1 of 2

একজন ভিসি ও দীর্ঘশ্বাস

একজন ভিসি ও দীর্ঘশ্বাস

খবরের কাগজ খুললেই দেখি ওমুক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ। তমুক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির কারণে রাজনৈতিক নিয়োগ, সেশনজট! এই খবরগুলো পড়ে বুক চাপড়াই। দাঁত কটমট করে! মনের ভেতর এক তীব্র যন্ত্রণায় খবর পড়া বন্ধ করে দিতে ইচ্ছে হয়। পৃথিবীর আর কোনো দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের বিরুদ্ধে এমন খবর চোখে পড়ে না।

স্টকহোম ইউনিভার্সিটির প্রো-ভিসি ছিলেন প্রফেসর হান্স এডলফসন। সাইকেলে চেপে আসতেন। তিনি আমার শিক্ষক। অর্গানিক কেমেস্ট্রির প্রফেসর। আমাদের পড়াতেন অ্যাডভান্স অর্গানিক সিনথেসিস। পিএইচডি করেছিলেন সে দেশের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় KTH থেকে। পোস্টডক করেছিলেন। স্ক্রিপস রিসার্চ ইনস্টিটিউটে, নোবেল বিজয়ী কেমিস্টের অধীনে। প্রফেসর হান্স বর্তমানে সুইডেনের উমিও ইউনিভার্সিটির ভিসি। তাকে দেখেছি, তার কাজ দেখেছি, তাঁদের স্ট্র্যাটেজি দেখেছি। সে দেশের একজন ভিসির লক্ষ্য, কর্ম ও উদ্দেশ্য দেখেছি। একবার স্টকহোম ইউনিভার্সিটি ওয়ার্ল্ড র‍্যাঙ্কিংয়ে ৬৬তম হলো। সেটা কী করে ৫০-এর কোটায় নেওয়া যায়, সেটা নিয়ে তাঁর। কাছ থেকে কত পরিকল্পনার কথা শুনলাম। দুঃখবোধ নিয়ে ভাবলাম, তোমাদের জন্ম কেন আমাদের দেশে হয় না।

ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়ার প্রেসিডেন্টের (ভিসিতুল্য) নাম এমি গুটম্যান। বিদুষী এই নারী একজন শিক্ষক, গত লেখক। ডোনাল্ড ট্রাম্পের সরকার ক্ষমতায় আসার কাজ ইমিগ্রেশন-বিষয়ক বিভিন্ন জটিলতা তৈরি করেছে প্রতিবারই ইউপ্যানের প্রেসিডেন্ট এমি, সেটার প্রমা জানিয়েছেন। তার পাঠানো ই-মেইল সবার ইনবকো চল। তিনি সরকারের যেকোনো উল্টা-পাল্টা নিয়ম-নীতির বিড় অবস্থান নিয়ে শিক্ষার্থীদের পাশে থাকার কথা ব্যক্ত করেন। একই ঘটনা ঘটে আমেরিকার অন্য বহু বিশ্ববিদ্যালয়েও। আমি অবাক হয়ে ভাবলাম, এ দেশের একজন ভিসি, দেশের সরকারের নী বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ও তার শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ান। এসব দেশে যেন বিশ্ববিদ্যালয় নিজেই একটি রাষ্টতল প্রতিষ্ঠান! সরকারের পালাবদলের সঙ্গে এসব দেশের ভিসিরা। পরিবর্তিত হন না।

একজন ভিসি হলেন একজন অভিভাবক। তাঁর প্রতিষ্ঠানের হাজারো শিক্ষার্থীর অভিভাবক। কর্মচারী-কর্মকর্তাদের অভিভাবক। তাঁর নির্দিষ্ট কাজ থাকবে। সেগুলো নিয়েই তার দিবা-রাত কাটবে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা-গবেষণার মানোন্নয়নে সব ধরনের চেষ্টা চালাবেন। সর্বোচ্চ মেধাবীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেব নিয়োগ পাচ্ছে কি না, সেটা নিশ্চিত করবেন। প্রতিবছর সর্বোচ্চসংখ্যক আন্তর্জাতিক মানের সেমিনার সিম্পোজিয়াম অনুষ্ঠিত হচ্ছে কি না, লক্ষ রাখবেন। বিদেশের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি-প্রোভিসিদের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। সরকার ও আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে কী করে গবেষণাম অনুদান নেওয়া যায়, সেই চেষ্টা করবেন। বছর বছর গবেষণাপত্রের মান ও সংখ্যা বাড়ানোর জন্য গবেষকদের– বৈঠক করবেন। যেসব শিক্ষক শিক্ষা ও গবেষণায় পিছিয়ে থাকছেন, তাঁদের চাপ দেবেন। বিদেশের ভালো ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তার প্রতিষ্ঠানের গুণগত যে ব্যবধান, সেগুলো পুরণের চেষ্টায় নিয়োজিত থাকবেন। দেশের শিক্ষা তার উন্নয়ন নিয়ে তার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার কথা প্রচারমাধ্যমে জানাবেন। তিনি শিক্ষা ও গবেষণাবিষয়ক লেখালেখি করবেন। এগুলো হবে তার কাজ। এগুলোই হবে তার। নেশা। তিনি সময় কাটাবেন এগুলো নিয়েই। এটাই হওয়ার কথা!

অসম্ভব কষ্ট হয় যখন দেখি একজন ভিসি রাজনৈতিক কলাম। লেখা নিয়ে ব্যস্ত। সরকারের গুণগান গাইতে ব্যস্ত। বিদেশ ভ্রমণে গিয়ে উচ্ছ্বসিত, আবেগে উদ্বেলিত। মনে হয়, যেন ভিসি হওয়ার পরম সার্থকতা হলো দেশের মানুষের টাকায় বিদেশ ভ্রমণ। একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি কি জানেন না, তাঁর দায়িত্ব কী হওয়া উচিত? তিনি কি জানেন না, কী করে একটি প্রতিষ্ঠানের মানোন্নয়ন করতে হয়? তিনি কি জানেন না, তার জন্য একটি প্রতিষ্ঠান ধসে পড়তে পারে? তার ভুলের জন্য হাজারো নিষ্পাপ শিক্ষার্থী আজীবন দীর্ঘশ্বাস ফেলবেন! তার অবহেলার জন্য কত কত তরুণ-তরুণী পৃথিবীর প্রতিযোগিতা থেকে পিছিয়ে যাচ্ছেন! আমাদের ভিসিরা যদি শিক্ষা ও গবেষণার মানোন্নয়নেই ব্রত না হন, তাহলে ছেলেমেয়েদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ডেকে নেওয়ার দরকার কী? আমরা বরং অশিক্ষিতই থেকে যাই, আর ওনারা থাকুন রাজনীতি আর দল নিয়ে।

দেশের হাজারো তরুণ-তরুণী সেশনজটের কারণে দীর্ঘশ্বাস ফেলছেন। হাজারো শিক্ষার্থী মানসম্পন্ন শিক্ষা পাচ্ছেন না, শুধু রাজনৈতিক নিয়োগের কারণে। শিক্ষার্থীরা গবেষণার সামান্যতম দিকনির্দেশনা পাচ্ছে না শুধু উপযুক্ত শিক্ষক ও গবেষক নিয়োগ না দেওয়ার করণে। এগুলো যদি একজন ভিসি না দেখেন, তাহলে দেখবে কে? প্রতিষ্ঠানের মানোন্নয়ন করতে গিয়ে যদি তান সরকার কিংবা রাজনীতির দ্বারা বাধাগ্রস্ত হন, তাহলে। পদত্যাগ করবেন। তাঁর প্রতিষ্ঠানের হাজারো শিক্ষার্থীর কাছে দায়মুক্ত থাকার চেয়ে বড় আনন্দ আর কী-ই বা হতে পারে।

মাননীয় ভিসিগণ, আপনাদের কাছে করজোড়ে বলছি, নিষ্পাপ ছেলেমেয়েগুলোর কথা ভাবুন। দেশের হাজার হাজার গরিব ছেলেমেয়ে আপনাদের প্রতিষ্ঠানে পড়তে আসেন দরিদ্রতা ঘোচানোর লক্ষ্যে। নিজেকে সুশিক্ষিত করার পরিবারগুলোকে আহার-ওষুধ দিয়ে বাঁচিয়ে রাখার সুর এই গরিব ছেলেমেয়েগুলোর রাষ্ট্রীয় অধিকার হলো উন্নত শিক্ষা পাওয়া। তাঁদের ডেকে ডেকে এনে তাদের প্রতি উদাসীন হবেন না। তাঁদের জীবন ধ্বংস করবেন না, প্লিজ!