ষষ্ঠ অঙ্ক
(তারপর অলঙ্কার শোভিত উৎফুল্ল সিদ্ধার্থকের প্রবেশ।)
সিদ্ধার্থক ঘনশ্যাম ‘কেশী’ হন্তা কেশবের জয়! লোকলোচন চন্দ্রমা চন্দ্রগুপ্তের জয়!! যার মহিমায় সকল জয়ের কার্য সিদ্ধ এবং প্রতিপক্ষ পর্যুদস্ত, আর্য চাণক্যের সেই নীতির জয়!!! ॥১॥
আজ বহুদিন পর প্রিয় বয়স্য সমিদ্ধার্থককে গিয়ে দেখি। (পরিক্রমা করে ও দেখে) এই যে আমার প্রিয় বয়স্য সমিদ্ধার্থক এদিকেই আসছে। যাই তবে এগিয়ে ওর কাছে।
(তারপর সমিদ্ধার্থকের প্রবেশ)
সমিদ্ধার্থক—সন্তাপে যার উপস্থিতি চন্দ্রের মতো প্রীতিপ্রদ, গৃহে কোনো উৎসব হলে যে সবার সঙ্গে আনন্দ করে, সেই বন্ধুর কথা সারাক্ষণ হৃদয়জুড়ে থাকে। এমন বন্ধুর বিরহে প্রাচুর্য দুঃখ দেয় ॥২॥
আমি শুনেছি, প্রিয় রহস্য সিদ্ধার্থক মলয়কেতুর শিবির থেকে ফিরে এসেছে। তবে যাই, খুঁজি একে। (পরিক্রমা করল। দেখে) এই যে সিদ্ধার্থক।
সিদ্ধার্থক–(কাছে গিয়ে) আরে, সমিদ্ধার্থক যে! প্রিয়বয়স্যের সব খবর সুখের তো?
(পরস্পর আলিঙ্গন করল। )
সমিদ্ধার্থক—বয়স্য, সুখ আমার কেমন করে হবে? দীর্ঘ প্রবাসের পর ফিরে এসে তুমি আজ অবধি আমার বাড়ি গেলে না!
সিদ্ধার্থক–মাফ কর, ভাই। দেখামাত্র আর্য চাণক্য আদেশ করলেন, ‘সিদ্ধার্থক যাও, এই সুখের সংবাদটা মহারাজ চন্দ্রশ্রীকে জানিয়ে এস।’ তাই সংবাদটা তাঁকে দিয়ে রাজ-অনুগ্রহ লাভ করে প্রিয়বয়স্যকে দেখব বলে তোমার বাড়িতেই চলেছি।
সমিদ্ধার্থক—বয়স্য, যদি আমার শোনার মতো হয়, তবে বল দেখি কী সেই প্রিয় সংবাদ যা তুমি প্রিয়দর্শন চন্দ্রশ্রীর কাছে নিবেদন করে এলে।
সিদ্ধার্থক—বয়স্য, তোমাকে না শোনানোর কীই-বা আছ? শোন তবে। ব্যাপারটা হল : চাণক্যের নীতিতে বিভ্রান্ত হয়ে হতভাগা মলয়কেতু রাক্ষসকে তাড়িয়ে দিল এবং চিত্রবর্মা প্রমুখ প্রধান প্রধান পাঁচজন রাজাকে মেরে ফেলল। তখন মিত্র রাজেরা ভাবল, এ দুরাচার অগ্র-পশ্চাৎ বিবেচনা না করেই কাজ করে। নিরাপত্তার জন্য তারা মলয়কেতুর শিবির ত্যাগ করে ভয়ে ভয়ে নিজ নিজ রাজ্যে প্রস্থান করল। সামন্তরাজদের সকলের মনোবল গেল ভেঙে। অবশিষ্ট সৈনিক পরিবারগুলো ভয়ে কাঁপতে লাগল। এই পরিস্থিতিতে ভদ্রভট, পুরুষদত্ত, ডিঙ্গরাত, বলগুপ্ত, রাজসেন, ভাগুরায়ণ, রোহিতাক্ষ, বিজয়বর্মা প্রমুখ পুরুষেরা মলয়কেতুকে বন্দি করে ফেলল। সমিদ্ধার্থক—বয়স্য, লোকে বলে ভদ্রভট প্রভৃতি মহারাজ চন্দ্রগুপ্তের প্রতি বিরক্ত হয়ে মলয়কেতুকে গিয়ে আশ্রয় করেছে। তবে কেন কুকবির করা নাটকের মতো—শুরুতে এক, শেষে অন্য?
সিদ্ধার্থক—বয়স্য, দৈবের গতির ন্যায় চাণক্য-নীতির গতি আগে থেকে বোঝা যায় না। এ নীতিকে নমস্কার।
সমিদ্ধার্থক—তারপর, তারপর?
সিদ্ধার্থক—তারপর আর্য চাণক্য বহু বাছা বাছা সৈন্য নিয়ে নগর থেকে বেরিয়ে গিয়ে রাজাদের পরিত্যক্ত সমস্ত ম্লেচ্ছ সেনাকে ছত্রভঙ্গ করে দিলেন।
সমিদ্ধার্থক—বয়স্য, সেটা কোথায়?
সিদ্ধার্থক—ওই যেখানে হস্তীগুলো অতি প্রবল মদগর্বে সজল মেঘের অনুকরণে গর্জন করছে এবং কশাঘাতের ভয়ে কম্পমান অশ্বগুলো লাফিয়ে লাফিয়ে দ্রুত জয়শব্দের উত্তেজনায় ধাবিত হচ্ছে ॥৩॥
সমিদ্ধার্থক–বয়স্য, সে যা হোক্। ওইভাবে সমস্ত লোকের সামনে কাজ ছেড়ে দিয়ে আর্য চাণক্য এতদিন বসে থেকে আবার গিয়ে সেই মন্ত্রীপদেই বসলেন কেন?
সিদ্ধার্থক—এখন দেখছি তুমি অতি ছেলেমানুষ, কারণ যে আর্য-চাণক্য-চরিত্র অমাত্য রাক্ষসও আগে থেকে বুঝতে পারেন না, তাই তুমি বুঝতে চাইছ।
সমিদ্ধার্থক—বয়স্য, অমাত্য রাক্ষস এখন কোথায়?
সিদ্ধার্থক—ওদিকে ভয়ভ্রান্তি বেড়ে গেলে মলয়কেতুর শিবির থেকে বেরিয়ে এই পাটলিপুত্রে এসেছেন। উদুম্বর নামে চর তাঁর অনুসরণ করছিল। সে-ই আর্য চাণক্যকে একথা জানিয়েছে।
সমিদ্ধার্থক—বয়স্য, অমাত্য রাক্ষস নন্দরাজ্য ফিরিয়ে আনবার জন্য কৃতসংকল্প হয়ে নগর ছেড়ে গিয়েছিলেন, সম্প্রতি অকৃতকার্য হয়ে সেই পাটলিপুত্রেই আবার ফিরে এলেন?
সিদ্ধার্থক—বয়স্য, আন্দাজ করি, চন্দনদাসের প্রতি স্নেহের টানে এসেছেন।
সমিদ্ধার্থক—বয়স্য, মনে হচ্ছে যেন চন্দনদাসের মুক্তি হবে।
সিদ্ধার্থক—সে হতভাগার মুক্তি কিসে? আর্য চাণক্যের আজ্ঞায় তাকে তো এক্ষুনি আমাদের বধ্যভূমিতে নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলতে হবে।
সমিদ্ধার্থক—(সক্রোধে) আর্য চাণক্যের কি আর কোনো ঘাতক ছিল না যে এরকম সব অতি নৃশংস কাজে আমাদের দুজনকে নিযুক্ত করলেন?
সিদ্ধার্থক—বয়স্য, এ সংসারে প্রাণে বেঁচে থাকতে ইচ্ছুক কার সাধ্য আর্য চাণক্যের আজ্ঞার বিরুদ্ধে যায়? এসো তবে, চণ্ডাল-বেশধারী হয়ে আমরা দুজনে চন্দনদাসকে বধ্যস্থানে নিয়ে যাই। (উভয়ে নিষ্ক্রান্ত)
(প্রবেশক সমাপ্ত।)
(তারপর রজ্জুহাতে পুরুষের প্রবেশ)
পুরুষ—আর্য চাণক্যের নীতি যেন একগাছা দড়ি। ছয়গুণের সংযোগে সে নীতি যেমন দৃঢ়, ছয়টা পাক দেওয়ায় এ দড়িও তেমন শক্ত। শত্রুকে শায়েস্তা করতে সেই নীতির মতো এই দড়িও সদা-প্রস্তুত। একে একে উপায়ের প্রয়োগে নীতির প্রধান পদ্ধতি যেমন রচনা করা হয়েছে, চারটি কৌশল ক্রমে খাটিয়ে দড়ির মুখের ফাঁসটিও তেমনি তৈরি করা হয়েছে। এ হেন চাণক্য নীতি-রজ্জুর জয় হোক্ ॥৪॥
(পরিক্রমা করে, দেখে) এ সেই জায়গা যেখানকার কথা উদুম্বর আর্য চাণক্যকে বলেছিল, চাণক্যের আদেশে এখানে এসে আমার অমাত্য রাক্ষসকে খোঁজার কথা। (দেখে) ওই তো অমাত্য রাক্ষস মাথায় কাপড় ঢাকা দিয়ে এদিকেই আসছেন। ঠিক আছে, ভাঙা বাগানবাড়ির এই গাছগুলোর আড়ালে লুকিয়ে থেকে দেখি কোথায় ইনি বসেন! (পরিক্রমা করে, দাঁড়াল)
(তারপর যথানির্দিষ্ট সশস্ত্র রাক্ষসের প্রবেশ)
রাক্ষস—(সাশ্রুনেত্রে) কী কষ্ট! ওঃ কী কষ্ট!! আশ্রয় নষ্ট হওয়ায় কুলটা স্ত্রীর মতো কাতর লক্ষ্মী ভিন্ন লোকের আয়ত্তে চলে গেল। প্রভু-ভক্তি ভুলে গিয়ে প্রজারা গড্ডলিকা প্রবাহের ন্যায় তাকেই অনুসরণ করল। অতি বিশ্বাসী লোকেরা চেষ্টা করেও তাদের পুরুষকারের ফল পেল না, কাজের ভার দিল তাই ছেড়ে। অথবা কি-ই বা তারা করবে? মাথা-না-থাকা দেহের অঙ্গের মতো তারা নিশ্চেষ্ট হয়ে রয়েছে ॥৫॥
আবার—পরম কুলীন, দেবচরিত্র, পৃথিবী-পতি প্রভুকে লক্ষ্মী কোন এক ছুতোয় ছেড়ে দুর্বিনীতা বৃষলীর (শূদ্রার) মতো মিলল গিয়ে বৃষলের সঙ্গে। তারপর সে তার কাছেই টিকে রইল। এ ব্যাপারে আমরা কীই-বা করব? শত্রুতা করে দৈব আমাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টাকেও ব্যর্থ করে দিচ্ছে ॥৬॥
প্রভু নন্দের পক্ষে নিতান্ত বে-মানান ছিল সেই মৃত্যু। যা হোক্, সেভাবেই তিনি যখন স্বর্গে গেলেন, পর্বতেশ্বরকে অবলম্বন করে আমি তখন রাজ্যোদ্ধারের চেষ্টা করলাম। পর্বতেশ্বরও নিহত হলেন। তখন তাঁর পুত্রকে আশ্রয় করে চেষ্টা চালালাম। তবুও কোনো ফল হল না। বস্তুত দৈবই হচ্ছে নন্দকুলের শত্রু, ওই ব্রাহ্মণ নয় ॥৭॥
ওঃ, সেই ম্লেচ্ছ কী বিবেকহীন! প্রভু সমূলে উন্মুলিত হলেও যে এখনও তাঁর সেবা করে চলেছে, সেই রাক্ষস অক্ষতদেহে কি তাঁর শত্রুদের সঙ্গে সন্ধি করবে? ম্লেচ্ছটার মনে বিবেকবুদ্ধি বলে কিছু নেই, তাই এ ব্যাপারটা সে একবার ভেবেও দেখল না। অথবা এ তার দোষ নয়; দৈব প্রতিকূল হলে মানুষের বুদ্ধি সব ওলটপালট হয়ে যায় ॥৮॥
সে যা হোক্, এখনও রাক্ষস শত্রুর হাতে প্রাণ দিতে প্রস্তুত, কিন্তু চন্দ্রগুপ্তের সঙ্গে সন্ধি সে করবে না। অথবা প্রতিশ্রুতিমতো কাজ করিনি—এই অযশই বরং হোক, কিন্তু শত্রুর ছলনার শিকার হয়েছি, এ অপবাদ ভালো নয়। (চারদিকে দেখে সাশ্রুনেত্রে) কুসুমপুরের উপকণ্ঠে এই সকল স্থানগুলো প্রভুর অভ্যস্ত পদসঞ্চারে পবিত্র হয়ে আছে। কারণ, এখানে—এই যে এইখানটায় প্রভু, নন্দ অশ্বারোহণে মৃগয়া করতে এসে ধনুকের ছিলায় টান দিলে ঘোড়ার লাগামের[২] রজ্জু আল্গা হয়ে গেল, ঘোড়া ছুটতে লাগল আশ্চর্য বেগে, ততক্ষণে শিকারের জন্তুও ধেয়ে চলেছে তেমনি দ্রুত পদক্ষেপে। ঠিক এই মুহূর্তে অপূর্ব দক্ষতায় তিনি চঞ্চল লক্ষ্যকে বাণবিদ্ধ করলেন। এই বাগানগুলোতে তিনি থাকতেন, এই জায়গাটায় সামন্ত নৃপদের সঙ্গে কথা বলতেন। এখন তাঁরা কেউ আর নেই। এ অবস্থায় কুসুমপুরের এই জায়গাগুলো দেখে আমার অতি দারুণ কষ্ট হচ্ছে ॥৯॥
মন্দভাগ্য আমি তবে কোথায় যাই? (দেখে) ওই তো জীর্ণ উদ্যান দেখা যাচ্ছে। ওইখানে প্রবেশ করে কারো কাছ থেকে চন্দনদাসের সংবাদ সংগ্রহ করব। সত্যি, মানুষের জীবনে ভালো-মন্দ অবস্থা পরিবর্তন আগে থেকে বোঝা যায় না। কেননা—আগে যখন আমি নগরের বাইরে যেতাম, রাজার মতো যেতাম; সহস্র নৃপতি থাকত আমায় ঘিরে; পুরবাসীরা আমাকে প্রতিপদের চাঁদের মতো আঙুল দিয়ে কতজনকে দেখিয়ে দিত, আর আমিও চলতাম তখন ধীরে ধীরে। সমস্ত শ্রম ব্যর্থ হয়ে যাবার পর আজ সেই আমি আবার সেই নগরেরই এক ভাঙা বাগানে চোরের মতো ভয়ে ভয়ে ঢুকে পড়ছি ॥১০॥
আর, আশ্চর্যের কী আছে? যাঁদের অনুগ্রহে আমার এত জাঁক ছিল, তাঁরাই তো নেই। (ঢোকার অভিনয় করে এবং দেখে) হায়! এই জীর্ণ উদ্যানের কী করুণ দশা! এই যে এখানে—মহৎ কৃতিত্বে সমৃদ্ধ বংশের মতো স্থাপত্যের মহৎ নিদর্শন স্বরূপ নির্মিত এই সৌধখানি ভগ্নদশা প্রাপ্ত হয়েছে, মিত্র-বিনাশে সুজনের হৃদয়ের মতো সরোবরটি শুকিয়ে গেছে; প্ৰতিকূল নিয়তির মুখে নীতির মতনই গাছগুলো ফলহীন। মূর্খের মন যেমন কুবুদ্ধিতে ছেয়ে যায়, জমিও তেমনি ঘাসে ঘাসে ঢেকে গেছে ॥১১॥ আবার- শাণিত-কঠোর-কুঠারাঘাতে তরুশাখাগুলো ক্ষতবিক্ষত; শাখাস্থিত কপোতদের অবিরত কূজনে যেন তাদেরই ব্যথার প্রকাশ। চিরপরিচিত শাখার ব্যথায় সহানুভূতিশীল সর্পেরা যেন দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে তাদের নিজ খোলস দিয়ে ক্ষতস্থানগুলো বেঁধে দিচ্ছে! ॥১২।। আবার এদিকে এই দুর্ভাগা গাছগুলো—যাদের ভেতরটা স্পষ্ট শুকিয়ে গেছে, অতি বড় শোকের চিহ্নস্বরূপ সারা গায়ে যাদের কীটের ক্ষত, পত্রাভাবে ছায়ালোপ পাওয়ায় চেহারা যাদের মলিন, তারা যেন বিপদ্গ্ৰস্ত হয়ে শ্মশানযাত্রার জন্য তৈরি হচ্ছে ॥১৩॥
এ বাড়ির যা চরম দশা তাতে যেখানে-সেখানে ভাঙা পাথরের পাটা এখন সহজেই পাওয়া যায়। যাই, এই ভাঙা পাটাটার উপরে খানিক বসি। (বসে এবং শুনে) এ কী? হঠাৎ এ সময়ে জোর ঢাকের বাজনা, শঙ্খের ধ্বনি মিলে এক বিরাট উৎসবের কলকল শোনা যাচ্ছে। এ শব্দ এত তুমুল যে শ্রোতাদের অসহায় কর্ণেন্দ্রিয়ের কষ্ট হচ্ছে, এত বিপুল এ শব্দ প্রাসাদগুলোর মধ্যে প্রবেশ করে স্থান সঙ্কুলান না হওয়ায় সহসা নিষ্ক্রান্ত হচ্ছে! প্রাসাদগুলো যেন পূর্বে পান করা অপ্রমেয় ওই শব্দকে আত্মসাৎ করতে না পেরে পরে বমি করে ফেলেছে। ওই আনন্দনাদ প্রবল পটহ ও শঙ্খধ্বনির সঙ্গে মিশে গিয়ে যেন কৌতূহলবশে দিমণ্ডলের দৈর্ঘ্য পরিমাপ করবার জন্যই চতুর্দিকে পরিব্যাপ্ত হচ্ছে ॥১৪॥
(চিন্তা করে) ওঃ বুঝেছি। মলয়কেতুর অন্তরীণ উপলক্ষেই এ শব্দ। এতে বোঝা যাচ্ছে রাজপ্রাসাদে (অর্ধেক বলে, ঈর্ষার প্রকাশসহ) মৌর্যের রাজপ্রাসাদে আজ মহাআনন্দ। (সাশ্রুনেত্রে) কষ্ট! উঃ কী কষ্ট! বিধাতা শত্রুর সম্পদের কথা আমাকে শুনিয়েছেন এবং ওখানে এনে দেখিয়েছেন। মনে হয়, বিধাতা এখন আমাকে তা অনুভব করাতে সচেষ্ট হয়েছেন ॥১৫॥
পুরুষ—ইনি বসে পড়েছেন। এবারে আর্য চাণক্যের আদেশ পালন করি।
(রাক্ষসকে যেন দেখে নাই এমনভাবে তার সামনে দড়ির ফাঁস গলায় জড়াতে লাগল)
রাক্ষস—(দেখে) এ কী! এ কেন এভাবে নিজেকে ফাঁসিতে ঝোলাচ্ছে? বেচারী আমার মতো দুঃখী। যাক্ গে, একে জিগ্যেস করি। (কাছে গিয়ে) ভদ্র, এ কী করছ?
পুরুষ—(সজল চোখে) প্রিয় সখার বিনাশের দুঃখে আমাদের মতো মন্দভাগ্যরা যা করে থাকে, তাই।
রাক্ষস–(স্বগত) আগেই আমি বুঝেছি এ বেচারী নিশ্চিত আমার মতোই দুঃখী। (প্রকাশ্যে) তোমারও দেখছি ভাই আমার মতনই বিপদ! তা যদি ব্যাপারটা গোপনীয় না হয় বা বলতে তোমার খুব কষ্ট না হয়, তবে শুনতে চাই।
পুরুষ–আর্য, গোপনীয়ও নয়, অতি কষ্টকরও নয়। কিন্তু প্রিয় সখার বিনাশের আশঙ্কায় আমার হৃদয় উৎকণ্ঠিত। মৃত্যুর মুহূর্তমাত্র বিলম্বও আমি সইতে পারছি না।
রাক্ষস– (নিশ্বাস ফেলে, আত্মগত) হায়! বন্ধুর বিপদে আমি অচেনা লোকের মতো উদাসীন। এ ব্যক্তি আমাকে লজ্জা দিচ্ছে। (প্রকাশ্যে) ভদ্র, যদি গোপনীয় বা অতি ক্লেশকর না-ই হয়, তবে শুনতে চাই!
পুরুষ—সত্যি, আর্যের এত আগ্রহ। কী করি? বলেই ফেলি। এই নগরে বিষ্ণুদাস নামে এক মণিকার শ্রেষ্ঠী আছেন।
রাক্ষস—(স্বগত) বিষ্ণুদাস তো চন্দনদাসের পরম সুহৃদ্। (প্রকাশ্যে) তার কী?
পুরুষ—তিনি আমার প্রিয় সখা—
রাক্ষস― (সহর্ষে, আত্মগত) অ্যা এ যে, ‘প্রিয় সখা’ বলছে! সম্পর্ক অতি নিবিড়। হ্যাঁ, চন্দনদাসের খবর এ জানবে।
পুরুষ—এই কিছুক্ষণ পূর্বে তিনি দরিদ্রদের মধ্যে তাঁর অলঙ্কার ও অন্যান্য সম্পত্তি বিলিয়ে দিয়ে অগ্নিপ্রবেশের ইচ্ছায় নগর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়েছেন। আমিও তাঁর সম্বন্ধে শোনার অযোগ্য সংবাদ যাতে না শুনে ফেলি, তাই তক্ষুনি উদ্বন্ধনে আত্মহত্যার উদ্দেশ্যে এই জীর্ণ উদ্যানে ছুটে এসেছি।
রাক্ষস—ভদ্র, তোমার সখার অগ্নিপ্রবেশের কারণ কী? ঔষধের সাধ্যাতীত কোনো মারাত্মক ব্যাধিতে কি তিনি আক্রান্ত?
পুরুষ—না, না।
রাক্ষস—তবে কি অগ্নি ও বিষতুল্য রাজরোষের প্রকোপে তিনি পড়েছেন?
পুরুষ—আর্য, অমন বিশ্রী কথা বলবেন না। চন্দ্রগুপ্তের রাজ্যে নিষ্ঠুর আচরণ নেই।
রাক্ষস—তবে কি ইনি অলভ্য কোনো পরস্ত্রীতে আসক্ত হয়েছেন?
পুরুষ—(কানচাপা দিয়ে) ছিঃ, এ কথা বলবেন না। অবিনয়ের পাত্র ইনি নন।
রাক্ষস—তোমার মতো তাঁরও কি বন্ধুর বিনাশ অবশ্যম্ভাবী?
পুরুষ—আর্য, নয়তো কী?
রাক্ষস–(আবেগ-ভরে, আত্মগত) ইনি চন্দনদাসের প্রিয় সুহৃদ্, প্রিয় সুহৃদের আসন্ন বিনাশেই এঁর অগ্নিপ্রবেশের কারণ—এ কথা শুনে আমার হৃদয়, সত্যি, যোগ্য স্নেহের প্রতি পক্ষপাতে বিচলিত। (প্রকাশ্যে) সেই সুহৃদের বিনাশের ব্যাপার এবং প্রিয় সুহৃদের প্রতি বাৎসল্যবশে মরতে উদ্যত সেই বিষ্ণুদাসের সুচরিত বৃত্তান্ত সবিস্তারে শুনতে চাই।
পুরুষ—আর্য, এরপর মন্দভাগ্য আমি আমার মৃত্যুর নতুন বাধা সৃষ্টি করতে অপারগ।
রাক্ষস—ভদ্র, শোনাও। এ কথা যথার্থ শুনবার জিনিশ।
পুরুষ—অগত্যা কী করি? এই যে বলছি, আৰ্য শুনুন।
রাক্ষস—ভদ্র, মন দিলাম।
পুরুষ—এই নগরে চন্দনদাস নামে এক মণিকার শ্রেষ্ঠী আছেন।
রাক্ষস—এই যে অদৃষ্ট আমার শোকের দীক্ষাগৃহের দ্বার উন্মোচন করল। হৃদয় স্থির হও, আরও কষ্টকর কিছু তোমাকে শুনতে হবেঃ।
পুরুষ—তিনি এই বিষ্ণুদাসের প্রিয় মিত্র।
রাক্ষস—(স্বগত) হৃদয়ের ওপর সেই শোকের বজ্র পড়ল বলে!
পুরুষ—তারপর বিষ্ণুদাস আজ গিয়ে চন্দ্রগুপ্তকে মিত্রস্নেহের যোগ্য কথাই বললেন। রাক্ষস—বল তো কী বলল।
পুরুষ—‘মহারাজ, আমার গৃহে যা অর্থ আছে তা রাজপরিবারের ভরণপোষণের পক্ষেও যথেষ্ট। তার বিনিময়ে প্রিয় বয়স্য চন্দনদাসকে আপনি মুক্তি দিন।’
রাক্ষস—(স্বগত) শাবাশ, বিষ্ণুদাস শাবাশ! মিত্রস্নেহ তুমি যথার্থ দেখালে। কারণ, যার জন্য পুত্র পিতাকে, পিতা পুত্রকে শত্রুর ন্যায় হিংসা করে, যার জন্য বন্ধুও বন্ধুর প্রতি স্নেহ ভুলে যায়, সকলের প্রিয় সেই অর্থকে বণিকজাতির একজন হয়েও[৫] তুমি সহসা অনর্থের মতো ত্যাগ করতে উদ্যত হয়েছ। হে বণিক, তোমার অর্থ এবার সার্থক হল ॥১৭।
(প্রকাশ্যে) ভদ্র, এ কথা শুনে মৌর্য কী বলল?
পুরুষ—আর্য, চন্দ্রগুপ্তকে এ কথা বললে শ্রেষ্ঠী বিষ্ণুদাসকে তিনি তদুত্তরে বললেন, ‘অর্থের জন্য চন্দনদাসকে আমি কারারুদ্ধ করিনি, কিন্তু সে যে অমাত্য রাক্ষসের বাড়ির লোকদের লুকিয়ে রেখেছে এবং বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও তাদের সমর্পণ করেনি—যেটাই তার কারাবাসের কারণ। অতএব যদি তাদের এনে দেয়, তবে তার মুক্তি হবে, নচেৎ প্রাণদণ্ড দেওয়া হবে।’ এই বলে চন্দনদাসকে বধ্যস্থলে পাঠিয়ে দিলেন। তারপর ‘বয়স্য চন্দনদাস সম্বন্ধে যা শোনার নয়, তা যাতে শুনতে না হয়, সেজন্য ততক্ষণে গিয়ে আগুনে প্রবেশ করি’—এই সঙ্কল্পে শ্রেষ্ঠী বিষ্ণুদাস নগর থেকে বেরিয়ে গেলেন! আমিও বিষ্ণুদাসের সম্বন্ধে শোনার অযোগ্য কথা শুনবার আগেই যাতে উদ্বন্ধনে আত্মহত্যা করতে পারি, সেজন্য এই জীর্ণ উদ্যানে এসে প্রবেশ করেছি।
রাক্ষস—ভদ্র, চন্দনদাসকে মেরে ফেলেনি তো?
পুরুষ—আজই তো মারবে। অমাত্য রাক্ষসের পরিজনদের হাজির করবার জন্য তাঁকে বারবার বলা হচ্ছে। মিত্রবাৎসল্যে তিনি কিন্তু তাঁদের সমর্পণ করছেন না। অতএব, এ কারণে আমি আত্মহননের বিলম্ব করব না।
রাক্ষস—(সহর্ষ, স্বগত) উত্তম, সখা চন্দনদাস, উত্তম! শিবি রাজা শরণাগতকে রক্ষা করে যশ অর্জন করেছিলেন; হে সাধু চন্দনদাস, তোমার সুহৃদ্ তোমার শরণাগত হওয়া তো দূরের কথা, কাছেও আসেনি, অথচ তাকে রক্ষা করে তুমি যশ অর্জন করলে ॥১৮॥
(প্রকাশ্যে) ভদ্র, এক্ষুনি যাও, শীঘ্র গিয়ে বিষ্ণুদাসকে অগ্নিপ্রবেশ থেকে নিরস্ত কর। আমিও গিয়ে চন্দনদাসকে মরণের হাত থেকে রক্ষা করি।
পুরুষ—আচ্ছা, আপনি আবার কী উপায়ে চন্দনদাসকে মরণের হাত থেকে রক্ষা করবেন?
রাক্ষস—(অসি কোষমুক্ত করে) কেন, এই যে আমার পুরুষকারের নিত্যসঙ্গী এই অসি রয়েছে, এরই সাহায্যে। কেননা দেখ—মিত্রস্নেহে মন আমার কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে, এই অসি এখন আমাকে দুঃসাহসের প্রেরণা যোগাচ্ছে—এই অসি যা জলগর্ভ মেঘের মতো নীল এবং আকাশের মতো নির্মল, যুদ্ধের প্রতি গভীর অনুরাগে যা পুলকিত হয়েই যেন আমার দক্ষিণ হস্তের সঙ্গে সখ্য স্থাপন করেছে এবং সামর্থ্যের প্রকাশে যা বারবার যুদ্ধের কষ্টিপাথরে শত্রুদের কাছে গুণবত্তার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে ॥১৯
পুরুষ—আর্য যে এভাবে শ্রেষ্ঠী চন্দনদাসের জীবন রক্ষার জন্য তৎপর হচ্ছেন, এতেই আন্দাজ হচ্ছে। তবুও প্রতিকূল-দৈবদশা-বিপাকে পড়েছেন বলে ঠিক বুঝতে পারছি না। আপনি কি সুগৃহীতনামা অমাত্য রাক্ষস, ভাগ্যবলে যে শ্রদ্ধাস্পদকে আমি আজ চোখের সামনে দেখছি? যাই হোক, সন্দেহ নিরসন করে আপনি আমাকে অনুগৃহীত করুন। (পায়ে পড়ল)
রাক্ষস—আমি সেই যথার্থ রাক্ষস, যে প্রভুর বংশের বিনাশ প্রত্যক্ষ করেছে, বন্ধুদের বিপদের যে কারণ, যে অনার্যের নাম নিলে অমঙ্গল হয়।
পুরুষ—(সহর্ষে, পুনরায় পায়ে পড়ে) আশ্চর্য, ভাগ্যবলে আপনাকে দেখলাম!
রাক্ষস—ভদ্র, ওঠ, ওঠ। সময় নষ্ট করে কাজ নেই। বিষ্ণুদাসকে গিয়ে বল, রাক্ষস এক্ষুনি চন্দনদাসের প্রাণরক্ষা করছে। (এই বলে ‘মিত্রস্নেহে মন’ ইত্যাদি আবৃত্তি করতে করতে মুক্ত অসিহস্তে পরিক্রমা)
পুরুষ—(পায়ে পড়ে) ভক্তিভাজন অমাত্য আমাকে ক্ষমা করবেন। জানেন তো, প্রথমে হতভাগা চন্দ্রগুপ্ত আর্য শকটদাসকে বধ্যস্থানে উপনীত করার আদেশ দিয়েছিল। কে একজন তাকে সেখান থেকে ছিনিয়ে নিয়ে দেশান্তরে চলে গেল। তাইতো ‘কেন এই প্রমাদ ঘটল?’—এই অভিযোগে দুরাত্মা চন্দ্রগুপ্ত ঘাতকদের মেরে ফেলল। শকটদাসকে কেন্দ্র করে যে ক্রোধাগ্নি প্রজ্বলিত হয়েছিল, ঘাতকহত্যায় তা প্রশমিত হল। তখন থেকে ঘাতকেরা সামনে বা পেছনে শস্ত্রধারী অপরিচিত পুরুষ দেখলেই আত্মরক্ষার স্বার্থে হুঁশিয়ার হয়ে বধ্যস্থানে উপনীত বধ্যকে তৎক্ষণাৎ হত্যা করে। তাই এভাবে শস্ত্রহাতে অমাত্য যদি যেতে থাকেন, তবে শ্রেষ্ঠী চন্দনদাসের মৃত্যু ত্বরান্বিত হবে। (নিষ্ক্রান্ত )
রাক্ষস—(স্বগত) ও হো! ধূর্ত চাণক্যের নীতির গতি বোঝা কঠিন। কারণ, আমি ধারণা করেছি, শকটদাসকে শত্রুর অভিরুচি অনুসারেই আমার কাছে হাজির করা হয়েছে। তাই যদি হয়, তবে শত্রু আবার ক্রোধবশে ঘাতকদের নিহত করল কেন? আর, যদি সেটা সাজানো ব্যাপার না হয়, তবে শকটদাস এমন অনিষ্টকর কাজের কথা মনে করল কী করে? এইভাবে নানা তর্ক করে করে মন কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারছে না।।২০
(চিন্তা করে) আগে যখন এরকম ব্যাপারে ঘাতকদের মেরে ফেলা হয়েছে, তখন আর এটা শাস্ত্রের সময় নয়। নীতি ফল দেয় দেরিতে, তাই নীতি দিয়ে এখানে কী করব? আমারই জন্য প্রিয়বন্ধুর এই চরম সঙ্কট, ঔদাসীন্য আমার সাজে না। বুঝেছি, তাঁর দেহের মূল্যস্বরূপ আমার এই দেহকেই মুক্তিপণ দেব ॥২১॥
[সকলে নিষ্ক্রান্ত]
॥ষষ্ঠ অঙ্ক সমাপ্ত॥
***
প্রসঙ্গকথা – ষষ্ঠ অঙ্ক
১. মুখসন্ধি, নির্বাহন সন্ধির কথা পূর্বে বলা হয়েছে। যে কোনো ভালো নাটকে মুখ ও নির্বহন সন্ধির মধ্যে অর্থাৎ প্রারম্ভ ও পরিণতির মধ্যে পূর্ণ সামঞ্জস্য থাকে! নাটকীয় বস্তু নানা গতিশীল ঘটনা ও ঘটনাদ্বয়ের মাধ্যমে পাঁচটি সন্ধিতে আরোহণ ও অবরোহণের মধ্য দিয়ে পরিণতি লাভ করে। ‘মুখ’ শব্দের অর্থ ‘আরম্ভ’! অতএব মুখ সন্ধিতে যার আরম্ভ, নির্বাহনে তা সিদ্ধি। এ দুয়ের মধ্যে যদি অমিল বা গরমিল দেখা যায় তবে সে নাটক ‘কুকবি’কৃত নাটক বলেই গৃহীত হবে। বিশাখদত্তের বিবক্ষা এটাই যে তাঁর এ নাটক এ ধরনের ত্রুটি থেকে মুক্ত।
২. কবিকা= লাগাম
৩. সব্রহ্মচারী—[স(সহ বা সয) ব্রহ্মচারী]= সতীর্থ! ব্যসন= বিপদ্ বা দুঃখ। অতএব, ‘ব্যসনব্রহ্মাচারী’ শব্দের অর্থ বিপন্নতা বা দুঃখানুভূতির দিক থেকে সতীর্থ।
৪. ‘অপাবৃতং… শোকদীক্ষাদ্বারম্’—মঞ্জুভাষণ লা Euphemism-এর একটি সুন্দর দৃষ্টান্ত,—কঠিন শোকের প্রকাশে কেমন কোমল গম্ভীর ভঙ্গীর আশ্রয়। তুলনীয়—‘হৃদয়, মা উত্তাম্য শকুন্তলা—১ম অঙ্ক!
৫. অর্থলাভ বণিকের সহজাত দোষ। তুমিও তো বণিক্, অর্থগৃধু তাদেরই একজন। তথাপি সদুদ্দেশ্যে অকাতরে (বণিকের কাছে প্রাণাপেক্ষা প্রিয়) অর্থকে অনর্থবৎ বিসর্জন করেছ, এতে তোমার সেই অর্থই কৃতার্থ হয়েছে।