ভালোবাসা ফুরিয়ে গেলে
চলমান ফুটপাথের ওপরে দাঁড়িয়ে ফানল্যান্ড-এর দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল স্নিগ্ধপ্রভাত। এই এলাকায় ফানল্যান্ড সাইবার ক্যাসিনোর জুড়ি নেই। ইন্টারনেটে হরেকরকম জুয়াখেলার ব্যবস্থা যেমন আছে, তেমনই আছে হালকা-চড়া নেশার ব্যাপক আয়োজন।
পকেট থেকে একটা লাভ মি টফি বের করে মুখে পুরে দিল স্নিগ্ধপ্রভাত। এই টফিটায় ঝিমঝিমে নেশা হয়। আসল নেশার আগে এটা গৌরচন্দ্রিকার কাজ করে। যার ফলে খুব অল্পদিনেই এই টফিটা বাজার মাত করে দিয়েছে।
লাভ মি-র দৌলতে স্নিগ্ধপ্রভাতের মুখের ভেতরটা ঠান্ডা আর মিষ্টি হয়ে গিয়েছিল। আর মাথার ভেতরটা হালকা উলের বলের মতো লাগছিল। ও মুখ তুলে আকাশের দিকে তাকাল।
আকাশে অনেকগুলো আলোর বিন্দু উল্কার মতো ছুটোছুটি করছিল। ওগুলো ফ্লোট্যাক্সি। হ্যালোজেন হেডলাইট জ্বেলে প্যাসেঞ্জার নিয়ে আকাশপথে ছুটে যাচ্ছে। হেডলাইটের আভা কালো আকাশে সোনার তরোয়াল বলে মনে হচ্ছিল।
সোনা থেকেই স্বর্ণদ্যুতির কথা মনে পড়ে গেল। স্বর্ণদা। কতদিন স্বর্ণার সঙ্গে দেখা নেই! প্রায় পাঁচবছর। কিন্তু ইদানীং রোজই কোনও-না-কোনও ছলছুতোয় স্বর্ণদ্যুতির কথা স্নিগ্ধপ্রভাতের মনে পড়ে যায়। বছর ছ-সাত আগে ওই মাতাল মানুষটা যা-যা বলেছিল সেগুলো কোন এক অলৌকিক প্রক্রিয়ায় স্নিগ্ধপ্রভাতের জীবনে সত্যি হতে শুরু করেছে।
সেসময়ে স্নিগ্ধপ্রভাত বি-ইলেভেন সিটিতে ছিল। মনের সুখে চাকরি করত আর জীবনটাকে দু-হাতে লোফালুফি করত। সন্ধে হলেই সাইবার ক্যাসিনো। নেশার ট্যাবলেট, মদ, ইন্টারনেট জুয়া, আর হলোগ্রাম-স্ট্রিপটিজ।
বেশ কাটছিল দিনগুলো। এখন সেইসব দিনের কথা মনে পড়লেই ডানা ঝাপটাতে ইচ্ছে করে। কিন্তু ওই ইচ্ছে পর্যন্তই। এখন স্নিগ্ধপ্রভাতের ডানা ভারী হয়ে গেছে।
স্বর্ণদ্যুতি ওর চেয়ে অন্তত দশবছরের বড়। কিন্তু সাইবার ক্যাসিনোর আলাপ হওয়ার পরই কেমন করে যেন আলাপটা খুব তাড়াতাড়ি ঘনিষ্ঠতার দিকে বাঁক নিয়েছিল। স্বর্ণদ্যুতি রাতারাতি স্বর্ণদা হয়ে গিয়েছিল। লোকে বলে ক্যাসিনো-ট্যাসিনোয় আলাপ-টালাপ হলে নাকি এইরকমই হয়।
স্বর্ণদ্যুতিকে সবসময় কেমন মনমরা দেখাত। নেশা করতে করতে বিড়বিড় করে বলত, লাইফ ইজ বাট আ ওয়াকিং শ্যাডো…।
স্বর্ণদ্যুতি বিয়ে করেছে প্রায় পঁচিশ বছর। তাই নানারকম আবেগের উথালপাতাল বহুকাল আগেই শেষ হয়ে গেছে। এখন বোধহয় অবশেষটুকু আঁকড়ে ধরে ও বেঁচে আছে।
একঘেয়েমির হাত থেকে বাঁচতে স্বর্ণদ্যুতি জুয়াড়ি হয়েছে। আর স্নিগ্ধপ্রভাত চিরকাল একা থাকবে, স্বাধীন থাকবে, খামখেয়ালি জীবন কাটাবে–এই উদ্দাম ভাবনা থেকে জুয়ার নেশায় জড়িয়েছে।
স্বর্ণদ্যুতি প্রায়ই বলত, তোমাকে আমার ফ্ল্যাটে একদিন নিয়ে যাব। অথচ নিয়ে যেত না।
শহরের সবচেয়ে আকাঙ্ক্ষার এলাকায় স্বর্ণদ্যুতির ফ্ল্যাট। স্নিগ্ধপ্রভাতের সে-ফ্ল্যাট দেখার কৌতূহলও ছিল। সুতরাং ও অপেক্ষা করতে লাগল।
বেশ মনে পড়ে, একদিন একফেঁটা হুইস্কি কনসেনট্রেট খেয়ে স্বর্ণদ্যুতির বেশ টালমাটাল অবস্থা–তখন হঠাৎই ও স্নিগ্ধপ্রভাতের হাত ধরে টান মেরেছে চলো, আজ তোমাকে আমার ফ্ল্যাটে নিয়ে যাব। আজই সুবিধে…।
কীসের সুবিধে কে জানে! স্নিগ্ধপ্রভাত আর আপত্তি করেনি।
সাইবার ক্যাসিনো থেকে ওরা দুজনে বাইরে বেরিয়ে এসেছে।
পকেট থেকে ছোট্ট রিমোট কন্ট্রোল ইউনিট বের করে সিগন্যাল দিল স্বর্ণদ্যুতি। একটা ফ্লোট্যাক্সি কোথা থেকে এসে ঝুপ করে নেমে পড়ল ওদের পায়ের কাছে।
গাড়িতে উঠে স্বর্ণদ্যুতি ফ্ল্যাটের কো-অর্ডিনেট বলল। ফ্লোট্যাক্সিটা আবার ভেসে পড়ল আকাশে।
ফ্ল্যাটে ঢুকেই স্বর্ণদ্যুতি জড়ানো গলায় বলল, এই হল আমার ফ্ল্যাট।
স্নিগ্ধপ্রভাত মুগ্ধ হয়ে ফ্ল্যাটটা দেখছিল।
স্বর্ণদ্যুতি বড়লোক ও জানত–তবে এরকম জঘন্য বড়লোক সেটা আগে বুঝতে পারেনি।
স্বর্ণদ্যুতির এক ছেলে, এক মেয়ে। বয়েস বাইশ আর উনিশ। ওর কাছেই শুনেছিল ছেলেমেয়ে দুজনেই খুব চৌকশ। এখন ওরা পড়াশোনা করছে। তবে ভবিষ্যতের ভাবনা-চিন্তা ওরা আগেভাগেই সব ছকে রেখেছে।
সাইবার ক্যাসিনোয় বসে কম্পিউটারের পরদার দিকে আনমনে তাকিয়ে স্বর্ণদ্যুতি বলেছিল, বুঝলে, আমার ওয়াইফ রত্নমঞ্জুষা বলে ওরও একটা ফিউচার আছে। তেতো হাসল স্বর্ণদ্যুতি ও ওদের তিনজনেরই ফিউচার আছে। আমার নেই। আমার শুধু পাস্ট। এইভাবেই কোনদিন পাস্ট টেন্স হয়ে যাব। নাকি শালা এর মধ্যেই হয়ে গেছি!
চোখধাঁধানো ফ্ল্যাটের দরজায় দাঁড়িয়ে স্বর্ণদ্যুতির কথাগুলো ভাবছিল স্নিগ্ধপ্রভাত।
বসবার ঘরে ঢুকে স্বর্ণদ্যুতি বলল, এখন ওরা কেউ নেই। ওরা যার-যার দারুণ সব জরুরি কাজে বেরিয়েছে। সব পাখি রাতে ফ্ল্যাটে ফিরবে। সেইজন্যেই তোমাকে এ সময়ে নিয়ে এসেছি।
স্নিগ্ধপ্রভাত অবাক হলেও কিছু বলল না। ভাবছিল, আজ কি সাইবার-বার-এ বসে স্বর্ণদ্যুতি একটু বেশি খেয়ে ফেলেছে।
এবার তোমাকে একটা টপ সিক্রেট খবর দিই।
কী, স্বর্ণদা?
এই ফ্ল্যাটের ভেতরে আরও চারটে ফ্ল্যাট আছে।
মানে! স্নিগ্ধপ্রভাত অবাক হয়ে ফ্ল্যাটের চারপাশে তাকায়। অন্যান্য ঘরের দরজার দিকে দ্যাখে।
হ্যাঁ, চারটে ফ্ল্যাট।
স্নিগ্ধপ্রভাতের হাত ধরে টানতে টানতে একটা ঘরের দরজার কাছে নিয়ে যায় স্বর্ণদ্যুতি।
এ-ঘরটায় আমার ছেলে থাকে। এটা একটা ওয়ান রুম ফ্ল্যাট।
সামান্য ভুলভাল পা ফেলে স্বর্ণদ্যুতি আর-একটা ঘরের দরজার গিয়ে দাঁড়ায়। ঘরটার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলে, এ-ঘরটায় আমার মেয়ে থাকে। এটা একটা ওয়ান রুম ফ্ল্যাট।
তারপর স্বর্ণদ্যুতি এগিয়ে গেল সবচেয়ে বড় ঘরটার দিকে। মাতাল আঙুলে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে স্নিগ্ধপ্রভাতকেও টেনে নিয়ে চলল।
ঘরের দরজায় এসে কেমন করে যেন হাসল স্বর্ণদ্যুতি। ডাল বেড খাটের দিকে আঙুল তুলে জড়ানো ভাঙা গলায় বলল, ওই খাটটায় দুটো ওয়ান রুম ফ্ল্যাট আছে। রোজ রাতে দুটো ফ্ল্যাট চুপচাপ পাশাপাশি শুয়ে থাকে–আমি আর রত্নমঞ্জু।
স্নিগ্ধপ্রভাতকে টেনে এনে ড্রইংরুমের সোফায় বসাল স্বর্ণদ্যুতি। দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় ওর দীর্ঘ শরীরটা সামান্য এপাশ-ওপাশ দুলছিল।
ফ্ল্যাট বাড়ির ডিফারেন্ট ফ্ল্যাটের মধ্যে রিলেশানটা কেমন হয় জানো?
মোটামুটি জানলেও স্নিগ্ধপ্রভাত চুপ করে রইল। কারণ, স্বর্ণদ্যুতি এখন বলতে চাইছে– হয়তো নিজের সঙ্গেই কথা বলছে।
আমাদের মধ্যে রিলেশানটা এখন সেই জায়গায় পৌঁছে গেছে। আমরা যেন এক-একটা ফ্ল্যাট। পাশাপাশি আছি অথচ মাঝে মরুভূমির মতো বিস্তর ফাঁক। মানে, ধরো একটা মুক্তোর মালা– কিন্তু পাশাপাশি বসানো পাথরগুলোর ভেতর দিয়ে যে-সুতোটা যায়, সেটাই নেই। বাইরে থেকে দেখে কিন্তু এটা বোঝা যাবে না। মনে হবে মুক্তোর মালাটা ঠিকঠাকই আছে। তাই আমরা এখন ফ্ল্যাট…নাকি ত্রিশঙ্কু মুক্তো?..কে জানে!
শেষদিকটায় স্বর্ণদ্যুতির গলা আবেগে ধরে গিয়েছিল। তারপর আচমকা ও হাঁটুগেড়ে বসে পড়ল স্নিগ্ধপ্রভাতের পায়ের কাছে। ওর কোলে মাথা রেখে কান্না-জড়ানো গলায় বলতে লাগল, সব ভালোবাসা ফুরিয়ে গেছে রে, সব ভালোবাসা ফুরিয়ে গেছে…।
শেষদিকে ওর কথা জড়িয়ে গেল। স্নিগ্ধপ্রভাতকে আঁকড়ে ধরে ও বাচ্চা ছেলের মতো হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। ওকে কী বিপন্ন, কী অসহায় লাগছিল!
তারপর অনেকগুলো বছর কেটে গেছে।
ফুটপাথ ফানল্যান্ডের কাছে এসে পড়তেই নেমে পড়ল স্নিগ্ধপ্রভাত। কাচের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে নিজের সিটিজেন কোড বলার সঙ্গে-সঙ্গে দরজা খুলে গেল।
ফানল্যান্ডের ভেতরটা খুব ঠান্ডা আর চুপচাপ। শুধু হালকা মিউজিকের শব্দতরঙ্গ কোমলভাবে খেলে বেড়াচ্ছে।
সেন্টার স্টেজে হলোগ্রাম-স্ট্রিপটিজ চলছিল। দুটো মেয়ে অথবা মেয়ের ছায়া শরীর বেঁকিয়েচুরিয়ে এমনভাবে নাচছিল যেন ওরা রবারের তৈরি।
হলোগ্রাম-স্ট্রিপটিজের সুবিধে হচ্ছে উত্তেজিত দর্শক হামলে পড়ে নাচিয়েদের বিরক্ত করতে পারে না। ফলে হইচই গোলমালের কোনও ভয় নেই।
একটা টেবিলে বসে হুইস্কির অর্ডার দিল স্নিগ্ধপ্রভাত। আর তাতে প্রথম চুমুক দিতেই সুপর্ণলতিকার কথা মনে পড়ল।
সঙ্গে-সঙ্গে মুখটা কেমন বিস্বাদ ঠেকল।
স্বর্ণদ্যুতির সঙ্গে সুপর্ণলতিকার কোথায় যেন একটা যোগসূত্র রয়েছে।
গ্লাসে আবার চুমুক দিল স্নিগ্ধপ্রভাত।
ও যখন সুপর্ণলতিকাকে বিয়ে করে তখন স্বর্ণদ্যুতির সঙ্গে ওর কোনও যোগাযোগ ছিল না। মোটামুটি চুপচাপই বিয়েটা হয়ে গিয়েছিল। শহরের সেন্ট্রাল ডেটা ব্যাঙ্কে যখন ওদের বিয়ের রেজিস্ট্রেশানটা স্টোর হয় তখনই একটা নিয়ম ওদের বেঁধে ফ্যালে : অন্তত আট বছরের জন্যে ওদের স্বামী-স্ত্রী হিসেবে থাকতে হবে।
গত শতকে আকছার ডিভোর্সের ব্যাপারটা এত মারাত্মক হয়ে দাঁড়িয়েছিল যে, সরকার নতুন ম্যারেজ অ্যাক্ট চালু করতে বাধ্য হয়। সেসময়ে গড়ে এক-একজন নাগরিকের বিয়ের সংখ্যা ৩.৪ এ পৌঁছে গিয়েছিল। এত ডিভোর্স আর বিয়ের রেকর্ড রাখতে গিয়ে সরকারি দপ্তরের কাজের পরিমাণ যেমন বেড়েছিল, তেমনই বেড়েছিল হরেকরকম মামলা-মোকদ্দমা। এ ছাড়া সেন্ট্রাল ডেটা ব্যাঙ্কের মেমোরিও লাগছিল প্রচুর।
সুপর্ণলতিকাকে বিয়ে করার সময় আট বছরের নিয়মটা আটশো বছরের হলেও স্নিগ্ধপ্রভাতের কোনওরকম আপত্তি ছিল না। তীব্র ভালোবেসে ও সুপর্ণলতিকাকে বিয়ে করেছিল। ওকে ভালোবেসে স্নিগ্ধপ্রভাত বুঝতে পেরেছিল, এই ভয়ংকর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগেও ভালোবাসার ব্যাপারটা একইরকম রয়ে গেছে। এই প্রবল টানকে বিজ্ঞান এখনও ব্যাখ্যা করতে পারেনি।
কিন্তু তার পরের ঘটনাগুলোকেও স্নিগ্ধপ্রভাত ঠিক ব্যাখ্যা করতে পারেনি। বিয়ের দু-আড়াই বছর উদ্দাম মাতামাতির পর সবকিছু কেমন ধীরে-ধীরে বদলে গেল। বিকেল থেকে আকাশের রং পালটে ধীরে-ধীরে যেমন গোধূলি এবং সন্ধে হয়, ব্যাপারটা অনেকটা যেন সেইরকম।
তার পরের কয়েকটা বছরে একটা টাটকা ছটফটে মাছ ডিপ ফ্রিজের ভেতরে ঠান্ডা হিম হয়ে গেল। আর এখনও তাই।
কেন, কে জানে!
সুপর্ণলতিকা কি বড্ড বেশি কথা বলে? সবসময় কি ওর ঠোঁট নড়ে?
ঠোঁট। এই ঠোঁটের জন্য একদিন স্নিগ্ধপ্রভাতের ঠোঁট পাগল ছিল। কিন্তু দু-আড়াই বছরের মধ্যেই সে-পাগলামি স্তিমিত হয়ে গেছে। এখন ওর মনে হয় ধীরে-ধীরে ও আর সুপর্ণলতিকা দুটো ফ্ল্যাট হয়ে যাচ্ছে। রাতে সেই দুটো ফ্ল্যাট পাশাপাশি বিছানায় শুয়ে থাকে। যেমন করে শুয়ে থাকত স্বর্ণদ্যুতি আর রত্নমঞ্জু।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল স্নিগ্ধপ্রভাত।
নিভে যাওয়া সম্পর্ককে কি আবার দপ করে জ্বেলে দিতে পারে বিজ্ঞান? বোধহয় না। বিজ্ঞানের আবিষ্কার শরীরে আগুন ধরাতে পারে–মনে নয়।
একজন হলোগ্রাম-স্ট্রিপার নাচতে নাচতে স্টেজ থেকে নেমে এসেছিল। মেয়েটা যেমন খুশি টেবিল-চেয়ার-মানুষকে ভেদ করে নাচের ভঙ্গিতে যত্রতত্র ঘুরে বেড়াতে লাগল। একজন বেসামাল খদ্দের ওকে জাপটে ধরতে গিয়ে মেঝেতে মুখ থুবড়ে পড়ল।
মেয়েটা যখন সিগ্ধপ্রভাতকে ভেদ করে চলে গেল তখন ও যেন সামান্য উষ্ণতার ছোঁয়া পেল। মনটা ক্ষণিকের জন্য চনমনে হয়ে উঠল।
আবার দীর্ঘশ্বাস পড়ল। মনে হল জীবন কত ক্লান্তিকর, কত দীর্ঘ।
রাতে বাড়ি ফেরার সময় স্নিগ্ধপ্রভাত ভাবতে চেষ্টা করছিল ফানল্যান্ডটাই যেন ওর বাড়ি। সেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে ও সুপর্ণলতিকা নামে একটি মেয়ের সঙ্গে কিছুটা সময় কাটাতে যাচ্ছে। কিন্তু ভাবনাটা তেমন জমছিল না।
ফ্ল্যাটে ফিরে এসে ও সুপর্ণলতিকার মুখোমুখি হল।
সুপর্ণলতিকা কোনও কথা বলল না। ঠান্ডা চোখে স্বামীর দিকে একপলক তাকিয়ে পামটপ কম্পিউটারে সেলাইয়ের গ্রাফিক্স দেখতে লাগল।
স্নিগ্ধপ্রভাত স্ত্রীকে দেখছিল।
সেই একইরকম মনোরম সৌন্দর্য মাখানো মুখ। সময়ের কোনও ছাপ পড়েনি সেখানে। অথচ স্নিগ্ধপ্রভাত পলকের জন্যও কোনও টান অনুভব করল না।
ওর ভেতরে-ভেতরে কান্না পাচ্ছিল। রোজই এমন কান্না পায়।
একটা ঠান্ডা সম্পর্ককে আঁকড়ে ধরে জীবন কাটানো যায় না কিছুতেই। অথচ ও চেষ্টা করেও ভেতর থেকে কোনও উষ্ণতা খুঁজে পায় না। ওর ভালোবাসা নির্ঘাত মরে গেছে। আর সেই মৃত শিশুটিকে কোলে নিয়ে ও বোকার মতো বোতল থেকে দুধ খাওয়াতে চেষ্টা করছে।
স্নিগ্ধপ্রভাতের নিজেকে কেমন অপরাধী মনে হচ্ছিল। সুপর্ণলতিকার টান ও টের পায়। অথচ সেই টানের উত্তর দেওয়ার মতো ক্ষমতা ওর নেই।
জামাকাপড় ছেড়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল স্নিগ্ধপ্রভাত। ভাবতে চেষ্টা করল, ঠিক কবে থেকে ওরা ফ্ল্যাটে বদলে যেতে শুরু করেছে।
চোখ বুজে ডানহাত এলিয়ে দিল চোখের ওপরে।
ইশ, কোনও ম্যাজিশিয়ান যদি পারত ওর ফুরিয়ে যাওয়া ভালোবাসাকে ফিরিয়ে দিতে!
.
মাথার ভেতরে কেমন যেন দপদপ করছিল। কেউ যেন সেখানে পুঁচকে একটা হাতুড়ি নিয়ে ঠুকঠুক করে পেরেক ঠুকছিল। স্নিগ্ধপ্রভাতের মরে যেতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু কোথা থেকে যেন গোলাপের গন্ধ ওর নাকে এসে ঢুকছিল–এবং ওর বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করছিল।
দুটো ইচ্ছের লড়াই চলতে-চলতে ওর ঘুম ভেঙে গেল।
সম্পূর্ণ অচেনা একটা ঘরে অচেনা একটা বিছানায় জেগে উঠল স্নিগ্ধপ্রভাত।
অবাক চোখে ধড়মড়িয়ে উঠে বসতেই রক্তের মতো টুকটুকে লাল একগুচ্ছ গোলাপ ওর নজরে পড়ল। বিছানার পাশেই স্বচ্ছ টেবিলের ওপরে দাঁড়িয়ে স্বচ্ছ ফুলদানি। বোধহয় অ্যাক্রিলিকের তৈরি। ফুলদানির ওপরটা গোলাপের পাপড়িতে ঢাকা।
ওঃ..আপনার ঘুম ভেঙেছে!
গোলাপের দিক থেকে চোখ তুলল স্নিগ্ধপ্রভাত। চোখ পড়ল আর-এক গোলাপের দিকে।
সুন্দর লম্বাটে মুখ। ফরসা কপালে উজ্জ্বল টিপ। পরনে হালকা গোলাপি শাড়ি। পাতলা ঠোঁটে একচিলতে দুষ্টুমির হাসি। সেইসঙ্গে আবছা পারফিউমের ঘ্রাণ যেন টের পেল স্নিগ্ধপ্রভাত।
আমি কোথায়? প্রশ্নটা ওর নিজের কানেই কেমন বোকা-বোকা শোনাল।
কোথায় আবার! আমার ফ্ল্যাটে! কী সহজ স্বাভাবিক উত্তর দিল তরুণী!
আপনি কে?
খিলখিল করে হেসে উঠল। স্নিগ্ধপ্রভাতের শরীরের ভেতর দিয়ে ঝরনা বয়ে গেল।
আমার নাম অঙ্গলাবণি।
নামটা ঝংকার তুলল কানে। অনেক প্রশ্ন ভিড় করে এল ঠোঁটে। উচ্চারণ না করে স্নিগ্ধপ্রভাত সেইসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে লাগল অঙ্গলাবণির মুখে।
এখানে ও কেমন করে এল!
জটপাকানো স্মৃতি হাতড়ে এই রহস্যের উত্তর খুঁজতে চেষ্টা করল।
ঝাপসাভাবে যেটুকু ও মনে করতে পারল সেটা হল, কাল রাতে ও ফানল্যান্ডে ছিল। ছোট ছোট চুমুকে হুইস্কি খাচ্ছিল আর হলোগ্রাফিক ক্যাবারে দেখছিল। একটি রোগা মেয়ে সাপের মতো শরীরটা খেলিয়ে সিলিকোন-যৌবনের নগ্ন হাতছানি দিয়ে নাচছিল।
স্নিগ্ধপ্রভাত যখন পুরো বুঁদ হয়ে গেছে ঠিক তখনই একজন অচেনা লোক ওকে ডেকে নিয়ে গেছে ক্যাসিনোর বাইরে। বলেছে, কে একজন যেন একটা ইমার্জেন্সি খবর এনেছে মিগ্ধপ্রভাতের জন্য।
বাইরে বেরিয়ে একটা আলো-আঁধারি জায়গায় ওকে ডেকে নিয়ে গিয়ে লোকটা হঠাৎই স্নিগ্ধপ্রভাতের নাক লক্ষ্য করে ফুঁ দিয়েছে।
সঙ্গে-সঙ্গে একটা তীব্র কটু গন্ধ স্নিগ্ধপ্রভাতের নাকে ঢুকে গিয়েছিল। তারপর ওর আর কিছু মনে নেই।
আমি এখানে কেমন করে এলাম? অনেকক্ষণ পর ভেতরের প্রশ্নটা বাইরে বেরিয়ে এল।
রাস্তায় আপনি সেন্সলেস হয়ে পড়েছিলেন। আমি তুলে নিয়ে এসেছি। আপনার পকেটের জিনিসপত্র সব ওই টেবিলটার ড্রয়ারে আছে।
আঙুল তুলে একটা টেবিলের দিকে দেখাল অঙ্গলাবণি। তার পাশেই একটা ভোলা জানলা। তার কাচের শার্সিতে ভোরের রোদ। আর জানলার বাইরে কঁকড়া গাছে দুটো বুলবুলি। অকারণেই ডাকছে।
বুলবুলি দুটোকে কেমন যেন চেনা মনে হল।
কোথায় পড়ে ছিলাম আমি?
চার নম্বর সুপারওয়ের ওপরে।ফানল্যান্ড সাইবার ক্যাসিনোর পাশের একটা অন্ধকার জায়গায়…।
একটু সময় নিল স্নিগ্ধপ্রভাত। তারপর আলতো গলায় কাল রাতের ব্যাপারটা যেটুকু মনে ছিল বলল।
আপনি খুব জোর বেঁচে গেছেন। এই কায়দায় লুঠপাট করাটা এখন ভীষণ বেড়ে গেছে।
আপনার জন্যেই বেঁচে গেছি..। কৃতজ্ঞতার সুরে বলল স্নিগ্ধপ্রভাত।
হাসল অঙ্গলাবণি। কিছু বলল না। আয়ত চোখ মেলে স্নিগ্ধপ্রভাতকে দেখতে লাগল।
আপনি ছাড়া এ-ফ্ল্যাটে আর কে-কে থাকে?
আবার হাসল : কেউ না। আমি একা। তারপর কপাল থেকে চুল সরিয়ে বলল, চলুন, হাত-মুখ ধোবেন চলুন–
অঙ্গলাবণির কথাবার্তায় কেমন যেন অধিকারের ভাব। কিন্তু স্নিগ্ধপ্রভাতের ভালো লাগল। ওর ভেতরে-ভেতরে বোধহয় বহুদিনের একটা আর্তি ছিল যে, কেউ ওকে অধিকার করুক। বাইরে থেকে নয়–ভেতর থেকে।
স্নিগ্ধপ্রভাত অঙ্গলাবণির মুখের রেখাগুলো পড়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিল।
অচেনা এক পুরুষকে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসার ব্যাপারে কোনও দ্বিধা বা সংশয়ের ছাপ নেই। বরং কোথায় যেন একটা কৌতুক ও কৌতূহল কাজ করছে।
হাত-মুখ ধুয়ে ডাইনিং টেবিলে বসল মিগ্ধপ্রভাত। অঙ্গলাবণির দেওয়া কফির কাপে চুমুক দিয়ে হেসে বলল, আপনি খুব পরোপকারী…।
দীর্ঘশ্বাস ফেলল অঙ্গলাবণি : আপনি যেরকম ভাবছেন সেরকম নয়। নেহাত চাকরি ছাড়া আর কোনও কাজ নেই, তাই…। এই যেমন আপনার জন্যে কদিন অফিস ছুটি নিয়েছি…।
নতুন এক অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে দিনটা কাটতে লাগল। কোনও কাজ নেই–শুধু বিশ্রাম আর আরাম। সেইসঙ্গে অঙ্গলাবণির মধুর শাসন, দু-একটা এলোমেলো কথা। স্নিগ্ধপ্রভাতের বেশ লাগছিল।
ডাইনিং টেবিলে খেতে বসে ওদের কথা হচ্ছিল।
কাচের জানলায় রোদ এখন চড়া হয়েছে। আকাশ সকালের নীল থেকে চোখ-ধাঁধানো সাদাটে হয়ে গেছে।
মিউজিক সিস্টেমে হালকা সুর বাজছিল। তাতে কেমন একটা মিষ্টি আমেজ তৈরি হয়ে যাচ্ছিল।
একা-একা এতবড় ফ্ল্যাটে থাকেন…ভয় করে না?
যত না ভয় তার চেয়ে বেশি মনখারাপ লাগত।
আপনি কি সারাজীবন একা না কি? কেউ-না-কেউ নিশ্চয়ই আছে…।
জীবনের শুরুতে মা-বাবা-ভাই-বোন ছিল। তারপর স্বামী। আর তারপর…একা আমি।
আপনার হাজব্যান্ড এখন কোথায়?
এ-থ্রি সিটিতে একটা ফ্ল্যাট নিয়ে আছে। বছরখানেক হল আমাদের কাটাকুটি হয়ে গেছে।
কাটাকুটি! শব্দটা কেমন যেন কানে বাজল।
স্নিগ্ধপ্রভাতের কপালে বোধহয় প্রশ্নের ভাঁজ পড়েছিল। সেটা লক্ষ করে অঙ্গলাবণি বলল, না–ডিভোর্স হয়নি। অফিসিয়ালি ডিভোর্স পেতে এখনও বছরদুয়েক বাকি।
কথাটা বলে তেতো হাসল। স্নিগ্ধপ্রভাতের পাতে আরও একটু তরকারি দিল।
মুখে ভাত নিয়ে জড়ানো গলায় স্নিগ্ধপ্রভাত জিগ্যেস করল, আপনাকে ছেড়ে চলে গেল কেন?
ও ভীষণ বোর হয়ে গিয়েছিল। বলত, আমাদের ভালোবাসা নাকি ফুরিয়ে গেছে। এর পর তো আর একসঙ্গে থাকার কোনও মানে হয় না!
দারুণ!
অঙ্গলাবণি অবাক হয়ে স্নিগ্ধপ্রভাতের চোখে তাকাল।
স্নিগ্ধপ্রভাত বলল, রান্নাটা দারুণ হয়েছে। তারপর ও কী নাম আপনার হাজব্যান্ডের?
জেনে কী হবে!
তবু…জানতে ইচ্ছে করছে।
শোভনসুন্দর…।
নামটা চমৎকার–তবে মানুষটা নয়।
কী করে বুঝলেন?
আপনাকে ভালোবাসতে চায়নি, তাই।
হাসল অঙ্গলাবণি : আমারও তো অনেক দোষ থাকতে পারে! চট করে কারও সাইড নেওয়া ঠিক নয়।
আপনার সাইড নিতে আমার ভালো লাগছে। এটা কিন্তু খোশামোদ নয়। আসলে প্রত্যেকের মনের ভেতরে ভালো লাগার একটা সুইচ আছে। ওটা যখন-তখন কোনও লজিক ছাড়াই অন-অফ হয়। আপনার বেলায় অন হয়ে গেছে।
খেতে-খেতেই হেসে গড়িয়ে পড়ল অঙ্গলাবণি। হাসি থামলে পর বলল, সত্যি, আপনি এক অদ্ভুত মানুষ!
শোভনসুন্দর। নামটা মনে-মনে বিড়বিড় করল স্নিগ্ধপ্রভাত। অঙ্গলাবণি আর শোভনসুন্দরের জীবনে ভালোবাসা ফুরিয়ে গেছে।
স্নিগ্ধপ্রভাত অবাক হয়ে যাচ্ছিল। অঙ্গলাবণির জীবনের সঙ্গে ওর এত মিল! কোন বিচিত্র এক দুর্ঘটনা দুজন সমান্তরাল মানুষকে একটি বিন্দুতে মিলিয়ে দিল।
কিছুক্ষণ চুপচাপ স্নিগ্ধপ্রভাতকে খুঁটিয়ে লক্ষ করল অঙ্গলাবণি। তারপর আলতো করে ছুঁড়ে দিল একটি প্রশ্ন : আপনার বাড়িতে কে কে আছে?
অনিচ্ছাসত্ত্বেও স্নিগ্ধপ্রভাতের একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল বুকের ভেতরের প্রবল চাপটা শূন্য হয়ে গেল। মুখ সামান্য নীচু করে ও বলল, সুপর্ণলতিকা–আমার ওয়াইফ।
ও অবাক হয়ে খেয়াল করল, এতক্ষণে এই প্রথম ওর সুপর্ণলতিকার কথা মনে পড়ল। বাড়ি ফেরার জন্য ওর এতটুকুও মন টানল না।
আপনার বউয়ের কথা বলুন। সুপর্ণলতিকা নামটা কিন্তু দারুণ! অঙ্গলাবণিকে খুশি-খুশি দেখাল।
হ্যাঁ, দারুণ নাম–তবে অঙ্গলাবণির কাছে কিছু নয়।
ওঁর কথা বলুন। কেমন মানুষ আপনার ওয়াইফ?
ভালো। কিছুক্ষণ চুপচাপ খেতে লাগল স্নিগ্ধপ্রভাত। তারপর অনেকটা বোধহয় শোভনসুন্দরের মতো।
অঙ্গলাবণি মুখ নামাল।
আপনাকে আর-একটুকরো মাছ দিই…।
দিন।
স্নিগ্ধপ্রভাতের কেমন অদ্ভুত লাগছিল। ঘরে ফেরার কোনও তাড়া নেই। ফিরতে ইচ্ছেও করছে না। বরং মনে-মনে ও একটা অ্যাডভেঞ্চার চাইছে। আর নিজেকে বেশ স্বাধীন মনে হচ্ছে।
আচ্ছা, সুপর্ণলতিকাকে কেমন দেখতে? কাল বিকেলে ও কী যেন বলেছিল? দুটো ফ্লোট্যাক্সির অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে…কোন স্পেস কো-অর্ডিনেটে যেন…?
নাঃ, ভালো করে কিছু মনে পড়ছে না।
মাথার ভেতরে টিপটিপ করে যন্ত্রণার একটা ধারা অবিরাম বয়ে চলেছিল। মাঝে-মাঝে অস্থির হয়ে ব্যথাটা জানান দিচ্ছিল।
.
একদিন দু-দিন করে তিনটে দিন পেরিয়ে গেল। শুয়ে-বসে অলস গল্প করে ওদের সময় কাটতে লাগল।
তিনদিনে স্নিগ্ধপ্রভাত পুরোপুরি সেরে উঠেছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও ওর এখানে থেকে যেতে মন চাইছিল। অথচ লজ্জায় সংকোচে অঙ্গলাবণিকে সেকথাও বলতে পারছিল না।
চারদিনের দিন অঙ্গলাবণি ওকে বলল, আপনি এখন ভালোই আছেন। আজ থেকে আমার অফিস যাওয়া শুরু। আপনি এই ফ্ল্যাটের পাহারায় রইলেন। কী, কোনও আপত্তি নেই তো!
না, আপত্তি নেই। তবে একা-একা থাকতে বোর লাগবে।
সেকী? শোভনসুন্দর তো উলটো কথা বলেছিল আমাকে। আমার সঙ্গে দোকা থাকতে থাকতে ও বোর হয়ে গিয়েছিল। হাসল অঙ্গলাবণি।
আমি আমার কথা জানি–অন্যেরটা জানি না। তাই আমারটাই বললাম। নাকি আপনি বোর হয়ে যাচ্ছেন?
না, না ।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সাজগোজ শেষ করছিল অঙ্গলাবণি। আয়নার মধ্যে দিয়ে স্নিগ্ধপ্রভাতের দিকে তাকিয়ে বলল, জানেন, আমার অফিস-বসটা একটা রোবট। কাজ ছাড়া আর কোনও নেশা নেই। এমনকী আমার দিকে মুখ তুলে একপলক তাকায় না। মানে, যখন তাকায় তখন শুধু কাজের কথাই বলে।
আমি কিন্তু সেরকম না। বরং বেশ দুর্বল মানুষ।
অঙ্গলাবণি আয়নায় হাসল।
আয়নাটা অ্যান্টিক। সুন্দর কারুকাজ করা।
সেদিকে তাকিয়ে স্নিগ্ধপ্রভাত বলল, দারুণ!
সাজতে-সাজতে ভুরু তুলল অঙ্গলাবণি : আয়নাটা?
–আয়নার ছায়াটা। আপনার ইমেজটা।
এটা কিন্তু ভারচুয়াল ইমেজ। একে আঙুলে ছোঁয়া যায় না। হাসল ঠোঁটের কোণে।
ভারচুয়াল ইমেজ থেকেই একদিন রিয়েল ইমেজে পৌঁছে যাব। তারপর সেখান থেকে অবজেক্টে। তখন ছুঁতে কোনও অসুবিধে হবে না।
ভারচুয়াল রিয়েলিটি কিন্তু সত্যি নয়।
সত্যি না হোক সত্যির কাছাকাছি তো বটে! তাতেই আমার সাধ মিটবে।
এত অল্পেতেই আপনি খুশি?
হ্যাঁ। ঘাড় কাত করে বলল মিগ্ধপ্রভাত, আসলে চেয়েছিলামই তো অল্প! তাই অল্প পেলেই খুশি। কিন্তু পেলাম কই!
দাঁড়ান, অফিস থেকে ফিরে এসে আপনার এই ফিলিংটা অ্যানালিসিস করতে হবে।
ঠিক তখনই কথা-বলা-টেলিফোন মিষ্টি ধাতব গলায় বলে উঠল, ফোন এসেছে–ফোন ধরো।
অঙ্গলাবণি ধরছি বলতেই ঘরের দেওয়ালের একটা অংশ টিভির পরদা হয়ে গেল। সেখানে ফুটে উঠল একজন প্রৌঢ়ের রঙিন মুখ।
চোখে মেটাল ফ্রেমের চশমা। গালে ধপধপে সাদা চাপদাড়ি। মাথায় ব্যাকব্রাশ করা কাঁচাপাকা চুল। নাকের নীচে সাদা পুরু গোঁফ। তারই আড়ালে একচিলতে হাসি।
কেমন আছ, অঙ্গলাবণি?
এখনও পর্যন্ত ভালোই, ডক্টর–।
কোনও কমপ্লেন নেই?
না–একটুও না।
দ্যাখো, পেশেন্টকে আমি কিন্তু পুরোপুরি তোমার হাতে ছেড়ে দিয়েছি। হি ইজ অল ইয়োর। কোনও প্রবলেম হলে বলবে। আর কদিন যাক–তারপর তোমার বাড়িতে একদিন চা খেতে যাব।
ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম, ডক্টর।
ও.কে., সি ইউ দেন…।
পরদার ছবি মিলিয়ে গেল।
অঙ্গলাবণি বলল, টেলিফোন শেষ হয়েছে।
সঙ্গে-সঙ্গে পরদাটাও মিলিয়ে গেল। দেওয়ালটা আবার দেওয়ালের মতো হয়ে গেল। কথা বলা-টেলিফোন বলল, ধন্যবাদ।
এবার স্নিগ্ধপ্রভাতের দিকে ফিরে তাকাল অঙ্গলাবণি? উনি ডক্টর নীতিনপ্রকাশ। তোমার চিকিৎসা করছেন…।
স্নিগ্ধপ্রভাত হাসল ও ভুল বললে। আমি এখন তোমার চিকিৎসায় আছি।
অনেক পরে, অঙ্গলাবণি টা-টা করে অফিসে বেরিয়ে যাওয়ার পর, স্নিগ্ধপ্রভাতের খেয়াল হল ওরা হঠাৎই আপনি থেকে তুমি-তে নেমে এসেছে। কিন্তু এরকম হঠাৎ নেমে এলেও ওরা কেউই কোনও হোঁচট খায়নি।
আচ্ছা, এটা কি নামা, না ওঠা?
অঙ্গলাবণি চলে যাওয়ার পর স্নিগ্ধপ্রভাতের মনখারাপ লাগছিল। এত বড় শৌখিন ফ্ল্যাটে ভীষণ একা-একা লাগছিল।
সুপর্ণলতিকাকে একটা ফোন করলে কেমন হয়! কী করছে ও এখন?
সুতরাং ডাইনিং হলে টেলিফোনের কাছে গিয়ে ও বলল, একটা ফোন করব।
বলামাত্রই টেলিফোন জবাব দিল, কত নাম্বার বলো…।
নম্বরটা ঠিকমতো মনে পড়ছিল না। কেমন যেন ঝাপসা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল। মিগ্ধপ্রভাতের মাথা টিপটিপ করছিল।
শেষপর্যন্ত মরিয়া হয়ে একটা নম্বর বলল স্নিগ্ধপ্রভাত।
নম্বরটা বলা শেষ হতে-না-হতেই ও-প্রান্তে রিং বাজতে শুরু করল।
রিং হয়েই চলল। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করা সত্ত্বেও কেউ ফোন ধরল না। নিশ্চয়ই সুপর্ণলতিকা বাড়িতে নেই কোথাও বেরিয়েছে। অথবা নম্বরটাই ভুলভাল হয়েছে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্নিগ্ধপ্রভাত বলল, লাইন ছেড়ে দাও।
কথা-বলা-টেলিফোন লাইন কেটে দিয়ে বলল, ধন্যবাদ।
*
দু-সপ্তাহের মধ্যেই অঙ্গলাবণি স্নিগ্ধপ্রভাতের অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেল। ও চোখের আড়াল হলেই স্নিগ্ধপ্রভাতের অন্তরে অসহায় পিপাসা জেগে ওঠে। এক অদ্ভুত টান ওকে অঙ্গলাবণির পরাধীন করে তোলে। সে-কথা একদিন, এক দুর্বল মুহূর্তে অঙ্গলাবণিকে বলেও ফ্যালে।
ইলেকট্রনিক অরগ্যানের মতো মিষ্টি শব্দের ঢেউ খেলিয়ে হেসে ওঠে অঙ্গলাবণি। তারপর বলে, এ কী ছেলেমানুষি! ডক্টর নীতিনপ্রকাশকে তোমার এই ইলিউশানের কথা বলতে হবে।
ইলিউশান! মায়া! তোমাকে মনে-মনে চাওয়াটা স্রেফ মায়া! সত্যি নয়?
কী জানি! ডক্টর হয়তো তা-ই বলবেন।
এই যে তোমাকে ছুঁতে না পেলে আমার মন কষ্ট পাচ্ছে–এটাও মায়া?
হতেও তো পারে।
আচমকা স্নিগ্ধপ্রভাত অঙ্গলাবণির দিকে ঝুঁকে পড়ল। আকুলভাবে জড়িয়ে ধরল ওকে। এবং ঠোঁটে চুমু খেল।
এক আশ্চর্য উত্তাপ এক শরীর থেকে অন্য শরীরে বয়ে গেল। উত্তাপ না হয়ে সেটা বিদ্যুৎ তরঙ্গও হতে পারে।
দুটো শরীর গলতে শুরু করল। কেউই আর নিজের আয়ত্বে ছিল না। মন যা-যা চাইছিল শরীর তা-ই করতে শুরু করল।
এতদিন ধরে যে-সংযম দুজনে মেনে চলছিল একটি মুহূর্তে সেটা মিথ্যে হয়ে গেল।
একসময়, খানিকটা শান্ত হওয়ার পর, স্নিগ্ধপ্রভাত বলে ফেলল, তোমাকে ছাড়া আমি থাকতে পারব না।
সুপর্ণলতিকা?
অসম্ভব।
হাসল অঙ্গলাবণি। বলল, আমার অবস্থাটাও একইরকম। এখন বুঝলাম তোমার মধ্যে কতরকম অস্থির পাগলামি লুকিয়ে আছে। শোভনসুন্দর কখনও আমাকে এরকম পাগলের মতো আদর করেনি।
স্নিগ্ধপ্রভাতের কাছ থেকে সরে এল অঙ্গলাবণি। বলল, ডক্টর নীতিনপ্রকাশকে একটা ফোন করি।
সেকথা শুনতে পেয়ে কথা-বলা-টেলিফোন বলে উঠল, নাম্বার বলো–।
নম্বর বলল অঙ্গলাবণি। এবং ও-প্রান্তে ফোন বাজতে শুরু করল।
ডক্টর ফোন ধরতেই ঘরের দেওয়ালের একটা অংশ টিভির পরদা হয়ে গেল। সেখানে ডক্টর নীতিনপ্রকাশকে দেখা গেল।
হাউ আর য়ু, মাই লেডি?
ফাইন। আপনার সঙ্গে জরুরি কথা আছে। আপনাকে এখুনি একবার আমার ফ্ল্যাটে আসতে হবে।
কেন, কী হয়েছে?
খুব সিরিয়াস ব্যাপার। আপনি এলে পর বলব।
নীতিনপ্রকাশ হাসলেন কী, আমার এক্সপেরিমেন্ট সাকসেসফুল হয়েছে?
জানি না। আপনি এলে সব বলব।
টেলিফোন শেষ হয়েছে বলে ফোন ছেড়ে দিল অঙ্গলাবণি। টেলিফোন ওকে যথারীতি ধন্যবাদ জানাল।
টেলিফোনের কথাবার্তা শুনে স্নিগ্ধপ্রভাত একটু অবাক হয়েছিল।
ওর যেন মনে হচ্ছিল, ডক্টর নীতিনপ্রকাশ আর অঙ্গলাবণির মধ্যে কী এক গোপন খেলা চলছে। আর সে-খেলাটা ওকে নিয়েই।
তা হলে কি নীতিনপ্রকাশই শোভনসুন্দর? আড়ালে থেকে পরকীয়া সহবাসের ওপরে পরীক্ষা নিরীক্ষা চালাচ্ছেন? যদি তাই হয়, তা হলে মানতেই হবে, এ বড় নিষ্ঠুর পরীক্ষা।
নিজেকে গিনিপিগ ভাবতে স্নিগ্ধপ্রভাতের বেশ খারাপ লাগল।
কীসের এক্সপেরিমেন্ট সাকসেসফুল হয়েছে, অঙ্গলাবণি?
উত্তর না দিয়ে ঠোঁট টিপে হাসল। বলল, ডক্টর এলেই সব জানতে পারবে।
.
ডক্টর নীতিনপ্রকাশ চেয়ারে বসে কৌতুকভরা চোখে তাকিয়ে ছিলেন স্নিগ্ধপ্রভাতের দিকে। ওঁকে ঠিক টিভি-পরদার রঙিন ছবির মতোই লাগছিল।
অঙ্গলাবণি তিনজনের জন্য কফি আর বিস্কুট নিয়ে ঘরে ঢুকল। ওঁদের সামনের টেবিলে সেগুলো সাজিয়ে দিয়ে ইশারায় চুমুক দিতে বলল। তারপর নিজে একটা কাপ তুলে ঠোঁটে ছোঁয়াল। সেই ঠোঁট, যেখানে স্নিগ্ধপ্রভাতের ঠোঁটের ছোঁয়া লেগে আছে।
কফিটা কেমন হয়েছে? ডক্টর স্নিগ্ধপ্রভাতকে জিগ্যেস করলেন।
দারুণ! মুখে তৃপ্তির শব্দ করল স্নিগ্ধপ্রভাত।
আপনি কেমন আছেন?
বেশ অবাক হয়ে নীতিনপ্রকাশের চোখে তাকাল স্নিগ্ধপ্রভাত : কেন, ভালোই তো আছি!
আমরাও তা-ই চাই। হাসলেন ডক্টর।
তারপর চশমাটা চোখ থেকে খুলে কাচদুটোয় মুখের ভাপ দিলেন। জামার আস্তিনে ঘষে কাচদুটো পরিষ্কার করলেন।
চশমা না থাকায় নীতিনপ্রকাশের চোখদুটো ছোট-ছোট দেখাচ্ছিল।
স্নিগ্ধপ্রভাত, আপনাকে আজ আমি একটা নতুন টেকনোলজির কথা শোনাব–এম. এম. টেকনোলজি। যার পুরো নাম হল মেমোরি ম্যাপিং টেকনোলজি। এই টেকনোলজি দিয়ে আমাদের মেমোরিকে–মানে, স্মৃতিকে বদলে দেওয়া যায়।
তার মানে!
তার মানে আর কিছুই না… চশমাটা নেড়েচেড়ে ঠিকঠাক করে চোখে বসালেন নীতিনপ্রকাশ : আমাদের স্মৃতি হচ্ছে অনেকটা সাদা কাগজে পেনসিলের দাগের মতো। ব্রেনের কোটি কোটি নিউরোনের মধ্যে স্মৃতি বাসা বেঁধে থাকে। আমাদের এই নতুন টেকনোলজি কাগজে আঁকা পেনসিলের দাগ সহজেই মুছে ফেলতে পারে, এবং এঁকে দিতে পারে নতুন পেনসিলের দাগ। আই মিন, টোটাল মেমোরির নানান অংশ আমরা খুশিমতো মুছে দিতে পারি। আবার আমাদের পছন্দমতো তৈরি করা মেমোরি–মানে, ফ্যাব্রিকেটেড মেমোরি প্রিন্ট করে দিতে পারি আপনার মগজে। হাসলেন নীতিনপ্রকাশ : ইন ফ্যাক্ট আমি তাই করেছি। আপনার ওয়াইফ সুপর্ণলতিকার চেহারা আর আচরণের যে-স্মৃতি আপনার মেমোরিতে ছিল সেটা আমি টোটালি ইরেজ করে দিয়েছি। সেইজন্যেই নতুন এক লোকালিটির নতুন এই ফ্ল্যাটে ওকে দেখে আপনি চিনতে পারেননি। ওকে আপনি অন্য কারও স্ত্রী অঙ্গলাবণি বলে মেনে নিয়েছেন…।
স্টপ ইট, ডক্টর! চিৎকার করে উঠল স্নিগ্ধপ্রভাত, প্লিজ ডোন্ট টক রাবিশ!
ডক্টর নীতিনপ্রকাশ মুচকি মুচকি হাসছিলেন। আর অঙ্গলাবণি নাকি সুপর্ণলতিকা?– আড়চোখে মিগ্ধপ্রভাতকে দেখছিল।
আপনি এই নতুন পরিচয়কে বিশ্বাস করেছেন। আমি ফ্ল্যাটে আসামাত্রই অঙ্গলাবণি আমাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে সব কথা বলেছে। কয়েক ঘণ্টা আগেই আপনি ওকে বলেছেন : তোমাকে ছাড়া আমি থাকতে পারব না। যে-মুহূর্তে আপনি একথা বলেছেন সেই মুহূর্তেই আমার এক্সপেরিমেন্ট সাকসেসফুল হয়েছে। আপনাদের ঠান্ডা হয়ে যাওয়া সম্পর্ক আবার বেঁচে উঠেছে। আপনি নিশ্চয়ই মানবেন, আই হ্যাভ রিপেয়ারড আ শ্যাটার রিলেশনশিপ। নীতিনপ্রকাশ কৌতুকের চোখে তাকালেন সুপর্ণলতিকার দিকে কী বলো, অঙ্গলাবণি?
স্নিগ্ধপ্রভাতের সবকিছু কেমন গোলমাল হয়ে যাচ্ছিল। ওই তো বসে রয়েছে অঙ্গলাবণি! কী সুন্দর ওর বসার ভঙ্গি! কী সুন্দর শান্ত ওর ভালোবাসা মাখানো মুখ! ও যে আসলে সুপর্ণলতিকা সেটা জানার পরেও স্নিগ্ধপ্রভাতের টানটা কমছে না কেন? এম. এম. টেকনোলজি কি এতই অদ্ভুত!
সুপর্ণলতিকার দিকে ফিরে হাসলেন নীতিনপ্রকাশ ও কী, এবারে তুমি খুশি তো! এবারে শুরু হোক তোমাদের মোস্ট হ্যাপি কনজুগাল লাইফ। যদি আবার কখনও বোর হয়ে যাও আমাকে শুধু একটা ফোন করে দিয়ো। তোমার মাথা থেকে হাজব্যান্ডের মেমোরি ম্যাপ বদলে দিয়ে ভালোবাসায় টইটম্বুর নতুন এক হাজব্যান্ড ফিরিয়ে দেব। আমার রিসার্চ টিমের লোকজন ওঁকে ফুঁ দিয়ে অ্যানেসথেসিয়া করে আবার তুলে নিয়ে আসবে আমার ল্যাবে। তারপর একটু এম. এম. টেকনোলজি–ব্যস, তার পরই পুরোনো মানুষটা একেবারে নতুন হয়ে যাবে।
স্নিগ্ধপ্রভাতের ঘোর তখনও কাটেনি। ও ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিল নীতিনপ্রকাশের দিকে।
নীতিনপ্রকাশ হাত বাড়িয়ে স্নিগ্ধপ্রভাতের হাত চেপে ধরলেন। হেসে বললেন, ঘাবড়াবেন, স্নিগ্ধপ্রভাত। যদি সুপর্ণলতিকা মানে, এই অঙ্গলাবণি– আঙুল তুলে অঙ্গলাবণিকে দেখালেন তিনিঃ বোর হয়ে যায়, তা হলে আপনিও আমাকে কনট্যাক্ট করতে পারেন। তখন স্নিগ্ধপ্রভাতকে পালটে রাজসম্রাট করে ওর কাছে আমি হাজির করব। হাসলেন ডক্টর ও সমাজের যে-কোনও স্বামী-স্ত্রীর প্রবলেম সম্ভ করার জন্যে আমি এবং আমার এম. এম. টেকনোলজি সবসময় হাজির। অলওয়েজ অ্যাট ইয়োর সার্ভিস। আমার ফোন নাম্বার আর ফিজের ব্যাপারটা আপনি পরে আপনার স্ত্রীর কাছ থেকে জেনে নেবেন। তবে মনে হয়, তার আর দরকার হবে না। নীতিনপ্রকাশকে স্নিগ্ধপ্রভাতের দেবতা বলে মনে হচ্ছিল।