সপ্তম অঙ্ক

সপ্তম অঙ্ক

(চণ্ডালের প্রবেশ)

চণ্ডাল—ও মশাইরা, সরুন, সরুন। লোকেরা সব ভাগো ভাগো। যদি নিজের প্রাণ, সম্পত্তি, ভার্যা ও কুল রক্ষা করতে চাও, তবে রাজ-অনিষ্ট করার বিষয় চেষ্টা থেকে শত হাত দূরে থাক ॥১॥

আরো দেখ—অপথ্য সেবন করলে লোকের ব্যাধি হয়, মৃত্যুও হয়। কিন্তু রাজ-অপথ্য (রাজার অনিষ্ট) আচরণ করলে সবংশে মরতে হয় ॥২॥

তবু যদি না বিশ্বাস হয়, তবে দেখ রাজার অনিষ্টকারী শ্রেষ্ঠী চন্দনদাসকে স্ত্রীপুত্রসহ বধ্যস্থানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। (আকাশের দিকে চেয়ে শোনার অভিনয় করে) মশাইরা কী বলছেন?—‘এঁর কোনো মুক্তির উপায় হয় কি?’ হয়, মশাইরা, হয়, যদি ইনি অমাত্য রাক্ষসের পরিজনদের সমর্পণ করেন। (পুনরায় আকাশে) কী বলছেন? ‘ইনি শরণাগতের প্রতি স্নেহশীল, তাই কেবল নিজের জীবনরক্ষার জন্য এমন গর্হিত কাজ করবেন না।’ মশাইরা তবে জেনে রাখুন—এঁর সঙ্গতি হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে প্রতিকারের বিষয় চিন্তা করে তবে আপনাদের কী লাভ?

(তারপর কাঁধে শূল নিয়ে বধ্যবেশে চন্দনদাসের প্রবেশ, সঙ্গে স্ত্রী ও পুত্র, পেছনে দ্বিতীয় চণ্ডাল।)

চন্দনদাস—(সাশ্রুনেত্রে) হা ধিক্! হা ধিক্! চরিত্রস্খলনের ভয়ে ভীত আমাদের মতো লোকদেরও চোরের মতো মরতে হচ্ছে। হে মৃত্যুরাজ যম, তোমাকে নমস্কার! অথবা যারা স্বভাবত নৃশংস, তাদের কাছে দোষী-নির্দোষের কোনো ভেদ নেই। যেমন—প্রাণী-হত্যা হবে—ওই আশঙ্কায় যে হরিণ আমিষ ছেড়ে তৃণ খেয়ে প্রাণ ধারণ করে, সেই সরল হরিণকে মারবার জন্য ব্যাধের কী আগ্রহ ॥৩॥

(চারদিকে দেখে) ওই যে, প্রিয় বয়স্য বিষ্ণুদাস, আমার কথার একটা উত্তরও কেন দিবে না? অথবা, তেমন মানুষ দুর্লভ যারা এমন দুঃসময়ে চোখের সামনে থাকে। (সাশ্রুনেত্রে) ওই তো আমার প্রিয় বন্ধুরা অতিকষ্টে নিজেদের ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। মুখে তাদের পরিবর্ধমান শোকের মলিন ছায়া, চোখে তাদের প্রতিকারের একমাত্র উপায় অশ্রুর প্রবল ধারা। এমনি অশ্রুভারাক্রান্ত আকুল দৃষ্টি দিয়ে বন্ধুরা অনুগমন করছে। (পরিক্রমা)

চণ্ডাল—আর্য চন্দনদাস, বধ্যস্থানে এসে গেছেন, পরিজনদের এবার বিদায় দিন।

চন্দনদাস—গৃহিণী, এবারে স-পুত্র ফিরে যাও। এরপর আর অনুগমন করা সঙ্গত নয়।

কুটুম্বিনী—(সজলচোখে) আর্য যে লোকান্তরে যাচ্ছেন, দেশান্তরে নয়।

চন্দনদাস—আর্যে, মিত্রের স্বার্থে আমার এই মৃত্যু, ব্যক্তিগত কোনো দোষে নয়। অতএব, বিষাদে কাজ কী?

কুটুম্বিনী—আর্য, যদি তাই হয়, তবে কুলস্ত্রীর পক্ষে এটা তো ফিরে যাবার সময় নয়।

চন্দনদাস—গৃহিণীর তবে সঙ্কল্প কী?

কুটুম্বিনী—স্বামীর পদাঙ্ক অনুসরণ করে নিজেকে কৃতার্থ করতে চাই।

চন্দনদাস—আর্যে, এটা অনুচিত প্রয়াস। বেচারী পুত্র লোক-ব্যবহারে অনভিজ্ঞ বালক মাত্র। তোমার কাজ হবে তার সহায় হওয়া।

কুটুম্বিনী—দেবতারা প্রসন্ন হয়ে এর সহায় হোন। পুত্র, বাছা আমার, পিতার দুচরণে শেষবারের মতো প্রণিপাত কর!

পুত্র—(পায়ে পড়ে) বাবা, আপনি ছেড়ে চলে গেলে এরপর আমি কী করব?

চন্দনদাস—বৎস, যে দেশে চাণক্য নেই, সেখানে গিয়ে বাস করবে।

চণ্ডাল—আর্য চন্দনদাস, শূল স্থাপনা হয়েছে, প্রস্তুত হোন।

কুটুম্বিনী—আর্যরা, বাঁচান, বাঁচান।

চন্দনদাস—আর্যে, তুমি আবার এখানে আর্তনাদ করছ কেন? স্বর্গত ব্যক্তিদের শোকার্ত পরিজনদের প্রতি দেবতারা অনুকম্পা করেন। (তাছাড়া, বন্ধুর স্বার্থে আমার এ মৃত্যু, অনুচিত কোনো কাজের দরুন নয়। তবে কেন আনন্দের স্থলে তুমি রোদন করছ)?

প্রথম চণ্ডাল—ওরে বিল্বপত্র, চন্দনদাসকে ধর, পরিজনেরা আপনা থেকেই চলে যাবে।

দ্বিতীয় চণ্ডাল—ওরে বজ্রলোমা, এই ধরছি।

চন্দনদাস—ভদ্র, এক মুহূর্ত দাঁড়াও, পুত্রকে আলিঙ্গন করি। (পুত্রকে আলিঙ্গন করে, মস্তক আঘ্রাণ করে) বৎস, মৃত্যু তো অবশ্যম্ভাবী, অতএব মিত্রের কাজ করেই মৃত্যুবরণ কর।

পুত্র—বাবা, এ কি আর বলে দিতে হয়? এ যে আমাদের বংশের ধর্ম।

(পায়ে পড়ল।)

চণ্ডাল—ওরে, এঁকে ধর্। (চণ্ডাল দুজন চন্দনদাসকে ধরল।)

কুটুম্বিনী—(বুক চাপড়ে) আর্যগণ! বাঁচান, বাঁচান।

(পর্দা সরিয়ে রাক্ষসের প্রবেশ।)

রাক্ষস—সুচরিতে, আপনি ভয় পাবেন না। ওহে শূলওয়ালারা, চন্দনদাসকে আর মারতে হবে না।

যে পূর্বে শত্রুর বংশের মতো প্রভুবংশ ধ্বংস হতে দেখেছে, মিত্রদের বিপদে যে মহোৎসবের স্বাচ্ছন্দ্যে ছিল, অপমানে জর্জর হয়েও তোমাদের বধের কল্পনায় যার প্রাণ এখনও প্রিয়, সেই আমার গলায় মৃত্যুলোকে যাবার ছাড়পত্র স্বরূপ এই বধের মালা জড়িয়ে দাও ॥৪॥

চন্দনদাস—(সাশ্রুনেত্রে দেখে) অমাত্য, এ কী?

রাক্ষস—এ তোমারই সুচরিতের একাংশের অনুকরণ মাত্র।

চন্দনদাস—অমাত্য, আমাদের সকল প্রয়াস ব্যর্থ করে দিয়ে এ আপনি কী করলেন? রাক্ষস—সখা, নিজের কাজই করলাম। তিরস্কারে কাজ নেই। ভদ্রমুখ, দুরাত্মা চাণক্যকে গিয়ে বল।

বজ্ৰলোমা—কী বলব?

রাক্ষস—যে ঘোর কলিকালে শিষ্টজনরুচি বিরল, সেই দুঃসময়েও যে যশস্বী পুরুষ নিজের প্রাণের বিনিময়ে পরের প্রাণ রক্ষা করে শিবি রাজার যশকেও ম্লান করে দিয়েছেন, যে বিশুদ্ধচিত্ত পুরুষ নিজের সংস্কৃতিতে বৌদ্ধদের উদার চেষ্টাকেও তুচ্ছ করে দিয়েছেন, পূজার্হ হয়েও যার জন্য সেই পুরুষ তোমার কাছে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডনীয়, সেই আমি এসে গেছি ॥৫॥

প্রথম চণ্ডাল—ওরে বিল্বপত্র, তুই তাহলে চন্দনদাসকে ধরে এই শ্মশানতরুর ছায়ায় খানিক থাক, আমি ততক্ষণে আর্য-চাণক্যের কাছে নিবেদন করে আসি যে, অমাত্য রাক্ষস ধরা পড়েছেন।

দ্বিতীয় চণ্ডাল—হ্যাঁ রে বজ্রলোমা, তাই হোক। (স্ত্রী-পুত্রসহ চন্দনদাসকে নিয়ে নিষ্ক্রান্ত।)

প্রথম চণ্ডাল—আসুন অমাত্য। (রাক্ষসের সঙ্গে পরিক্রমা করে) এখানে কেউ আছে কি? তবে নন্দবংশরূপ পর্বতের পক্ষে বজ্রস্বরূপ এবং মৌর্য রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা আর্য চাণক্যকে নিবেদন কর যে—

রাক্ষস—(স্বগত) এও শুনতে হচ্ছে।–আর্যের নীতির প্রভাবে যাঁর বুদ্ধি বিভ্রান্ত এবং পুরুষকার প্রতিহত, সেই অমাত্য রাক্ষস ধরা পড়েছেন।

(তারপর পর্দার গা ঢেকে মুখটি মাত্র দেখিয়ে চাণক্যের প্রবেশ)

চাণক্য—ভদ্র, বল, বল—

উচ্চ-শিখা-পুঞ্জে কপিলবর্ণ জ্বলন্ত বহ্নিকে বস্ত্রাঞ্চলে কে বদ্ধ করল? সদাসঞ্চারী বায়ুকে পাশবদ্ধ করে কে নিশ্চল করল? গজ-মদগন্ধে আমোদিত যার কেশর, সেই সিংহকে কে পঞ্জরে অবরুদ্ধ করল? বহুকুম্ভীর- হাঙ্গর-সঙ্কুল ভীষণ সমুদ্র দুই বাহুর সাহায্যে কে অতিক্রম করল! ॥৬॥

চণ্ডাল—রাজনীতিতে প্রাজ্ঞ আর্যই।

চাণক্য—না, না, এরূপ বল না। বল যে, নন্দবংশ বিদ্বেষী দৈবই এসব করল।

রাক্ষস― (স্বগত) এই সেই দুরাত্মা অথবা মহাত্মা কৌটিল্য। সাগর যেমন রত্নরাশির আকর, ইনি তেমনি সর্বশাস্ত্রের আকর। বিদ্বেষ-বশে এঁর এত গুণেও কিন্তু আমরা তুষ্ট নই ॥৭॥

চাণক্য—(দেখে, সহসে, স্বগত) ও হো! এই সেই অমাত্য রাক্ষস, যে মহাত্মা—আমার বুদ্ধি এবং বৃষলের সেনাকে বিবিধ জরুরি কার্যক্রমের পরিকল্পনা ও রূপায়ণের উদ্বেগে বহু রাত্রি জাগিয়ে রেখে সুদীর্ঘকাল কত কষ্ট দিয়েছে ॥৮॥ (পর্দা সরিয়ে ফেলে, কাছে এগিয়ে আসে)

এই যে অমাত্য রাক্ষস, আমি বিষ্ণুগুপ্ত, আপনাকে অভিবাদন করছি।

রাক্ষস—(স্বগত) ‘অমাত্য’ কথাটা এখন আমার পক্ষে লজ্জাকর বিশেষণ। (প্রকাশ্যে) বিষ্ণুগুপ্ত, চণ্ডালের স্পর্শে অপবিত্র আমাকে স্পর্শ করা তোমার উচিত নয়।

চাণক্য—অমাত্য রাক্ষস, এরা দুজন চণ্ডাল নয়। একে তো আগে আপনি দেখেছেন, এ সিদ্ধার্থক নামে রাজপুরুষ। আর ওই দ্বিতীয় জন, সেই রাজপুরুষ, নাম সমিদ্ধার্থক। বেচারী শকটদাসকে কিছু না জানিয়ে তাকে দিয়েই ওইভাবে সেই কপটপত্র লিখিয়ে নিয়েছি।

রাক্ষস—(স্বগত) সৌভাগ্য বটে যে শকটদাসের প্রতি আমার সন্দেহ দূরীভূত হল।

চাণক্য—বেশি বলে কাজ নেই। সংক্ষেপে এই বলা যাক্ : ভদ্রভট প্রভৃতি সেই ভৃত্য, সেই পত্র, সেই সিদ্ধার্থক, সেই তিনখানি অলঙ্কার, আপনার তথাকথিত সুহৃদ্ সেই ভিক্ষু, জীর্ণ উদ্যানের সেই আর্ত পুরুষ এবং শ্রেষ্ঠী চন্দনদাসের এই ক্লেশ—এ সবই আমার (অর্ধেক বলে লজ্জার অভিনয়) কূটনীতি। আমি যে চাই বৃষলের সঙ্গে হে বীর, আপনার সংযোগ ঘটুক ॥৯॥

তা এই যে বৃষল আপনাকে দেখতে চায়। চলুন, দেখা করি।

রাক্ষস—(স্বগত) ক্ষতি কী? যাই, দেখাই করি।

(তারপর যথাযোগ্য পরিজনবর্গসহ রাজার প্রবেশ)

রাজা—(স্বগত) যুদ্ধ বিনাই যে আর্য দুর্জয় শত্রুসৈন্য জয় করেছেন, এতে আমি লজ্জিত বটে। আর্যের নীতির গুণে আমার সিদ্ধি সুলভ বলে, ধনুকের তীরগুলো তাদের তৃণীরের মধ্যেই চিরটা কাল অলস হয়ে পড়ে থাকবার ব্রত পালন করছে; নিজেদের (কর্মহীন করুণ দশার জন্য) শোকেই যেন তারা অধোমুখ, মুখে ফলা লাগানো সত্ত্বেও তাদের কোনো কাজে না লাগানোয় তারা যেন লজ্জায় মরে আছে ॥১॥ অথবা—আমার মতো ঘুমিয়ে থাকলেও যার রাজত্বে গুরু স্বয়ং রাজকার্যে জেগে বসে থাকেন, ধনুর গুণ খুলে রাখলেও জগতে যা কিছু জয় করবার সে তা অবশ্যই জয় করতে পারে ॥১১

(চাণক্যের কাছে এগিয়ে গিয়ে)

আর্য, চন্দ্রগুপ্ত প্রণাম করছে।

চাণক্য—বৃষল, তোমার যা কিছু ভালো চেয়েছিলাম সবই হয়েছে। দেখ, অমাত্য রাক্ষসকে আমরা পেয়ে গেছি। অতএব, মহামান্য মুখ্য অমাত্যকে অভিবাদন কর।

রাক্ষস—(স্বগত) ইনি দেখছি সম্পর্কও পাতিয়েছেন!

রাজা—(রাক্ষসের কাছে গিয়ে) আর্য, চন্দ্রগুপ্ত অভিবাদন করেছেন।

রাক্ষস—(দেখে স্বগত) হ্যাঁ, এ সেই চন্দ্রগুপ্ত, বাল্যদশাতেই যে জগতে তার ভাবী সমুন্নতির স্বাক্ষর রেখেছিল। হাতি যেমন কালে যূথপতি হয়, তেমনি ইনি ক্রমে রাজ-ঐশ্বর্য অধিকার করেছেন ॥ ১২॥

(প্রকাশ্যে) মহারাজ, আপনি জয়যুক্ত হোন।

রাজা- আর্য, ষাড়গুণ্য-চিন্তায় আমার পূজ্যপাদ আচার্য এবং আর্য স্বয়ং যখন জাগরূক, তখন ভেবে দেখুন তো জগতে কী আর আমার অবিজিত রইল ॥ ১৩॥

রাক্ষস—(স্বগত) কৌটিল্যের শিষ্য আমাকে ভৃত্যরূপে দেখছে না তো? অথবা, এটা বাস্তবিক চন্দ্রগুপ্তের বিনয়, বিদ্বেষ আমাকে বিপরীত বোঝাচ্ছে। কারণ—বিনয়াদি আত্মগুণসম্পন্ন যোগ্য জিগীষুকে আশ্রয় করে মন্দবুদ্ধি মন্ত্রী ও যশস্বীরা চির প্রতিষ্ঠা লাভ করে। কিন্তু অপদার্থ পাত্রকে আশ্রয় করলে নীতি যতই অভ্রান্ত হোক না কেন, সে মন্ত্রী তীরতরুর মতো আশ্রয় ধস হওয়ায় ধরাশায়ী হয়[৬] ॥১৪।।

চাণক্য—অমাত্য রাক্ষস, আপনি চান কি চন্দনদাস বেঁচে থাক্?

রাক্ষস—ওহে বিষ্ণুগুপ্ত, সন্দেহ কিসে?

চাণক্য—অমাত্য রাক্ষস, আপনি বৃষলকে অনুগ্রহ করেছেন বটে, (মুখ্যামাত্যের পদ মর্যাদার অভিজ্ঞান স্বরূপ) শস্ত্র তো গ্রহণ করেননি। এ জন্যই সন্দেহ। তাই, যথার্থই যদি চন্দনদাসের জীবন-রক্ষা কাম্য হয়, তবে গ্রহণ করুন এই শস্ত্র।

রাক্ষস—ওহে বিষ্ণুগুপ্ত, না না, এ কথা বল না। আমি এর যোগ্য নই, বিশেষ করে, তুমি যখন এ শস্ত্র ধারণ করেছ।

চাণক্য—অমাত্য রাক্ষস, কিসে বুঝলেন যে আমি যোগ্য, আপনি অযোগ্য? দেখুন—হে মহামতি, আপনি দৃপ্ত শত্রুর দর্প নাশ করেন। আপনার পৌরুষের এতই প্রতাপ যে, চেয়ে দেখুন এই ঘোড়াগুলোর মুখে লাগাম সর্বদা লাগানোই রয়েছে, এদের পিঠের আসনগুলো কখনও শূন্য হয়নি, ঘোড়াগুলো এভাবে কৃশকায় হয়ে গেছে। এদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকা হাতিগুলোর অবস্থা দেখুন। স্নান, আহার, বিহার, পান এবং শয়ন কোনো ব্যাপারেই এরা স্বেচ্ছামতো সুখসম্ভোগ করতে পারে না। পিঠের গদি সওয়ারি ছাড়া থাকছে না কখনই, তাই ঘষায় ঘষায় এদের পিঠের হাড় ফুলে উঠেছে ॥১৫॥

অথবা, বেশি কথায় কাজ কী? আপনি শস্ত্র গ্রহণ না করলে চন্দনদাসের প্রাণরক্ষা হবে না।

রাক্ষস- (স্বগত) নন্দস্নেহগুণে হৃদয় আমার অভিভূত; অথচ তাঁদেরই শত্রু যারা, আমি হলাম তাদের ভৃত্য। সে বৃক্ষগুলোকে নিজেই জলসিঞ্চন করে বর্ধিত করেছিলাম, তাদেরই আমি স্বহস্তে ছেদন করলাম। সুহৃদের দেহ রক্ষার জন্য শস্ত্র আমাকে গ্রহণ করতে হচ্ছে। কর্মের এমনি গতি যে তা চিরকাল বিধাতারও আজ্ঞাবহ হয় না? ॥১৬

(প্রকাশ্যে) বিষ্ণুগুপ্ত, মিত্রস্নেহকে নমস্কার, এ মানুষকে দিয়ে যে কোনো কাজ করাতে পারে। উপায় কী আর, এই আনুগত্য স্বীকার করছি।

চাণক্য–(সহর্ষে, শস্ত্র অর্পণ করে) বৃষল, বৃষল, অমাত্য রাক্ষস এক্ষণে তোমায় অনুগ্রহ করলেন। তোমার এই সৌভাগ্যে আমি অভিনন্দন জানাচ্ছি।

রাজা—আর্যের অনুগ্রহেই চন্দ্রগুপ্তের এই সৌভাগ্য সুখ।

পুরুষ—(প্রবেশ করে) আর্যের জয় হোক্। ভদ্রভট, ভাগুরায়ণ প্রমুখ এইমাত্র হাত-পা বাঁধা অবস্থায় মলয়কেতুকে নিয়ে এসে দোরগোড়ায় হাজির করছে। আর্য শুনলেন। এরপর আর্যের যা অভিরুচি।

চাণক্য—ভদ্র, অমাত্য রাক্ষসকে বল। তিনিই এখন এসব দেখবেন।

রাক্ষস—(স্বগত) এ কী! ভৃত্যে পরিণত করার পর কৌটিল্য আমাকে এখন আদেশ দিতে প্ররোচিত করছে। উপায় কী? (প্রকাশ্যে) মহারাজ চন্দ্রগুপ্ত, আপনার জানাই আছে আমি কিছুকাল মলয়কেতুর আশ্রয়ে বাস করেছিলাম, অতএব এর প্রাণ রক্ষা করুন।

রাজা–(চাণক্যের মুখের দিকে তাকালেন।)

চাণক্য—বৃষল, অমাত্য রাক্ষসের প্রথম অনুরোধের সম্মান রক্ষা করা উচিত। (পুরুষের প্রতি) ভদ্র, আমার নির্দেশমতো ভদ্রভট প্রভৃতিকে বল, ‘অমাত্য রাক্ষসের অনুরোধে দেব চন্দ্রগুপ্ত মলয়কেতুকে তার পৈতৃক বিষয়সম্পত্তি দিয়ে দিলেন। অতএব, তোমরা এর সঙ্গে যাও। এ রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত হলে পর তোমরা ফিরে আসবে।’

পুরুষ—আর্যের যা আদেশ। (পরিক্রমা)

চাণক্য—ভদ্র, দাঁড়াও, দাঁড়াও। আরো কথা আছে। দুর্গরক্ষক বিজয়পালকেও বল, ‘অমাত্য রাক্ষসকে পেয়ে পরম প্রীত চন্দ্রগুপ্ত আদেশ করলেন যে, শ্রেষ্ঠী চন্দনদাসকে পৃথিবীর সকল নগরের শ্রেষ্ঠীপদে প্রতিষ্ঠিত করা হোক্। পুনশ্চ, হস্তী-অশ্ব ব্যতিরেকে সকলের বন্ধন মোচন করা হোক্।’ অথবা অমাত্য রাক্ষস যেখানে নেতৃত্বে, সেখানে হস্তী-অশ্বের কী প্রয়োজন? তাই, এখন—হস্তী-অশ্ব ব্যতিরেকে সকলের বন্ধন মোচন কর। প্রতিজ্ঞা আমার পূর্ণ, তাই আমি এখন কেবল শিখা বন্ধন করি ॥১৭।।

পুরুষ—আর্যের আজ্ঞা! ( নিষ্ক্রান্ত। )

চাণক্য—হে রাজন্ চন্দ্রগুপ্ত, হে অমাত্য রাক্ষস, বলুন আপনাদের আর কোন প্ৰিয় কাজ করব।

রাজা–এর পরেও কি প্রিয় আছে? নন্দরা সকলে উন্মুলিত হয়েছে, আমি রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছি, রাক্ষসের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপিত হয়েছে। এর চাইতে প্ৰিয় কোন্ কাজ করা করণীয় আছে।[৮]

রাক্ষস—তথাপি এই হোক্ ভরতবাক্য—পুরাকালে পৃথিবী প্রলয়পয়োধি নিমগ্ন হলে তার উদ্ধারের জন্য স্বয়ম্ভু বিষ্ণু শূকর রূপ ধারণ করেছিলেন। তাঁর ধরণী-ধারণ-সমর্থ দন্তাগ্রের আশ্রয় নিয়ে পৃথিবী সে যাত্রা রক্ষা পেয়েছিল। সম্প্রতি পৃথিবী আবার ম্লেচ্ছদের উপদ্রবে বিপন্ন হয়েছিল। ভগবান্ স্বয়ম্ভূ এবারে রাজমূর্তি ধারণ করে অবতীর্ণ হলে পৃথিবী তাঁর দুই বাহুর আশ্রয়ে এসে নিরুপদ্রব হল। ভগবান্ বিষ্ণুর রাজমূর্তি এই পার্থিব চন্দ্রগুপ্ত চিরকাল পৃথিবীকে পালন করুন, তাঁর আত্মীয়, বন্ধু, এবং ভৃত্যবর্গের শ্রীবৃদ্ধি হোক্ ॥১৯॥

(সকলে নিষ্ক্রান্ত)

॥ সপ্তম অঙ্ক সমাপ্ত ॥

॥ বিশাখদত্ত বিরচিত মুদ্রারাক্ষস নাটক সমাপ্ত ॥

***

প্রসঙ্গকথা – সপ্তম অঙ্ক

১ . তুলনীয় :

“তং ষস্তু দ্বেষ্টি সম্মোহাৎ স বিনশ্যত্যসংশয়ম্‌
তস্য হ্যাণ্ড বিনাশায় রাজা প্রকৃরূতে মনঃ।”
–যে মূঢ়তাবশে রাজার প্রতি দ্বেষ-পরায়ণ হয়, সে নিশ্চিত বিনষ্ট হয়। কারণ, তার আশু বিনাশের জন্য রাজা সচেষ্ট হয়! (মনুসংহিতা ৭/১২)

২. শ্লোকটির মাধ্যমে চন্দনদাসের চরিত্রের কোমল-মধুর আর একটি দিক কত সুন্দর এবং সহজভাবে ফুটে উঠেছে! নিজের বক্তব্যকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্যই শ্লোকটি উচ্চারিত হয়েছে। মর্মার্থ এই যে, নিষ্ঠুর দুরাত্মার কাছে নিরপরাধ বা নিরীহ, এমনকি অহিংস তপস্বীরও রেহাই নেই।

৩. ঔশীনরীয় যশঃ= উশীনরপুত্র শিবির যশ (উশীনরস্য অপতৎপুমান্ ঔশীনরঃ, তস্যেদম্)! কাশীরাজ উশীনরপুত্র শিবির কাহিনী বহু গ্রন্থে উল্লিখিত রয়েছে। তাঁর ত্যাগের কাহিনী পূর্বে আমরা বিবৃত করেছি।

বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের ত্যাগব্রতের এই সপ্রশংস উল্লেখ থেকে এটা প্রতীত হয় যে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের পাশে বৌদ্ধধর্মের উদার আদর্শ ও ত্যাগব্রতের জনপ্রিয়তা তখনও ক্ষুণ্ণ হয়নি! বৌদ্ধদের গুণকীর্তি নাটকটির প্রাচীনত্বের সপক্ষে বড়ো সাক্ষ্যও বটে।

৪. অনেকপ= হস্তী [অনেকাভ্যাং (দ্বাভ্যং) পিবতি ইতি অনেক—পা+ক>অনেকপ]।

৫. চণ্ডালের (চণ্ডালবেশী রাজপুরুষের) মুখে তাঁর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা শুনে মুহূর্তের মধ্যেই চাণক্য তার নিষেধ-উক্তির মাধ্যমে রাক্ষসের মনের উপর সান্ত্বনার প্রলেপ দিতে চাইলেন এবং বললেন যে, যা কিছু অসাধ্য সাধিত হয়েছে, তার প্রযোজক কর্তা স্বয়ং নন্দকুলবিদ্বেষী দৈব। চাণক্য-চরিত্রে দৈববিশ্বাসের কোনো স্থান নেই, অথচ এখানে চাণক্য সেই দৈবেরই দোহাই দিলেন। এতে রাক্ষসের মতন একজন বরণীয় বীরের কাছে চাণক্য আত্মশ্লাঘার লজ্জা থেকে নিষ্কৃতি পেলেন; রাক্ষসের পুরুষকার এবং একনিষ্ঠ প্রযত্নের প্রতি সম্মানও দেখানো হল (“ন চ দৈবাৎ পরং বলম্”)। এ ভৃত্যজনের কাছে চাণক্যের সৌজন্যও প্রকট হল। উপরন্তু, রাক্ষসের যে দৈবে কতখানি বিশ্বাস, সেটা চাণক্য নিশ্চয়ই জানতেন; তাই ওই মুহূর্তে ওইরূপ মন্তব্যে তাঁর মনস্তাত্ত্বিক-বিশ্লেষণপটুতার পরিচয়ও পাওয়া গেল।

৬. ‘দ্রব্য’ এবং ‘অদ্রব্য’ কথা দুটি এখানে বাংলায় বহুপ্রচলিত ‘পদার্থ’ এবং ‘অপদার্থ’ শব্দ দুটির মতোই শোনায়। অর্থও তাই অবশ্য—অর্থশাস্ত্রের দৃষ্টিতে ‘দ্রব্য’ বলতে আত্মগুণসম্পন্ন রাজাকেই বোঝা উচিত। ‘অদ্রব্য’র অর্থ হবে তার বিপরীত।

৭. তুলনীয়—“বিষবৃক্ষোঽপি সংবধ্য স্বয়ং ছেতুমসাম্প্রতম্।” (কুমারসম্ভব )

৮. এই মুহূর্তে এরকম একটি শ্লোকের ‘ঔচিত্য’ সম্পর্কে প্রশ্ন জাগে। যে রাক্ষসকে মহামাত্যরূপে পাবার জন্য এত কিছু, আজ তাঁকে পেয়ে তাঁরই সম্মুখে তাঁর সর্বাপেক্ষা অপ্রিয় প্রসঙ্গ নন্দবংশধ্বংসের কথা এভাবে না তুললেই কি নয়? নাটকের শোভন- সুন্দর সমাপ্তির মুখে তাই এ শ্লোকটি কেমন বেমানান। অবশ্য—অনেক পাণ্ডুলিপিতে এ শ্লোকটি অনুপস্থিত।

৯. তুলনীয় :

“উদ্ধৃতাসি বরাহেণ কৃষ্ণেন শতবাহুনা তৈত্তিরীয় আরণ্যক!

তৈত্তিরীয় আরণ্যক অনুসারে প্রজাপতি (পরবর্তীকালে ব্রহ্মা বলে খ্যাত) সীমাহীন সলিলরাশি থেকে পৃথিবীকে উদ্ধার করেছিলেন। হরিবংশে কিন্তু অন্য রকম বলা হয়েছে : পর্বতভারে পৃথিবী অনন্ত অগাধ জলরাশিতে মগ্ন হলে ভগবান্ বিষ্ণু বরাহরূপ ধরে তাকে জল থেকে উদ্ধার করেন। ‘আত্মযোনি’ শব্দটি (যার পর্যায়শব্দ আত্মভু) এখানে ‘বিষ্ণু’ অর্থেই প্রযুক্ত হয়েছে। রাজমূর্তি—রাজা যে বিষ্ণু অবতার অর্থাৎ বিষ্ণুই যে রাজার মূর্তিতে জগতে জগৎশাসনের জন্য নেমে আসেন, এ মতই এখানে ব্যক্ত হয়েছে। তুলনীয় —“State is the march of God on earth”—Hegel. চন্দ্রগুপ্ত—‘পাঠান্তর’ ভূমিকায় কাল-নির্ণয় প্রসঙ্গে আলোচিত হয়েছে! ‘চন্দ্ৰগুপ্ত’—পাঠটিই শ্রেয়ঃ, তাতে রাক্ষসের পক্ষে নবীন রাজা মৌর্য চন্দ্রগুপ্তের প্রশস্তি ও শুভাশংসা যেমন সঙ্গতিপূর্ণ হয় (নাটকের দিক থেকে), তেমনি নাট্যকার বিশাখদত্তের পৃষ্ঠপোষক সম্রাট দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের প্রশস্তি ও আশীর্বচনও সুসঙ্গত হয়। “চন্দ্রগুপ্ত’ পদটির এই শ্লিষ্ট প্রয়োগে দুটি উদ্দেশ্যই সুন্দরভাবে সুসংশ্লিষ্ট হয়। অতএব এই পাঠটিই বরণীয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *