1 of 2

প্রিয় অভিভাবকগণ, একটু শুনুন

প্রিয় অভিভাবকগণ, একটু শুনুন

স্টকহোম ইউনিভার্সিটিতে যখন আমি গবেষণা করতে যাই, প্রথমেই বিস্মিত হই সেখানে শিক্ষার্থীদের বৈচিত্র্য দেখে। সারা দুনিয়া থেকে ছেলেমেয়েরা এসেছে পড়তে। কত ধর্মের, কত রঙের, কত জাতের। যে যার মতো পোশাক পরে চলছে। তাদের চলনে, বসনে কত ভিন্নতা। সেসব নিয়ে কারও কোনো মাথাব্যথা নেই। যুবতীরা চলছে আপন ঢঙে। কেউ তাদের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকছে না। কেউ কারও দিকে অকারণে মুহূর্ত সময় নষ্ট করে না।

একটি ক্যাম্পাসে এত ধর্মের এত বর্ণের মানুষ আগে কখনো। দেখিনি। আফ্রিকান কৃষ্ণাঙ্গ, ইউরোপিয়ান শ্বেতাঙ্গ, লাতিন আমেরিকান ও এশিয়ান বহু শিক্ষার্থীর মিলনমেলা। সত্যিকারের অভয়ারণ্য বলতে যা বোঝায়, সে ক্যাম্পাসটি যেন তা-ই। শিক্ষার্থীরা দিন-রাত লাইব্রেরিতে পড়ছে। ল্যাবরেটরিতে গবেষণা করছে। রাত ১০টা কি ১২টা পর্যন্ত বহু রুমে আলো জ্বলছে। গভীর রাতে মেয়েরা বাসায় ফিরছে। সামান্যতম কোনো দ্বিধা। নেই। ভয় নেই কারও। আমার ডিপার্টমেন্টেই ছিল মুসলিম, হিন্দু, ইহুদি এমন নানান ধর্মের গবেষক। কারও বা আবার কোনো ধর্মই নেই। তারা ধর্ম বিশ্বাস করে না। প্রকাশ্যে সবাইকে এটা বলছে। তাদের ভেতর কোনো সংকোচ নেই। কেউ কারও বিশ্বাস নিয়ে বাড়াবাড়ি করছে না।

এই অদ্ভুত সহনশীলতা আমাকে খুব নাড়া দেয়। আমি এর .ম খুঁজতে শুরু করলাম। একপর্যায়ে লক্ষ করলাম, তাদের। রক্ষা ব্যবস্থায় শিশুদের নানান সংস্কৃতি, ধর্ম ও মানুষ সম্পর্কে শেখানো হয়। একটি নির্দিষ্ট ধর্ম বছরে পর বছর না পড়িয়ে বভিন্ন ধর্ম সম্পর্কে জানানো হয়। বিভিন্ন ধর্মের ভালো শিক্ষাগুলো। দওয়া হয়। তাছাড়া শৈশব থেকে ওরা একটি বৈচিত্র্যময়। সংস্কৃতির সমাজে বড় হয়। বিভিন্ন দেশ থেকে আসা ভিন্ন। ভাষাভাষীর মানুষ দেখে বেড়ে ওঠে। পারিবারিকভাবেও সেখানের ছেলেমেয়েরা পায় উদার মানসিকতার শিক্ষা। ইউরোপ থেকে যখন আমেরিকায় যাই, তখন এই বিষয়গুলো আমেরিকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও দেখতে পাই। বৈচিত্র্য, উদারতা ও সহনশীলতার দিক দিয়ে এ অঞ্চলের বিদ্যাপীঠগুলো অনন্য। তাই সেসব প্রতিষ্ঠানে এসে জড়ো হয় সারা দুনিয়ার মেধাবী ছেলেমেয়েরা। আর একটি দেশের বিদ্যালয়গুলোতে যেভাবে শিশু-কিশোর-যুবাদের গড়ে তোলা হয়, সে দেশের সমাজে তেমনটিই প্রতিফলিত হয়।

আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো অতটা বৈচিত্র্যময় নয়। আমাদের শিক্ষার ভিত অতটা শক্ত নয়। বহু ধর্মের, বহু মতের মানুষ দেখে আমরা আশৈশব বেড়ে উঠি না। আমরা বুঝতেই পারি না পৃথিবীটা অনেক বড়। এখানে কোনো মানুষের সঙ্গে কোনো মানুষের হুবহু মিল নেই। মানবসভ্যতায় এটাই সত্য। এই অমিলের মধ্যেই সৌন্দর্য। এই অমিলের মধ্যেই মেলবন্ধন। পৃথিবীর মানুষদের ভাষা ভিন্ন। খাবারের রুচি ভিন্ন। পোশাকের ধরন ভিন্ন। বিশ্বাস, আচার, কৃষ্টি, সংস্কৃতি ভিন্ন। তাই একে অপরের প্রতি সম্মান দেখানো আবশ্যক।

সামাজিক প্রেক্ষাপট থেকে চিন্তা করলে, আমরা এক ভয়ংকর সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি এখন। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা দুর্বল। হয়ে যাচ্ছে। প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে হরহামেশা। সামাজিক অবক্ষয় বেড়েছে। চারদিকে নারী নির্যাতন, ধর্ষণ যেন নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়। রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতার সঙ্গে সঙ্গে ধর্মীয় ও অন্যান্য অসহিষ্ণতা বেড়েই চলছে। চারদিকে উগ্রবাদ ছোবল দিচ্ছে থেমে থেমে। এমন অস্থির সময়ে প্রতিটি সন্তানের জন্য পারিবারিক শিক্ষা জোরদার করা অত্যন্ত জরুরি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। পাশাপাশি ঘর থেকেই ধর্মীয় ও অন্যান্য সহনশীলতার শিক্ষা শুরু করতে হবে। শৈশব থেকেই উদার মানসিকতা তৈরির। লক্ষ্যে কাজ করতে হবে। কারণ, আজকের শিশুই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ।

আপনার শিশুটিকে ধর্ম শেখান। সঙ্গে শেখান চিত্রকলা-শিল্প সাহিত্য-বিজ্ঞান। এগুলো মানুষের মনন গড়তে সাহায্য করে। তাকে ভিন্ন ধর্ম শ্রদ্ধা করতে শেখান। তাকে আইনস্টাইনের গল্প শোনান। নিউটনের কথা বলুন। তাকে ভ্যান গগ-পিকাসোর চিত্র দেখান। তাকে শেখান রবীন্দ্র-নজরুল-হাফিজের কাব্য। তার কাছে বলুন ভ্রমণকাহিনি। সাধ্যমতো নিয়ে যান বেড়াতে। পৃথিবী দেখে দেখে বেড়ে উঠুক সে। তাকে শোনান গ্যালিলিওর কথা। এই মহাকাশের দিকে তাকিয়ে তাকে প্রশ্ন করতে বলুন, প্লিজ।

তাহলে জাগতিক বহু বিচিত্রতা দেখে সে হুট করে হোঁচট খাবে না। সে একদিন জানবে, এই পৃথিবীর কেউ কালো, কেউ বাদামি। কেউ মসজিদে যায়, কেউ সিনেগগে। কেউ পাতার ছবি আঁকে, কেউ নগ্ন নারীর। কেউ আবরু দিয়ে শরীর ঢাকে, কেউ বস্ত্রহীন ঘোরে সৈকতে। কারও বিপরীত লিঙ্গ পছন্দ, কারো। সমলিঙ্গ। সে যেন তখন রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে কুঁচকে না যায়। তার যেন মনে না হয়, নিজের শেখা আদর্শের বাইরে সবই ঘৃণ্য, সবই অন্যায়। তার যেন মনে না হয়, নিজ আদর্শের বিরুদ্ধ হলেই সশস্ত্র প্রতিবাদ করা উচিত।