1 of 2

বনবনিয়া

বনবনিয়া

আমরা যখন খুব সমস্যার মধ্যে দিন কাটাচ্ছি ঠিক তখনই বম্বনিয়া ঢুকে পড়ল আমাদের জীবনে। আর ওইটুকু পুঁচকে দশ-বারো বছরের একটা বাচ্চা ছেলের কাছে আমরা সবাই যেন নতুন করে শিখলাম : বিপদে ভয় করতে নেই।

কয়লাখনি এলাকায় আমরা থাকি। আমরা বলতে বাপি, মা, আমার দিদি মহুয়া, আর আমি। বাপি কোল ইন্ডিয়া কোম্পানির অ্যাকাউন্ট্র ডিপার্টমেন্টে চাকরি করেন। বহু বছর আগে আমরা যখন কলকাতার আলমবাজারে থাকতাম তখন মা একটা প্রাইমারি স্কুলে ইংরেজি পড়াতেন। এখন চাকরি করেন না, তবে লেখালিখি করেন–সেসব লেখা কলকাতার নানান ম্যাগাজিনে বেরোয়। এ অঞ্চলের লোকেরা মায়ের লেখালিখির কথা জানে।

অফিস থেকে আমাদের কোয়ার্টার অনেকটা দূরে ছিল বলে বাপির যাতায়াতে বেশ কষ্ট হত। তা ছাড়া আমার স্কুলটাও বেশ ঘুরপথ ধরে যেতে হত। দিদি কলেজে যেত দুটো বাস পালটে, দুবার সাইকেল রিকশা চড়ে। এইসব অসুবিধের কথা ভেবে আমরা জামতলা এলাকা ছেড়ে সাহেবপাড়ায় চলে এসেছি। সাহেবপাড়ায় এক কালে নাকি সাহেবসুবোরা থাকত। এখনও সে-আমলের কয়েকটা বাড়ি-ঘর দেখলে কথাটা যে সত্যি সেটা বোঝা যায়।

সাহেবপাড়ায় ছোট জমি কিনে বাপি সুন্দর একটা বাড়ি করেছেন। কলকাতার আমাদের আত্মীয়স্বজন খুব একটা নেই। তা ছাড়া এ-জায়গাটা মা-বাপি দুজনেরই বেশ ভালো লেগে গেছে। তাই ওঁরা চেয়েছেন বাকি জীবনটা এখানেই কাটিয়ে দিতে। আর আমার বা দিদির বন্ধুবান্ধবও তো এখানে কম নেই।

গণ্ডগোলটা শুরু হল নতুন বাড়িতে আমরা চলে আসার পর।

একদিন সন্ধেবেলা অফিস থেকে ফিরে বাপি চায়ের কাপ হাতে বাইরের উঠোনে বসে আছেন, তিনটে সাইকেল আমাদের সদরে এসে থামল।

তিনটে সাইকেল থেকে নেমে পড়ল চারজন। জিনসের প্যান্ট, মাথায় কঁকড়া চুল, কোমরে বড় বকলস লাগানো বেল্ট, দুজনের আবার এক কানে একটা করে মাকড়ি।

ওদের মধ্যে একজন সুপুরি বা জর্দা গোছের কিছু একটা চিবাচ্ছিল। শব্দ করে একদলা লাল থুতু ফেলে বাপির দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, অ্যাই, আপনি রাসমোহন মিত্তির?

বিকেল মরে এলেও সন্ধের আঁধার তখনও নামেনি। আমি বাগানে ফুলগাছগুলোর কাছে ঘোরাঘুরি করছিলাম। সেখানে কয়েকটা ফড়িং উড়ছিল। আমি ওদের ওড়া দেখছিলাম। স্কুলের সায়েন্স টিচার প্রসাদবাবু বলেছেন, ফড়িং-এর দু-জোড়া ডানা সমান তালে নড়ে না–একজোড়া খুব ধীরে নড়ে, আর একজোড়া খুব তাড়াতাড়ি। একজোড়া ওড়ার গতি নিয়ন্ত্রণ করে, অন্য জোড়া ওড়ার দিক। ঠিক যেন নৌকোর দাঁড় আর হাল।

ছেলেগুলোকে প্রথমটা আমি তেমন নজর করে দেখিনি। কিন্তু ওই নোংরা ভঙ্গিতে বাপিকে প্রশ্ন করামাত্রই আমি ফড়িং ছেড়ে ওদের দিকে তাকালাম।

বাপি কেমন যেন থতমত খেয়ে বললেন, হ্যাঁ, আমিই রাসমোহন মিত্র। কী ব্যাপার বলুন?

লাথি মেরে সদর দরজা খুলে ফেলল ছেলেটা। ইট-পাতা পথ ধরে চার-পা এগিয়ে এসে মুচকি হেসে বলল, এখানে জমি পারচেজ করে বাড়ি বানালেন, আর আমাদের পারচেজ ট্যাক্সটা দেবেন না!

চায়ের কাপ-প্লেট বাপির হাতে ঠকঠক করে নড়ছিল। বাপি সেটা মেঝেতে নামিয়ে রেখে কোনওরকমে উঠে দাঁড়ালেন।

কীসের পারচেজ ট্যাক্স?

ন্যাকা ষষ্ঠী আমার! পেছন থেকে কানে মাকড়িওয়াল একজন মন্তব্য করল, পারচেজ ট্যাক্স জানেন না!

বাড়ির নাম রেখেছেন কেকা নিকেতন! ওটা পালটি করে ন্যাকা নিকেতন করে দিন। তিন নম্বর দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে মন্তব্য করল।

কেকা আমার ঠাকুমার নাম। গতবছর ঠাকুমা মারা গেছেন।

চিৎকার-চেঁচামেচিতে মা বারান্দায় চলে এসেছিলেন। দিদি হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান করছিল হারমোনিয়াম ফেলে চলে এসেছে জানলায়। পরদা সরিয়ে অসভ্য ছোটলোকগুলোকে দেখছে।

বাপি উত্তেজিত হয়ে হাত নেড়ে বলতে চাইলেন, আপনাদের সঙ্গে কোনও কথা আমি বলতে চাই না। অসভ্যতার একটা সীমা আছে। আমি…।

সামনের ছেলেটা, যে বোধহয় পান পরাগ জাতীয় কিছু একটা চিবাচ্ছিল, শব্দ করে থুতু ছুঁড়ে দিল বাপির পায়ের কাছে। অল্পের জন্যে বাপির গায়ে লাগল না। তারপর বিচ্ছিরিরকম হেসে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, আমার নাম নেকড়ে। আপনি বহুত আনপঢ় আদমি আছেন–কোনও খবর রাখেন না। এই সাহেবপাড়া এরিয়াটা আমার। আমার সঙ্গে যারা আছে– বলে ঘুরে সঙ্গীদের দিকে তাকিয়ে আঙুল তুলে তাদের পরিচয় দিতে লাগল : এ হল নগা। এ হীরালাল। আর ওই যে পেছনে দাঁড়িয়ে–ওর নাম টার্গেট। ও মেশিন চালালে গুলি সবসময় টার্গেটে গিয়ে লাগে।

বাপি ফ্যালফ্যাল করে চরিত্রগুলোকে দেখতে লাগলেন। মা এর মধ্যে কখন যেন বাপির পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন।

নেকড়ে, টার্গেট কীসব অদ্ভুত নাম!

ওরা যে কারা সেটা আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম। কিন্তু জামতলায় এ ধরনের উপদ্রব ছিল না। বোধহয় অনেক কোয়ার্টার নিয়ে ছোটখাটো টাউনশিপ ছিল বলেই।

শুনুন, মিত্তিরবাবু– নেকড়ে ঠান্ডা চোখে বাপির দিকে তাকিয়ে বলল, তিরিশ হাজার টাকা দিলেই আপনার কেস সালটে যাবে। হীরালাল কাল সন্ধেবেলা আপনার কাছে নোট নিতে আসবে। মাল রেডি রাখবেন।

এবারে মা আর চুপ করে থাকতে পারলেন না। নেকড়েকে লক্ষ করে বললেন, এ কি মগের মুল্লুক না কি! হঠাৎ আপনাদের টাকা দিতে যাব কেন?

জেন্টসের কথায় লেডিজ নাক গলালে কেস আরও ক্যাচাল হয়ে যাবে। নেকড়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, হীরালাল কাল আসবে। নোট না দিলে.. কথা থামিয়ে টার্গেটের দিকে তাকাল নেকড়ে। চোখের ইশারা করে বলল, টার্গেট, একটু স্যাম্পেল শো করে দাও।

সঙ্গে-সঙ্গে জামার নীচে হাত ঢুকিয়ে কোমরের কাছ থেকে কী একটা নিয়ে হাত বের করল টার্গেট।

একটা কালো রিভলভার। রাস্তার আলো ওটার গা থেকে ঠিকরে পড়ছে।

রিভলভারটা সামনে উঁচিয়ে বাপির খুব কাছে এগিয়ে এল টার্গেট।

বাপি ঠকঠক করে কাঁপতে শুরু করলেন। মা একটা চিৎকার করে বাপিকে জাপটে ধরলেন, কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ওঁকে কিছু কোরো না। ওঁকে কিছু কোরো না। তোমরা টাকা পেয়ে যাবে।

অব আয়া হ্যায় লাইন মে। দাঁত খুঁটতে-খুঁটতে মন্তব্য করল হীরালাল।

টার্গেট রিভলভারটা বাপির একেবারে কপালে ঠেকিয়ে ধরে বলল, আঙুলে একটু চাপ দিলেই আপনি কোল ইন্ডিয়া কেন, হোল ইন্ডিয়া থেকে রিটায়ার হয়ে যাবেন।

বাপি হঠাৎই খসে পড়ে গেলেন মাটিতে। মা চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন। দিদি ঘর থেকে বেরিয়ে ছুটে এল বারান্দায়। আমিও ছুটে গেলাম বাপির কাছে। আমার গলার ভেতরটা কেমন শক্ত হয়ে যাচ্ছিল।

বাপি পড়ে যেতেই টার্গেট কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে হাসল। নেকড়ের দিকে তাকিয়ে বলল, বস, এ তো আমুল বাটার দেখছি। শাটার টেপার আগেই ছবি হয়ে গেল।

ওরা চারজন সদর দরজার দিকে হাঁটা দিল।

গেট পেরিয়ে বেরোনোর সময় নগা বলল, কাল সাতটায় আমি আর হীরু আসব, মাল রেডি রাখবেন। থানা-পুলিশ করে কোনও লাভ নেই।

চারটে অপচ্ছায়া তিনটে সাইকেলে চড়ে চলে গেল।

আমরা ততক্ষণে মাথায়-মুখে জলের ঝাপটা দিয়ে বাপির জ্ঞান ফিরিয়ে এনেছি। নতুন বাড়িতে আসার আনন্দ আমাদের মন থেকে সেই মুহূর্তেই মুছে গেল।

.

এরপর বিপদ বাড়তেই থাকল।

বাড়ি তৈরি করার সময় বাপি কীরকম খোঁজখবর নিয়েছিলেন কে জানে! তখন বোধহয় নেকড়েদের কথা জানা যায়নি। এখন টাকা জোগাড় করার চেষ্টায় বাপি পাগলের মতো হয়ে গেলেন। বাপি আর মা মিলে কতজনকে যে ফোন করলেন তার কোনও হিসেব নেই। আমি আর দিদি লুকিয়ে লুকিয়ে ঠাকুরকে ডাকতে লাগলাম।

পরদিন ওরা এল। হীরালাল আর নগা।

বাপি ওদের হাতে পাঁচ হাজার টাকা তুলে দিয়ে করুণভাবে বললেন, এক দিনে এর বেশি জোগাড় করতে পারিনি। আমাকে আপনারা দয়া করে কটা দিন সময় দিন।

উত্তরে ওরা বাপিকে এক ধাক্কা দিয়ে যেসব ভাষা ব্যবহার করল তাতে আমার মনে হচ্ছিল দুটো শয়তানের টুটি টিপে ধরে বেধড়ক পেটাই। কিন্তু কল্পনা আর বাস্তব তো এক নয়!

ওরা যা-তা ভাষায় ওয়ার্নিং দিয়ে চলে গেল। বলে গেল সাতদিনের মধ্যে বাকি টাকা চাই। মেয়ে-বউয়ের সোনাদানা বেচে হলেও টাকাটা বাপিকে জোগাড় করতেই হবে। নইলে ওদের বস খেপে যাবে। তখন টার্গেট…।

বাপির দিকে রিভলভারের মতো করে আঙুল দেখিয়ে মুখে দুবার গুলি ছোঁড়ার নকল আওয়াজ করল হীরালাল। হেসে বলল, কেন বেফালতু খরচা হয়ে যাবেন, মশাই।

ওরা চলে যাওয়ার অনেকক্ষণ পরেও বাপি বাঁশপাতার মতো থরথর করে কাঁপছিলেন। আর মা সারাক্ষণ কোনও ভয় নেই! কোনও ভয় নেই! বলে কান্না চাপতে লাগলেন।

এলাকায় সামান্য খোঁজখবর নিতেই আমরা নেকড়ে সম্পর্কে যা জানার জেনে গেছি। অথচ আগে এসব খোঁজ পাইনি।

যখন আমি স্কুলে যাই, ওদের বাজারের মোড়ের কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। ওরা আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসে।

একদিন নগা আমাকে ডেকে বলল, অ্যাই ছোঁড়া, শোন। তোর বাপ আর নোট জোগাড় করতে পারল?

এর মধ্যে মায়ের গয়না বিক্রি করে বাপি ওদের আরও ছহাজার টাকা দিয়েছেন। তারপর কাকুতি-মিনতি করে আরও একমাস সময় পেয়েছেন।

আমি মাথা নেড়ে কোনওরকমে না বলেছি। তারপর তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে চলে গেছি– যত তাড়াতাড়ি ওদের কাছ থেকে দুরে চলে যাওয়া যায়।

বাজারের মোড়ের কাছে ওদের দলটা সবসময় আড্ডা মারে। কাউকে ওরা ভয় পায় না, কিন্তু ওদের সবাই ভয় পায়। ওই মোড় দিয়ে যারা যাতায়াত করে তাদের সবাইকেই দেখেছি ওদের কেমন সমীহ করে।

আর-একদিন টার্গেট আমাকে দেখতে পেয়ে ডাকল, বলল, তোর দিদির নাম যেন কী?

 আমার মুখ-চোখ লাল হয়ে গেল। কোনওরকমে বললাম, মহুয়া।

ওরা দল বেঁধে হাসল। তারপর নেকড়ে বলল, মহুয়া বড় মিষ্টি।

আমি অন্ধ রাগে নেকড়ের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। নেকড়ে সঙ্গে-সঙ্গে ক্যারাটের ভঙ্গিতে আমাকে সপাটে এক লাথি কষাল।

লাথিটা পেটে এসে লাগতেই আমি ওঁক শব্দ করে ছিটকে পড়ে গেলাম রাস্তায়। মাথার ভেতরে আগুন জ্বলছিল, শরীরটা কেমন ঝিমঝিম করছিল। সেই অবস্থায় ঝাপসা চোখে দেখলাম, নেকড়ে দাঁত বের করে হাসতে হাসতে আমার দিকে এগিয়ে আসছে।

আমার খুব কাছে এসে দাঁড়াল নেকড়ে। চিবিয়ে-চিবিয়ে বলল, মহুয়া বড় মিষ্টি।

তারপর বুট পরা পায়ে পাগলের মতো এলোপাতাড়ি লাথি মারতে শুরু করল আমাকে।

অনেকক্ষণ পর কোনওরকমে উঠে দাঁড়িয়ে খোঁড়াতে-খোঁড়াতে বাড়ির পথ ধরলাম।

রাস্তার বহু লোক ঘটনাটা দেখেও কোনও ভ্রূক্ষেপ করেনি। আমার ক্ষতবিক্ষত আহত শরীরটাকে রাস্তা থেকে তোলার ব্যাপারেও কেউ সাহায্য করেনি। পথে একজন চেনা রিকশাওয়ালা তার সাইকেল রিকশা করে আমাকে বাড়ির গেটের কাছে পৌঁছে দিল। একবার শুধু বিড়বিড় করে লোকটা বলল, তুমি ওইটুকু ছেলে, তুমি কখনও ওদের সঙ্গে পারো! জোয়ান মানুষগুলোই সবকিছু মুখ বুজে সহ্য করছে…।

আমাকে দেখার পর বাড়িতে চিৎকার-চেঁচামেচি কান্না শুরু হল। দিদি তখন কাঁদতে কাঁদতে জানাল কলেজে যাওয়ার পথে লুম্পেনগুলো প্রায়ই নাকি ওকে নোংরা কথা বলে, অপমান করে।

মা দিশেহারা হয়ে গেলেন, বাপি কপাল চাপড়ে কাঁদতে শুরু করলেন। বাড়ি করে তিনি নিঃস্ব হয়ে গেছেন। ওদের টাকা তিনি কেমন করে মেটাবেন!

বাপিকে কখনও আমি এভাবে কাঁদতে দেখিনি।

সেদিন অনেক রাত পর্যন্ত আমরা চারটে প্রাণী ঘর অন্ধকার করে সর্বস্বান্তের মতো বসে রইলাম। আমাদের আর কোথাও যাওয়ার নেই, কিছু করার নেই।

এইরকম একটা অবস্থার মধ্যে বনবনিয়া আমাদের বাড়িতে এল।

একদিন সন্ধের মুখে বাপির হাত ধরে ও এসে হাজির হল।

বয়েস দশ-বারো বছর। গোলগাল শ্যামবর্ণ চেহারা। মুখটা দারুণ মিষ্টি। মাথা ন্যাড়া। ন্যাড়া মাথার পেছন দিকে মোটাসোটা একটা টিকি। ছানাবড়া চোখের কোলে কাজল। গায়ে লাল-সবুজ কাপড়ের তাপ্পি মারা একটা ঢোলা জামা ঠিক যেন ফুটবল প্লেয়ারের জার্সি। জামার নীচে কালো হাফ প্যান্টের খুব সামান্যই উঁকি মারছে। ওটুকু উঁকি না মারলে মনে হত ও প্যান্ট পরেনি।

বনবনিয়ার কপালে কাজলের টিপ, মাথায় একটা লাল কাপড়ের ফেট্টি বাঁধা। আর হাতে। গোলাপি রঙের প্লাস্টিকের একটা বাঁশি।

বাপি মাকে বললেন, তুমি বহুদিন ধরে ফাঁই ফরমাশ খাটার জন্যে একটা বাচ্চা ছেলের কথা বলছিলে–তাই ওকে নিয়ে এলাম। ওর নাম বনবনিয়া। তারপর বনবনিয়ার দিকে ফিরে : এই তোর মাইজি।

ছেলেটা এক গাল হেসে লাফিয়ে চলে গেল মায়ের কাছে। ন্যাড়া মাথা হেঁট করে মায়ের পা ছুঁয়ে বলল, পায় লাগু, মাজি।

মা খানিকটা অবাক হয়ে বাপিকে বললেন, ও বাংলা বলতে পারে না?

পারে–অল্প-অল্প।

বাপি, ওকে পেলে কোথায়? দিদি জিগ্যেস করল।

বাপি বনবনিয়াকে বললেন, তুই যা–এখন বাগানে গিয়ে খেলা কর।

ছেলেটা বাঁশি বাজাতে-বাজাতে ছুটে গেল বাগানের দিকে। বাগানে পৌঁছে হঠাৎই থমকে দাঁড়িয়ে হাতছানি দিল আমাকে লক্ষ করে, ওর দেশোয়ালি ভাষায় চেঁচিয়ে ডাকল, আও না, ছোটে মালিক, একসাথ খেলো…।

কেন জানি না, ওর হাতছানি আমি উপেক্ষা করতে পারলাম না। ওর সঙ্গে খেলার জন্যে ছুটে গেলাম বাগানে।

রাতে দিদির কাছে শুনলাম বনবনিয়াকে খুঁজে পাওয়ার কাহিনি।

জামতলার পশ্চিম দিকে দুটো পুরোনো কয়লা খনি আছে। বহু বছর আগেই ওই খনি দুটো থেকে কয়লা তোলার কাজ শেষ হয়ে গেছে। সেই জোড়া খনি আর তার লাগোয়া বড়সড় মাঠটা জুড়ে বছরের এসময়টায় একটা মেলা বসে। তাতে নানান জিনিস বিক্রি হয়। লাল-নীল কাপড়ে ম্যারাপ বেঁধে হরেকরকম খাবারের দোকান তৈরি হয়। কখনও কখনও নাগরদোলাও বসে।

মেলার মাঠ পেরিয়ে গেলে কুলি-কামিনদের বস্তি, তারও ওপাশে বড়-বড় গাছের জঙ্গল।

বাপি নেকড়েদের সমস্যা মেটানোর চেষ্টায় এক কুলি সর্দারের সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিলেন। কথাবার্তা বলে হতাশ হয়ে মেলার মাঠ পেরিয়ে ফিরে আসছিলেন।

পড়ন্ত বিকেলে আনমনা পায়ে উঁচু-নিচু পথ পেরিয়ে হেঁটে আসছিলেন বাপি। মেলার কলরোল দূর থেকে শোনা যাচ্ছিল, তবে বাপির কানে ঢুকছিল না। একটা খনির পিটের কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় অদ্ভুত এক কান্নার আওয়াজ বাপির কানে আসে। বোধহয় খানির ভেতরে হাওয়া ঢুকে শব্দ হচ্ছিল। কিন্তু সেদিকে কান পাততে গিয়ে বাপি পড়ে যান মাটিতে। তাঁর মাথাটা কেমন ঘুরে যায়। হাতের ছাতাটা ছিটকে পড়ে দূরে। গরম হাওয়ার তাপ তখনও চোখে-মুখে বেশ টের পাচ্ছিলেন তিনি। নিজের দুরবস্থার কথা ভেবে বাপির প্রায় কান্না পেয়ে যায়। এই বিপদে তাকে বাঁচানোর কেউ নেই! ছাতাটা মাটি থেকে তুলে নিয়ে ক্ষোভে হতাশায় সেটা পাগলের মতো মাটিতে পিটতে থাকেন বাপি।

ঠিক তখনই কোথা থেকে এক ঝলক ঠান্ডা মিষ্টি বাতাস উড়ে এসে বাপিকে ঘিরে নেয়। বুকের জ্বালা-যন্ত্রণা কমে গিয়ে ভেতরটা কেমন শান্ত হয়ে যায়। বাপি উঠে দাঁড়াতেই কে যেন তার জামা ধরে টানে, আর হিন্দিতে বলে, এ বাবু, পইসা দেও না।

ঘুরে তাকিয়েই দেখেন ন্যাড়া মাথা একটা মিষ্টি ছেলে।

কেন, পয়সা নিয়ে কী করবি?

ছেলেটা হেসে বলে, মাখখন খায়গা।

এ কী অদ্ভুত বায়না! পয়সা নিয়ে মাখন খাবে! নাকি মাখন-রুটি বলতে চাইছে?

বাপি ওকে দুটো টাকা দিতেই বাচ্চাটা সেলাম ঠুকে বাপির সঙ্গে-সঙ্গে লাফিয়ে লাফিয়ে চলতে শুরু করে। আর হাতের প্লাস্টিকের বাঁশিটা পোঁ-পোঁ করে বাজাতে থাকে।

কথায় কথায় জানা গেল ওর নাম বনবনিয়া। মা-বাবা কেউ নেই। কুলিদের বস্তিতে একজনের কাছে আশ্রয় নিয়ে আছে। সে খুব খাটায়, আর মদ খেয়ে প্রচণ্ড মারধোর করে।

এইরকম নানা কথা বলতে বলতে বনবনিয়া হঠাৎ বাপির জামা খামচে ধরে বায়না করে বসে : এ বাবু, আমি তোহার সঙ্গে যাবে। তোহার সঙ্গে থাকবে।

বাচ্চা ছেলেটার এই অনুরোধ বাপিকে কেমন যেন আচ্ছন্ন করে দিয়েছিল। বাপি আর না বলতে পারেননি।

বাড়িতে ওর একটা দিন কাটতে না কাটতেই আমরা সকলেই বুঝে গেলাম বম্বনিয়া দারুণ কাজের ছেলে। সব কাজই করে হাসি মুখে। লাফিয়ে-লাফিয়ে চলে, গুনগুন করে দেশোয়ালি ভাষায় গান করে। আমাকে ডাকে ছোটে মালিক, দিদিকে ছোটে মালকিন, বাপিকে বাবু আর মা-কে মাজি।

নতুন জামাকাপড় ওকে পরানো গেল বটে কিন্তু মাথার ফেট্টি কিছুতেই ও খুলল না। আর কাজল লাগানোর অভ্যেস ছাড়ানো গেল না। মা কখনও কখনও কপট রাগে ওকে বলেন, গেঁয়ো ভূত।

উত্তরে বনবনিয়া খিলখিল করে হাসে।

 এর মধ্যে একদিন দুপুরে নেকড়ের দল টাকা চাইতে বাড়িতে এসে হাজির হল।

দিনটা ছিল রবিবার। আমরা সবাই বাড়িতেই ছিলাম। ওদের ডাকে বাপি বাইরে বেরোতেই লোফারগুলো অশ্রাব্য গালিগালাজ শুরু করল।

বনবনিয়া আমার কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছিল। ওদের কাণ্ড দেখে চাপা গলায় আমাকে জিগ্যেস করল, এসব কী ব্যাপার, ছোটে মালিক?

আমি এতদিন কোনও কথা ওকে জানাইনি–চাকরবাকরকে জানানোর কোনও মানে হয় না তাই। কিন্তু ওর প্রশ্নটা শোনামাত্রই আমার মনটা কীরকম যেন হয়ে গেল। ওকে সবকিছু খুলে বলতে ইচ্ছে করল।

সব কথা মনোযোগ দিয়ে শুনল বনবনিয়া। এবং পরমুহূর্তেই বারান্দা ছেড়ে এক ছুটে চলে গেল উঠোনে–বাপির কাছে।

টার্গেট তখন অশ্লীল ভাষায় বাপিকে হুমকি দিচ্ছিল। আর বাপি অসহায়ভাবে মুখ বুজে অপমানগুলো সহ্য করছিলেন।

নেকড়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে জাবর কাটছিল। ওর কাছাকাছি অচেনা দুজন শাগরেদ নোংরাভাবে হাসছিল।

টার্গেট হঠাৎই বাপির গলার কাছটা খামচে চেপে ধরল।

সঙ্গে-সঙ্গে বনবনিয়া চিৎকার করে উঠল, এ কোম্পানি, বাবুকো ছোড় দে! নেহি তো সব কুছু গড়বড় হয়ে যাবে।

নেকড়ে পাশ থেকে বনবনিয়াকে জোরালো এক লাথি কষাল।

আশ্চর্য! ওইটুকু পুঁচকে ছেলেটা ছিটকে পড়ে গেল না। ও সামান্য কাত হয়ে খর চোখে তাকাল নেকড়ের দিকে। ওর কাজল-টানা চোখ দিয়ে যেন আগুন বেরোচ্ছিল। ছোট-ছোট দু-হাত মাথার ওপরে তুলে অদ্ভুত কয়েকটা মুদ্রা দেখাল ছেলেটা। তারপর কোম্পানি হোশিয়ার! বলে চিৎকার করেই বাপিকে ঘিরে বনবন করে ঘুরপাক খেতে লাগল। ওর ধাক্কায় টার্গেট ছিটকে গেল, আর ছেলেটা ঘুরতেই লাগল।

ওর গতিবেগ বাড়তে বাড়তে এমন হল যে, শেষ পর্যন্ত একটা ঝাপসা কুয়াশার পিণ্ড বাপিকে ঘিরে পাক খাচ্ছিল। ভর দুপুরের কড়া রোদ তার ওপরে ঠিকরে পড়ে রামধনু তৈরি করে ফেলল।

আমরা অবাক হয়ে এসব কাণ্ড দেখতে লাগলাম।

নেকড়ের দল কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে পায়ে-পায়ে পিছিয়ে গেল।

ওরা সদর দরজা পেরিয়ে চলে যেতেই বনবনিয়া থামল। আমাদের সবার দিকে পালা করে তাকিয়ে হাসতে-হাসতে বলল, বদমাশ লোগ ভাগ গয়া।

বাপি থতমত খেয়ে জিগ্যেস করলেন, এসব তুই কী কাণ্ড করলি রে, বনবনিয়া!

বনবনিয়া হাত উলটে বলল, হম কুছু করেনি, বাবু। হম কুছু নেহি করতা। সব হো যাতা হ্যায়।

এ আবার কী ধরনের কথা! ও কিছু করে না, সব হয়ে যায়!

 মা আনন্দে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, তুই গেঁয়ো ভূত, না ভগবান!

সেদিন আমরা বনবনিয়াকে ধরে কষে আদর করলাম। মা ওকে দুটো রসগোল্লা খাওয়ালেন। আমি আমার সবচেয়ে প্রিয় ভিডিয়ো গেম খেলনাটা ওকে দিয়ে দিলাম।

বাপি দুশ্চিন্তার সুরে বললেন, কাজটা বোধহয় তুই ঠিক করলি না রে, বনবনিয়া। ওরা আবার আসবে। ওরা খুব সাংঘাতিক লোক।

পাকা-পাকা কথায় দিব্যি জবাব দিল ছেলেটা, কোই চিন্তা নাই, বাবু। খতরনাক আদমির সঙ্গে খেলা করতে হামার দারুণ লাগে। আও, ছোটে মালিক, লিখাই-পঢ়াই-কা টাইম হো গয়া।

শেষ কথাটা আমাকে লক্ষ করে। যত দিন যাচ্ছে ততই দেখছি বনবনিয়া আমাকে আর দিদিকে যখন-তখন জ্ঞান দিচ্ছে। এখন যে আমার পড়তে বসার সময় সেটা আমি ভালো করেই জানি।

.

একদিন রাতে আমি একটা অদ্ভুত ব্যাপার দেখলাম।

বনবনিয়া আমার ঘরে মেঝেতে বিছানা করে শোয়। সেদিন রাতে ঘুমের ঘোরে আমি বিচ্ছিরি বিচ্ছিরি স্বপ্ন দেখছিলাম। হঠাৎই ঘুম ভেঙে গিয়ে দেখি সারা শরীর ঘামে ভিজে যাচ্ছে। একইসঙ্গে কেমন যেন ভয়-ভয় করছিল। তাই ভরসা খুঁজতে পাশ ফিরে মেঝের দিকে তাকালাম–যেখানটায় বনবনিয়া শোয়।

দেখি বিছানায় ও নেই।

আমি তাড়াতাড়ি উঠে বসলাম বিছানায়। আর তখনই বাঁশির সুর শুনতে পেলাম। কেউ যেন ফিসফিস করে বাঁশি বাজাচ্ছে। সেই অস্পষ্ট মিহি সুর যেন কানের ভেতর দিয়ে মরমে পৌঁছে যাচ্ছে।

বনবনিয়া এত মিষ্টি সুরে বাঁশি বাজাতে পারে তা তো জানতাম না! কিন্তু ও গেল কোথায়!

অন্ধকারে এপাশ-ওপাশ চোখ চালিয়ে ওকে খুঁজতে লাগলাম। খুঁজে না পেয়ে যখন ভাবছি বিছানা ছেড়ে উঠে দেখব দরজার ছিটকিনি খোলা কি না, ঠিক তখনই খোলা জানলা দিয়ে বাইরে নজর গেল আমার।

আকাশে প্রায়-পূর্ণিমার চাঁদ। তাকে ঘিরে কয়েক টুকরো মেঘ। আমাদের বাগানের একটা বড় জাম গাছ চাঁদের আলো আড়াল করায় উঠোনের একটা দিক গাঢ় অন্ধকারে ঢেকে গেছে। সেই গাঢ় ছায়ার পাশেই ঠিকরে পড়েছে জ্যোৎস্নার আলো। বনবনিয়াকে সেই আলো-ছায়ার মধ্যে দেখতে পেলাম।

পরনে শুধু একটা হাফপ্যান্ট। মাথায় ফেট্টি বাঁধা। হাতে প্লাস্টিকের বাঁশি। ছেলেটা অদ্ভুত নাচের ভঙ্গিতে বাঁশি বাজাতে বাজাতে একবার আলো থেকে ছায়ায় ঢুকছে, আর-একবার ছায়া থেকে আলোয়।

কেমন এক বিচিত্র আভা ছেলেটাকে জড়িয়ে ছিল। ফলে ও গাছের ছায়ার অন্ধকারে ঢুকে পড়লেও ওকে আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম।

আমি হতবাক হয়ে বাচ্চা ছেলেটাকে দেখতে লাগলাম।

একটু পরেই দেখি ও নাচ থামিয়ে জানলায় দিকে ফিরে আসছে।

আমি তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লাম বিছানায়। ঘুমের ভান করে পড়ে রইলাম।

শুয়ে-শুয়ে ভাবতে লাগলাম, বনবনিয়া জানলা লক্ষ করে আসছে কেন। আমার ঘরের দরজা দিয়ে ঢুকতে হলে তো ওকে বাড়ির দরজা দিয়ে ঢুকে তারপর আসতে হবে। আর সেই দরজাটা তো অন্য দিকে! বনবনিয়া তো সেদিকে গেল না!

একটু পরেই নাকে সুন্দর একটা গন্ধ টের পেলাম ধূপ-ধুনোর গাঢ় গন্ধ। এ-গন্ধে নেশা ধরে যায়।

সামান্য চোখ খুলে দেখি বনবনিয়া এসে গেছে ঘরের ভেতরে। অদ্ভুত আভাটা তখনও ওর গায়ে জড়িয়ে আছে। আর সুন্দর গন্ধটাও।

আমি কেমন যেন আচ্ছন্ন হয়ে গেলাম। বনবনিয়ার এইসব উদ্ভট কাণ্ড দেখে আমার তো ভয় পাওয়ার কথা। কিন্তু কেন জানি না, একটুও ভয় করছিল না। বরং ও ঘরে ফিরে আসায় যেন বেশ ভরসা পেলাম। হঠাৎই ভীষণ ঘুম পেয়ে গেল আমার। তারপরই কখন যেন গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছি।

এ-ঘটনার কথা আমি কাউকে বলিনি। পাছে বনবনিয়া আমাদের বাড়ি ছেড়ে চলে যায়, সেই ভয়ে।

কিন্তু কয়েকদিন পর রাতে শোওয়ার সময় ওকে সেই ব্যাপারে প্রশ্ন করলাম।

ও কাজল-মাখা চোখে নিষ্পাপভাবে তাকাল আমার দিকে। মিষ্টি করে হেসে বলল, কা জানে, ছোটে মালিক। হম কুছু নেহি করতা। সব হো যাতা হ্যায়।

আমি হতবাক হয়ে ওকে দেখতে লাগলাম। সেই মুহূর্তে হঠাৎই কেমন মনে হল, বনবনিয়া আমাদের বাড়িতে বেশিদিন থাকবে না।

.

চরম দিনটা এসে গেল খুব তাড়াতাড়ি।

বনবনিয়া সন্ধে সাতটা নাগাদ আমাকে বলল, ছোটে মালিক, হামার সাথ চলো। পতঙ্গ লানে যায়েঙ্গে।

অনেক চেষ্টায় জানলাম পতঙ্গ মানে ঘুড়ি। এখন ও ঘুড়ি কিনতে যাবে! ঘুড়ি ওড়ানোর নেশা আমারও আছে। কিন্তু এখন ঘুড়ি কিনতে যাওয়ার কথা শুনলে বাপি নির্ঘাত বকবেন। আর মাও নিশ্চয়ই ছেড়ে কথা বলবেন না।

সেই আশঙ্কার কথা বনবনিয়াকে বলতেই ও ছুটে গেল পাশের ঘরে–বাপি আর মায়ের কাছে। আমিও তাড়াতাড়ি বইপত্র গুছিয়ে উঠে পড়লাম পড়ার টেবিল ছেড়ে।

পাশের ঘরে গিয়ে দেখি বনবনিয়া বাপি আর মায়ের একেবারে হাতে-পায়ে ধরাধরি। ও ইনিয়েবিনিয়ে ঘুড়ি কিনতে যাওয়ার কথা বলছে, আর বারবার বলছে ওর হাতে আর সময় নেই। ওকে যাওয়ার অনুমতি দিতেই হবে। বিনা অনুমতিতে ও যেতে পারবে না।

সময় নেই মানে! কী বলতে চায় বনবনিয়া!

যাই হোক, শেষ পর্যন্ত অনুমতি পাওয়া গেল। কী ভেবে দিদি সঙ্গে যেতে চেয়েছিল, কিন্তু বনবনিয়া বারণ করল : নেহি, ছোটে মালকিন, তোহার যানা ঠিক নেহি হ্যায়।

একটু পরেই আমরা পথে বেরোলাম। আকাশ মেঘলা। চাঁদের আলোর ছিটেফোঁটাও নেই।

 রাস্তার আলোর হঠাৎই খেয়াল করলাম, বনবনিয়া কোন ফাঁকে যেন পোশাক পালটে নিয়েছে। ওর গায়ে প্রথম দিনের সেই লাল-সবুজ ঢোলা জামা, সঙ্গে কালো হাফ-প্যান্ট। আর হাতে প্লাস্টিকের বাঁশি তো আছেই।

এবড়োখেবড়ো পিচ-খোঁড়া রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে বনবনিয়া বিড়বিড় করে বলতে লাগল, ও লোগ বহুত বদমাশ হ্যায়। বহুত আদমির সর্বনাশ করেছে।

বুঝলাম, ও নেকড়েদের কথা বলছে।

বনবনিয়ার সেদিনকার প্রতিবাদের পর নেকড়ের দল আরও দুবার এসেছে আমাদের বাড়িতে। হাবভাবে বুঝেছি, ওরা মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র সঙ্গে নিয়েই এসেছে। তবে আগের তুলনায় অনেক ভদ্রভাবে ওরা বাকি টাকার দাবি করেছে বাপির কাছে। বনবনিয়াকে মা তখন আগলে রেখেছিল–পাছে ও আগের দিনের মতো কিছু করে বসে।

ওরা চলে যাওয়ার পর বনবনিয়া আমার কাছে বসে গজগজ করছিল : পাপ কা ডালা ভর গিয়া। পাপ কা ডালা ভর গিয়া।

কাদের পাপের ডালা ভরে গেছে? ও কি নেকড়েদের কথা বলছে?

আনমনা হয়ে এইসব কথা ভাবতে-ভাবতে খেয়াল করিনি কখন যেন বাজারের মোড়ে পৌঁছে গেছি। অথচ ঘুড়ির দোকানে যেতে হলে এদিকে আসার কথা নয়। এদিক দিয়ে গেলে অনেকটা ঘুরপথ হয়।

চোখে পড়ল নেকড়ে তার পাঁচজন সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে যথারীতি হাজির। কী একটা ব্যাপার নিয়ে ওরা নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করছে।

আমাকে তাজ্জব করে দিয়ে বনবনিয়া সোজা এগিয়ে গেল ওদের দিকে। আমি ওকে ডেকে কিছু বলতে যাওয়ার আগেই বনবনিয়া নেকড়েকে লক্ষ করে চেঁচিয়ে উঠল, এ কোম্পানি, তোহার পাপ কা ডালা ভর গিয়া।

নেকড়ের দল সঙ্গে-সঙ্গে আমাদের খেয়াল করল। কানে-শোনা-যায়-না এমন ভাষায় গালিগালাজ করতে করতে ওরা তেড়ে এল আমাদের দিকে। ছজনকে ওইভাবে তেড়ে আসতে দেখে আমি ভয়ে চিৎকার করে উঠলাম, বনবনিয়া, পালিয়ে এসো।

বনবনিয়া আমার দিকে ফিরে হাসল, তারপর ওর প্লাস্টিকের বাঁশিতে ফুঁ দিল।

বাজারের মোড়ে লোকজন কম যাতায়াত করে না। তা ছাড়া ছোট-বড় দোকানপাটও অনেক। কিছু দোকান বন্ধ হয়ে গেলেও বেশ কিছু এখনও ভোলা।

গণ্ডগোলটা শুরু হতেই আমাদের ঘিরে লোকজনের ভিড় জমে গেছে। নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে মজা দেখছে সবাই।

বনবনিয়ার বাঁশিতে সুর উঠতেই একটা চেনা সুগন্ধ আমার নাকে এল। বনবনিয়াকে ঘিরে একটা আবছা আভাও যেন লক্ষ করলাম।

নেকড়ের দল ওর ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়তেই সংঘর্ষের বিশ্রী শব্দ আমার কানে এল। দেখি নেকড়েরা তিনজন হাত-বুক-মুখ চেপে রাস্তায় বসে পড়েছে। একজনের নাক ফেটে রক্ত পড়ছে। ওরা যেন কোনও পাথরের মূর্তির ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। কারণ বনবনিয়া নিশ্চলভাবে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে।

নেকড়ে ততটা আহত হয়নি। ও এক ছুটে একটা দরমা ঘেরা দোকানে ঢুকে গেল। পরমুহূর্তেই একটা লম্বা ধারালো তরোয়াল নিয়ে বেরিয়ে এল সেখান থেকে। রাস্তা আর দোকানের আলো পড়ে তরোয়ালটা ঝিকিয়ে উঠল।

 তরোয়ালটা বাগিয়ে ধরে ধীরে-ধীরে পা ফেলে বনবনিয়ার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল নেকড়ে। নোংরা গালাগাল দিয়ে বলল, তোর ন্যাড়া মাথা এক কোপে দু-ফাঁক করে দেব।

 তরোয়ালটা শূন্যে ঘুরিয়ে নেকড়ে বসিয়ে দিল বস্তুনিয়ার মাথায়।

আমি ভয়ে চিৎকার করে উঠলাম। দর্শকদের কেউ-কেউ অজান্তে আর্তনাদ করে উঠল।

কিন্তু নেকড়ের তরোয়ালটা স্রেফ বাতাস কেটে বেরিয়ে গেল। ন্যাড়া মাথা বাচ্চা ছেলেটা একইভাবে নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে।

হতভম্ব নেকড়ে অন্ধ রাগে ওকে লক্ষ করে পাগলের মতো তরোয়াল চালাতে লাগল। কিন্তু তার ফল হল একই।

শেষ পর্যন্ত ও তরোয়ালে ভর দিয়ে ঝুঁকে পড়ে হাঁপাতে লাগল।

টার্গেট আর হীরালাল বস্তুনিয়ার দিকে এগিয়ে আসছিল, বম্বনিয়া ওদের দিকে তাকিয়ে খলখল করে হেসে উঠল। ওর চোখ হঠাৎই লাল টুনি বাতি হয়ে জ্বলে উঠল। বম্বনিয়া চিৎকার করে বলে উঠল, হম কুছু নেহি করতা। সব হো যাতা হ্যায়।

টার্গেট বনবনিয়ার বুক তাক করে গুলি চালাল।

গুলিটা বোধহয় বনবনিয়ার গায়ে ঠিকরে আবার টার্গেটের দিকেই ফিরে গেছে। কারণ টার্গেট রিভলভার ফেলে দিয়ে তলপেট চেপে বসে পড়ল। ওর আঙুলের ফাঁক দিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসতে লাগল।

আমাদের চারপাশে ততক্ষণে শোরগোল শুরু হয়ে গেছে। হীরালাল দৌড়ে পালাতে যাচ্ছিল। আহত নগাও ওকে অনুসরণ করার চেষ্টা করছিল। কিন্তু বনবনিয়া বাঁশিতে সুর তুলতেই ওরা পলকে পাথর হয়ে গেল। যেন কেউ ওদের মন্ত্রবলে অবশ করে দিয়েছে।

বনবনিয়া আমার কাছে এসে মিষ্টি করে হেসে বলল, হম যাতা হ্যায়, ছোটে মালিক। এদেরকেও নিয়ে যাচ্ছি। এরা আর কখনও ফিরে আসবে না। আর কারও সর্বনাশ করবে না।

আমাদের সবাইকে স্তম্ভিত করে দিয়ে ন্যাড়া মাথায় লাল ফেট্টি বাঁধা বাচ্চা ছেলেটা বাঁশি বাজাতে-বাজাতে নাচের ভঙ্গিতে পা ফেলে রওনা হল অন্ধকারের দিকে। আর নেকড়েরা ছজন কোন অলৌকিক নির্দেশে ওকে অনুসরণ করল। ঠিক যেন হ্যাঁমেলিনের বাঁশিওয়ালা ইঁদুরের পালকে মন্ত্রমুগ্ধ করে মৃত্যুর দিকে টেনে নিয়ে চলেছে।

অন্ধকারে মিলিয়ে যাওয়ার আগে বম্বনিয়া চেঁচিয়ে বলে গেল, যব কিসিকা পাপ কা ডালা ভর যাতা হ্যায়, তব হম আতা হ্যায়।

কারও পাপের ডালা পূর্ণ হলেই বনবনিয়া আসে! বিপদ থেকে সবাইকে বাঁচায়।

বনবনিয়াকে তারপর আমি আর কখনও দেখিনি।

যদি কখনও তোমরা ভীষণ বিপদে পড়ো, অসহায় দিশেহারা হয়ে যাও, আঁকড়ে ধরার জন্যে কোনও খড়কুটোও না থাকে তখন যদি মাথায় ফেট্টি বাঁধা ন্যাড়া মাথা টিকিওয়ালা কোনও বাচ্চা ছেলেকে দেখতে পাও, চোখে কাজল, কপালে কাজলের টিপ, হাতে বাঁশি, তোমার কাছে এসে মাখন খাওয়ার পয়সা চাইছে–তো বুঝবে ও-ই হল বনবনিয়া। তবে ওর আসল নাম বোধহয় বিপত্তারণ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *