1 of 2

আলোকিত সমাজের মূলমন্ত্র

আলোকিত সমাজের মূলমন্ত্র

পৃথিবীতে রাষ্ট্রের সীমা আছে, ভাষার ভিন্নতা আছে, খাবারের আলাদা সংস্কৃতি আছে, তবে জ্ঞান-গবেষণার দুনিয়া একটা। সেখানে ভাষা, খাদ্য, কাপড়-চোপড় ইত্যাদি কোনো বিষয় না। জাপানিজ ও জার্মানরা ইংরেজি ব্যবহার না করেই দুনিয়ার সেরা উদ্ভাবক জাতি। চীনারা তিন বেলা পেট ভরে ভাত খেয়েই পৃথিবী জয় করছে। বাঙালি লুঙ্গি পরে, হাত দিয়ে ভাত-মাছ খেয়েও সেটা করতে পারবে; যদি মূলমন্ত্রগুলোকে দাঁড় করানো যায়।

জ্ঞান-গবেষণায় অগ্রগতির জন্য একটা সংস্কৃতির প্রয়োজন। হয়। এটা একদিনে গড়ে ওঠে না। সেটা গড়ে তোলার জন্য বহুদিন ধরে একটা কার্যকর ফরমেট প্রয়োজন হয়। আর সেটার মূলে আছে আন্ডারস্ট্যান্ডিং, ডিসকাশন, আরগুমেন্ট ও আইডিয়া।

আন্ডারস্ট্যান্ডিং হলো কোনো বিষয় সঠিকভাবে বোঝা। একজন গবেষক বা শিক্ষক তাঁর শিক্ষার্থীদের যা পড়াবেন, যা দেখাবেন, তা ছেলেমেয়েরা সঠিকভাবে বুঝতে পারছে কি না, সেটা হলো প্রথম এবং প্রধান লক্ষণীয় বিষয়। কেউ ইংরেজিতে নিউটনের সূত্র পড়বে, কেউ পড়বে জাপানিজে, কেউ পড়বে বাংলায়–তবে সবাইকে, একই বিষয় গভীরভাবে বুঝতে হবে। কোনো বিষয় সঠিকভাবে বুঝতে না পারলে, সে বিষয়ের সৌন্দর্য। ধরা পড়ে না। সে বিষয় থেকে ভাবনার শাখা-প্রশাখা গজায় না। বনসাইয়ের মতো বুড়ো হয় ঠিকই, বিকশিত হয় না।

ডিসকাশন হলো আলোচনা। জ্ঞান-গবেষণায় এই আলোচনার বিষয়টা অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ। আলোচনা করলে মানুষের ভেতর ন নতন জানালা তৈরি হয়। সেসব জানালা দিয়ে একই বিষয়বস্তুকে নানান দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়। পৃথিবীর সব। মানষ যদি ভাবত চাঁদের দেশে বুড়ি আছে, আর সে বুড়ি সতা। কাটছে এবং সবাই যদি সেটা মেনে নিত, তাহলে মানুষ কোনো দিন চন্দ্র বিজয় করতে পারত না। মানুষ যখন আলোচনা করে, তখন তার দৃষ্টি খোলে। নতুন নতুন চোখ তৈরি হয়। তবে আলোচনা হতে হয় নিঃসঙ্কোচ এবং নির্ভয় চিত্তে। চিত্তে দ্বিধা নিয়ে আলোচনা হয় না। সেটার নাম কথাবার্তা! টকিং, বাট নট ডিসকাশন! চাবানো চুইংগামের মতো। ঘণ্টার পর ঘণ্টা চাবানো যাবে, ফলাফল থাকবে একই!

আরগুমেন্ট হলো তর্ক! যুক্তি, পরীক্ষা, গণিত ইত্যাদি-ভিত্তিক তর্ক। তর্কহীন সমাজ মৃত। আরগুমেন্ট ছাড়া জ্ঞান হলো জড় অসাড়! সেখানে কোনো প্রাণ থাকে না। আপডেটেড হয় না। জং ধরে থাকে। ঘুণে খেয়ে শাসশূন্য করে রাখে। যুক্তির তর্ককে যে সমাজ বেয়াদবির ট্যাগ দিয়ে চাপিয়ে রাখে, সেখানে বেয়াদবই থাকে–আলোকিত মানুষ থাকতে পারেন না।

আইডিয়া হলো ধারণা। পৃথিবীর যেকোনো সৃষ্টির মূলে হলো আইডিয়া। ছোট-বড় সব সৃষ্টির জন্য আইডিয়া লাগে। আইডিয়া থেকে হয় ফ্রেম বা ডিজাইন। একটা কবিতা লিখতে আইডিয়া লাগে–কী হবে সে কবিতার প্রতিপাদ্য। একটা গল্প লিখতে আইডিয়া লাগে–কী হবে সে গল্পের মূল বক্তব্য। যত উন্নত আইডিয়া, তত উন্নত ভিত্তি! সেটা রাজনীতি হোক, রাষ্ট্রনীতি হোক আর জ্ঞান-গবেষণা হোক। আমাদের দেশে তরুণদের আইডিয়াকে আমরা উদ্ভট-উদভ্রান্ত বলে অবহেলা করি। তরুণদের নতুন নতুন বিষয়ে ভাবতে উৎসাহিত করি না। অভয় দিই না।

একটা সমাজ যদি সৃষ্টিতে, উদ্ভাবনে, আবিষ্কারে ও জ্ঞান বিজ্ঞানে অনন্য হতে হয়, তাহলে এই বিষয়গুলোর চর্চা অপরিহার্য–আন্ডারস্ট্যাডিং, ডিসকাশন, আরগুমেন্ট ও আইডিয়া। (UDAI)। একটা সমাজ যদি পৃথিবীর মঞ্চে নেতৃত্ব দিতে চায়, তাহলে এই বিষয়গুলোর সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হয়। পৃথিবীর উন্নত সমাজে এই চর্চাগুলো হচ্ছে প্রতিনিয়ত। আন্ডারস্ট্যান্ডিং, ডিসকাশন, আরগুমেন্ট এবং আইডিয়া–এগুলো হলো আলোকিত সমাজের মূলমন্ত্র। কুসংস্কার, গোঁড়ামি, অন্ধত্বকে মুছে দেওয়ার অনিবার্য হাতিয়ার। আমরা কী এগুলোর চর্চা সমাজে প্রতিষ্ঠা করতে পারছি?