1 of 2

সম্ভাবনা খুন হয়ে যায়

সম্ভাবনা খুন হয়ে যায়

কিছুদিন আগে একটি সেমিনারে গিয়েছিলাম। বিষয়বস্তু ছিল আগামীর নেতৃত্ব (Future Leadership) বিষয়ক। তরুণেরাই মূলত বক্তা। তরুণদের কেউ আমেরিকার শিক্ষক, গবেষক। কেউবা উদ্যোক্তা। বেশির ভাগ বক্তাই একটি বিষয়ে জোর (Emphasise) দিলেন। সেটা হলো, দেশের প্রতিটি অংশ থেকেই সম্ভাবনাকে বের করে আনার চেষ্টা। অর্থাৎ সুষম ব্যবস্থার মাধ্যমে সম্ভাবনাকে অনুসন্ধান করা। শিক্ষাকে আরও সুষম করার জন্য অনেকেই ইঙ্গিত দিলেন। আমি কিছুটা অবাক হলাম! আমেরিকার মতো উন্নত সমাজ যদি এখনো এগুলো নিয়ে ভাবে, কাজ করে–তাহলে আমাদের কী অবস্থা!

বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী আসে গ্রাম থেকে। মফস্বলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর দশা কি কেউ জানে? গ্রামের। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর খোঁজখবর কি রাষ্ট্র রাখে? গ্রামের হাইস্কুলে পড়াশোনা করতে হয়েছে বলে আমি বিষয়টা গভীরভাবে জানি।

শিক্ষামন্ত্রী কি জানেন যে গ্রামের প্রতিষ্ঠানগুলোতে কখন, কারা নিয়োগ পাচ্ছেন? তিনি কি জানেন, ওখানে কী পড়ানো হয়? তিনি কি জানেন, এই দরিদ্র ছেলেমেয়েগুলোকে রাষ্ট্র কতটা অবহেলায় খে? তিনি কি জানেন, এই ছেলেমেয়েগুলো প্রকৃত শিক্ষা পায় না বলে মেধার প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারে। সারাটা জীবন কী অমানবিক সংগ্রাম করতে হয় এস

এ দেশের সবচেয়ে অবহেলিত তরুণেরা হলেন মফস্বলের। তারা না পান ভালো শিক্ষা, না পান ভালো শিক্ষক দিকনির্দেশনা। গ্রামের স্কুলের শিক্ষকেরা আইনস্টা জানেন না। তাঁরা নিউটন, রাদারফোর্ড, হাইজেনবার্গ, ভান পিকাসোর কথা জানেন না। তারা আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের কত কোনো দিন বলেননি আমাকে। কোনো দিন জগদীশের গল শোনাননি। কোনো দিন বলেননি (সত্যেন বোস নামের একটি তরুণ এই বাংলায় বসে সারা দুনিয়া তোলপাড় করতে চেয়েছিলেন। গ্রামের ছেলেমেয়েদের সামনে রোল মডেল থাকেন মুদির দোকানদার, গাঁয়ের মাস্তান, আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়া মধ্যপ্রাচ্যফেরত লোক। খুব বেশি হলে ক্রিকেটার মোস্তাফিজ। নাইলে টিভির নায়ক-নায়িকা।

আমরা যারা সেই গ্রাম থেকে পৃথিবী জয়ের স্বপ্ন নিয়ে বের হই, তাদের ২০৬টি হাড়ে কতটা কালো দাগ জমে, সেটা শব্দ দিয়ে বলে শেষ করা যাবে না। কোনো দিন না। সম্ভাবনা খুনের দেশটির নাম–আমার বাংলাদেশ। তা না হলে, আমার যে সহপাঠী আজ রাজমিস্ত্রি, সে হতে পারত আমার মতো, পৃথিবীখ্যাত স্কুলের অণুর মিস্ত্রি। যে ছেলেটি অর্থ-কড়ি হারিয়ে মধ্যপ্রাচ্যফেরত, তিনি হতে পারতেন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া কেতাদুরস্ত ব্যাংকার। যে মেয়েটি একটি দোচালা ঘরের ব্যস্ততম জননী, তিনি হতে পারতেন। নারী উদ্যোক্তা।

গ্রামের স্কুলগুলোতে শুধু একবার গিয়ে তাকিয়ে দেখুন, কত কত নিষ্পপ-মেধাবী নীরবে খুন হয়ে যাচ্ছে। হেসে হেসে তাদের খুন করা হচ্ছে। পৃথিবীর কোনো দেশের প্রান্তিক শিশু-কিশোর-তরুণ এতটা অবহেলায় থাকে না। মনে রাখবেন, মানুষ শুধু গর্ভ থেকে জন্মায়। সমাজ ও শিক্ষা তাকে মানুষ করে। আর সেই কাজটা কম রাষ্ট্রকেই। কারণ, সম্ভাবনা খুন হয়ে গেলে, সমাজটাই খুন হয়।