেষ হয়ে আসছে। তারপর…তারপর ফেরার আর পথ থাকবে না। ছবি থেকে চোখ সরিয়ে নিল কমলেশ। বিছানায় বসে ভাবতে লাগল।

আজ বোধহয় মঙ্গলবার। আজই কিশোর আহুজার আসার কথা। বিশাল চেহারার এই ব্যবসায়ী ভদ্রলোক বেশি বয়েসে বিপত্নীক হয়েছেন। ছেলেমেয়ে নেই কিন্তু অঢেল টাকা আছে। তাঁর খুব শখ একটা প্রমাণ মাপের মেয়ে পুতুলের। পুতুলটায় কলকবজা তেমন একটা না থাকলেও চলবে, তবে বডিটা পাঁউরুটির মতো নরম হওয়া চাই। কমলেশ বহুবার ভদ্রলোককে ফিরিয়ে দিয়েছে। বলেছে, এরকম খেলনা আমি তৈরি করি না। কিন্তু আহুজা নাছোড়বান্দা। বারবার শুধু বলেন, আপনি রিফিউজ করলে আমার জিন্দেগিটা একদোম বরবাদ হয়ে যাবে, সায়েন্টিসবাবু। আমি যে কী লোনলি সে আপনাকে আর কী বলব! ভেরি-ভেরি লোনলি–মনে হোয় কি চারপাশে কুছু নাই–সির বিরানি আর তনহাই…।

কমলেশের হাসি পেয়েছিল। যার চারপাশে কুছু নাই, একটা খেলার পুতুল ধরে দিলেই তার কিছু নাই মিছে হয়ে যাবে! আজ যদি কিশোর আহুজা আসেন তা হলে স্পষ্ট দুকথা শুনিয়ে দেবে কমলেশ।

ঠিক এমনসময় টেলিফোনটা বেজে উঠল।

মদের বোতল আর গেলাসের পাশেই টেলিফোন। কমলেশ টেলিফোন ধরতে উঠে দাঁড়াল। কার ফোন হতে পারে? সুপারটয় করপোরেশন-এর এম. ডি.? কমলেশকে আবার চাকরিতে জয়েন করার জন্য সাধাসাধি করতে চাইছেন? উঁহু, কমলেশ কিছুতেই রাজি হবে না। আবিষ্কারের স্বাধীনতা বলে একটা ব্যাপার আছে।

সুন্দরী যথারীতি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের রূপচর্চায় মশগুল। আপনমনে গুনগুন করে কী একটা গানের সুর ভাঁজছিল। ও ড্যাবড্যাবে চোখ দিয়ে কমলেশকে একবার দেখল। তার পর গুনগুন করা থামিয়ে বলল, ডার্লিং, যদি আমার ফোন হয় তা হলে বলে দিয়ে আমি বাড়ি নেই।

কমলেশ থমকে দাঁড়িয়ে হাঁ করে সুন্দরীকে দেখল। মাত্র কয়েকঘণ্টাতেই এই বকযন্ত্রটা ডার্লিং এ পৌঁছে গেছে! সত্যি, আজকের রাতটা ভালোয়-ভালোয় কাটলে হয়! শোওয়ার আগে এটার সুইচ অফ করতে ভুলে গেলে চলবে না।

ও কাটাকাটা সুরে বলল, তোমাকে আবার কে ফোন করতে যাবে! তুমি যে আমার ফ্ল্যাটে জন্ম নিয়েছ তাই-ই তো কেউ জানে না!

সুন্দরী প্রায় মুখঝামটা দিয়ে কমলেশকে দাবড়ে দিল :! তুমি ওই আনন্দেই থাকো। আজকালকার জোয়ান ছোঁড়াগুলোকে কিছু বিশ্বাস নেই। ওরা রূপের গন্ধ পায়।

কথা শেষ করেই আবার গুনগুন, আবার প্রতিবিম্বের সামনে দাঁড়িয়ে রূপচর্চা।

 কমলেশের ইচ্ছে হল টেনে-টেনে নিজের মাথার চুলগুলো ছিঁড়ে ফ্যালে।

কিন্তু টেলিফোন তখনও বাজছিল।

ও তাড়াতাড়ি রিসিভার তুলে নিয়ে গম্ভীর গলায় বলল, হ্যালো।

সুপারটয় করপোরেশন-এর এম. ডি. নয়, ওপাশ থেকে রোমির তীব্র কণ্ঠস্বর ভেসে এল? আজকাল কি কানেও কম শুনছ নাকি?

রোমি, রোমি…কমলেশের মাথা ঝিমঝিম ভাবটা পলকে কেটে গেল। গলার ভেতরে সুপুরির একটা কুচি আটকে গেছে বলে মনে হল।

শোনো, কাল সন্ধেবেলা সাতটা-সাড়ে সাতটা নাগাদ আমি যাব। তুমি ঘরে থেকো। ফ্ল্যাটে তালা দিয়ে হুট করে কোথাও চলে যেয়ো না।

না, না, থাকব। একটু থেমে তারপর, রিঙ্কুকে নিয়ে আসবে তো?

রোমি ঠান্ডা গলায় বলল, ওর সামনে পরীক্ষা। আজেবাজে সময় নষ্ট করলে পড়ার ক্ষতি হবে।

এক-দেড়ঘণ্টার জন্যে এলে কী আর এমন ক্ষতি হত! অনেকদিন ওকে দেখিনি। খুব দেখতে ইচ্ছে করছে, বিশ্বাস করো।

দেখি, পরীক্ষার পর যদি একদিন নিয়ে যেতে পারি।

কমলেশ মনে-মনে রিঙ্কুর মুখটা ভাবল। ও যদি আসত তা হলে কমলেশ আইসক্রিম, ক্যাডবেরি চকোলেট, ঘুগনি, ফুচকা–আরও কত কী নিয়ে আসত কে জানে! এগুলো সবই রিঙ্কুর ফেবারিট ডিশ।

কমলেশ বলল, কাল সন্ধেবেলা তোমার জন্যে ফুরিজ-এর চিকেন প্যাটিস আর থার্স আপ এনে রাখব।

এগুলো রোমির ফেবারিট, কমলেশ জানে। ফুরিজ-এ ওরা একবারই খেতে গিয়েছিল। তবে কমলেশ মাঝেমধ্যে চিকেন প্যাটিস কিনে নিয়ে আসত।

রোমি তাড়াতাড়ি বলে উঠল, না, না, ওসব ঝামেলা করতে যেয়ো না। আমি তো যাব আর কয়েকটা শাড়ি-জামাকাপড়, ব্যাঙ্কের চেকবই-পাশবই, আর মিক্সিটা নিয়েই চলে আসব। মনে আছে, কবছর আগে আমাদের অ্যানিভারসারিতে ওটা বড়দি আমাকে প্রেজেন্ট করেছিল?

মনে আছে। রোমির বড়দি জামশেদপুরে থাকে। স্বামী টাটার বিশাল অফিসার। এইট্টি নাইনে ওদের বিবাহবার্ষিকীর সময়ে ওরা কলকাতায় ছিল। তখনই মিক্সিটা প্রেজেন্ট করেছিল।

রোমি মিক্সি নিতে আসবে। পাশবই-চেকবই, আর শাড়ি-জামাকাপড় নিতে আসবে। মাঝেমাঝেই ও এরকম আসে। দরকারি জিনিসগুলো নিয়ে যায়। পাশবইটা জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট হলেও ওতে রোমিরই টাকা থাকত। আর মিক্সি দিয়ে কমলেশ এখন কী করবে! কিছুই আর মেশানোর নেই। বরং রিঙ্কু ম্যাংগো জুস খেতে খুব ভালোবাসত। রোমি নিয়ে গেলে মেয়েটা খুশি হবে।

রোমি…রোমি…।

রোমি ফোন নামিয়ে রাখতে যাচ্ছিল, একটু অধৈর্য হয়ে বলল, বলল, কী? আমার স্কুলের দেরি হয়ে যাচ্ছে।

কমলেশের পুরোনো কথা মনে পড়ছিল। ও প্রাণপণে ভুলতে চেষ্টা করছিল, কিন্তু পারছিল না।

কমলেশ থেমে-থেমে বলল, রোমি–আবার সবকিছু ঠিকঠাক করে নেওয়া যায় না? আগের মতো।

অন্য কোনও কথা থাকলে বলো।

তোমার পুরোনো দিনগুলোর কথা মনে পড়ে না?

পড়ে–তাতে কী?

তাতে কী! কমলেশ যেন পাথর হয়ে যাচ্ছিল। বিয়ের আগে রোমির সঙ্গে দু-বছরের দুরন্ত ভালোবাসা; মাঠ-ময়দান, ভিক্টোরিয়া, রেস্তোরাঁ, সিনেমা হল, বকখালি বেড়িয়ে আসা; পাগলের মতো চুমু খাওয়া, আদর করা–সব এখন তাতে কী!

একদিন শীতের পড়ন্ত বেলায় ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের পুকুরপাড়ে কাঠের বেঞ্চে বসে ছিল ওরা। সূর্য ঢলে পড়ছিল ডানদিকের আকাশে, আর সামনে শান্ত জলের আয়নায় শ্বেতপাথরের স্মৃতিসৌধটির ছায়া পড়েছিল। রোমির নরম চিকন হাতের পাতা কমলেশের হাতে ধরা ছিল। কমলেশ ওর কররেখা দেখতে-দেখতে বলেছিল, স্মৃতির ছায়া পড়েছিল শীতল জলতলে, প্রতিশ্রুতি আঁকা ছিল তোমার করতলে।

রোমি ওর হাতটা মুঠো করে আঁকড়ে ধরেছিল।

সেই প্রতিশ্রুতিও এখন তাতে কী হয়ে গেছে।

এর আগেও রোমি কয়েকবার ফোন করেছে, এই ফ্ল্যাটেও এসেছে কোনও না-কোনও দরকারে। কিন্তু তখন কমলেশের সংযম ছিল, আহত অভিমান ছিল, আর ভেবেছিল রোমি আবার নিজে থেকেই ফিরে আসবে। সেটা হয়নি।

ইদানীং কমলেশের কেমন যেন ফাঁকা-ফাঁকা লাগে। বুকের ভেতরটা কেমন করতে থাকে। এখনও করছিল।

রোমি, আমি যদি কোনও অন্যায় করে থাকি তা হলে।

কমলেশ, কী হচ্ছে! এসব বলে বোর কোরো না। যাকগে, তোমার ইনভেনশান আর ডিসকভারি কীরকম চলছে বলো।

কমলেশ সুন্দরীর দিকে একবার তাকাল।

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তখন সেজে চলেছে। পাউডার, ক্লিনজিং মিল্ক, ময়েশ্চারাইজার, পারফিউম–রোমির উপকরণ যা কিছু আছে একের পর এক মেখে চলেছে। আর ড্রয়ার থেকে রিঙ্কুর একটা লাল রঙের বো বের করে নিয়ে মাথার একখাবলা পরচুলায় আটকে দিয়েছে। এদিক ওদিক ঘাড় বেঁকিয়ে রোবটটা আয়নার নিজেকে দেখছে আর গুনগুন করে গাইছে, আমি তোমায় বড় ভালোবাসি, তোমায় বড় ভালোবাসি।

টেলিফোনে কথা বলতে গিয়ে কমলেশের গলা ভেঙে গেল। একটু কেশে গলা পরিষ্কার করে কয়েকবার টোক গিলে ও বলল, কালই একটা নতুন রোবট তৈরি করেছি। খুব সুন্দর দেখতে।

আমার চেয়েও? রোমি ঠাট্টার সুরে বলল।

তোমার চেয়ে সুন্দর আমার কাছে আর কেউ নেই, রোমি। কমলেশের গলা ধরে যাচ্ছিল।

ওরা রাস্তায় বেরোলে সবাই হাঁ করে রোমিকে দেখত–যেন তাজমহল দেখছে। অস্বাভাবিক কিছু নয়। রোমি যে আপাদমস্তক সুন্দর! কতজন যে ওকে সিনেমায় নামার অফার দিয়েছে তার কোনও হিসেব নেই। তবে ফিমের ব্যাপারে কমলেশের বরাবরই কেমন একটু অ্যালার্জি আছে। তাই রোমি উৎসাহ দেখালেও কমলেশ আপত্তি করেছে। রোমি বলেছে, তুমি চাও না, টিভি-সিনেমায় সবাই আমাকে দেখুক? সবাই জানুক তোমার বউ কত রূপসি! কমলেশ ওর ছেলেমানুষি গোঁয়ারতুমির সুরে বলেছে, না, চাই না। তোমার সুন্দরটুকু শুধু আমার জন্যে। সবাই তোমাকে ওভাবে দেখলে আমি হিংসেয় মরে যাব। আমার ডেথ সার্টিফিকেটে লেখা থাকবে, হিংসেয় আক্রান্ত হয়ে বিনা চিকিৎসায় মারা গেছে। কথাটা বলে কমলেশ হেসেছে। রোমিও হেসেছে। কিন্তু সেটাই ছিল বোধহয় শুরু। তারপর একই কথা অনেকবার উঠেছে। ধীরে-ধীরে সুর কেটে গেছে। আর তখনই সুতপন এসেছে রোমির কাছাকাছি।

টেলিফোনের ও-প্রান্তে রোমি হাসল, বলল, তবে যে বললে খুব সুন্দর দেখতে!

কমলেশ নিজেকে সামলে নিতে একটু সময় নিল। তারপর বলল, না, না, রোবটটা নিজেই নিজেকে বিশ্বসুন্দরী খেতাব দিয়ে বসে আছে–তাই ও কথা বলেছি।

তা হলে আর কী, বিউটি কনটেস্টে নামিয়ে দাও। হাসল রোমি।

কমলেশ যেন হঠাৎ পুরোনো হাসির ছোঁয়া খুঁজে পেল। কিন্তু তাতে কী!

কাল সন্ধেবেলা যাচ্ছি তা হলে। বলে লাইন কেটে দিল রোমি।

কমলেশ রিসিভার নামিয়ে রাখামাত্রই সুন্দরী বলে উঠল, কী, বাবুর প্রেমালাপ শেষ হল?

কোনও উত্তর না দিয়ে কমলেশ বিছানায় গিয়ে বসে পড়ল। সামনের ঝুলবারান্দার মেঝেতে রোদ নেমে এসে শুয়ে পড়েছে। আগেকার সময় হলে বারান্দার রেলিঙে এখন রোমির ভিজে শাড়ি শুকোত।

কমলেশের মাথার দপদপানিটা বেশ কয়েক ধাপ চাড়া দিয়েছে। একইসঙ্গে মাথার ভেতরে অসংখ্য স্মৃতিকোষে পুরোনো দিনের জলছবিগুলো এলোমেলো ছুটোছুটি করে বেড়াচ্ছিল।

কমলেশ, আমার কথায় দুঃখ পেলে?

কমলেশ মাথা তুলে আয়নার দিকে দেখল। আমুল স্প্রে-র ভাঙা টিন ইত্যাদি এখন ওর দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। একটু আগের কথাটা বলার সময় গলার ধাতব স্বর যথেষ্ট মোলায়েম করার চেষ্টা করেছে।

না, কমলেশ মোটেই দুঃখ পায়নি। একটা হতকুচ্ছিত যন্ত্রের মন্তব্যে কে-ই বা দুঃখ পায়! তা ছাড়া কমলেশের এখন কোনওদিকে মন ছিল না। শুধু ভাবছিল, কাল রোমি এলে ওকে কী বলবে। নিজেকে কি বড় বেশি ভিখারি মনে হচ্ছে?

কমলেশ উঠে আয়নার কাছে যেতে চাইল। রোবটটা ওর পথ আগলে দাঁড়িয়ে। এটাকে বিকল করে ভেঙেচুরে শেষ করে দিলেই ল্যাঠা চুকে যায়। কিন্তু কাল রোমি যে এটা দেখবে। কমলেশের নতুন আবিষ্কার।

কমলেশ সুন্দরীকে পাশ কাটিয়ে আয়নার দিকে এগোনোর চেষ্টা করতেই রোবটটা আগের মতো ঢং করে আঁতকে উঠে খানিকটা সরে গিয়ে বলল, আবার দুষ্টুমি! না, কমলেশ, না প্লিজ, ওসব আমার ভালো লাগে না। ওঃ, রূপই হয়েছে আমার যত জ্বালা!

কমলেশ কী করবে ভেবে পেল না। শুধু বিরক্তভাবে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ভয় নেই, তোমার সঙ্গে ফুলশয্যা করার কোনও বাসনা আমার নেই।

কামনা-বাসনাই তো মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু। দীর্ঘশ্বাস ফেলল সুন্দরী।

হায় রে আবিষ্কার! কমলেশ আসলে নেশার ঘোরে নিজের জন্য একটি বাঁশ আবিষ্কার করেছে।

তখনই কমলেশ টের পেল, বেশ খিদে পেয়েছে। ও দেওয়ালে টাঙানো ডিজিটাল ঘড়ির দিকে তাকাল। লাল-হলদে-সবুজ এল. ই. ডি. বাতি জ্বলজ্বল করে জানান দিচ্ছে এখন প্রায় পৌনে এগারোটা। ছুটির মা কখন আসবে?

কমলেশের ভালো লাগছিল না। ও রাস্তায় বেরোনোর জন্য তৈরি হতে লাগল। শেভ করে, জামা-প্যান্ট পরে নিয়ে যখন আয়নার সামনে চুল আঁচড়াতে যাচ্ছে, তখন ও খেয়াল করল, সুন্দরী বেশ মনোযোগ দিয়ে ওর প্রতিটি কাজ লক্ষ করছে।

কমলেশের কেমন যেন অস্বস্তি হল। ও নেহাত কথা বলার জন্যই বলল, আমি একটু বেরোচ্ছি। তুমি ফ্ল্যাটে একা থাকতে যেন ভয় পেয়ো না। এখুনি অবশ্য ছুটির মা এসে পড়বে।

সুন্দরীর চোখে আলো জ্বলছিল। ও বলল, তাড়াতাড়ি ফিরে এসো, বেশি দেরি কোরো না যেন।

সুন্দরীর কথার মধ্যে এমন একটা আপন ভাব ছিল যে, কমলেশ চুল আঁচড়াতে- আঁচড়াতে থেমে গেল। রোবটটাকে দেখল। ওটা সত্যি-সত্যি লোহালক্কড়, আই. সি. চিপ আর তার-টার দিয়ে তৈরি তো!

কমলেশ আলতো গলায় বলল, তোমাকে সঙ্গে নিয়ে বেরোতে পারতাম, কিন্তু…।

না, না, দরকার নেই। সুন্দরী ঝটপট বলে উঠল, রাস্তায় বেরোলেই আবার ছেলে-বুড়োর দল আমার ওপর একেবারে হামলে পড়বে। রোবটটা আয়নায় দিকে এক পা এগিয়ে গেল : নাও, সরো, এবার একটু আয়নাটা দেখি।

কমলেশ আর দেরি করল না। ফ্ল্যাট ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল। ছুটির মা এলে কোনও অসুবিধে নেই। তার কাছে ফ্ল্যাটের ডুপ্লিকেট চাবি আছে।

একতলার সদর দরজা দিয়ে বেরোতেই গুরুপদবাবুর সঙ্গে দেখা। ফ্ল্যাটবাড়ির লাগোয়া বাগানের পাশে ভদ্রলোক ছোট-ছোট পায়ে ঘুরঘুর করছেন। বোধহয় রোদ পোয়াচ্ছেন। পরনে একই পোশাক এবং হাতে পাচালো লাঠি।

বাতাসে নতুন শীত শীত ভাব, আকাশ মেঘলা।

কমলেশ আকাশের দিকে একবার দেখল। তারপর বলতে হয় তাই বলল, মেসোমশাই, রোদ চড়া হলে আপনার বেশ আরাম লাগত।

গুরুপদ সরকার পায়চারি থামিয়ে কমলেশের খুব কাছে এসে ফোঁস করে শ্বাস ফেলে চেঁচিয়ে বললেন, হ্যাঁ, বাবা, জানি, রোজ ভাড়া পেলে আমার বেশ আরাম লাগত। কিন্তু তোমরাই তো ভাড়া বাকি ফেলে-ফেলে–

কমলেশের হঠাৎই খেয়াল হল, ভদ্রলোক কানে কম শোনেন। ও তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ঠিক আছে, মেসোমশাই, এ নিয়ে পরে কথা হবে এবং হনহন করে হাঁটা দিল। নাঃ, ভদ্রলোকের জন্য একটা ফার্স্ট ক্লাস হিয়ারিং এইড তৈরি করে দিতে হবে।

.

সবকিছু আবার যেন আগের মতো লাগছিল।

রান্নাঘরে কাপ-প্লেট-চামচের টুংটাং শব্দ। রোমি চা তৈরি করছে। কমলেশ কেমন একটা ঘোরের মধ্যে ছোট-ছোট শব্দগুলো শুনছিল। শব্দগুলো ওকে রান্নাঘরের দিকে টানছিল। কিন্তু সামনেই চেয়ারে সুতপন বসে আছে। তাই কমলেশ আবার এলোমেলো কথা শুরু করল ওর সঙ্গে।

তোমার নতুন টিভি সিরিয়ালের কাজ কেমন চলছে?

আচ্ছা, ঠিক কতদিন পর রোমির হাতে চা খাবে কমলেশ? ও মনে-মনে একটা হিসেব কষতে শুরু করল।

সুতপন বেশ উৎসাহ নিয়ে ওর সিরিয়ালের কথা বলতে লাগল। তেরোটা এপিসোডের মধ্যে চারটে এপিসোডের শুটিং শেষ। তারপর…।

রোমি ওদের চা নিয়ে শোওয়ার ঘরে এসে ঢুকল। ছোট টেবিল থেকে বোতল আর গেলাস আগেই সরিয়ে ফেলেছিল কমলেশ। সেটার ওপরেই চায়ের কাপ-প্লেট রাখল রোমি। টেবিলটা টেনে দিল কমলেশ আর সুতপনের মাঝে। তারপর আবার রান্নাঘরের দিকে গেল নিজের চায়ের কাপ নিয়ে আসতে।

একটু আগেই প্যাটিস খাওয়া শেষ হয়েছে। কমলেশ রোমির বারণ শোনেনি। বিকেলে বেরিয়ে ফ্লরিজ-এর প্যাটিস নিয়ে এসেছিল।

কথা বলতে বলতে সুতপন হাসছিল। বেশ সুন্দর চেহারা ছেলেটির। ও নিজেই তো সিরিয়ালে অভিনয় করতে পারে!

রোমি চা নিয়ে এসে বিছানায় বসল। কমলেশের কাছ থেকে একটু দূরে।

সুতপন চায়ের কাপে লম্বা চুমুক দিয়ে বলল, কমলেশদা, আপনার জন্যে একটা সারপ্রাইজ আছে।

কমলেশ কৌতূহলী চোখে সুতপনের দিকে তাকাল। সুতপন রোমিকে একবার দেখল। চোখে হাসল। তারপর বলল, এখনই যে-সিরিয়ালটার কথা আপনাকে বললাম, মানে, জীবনের সুখ দুঃখ, ওটাতে রোমি অভিনয় করছে–হিরোইন।

কমলেশ চা খাওয়া থামিয়ে রোমিকে দেখল। মুখে তৃপ্তি আর প্রচ্ছন্ন অহঙ্কার। রোমির সৌন্দর্য এবার সকলে দেখবে, তারিফ করবে। কমলেশের সেই কাল্পনিক ডেথ সার্টিফিকেটের কথা মনে পড়ল। তবে তার বেশি কিছু নয়।

রোমির কাছে কমলেশ নিতান্তই সাধারণ। একটু চটাচটি হলেই ও বলত, তুমি নেহাতই একটা সেকেলে ছাপোষা মানুষ–শুধু একটু বিজ্ঞান জানো।

শত চেষ্টা করেও কমলেশ রোমির ওই ডেফিনেশান পালটাতে পারেনি। আর নিজেকেও পালটাতে পারেনি। তবে ছোট্ট রিঙ্কু সবসময় ওকে আশা জোগাত। মনে হত, এই বুঝি সব আবার ঠিকঠাক হয়ে যাবে।

কী হল, তুমি কিছু বলছ না যে!

রোমির কথায় সামান্য অবজ্ঞার রেশ যেন টের পেল কমলেশ। ওর পরনের গোলাপি সাদা সিল্কের শাড়ি চকচক করছে। বড় চোখে লাগছে।

কমলেশ স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে বলল, এ তো খুব ভালো খবর।

রোমি সুতপনের দিকে তাকিয়ে বলল, সুতপন, দ্যাখো না, এই সিরিয়ালটায় কমলেশের কোনও টেকনিক্যাল হেল্প নেওয়া যায় কি না।

আমি তো কমলেশদাকে ওপেন অফার দিয়েই রেখেছি।

কমলেশ বলল, না, না, আমি এখন নতুন একটা মেশিন নিয়ে কাজ শুরু করেছি। ওটার পেছনে তিন-চারমাস লেগে যাবে।

কমলেশ রোমির চোখে তাকিয়েই বুঝতে পারল, ওর মিছে কথা রোমির কাছে ধরা পড়ে গেছে।

রোমি সহজ গলায় বলল, কালই তো তুমি ফোনে বললে কী একটা বিউটি কুইন রোবট তৈরি করেছ।

সত্যি, কমলেশদা! সুতপনের গলায় আগ্রহ।

কমলেশের ভালো লাগল। ও চাইছিল, রোমিই সুন্দরীর প্রসঙ্গ তুলুক, কমলেশের নতুন আবিষ্কার নিয়ে প্রশ্ন করুক।

যাক, ব্যস্ত হওয়ার মতো একটা কাজ পাওয়া গেল। চায়ের কাপ রেখে কমলেশ উঠে এগিয়ে গেল আয়নার কাছে। খবরের কাগজে মুড়ে সুন্দরীকে মেঝেতে শুইয়ে রেখেছিল ও। কাগজের মোড়ক খুলে রোবটটাকে দাঁড় করাল। তারপর সুইচ অন করে দিয়ে বলল, এই হল আমার নিউ ইনভেনশান–।

সজ্ঞান হওয়ামাত্রই সুন্দরী আয়নার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ঘাড় বেঁকিয়ে সাজগোজ শুরু করল। আর সেইসঙ্গে গুনগুন করে গান ধরল, আমি রূপে তোমায় ভোলাব না, ভালোবাসায় ভোলাব।

প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই শুরু হয়ে গেল পাগলপারা হাসি। রোমি খিলখিল করে হাসতে শুরু করেছে। শরীর বেঁকিয়েচুরিয়ে মুখ তুলে হাসছে তো হাসছেই।

সুতপনও হাসছিল, তবে অতটা শব্দ করে নয়।

কমলেশ কেমন বোকার মতো সুন্দরীর পাশে দাঁড়িয়ে রইল।

রোমি হাসির দমক কমিয়ে চোখের জল মুছে বলল, এই তোমার বিউটি কুইন! তারপর আবার হাসি।

সুন্দরী ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল রোমির দিকে। তারপর বলল, কমলেশ, ওকে থামতে বলো। আমার কানে লাগছে।

রোমি অনেক কষ্টে থামল। বলল, সত্যি, কী সুন্দর! যেমন চেহারা, তেমনই গলা–কোনটা ছেড়ে কোনটা বলি!

কমলেশ বিছানার কাছে এগিয়ে এল। রোমি উঠে দাঁড়াল। সুতপনও।

রোমির যা-যা নেওয়ার সবকিছু আগেই বড় একটা শপিং ব্যাগে ঢুকিয়ে নিয়েছিল। ওকে উঠে দাঁড়াতে দেখেই সুতপন ঝুঁকে পড়ে ব্যাগটা হাতে তুলে নিল। হাসতে হাসতে বলল, কমলেশদা, আজ একটা দারুণ জিনিস দেখালেন। আপনার হাত খালি হলে আমাদের টেকনিক্যাল হেল্প করার ব্যাপারে একটু ভাববেন কিন্তু।

কমলেশ ঘাড় নাড়ল।

রোমি হেসে বলল, তোমার এই কিম্ভুতকিমাকার বস্তুটিকে বিউটি কনটেস্টে নামিয়ে দাও।

সুন্দরী জোরালো গলায় জবাব দিল, ধন্যবাদ, আমার কনফারমেশনের দরকার নেই। আমি

জানি আমাকে তোমার চেয়েও সুন্দর দেখতে কথা শেষ করেই আবার গুনগুন গান।

রোমির ফরসা মুখ লাল হল। ও কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, আমি যাচ্ছি। তুমি তা হলে লিভ টুগেদারের ভালোই সঙ্গী পেয়েছ।

কমলেশ চাইছিল না রোমি এত তাড়াতাড়ি চলে যাক। ও বলল, তুমি এই রোবটটার কথায় কিছু মনে কোরো না। এটা ভীষণ উলটোপালটা বকে। বড্ড খামখেয়ালি।

রোমি বিরক্তভাবে বলল, তবে তো একেবারে রাজযোটক!

রোমি দরজার দিকে এক-পা বাড়াতেই কমলেশ প্রায় পথ আগলে দাঁড়াল। মরিয়া হয়ে জিগ্যেস করল, রিঙ্কু কেমন আছে? ওকে অনেকদিন দেখিনি।

এখানকার চেয়ে অনেক ভালো আছে।

কমলেশ সুতপনের দিকে একবার দেখল। তারপর বলল, সুতপন, আমি রোমির সঙ্গে কয়েকটা পারসোনাল কথা বলতে চাই।

সুতপন ভদ্র ছেলে। রোমি কিছু বলার আগেই ও বলল, আমি বাইরের ঘরে আছি– তারপর সহজ পা ফেলে বেরিয়ে গেল শোওয়ার ঘর থেকে।

ঝুলবারান্দার দরজার দিকে চোখ গেল কমলেশের। বাইরের রাত কুচকুচে কালো। সেই কালো রাত নতুন শীতের হিমেল বাতাস পাঠিয়ে দিচ্ছিল ঘরের ভেতরে।

রোমি–।

বলো।

কী বলবে কমলেশ! নিজেকে ভীষণ খাটো মনে হচ্ছে। অথচ ও তো কোনও অন্যায় করেনি! এই অপদার্থ বেঁচে-থাকা তো সাধ করে বেছে নেয়নি!

রোমি, এভাবে আমি আর পারছি না। তোমার সব কথা আমি মেনে নেব, কিন্তু এভাবে আমাকে আর কষ্ট দিয়ো না..প্লিজ… কমলেশের কান্না পেয়ে যাচ্ছিল।

রোমি কোনও জবাব দিল না।

রোমি, তুমি…রিঙ্কু…তোমরা…হয় এখানে চলে এস, নয়তো আমাকে তোমাদের কাছে নিয়ে যাও। এভাবে আমি…আমি… কমলেশের গলায় বুকে কষ্ট হচ্ছিল।

রোমি এবার কথা বলল, এইজন্যেই তোমার সঙ্গে কোনওরকম রিলেশান রাখা প্রবলেম। আমাদের বনিবনা হয়নি, আলাদা আছি, ঠিক আছে। কিন্তু হ্যালো-হাই রিলেশান রাখতে তো কোনও ক্ষতি নেই! সেটা দেখছি তোমার এই বস্তপচা সেন্টিমেন্টের জন্যেই রাখা যাবে না। এমন ছেলেমানুষি করো না! এরপর থেকে দরকারি জিনিসপত্র যা কিছু নেওয়ার সুতপনই এসে নিয়ে যাবে।

কমলেশ পাথরের মতো হয়ে গেল। আর কী বলবে ভেবে পেল না। সেন্টিমেন্টের কোনও দাম নেই! সেটাও তাতে কী হয়ে গেছে! কমলেশের চোখের সামনে সবকিছু ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিল।

কমলেশ–।

রোমি নয়, সুন্দরী ওর নাম ধরে ডেকেছে। আয়না ছেড়ে এক-পা এগিয়েও এসেছে ওদের দিকে।

কাকে কী বলছ, কমলেশ! তোমার কথা ও বুঝবে না। ওর…ওর শুধু বাইরেটা সুন্দর। আমার সঙ্গে ওর কোনও তুলনাই হয় না। হোপলেস বেচারি হতভাগিনী।

আগুন জ্বলে গেল।

রোমি চিৎকার করে উঠল, তুমি যেমন, ঠিক সেরকম রোবটই তৈরি করেছ। এসব তোমার শয়তানি কারিকুরি। অভদ্র, ছোটলোক! আমাকে ডেকে এনে…।

রোমি, প্লিজ। রোমি– কমলেশ আকুলভাবে কিছু একটা বলতে চাইল।

 সুতপন হন্তদন্ত হয়ে এসে ঢুকল ঘরে।

রোমি ধারালো চোখে একবার সুন্দরীকে দেখল, তারপর সুতপনকে নিয়ে গটগট করে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। ফ্ল্যাটের দরজা খোলা এবং বন্ধ করার শব্দ এ-ঘর থেকেই স্পষ্ট শুনতে পেল কমলেশ।

অনেকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে শীতের হাওয়া অনুভব করল। তারপর রবারের পা নিয়ে বিছানায় গিয়ে বসল। ওর ভেতরে কিছু একটা হচ্ছিল। একটা বালিশ আঁকড়ে উপুড় হয়ে শুয়ে কমলেশ বোকার মতো হাউহাউ করে কাঁদতে লাগল।

আর সুন্দরী শুধু অবাক হয়ে কমলেশকে দেখছিল।

.

অনেক…অনেকক্ষণ পর কমলেশ যেন কারও ডাক শুনতে পেল। চোখ খুলতেই দেখল, ঘর অন্ধকার। কখন লোডশেডিং হয়েছে টের পায়নি। বারান্দার খোলা দরজা দিয়ে বাইরের রাত আবছাভাবে বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু আর কিছুই কমলেশ দেখতে পাচ্ছে না। শুধু অন্ধকার।

কমলেশ—

 খুব কাছ থেকে নরম গলায় সুন্দরী ওর নাম ধরে ডাকছে।

অন্ধকারে বাঁ-হাতের কাছটায় ধাতব ছোঁয়া টের পেল কমলেশ।

 সুন্দরী আবার ডাকল, কমলেশ–।

একটা সুন্দর গন্ধ কমলেশের নাকে এল। ও বড় করে শ্বাস নিল। হাত বাড়াতেই এবড়োখেবড়ো শীতল ধাতুর ছোঁয়া লাগল। কমলেশের হাত আলতো করে ছুঁয়ে যেতে লাগল রোবটটার শরীর। গন্ধটা যেন আরও তীব্র হয়েছে। কমলেশের নেশা ধরে যাচ্ছিল। ডানহাতটা সুন্দরীর বুকের কাছটায় যেতেই ছোট্ট দরজার নবটা টের পেল।

গন্ধটা কি ওর ভেতর থেকেই আসছে?

কমলেশের মাথা ঠিকঠাক কাজ করছিল না। চোখ জ্বালা করছিল, মাথা দপদপ করছিল।

 নব টেনে দরজাটা খুলে ফেলল কমলেশ।

মনে হল, গন্ধটা আরও বেড়ে গেছে। কমলেশকে নিশির মতো টানছে।

রোবটটাকে দুহাতে আঁকড়ে ধরে কোনওরকমে উঠে বসল কমলেশ। অনুমানে ভর করে মুখটা নিয়ে গেল খোলা দরজার খুব কাছে। বুক ভরে শ্বাস নিল। তারপর অন্ধকারের মধ্যেই চোখ মেলে সুন্দরীর ভেতরটা দেখতে চেষ্টা করল।

কমলেশ–।

দরজার ভেতরে মুখ ঢুকিয়ে দিয়ে আচ্ছন্ন কমলেশ নরম গলায় ডেকে উঠল, সুন্দরী–। তোমার ভেতরটা কী সুন্দর…!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *