তৃতীয় অঙ্ক – কৃতককলহ

তৃতীয় অঙ্ক – কৃতককলহ

(তারপর কঞ্চুকীর প্রবেশ)

কঞ্চুকী—(সবিষাদে) চক্ষু, কর্ণ প্রভৃতি যে ইন্দ্রিয়গুলোর সাহায্য রূপাদি বিষয় ভোগ করে তুমি আত্মতৃপ্তি লাভ করতে, এখন তাদেরই নিজ নিজ বিষয়ের বোধশক্তি ক্ষীণ হয়ে গেছে। তোমার আজ্ঞাবহ-ভৃত্যের মতো অনুগত অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো অতিদ্রুত তাদের পটুতা হারিয়ে ফেলছে। জরা, দেখছি, তোমারই মাথায় পা দিয়ে ভর করেছে। তবে তুমি, হে তৃষ্ণা, বৃথাই কষ্ট পাচ্ছ ॥১॥

(পরিক্রমা করে—আকাশে) এই যে ওহে সুগাঙ্গ প্রাসাদের’ দায়িত্বে নিযুক্ত শিল্পীরা, পুণ্যশ্লোক দেব চন্দ্রগুপ্ত তোমাদের আদেশ করছেন, ‘কৌমুদী মহোৎসব আরম্ভ হওয়ায় এখন অনেক বেশি সুন্দর হয়ে ওঠা কুসুমপুরের দৃশ্য আমি দেখতে চাই। সুতরাং সুগাঙ্গ প্রাসাদের ছাদের যে যে জায়গা থেকে আমাদের দেখার সুবিধা, সেসব জায়গা ঠিকঠাক করে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখ। (আবার আকাশে) কী বলছ?—‘আর্য, প্রভু কি এটা জানেনই না যে কৌমুদী মহোৎসব` নিষিদ্ধ হয়ে গেছে?’ আহ্, হতভাগারা এমন অলক্ষুণে কথায় তোদের কাজ কী? এতে যে এক্ষুনি প্রাণটা যাবে! শীঘ্র এখন—ধূপগন্ধে সুরভিত করো স্তম্ভগুলোকে, ফুলের মালা পরিয়ে দাও ওদের গায়ে; এরপর পূর্ণিমার চাঁদের কোমল কিরণচ্ছটার মতো যাদের শুভ্রতা, বাছাই করা সেই চামরগুলোর শোভার মেলবন্ধন ঘটুক ওই স্তম্ভ- বীথির সঙ্গে।। দীর্ঘদিন ধরে সিংহলাঞ্ছিত ওই সিংহাসনের ভার সয়ে সয়ে পৃথিবীর মূর্ছা যাবার উপক্রম, কাজেই সত্বর কুসুম-সংমিশ্র চন্দনজল সিঞ্চন করে তাকে সঞ্জীবিত করে তোল ॥২॥

কী বলছ?—‘আর্য, এই এক্ষুনি মহারাজের আজ্ঞামতো কাজ করছি।’ তা ভালো মানুষেরা, ত্বরা করো। দেব চন্দ্রগুপ্ত এই এসে পড়লেন বলে! ওই যে তিনি—যিনি নবীন বয়সে সমুন্নত মস্তকে পৃথিবীর সেই গুরুভার বহনে প্রবৃত্ত হয়েছেন—যে দুর্বহভার রাজ্যশাসনের বন্ধুরপথে অবিচল কর্মদক্ষতার অধিকারী তাঁর পিতা সুবিশ্বস্ত অমাত্যাদি অঙ্গের সহায়তাই চিরটা কাল বয়ে এসেছেন। দৃঢ়চেতা এই চন্দ্রগুপ্ত শিক্ষানবিশির পর্যায়ে রয়েছেন বলে হোঁচট খাচ্ছেন ঠিকই, কিন্তু তবুও তাঁর মনে গ্লানি বাসা বাঁধছে না ॥৩॥ (নেপথ্যে)—এদিকে, এদিকে মহারাজ।

(রাজা ও প্রতিহারীর প্রবেশ)

রাজা—(স্বগত) রাজধর্ম ঠিক ঠিক পালন করতে হলে রাজ্য অবশ্যই রাজার পক্ষে দারুণ অস্বস্তির কারণ। কেননা—পরের স্বার্থ দেখতে দেখতে রাজার নিজের স্বার্থ যায় খোয়া। স্বার্থ যদি একেবারে নাই রইল, তবে তো বাস্তবিক তিনি ক্ষিতিপতি রইলেন না। পরার্থই যদি স্বার্থ অপেক্ষাও তাঁর নিকট শ্রেয় হয়, তবে হায়, তিনি পরেই অধীন। পরাধীন পুরুষ কী করে আনন্দ-রস আস্বাদ করবেন? ॥ ৪ ॥

আবার দেখ, যেসব রাজা আত্মসচেতন, তাঁদের পক্ষেও রাজলক্ষ্মীকে প্ৰস করা দুরূহ ব্যাপার। কেননা—রাজা কড়া-প্রকৃতির পুরুষ হলে লক্ষ্মী সোদ্বেগে সরে আসে তাঁর কাছ থেকে। আবার যাঁর স্বভাব কোমল তাঁর কাছেও লক্ষ্মী থাকে না এই ভয়ে যে, এই বুঝি লোকে অমান্য করল। মূর্খকে ঘৃণা করে, কিন্তু খুব বিদ্বানদের সঙ্গেও তার মাখামাখি নেই। বীর দেখলে ভীষণ ভয় পায়, অথচ একান্ত ভীরুদের করে উপহাস। প্রশ্রয় পেয়ে পেয়ে মাথায়-চড়া বারনারীর মতো রাজলক্ষ্মীর মন-রাখা বড় কঠিন কাজ ॥৫॥

এদিকে আবার, আর্য আদেশ করেছেন যে তাঁর সঙ্গে কপট কলহ করে কিছুকাল স্বাধীনভাবে রাজ্যের কাজকর্ম চালাতে হবে। এ যেন আমার কাছে পাপ-প্রস্তাব; বহু কষ্টে আমি এতে সায় দিয়েছি। অথবা, সতত আর্যের শিক্ষার গুণে আমার বুদ্ধি পরিচ্ছন্ন থাকায় আমি বরাবরই স্বাধীন কেননা—শিষ্য এ সংসারে ভালো কাজ করতে থাকলে গুরু তাকে বারণ করেন না। কিন্তু সে যখন মোহের বশে সুপথ ত্যাগ করে, গুরু তখন তার পক্ষে হন অঙ্কুশ। বিনয়নিষ্ঠ সজ্জনেরা তাই সদাই নিরঙ্কুশ (স্বাধীন)। এর চাইতে অতিরিক্ত কোনো স্বাধীনতায় আমার রুচি নেই।

(প্রকাশ্যে) আর্য বৈহীনরি, সুগাঙ্গপ্রাসাদের পথ দেখিয়ে চলুন

কঞ্চুকী—এদিকে, প্রভু এদিকে! (পরিক্রমার অভিনয় করে) এই সুগাঙ্গপ্রাসাদ। প্ৰভু ধীরে ধীরে উঠুন।

রাজা—(ওঠার অভিনয় করে—সব দিকে তাকিয়ে) আহ্, শরতের শোভায় ভরে গেছে সব দিক। খুব সুন্দর দেখাচ্ছে এদের। কেননা, দশদিক যেন দশটা বড় বড় নদীর মতো আকাশ থেকে ক্রমে সঙ্কীর্ণ হয়ে নেমে আসছে, দুপাশে তাদের ছেঁড়া-ছেঁড়া সাদা মেঘের সৈকত, কলকণ্ঠ সারসেরা দল বেঁধে সর্বত্র উড়ে বেড়াচ্ছে, নানান রূপের তারারা সব বিচ কুমুদের নিবিড় সৌন্দর্যে ফুটে আছে ॥৭॥

উপরন্তু—উদ্বৃত্ত জলরাশিকে স্বস্থানে সরিয়ে দিয়ে, শালিধানের উদ্ধত মাথাকে ফলভারে নুইয়ে দিয়ে, ময়ূরদের উগ্র বিষবৎ কাম-মত্তার উপশম করে দিয়ে—আহা! শরৎ যেন সমস্ত জগৎকে বিনয়েরই শিক্ষা দিচ্ছে ॥৮॥ এদিকে আবার—বহুবল্লভ স্বামীর প্রতি ঈর্ষা-কলুষিত পত্নীর দেহ ক্ৰমে কৃশ হতে থাকলে রতিকথাচতুরা দূতী যেমন বহু চেষ্টায় কোনোমতে তাকে প্রসন্ন করে শেষ পর্যন্ত দেহে-মনে-এক করে তার পতির সঙ্গে মিলনের অপেক্ষায় তার কাছে নিয়ে যায়, তেমনি এই শরৎ (নদী-গর্ভ থেকে দূরে সরে-যাওয়া বর্ষার ঘোলা জলে) আবিলা গঙ্গা ক্রমে শীর্ণ হওয়ায় তাকে ইদানীং অনাবিল করে নদীগর্ভমুখে কোনোমতে সুস্থির করে বহুনদীবল্লভ সাগরের সঙ্গে পুনরায় সর্বাত্মকভাবে মিলিয়ে দিতে চাইছে ।।৯।।

(চারদিক দেখার অভিনয় করে) এ কী! কুসুমপুরে কৌমুদীমহোৎসব শুরু হয়নি কেন? আর্য বৈহীনরি, আচ্ছা, আমার আদেশমতো আপনি কুসুমপুরে কৌমুদীমহোৎসব করার কথা ঘোষণা করেছিলেন তো?

কঞ্চুকী—আজ্ঞে, হ্যাঁ।

রাজা—পুরবাসীরা কী তবে আমার আদেশ গ্রাহ্য করল না?

কঞ্চুকী—(দুই কানে আঙুল দিয়ে) পাপ দূর হোক, পাপ দূর হোক। পৃথিবী প্রভুর যে আদেশ কখনো অন্যথা করেনি, সেই আদেশ পুরবাসীরা করবে অগ্রাহ্য?

রাজা—তবে কেন এখন কুসুমপুরে কৌমুদীমহোৎসব শুরু হল না? তবে কেন এখনও বাক্-চাতুরী পটু অনুগামী ভাঁড়দের খোলসা রঙ্গরসিকতা উপভোগ করতে করতে নিতম্বভারে স্লথগতি গণিকারা রাজপথ অলঙ্কৃত করছে না? সেরা বিত্তবান্ নাগরিকেরা কেন নির্ভয়ে পরস্পরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নিজ নিজ গৃহৈশ্বর্য প্রকট করে রমণীজন সঙ্গে চির-প্রতীক্ষিত এই পূর্ণিমা মহোৎসব উপভোগ করছে না? ॥ ১০॥

কঞ্চুকী—এটা ঠিক এমনি।

রাজা—সেটা কী?

কঞ্চুকী—প্ৰভু, এটা হল–।

রাজা—স্পষ্ট করে বলুন।

কঞ্চুকী—কৌমুদীমহোৎসব নিষিদ্ধ হয়েছে।

রাজা—(সক্রোধে) আহ্, কার নির্দেশে?

কঞ্চুকী—প্রভু, এর বেশি জানাতে পারব না।

রাজা—দুচোখে দেখবার মতো এমন সুন্দর জিনিশটাকে আর্য চাণক্য দর্শকের কাছ থেকে কেড়ে নিলেন না তো?

কঞ্চুকী—প্রাণের মায়া থাকতে আর কারই-বা সাধ্য প্রভুর আদেশ অমান্য করে। রাজা—শোণোত্তরা, আমি একটু বসতে চাই।

প্রতিহারী—মহারাজ, এই সিংহাসন, বসুন।

রাজা- (বসার অভিনয় করে) আর্য বৈহীনরি, আর্য চাণক্যের দেখা পেতে চাই।

কঞ্চুকী—প্রভুর যা আদেশ। (নিষ্ক্রান্ত)

(তারপর নিজবাটীতে আসনে বসে কোপাবিষ্ট চিন্তান্বিত চাণক্যের প্রবেশ)

চাণক্য—দুরাত্মা রাক্ষস কি আমার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চায়? কোপ-তাড়িত সর্পের ন্যায় কৌটিল্য নগর থেকে বেরিয়ে গিয়ে যেমন নন্দদের হত্যা করল ও মৌর্য বৃষলকে রাজা করল, আমিও তেমন মৌর্যকুলচন্দ্রের শ্রী হরণ করবে—এ সংকল্পকে মনে ঠাঁই দিয়ে এ (রাক্ষস) আমার বুদ্ধির মাহাত্ম্য ছাড়িয়ে যেতে চেষ্টা করছে ॥১১॥

(আকাশের দিকে চেয়ে) রাক্ষস, রাক্ষস, এই দুরন্ত প্রয়াস থেকে বিরত হও। অপদার্থ মন্ত্রীরাই যার রাজ্যের দায়-দায়িত্ব পালন করত, সেই গর্ব- স্ফীত রাজা নন্দ তো এ নয়, এ যে চন্দ্রগুপ্ত। আর তুমিও তো চাণক্য নও। তুমি আমার অনুকরণ করছ ঠিকই, কিন্তু আমার সঙ্গে মিল তোমার কেবল এক জায়গাতেই—যে, বৈরিতাটা বড়োয় বড়োয় ॥১২॥

(চিন্তা করে) অথবা এ ব্যাপারে আমার মনকে বেশি ব্যতিব্যস্ত করে কাজ নেই। কারণ, আমার নিযুক্ত লোকেরা পর্বত-পুত্র মলয়কেতুর বিশ্বাসভাজন হয়ে সেই সুযোগে তাকে সবদিক থেকে ঘিরে রেখেছে। সিদ্ধার্থক প্রভৃতি চরেরা নিজ নিজ কাজ হাসিল করতে তৎপর হয়ে উঠেছে। সম্প্রতি মৌর্যকুলচন্দ্র চন্দ্রগুপ্তের সঙ্গে কৃত্রিম কলহ করে বিরুদ্ধাচারী রাক্ষসকে—তা সে নিজের ধারণাতে যত দক্ষ ভেদনীতিজ্ঞই হোক্ না কেন—শত্রুর থেকে আলাদা করব ॥১৩।।

কঞ্চুকী—(প্রবেশ করে) চাকরি করা সত্যি কষ্টকর। ভয় করে চলতে হবে রাজাকে, তারপর মন্ত্রীকে, তারপর রাজার প্রিয়পাত্রকে; তারপর রাজবাড়িতে তাঁর অনুগ্রহ-পুষ্ট যেসব বিটেরা থাকে, তাদের ভয় করতে হবে, ভয় করতে হবে আরো অনেককে। পেটের দায়ে এর-ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকো, কত রকম মিথ্যা বলে মন জুগিয়ে চলো। দৈন্যের দরুনই এত কষ্ট যাকে করতে হয়, সেই ভৃত্যের কাজ তাকে হেয় করে তোলে। বিজ্ঞ লোকেরা যে বলেন—‘সেবা কুকুরের বৃত্তি’, কথাটা খাঁটি ॥১৪॥

(পরিক্রমা করে, তাকিয়ে) এই আর্য চাণক্যের বাড়ি। ভেতরে যাই তবে। (প্রবেশ করে, দেখে) আহা! রাজাধিরাজের যিনি মন্ত্রী, তাঁর এই ঐশ্বর্য! এই তো—ঘুঁটে ভাঙার জন্য এই একখণ্ড পাথর, ব্রাহ্মণ বালকদের জড়ো-করা এই কুশের গাদা! জীর্ণ কুটিরখানিও দেখা যাচ্ছে—ঘরের দেয়াল পড়ছে ধসে, এই-যে হোমের কাঠগুলো, শুকোতে দেওয়া চালের এদিকটা ঝুলে পড়েছে। অতএব এটা ঠিকই যে—প্রভু চন্দ্রগুপ্ত এঁর কাছে নেহাতই বৃষল। কারণ—যারা মিথ্যা বলে না, তেমন লোকও দৈন্যের দায়ে অযথা এমন প্রগল্ভতা করতে থাকে যে, মুখ শ্রান্ত হলেও তারা থামে না, রাজার আদৌ যেসব গুণ নেই—সেইসব গুণকীর্তন করেও তারা তাঁর স্তুতি করতে থাকে। এমন কাণ্ড যে লোকে করে, তার একমাত্র কারণ কিন্তু তৃষ্ণা। এ না হলে রাজা নির্লোভ ব্যক্তিদের নিকট তৃণবৎ উপেক্ষার পাত্র ॥১৫।।

(দেখে—সভয়ে) আরে, এই তো আর্য চাণক্য বসে আছেন। সহস্ররশ্মি সূর্যের কিরণ এককালে সর্বত্র যায় না, তাই (পৃথিবীতে) শীত ও গ্রীষ্ম পালা করে আসে। কিন্তু যিনি পৃথিবীকে তুচ্ছ করে নন্দের অস্ত ও মৌর্যের উদয়—একই কালে সংঘটিত করালেন, তিনি (চাণক্য) স্বতেজে সূর্যের তেজকেও অতিক্রম করেছেন ॥১৬।।

(মাটিতে হাঁটু গেড়ে) আর্যের জয় হোক।

চাণক্য—বৈহীনরি, আগমনের কী হেতু?

কঞ্চুকী—আর্য, যাঁর পাদপদ্মযুগল প্রণামের-ব্যগ্রতায়-আন্দোলিত ভূমিপালদের শিরোমাল্যের মণিমানিক্যের প্রভায় সতত পিঙ্গলবর্ণ, সেই পূণ্যশ্লোক প্ৰভু চন্দ্রগুপ্ত আর্যের চরণে নতশিরে প্রণাম করে নিবেদন করেছেন—‘কাজের কোনো বিঘ্ন না ঘটলে আর্যকে একবার দেখতে চাই।’

চাণক্য—বৃষল আমার দর্শন চায়। বৈহীনরি, আমি যে কৌমুদীমহোৎসব নিষেধ করেছি, সে কথাটা বৃষলের কানে যায়নি তো?

কঞ্চুকী—আর্য, গিয়েছে বৈ-কি?

চাণক্য—(সক্রোধে) আহ্, কে বলেছে?

কঞ্চুকী—(সভয়ে) আর্য প্রসন্ন হোন। প্রভু নিজেই সুগাঙ্গপ্রাসাদে আরোহণ করে দেখেছেন যে, নগরীতে কৌমুদীমহোৎসব শুরু হয়নি।

চাণক্য—আহ্, বুঝেছি। তারপর ঝোপ বুঝে কোপ মেরে তোমরা তাকে খেপিয়েছ। আর কী?

কঞ্চুকী― (ভয়ের অভিনয় করে, নীরবে অধোমুখে অবস্থান।)

চাণক্য—হায়! চাণক্যের প্রতি বিদ্বেষভাব পোষণে রাজ-পরিজনদের কী আগ্রহ! তারপর, বৃষল কোথায়?

কঞ্চুকী― (ভয়ের অভিনয় করে) আর্য, সুগাঙ্গপ্রাসাদ থেকেই প্রভু আমায় আপনার পদপ্রান্তে পাঠিয়েছেন।

চাণক্য—(উঠে) সুগাঙ্গপ্রাসাদের পথ দেখিয়ে চল।

কঞ্চুকী—এদিকে, এদিকে আর্য। (উভয়ের পরিক্রমা)

এই সুগাঙ্গ প্রাসাদ। আর্য ধীরে ধীরে উঠুন।

চাণক্য—(ওঠার অভিনয় করে ও দেখে) এই তো, সিংহাসনে বসে আছে বৃষল।

ভালো, ভালো!

যে নন্দরা রাজকার্যের ধার ধারত না, তাদের কাছ থেকে এ সিংহাসন ছাড়িয়ে নেওয়া হয়েছে; রাজাদের মধ্যে বৃষভের মতো পরাক্রান্ত বৃষল সেখানে অধিষ্ঠিত; এ সিংহাসন এতদিনে যোগ্য রাজার আসঙ্গ পেয়েছে। একসঙ্গে এ গুণগুলো দেখে আমার আনন্দের জোয়ার আরও বহুগুণ বেড়ে গেল ॥১৮।।

(নিকটে গিয়ে) বৃষলের জয় হোক।

রাজা–(আসন থেকে উঠে) আর্য, চন্দ্রগুপ্ত প্রণাম করছে। (পদতলে প্ৰণিপাত।)

চাণক্য—(হাতে ধরে) ওঠ, বৎস, ওঠ।

শিলাগাত্রের প্রান্ত দিয়ে সুরনদী গঙ্গার প্রবাহের ফলে যে তার জলকণা সংস্পর্শে চির-শীতল—সেই গিরিরাজ হিমালয় থেকে শুরু করে, নানা বর্ণের উদ্ভাসে অপরূপ মণিরাজির দ্যুতিতে দীপ্ত দক্ষিণ সাগরের সুদূর তীরভূমির শেষ অবধি—এই বিশাল ভূভাগ থেকে নিত্য আগত শত শত রাজার সভয় প্রণতির মুহূর্তে তাদের শিরোরত্নের জ্যোতিতে তোমার দু পায়ের আঙুলের ফাঁকগুলো সদাই ভরে থাক ॥১৯॥

রাজা—আর্যের অনুগ্রহে এ সবই আমার জুটেছে। আর্য দয়া করে উপবেশন করুন। (উভয়ের যথাযোগ্য স্থানে উপবেশন। )

চাণক্য—বৃষল, কেন আমাকে ডেকেছ?

রাজা—আর্যের দর্শন লাভে নিজেকে পরিতৃপ্ত করতে চাই বলে।

চাণক্য—(সম্মিতে) এ সৌজন্যে কাজ নেই। যাদের ওপর কার্যভার ন্যস্ত আছে, তেমন রাজপুরুষদের প্রভুরা বিনা প্রয়োজনে ডাকেন না।

রাজা—আর্য, কৌমুদীমহোৎসব নিষেধের ফল কী হবে ভেবেছেন? চাণক্য—(হেসে) তিরস্কারের জন্য তবে আমায় ডেকেছ?

রাজা- পাপের কথা থাক, পাপের কথা থাক। না, না, মোটেই তা না। সশ্ৰদ্ধ আবেদন করব বলেই ডেকেছি।

চাণক্য—যদি তাই হয়, তবে যাঁরা তোমার সশ্রদ্ধ আবেদনের পাত্র, তাঁদের স্বাধীন ইচ্ছায় শিষ্যের বাধ সাধা উচিত নয়।

রাজা- এ তো সঙ্গত, এতে সন্দেহ কী? কিন্তু আর্য তো কখনও নিষ্প্রয়োজনে কেবল খেয়ালবশে কিছু করেন না, তাই আমাদের প্রশ্নের অবকাশ রয়েছে। চাণক্য—বৃষল, ঠিকই ধরেছ, প্রয়োজন ছাড়া চাণক্য স্বপ্নেও কিছু করে না। রাজা—আর্য, তাই তো, সেটা শুনব বলেই এত প্রশ্ন করছি!

চাণক্য—বৃষল, শোন। অর্থশাস্ত্র প্রণেতারা জগতে তিন প্রকারের সিদ্ধির কথা বলেন—রাজায়ত্ত, সচিবায়ত্ত এবং উভয়ায়ত্ত।[৩] তোমার সিদ্ধি যেখানে সচিবায়ত্ত, সেখানে তোমার প্রয়োজনের খোঁজে কাজ কী? কারণ, দায়িত্ব যখন আমার, এ বিষয়ে যা করার আমিই করব।

রাজা—(কোপবশে মুখ ফিরিয়ে নিলেন)

(নেপথ্যে দুজন বৈতালিকের বন্দনা।)

প্রথম—শরৎকালে কাশফুলের শুভ্রতায় দিমণ্ডল সাদা হয়ে যায়, (তাণ্ডবকালে) শিবদেহের বিভূতি কাশের শুভ্রতার চেয়ে বেশি শুভ্রতায় আকাশের রঙ করে দেয় সাদা। শরতে চাঁদের রশ্মিচ্ছটা শ্যামল মেঘকে ধবল করে তোলে, তেমনি শিবের শিরোধৃত চন্দ্রলেখার আলোকচ্ছটায় মেঘমলিন গজচর্ম হয়ে ওঠে শুভ্রতায় ভাস্বর। শরতে শুভ্র জ্যোৎস্নার উদ্ভাস, শিবদেহে শ্বেতোজ্জ্বল নরকপালের উৎকট বিলাস। শরতে রাজহংসশ্রেণি অমল সুষমা ছড়িয়ে দেয়, তেমনি অট্টহাসে শিবের দন্তপক্তি অপূর্ব শুক্ল-শ্রীমণ্ডিত হয়। শিবদেহের সদৃশ এ হেন শরৎ তোমাদের ক্লেশ মোচন করুন ॥২০॥

আবার—সর্পশরীর যার প্রশস্ত শয্যা, ফণামণ্ডল যার উপাধান, সেই শ্রীহরির সবে নিদ্রাভঙ্গ হয়েছে। তাই, সদ্য উন্মীলনের ফলে এখনো যার ঘোর কাটেনি, সর্পশিরস্থ মণিদীপের উজ্জ্বল আলোর দিকে তাকাতে যার অনিচ্ছা, আড়মোড় ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে হাই তোলায় সহসা যে অশ্রুকণায় আচ্ছন্ন, নিজের দর্শন ক্রিয়ার ব্যাপারে এখনও যার জড়তা, নিদ্রাভঙ্গে এখনও যে আরক্ত এবং অর্ধমুদ্রিত—শ্রীহরির সেই নয়ন তোমাদের নিত্য রক্ষা করুক।।২১।।

দ্বিতীয়—হে নরোত্তম, কোনোও উদ্দেশ্যে বিধাতা যাঁদের মহাপরাক্রমের আধাররূপে সৃষ্টি করেছেন, তাঁদের স্বীয় মর্যাদা ও গর্ববোধ প্রকট। নিজ শৌর্যে মদজলস্রাবী হাতিদের যূথপতিদের যারা বিজেতা সেই পশুরাজগণ যেমন অন্যে তাদের দন্তভঙ্গ করুক—এটা কদাচ সহ্য করতে পারে না, তেমনি আপনার মতো অতি-বিরল সার্বভৌম নৃপতিরা—কেউ তাঁদের আদেশ ভঙ্গ করুক—এটা সইতে পারেন না ॥২২॥

উপরন্তু—প্রভু অলঙ্কারাদি উপভোগ করলেই ‘প্রভু’ হয় না, অন্যেরা যাঁর আজ্ঞা হেয় করতে পারে না—আপনার মতো সেই প্রভুই ‘প্রভু’ ॥২৩॥

চাণক্য—(শুনে স্বগত) প্রথমটি তো হল দেবতাবিশেষের স্তুতি, শুভাশংসারূপে গীত হয়েছে, উপলক্ষ—সদ্য প্রবৃত্ত শরৎ ঋতুর গুণকীর্তন। আরেকটি যে কী ঠিক বুঝতে পারছি না। (চিন্তা করে)—হ্যাঁ, বুঝেছি। এটা রাক্ষসের চাল। দুরাত্মা রাক্ষস, ধরা পড়লে যে! কৌটিল্য জেগেই আছে।

রাজা—আর্য বৈহীনরি, এই বৈতালিক দুজনকে শতসহস্র সুবর্ণ মুদ্ৰা দাও।

কঞ্চুকী—প্রভুর যা আদেশ। (উঠে পরিক্রমা)

চাণক্য—(সক্রোধে) বৈহীনরি, দাঁড়াও, যেয়ো না। বৃষল, অস্থানে এত বিপুল অর্থব্যয় কেন?

রাজা—(কোপান্বিত হয়ে) আর্য, এভাবে সব কাজের বেলাতেই আমাকে বাধা দেওয়ায় রাজ্য যে আমার পক্ষে কারাগারতুল্য হয়ে পড়েছে, রাজ্য আর রাজ্যের মতো নেই।

চাণক্য—বৃষল, নিজেরা কাজকর্ম না দেখলে রাজাদের এসব অসুবিধা সইতে হয়। তা যদি না সও, তবে নিজেই কাজকর্ম দেখ।

রাজা—এবার থেকে আমিই আমার কাজকর্ম দেখব!

চাণক্য—এ আমার সুখের কথা। আমিও আমার কাজ করি।

রাজা—যদি তাই হয়, তবে কৌমুদীমহোৎসব নিষেধ করার প্রয়োজনটা শুনতে চাই। চাণক্য—বৃষল, কৌমুদীমহোৎসবের প্রয়োজনটাও-বা কী আমিও তা জানতে চাই। রাজা—প্রথমত, আমার আজ্ঞার লঙ্ঘন না হয়।

চাণক্য—কৌমুদীমহোৎসব নিষেধের ক্ষেত্রে তোমার আজ্ঞার অন্যথা করাই ছিল আমারও প্রথম উদ্দেশ্য। কেননা—তমাল তরুর নবপল্লবে শ্যামল যাদের বেলাবনাঞ্চল, চঞ্চল তিমিদের চলাচলে যাদের জলের তলদেশ পর্যন্ত আন্দোলিত, সেই চার সাগরের পার থেকে শত শত নৃপ এসে তোমার আজ্ঞা অম্লান পুষ্পমালার মতো শিরোধার্য করছে, সেই আজ্ঞার স্খলন কেবল আমার বেলাতেই যদি ঘটে, তবে তাতে এটাই প্রকাশ পায় যে, বিনয়ই তোমার সার্বভৌমত্বের অলঙ্কার ॥২৪॥

অতঃপর দ্বিতীয় প্রয়োজন যদি শুনতে চাও, তবে তাও বলব।

রাজা—বলুন।

চাণক্য—শোণোত্তরা, আমার নাম করে কায়স্থ অচলকে বল, “ভদ্রভট প্রভৃতির (যারা বিরক্তিবশত আমাদের এখান থেকে চলে গিয়ে মলয়কেতুর শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে) সম্পর্কে যে প্রামাণ্য পত্র রয়েছে, তা দিয়ে দাও।”

প্রতিহারী—আর্য যা আদেশ করেন। (বেরিয়ে গিয়ে আবার প্রবেশ) আৰ্য, এই পত্ৰ।

চাণক্য—(নিয়ে) বৃষল, শোন।

রাজা—হ্যাঁ, মনোনিবেশ করেছি।

চাণক্য—(পাঠ) “স্বস্তি। পুণ্যশ্লোক প্রভু চন্দ্রগুপ্তের সঙ্গে একজোটে যেসব প্রধান রাজকর্মচারী দাঁড়িয়েছিল, যারা এখান থেকে পালিয়ে দুর্ভাগা মলয়কেতুর শরণাপন্ন হয়েছে, তাদের বিবরণ লিপিবব্ধ রয়েছে এই পত্রে! তারা হল প্রথমে—গজাধ্যক্ষ ভদ্রভট, অশ্বাধ্যক্ষ পুরুষদত্ত, দৌবারিক প্রধান চন্দ্রভানুর ভাগিনেয় ডিঙ্গরাত, প্রভুর দূরসম্পর্কের কুটুম্ব মহারাজ বলগুপ্ত, প্রভুরই শৈশবের সেবক রাজসেন, সেনাপতি সিংহবলের অনুজ ভাগুরায়ণ, মালবরাজের পুত্র লোহিতাক্ষ, ক্ষত্রিয়দের অগ্রণী বিজয়বর্মা।” রাজা—আচ্ছা, এদের বিরক্তির কারণগুলো জানতে চাই! চাণক্য—বৃষল, শোন। এদের মধ্যে ভদ্রভট ও পুরুষদত্ত নামে যে দুজন যথাক্রমে গজাধ্যক্ষ ও অশ্বাধ্যক্ষ, সে দুটোই বারনারী, মদ ও মৃগয়া নিয়ে মেতে থাকায় হাতি-ঘোড়ার দেখাশোনায় মনই দিতে পারে না। আমি তাই এদের কাজ থেকে ছাড়িয়ে দিয়ে কেবল জীবিকানির্বাহের মতো বৃত্তি-ব্যবস্থা করেছি। এই জন্যে এরা শত্রুপক্ষে যোগ দিয়ে মলয়কেতুর আশ্রয়ে নিজ নিজ বিভাগে চাকরি নিয়েছে। আর এই যে ডিঙ্গরাত ও বলগুপ্ত—এরা দুজন অত্যন্ত লোভে পড়ে তোমার দেওয়া বেতন নেহাত অপ্রতুল মনে করে সেখানে অনেক পাবে—এই আশায় গিয়ে মলয়কেতুর শরণাপন্ন হয়েছে। আর, এই যে তোমার শৈশবের সেবক রাজসেন—সে তো তোমার কৃপায় হঠাৎ হাতি, ঘোড়া ও টাকা-পয়সা সমেত অতি-বিপুল ঐশ্বর্যের মালিক হয়ে—সেগুলো যদি আবার কেড়ে নেওয়া হয়—এই ভয়ে এ পক্ষ ছেড়ে গিয়ে মলয়কেতুকে আশ্রয় করেছে। এই যে সেনাপতি সিংহবলের ছোট ভাই ভাগুরায়ণ, তারও তো সে সময়ে পর্বতকের সঙ্গে সৌহার্দ জন্মেছিল; সেই স্নেহে সে ‘তোমার পিতাকে মেরেছে চাণক্য’—এই গল্প বলে ভয় পাইয়ে দিয়ে মলয়কেতুকে ভাগিয়ে দিল। তারপর, তোমার অনিষ্টকারী চন্দনদাস প্রভৃতির যখন সাজা হল, তখন নিজের দোষের কথা ভেবে দণ্ডের আশঙ্কায় সে পালিয়ে গিয়ে মলয়কেতুর আশ্রয় নিল। ‘এ আমার প্রাণরক্ষক’—এই কৃতজ্ঞতার অনুরোধে মলয়কেতুও তাকে নিজ পদমর্যাদার ঠিক পরবর্তী সম্মান—মন্ত্রীপদ দিয়ে কাছে রেখে নিল। শেষের দুজন—লোহিতাক্ষ ও বিজয়বর্মা—তারাও অত্যন্ত অভিমানবশে ওদের নিজ নিজ জ্ঞাতিদের যা দাও তা সহ্য করতে না পেরে মলয়কেতুর পক্ষে গেছে। এই হচ্ছে এদের বিরাগের কারণ।

রাজা—এভাবে এদের বিরাগের কারণগুলো যখন জানাই ছিল, তখন আর্য কালাতিপাত না করে কেন প্রতিবিধান করলেন না?

চাণক্য—প্রতিবিধান করতে পারা গেল না।

রাজা—কৌশলের অভাবে, না কি কোনো মতলবের খাতিরে?

চাণক্য—কৌশলের অভাব হতে যাবে কেন? মতলবের খাতিরেই।

রাজা—মতবলটা এখন শুনতে চাই।

চাণক্য—শোন এবং অনুধাবন করো। কর্মচারীরা বিরাগের বশবর্তী হলে তার দুরকম প্রতিবিধান জগতে প্রচলিত আছে—অনুগ্রহ এবং নিগ্রহ। কর্মচ্যুত ভদ্রভট ও পুরুষদত্তের প্রতি অনুগ্রহের মানে দাঁড়ায় তাদের আবার চাকরিতে নেওয়া। ব্যসনের প্রতি এত টান যে কাজে মন টেকে না—এমনতরো লোককে পুনর্নিয়োগ করার অর্থ রাজ্যের প্রধান অবলম্বন যে হস্তী ও অশ্ব—তাদের নির্ঘাত সর্বনাশ ডেকে আনা। ডিঙ্গরাত ও বলগুপ্ত এত বেশি লোভী যে এদের গোটা রাজ্যটা দিয়ে দিলেও এরা সন্তুষ্ট হবে না। এদের প্রতি অনুগ্রহ কীভাবে সম্ভব? রাজসেনের রয়েছে ধনের ভয়, আর ভাগুরায়ণের প্রাণের ভয়—এদের দুজনের প্রতিই-বা অনুগ্রহের অবকাশ কোথায়? লোহিতাক্ষ আর বিজয়বর্মার অভিমান এত দুরন্ত যে নিজ নিজ জ্ঞাতিদের মান-সম্মানও বরদাস্ত করতে পারে না, কী প্রকারের অনুগ্রহে এরা প্রীত হবে? অতএব আমি প্রথম বিকল্প (অনুগ্রহের প্রসঙ্গ) ছেড়ে দিয়েছি। পরের বিকল্পের (নিগ্রহের) কথা ভেবে দেখেছি যে আমরা মাত্র অল্প কিছুকাল নন্দের রাজ্য অধিকার করেছি। যে সমস্ত প্রভাবশালী রাজকর্মচারী আমাদের সংগ্রামের মুহূর্তে পাশে দাঁড়িয়েছিল, তাদের এখনি উগ্র দণ্ড দিয়ে নিগৃহীত করলে নন্দবংশের প্রতি এখনো যারা অনুরক্ত, সেইসব প্রজারা আমাদের বিশ্বাস করবে না। অতএব এ পক্ষ ও আমি পরিহার করেছি। সুতরাং আমাদের পক্ষের লোকগুলোকে অনুগ্রহ দেখিয়ে পর্বতকপুত্র মলয়কেতু দলে টেনেছে। তার পিতার হত্যার দরুন সে তো আমাদের প্রতি রুষ্টই ছিল। এখন সে রাক্ষসের পরামর্শ শুনে শুনে বিশাল ম্লেচ্ছবাহিনী পরিবৃত হয়ে আমাদের আক্রমণ করতে উদ্যত হয়েছে। এটা তাই উদ্যমের কাল, উৎসবের কাল নয়। তাই যেখানে দুর্গের সংস্কারকার্য আরম্ভ করতে হবে, কৌমুদীমহোৎসবে সেখানে কী প্রয়োজন? নিষেধ আমি সেজন্যই করেছি।

রাজা—আর্য, এ বিষয়ে বহু প্রশ্ন করার আছে।

চাণক্য—বৃষল, স্বচ্ছন্দে প্রশ্ন কর। আমারও এতে অনেক বলবার আছে। রাজা—এসব অনর্থের হেতু সেই মলয়কেতু যখন পালিয়ে গেল, তখন আপনি কেন দেখেও দেখলেন না?

চাণক্য—বৃষল; উদাসীন যদি না থাকতাম, তবে দুটি পথ আমাদের পক্ষে খোলা থাকত—হয় তাকে দণ্ড দিয়ে হত, নয়তো প্রতিশ্রুত রাজ্যার্ধ তাকে দিতে হত। তাকে (মলয়কেতুকে) যদি নিগ্রহ করা হত—তবে আমাদের নিজেদের দিক থেকেই এটা সমর্থিত হত যে ‘পর্বতককে আমরাই হত্যা করেছি’—অর্থাৎ সেই বিশ্বাসঘাতকতার ব্যাপারে আমাদের হাত ছিল। আর প্রতিশ্রুত রাজ্যার্ধ যদি তাকে দিতাম, তবে পর্বতককে হত্যা করে আমাদের কেবল কৃতঘ্নতার পাপটাই হত সম্বল। তাই মলয়কেতুর পালিয়ে যাবার ব্যাপারে আমি ছিলাম উদাসীন।

রাজা—এক্ষেত্রে না হয় এটাই হল। কিন্তু রাক্ষস তো এখানেই বাস করছিল। তবুও আর্য তার প্রতি উদাসীন ছিলেন। এ প্রশ্নে আর্যের কী উত্তর আছে?

চাণক্য—যেসব প্রজারা নন্দের অনুরক্ত এবং চরিত্রের মর্যাদা জানে, তারা তাদের প্রভুর প্রতি রাক্ষসের অবিচল ভক্তি দেখে এবং সুদীর্ঘকাল একত্রে বাস করার ফলে রাক্ষসকে অত্যন্ত বিশ্বাস করে; রাক্ষস নিজে প্রজ্ঞা ও পৌরুষবান্, সহায়-সম্পদ তার প্রচুর, অর্থও রয়েছে পর্যাপ্ত। সে যদি এখানে এই নগরের মধ্যেও থেকে যেত, তবে নিশ্চিত নাগরিকদের মধ্যে বড় রকমের বিক্ষোভের সঞ্চার ঘটাত। দূরে সরিয়ে দেওয়ায় এটাই হয়েছে যে বাইরে বাইরে সে যতই ঝঞ্ঝাট বাধাক, কোনো-না-কোনো উপায়ে তাকে বশে আনতে পারব। অতএব সে যখন এখানে ছিল, সে ছিল হৃদয়ের শেল, দূরে ঠেলে দিয়ে সে শেল উপড়ে ফেলেছি[৪]।

রাজা—আর্য, বলপ্রয়োগ করে তাকে বন্দি করলেন না কেন?

চাণক্য—সে যে রাক্ষস। জোর করে ধরতে গেলে সে হয় তোমার বহু সৈন্য নাশ করত, নয়তো নিজেকেই নাশ করত! তা করলে…দুদিকের দোষ। দেখ—বেশি জোর-জুলুম করলে সে যদি মৃত্যুবরণ করত, তবে বৃষল, তুমি তো তার মতো একজন পুরুষকে চিরতরে হারাতে। অথবা, সে যদি তোমার সেনাবাহিনীর পুরোধাদের নিহত করত, সেটাও হত ক্ষতিকর। সুতরাং বন্য হস্তীর মতোই তাকে কৌশলে বশ করতে হবে ॥২৫॥

রাজা সাধ্য নেই—কথায় আর্যের সঙ্গে পেরে উঠি। সব দিক থেকে দেখা যাচ্ছে- অমাত্য রাক্ষসই এক্ষেত্রে অধিক প্রশংসার যোগ্য।

চাণক্য (সক্রোধে) “আপনি নন”–এটুকু তোমার কথার বাকি অংশ। ওহে বৃষল, কোন কাজটা সে করেছে?

রাজা—যদি না-জানা থাকে তবে শুনুন! সেই মহাত্মাই তো আমাদের অধিকৃত পুরীতে আমাদের গলায় পা দিয়ে যত দিন খুশি থেকে গেলেন! বিজয়-ঘোষণা করতে গেলে তিনি আমাদের সৈন্যদের জোর করে বাধা দিলেন। তাঁর বহুধা-ব্যাপ্ত রাজনীতির মহিমায় আমরা এমন সংঘাতিকভাবে সম্মোহিত হয়েছি যে আমাদের মন এখন বিশ্বস্ত আপনজনকেও বিশ্বাস করতে আর ভরসা পায় না ॥২৬।।

চাণক্য–(হেসে) রাক্ষস এই করেছে! বৃষল, আমি কিন্তু ধারণা করেছিলাম যে, নন্দের মতো তোমাকে উৎখাত করে তোমার মতো মলয়কেতুকে পৃথিবীতে সার্বভৌম-রাজপদে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

রাজা- এ কাজ তো অন্যে করেছে, আর্যের তাতে কোন কৃতিত্ব?

চাণক্য—ওহে হিংসুক; অন্য কে রাক্ষসের মুখের ওপর উদ্দীপ্ত কোপের আবেশে কম্পমান অঙ্গুলির অগ্রভাগে শিখাবন্ধন খুলে দিয়ে তাবৎ শত্রুর বংশ নিঃশেষে ধ্বংস করার দুঃসাধ্য দীর্ঘ প্রতিজ্ঞা উচ্চারণ করে গর্বোদ্ধত নিরানব্বই শত-কোটি স্বর্ণমুদ্রার স্বত্বাধিকারী নন্দদেরকে রাক্ষসের চোখের সামনেই বলির পশুর মতো পালা করে হত্যা করেছিল? ॥২৭॥

অধিকন্তু তাকিয়ে দেখ——নন্দদের গলিত-শবদেহ-নিঃসৃত মেধধারায় পুষ্ট চিতাগ্নি আজও নির্বাপিত হয়নি, সে অগ্নি শ্মশানবাসী জন্তুদের নন্দদের দেহাবশেষ ভক্ষণের সুযোগ দিয়ে তৃপ্ত করছে, সেই অগ্নির ধূমে দিগুলে সূর্যের কিরণ ঢাকা পড়ে গেছে, বড়ো বড়ো নিষ্কম্প পাখায় শকুনগুলো আকাশে চক্রাকারে আবর্তিত হচ্ছে; দেখে মনে হচ্ছে—দিমণ্ডল যেন মেঘাচ্ছন্ন হয়ে গেছে[৫] ॥২৮।।

রাজা—সে তো অন্যে করেছে।

চাণক্য—আহ্, কে করেছে?

রাজা—নন্দবংশবিদ্বেষী দৈব।

চাণক্য—দৈবের দোহাই মূর্খেরা দেয়।

রাজা—বিদ্বানরাও বড়াই করেন না!

চাণক্য—(সকোপে) বৃষল, তুমি কী ভৃত্যের মতো আমার ওপর প্রভুত্ব ফলাতে চাও? শিখা বন্ধ হলেও তাকে মুক্ত করতে হস্ত আবার ধাবিত হচ্ছে। (ভূমিতে পদাঘাত করে) পুনর্বার শপথের বেদিতে আরোহণের জন্য আমার এই চরণ চঞ্চল হচ্ছে। কাল তোমার ঘনিয়ে এসেছে, নন্দদের বিনাশের পর যে ক্রোধানল আমার প্রশমিত হয়েছিল, এখন তাকেই তুমি প্রজ্বলিত করছ ॥২৯।।

রাজা–(সোদ্বেগে-স্বগত) আরে! আর্য কী তবে সত্যিই কুপিত হলেন!

ক্রোধে কম্পমান চোখের পাতা থেকে নির্মল অশ্রুজল ঝরে পড়ায় ক্রোধতপ্ত চোখের রক্তিম ভাব কিছুটা কমলেও পিঙ্গল নেত্র-জ্যোতির ঊর্ধ্বে বঙ্কিম ধূমশিখার মতো ভ্রুভঙ্গ হতে লাগল। তিনি ভূমিতে পদাঘাত করা মাত্র পৃথিবীতে এক প্রচণ্ড কম্পন অনুভূত হল, তবুও সে পদাঘাত পৃথিবী কোনোমতে সয়ে নিল, সম্ভবত সে সময়ে তাণ্ডবকালে শিবের রৌদ্ররসের অভিনয়ের কথা পৃথিবীর স্মরণে এসেছিল ॥৩০॥

চাণক্য—(কপট কোপ সংবরণ করে) বৃষল, বৃষল, বাদানুবাদে কাজ নেই। যদি বোঝ রাক্ষস আমার চেয়ে যোগ্যতর, তবে এই শস্ত্র তাকে দাও। (শস্ত্র ত্যাগ করে, দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ করে) রাক্ষস, রাক্ষস, তুমি কিনা কৌটিল্যের বুদ্ধিকে জয় করতে চাও, আর এই তোমার বুদ্ধির মাহাত্ম্য!

‘চাণক্য থেকে ভক্তি সরে গেলে মৌর্যকে আমি সহজে জয় করব’—এই আশায় তুমি যে ভেদনীতি সম্প্রতি প্রয়োগ করেছিলে ওহে শঠ, সে নীতির সবটা তোমারই সর্বনাশ ডেকে আনবে ॥৩১॥ (নিষ্ক্রান্ত)

রাজা—আর্য বৈহীনরি, প্রজাদেরকে জানিয়ে দিন যে আজ থেকে চন্দ্রগুপ্ত চাণক্যের অপেক্ষা না রেখে নিজেই রাজ্য পরিচালনা করবে।

কঞ্চুকী—(আত্মগত) কী করে বিশেষণহীন ‘চাণক্য’ বললেন, ‘আর্য চাণক্য’ বললেন না! হায়! কাজের পাট তাঁর চুকিয়ে দেওয়া হল। অথবা, এ ব্যাপারে প্রভুর সত্যি কোনো দোষ নেই। কারণ, রাজা যে অসম্মান করছেন সেটা মন্ত্রীরই দোষ। মাহুতের দোষেই হাতি ‘খ্যাপা হাতি’ বলে দুর্নামের ভাগী হয় ॥৩২॥

রাজা—আর্য, কী ভাবছেন?

কঞ্চুকী—কিছু না, প্রভু। ভাগ্যে প্রভু এতদিনে যথার্থ প্রভু হয়েছে।

রাজা—(স্বগত) আমাদের লোকে এভাবে বুঝলে, আর্য যে উদ্দেশ্য সিদ্ধির কথা ভেবেছেন, তাতে তিনি সিদ্ধকাম হন। (প্রকাশ্যে) শোণোত্তরা, এই বিরস বিবাদে মাথায় আমার যন্ত্রণা হচ্ছে।[৬ শয়নগৃহের পথ দেখিয়ে চল।

প্রতিহারী—আসুন, প্ৰভু আসুন।

রাজা—(আত্মগত) আর্যের আজ্ঞাতেই আমি তাঁর গৌরব লঙ্ঘন করেছি, তাতেই তার ইচ্ছা হচ্ছে—ভূমিগর্ভে আত্মগোপন করি। আর, যারা বাস্তবিকই গুরুজনদের অবমাননা করে, তাদের হৃদয় কেন লজ্জায় বিদীর্ণ হয় না?

[সকলে নিষ্ক্রান্ত]

‘কৃতককলহ’ নামে তৃতীয় অঙ্ক শেষ।

***

প্রসঙ্গকথা – তৃতীয় অঙ্ক

১. পাটলিপুত্রের রাজপ্রাসাদের নাম ‘সুগাঙ্গ-প্রাসাদ’ গঙ্গার শৈত্য-পাবনত্বাদির সঙ্গে এ প্রাসাদের সম্পর্কের নিবিড়তা ‘সুগাঙ্গ’ নাম থেকেই প্রতীত হয়। গঙ্গা ও শোণের সঙ্গমে অবস্থিত পাটলিপুত্রের এই রাজপ্রাসাদ সেযুগে শিল্প ও কারুকার্যের এক অপূর্ব নিদর্শন ছিল।

২. শরতের পূর্ণিমা রাতে (আশ্বিন বা কার্তিক মাসে) কৌমুদী মহোৎসব ভারতবর্ষে অতি প্রাচীন কাল থেকে প্রচলিত এক জনপ্রিয় উৎসব। পশ্চিম ভারতে আজও এ দিনটিতে মানুষ সাদা পোশাক পরে, সাদা রঙের খাবার খায়, পরিবেশনেও সাদা জিনিশপত্র ব্যবহার করে। রাত্রি-জাগরণ এবং নৃত্যগীত এ উৎসবের অপরিহার্য অঙ্গ। এ নাটকে অবশ্য পারিবার্শ্বিক সাক্ষ্য থেকে এটা অনুমিত হয় যে, এ উৎসব কার্তিক মাসে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। কার্তিক মাসেরই এক নাম কৌমুদ (‘কৌমুদঃ স্যাৎ কার্তিককে’।)

৩. পূর্ববর্তী অর্থশাস্ত্রকারগণ ত্রিবিধা সিদ্ধি বা তিন রকমের রাজতন্ত্রের কথা বলেছেন। চাণক্য বা কৌটিল্যের কাছে বরণীয় রূপটি কিন্তু সচিবায়ত্ত রাজতন্ত্র। সচিবায়ত্ত রাজতন্ত্রে রাজার স্বেচ্ছাচারিতার সুযোগ অপেক্ষাকৃত কম : কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্রে বলেছেন—সহায়সাধ্যং রাজত্বং চক্রমেকং ন বর্ততে।

কুর্বীত সচিবাংস্তস্মাত্তেষাং চ শৃণুয়াস্মতম্।।১/৭

[একটি চক্রে যেমন শকট চলে না, রাজারাও তেমনি অমাত্যাদির সহায় ভিন্ন একাকী রাজকার্য পরিচালনে সমর্থ হন না! অতএব সহায়ভূত সচিবদের রাজা নিযুক্ত করবেন এবং তাঁদের মন্ত্রণা শুনবেন।]

রাজায়ত্তা, সচিবায়ত্তা এবং উভয়ায়ত্তা সিদ্ধির মধ্যে ভেদ দেখাতে গিয়ে শ্রীযুক্ত তেলাঙ্ (Telang) মন্তব্য করেছেন : “The distiction is, in essence, the same as that between a despotic monarch, a constitutional monarch, and a monarch who reigns but does not govern.”

৪. স্হায়সম্পদ্, এবং কেশবত্তা হচ্ছে রাক্ষসের প্রভুশক্তির পরিচায়ক, প্রজ্ঞা এবং পুরুষকার যথাক্রমে তাঁর মন্ত্রশক্তি এবং উৎসাহশক্তির পরিচায়ক। বিজিগীষুকে এই তিন শক্তির অধিকারী হতে হয়! এদিক থেকে রাক্ষস যে চাণক্যের যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী, সেটা সূচিত হয়েছে।

অন্তঃকোপ এবং বাহ্যকোপ সম্বন্ধে অর্থশাস্ত্রকার বলেছেন, “রাজার প্রতি (রাজ্যের) দুই প্রকার কোপ সম্ভাবিত হয়, যথা—(অমাত্যাদিজনিত) অভ্যন্তর কোপ ও (অরিজনিত) বাহ্যকোপ। বাহ্যকোপ অপেক্ষা অভ্যন্তর কোপ অধিকতর ভয়াবহ, কারণ অভ্যন্তর কোপ গৃহের মধ্যস্থিত সর্পের মতো সর্বদা ভয় উৎপাদন করে”! (অর্থশাস্ত্র ৮/১)– মহাকবি ভারবির রচনাতেও অন্তঃকোপের ভয়াবহতা উল্লিখিত হয়েছে “অণুরপ্যুপহন্তি বিগ্রহঃ প্রভুমন্তঃপ্রকৃতিপ্রকোপজঃ”। (কিরাত ২/৫১)

৫. রাক্ষসের তথাকথিত ভেদনীতি যে বুমেরাং (boomerang) হয়ে রাক্ষসকেই প্রত্যাঘাত করবে, সেই কঠিন ইঙ্গিতই চাণক্য এখানে করলেন! ৫ম অঙ্কে দেখা যাবে মলয়কেতু এবং অন্যান্য সহযোগীর কাছ থেকে রাক্ষস কীভাবে বিচ্ছিন্ন হচ্ছেন, চাণক্যের কথা তখন অক্ষরে অক্ষরে ফলে যাবে।

৬. চন্দ্রগুপ্তের মনের ওপর তাঁর গুরুর কৃত্রিম কলহের প্রতিক্রিয়া লক্ষণীয় : বিশাখদত্তের সংস্কৃত এখানে কথ্যভাষার মতোই সুবোধ্য ও সাবলীল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *