দ্বিতীয় অঙ্ক – রাক্ষসবিচার

দ্বিতীয় অঙ্ক – রাক্ষসবিচার

(সাপুড়ের প্রবেশ)

সাপুড়ে—যারা তন্ত্রমতো ঔষধ প্রয়োগ করতে জানে, মণ্ডলগুলো অবিকল আঁকতে পারে, মন্ত্রের গোপনীয়তা রক্ষায় যারা পটু, রাজসাপকে নিয়ে চলাফেরা তারাই করতে পারে। ১

(আকাশে) আর্য, আপনি কি জিগ্যেস করছেন,– ‘তুমি কে?’ আর্য, আমি সাপুড়ে, আমার নাম জীর্ণবিষ। কী বলছেন? ‘আমিও সাপ খেলাতে চাই?’ আচ্ছা, আর্যের পেশাটা কী? কী বললেন—রাজপরিবারের সেবক? তবে তো আর্য সাপ নিয়েই খেলা করছেন। কী করে? মন্ত্র আর গাছগাছড়ার ব্যাপারে অনভিজ্ঞ সাপুড়ে, খ্যাপা হাতির বেসামাল মাহুত, পদমর্যাদার অহঙ্কারে উদ্ধত রাজকর্মচারী এ তিনজনেরই ধ্বংস কিন্তু অনিবার্য। আরে! এ যে দেখতে-না-দেখতেই চলে গেল।

(আবার আকাশের দিকে চেয়ে) আর্য, আপনি কি বলছেন—‘এই ঝাঁপিগুলোতে কী আছে?’ সাপ আছে, এদের দিয়েই আমি করে খাই। কী বলছেন? ‘দেখতে চাই’? আর্য, আমায় মাপ করুন, এটা দেখাবার জায়গা নয়। তবে, যদি আপনার আগ্রহ থাকে, আসুন, এই বাড়িতে দেখাচ্ছি। কী বললেন?—এটা হল প্রভু অমাত্য রাক্ষসের বাড়ি। আমাদের মতো লোকদের এখানে ঢোকা বারণ? আর্য, তাহলে চলে যান। আমার অবশ্য পেশার খাতিরে এখানে ঢোকা চলবে। আরে! এ যে চলে গেল।

(স্বগত। সংস্কৃত ভাষার মাধ্যমে)॥১॥ আহ্, কী আশ্চর্য; চাণক্যের বুদ্ধিতে পরিচালিত চন্দ্রগুপ্তকে দেখলে রাক্ষসের প্রচেষ্টাকে যেন নিরর্থক মনে হয়। রাক্ষসের পরামর্শপুষ্ট মলয়কেতুকে যখন দেখি, তখন মনে হয়—সিংহাসন বুঝি চন্দ্রগুপ্তের হাতছাড়া হল। কারণ—

কৌটিল্যের বুদ্ধিরূপ রজ্জুতে শক্ত করে বেঁধে রাখার দরুন মৌর্য নৃপতির রাজলক্ষ্মীকে অচঞ্চল বলেই মনে হয়। অন্যদিকে লক্ষ করলে দেখতে পাই—উপায়রূপ চারহাত দিয়ে রাক্ষস তাকে যেন টেনে নিয়ে আসছে।।২।।

তাই, দুই মহামন্ত্রীর এই বুদ্ধির লড়াইয়ে পড়ে নন্দকুললক্ষ্মী কী করবেন ঠিক করতে পারছেন না।

বনানীতে যুদ্ধরত দুই বনগজের মাঝখানে বেপথুমতী হস্তিনী যেমন যখন যার জয়ের সম্ভাবনা দেখে সেদিকে ছোটে, তেমনি যুধ্যমান দুই মহামন্ত্রীর জয়ের নিষ্পত্তি না হওয়া অবধি রাজলক্ষ্মী একবার এদিকে, একবার ওদিকে—এমনি ছোটাছুটি করতে করতে নিশ্চিত ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন ॥৩॥ তা আমি এখন অমাত্য রাক্ষসের সঙ্গে দেখা করি।

(পরিক্রমা করে দাঁড়িয়ে পড়ল)।

(তারপর আসনে উপবিষ্ট চিন্তাকুল রাক্ষসের প্রবেশ, পেছন পেছন তার সেবক)

রাক্ষস—(সাশ্রুনেত্রে) কী কষ্ট! হায়, কী কষ্ট!!

নীতি ও বীরত্ব—এই দুই গুণের প্রয়োগনৈপুণ্যে যাঁরা শত্রুদের নিরস্ত করতেন, যাদবদের মতো নন্দদের সেই বিরাট বংশ নিষ্ঠুর নিয়তির চক্রান্তে ছারখার হওয়ায় আমি চিন্তাভারাক্রান্ত মনে রাতদিন জেগে জেগে নানা ধরনের কর্মপন্থার রূপরেখা আঁকি বটে, কিন্তু সেগুলো সবই ভিত্তিহীন চিত্রকর্মের মতোই নিরালম্ব ॥৪॥

অথবা—আমি যে একান্তভাবে পরের (মলয়কেতুর) দাসত্ব স্বীকার করে প্রগাঢ়ভাবে কূটনীতিতে মনোনিবেশ করেছি, সেটা পূর্বের প্রভুর প্রতি আনুগত্য বিস্মৃত হয়েছি বলে নয়, বিষয়-সম্ভোগে এখনও আমার মন নিতান্ত আসক্ত বলে নয়, আমি প্রাণে মারা পড়ব—এই ভয়েও নয়, কিংবা পুনর্বার আত্ম-প্রতিষ্ঠার অভিপ্রায়েও নয়, আমার উদ্দেশ্য আসলে এটাই যে শত্রুকে যদি বধ করতে পারি তবে প্রভু স্বর্গে থেকেও আমার কাজে খুশি হবেন ॥৫॥

(আকাশের দিকে তাকিয়ে—সাশ্রুনেত্রে)

ভগবতি কমলালয়ে, গুণের আদর তুমি একেবারেই জান না। কারণ, আনন্দের নিদান প্রভু নন্দকে ত্যাগ করে তুমি তাঁর শত্রু মৌর্যপুত্রে কেন আসক্ত হলে বল তো? গন্ধগজের বিনাশের সঙ্গে সঙ্গে তার মদবারিধারার যেমন বিলুপ্ত ঘটে, তেমনি, হে চপলে, সেইক্ষণেই কেন তোমার চিরবিলোপ ঘটল না ॥৬॥

উপরন্তু, হে আভিজাত্যহীনা!

পৃথিবীতে যত বিখ্যাত বংশের কুলীন নৃপতি ছিলেন, তাঁদের সকলেই কি ভস্মীভূত হয়েছিলেন যে, হে দুঃশীলা, কুলহীন মৌর্যকে তুমি পতিত্বে বরণ করলে? অথবা, স্ত্রীলোকের বুদ্ধি যা কাশফুলের শীর্যের মতোই অস্থির, তার প্রকৃতিটাই এমনি যে পুরুষের যোগ্যতা বিচারে তা বিমুখ ॥৭॥

হে দুর্বিনীতে, আমি তাই, তুমি যাকে আশ্রয় করছে, তাকে শেষ করেই তোমার আশা ঘুচিয়ে দেব। (চিন্তা করে) আমি তাহলে নগর থেকে বেরিয়ে আসার সময় পরম সুহৃদ্ চন্দনদাসের বাড়িতে আমার পরিজনদের রেখে উচিত কাজই করেছি। কেননা, প্রভুপাদের অন্নাশ্রিত যারা আমাদের মতো একই উদ্দেশ্যে সেখানে অবস্থান করেছ, এতে তারা ভাববে যে রাক্ষস কুসুমপুর অভিযানের প্রতি উদাসীন নন, ফলে তাদের উদ্যম আর শিথিল হয়ে পড়বে না। শকটদাসের হাতে মোটা টাকা দিয়ে তাকে সেখানে রেখেছি; তার কাজ হল চন্দ্রগুপ্তের উপর দৈহিক আক্রমণের তথা বিষপ্রয়োগের জন্য যে আততায়ীদের আমি নিযুক্ত করেছি, তাদের খুশি করে হাতে রাখা এবং শত্রুপক্ষের সব গোপন কাজ ফাঁস করে দেওয়া। প্রতিমুহূর্তে শত্রুর গতিবিধির খবর সংগ্রহের জন্য এবং ওদের ঐক্যে ভাঙন সৃষ্টির জন্য জীবসিদ্ধি প্রভৃতি মিত্রদের নিয়োজিত রেখেছি। সুতরাং, এ বিষয়ে বেশি বলার কী আছে।

সন্তানবৎসল প্রভু ব্যাঘ্রশিশুর মতো যাকে লালন-পালন করে বড় করে তুলতে না তুলতেই সহসা সবংশে বিনষ্ট হলেন, বুদ্ধিবাণে তারই মৰ্ম আমি ভেদ করব, অবশ্য যদি অদৃশ্য রূপধারী দৈব বর্মের কাজ না করে ॥৮॥

(অতঃপর কঞ্চুকীর প্রবেশ।)

কঞ্চুকী—বৃদ্ধ চাণক্যের নীতি যেমন নন্দকে আয়ত্ত করে কালক্রমে মৌর্যকে নগরে প্রতিষ্ঠিত করেছে, তেমনি বার্ধক্যও আমার কামকে মথিত করে ক্রমে আমার মধ্যে ধর্মের প্রতিষ্ঠা করেছে। সেই ধর্মভাব আমার বেড়ে যাচ্ছে, অথচ রাজসেবার সুযোগে অন্তরস্থ লোভ সম্প্রতি তাকে অভিভূত করতে চেষ্টা করছে, কিন্তু পারছে না, যেমন রাক্ষস সম্প্রতি (মলয়কেতুর সেবার অবকাশে, উন্নতিশীল মৌর্যকে জয় করবার প্রয়াস পাচ্ছে, কিন্তু সমর্থ হচ্ছে না[২] ॥৯॥

(পরিক্রমা করে ও অগ্রসর হয়ে)—এই অমাত্য রাক্ষসের গৃহ। প্রবেশ করি।

(প্রবেশ করে, দেখে) আপনার কল্যাণ হোক।

রাক্ষস—প্রণাম আর্য। প্রিয়ংবদক, আসন আনো।

পুরুষ—এই যে আসুন, আর্য বসুন।

কঞ্চুকী—(উপবেশন করে) কুমার মলয়কেতু অমাত্যকে অনুরোধ জানিয়েছেন, বহুকাল যাবৎ আর্য অভ্যস্ত বেশভূষা ত্যাগ করেছেন, আমার হৃদয় এজন্য ব্যথিত। যদিও এত শীঘ্র প্রভুর গুণাবলি ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়, তবুও আশা করি, আর্য আমার অনুরোধ রাখবেন।’ (এই বলে অলঙ্কারগুলো দেখিয়ে) এই অলঙ্কারগুলো কুমার নিজের দেহ থেকে খুলে পাঠালেন, অনুগ্রহ করে আর্য এগুলো, আশা করি, পরিধান করবেন!

রাক্ষস—আর্য জাজলি, কুমারকে আমার জবানিতে বলুন, ‘আপনার গুণাবলির প্রতি পক্ষপাত বশত প্রভুর গুণগ্রাম বাস্তবিকই বিস্মৃত হয়েছি। কিন্তু—

হে নরোত্তম, যতদিন না আপনার শত্রুগোষ্ঠীকে নিঃশেষে ক্ষয় করে আপনার এই সুবর্ণসিংহাসন ওই “সুগাঙ্গ-প্রাসাদে” প্রতিষ্ঠিত করতে পারি, ততদিন শৌর্যহীন, শত্রুর পরাভব-জনিত-লাঞ্ছনায় জর্জর—এই অঙ্গসমূহে সামান্যমাত্র অলঙ্কারও ধারণ করব না।

কঞ্চুকী—অমাত্য যেখানে নেতা, সেখানে কুমারের পক্ষে এটা সুলভ। অতএব কুমারের এই প্রথম অনুরোধ রক্ষা করুন।

রাক্ষস—আর্য, কুমারের মতো আপনার কথাও তো অমান্য করবার নয়। ঠিক আছে, তাহলে কুমারের আদেশ মানা যাক্।

কঞ্চুকী—(অলঙ্কার পরাবার অভিনয় করে) আপনার কল্যাণ হোক। আমি চলি।

রাক্ষস—আর্য, আমার অভিবাদন নিন।

(কঞ্চুকী নিষ্ক্রান্ত )

রাক্ষস—প্রিয়ংবদক, দেখ তো আমার সাক্ষাৎপ্রার্থী দরজায় কে দাঁড়িয়ে আছে!

পুরুষ—অমাত্যের যা আদেশ। (পরিক্রমা করে সাপুড়েকে দেখে।) আর্য, আপনি কে?

সাপুড়ে—ভদ্র, আমি হচ্ছি সাপুড়ে, আমার নাম জীর্ণবিষ। অমাত্যের সামনে সাপ খেলাতে চাই।

পুরুষ—দাঁড়াও, অমাত্যকে বলে আসি। (রাক্ষসের কাছে গিয়ে) অমাত্য, আগন্তুক একজন সাপুড়ে; সাপের খেলা দেখাতে চায়।

রাক্ষস—(বাম চক্ষুর স্পন্দনের অভিনয় করে—আত্মগত) এ কী!

প্রথমেই সৰ্পদর্শন। (প্রকাশ্যে) প্রিয়ংবদক, সাপ দেখার শখ আমার নেই। তাই পারিতোষিক দিয়ে একে বিদায় কর।

প্রিয়ংবদক—আচ্ছা। (সাপুড়ের কাছে গিয়ে) আর্য, আপনি সাপ দেখাতে এসেছিলেন বলে অমাত্য খুশি হয়ে আমাকে এই পরিতোষিক দিলেন, কিন্তু আপনার সাপ দেখে আপনাকে অনুগৃহীত করতে পারলেন না।

সাপুড়ে—ভদ্র, অমাত্যকে নিবেদন কর যে কেবল সাপখেলা দেখানোই আমার একমাত্র পেশা নয়, আমি একজন প্রাকৃত কবিও বটে। অতএব, অমাত্য আমায় দেখা দিয়ে যদি কৃপা না করেন, তবে এই ক্ষুদ্র পত্রখানি অনুগ্রহ করে পাঠ করুন।

প্রিয়ংবদক—(পত্র হাতে নিয়ে রাক্ষসের কাছে দিয়ে।) আর্য, এ অমাত্যকে এই প্রার্থনা জানাচ্ছে, ‘আমি শুধু সাপুড়ে নই, বস্তুত আমি একজন প্রাকৃত কবি ও বটে। এতএব, অমাত্য যদি আমাকে দেখা দিয়ে অনুগ্রহ না করেন, তবে অন্তত এই ক্ষুদ্র পত্রখানি দয়া করে পড়ুন।’

রাক্ষস—(পত্র-গ্রহণ ও পাঠ) নিজ নৈপুণ্যে নিঃশেষে কুসুম-মধু[৩] পান করে ভ্রমর যা উদ্গিরণ করে, তা অন্যের কাজে লাগে ॥১১।

(চিন্তা করে—স্বগত) ওহো, পদ্যটার মানে হচ্ছে, ‘আমি আপনার গুপ্তচর, কুসুমপুরের খবর জানি।’ নানা কাজের ব্যস্ততায় মনের নেই অবসর, আর চরের সংখ্যাও হয়েছে এত বেশি যে, ভুলেই গেছলাম। এখন মনে পড়ল[৪]। এ নির্ঘাত বিরাধগুপ্ত—সাপুড়ের ছদ্মবেশ নিয়েছে।

(প্রকাশ্যে) প্রিয়ংবদক, একে নিয়ে এসো। এ একজন ভালো কবিয়াল। এর কাছ থেকে ভালো ভালো পদ শোনা যাক্।

প্রিয়ংবদক—(‘আচ্ছা’ বলে সাপুড়ের কাছে গিয়ে।) আর্য ভেতরে চলুন।

সাপুড়ে—(এগিয়ে যাবার অভিনয় করে তাকিয়ে স্বগত। সংস্কৃত ভাষার আশ্রয়ে।) এই অমাত্য রাক্ষস। ইনি সেই পুরুষ—যাঁর উদ্যমের ভয়ে রাজশ্রী বাম বাহুলতা মৌর্যের কণ্ঠে শিথিলভাবে রেখে, মুখটা ঘুরিয়ে জোর করে স্কন্ধে দক্ষিণ বাহুলতা স্থাপন করা সত্ত্বেও তা বারবার কোলে খসে পড়ায় এখনও পর্যন্ত তার দক্ষিণ স্তন মৌর্যের বক্ষোলীন করতে পারছে না যাতে সেই স্তনবৃন্ত গাঢ় আলিঙ্গনের নিবিড়তায় একান্ত পিষ্ট হতে পারে ॥১২॥

(প্রকাশে) অমাত্যের জয় হোক।

রাক্ষস—(দেখে) এ যে বিরাধ[৫]-–(অর্ধেকটা বলে) দাড়ি-গোঁফও গজিয়েছে একগাদা; প্রিয়ংবদক, সাপগুলোকে নিয়ে এবার আমি মজা করব। পরিজনরা গিয়ে বিশ্রাম করুক। তুমিও তোমার কাজের জায়গা ছেড়ে থেক না।

প্রিয়ংবদক—আচ্ছা। (পরিজনসহ নিষ্ক্রান্ত )

রাক্ষস—বন্ধু বিরাধগুপ্ত, এই আসন, বসো।

বিরাধগুপ্ত—(বসার অভিনয় করল)।

রাক্ষস― (ভালো করে দেখে) আহা! প্রভুর পাদপদ্মের যারা সেবক, তাদের এই দশা!

(রোদন করতে লাগল )

বিরাধগুপ্ত—অমাত্য, শোক করবেন না। সেদিন বেশি দূরে নেই যখন অমাত্য আমাদের আগের সে অবস্থা ফিরিয়ে আনবেন।

রাক্ষস- বন্ধু, কুসুমপুরের বৃত্তান্ত বল।

বিরাধগুপ্ত—অমাত্য, কুসুমপুরের বৃত্তান্ত বিস্তীর্ণ, তাই কোথা থেকে শুরু করব?

রাক্ষস—বন্ধু, আমি যাদের বিষপ্রয়োগের কাজে পাঠিয়েছিলাম, চন্দ্রগুপ্তের সদ্য নগর-প্রবেশের সময় থেকেই তারা কী কী করেছে, সে কথা আমি গোড়া থেকে শুনতে চাই।

বিরাধগুপ্ত—এই আমি বলছি। ঘটনাটা এরকম যে, চাণক্যের মন্ত্রণায় পরিচালিত চন্দ্রগুপ্ত ও পর্বতেশ্বরের সেনাবাহিনীর শক, যবন, কিরাত, কম্বোজ, পারসিক, বাকি প্রভৃতি নানা জাতের সৈন্যরা প্রলয়কালীন জলোচ্ছ্বাসে উত্তাল সাগরের ন্যায় চতুর্দিক থেকে এসে কুসুমপুরকে অবরুদ্ধ করল।

রাক্ষস—(তরবারি টেনে নিয়ে, উত্তেজনায়) ওহে! আমি থাকতে কে কুসুমপুর অবরোধ করবে? প্রবীরক, প্রবীরক, শীঘ্র এক্ষুনি—ধনুর্ধরগণ ক্ষিপ্রবেগে প্রাচীরের চারদিকে পরিক্রমা করুক, প্রতিপক্ষের গজশ্রেণির মধ্যে ঢুকে পড়ে ওদের ছত্রভঙ্গ করতে সক্ষম হাতিগুলো ফটকে ফটকে দাঁড়িয়ে পড়ুক। যশ যাদের কাম্য, তারা মৃত্যুভয় ত্যাগ করে আমার সঙ্গে একত্র হয়ে শত্রুর দুর্বল বাহিনীকে আঘাত করার সঙ্কল্পে বেরিয়ে আসুক[৬] ॥ ১৩॥

বিরাধগুপ্ত—অমাত্য, উত্তেজিত হবেন না। এ তো পুরনো ঘটনার কথা বলছি।

রাক্ষস—(নিশ্বাস ত্যাগ করে) হা ধিক্! এটা পুরনো ঘটনা; আমার কিন্তু মনে হচ্ছিল ঘটনার কাল একেবারে বর্তমান। (তরবারি রেখে দিয়ে) হা, দেব নন্দ! রাক্ষসের প্রতি আপনার অনুগ্রহের আতিশয্য আমার মনে আছে। এই যুদ্ধের সময় আপনি ‘যেখানে (প্রতিপক্ষের) ওই মেঘ-নীল হস্তী-যূথ বিচরণ করছে, রাক্ষস যাক সেখানে। ওই যে (শত্রুর) অশ্ববাহিনী বাঁধভাঙা জলের মতো বিপুল উচ্ছ্বাসে এগিয়ে আসছে, রাক্ষস গিয়ে ওদের প্রতিহত করুক। পদাতিক বাহিনীকে রাক্ষস গিয়ে বিধ্বস্ত করুক।’—এইভাবে আমার প্রতি আদেশ পাঠাবার বেলায় স্নেহের বশে আপনি মনে করতেন নগরে যেন হাজার হাজার রাক্ষস রয়েছে ॥ ১৪॥

বিরাধগুপ্ত—তারপর, দেব সর্বার্থসিদ্ধি যখন দেখলেন কুসুমপুর সব দিক থেকে অবরুদ্ধ, আর এই দীর্ঘস্থায়ী অবরোধের ফলে নাগরিকদের অপরিসীম কষ্ট একটানা চলতে থাকল, তখন তিনি আর সহ্য করতে পারলেন না। এ হেন অবস্থাতেও তিনি শুধু নাগরিকদের মুখ চেয়ে সুড়ঙ্গপথে তপোবনে পালিয়ে গেলেন। প্রভুর অনুপস্থিতিতে আপনার সৈন্যদের প্রযত্নে শৈথিল্য দেখা দিলে শত্রুর জয় হল, কিন্তু নগরাভ্যন্তরে বসবাসকারী আপনার লোকজন শত্রুর জয় ঘোষণাদি কার্যে ব্যাঘাত সৃষ্টির মাধ্যমে তাদের অসম সাহসিকতা প্রকটিত করলে আপনি তাদের মনোভাব বুঝতে পেরে নন্দরাজ্যকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করবার আশায় সুড়ঙ্গপথে নগরের বাইরে চলে গেলেন। তারপর চন্দ্রগুপ্তকে বধ করার জন্য আপনি বিষকন্যা নিযুক্ত করলে তাতে যখন বেচারী পর্বতেশ্বরের প্রাণ গেল।

রাক্ষস—বন্ধু আশ্চর্য—কি দেখ—কর্ণ অর্জুনকে মারবে বলে যেমন অমোঘ ‘একঘ্নী শক্তি’[৭] সযত্নে রেখে দিয়েছিলেন, তেমনি আমি চন্দ্রগুপ্তকে মারব বলে একপুরুষ-ঘাতিনী সেই বিষকন্যাকে রেখেছিলাম। কিন্তু সেই শক্তি যেমন বিষ্ণুরই একান্ত কল্যাণে নিয়োজিত হয়ে হিড়িম্বাতনয় ঘটোৎকচকে বধ করেছিল, তেমনি হতভাগা বিষ্ণুগুপ্তের পরম অভীষ্টসিদ্ধির জন্য সেই বিষকন্যা তারই বধ্য পর্বতরাজ পর্বতককে নিহত করল ॥১৫।।

বিরাধগুপ্ত—অমাত্য, এটা দৈবের খেয়াল, এখানে কী করার আছে?

রাক্ষস—তারপর, তারপর?

বিরাধগুপ্ত—তারপর পিতার মৃত্যুতে ভয় পেয়ে কুমার মলয়কেতু পালিয়ে গেলেন। পর্বতকের ভ্রাতা বৈরোচককে বুঝিয়ে-সুজিয়ে তার ওপর ভরসা রেখে চন্দ্রগুপ্ত যে নন্দভবনে প্রবেশ করবে সে সংবাদ প্রকাশ্যে ঘোষণা করা হল। হতভাগ্য চাণক্য তখন কুসুমপুরে যত সূত্রধরের বাস —সবাইকে ডেকে বলে দিল—‘লগ্নাচার্যদের নির্দেশমতো মধ্যরাত্রে চন্দ্রগুপ্ত নন্দপ্রাসাদে প্রবেশ করবে। অতএব পূর্বদিকের প্রধান প্রবেশদ্বার থেকে আরম্ভ করে রাজভবনের সংস্কার কর।’ এ কথা শুনে সূত্রধরেরা বলল, ‘আর্য, দেব চন্দ্রগুপ্তের নন্দভবন-প্রবেশের খবর আগে থেকেই জানতে পেরে সূত্রধর দারুবর্মা সুবর্ণ তোরণাদির সন্নিবেশ করে অভিনব অলঙ্করণ-বৈশিষ্ট্যে রাজভবনে প্রবেশের প্রথম ফটকটি সুসজ্জিত করেছেন। আমরা তবে এখন ভিতরের যা কিছু সাজসজ্জার কাজ, তাই করি।’ তখন চাণক্য—আদেশ না করতেই সূত্রধর দারুবর্মা রাজভবনের প্রবেশদ্বারের সংস্কার করে ফেলেছে—এ খবরে খুব সন্তুষ্ট হয়েছে এমন ভাব দেখিয়ে অনেকক্ষণ ধরে দারুবর্মার কর্ম-তৎপরতার প্রশংসা করে বলল, ‘দারুবর্মা, অচিরেই তুমি তোমার কর্ম-তৎপরতার অনুরূপ ফল লাভ করবে।’

রাক্ষস (সোদ্বেগে)—বন্ধু, চাণক্যের খুশিভাবটা কিসে? দারুবর্মার প্রচেষ্টা নিষ্ফল, নতুবা অনিষ্টফলপ্রসূ হয়ে থাকবে—এটাই আমার ধারণা। কারণ বুদ্ধিভ্রংশবশতই হোক অথবা প্রভুর প্রতি রাজভক্তির আতিশয্যেই হোক—আদেশ করা পর্যন্ত অপেক্ষা না করে এ চাণক্যের মনে ঘোর সংশয় সৃষ্টি করেছে। তারপর, তারপর?

বিরাধগুপ্ত—তারপর, লগ্ন শুভ বলে মধ্যরাত্রে চন্দ্রগুপ্ত নন্দরাজপুরীতে প্রবেশ করবে—এ বিষয়ে শিল্পী ও পুরবাসীদের অবহিত করে সেই মুহূর্তেই চণ্ড চাণক্য পর্বতেশ্বরের ভ্রাতা বৈরোচককে চন্দ্রগুপ্তের সঙ্গে একই আসনে বসিয়ে পৃথিবীরাজ্য ভাগ করে দিল।

রাক্ষস—সে কি পর্বতকের ভ্রাতা বৈরোচককে পূর্বপ্রতিশ্রুতি মতো রাজ্যের অর্ধাংশ দিয়ে দিল?

বিরাধগুপ্ত—নয় তো কী?

রাক্ষস (স্বগত) পর্বতেশ্বরকে হত্যার অপযশ ঢাকতেই জনগণের মধ্যে এই গল্পটা ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। অতিধূর্ত চাণক্য নিশ্চয়ই ওই বেচারীরও গুপ্তহত্যার কিছু একটা অভিসন্ধি করেছে। (প্রকাশ্যে) তারপর, তারপর।

বিরাধগুপ্ত—তারপর, রাতে চন্দ্রগুপ্ত নন্দভবনে প্রবেশ করছেন—এ কথা আগেই ঘোষণা করে দিয়ে তারপর বৈরোচকের অভিষেকের অনুষ্ঠান হল। উজ্জ্বল মণি-মুক্তার নানারকমের চিত্রপট-বসানো এক বর্মের আড়ালে ঢাকা পড়ল তাঁর শরীরটা, মণিময় মুকুটের নিবিড় আচ্ছাদনে ঢাকা পড়ল তাঁর সুন্দর চুলে ভরা মাথা, দুই কাঁধ থেকে আড়াআড়িভাবে নেমে আসা সুগন্ধি পুষ্পমাল্যে তাঁর বিশাল বক্ষঃস্থল হল উদ্ভাসিত। সাজসজ্জার বহরে তাঁর চেহারাটা এমনি দাঁড়াল যে তাঁর একান্ত পরিচিত লোকেরাও তাঁকে আর চিনতে পারছিল না। এরপর চণ্ড চাণক্যের আদেশে তিনি চন্দ্রগুপ্তের বাহন ‘চন্দ্রলেখা’ নামে হস্তিনীর পৃষ্ঠে আরোহণ করলে যেসব রাজারা বরাবর চন্দ্রগুপ্তের অনুগামী তারাই তাঁর অনুগমন করতে লাগল। এভাবেই বৈরোচক যখন দেব নন্দের প্রাসাদে প্রবেশ করতে উদ্যত, যখন আপনার নিযুক্ত সূত্রধর দারুবর্মা ‘এই তো চন্দ্রগুপ্ত’ এইরূপ মনে করে তার উপর ক্ষেপণের জন্য যন্ত্র-চালিত তোরণকে প্রস্তুত রাখল। ইতিমধ্যে চন্দ্রগুপ্তের অনুচর রাজারা তাদের বাহনগুলোকে বাইরে থামিয়ে দিয়ে নিজেরা বাইরেই রয়ে গেল। তখন চন্দ্রগুপ্তের হাতিটার মাহুত বর্বরক—যাকে আপনিই নিযুক্ত করেছিলেন, সে সুবর্ণযষ্টির ভেতরে লুকিয়ে-রাখা সরু ছুরিটা টেনে বের করার ইচ্ছায় সোনার শিকলে ঝোলানো সেই সুবর্ণযষ্টিটি হাতে তুলে নিল।

রাক্ষস—দুজনেরই অবস্থানে উদ্যোগ।

বিরাধগুপ্ত—তারপর, সেই হস্তিনী তার পেছনে আঘাতের ভয়ে হঠাৎ অতি দ্রুত তার গতি-পরিবর্তন করল। বেচারী বর্বরক বৈরোচককে চন্দ্রগুপ্ত বলে ধরে নিয়ে ছুরি টেনে বের করে তাঁকে বিধবার জন্যে কেবল তৈরি হয়েছে—কিন্তু তাঁকে তখনও ছুঁতে পারেনি, ঠিক এমন সময় সেই যন্ত্রচালিত তোরণ পড়ল গিয়ে বর্বরকের ঘাড়ে,– বস্তুত হাতির (চন্দ্রলেখার) আগের গতির হিশাব করে ওই তোরণ ছেড়ে দেওয়া তা পড়ল গিয়ে লক্ষ্য ছেড়ে দূরে (বর্বরকের ঘাড়ে)। মারা পড়ল বেচারী বর্বরক। তখন দারুবর্মা যন্ত্র-চালিত তোরণ ক্ষেপণের পরিণতিতে তার নিজের মৃত্যু নিশ্চিত ভেবে আগেভাগেই উত্তুঙ্গ তোরণের উপর উঠে যন্ত্র চালাবার লম্বা লোহার হাতলটা খুলে নিয়ে হাতির পিঠেই বেচারী বৈরোচককে মেরে ফেলল।

রাক্ষস—কী কষ্টকর। দু-দুটা অনর্থ ঘটে গেল। চন্দ্রগুপ্ত মারা গেল না, মারা পড়ল নিয়তির হাতে বৈরোচক আর বর্বরক। তারপর সূত্রধর দারুবর্মার কী হল? বিরাধগুপ্ত—বৈরোচকের আগে আগে শোভাযাত্রা করে যে পদাতিকেরা যাচ্ছিল, তারাই তাকে খোয়া ছুড়ে ছুড়ে মেরে ফেলল।

রাক্ষস—(সাশ্রুনেত্রে) কী কষ্ট! হায়!! স্নেহশীল সুহৃদ দারুবর্মা আমাদের ছেড়ে গেল। আচ্ছা, সেখানে বৈদ্য অভয়দত্ত ছিল, সে কী করল?

বিরাধগুপ্ত—সবই করেছে।

রাক্ষস—(সানন্দে) দুরাত্মা চন্দ্রগুপ্ত কি নিহত হয়েছে?

বিরাধগুপ্ত—অমাত্য, দৈবের জোরে সে নিহত হয়নি।

রাক্ষস—(সবিষাদে) তবে এইমাত্র তুমি কী বললে, যে, ‘সবই করেছে’। বিরাধগুপ্ত—অমাত্য, সে চন্দ্রগুপ্তের জন্য সূক্ষ্ম রাসায়নিক চূর্ণ মিশিয়ে ওষুধ তৈরি করেছিল। ধূর্ত চাণক্য ওই ওষুধ পরীক্ষা করতে লাগল। সোনার পাত্রে ফেলে দেখল—ওষুধের বং গেছে বদলে। তাই-না দেখে চন্দ্রগুপ্তকে চাণক্য বলল, “বৃষল, বিষাক্ত এই ওষুধ যেন পান করো না।”

রাক্ষস—ও মহাধূর্ত। তারপর, সে বৈদ্যের কী খবর?

বিরাধগুপ্ত—সেই ওষুধই তাকে খাওয়ানো হল এবং সে মারা গেল।

রাক্ষস—(সবিষাদে) আহা! বিপুল বিজ্ঞানসম্পদের লোপ হল। তারপর শয়নকক্ষের দায়িত্ব যার ওপর ছিল, সেই প্রমোদকের কী হল?

বিরাধগুপ্ত—অন্যদের যা, তাই।

রাক্ষস—(সোদ্বেগে) কী প্রকার?

বিরাধগুপ্ত—সেই মূর্খটা তো আপনাদের দেয়া মোটা টাকা মুঠোয় পেয়ে দেদার খরচ করে সুখভোগ করতে লাগল। তারপর ‘কোত্থেকে এত প্রচুর টাকা এল’—এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে যখন সে নানারকম উল্টোপাল্টা উত্তর দিতে লাগল, তখন চণ্ড চাণক্যের হুকুমে তাকে বিশ্রীভাবে মেরে ফেলা হল।

রাক্ষস—(সোদ্বেগে)—কী! এখানেও আমরা দৈবের হাতে মার খেলাম। আচ্ছা, চন্দ্রগুপ্ত ঘুমিয়ে পড়লে তার দেহে আঘাতের জন্য যাদের আমরা পাঠিয়েছিলাম তারা তো আগে থেকেই রাজার শোবার ঘরের দেয়ালের ভেতর সুড়ঙ্গ করে সেখানে থেকে গিয়েছিল। সেই বীভৎসকদের খবর কী? বিরাধগুপ্ত—অমাত্য, খবর খুব শোচনীয়।

রাক্ষস—(আবেগের সঙ্গে)—কেমনতরো শোচনীয় খবর? তারা যে যেখানে লুকিয়ে ছিল, কূট চাণক্য নিশ্চয়ই তা টের পায়নি।

বিরাধগুপ্ত—পেয়েছে বৈ কি, অমাত্য। চন্দ্রগুপ্তের প্রবেশের পূর্বেই ধূর্ত চাণক্য সেই শোবার ঘরে ঢুকেই চারদিকে তার সন্ধানী দৃষ্টি ফেলতে-না-ফেলতে দেখতে পেল—দেয়ালের একটি জায়গায় ছিদ্র দিয়ে পিঁপড়ের সারি বেরিয়ে আসছে, মুখে তাদের ভাতের কণা। এই না দেখে ‘এই ঘরের ভেতর নিশ্চয়ই মানুষ রয়ে গেছে’—এটা বুঝতে পেরে সেই শোবার ঘরে লাগিয়ে দিল আগুন। আগুনে পুড়তে লাগল সেই ঘর, ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় তাদের দৃষ্টি হল রুদ্ধ। বাইরে যাবার যে রাস্তা তারা আগে থেকে করে রেখেছিল, তার দরজা আর খুঁজে পেল না। বীভৎসক প্রভৃতি সকলেই আগুনে পুড়ে সেখানেই মারা গেল।

রাক্ষস—(সাশ্রুনেত্র) কষ্ট! উহ্ কী কষ্ট!! দেখ দেখি বন্ধু হতভাগা দুরাত্মা চন্দ্রগুপ্তের ভাগ্যের জোর। কেননা—তাকে বধ করার জন্য যে বিষময়ী কন্যাকে আমি পাঠালাম, ভাগ্যের জোরে তাকে দিয়ে সে তার অর্ধেক রাজ্যের দাবিদার সুহৃদ পর্বতককে নিহত করল। (হাতে) শস্ত্র ও বিষ দিয়ে যাদের পাঠালাম, সেই সেই শস্ত্র ও বিষ-প্রয়োগেই তারা নিহত হল। দেখ, আমার নীতির চালগুলো মৌর্য্যের নানা শ্রেয় সাধনের মধ্য দিয়ে তার পক্ষেই সুফল প্রসব করছে ॥১৬।।

বিরাধগুপ্ত—অমাত্য, তা না হয় মানলাম। কিন্তু যে কাজটা শুরু হয়ে গেছে, তাকে তো আর মাঝখানে ছেড়ে দেওয়া যায় না। দেখুন—

নিকৃষ্ট লোকেরা বাধার ভয়ে কাজে হাতই দেয় না, মাঝারি ব্যক্তিত্বের লোকেরা কাজ শুরু করে ঠিকই, কিন্তু বিঘ্নের প্রতিবন্ধকতায় সে কাজ তাদের বন্ধ হয়ে যায়। অথচ যত বিঘ্নই বারবার এসে প্রতিকূলতা সৃষ্টি করুক না শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিরা তাদের আরদ্ধ ক্রিয়া পরিত্যাগ করেন না ॥১৭।। আরো দেখুন—শেষনাগের শরীরে কি বোঝার ভার লাগে না যে পৃথিবীকে সে ফেলে দিচ্ছে না? কিংবা সূর্যের কি পরিশ্রম হয় না যে সে কখনও ক্লান্ত হয়ে থেমে যায় না? কিন্তু শ্লাঘ্য পুরুষ দুর্বল ব্যক্তির মতো স্বীকৃত দায়িত্ব ত্যাগ করতে লজ্জা পায়। শুরু করলে সে কাজ শেষ করাই সজ্জনদের কুলব্ৰত ॥১৮॥

রাক্ষস—বন্ধু, তুমি তো চোখের ওপর দেখতেই পাচ্ছ—আমরা যে কাজ আরম্ভ করেছি তা আর ছাড়া যায় না।

তারপর, বল?

বিরাধগুপ্ত——তখন থেকেই চন্দ্রগুপ্তের দৈহিক নিরাপত্তার ব্যাপারে সতর্কতা হাজারগুণ বাড়িয়ে দিল ধূর্ত চাণক্য এবং ‘এ সব নাশকতা এদেরই কাজ’– এই সন্দেহে আপনাদের আস্থাভাজন যারা নগরে রয়ে গেছে, তাদের ওপর শুরু করল অত্যাচার।

রাক্ষস—(সোদ্বেগে) বল বল—কার কার ওপর অত্যাচার করেছে?

বিরাধগুপ্ত—প্রথমে সন্ন্যাসী জীবসিদ্ধিকে নিন্দায় কলঙ্কিত করে নগর থেকে বহিষ্কৃত করল।

রাক্ষস—(স্বগত)—এ না হয় সহ্য করলাম। যার কোনো আসক্তি নেই, স্থান-—পরিবর্তনে তার কিছু এসে যায় না। (প্রকাশ্যে) বয়স্য, কোন অপরাধে সে নির্বাসিত?

বিরাধগুপ্ত—‘এ রাক্ষসের নিযুক্ত বিষকন্যা দিয়ে পর্বতেশ্বরকে মেরেছে’—তাই।

রাক্ষস—(স্বগত) ভালো, কৌটিল্য, ভালো। নিজের গায়ে কলঙ্কের দাগ লাগল না, সব কেলেঙ্কারি চাপালে আমাদের ওপর। আর, অর্ধেক রাজ্যের দাবিদারকে করলে খতম। তাই বলি, একটিমাত্র নীতির বীজ পুঁতে তা থেকেই তুমি বহু ফল পেলে ॥১৯।।

(প্রকাশ্যে) তারপর, তারপর?

বিরাধগুপ্ত——তারপর—‘চন্দ্রগুপ্তের ওপর চড়াও হবার জন্য এ-ই দারুবর্মাদের লাগিয়েছে’ এ কথা নগরে প্রচার করে শকটদাসকে শূলে দেয়া হল।

রাক্ষস― (সাশ্রুনেত্রে) হা সখা শকটদাস! এমন মৃত্যু তোমাকে আদৌ মানায় না। অথবা প্রভুর কাজে তুমি প্রাণ দিয়েছ, তোমার জন্য অনুশোচনা করব না। অনুশোচনা আমাদের নিজেদের জন্যই করা উচিত—নন্দবংশের বিনাশেও যারা বাঁচতে ইচ্ছা করি

বিরাধগুপ্ত—অমাত্য, আপনি যা-ই করুন সে তো প্রভু কার্যোদ্ধারের জন্যই।

রাক্ষস—বন্ধু, প্রভু গেলেন পরলোকে, কৃতঘ্ন আমরা যে তার অনুগমন করলাম না—সে তো কেবল সেই উদ্দেশ্যেই, বেঁচে থাকার জন্য নয় ॥২০॥

বলে যাও আর কোন কোন বন্ধুর কী কী বিপদ হয়েছে—শোনার জন্য আমি প্ৰস্তুত।

বিরাধগুপ্ত—এটা জানতে পেরে চন্দনদাস অমাত্যের পরিবারকে অন্যত্র সরিয়ে দিয়েছে।

রাক্ষস—বন্ধু, নিষ্ঠুর ব্রাহ্মণ চাণক্যের বিরুদ্ধে তার এ কাজটা অন্যায় হয়েছে।

বিরাধগুপ্ত—অমাত্য, কিন্তু মিত্রদ্রোহ তো আরও অন্যায় হত।

রাক্ষস—তারপর, তারপর?

বিরাধগুপ্ত—তারপর বারবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও যখন অমাত্যের পরিবারকে সমর্পণ করল না, তখন অত্যন্ত রুষ্ট হয়ে চণ্ড চাণক্য—

রাক্ষস—(সোদ্বেগে) মেরে ফেলেনি তো?

বিরাধগুপ্ত—না। বাড়ির সব জিনিসপত্র বাজেয়াপ্ত করে স্ত্রী-পুত্রসহ তাকে কারাগারে ঢুকিয়ে দিয়েছে।

রাক্ষস—তবে যে, (সান্ত্বনার সুরে বললে)—‘রাক্ষসের পরিবারকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে! বরং বল—স্ত্রী-পুত্রসমেত রাক্ষসকে আটক রেখেছে।

পুরুষ—(প্রবেশ করে) অমাত্যের জয় হোক। এইমাত্র শকটদাস দোরগোড়ায় হাজির হয়েছেন।

রাক্ষস—ভদ্র, এ কী সত্য?

পুরুষ—মহামান্য অমাত্যের কাছে আমি কী মিথ্যা বলতে পারি?

রাক্ষস—বন্ধু বিরাধগুপ্ত, এ কী সম্ভব?

বিরাধগুপ্ত—অমাত্য, এমনটা হতেও পারে, কারণ বাঁচার হলে নিয়তিই বাঁচায়। রাক্ষস—প্রিয়ংবদক, এখনও দেরি করছ কেন? শীঘ্র তাকে নিয়ে এসো।

পুরুষ—অমাত্যের যা আদেশ। (নিষ্ক্রান্ত)।

(তারপর শকটদাস ও তার পেছন পেছন সিদ্ধার্থকের প্রবেশ)

শকটদাস—(স্বগত) মাটির ভেতর শূলটাকে পোক্তভাবে বসে যেতে দেখলাম যেমন পৃথিবীর বুকে মৌর্য তার প্রতিষ্ঠার ভিত করে দিল। দেখলাম আমার মাথায় পরিয়ে দেওয়া হয়েছে বধ্যমালা যা আমার বুদ্ধিভ্রংশ ঘটাচ্ছে যেমন তার (মৌর্যের) লক্ষ্মী তার বিচারবুদ্ধিকে করছে অবদলিত। এতসব দেখেও এবং প্রভুর সিংহাসনচ্যুতির সময়কার সেই ভয়াবহ দুঃসহ তূর্যনাদের মতো বধবাদ্যের ঢক্কাধ্বনি শুনেও যে আমার মন ভেঙে পড়েনি, তার কারণ, বোধ করি, এই যে প্রথম থেকেই আঘাতে আঘাতে আমার মন কঠিন হয়ে গেছে ॥২১॥

দেখে সানন্দে) এই তো বসে আছেন অমাত্য রাক্ষস—যিনি নন্দবংশের ক্ষয় হলেও প্রভুর প্রতি অক্ষয় ভক্তিতে এখনও প্রভুর কার্যভার বহন করছেন। পৃথিবীতে যারা প্রভুভক্ত, তাদের নিকট তিনি এক উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্তস্বরূপ ॥২২॥ (কাছে গিয়ে) অমাত্যের জয় হোক।

রাক্ষস–(দেখে সহর্ষে) সখা শকটদাস, বড়ো ভাগ্য যে কৌটিল্যের খপ্পরে পড়লেও তোমাকে আমরা (আবার) দেখতে পেলাম। এসো, আলিঙ্গন কর আমাকে।

শকটদাস—(তাই করল)।

রাক্ষস—(বহুক্ষণ ধরে আলিঙ্গন করে) এই-যে আসন, বসো।

শকটদাস—(উপবেশনের অভিনয় করল)।

রাক্ষস—সখা শকটদাস, আচ্ছা, আমার এমন হৃদয়-উল্লাসের নিমিত্ত কে? শকটদাস—(সিদ্ধার্থককে দেখিয়ে) এই প্রিয় সুহৃদ সিদ্ধার্থক ঘাতকদের তাড়িয়ে দিয়ে আমাকে বধ্যস্থান থেকে ছিনিয়ে এনেছে।

রাক্ষস—(সহর্ষে) ভদ্র সিদ্ধার্থক, এমন প্রিয় কার্যের প্রতিদানে কীই-বা যথেষ্ট? তবুও (এগুলো) তুমি নাও। (এই বলে নিজের গায়ের থেকে অলঙ্কার খুলে দান)।

সিদ্ধার্থক—(গ্রহণ করে পায়ে পড়ে স্বগত) আর্যের উপদেশ তো এই। ঠিক আছে, সে-রকমই করছি। (প্রকাশ্যে) অমাত্য, এখানে আমি এই প্রথম এলাম। আমার পরিচিত এখানে আর কেউ এমন নেই যার কাছে অমাত্যের এই অনুগ্রহের দান রেখে দিয়ে শান্তি পাব। তাই আমার ইচ্ছা—এই মুদ্রা দিয়ে চিহ্নাঙ্কিত করে অমাত্যেরই ধনাগারে রেখে দিই। যখন দরকার হবে, সময় মতো নিয়ে নেব।

রাক্ষস- ভদ্র এতে আর দোষ কী? শকটদাস, এরূপই করো।

শকটদাস—অমাত্যের যা আদেশ। (মুদ্রা দেখে জনান্তিকে)। অমাত্য, এ মুদ্রা আপনার নামাঙ্কিত।

রাক্ষস—(দেখে আত্মগত) সত্যি, নগর থেকে বেরিয়ে আসবার সময় আমার হাত থেকে ব্রাহ্মণী এটি তার বিচ্ছেদ যাপনের স্মারক হিশেবে নিয়েছিল। তা, এর হাতে এল কী করে? (প্রকাশ্যে) ভদ্র সিদ্ধার্থক, এ তুমি কোত্থেকে পেলে?

সিদ্ধার্থক—কুসুমপুরে আছেন মণিকারদের অগ্রণী নাম তাঁর চন্দনদাস। তাঁর বাড়ির দোরগোড়ায় পড়েছিল, আমি পেয়েছি।

রাক্ষস—ঠিক।

সিদ্ধার্থক—অমাত্য, এতে ঠিকটা কী?

রাক্ষস—ভদ্র, এটাই যে, খুব বড়লোকদের বাড়িতে এমন জিনিশ পড়ে থাকে ও লোকে পায়।

শকটদাস—বন্ধু সিদ্ধার্থক, অমাত্যের নামাঙ্কিত এই মুদ্ৰা। তাই তুমি এটি দিয়ে দাও, অমাত্য তোমায় এর চাইতে অনেক বেশি অর্থ দিয়ে খুশি করবেন।

সিদ্ধার্থক—আর্য, এ তো অনুগ্রহ যে অমাত্য এ মুদ্রা গ্রহণ করবেন। (মুদ্রা অর্পণ করল)।

রাক্ষস—বয়স্য শকটদাস, তুমি নিজের কাজের বেলায় এই মুদ্রাটিই ব্যবহার কোরো।

শকটদাস—অমাত্যের যা আদেশ।

সিদ্ধার্থক—অমাত্য, আমার একটা নিবেদন আছে।

রাক্ষস—স্বচ্ছন্দে বল।

সিদ্ধার্থক—এ তো অমাত্যের জানাই আছে যে, চণ্ড চাণক্যের অপ্রিয় কিছু করে পাটলিপুত্রে পুনরায় প্রবেশের পথ রুদ্ধ। আমার তাই ইচ্ছা—অমাত্যের চরণসেবা করি।

রাক্ষস—ভদ্র, এ প্রস্তাব আমার প্রিয়। এ অনুরোধ আমিই তোমাকে করতাম, কিন্তু তোমার অভিপ্রায় না জানায় গোপন রেখেছিলাম। অতএব এ তো করবেই।

সিদ্ধার্থক—(সহর্ষে) অনুগৃহীত হলাম।

রাক্ষস—সখা শকটদাস, সিদ্ধার্থকের বিশ্রামের ব্যবস্থা করাও।

শকটদাস—যা আদেশ। (সিদ্ধার্থকের সঙ্গে নিষ্ক্রান্ত)

রাক্ষস—বন্ধু বিরাধগুপ্ত, বৃত্তান্তের বাকিটা বলো। চন্দ্রগুপ্তের প্রজারা আমাদের ভেদনীতিমূলক ক্রিয়াগুলোকে ভালোভাবে নিচ্ছে তো?

বিরাধগুপ্ত—অমাত্য, নিচ্ছে তো বটেই; ব্যাপার যা প্রকাশ পাচ্ছে, তাতে তারা তদনুযায়ী কাজও করছে।

রাক্ষস—বন্ধু, কোনটা সেখানে প্রকাশ পেল?

বিরাধগুপ্ত—অমাত্য, এটাই সেখানে প্রকাশ যে, মলয়কেতু পালিয়ে যাবার পর থেকে চন্দ্রগুপ্ত চাণক্যের ওপর রুষ্ট হয়ে আছে; আর চাণক্যও তার উৎকট আত্মগরিমার বশে চন্দ্রগুপ্তকে সহ্য করতে পারছে না, নানাভাবে আজ্ঞা লঙ্ঘন করে চন্দ্রগুপ্তের মনঃকষ্ট বাড়িয়ে যাচ্ছে। আমার কাছেও ব্যাপারটা ঠেকেছে।

রাক্ষস—(সহর্ষে) বন্ধু বিরাধগুপ্ত, এই সাপুড়ের বেশেই তুমি আবার কুসুমপুরে যাও। সেখানে বৈতালিকের ছদ্মবেশে স্তনকলশ নামে আমার প্রিয় সুহৃদ বাস করছে। আমার কথা তুমি তাকে বলো গে, ‘যখনই চাণক্য আজ্ঞাভঙ্গের কাজ করে, তখনই চন্দ্রগুপ্তের যাতে উত্তেজনা বাড়ে—এমন এমন শ্লোক উচ্চারণ করে তার স্তুতি করতে থাকবে।’ কাজ কী হয়-না-হয়—অত্যন্ত সাবধানে করভকের মারফত জানিয়ে দেবে।

বিরাধগুপ্ত—অমাত্যের যা আদেশ। (নিষ্ক্রান্ত)

পুরুষ—(প্রবেশ করে) অমাত্যের জয় হোক। অমাত্য, শকটদাস জানাচ্ছেন, ‘এই তিনপ্রস্থ অলঙ্কার বিক্রির জন্যে এসেছে। অমাত্য এগুলো পরীক্ষা করে দেখুন।

রাক্ষস—(দেখে আত্মগত) বাহ্, অলঙ্কারগুলো খুবই মূল্যবান্। (প্রকাশ্যে) ভদ্র, আমার নাম করে শকটদাসকে বলো, ‘বিক্রেতাকে খুশি করে এগুলো রেখে দাও।’

পুরুষ—যা আদেশ। নিষ্ক্রান্ত)

রাক্ষস—আমিও অবিলম্বে করভককে কুসুমপুরে পাঠাই। (উঠে) দুরাত্মা চাণক্যের সঙ্গে চন্দ্রগুপ্তের বিচ্ছেদ হবে তো? অথবা আমার উদ্দেশ্যের চরিতার্থতাই আমি দেখছি। কারণ—পৃথিবীর সব রাজাই যে তার আজ্ঞা মানছে সেটাই মৌর্যের তেজ। ‘আমার আশ্রয়ে থেকেই এ রাজা হয়েছে’—এই ভেবেই চাণক্যের গর্ব। একজন রাজ্য পেয়ে কৃতার্থ হয়েছে, আরেকজন প্রতিজ্ঞার সাগর পাড়ি দিয়েছে। নিজ নিজ প্রয়াসে সাফল্যের এই অনুভূতিটাই কালে ছিদ্রপথ পেয়ে দুজনের সুসম্পর্কে ফাটল ধরাবে ॥২৩॥

[সকলে নিষ্ক্রান্ত]

।। রাক্ষসবিচার নামে দ্বিতীয় অঙ্ক সমাপ্ত ।।

***

প্রসঙ্গকথা – দ্বিতীয় অঙ্ক

১. সাপুড়ের ভূমিকায় ‘নীচপাত্র’ বিরাধগুপ্তের ভাষা প্রাকৃত! কিন্তু স্বগতোক্তির মুহূর্তে সে একাকী সংস্কৃত বলছে, সাপুড়ের ভূমিকায় সে তো নিজেকে এখন ভাবছে না। নাট্যশাস্ত্রীয় নিয়মে সে এখন ‘মধ্যম পাত্র’, এই ভাষা তার সংস্কৃত হতে বাধা নেই রাক্ষসের কাছেও সে তার বক্তব্য সংস্কৃতেই রেখেছে, কেননা সেখানেও তো ভাষাগত ভিন্ন পরিচয়ের প্রচ্ছদ নিষ্প্রয়োজন।

২. চাণক্যনীতির সঙ্গে বার্ধক্যের, নন্দের সঙ্গে কামের, মৌর্যের সঙ্গে ধর্মের এবং রাক্ষসের সঙ্গে লোভের তুলনা।

৩. ‘কুসুমরস’ থেকে সহৃদয় দর্শক কুসুমপুরবৃত্তান্তের কথাও বুঝবেন। নিজ নৈপুণ্যের সমগ্র কুসুমপুর বৃত্তান্ত সম্যক্ অবগত হয়ে ভ্রমণশীল (ভ্রমর) চর যা বিবৃত করবে তা অন্যের অর্থাৎ জিজ্ঞাসু প্রভুর কাজে লাগবে। এইটি হচ্ছে পদ্যাকারে এ পত্রের গূঢ় বক্তব্য!

৪. রাক্ষস যে চাণক্যের মতো সংগঠনশক্তির অধিকারী নন, এ বিস্মৃতি তার এক জোরালো নজির। নিজের পাঠানো গুপ্তচরকে নিজেই মনে করতে পারছেন না—এমন ভুল চাণক্যের প্রতিদ্বন্দ্বীকে মানায় না।

৫. পরিজনদের কাছে গুপ্তচরদের পরিচয় ব্যক্ত করার কথা নয়। কিন্তু রাক্ষস তাই করেছিলেন, ভুল নিজের কাছেই ধরা পড়ল, নাম অর্ধেক উচ্চারণ করেই হঠাৎ থামলেন! তারপর বাক্যার্থসঙ্গতির জন্য ‘নাম’কে বিশেষণরূপে ব্যবহার করলেন। বিকৃত রাধ বা বেশ যার সেই বিরাধ অর্থাৎ বিশ্রী পোশাক পরা।

৬. রাক্ষসের আবেগপ্রবণতা লক্ষণীয়। কুসুমপুর অবরোধ অতীতের ঘটনা! সেই বৃত্তান্ত শুনতে শুনতে রাক্ষস আত্মহারা হয়ে উত্তেজনায় ফেটে পড়েছেন। শার্দুল বিক্রিড়িত ছন্দে রচিত শ্লোকটিতে বীররসের মনোজ্ঞ স্ফূর্তি ঘটেছে।

৭. মহাভারতের দ্রোণপর্বে কর্ণের ‘একঘ্নী শক্তি’র কাহিনী বিবৃত আছে। দানবীর কর্ণ তাঁর কুণ্ডলসহ রক্ষা কবচ ছদ্মবেশী ইন্দ্রকে দান করলে ইন্দ্র তাঁকে একটি অমোঘ অস্ত্র দান করলেন। কিন্তু সেই অস্ত্রের শক্তি একজনকে হত্যা করেই নিঃশেষিত হবে—এটাই ছিল বৈশিষ্ট্য। এই অস্ত্রই একঘ্নী শক্তিরূপে খ্যাত।

৮. বিক্রেতাকে পর্যাপ্ত মূল্য দিয়ে অলঙ্কারগুলো কেনা হচ্ছে বটে, কিন্তু এই অলঙ্কারের জন্য রাক্ষসকে অনেক বেশি ‘মূল্য’ দিতে হবে। পঞ্চম অঙ্কের ১৭শ শ্লোক দ্রষ্টব্য। নাট্যবস্তুতে অলঙ্কারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা মৃচ্ছকটিকেও চারুদত্তকে চরম বিপদের সম্মুখে ঠেলে দিয়েছিল। (মৃচ্ছকটিক—৯ম অঙ্ক)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *