প্রথম অঙ্ক – মুদ্ৰালাভ

প্রথম অঙ্ক – মুদ্ৰালাভ

–“কে এই ভাগ্যবতী তোমার মাথায় ঠাঁই নিয়েছে?”

–“শশিকলা”।

–“এই কি তার নাম?”

“ওটাই তো তার নাম। তোমার চেনা, অথচ তুমি একে ভুলে গেলে কেন?”

–“আমি ওই রমণীর কথা জিগ্যেস করছি, চাঁদের কথা নয়।

“চন্দ্রে যদি আস্থা না হয়, বিজয়া বলুক।” এইভাবে (বক্রোক্তি-নৈপুণ্যে) দেবীর কাছে গঙ্গার প্রসঙ্গ এড়িয়ে যেতে ইচ্ছুক ভগবান শিবের চাতুরী তোমাদের রক্ষা করুন ॥১॥

পুনশ্চ—যথেচ্ছ পা ফেললে পৃথিবী তলিয়ে যেতে পারে—এই ভয়ে যিনি আস্তে পা ফেলেন, সকল ভুবনকে ছাপিয়ে যায় যে বাহুগুলো, তাদের সঙ্কুচিত করেই যিনি নিরন্তর অভিনয় করেন, পাছে দগ্ধ হয়ে যায়—এই আশঙ্কায় লক্ষ্য বস্তুসমূহে যিনি তাঁর প্রখর অগ্নিকণা-বর্ষী (তৃতীয় নেত্রের) দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখেন না, রঙ্গভূমির সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার (অস্বাচ্ছন্দ্য হেতু) ত্রিপুরবিজয়ী[১] শিবের সেই কষ্টসাধ্য নৃত্য তোমাদের রক্ষা করুক[২] ॥২॥

(নান্দ্যন্তে)

সূত্রধার—বেশি বলে কাজ নেই। দর্শকমণ্ডলী আমায় আজ্ঞা করেছেন যে, আজ তুমি

সামন্ত-রাজ বটেশ্বর দত্তের পৌত্র, ‘মহারাজ’—উপাধিধারী পৃথুর পুত্র বিশাখদত্তের লেখা ‘মুদ্রারাক্ষস’ নামে নতুন নাটক মঞ্চস্থ করবে। সত্যি বলতে কি, কাব্যকলা বিদগ্ধজনের এই সমাবেশে নাট্যপ্রয়োগ করতে এসে আমিও হৃদয়ে বেশ একটা গভীর তৃপ্তি বোধ করছি। কারণ, চাষি মূর্খ হলেও ভালো জমিতে বোনা বীজ ভালো ফসল দেয়। গুচ্ছ-ভরা শীষে শালিধানের যে সমৃদ্ধি, সেটা বপনকারী চাষির গুণে নয় ॥৩॥

এখন তবে বাড়ি যাই। গিন্নিকে ডেকে বাড়ির লোকজনের নিয়ে একটু গানের আয়োজন করি। (পরিক্রমা করে তাকিয়ে) এই যে আমার বাড়ি। ভিতরে যাই তাহলে। (প্রবেশের অভিনয় করে, ইতস্তত দেখে) এ কী! আমার বাড়িতে এ-যে মহোৎসবের মতো দেখাচ্ছে। পরিজনেরা নিজ নিজ কাজে ভীষণ রকমের ব্যস্ত। এই তো—

এ মেয়েটি জল বয়ে আনছে, এদিকে এ সুগন্ধি মসলা বাটছে, এ মহিলা রঙ-বেরঙের নানান মালা গাঁথছে, এই স্ত্রীলোকটি হামানদিস্তায় মুষল ফেলবার সময় মাঝে মাঝেই ‘হুম্ হুম্’ ধরনের কী একটা মিষ্টি আওয়াজ করছে ॥৪॥ যা হোক, পরিবারকে বরং ডেকে শুধোই। (নেপথ্যের দিকে চেয়ে) ওগো গুণবতী, সকল সমস্যার সমাধান-দায়িনী, সংসারে থাকার কারণ যে ধর্ম, অর্থ, কাম—ওগো আমার সেই ত্রিবর্গসাধিকে, আমার গার্হস্থ্যাশ্রমের নীতিবিদ্যারূপিণী, ওগো আমার সর্বকর্মের পরামর্শদায়িকে, এদিকে সত্বর এসো দেখি[৩] ॥৫॥

(নটীর প্রবেশ) )

নটী—আর্য, এই যে আমি। কী করব তার নির্দেশ দিয়ে আমায় কৃতার্থ করুন। সূত্রধার—আর্যে, কাজের কথা এখন থাক। বল দেখি আজ কি তুমি পূজ্য ব্রাহ্মণদের নিমন্ত্রণ করে আমাদের পরিবারকে ধন্য করেছ, না কি বিশিষ্ট

অতিথিরা এসে পড়েছেন আমাদের বাড়িতে—যে জন্যে রান্নার এই বিশেষ আয়োজন?

নটী—আর্য, পূজনীয় ব্রাহ্মণদের আমি নিমন্ত্রণ করেছি।

সূত্রধার—কী উপলক্ষে বল তো।

নটী—আজ যে চন্দ্ৰগ্ৰহণ।

সূত্রধার—আর্যে, কে এরূপ বললে?

নটী—এই রকমই তো নগরবাসীরা বলাবলি করছে।

সূত্রধার—আর্যে, চৌষট্টিটা যার অঙ্গ, সেই জ্যোতিঃশাস্ত্র শিখতে এককালে আমি বেশ শ্রম করেছিলাম। তা পূজ্যপাদ ব্রাহ্মণদের রান্না চলছে চলুক, কিন্তু গ্রহণের ব্যাপারটায় তোমাকে কেউ ঠকিয়েছে। কেন না দেখ–

চন্দ্রের মণ্ডল সবে পরিপূর্ণ হতে যাচ্ছে, কিন্তু ক্রূর গ্রহ সেই কেতুধ এখন তাকে বলপূর্বক গ্রাস করতে চাইছে—

(নেপথ্যে)

আহ্, কোন-সে জন আমি (বেঁচে) থাকতে চন্দ্রকে গ্রাস করতে চায়?

সূত্রধার—কিন্তু বুধের সঙ্গে যোগ একে রক্ষা করবে ॥৬॥

নটী—আর্য, এ আবার কে মর্ত্যের লোক হয়ে চন্দ্রকে (সেই দুষ্ট) গ্রহের কবল থেকে রক্ষা করতে চায়?

সূত্রধার—সত্যি বলতে কি, আমি ঠিক লক্ষ করিনি। ঠিক আছে, আবার বলুক,

এবারে আমি সতর্ক থেকে গলার স্বরটা চিনে নেব। (চন্দ্রের মণ্ডল সবে পরিপূর্ণ হতে যাচ্ছে, কিন্তু ক্রূরগ্রহ…ইত্যাদি পুনরায় আগের মতো উচ্চারণ করল। )

(নেপথ্যে )

আহ্, কোন-সে নর আমি (বেঁচে) থাকতে চন্দ্রগুপ্তকে পরাভূত করতে চায়?

সূত্রধার—(শুনে) হ্যাঁ চিনেছি। কৌটিল্য।

নটী― (ভয়ের অভিনয় করল)।

সূত্রধার—এই সেই কুটিলমতি কৌটিল্য যিনি তাঁর রোষাগ্নিতে নন্দবংশকে অচিরে দগ্ধ করেছেন। ‘চন্দ্রের গ্রহণ’ (চন্দ্রস্য গ্রহণম্)—এই কথা শুনে নামের মিল থাকায় মনে করেছেন মৌর্য-কুল-চন্দ্র চন্দ্রগুপ্তকে শত্রু আক্রমণ করতে আসছে ॥৭॥

এসো তবে, এখান থেকে আমরা চলে যাই। (নিষ্ক্রান্ত)

॥ প্রস্তাবনা সমাপ্ত ॥

(মুক্ত শিখার কেশগুচ্ছে অঙ্গুলি সঞ্চালন করতে করতে কুপিত চাণক্যের প্রবেশ)

চাণক্য—বল আমি থাকতে কে চন্দ্রগুপ্তকে পরাভূত করতে চায়? দেখ—

সিংহ সদ্য এক দাঁতাল হাতি শিকার করেছে। শিকারের রক্তের স্বাদ নেবার সঙ্গে সঙ্গে তার দাঁতগুলো হয়েছে রক্ত-রাঙা! তারপর হাই তুলতে গিয়ে যেইমাত্র সে হাঁ করেছে, অমনি তার মুখবিবরে সন্ধ্যারূণ চন্দ্রকলার মতো শোভাযুক্ত সেই ঝকঝকে দাঁত দেখা যাচ্ছে। জুম্ভণরত সিংহের মুখবিবর থেকে কে ওই দাঁত জোর করে উপড়ে নিতে চায়? ॥৮॥

আর—নন্দবংশের পক্ষে কালনাগিনী স্বরূপ, কোপানলের গাড়নীল ধূমশিখার সদৃশ আমার এই শিখাকে কোন মৃত্যুকামী ব্যক্তি আজও বাঁধতে দিতে চায় না?[৫] ॥৯॥

আরও বলি—নন্দকুলরূপ বনের পক্ষে দাবানল হয়ে জ্বলে উঠেছে আমার যে ক্রোধ, তার প্রচণ্ড তাপকে উপেক্ষা করে সেই অগ্নিশিখাকে লঙ্ঘন করতে গিয়ে পতঙ্গের মতো কে অচিরে মরতে চায়? সে কি তার নিজের এবং প্রতিপক্ষের শক্তির পার্থক্য বুঝতে পারে না? ॥১০॥

শার্ঙ্গরব, শার্ঙ্গরব।

(শিষ্যের প্রবেশ)

শিষ্য—আজ্ঞা করুন, গুরুদেব।

চাণক্য—বৎস, আমি বসতে চাইছি—

শিষ্য—গুরুদেব, ফটকের পাশের উঠোনের বৈঠকখানায় বেতের আসন দিয়ে রেখেছি। গুরুদেব, তাহলে, সেখানেই বসতে পারেন।

চাণক্য—বৎস, কাজে অতি-মনোযোগই আমাকে ব্যাকুল করেছে। শিষ্যের প্রতি উপাধ্যায়ের প্রকৃতি-সুলভ রুক্ষতা কিন্তু এটা নয়। (উপবেশনের অভিনয় করে স্বগত) কথাটা কীভাবে পুরবাসীদের মধ্যে প্রকাশ হয়ে পড়েছে যে নন্দবংশের বিনাশে রুষ্ট রাক্ষস পিতার হত্যায় কোপাবিষ্ট পর্বতকপুত্র মলয়কেতুকে সমগ্র নন্দরাজ্য দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে অত্যন্ত উৎসাহিত করে তার সঙ্গে সন্ধি করেছে এবং তারই সংগৃহীত ম্লেচ্ছরাজদের সম্মিলিত বিশাল বাহিনী-পরিবৃত হয়ে বৃষলকে[৬] আক্রমণ করতে উদ্যত হয়েছে? (চিন্তা করে) হলই-বা যে আমি সকল লোকের সামনে নন্দবংশ নিধনের প্রতিজ্ঞার কথা প্রকাশ্যে ঘোষণা করে সেই দুস্তর প্রতিজ্ঞানদী পার হয়েছি, সেই আমিই ইদানীং এই ব্যাপারটা রটে গেলেও একে সামলাতে পারব। কারণ—সে যে আমারই ক্রোধের আগুন যা শত্রুযুবতিরূপ দিগ্‌বালাদের মুখচন্দ্রকে সতত শোকের ধূমে মলিন করেছে, যা আমার নীতি-বায়ু-তাড়িত মোহভস্ম মন্ত্রীরূপ তরুশীর্ষে অবলীলায় চড়িয়ে দিয়েছে, যা নন্দপরিবার রূপ বাঁশবন থেকে ভয়ত্রস্ত পৌরজনরূপ পাখিগুলো পালিয়ে গেলে কোরকসমূহ সমেত ওই বনকে দগ্ধ করেছে, দাবানলের মতো আমার সেই ক্রোধাগ্নি যে এখন প্রশমিত হচ্ছে সেটা অবসাদের দরুন নয়, কিন্তু দাহ্য বস্তু আর অবশিষ্ট না থাকার দরুন ॥১১॥

আরও দেখ—যারা আগে রাজার ভয়ে নিচুমুখে অস্ফুট ধিক্কারে অসহায় আমাকে সম্মানের আসন থেকে টেনে নামাতে দেখে শোক করছিল, সেই সব লোক সম্প্রতি দেখেছে সিংহ যেমন পর্বতশীর্ষ থেকে যূথপতি হস্তীকে নিচে ছুড়ে ফেলে দেয়, তেমনি আমি নন্দকে সপরিবারে সিংহাসন থেকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছি (উৎখাত করেছি) ॥১২॥

প্রতিজ্ঞা পূরণের দায় আমার শেষ, তবুও বৃষলের মুখ চেয়ে এখন (প্রধানমন্ত্রীর প্রতীক স্বরূপ) এই শস্ত্র আমি ধারণ করেছি, এ তো সেই আমি—যে পৃথিবীর বুক থেকে নয়টি শেলের মতো নয়জন নন্দকে উন্মলিত করেছে, সরোবরে পদ্মিনীর মতো মৌর্য রাজত্বে লক্ষ্মীর প্রতিষ্ঠা করেছে, নিবিষ্টচিত্তে ভেবে-চিন্তে ক্রোধ ও প্রীতির সমুচিত ফল শত্রু ও মিত্রে সমানভাবে ভাগ করে দিয়েছে ॥১৩।।

অথবা, রাক্ষসকে বশ না করলে নন্দবংশের উচ্ছেদই-বা কী হল, আর চন্দ্রগুপ্তের রাজলক্ষ্মীর স্থিরতাই-বা কতটুকু প্রতিষ্ঠিত হল? (চিন্তা করে) সত্যি, নন্দবংশের প্রতি রাক্ষসের কী অশেষ আনুগত্য! নন্দ-পরিবারের যে কোনো বংশধর জীবিত থাকতে তাকে নিশ্চিত বৃষলের মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করানো যাবে না। (তাকে বশে আনার কৌশল হিশেবে) আমরা যা করতে পারি সেটা হল ওই বংশের প্রতি তার আনুগত্যকে নিষ্ক্রিয় করে রাখা। এই ধারণাতেই তপোবনে চলে যাওয়া সত্ত্বেও নন্দবংশের লোক (বলে) বেচারী সর্বার্থসিদ্ধিকে আমি হত্যা করালাম। কিন্তু সে যে এখন মলয়কেতুকে দলে টেনে আমাদের উচ্ছেদের জন্য অনেক বেশি তৎপরতা দেখাচ্ছে। (রাক্ষসকে যেন চাক্ষুষ দেখতে পাচ্ছে, এমনিভাবে আকাশে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে) উত্তম, অমাত্য রাক্ষস, উত্তম। হে বেদবিদ্ ব্রাহ্মণ, উত্তম!! উত্তম, বৃহস্পতিতুল্য হে মন্ত্রীবর, উত্তম!!! কেননা,

এ সংসারে মানুষ স্বার্থের তাগিদে, প্রভাব-প্রতিপত্তি যার অটুট আছে—এমন প্রভুরই সেবা করে। বিপদের দিনে যারা তার অনুগামী হয়, তারা তার পুনঃপ্রতিষ্ঠার আশাতেই অনুরূপ করে। কিন্তু প্রভুর মৃত্যুতেও যারা (তার) অতীতের অনুগ্রহাদির কথা মনে রেখে নিষ্কাম ভক্তিতে (প্রভু-নির্দিষ্ট) কার্যভার বহন করে, তোমার মতো তেমন কৃতী সেবক দুর্লভ ॥১৪॥ তা-ই তো তোমাকে আয়ত্ত করবার জন্য আমার এত প্রয়াস। (একটাই আমার ভাবনা) কীভাবে এগোলে আমাদের অনুকূলে এসে তুমি বৃষলের মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করবে।

কেন জান?

প্রভুভক্তি থাকলেও বুদ্ধিহীন কাপুরুষ ভৃত্য দিয়ে কী লাভ? জ্ঞান-বিক্রম থাকলেও যার ভক্তি নেই সেই ভৃত্য থাকারই-বা কী ফল? জ্ঞান বিক্রম ও ভক্তি—এক সঙ্গে এই তিন গুণ যাদের আছে, তেমন ভৃত্যেরাই রাজার সমৃদ্ধির কারণ হয়; অন্যেরা সম্পদেই হোক্, বিপদেই হোক্, ভার্যাব‍ (কেবল ভরণপোষণের পাত্র) ॥১৫।।

অতএব আমিও এ ব্যাপারে ঘুমিয়ে নেই। তাকে বাগানোর জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করছি। কেমন করে? প্রথমেই আমি জনসাধারণের মধ্যে একটা বাজে গুজব রটিয়ে দিয়েছি যে, “রাক্ষস বিষকন্যা[৭] পাঠিয়ে আমাদের পরম উপকারী বন্ধু হতভাগ্য পর্বতককে বধ করিয়েছে। এটাই তার পরিকল্পিত ছিল যে চন্দ্রগুপ্তই হোক আর বৃষলই হোক্—এই দুজনের মধ্যে যে-কোনো একজনকে শেষ করতে পারলেই চাণক্যের ক্ষতি হবে।” লোকে যাতে বিশ্বাস করে এবং ব্যাপারটা (জনসাধারণের কাছে) যাতে আরো পরিষ্কার হয়, সেজন্য পর্বতকের পুত্র মলয়কেতু ভাগুরায়নের মাধ্যমে গোপনে শুনিয়েছি—‘তোমার পিতাকে মেরেছে চাণক্য’। এই শুনে ভয় পেয়ে সে পালিয়েছে। রাক্ষসের পরামর্শ নিয়ে যদি আমাদের বিরুদ্ধে উঠে-পড়ে লাগে, আমি ঠিক একে বুদ্ধিবলে জব্দ করব। মলয়কেতুকে নিগৃহীত করে পর্বতককে বধ করেছে বলে রাক্ষসের যে অপযশ দিন-কে-দিন রাষ্ট্র হয়ে যাচ্ছে সেটা আমি চাপা দিতে চাই না। আবার, স্বপক্ষে ও বিপক্ষে কারা অনুরক্ত, কারা বিরক্ত তা জানবার জন্য নানা ছদ্মবেশে চর নিয়োগ করা হয়েছে। তারা বহুদেশের বেশ-ভূষা, ভাষা, আচার-ব্যবহার ও লোকেদের গতিবিধি বুঝতে ওস্তাদ। নন্দদের মন্ত্রী ও মিত্রদের মধ্যে অনেকে যারা কুসুমপুরে আছে, তাদেরও চলাফেরার ওপর কড়া নজর রাখা হচ্ছে। ভদ্রভট প্রভৃতি প্রধান পুরুষগণ যারা নন্দের বিরুদ্ধে চন্দ্রগুপ্তের অভ্যুত্থানের সপক্ষে ছিল, কারণ-পরম্পরা ঘটিয়ে তাদের এমন মান-মর্যাদা দেওয়া হয়েছে যাতে তারা স্ব-স্ব ক্ষেত্রে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত মনে করতে পারে। শত্রুর নিযুক্ত গূঢ় পুরুষদের মধ্যে অতি-সাহসী কেউ চায় অতর্কিতে আঘাত হানতে, আবার কেউ-বা খোঁজে বিষপ্রয়োগের সুযোগ—এ কথা মনে রেখে তার প্রতিবিধানের জন্য সদা হুঁশিয়ার, আনুগত্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ, বিশ্বস্ত পুরুষদের আমি রাজার সন্নিকটে যেখানে-যেখানে প্রয়োজন নিযুক্ত করেছি। আবার এদিকে রয়েছে আমার সহপাঠী বন্ধু—ব্রাহ্মণ ইন্দুশর্মা। তিনি শুক্রাচার্যের দণ্ডনীতি এবং চৌষট্টি অঙ্গের জ্যোতিঃশাস্ত্রে বিশেষ পাণ্ডিত্য অর্জন করেছেন। নন্দবংশ ধ্বংসের শপথ নেবার পরেই আমি তাঁকে মুণ্ডিত মস্তক ভিক্ষুর[৮] বেশে কুসুমপুরে এনে রেখেছি, নন্দের সব মন্ত্রীর সঙ্গে তাঁকে মিত্রতা-সূত্রে আবদ্ধ করিয়েছি; বিশেষ করে রাক্ষসের তো তাঁর ওপর খুবই আস্থা। তাঁকে দিয়ে এবারে আমাকে একটা বড় কাজ করিয়ে নিতে হবে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, আমাদের দিক থেকে কোনো চেষ্টাই বাদ যাচ্ছে না। রাষ্ট্রকাঠামোর প্রধান পুরুষ বৃষলই শুধু আমার ওপর রাজ্য চালানোর ভার অর্পণ করে সর্বদা নির্লিপ্ত হয়ে আছে। অথবা রাজ্যশাসনে স্বয়ং উদ্যোগী হয়ে অসাধারণ দুঃখ যেখানে ভোগ করতে হয় না, সেই রাজ্যই সুখের। কেন না—

আহার্যাদি স্বয়ং সংগ্রহ করে ভোগের বেলায় যেমন গজপতি, তেমনি নরপতি স্বভাবত বলশালী হলে প্রায়ই দুঃখে অবসন্ন হয়ে পড়ে ॥১৬।।

(অতঃপর যমপট নিয়ে চরের প্রবেশ)

চর—যমের পায়ে প্রণাম কর, কী কাজ অন্য দেবতায়? আর আর দেবতার যারা ভক্ত, তাদের কষ্টের প্রাণ ইনিই তো কেড়ে নিচ্ছেন ॥১৭।।

উপরন্তু, নিষ্ঠাসহ লেগে থাকলে বিপজ্জনক ব্যবসায় থেকে যেমন, ভক্তিতে তুষ্ট করতে পারলে এই মারাত্মক দেবতা থেকেও তেমন মানুষের জীবিকা নির্বাহ চলে। যিনি সব লোককে মারেন, সেই যমের দয়াতে আমি করে খাচ্ছি ॥১৮॥

এবার তবে এই বাড়িটায় ঢুকে যমের পট দেখিয়ে দেখিয়ে গান করি। (পরিক্রমা করল)।

শিষ্য—(দেখে ফেলে) ভদ্র, ভিতরে প্রবেশ নিষেধ।

চর—ওহে ব্রাহ্মণ, এ বাড়ি কার?

শিষ্য—আমাদের গুরুদেব পুণ্যশ্লোক আর্য চাণক্যের।

চর—ওহে ব্রাহ্মণ, এ তবে আমার কুটুম-বাড়ি, উনি যে আমার ধর্ম-ভাই সুতরাং আমায় ঢুকতে দাও, ঢুকে আমি তোমার গুরুর কাছে গিয়ে যমপট খুলে কিছু ধর্মকথা বলি।

শিষ্য—(সক্রোধে) ধিক্ মূর্খ! তুমি কি আমার গুরুদেবের চেয়েও বেশি ধর্ম জান? চর—ওহে ব্রাহ্মণ, রেগে যেও না। সবাই তো সবকিছু জানে না। তাই কোনো কোনো বিষয় জানেন তোমার গুরুদেব, আর কোনো কোনোটা জানে আমাদের মতো লোকেরা।

শিষ্য—মূর্খ, গুরুদেবের সর্বজ্ঞতার অপলাপ করতে চাও?

চর—ওহে ব্রাহ্মণ, তোমার গুরুদেব যদি সব জানেন, তবে বলুন দেখি, চন্দ্ৰ কার অবাঞ্ছিত?

শিষ্য—মূর্খ, এটা জানলেই কী, না জানলেই-বা কী?

চর—তোমার গুরুদেবই বুঝবেন যে, এটা জেনে কী লাভ। তুমি কেবল এইটুকুই জান যে পদ্মফুল চাঁদকে পছন্দ করে না। কেননা দেখ—
পদ্মফুল সুন্দর ঠিকই, কিন্তু তার রূপের সঙ্গে স্বভাবের মিল নেই। কারণ, পরিপূর্ণ মণ্ডলের শ্রীমণ্ডিত হলেও চন্দ্রের প্রতি পদ্ম বিরূপ ॥১৯॥

চাণক্য—(শুনতে পেয়ে স্বগত) ওহো! এ ইঙ্গিত করছে, ‘কোন কোন ব্যক্তি চন্দ্রগুপ্তের প্রতি বিরক্ত তা আমি জানি।’

শিষ্য—মূর্খ, অসংলগ্ন এ-সব কী বকছ?

চর—ওহে ব্রাহ্মণ, এ তো সু-সংলগ্নই হত-

শিষ্য—কী হলে (হত)?

চর—শুনতে জানে এমন লোক পেলে।

চাণক্য—ভদ্র, নিঃসঙ্কোচে প্রবেশ কর। এমন লোক পাবে যে শুনতে জানে, বুঝতেও পারে।

চর—এই প্রবেশ করছি। (প্রবেশ করে, এগিয়ে গিয়ে) আর্যের জয় হোক।

চাণক্য—(দেখে স্বগত) প্রজাদের মনের ভাব ভালো করে জানবার জন্য যাকে পাঠিয়েছিলাম, এ যেন দেখছি সেই নিপুণক। (প্রকাশ্যে) ভদ্র, স্বাগতম্। উপবেশন কর।

চর—আর্যের যা আজ্ঞা (ভূমিতে উপবেশন করল)।

চাণক্য—ভদ্র, এবার তবে নিজের কাজের কথা বল। প্রজারা বৃষলকে ভালোবাসে তো?

চর—তা তো বাসেই। আর্য তাদের বিরাগের হেতুগুলো একে একে দূরীভূত করায় প্রজারা সার্থকনামা দেব চন্দ্রগুপ্তের প্রতি অত্যন্ত অনুরক্ত। তবুও তিনজন লোক এ নগরে আছে যারা গোড়া থেকেই অমাত্য রাক্ষসের সঙ্গে শ্রদ্ধা ও সম্প্রীতির সম্পর্ক অটুট রেখেছে; এরা কিন্তু দেব চন্দ্রশ্রীর সৌভাগ্য সইতে পারছে না।

চাণক্য—(সক্রোধে) তার চাইতে বরং বল—নিজেদের জীবনটাকেই এরা সইতে পারছে না। ভদ্র, এদের নামগুলো জানা আছে তো?

চর—নাম না জেনে এসব খবর কি আর্যের কাছে নিবেদন করতে পারি!

চাণক্য—সেগুলো তবে শুনতে চাই।

চর—আর্য শুনুন। প্রথম জন হল এক ভিক্ষু, আর্যের শত্রুদের প্রতি যার বরাবরের পক্ষপাতিত্ব—

চাণক্য—(স্বগত) আমাদের শত্রুপক্ষে চিরপক্ষপাতী ভিক্ষু!

চর—নাম তার জীবসিদ্ধি। এ হচ্ছে সেই লোক যে অমাত্য রাক্ষস-নিযুক্ত বিষকন্যাকে নৃপতি পর্বতেশ্বরের উপর প্রয়োগ করেছিল।

চাণক্য–(স্বগত) জীবসিদ্ধি! এ তো আমারই গুপ্তচর। (প্রকাশ্যে) ভদ্র, এরপর দ্বিতীয়টি কে?

চর—আর্য, দ্বিতীয় জন হচ্ছে অমাত্য রাক্ষসের প্রিয় বয়স্য এক কায়স্থ, নাম শকটদাস।

চাণক্য—(হেসে, স্বগত) কায়স্থ তো সামান্য ব্যাপার। তবুও শত্রু সামান্য হলেও তাকে তুচ্ছ জ্ঞান করা ঠিক নয়। বন্ধুর ছদ্মবেশে তার পেছনে আমি সিদ্ধার্থককে লাগিয়েছি। (প্রকাশ্যে) ভদ্র, তৃতীয় নামটিও শুনতে চাই।

চর—তৃতীয় ব্যক্তিও অমাত্য রাক্ষসের যেন দ্বিতীয় হৃদয়। সে হচ্ছে পুষ্পপুরনিবাসী মণিকার শ্রেষ্ঠ চন্দনদাস যার গৃহে পরিবারকে রেখে অমাত্য রাক্ষস নগর ত্যাগ করেছেন।

চাণক্য—(স্বগত) নিশ্চিত তাঁর পরম সুহৃদ্। নিজের মনের মতো লোক না হলে রাক্ষস তার তত্ত্বাবধানে নিজের পরিবারকে রাখতেনই না। ভদ্র, কেমন করে জানলে, চন্দনদাসের গৃহে রাক্ষস তাঁর স্ত্রী-পুত্রকে রেখে গেছেন?

চর—আর্য, ছাপ দেবার এই আংটি দেখলেই আপনি সব বুঝতে পারবেন।

(আংটি দিল।)

চাণক্য—(আংটি দেখে তুলে নিয়ে রাক্ষসের নাম পড়লেন। খুশি হয়ে স্বগত) বরং বলা যাক, রাক্ষসই এখন আমার আঙুলের প্রেমে পড়েছে। (প্রকাশ্যে) ভদ্র, এই মোহরাঙ্কিত আংটি তোমার হাতে কী করে এল, সে বৃত্তান্ত সবিস্তর শুনতে চাই।

চর—আর্য শুনুন। আর্য তো আমাকে নগরবাসীদের গতিবিধি সম্বন্ধে খোঁজ-খবর নিতে পাঠিয়েছেন। পরগৃহে প্রবেশের পক্ষে এই যমপটটি ভালো সঙ্গী—এতে কেউ কোনো সন্দেহ করে না। এটি নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে মণিকার-শ্রেষ্ঠী চন্দনদাসের বাড়িতে ঢুকলাম।

চাণক্য—তারপর কী হল?

চর—তারপর ভেতর-বাড়ির একটা খোপ থেকে একটি ছোট ছেলে বালকসুলভ কৌতূহলে খুশি-খুশি চোখে বেরিয়ে আসবার উপক্রম করল। বয়স তার বছর পাঁচেক হবে বুঝি; চেহারাটি বেশ মিষ্টি, তাকিয়ে দেখার মতো। তখন (বেরিয়ে আসতে না-আসতে) ‘হায় রে, বেরিয়ে গেল; হায় হায়, বাইরে গেল’ এমনি ভয়-সূচক শব্দের সমাহারে সেই খোপের ভেতর থেকেই নারীকণ্ঠে জোর চেঁচামেচি শুরু হল। তারপর দরজার দিকে মুখখানি একটু বাড়িয়ে দিয়ে একটি স্ত্রীলোক বালকটিকে ঠিক বেরিয়ে আসার মুখে গালমন্দ করে কোমল বাহুলতা দিয়ে ধরে ফেলল। বালকটিকে আটকে রাখার ব্যস্ততায় তার চঞ্চল হাতের আঙুল থেকে পুরুষের আঙুলের মাপে তৈরি এই মাপের আংটিটি গলে পড়ল চৌকাঠে এবং তার অজ্ঞাতসারেই সেখান থেকে লাফিয়ে উঠে গড়াতে গড়াতে আমার পায়ের পাশে এসে নিশ্চল হয়ে রইল, যেন কোনো কূলবধূ পদপ্রান্তে প্রণাম করতে এসে নিশ্চল হয়ে রইল। আমিও ওতে অমাত্য রাক্ষসের নাম অঙ্কিত রয়েছে দেখে নিয়ে এসে আর্যের পাদমূলে রাখলাম। এই হল গিয়ে এই মুদ্রাঙ্কন আংটি পাবার বৃত্তান্ত!

চাণক্য—ভদ্র, শুনলাম। এখন যাও। অচিরে তুমি এই পরিশ্রমের যোগ্য পুরস্কার পাবে।

চর—আর্যের যে আদেশ।

(নিষ্ক্রান্ত )

চাণক্য—শার্ঙ্গরব, শার্ঙ্গরব।

(শিষ্যের প্রবেশ)

শিষ্য—আদেশ করুন গুরুদেব!

চাণক্য—দোয়াত ও একটি পাতা নিয়ে এস। (শিষ্য তাই করল)

(পাতাটি হাতে নিয়ে স্বগত) এতে কী লিখি? এই লেখার জোরেই রাক্ষসকে জয় করতে হবে।

(প্রতিহারীর প্রবেশ)

প্রতিহারী—আর্যের জয় হোক!

চাণক্য—(সহর্ষে স্বগত) ‘জয়’ কথাটিই ধরলাম। (প্রকাশ্যে) শোণোত্তরা, কী প্রয়োজনে এসেছ?

প্রতিহারী—আর্য, দেব চন্দশ্রী পদ্মকোরকের ন্যায় অঞ্জলিবদ্ধ হাত দুটি মাথায় রেখে আর্যকে নিবেদন করছেন—“আর্য যদি অনুমতি দেন তবে আমি শ্রদ্ধেয় পর্বতেশ্বরের শ্রাদ্ধানুষ্ঠান করতে চাই। আর যে অলঙ্কারগুলো তিনি পূর্বে পরিধান করেছিলেন, ব্রাহ্মণদের সেগুলো দান করতে চাই।”

চাণক্য—(সহর্ষে স্বগত) উত্তম, বৃষল! আমার অন্তরের সঙ্গে পরামর্শ করেই যেন তুমি এই বার্তা পাঠিয়েছ। (প্রকাশ্যে) শোণোত্তরা, বৃষলকে তুমি আমার নাম বলো—উত্তম উৎস; তুমি যথার্থই লোকব্যবহারে অভিজ্ঞ সুতরাং তুমি যেটা করতে চাইছ কর। কিন্তু পর্বতেশ্বরের ব্যবহৃত ভালো ভালো মূল্যবান অলঙ্কারগুলো অবশ্যই যোগ্য ব্রাহ্মণদের দেয়া উচিত। অতএব আমি নিজেই যোগ্যতা পরীক্ষা করে ব্রাহ্মণদের পাঠাব।

প্রতিহারী—আর্যের যা আদেশ। (নিষ্ক্রান্ত)

চাণক্য—শার্ঙ্গরব, বিশ্বাবসুদের তিন ভাইকে গিয়ে আমার নাম করে বলো- “বৃষলের নিকট থেকে দানের অলঙ্কারগুলো গ্রহণ কর এবং তারপরেই আমার সঙ্গে দেখা কর।”

শিষ্য—আচ্ছা।

(নিষ্ক্রান্ত )

চাণক্য—এই বিষয়টি হবে চিঠির শেষ দিক। প্রথম দিকটা কেমন হবে? (ভেবে নিয়ে) হ্যাঁ, বুঝেছি। চর-মাধ্যমে অবগত হয়েছি যে সেই ম্লেচ্ছ-রাজগোষ্ঠীর মধ্য থেকে প্রধান প্রধান পাঁচজন নৃপতি পরম সুহৃরূপে রাক্ষসের অনুসরণ করে। তারা হচ্ছে—কুলুতরাজ চিত্রবর্মা; শৌর্যে সিংহস্বরূপ মলয়াধিপ সিংহনাদ, কাশ্মীরের পুস্করাক্ষ; সিন্ধুদেশের রাজা শত্রুগর্ব-খর্বকারী সিন্ধুষেণ এবং পঞ্চমজন হচ্ছে পারস্যসম্রাট্ মেঘ যার রয়েছে বিশাল অশ্ববাহিনী। নিঃসন্দেহে এখন এদের নামই আমি এখানে লিখছি, (সাধ্য থাকে তো) চিত্রগুপ্ত মুছে ফেলুক ॥২০॥

(চিন্তা করে) অথবা থাক্। লিখছি না। গোড়ার দিকটা ঝাপসাই থাক্। (লেখার অভিনয় করে) শার্ঙ্গরব।

শিষ্য—(প্রবেশ করে) আদেশ করুন গুরুদেব!

চাণক্য—বৎস, শ্রোত্রিয় ব্রাহ্মণের হাতের লেখা, খুব যত্ন করে লিখলেও, সর্বদা অস্পষ্ট হয়। তাই আমার নাম করে সিদ্ধার্থককে বলো—“শকটদাসকে দিয়ে একটি পত্র লেখাবে—যাতে এই কথাগুলোই থাকবে কিন্তু কোনো শিরোনাম থাকবে না, কারণ এই পত্রের যা লিখিত বক্তব্য তা (রপ্ত করে) একজন আরেকজনের কাছে গিয়ে স্বয়ং বলবে। লেখা হয়ে গেলে সোজা আমার কাছে হাজির হবে। তাকে যেন বলো না যে চাণক্য লিখিয়ে নিচ্ছেন।”

শিষ্য—আচ্ছা।

(নিষ্ক্রান্ত)

চাণক্য—(স্বগত) ব্যস্, মলয়কেতুকে বশ করে ফেললাম।

(পত্রহস্তে সিদ্ধার্থকের প্রবেশ)

সিদ্ধার্থক আর্যের জয় হোক! আর্য, শকটদাসের (হস্তাক্ষরে) লেখা এই সেই পত্র।

চাণক্য—(হাতে নিয়ে) সত্যি, তাকিয়ে দেখবার মতো হাতের লেখা! (পড়ে নিয়ে) ভদ্র, মুদ্রার এই আংটিটি দিয়ে এতে ছাপ দাও।

সিদ্ধার্থক—(তাই করে) আর্য, এই যে মুদ্রা-দেওয়া চিঠি। আর কী করতে হবে?

চাণক্য—ভদ্র, তোমাকে এমন একটি কাজে লাগাতে চাই যা কেবল বিশ্বস্ত লোকের পক্ষেই করা সম্ভব।

সিদ্ধার্থক—(সহর্ষে) আর্য, এ আমার প্রতি অনুগ্রহ। আর্য আদেশ করুন, এই অনুগত দাসকে আর্যের কোন কাজ করতে হবে।

চাণক্য—প্রথমে তুমি বধ্যস্থানে যাও এবং রাগতভাবে ডান চোখ কুঁচকিয়ে সেই সংকেতের তাৎপর্য ঘাতকদের হৃদয়ঙ্গম করাও। তারপর সেই সংকেতের মানে বুঝতে পেরে যখন তারা সন্ত্রস্তভাব দেখিয়ে এদিক-সেদিক খুব ছুটতে থাকবে, তখন তুমি শকটদাসকে মধ্যস্থান থেকে সরিয়ে নিয়ে রাক্ষসের কাছে পৌছিয়ে দেবে। সুহৃদের প্রাণরক্ষায় পরিতুষ্ট হয়ে সে যা পারিতোষিক[৯] দিতে চাইবে, তা তুমি তার কাছ থেকে নিয়ো কিন্তু। অতঃপর কিছুকাল রাক্ষসের সেবা করো। তারপর শত্রুরা যখন (কুসুমপুরের) খুব কাছে এসে পড়বে, তখন এই দরকারি কাজটি করতে হবে। (কানে কানে—এমনি করে এই এই

সিদ্ধার্থক—আর্যের যা আদেশ।

শিষ্য—শার্ঙ্গরব, শার্ঙ্গরব!

চাণক্য—আমার নির্দেশমতো কালপাশিক ও দণ্ডপাশিককে গিয়ে বল যে বৃষল এই আদেশ দিচ্ছেন, “জীবসিদ্ধি নামে যে সন্ন্যাসী রাক্ষসের প্রেরণায় বিষকন্যা লাগিয়ে পর্বতককে হত্যা করেছিল, পূর্বাহ্নেই তার অপরাধের কথা জনসমক্ষে ঘোষণা করো এবং তারপর তাকে নিগৃহীত করে নগর থেকে বহিষ্কার করো।”

শিষ্য—আচ্ছা।

(পরিক্রমা করল)

চাণক্য—বৎস, দাঁড়াও, দাঁড়াও আরেকজন—ওই যে শকটদাস নামে কায়স্থ রাক্ষসের উস্কানিতে আমাদের প্রাণনাশের দুরভিসন্ধি করছে, তারও এই দোষ প্রকাশ্যে ঘোষণা করে তাকে শূলে চড়াও এবং তার পরিজনদের কারাগারে ঢোকাও।

শিষ্য—তাই হবে। (নিষ্ক্রান্ত)।

চাণক্য—(চিন্তার অভিনয় করছেন। আত্মগত) আচ্ছা, দুরাত্মা রাক্ষসকে আয়ত্তে

পাওয়া যাবে তো?

সিদ্ধার্থক—আর্য, পেয়ে গেছি। [১০]

চাণক্য—(সহর্ষে—আত্মগত) ওহো, রাক্ষসকে পাওয়া গেছে! (প্রকাশ্যে) ভদ্র, কার কথা বলছ যে, পেয়ে গেছ?

সিদ্ধার্থক—আর্যের আদেশ আমি পেয়ে গেছি। এবার কার্যসিদ্ধির জন্য বেরিয়ে পড়ি।

চাণক্য—(মুদ্রাঙ্কন করা আংটি ও চিঠি দিয়ে) বেরিয়ে পড়। তোমার কার্যসিদ্ধি হোক।

সিদ্ধার্থক—আচ্ছা। (নিষ্ক্রান্ত)।

(শিষ্যের প্রবেশ)

শিষ্য—গুরুদেব, কালপাশিক ও দণ্ডপাশিক আপনাকে নিবেদন করছেন যে, এই এখনই মহারাজ চন্দ্রগুপ্তের আজ্ঞা কার্যকরী হচ্ছে।

চাণক্য—ভালো। বৎস, মণিকার প্রধান চন্দনদাসকে এখনই দেখতে চাই।

শিষ্য—আচ্ছা। (বেরিয়ে গিয়ে চন্দনদাসকে সঙ্গে করে প্রবেশ)। এদিকে, এদিকে, মহাজন।

চন্দনদাস—(স্বগত) নিষ্ঠুর চাণক্য হঠাৎ ডেকে পাঠালে নির্দোষ ব্যক্তিরও ভয় হয়; আমি যেহেতু দোষ করেছি, আমার আর কী কথা! তাই ধনসেন প্রভৃতি যারা আমার আবাসে থাকে, তাদেরকে আমি বলেছিলাম—চণ্ড চাণক্য কোনো একদিন আমার বাড়ি খানাতল্লাশি করবে। সুতরাং হুঁশিয়ার হও; অমাত্য রাক্ষসের পরিজনদিকে (নিরাপদ স্থানে) সরিয়ে দাও। আমার পরে যখন যা হবার হোক।

শিষ্য—এই—যে, মহাজন, এদিকে এদিকে।

চন্দনদাস—এই আসছি আমি। (দুজনের পরিক্রমা)

শিষ্য—(নিকটে গিয়ে) গুরুদেব, ইনি শ্রেষ্ঠী চন্দনদাস।

চন্দনদাস—আর্যের জয় হোক।

চাণক্য—(নিরীক্ষণের অভিনয় করে)—স্বাগত শ্ৰেষ্ঠী! এই যে আসন। বসো এখানে।

চন্দনদাস—(প্রণত হয়ে) আর্য কি জানেন না যে অনুচিত মর্যাদা অপমানের অপেক্ষাও অধিক মনোবেদনা জন্মায়? তাই এখানেই আমি আমার যোগ্য আসন মাটিতেই বসছি।

চাণক্য—ওহে শ্রেষ্ঠী, না না, এরূপ বলো না। আমাদের কাছ থেকে এ সম্মান প্রাপ্যই। অতএব আসনেই তুমি বসো।

চন্দনদাস—(স্বগত) দুষ্ট একটা কিছু মতলব এঁটেছে। (প্রকাশ্যে) ঠিক আছে, আর্যের যেমন আদেশ।

চাণক্য—ওহে শ্রেষ্ঠী চন্দনদাস, ব্যবসাপত্তর ও লগ্নিতে লাভ আর সুদের অঙ্ক বেশ বেড়ে যাচ্ছে তো?

চন্দনদাস—(স্বগত) বেশি সৌজন্যে খটকা লাগছে। (প্রকাশ্যে) আজ্ঞে হ্যাঁ। আর্যের অনুগ্রহে ব্যবসা আমার নির্বিঘ্নেই চলছে।

চাণক্য—চন্দ্রগুপ্তের দোষসমূহ প্রজাদিগকে পূর্ব পূর্ব রাজার গুণাবলি স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে না তো?

চন্দনদাস—(কান ঢেকে ধরে) অলক্ষুণে কথা শোনাবেন না। চন্দ্রশ্রীকে পেয়ে প্রজারা খুবই আনন্দিত, শরতের রাতে পূর্ণিমার চাঁদ উঠলে যেমন আনন্দ হয়, ঠিক তেমনি।

চাণক্য—ওহে শ্রেষ্ঠী, তাই-ই যদি হয় তবে প্রীত প্রজাদের কাছ থেকে প্রতিদানে রাজা তাঁর প্রীতিকর কিছু চাইতে পারেন।

চন্দনদাস–আর্য আদেশ করুন, আমার কাছ থেকে কী চান, কতটাই-বা চান।

চাণক্য—ওহে শ্রেষ্ঠী, এটা চন্দ্রগুপ্তের রাজত্ব, নন্দের রাজত্ব নয়। অর্থের প্রতি আসক্তি ছিল বটে নন্দের, তাই আর্থিক প্রাপ্তিযোগ ছিল সুখের, কিন্তু চন্দ্রগুপ্তের পক্ষে একমাত্র সুখের হল তোমাদের শুভেচ্ছা।

চন্দনদাস–(সহর্ষে) আর্য, অনুগৃহীত হলাম।

চাণক্য—ওহে শ্রেষ্ঠী, তোমার তো প্রশ্ন করা উচিত ছিল যে, সেই শুভেচ্ছার প্রকাশ কীভাবে সম্ভব।

চন্দনদাস—আর্য আদেশ করুন।

চাণক্য—সংক্ষেপে বলতে গেলে প্রজারা রাজার বিরুদ্ধাচরণ না করলেই সম্ভব। চন্দনদাস—আর্য, কে এমন হতভাগা যাকে আর্য রাজার বিরুদ্ধাচারী বলে মনে করেন?

চাণক্য—তুমি হচ্ছ তাদের মধ্যে প্রথম জন।

চন্দনদাস—(কানচাপা দিয়ে) ছিঃ ছিঃ, এ পাপ প্রসঙ্গ শোনা যায় না। তৃণ হয়ে অগ্নির সঙ্গে বিরোধ কী ধরনের?

চাণক্য—এটা এই ধরনের বিরোধ যে তুমি রাজার অহিতকারী অমাত্য রাক্ষসের পরিজনদিগকে তোমার নিজের বাড়িতে লুকিয়ে রেখেছ।

চন্দনদাস—আৰ্য, এটা বাজে কথা। প্রকৃত ঘটনা না জেনেই কেউ আর্যকে এমনধারা বলেছে।

চাণক্য—ওহে শ্রেষ্ঠী, ভয় পেয়ো না। পূর্বের রাজার কর্মচারীরা ভয় পেয়ে নগরবাসীদের অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাদের বাড়িতে পরিবারের লোকজনদের রেখে অন্য দেশে চলে যায়—এটা এমন কিছু নয়। কিন্তু তার পরে তাদের গোপন করে রাখাটা দোষের হয়।

চন্দনদাস—ব্যাপারটা কিন্তু এমনিই। সে সময়ে অমাত্য রাক্ষসের পরিবারের লোকেরা আমার বাড়িতে ছিল।

চাণক্য—আগে বললে ‘বাজে কথা’, এখন বলছ ‘ছিল’– উক্তি দুটি পরস্পরবিরোধী। চন্দনদাস—আমার কথায় ওই একটু যা দোষ রয়ে গেছে।

চাণক্য—বুঝলে শ্রেষ্ঠী, চন্দ্রগুপ্ত যেখানে রাজা, ছলনার কোনো অবকাশ সেখানে নেই। অতএব রাক্ষসের পরিজনবর্গকে সমর্পণ কর। ছলনার অভিযোগ থেকে নিষ্কৃতি হোক তোমার।

চন্দনদাস—আর্য, আমি যে বললাম–আমার বাড়িতে অমাত্য রাক্ষসের পরিজনেরা ছিল।

চাণক্য—তারপর এখন কোথায় গেল?

চন্দনদাস—জানি না।

চাণক্য—(ঈষৎ হেসে) কেনই-বা না জানবে? ওহে শ্রেষ্ঠী, মাথার উপরে ভয় আর বহুদূরে তার প্রতিকার।[১১] আরো বলি—নন্দকে যেমন বিষ্ণুগুপ্ত অর্ধোক্ত (লজ্জার অভিনয়) করেছিল, তেমনি চন্দ্রগুপ্তকে অমাত্য রাক্ষস উচ্ছিন্ন করবে, এমন কথা মনে মনেও ভেবো না। দেখ—নন্দ জীবদ্দশায় বারবার চঞ্চলা হয়ে উঠলে বক্রনাস প্রমুখের মতো পরাক্রান্ত রাজনীতিবিদ্ ভালো ভালো মন্ত্রীরাও যাকে স্থির করে রাখতে পারেনি, সেই রাজলক্ষ্মীকে বর্তমানে একাসনে অচলা করা হয়েছে। চন্দ্রগুপ্তের অঙ্গকান্তির সঙ্গে যেন এক হয়ে সেই রাজ্যশ্রী আজ জগতের আনন্দ বিধান করছে। জ্যোৎস্নাকে চন্দ্র থেকে পৃথক করার মতো কে চন্দ্রগুপ্তের রাজ্যশ্রীকে তার কাছে থেকে ছিনিয়ে নিতে চায়?[১২] অধিকন্তু—

সিংহ সদ্য এক দাঁতাল হাতি শিকার করেছে (ইত্যাদি পূর্বোক্ত শ্লোকের পাঠ)

চন্দনদাস—(স্বগত) বড়ো বড়ো কথাগুলো এঁর কাজের সঙ্গে মিলে গেছে।

(নেপথ্যে কলকল)

চাণক্য—শার্ঙ্গরব, দেখ তো কী হল।

শিষ্য—আচ্ছা। (বেরিয়ে গিয়ে পুনরায় পবেশ)। গুরুদেব, দেখলাম রাজা চন্দ্রগুপ্তের আদেশে রাজার অনিষ্টকারী সন্ন্যাসী জীবসিদ্ধিকে নিগৃহীত করে নগর থেকে বহিষ্কার করা হচ্ছে।

চাণক্য—সন্ন্যাসী! আহা-হা! অথবা রাজার অনিষ্ট করার ফল ভোগ কর। ওহে শ্রেষ্ঠী চন্দনদাস, অনিষ্টকারীর প্রতি এ রাজার দণ্ড এমনি কঠোর। সুতরাং বন্ধুর হিতবাক্য মতো কাজ করো। রাক্ষসের পরিজনবর্গকে সমর্পণ করো, আর চিরকাল রাজার বহুবিধ অনুগ্রহ ভোগ করো।

চন্দনদাস—আমার বাড়িতে অমাত্যের পরিজনরা নেই।

(নেপথ্যে পুনরায় কলকল রব)

চাণক্য—শার্ঙ্গরব, দেখে এসো তো কী ব্যাপার।

শিষ্য—আচ্ছা। (নিষ্ক্রমণ এবং পুনরায় প্রবেশ) গুরুদেব, দেখলাম—এও রাজার আর এক অনিষ্টকারী কায়স্থ শকটদাস। একে শূলে চাপাবার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

চাণক্য—নিজ কর্মের ফল ভোগ করুক। ওহে শ্রেষ্ঠী, রাজার অনিষ্টকারীদের প্রতি এমনি উগ্রদণ্ড, এই রাজা রাক্ষসের পরিবারকে লুকিয়ে রাখার ব্যাপারে তোমাকে ক্ষমা করবে না। অতএব পরের পরিবারকে সমর্পণ করে নিজের পরিবার ও জীবন রক্ষা কর।

চন্দনদাস—আর্য, আপনি কি আমায় ভয় দেখাচ্ছেন? অমাত্য রাক্ষসের পরিজন আমার বাড়িতে থাকলেও আমি তাদের সমর্পণ করতাম না, নেই যখন তখন আর কী!

চাণক্য—চন্দনদাস, এই তোমার সংকল্প?

চন্দনদাস—হ্যাঁ, এটাই আমার সংকল্প।

চাণক্য—(স্বগত) উত্তম চন্দনদাস, উত্তম। পরের স্বার্থ বিসর্জন দিলে যেখানে নিজের অর্থলাভ এত সহজ, শিবির অবর্তমানে আজকের দিনে এ দুষ্কর কাজ কে করবে? ॥২৩।।

(প্রকাশ্যে) চন্দ্রনদাস, এই তোমার সিদ্ধান্ত?

চন্দনদাস—হ্যাঁ।

চাণক্য (সক্রোধে)—দূরাত্মা দুষ্ট বণিক্, তবে তুমি টের পাবে কাকে বলে রাজরোষ। চন্দনদাস—তৈরি আছি। আর্যের ক্ষমতায় যা কুলোয় তাই করুন।

চাণক্য—শার্ঙ্গরব, আমার আদেশ মতো কালপাশিক ও দণ্ডপাশিককে গিয়ে বলো, “শীঘ্র এই দুষ্ট বণিককে বেঁধে আন।” অথবা থাক্। দুর্গরক্ষক বিজয়পালকে বলো, “এর গৃহের যাবতীয় মূল্যবান্ সামগ্রী বাজেয়াপ্ত করে স্ত্রী-পুত্র-সমেত একে বন্দি করে রাখো, আমি ততক্ষণে বৃষলকে ঘটনাটা জানাই। বৃষল নিজেই এর প্রাণদণ্ডের আদেশ ঘোষণা করবে।”

শিষ্য–গুরুদেবের যা আদেশ। এই যে মহাজন, এদিকে, এদিকে।

চন্দনদাস—আর্য, আমি আসছি। (স্বগত) তবু আমার সৌভাগ্য এই যে বন্ধুর কাজ করতে গিয়ে মারা পড়ছি, মনুষ্যসুলভ কোনো দোষে নয়।

(পরিক্রমা করে শিষ্যের সঙ্গে নিষ্ক্রান্ত)

চাণক্য—(সহর্ষে) ওহ্, এবার তবে রাক্ষসকে পেয়ে গেছি! কেমন করে?—তার (রাক্ষসের) বিপদে এ (বণিক্) যেমন নিজের প্রাণকে অবাঞ্ছিত বস্তুর মতো ত্যাগ করছে, অনুরূপ এর বিপদে সেও নিশ্চয়ই নিজের প্রাণকে প্রিয় মনে করতে পারে ॥২৪।।

(নেপথ্যে কোলাহল)

চাণক্য—শার্ঙ্গরব, শার্ঙ্গরব।

শিষ্য (প্রবেশ করে)– আজ্ঞা করুন, গুরুদেব।

চাণক্য—এ কিসের কোলাহল?

শিষ্য—(বেরিয়ে গিয়ে ব্যাপারটা বুঝে নিয়ে আবার ঢুকল) গুরুদেব, এইমাত্র শকটদাসকে বধ করার মুহূর্তে সিদ্ধার্থক তাকে সঙ্গে নিয়ে বধ্যভূমি থেকে পালিয়ে গেছে।

চাণক্য—(স্বগত) ভালো, সিদ্ধার্থক। কাজ শুরু করে দিয়েছ। (প্রকাশ্যে) জোর করে নিয়ে পালিয়েছে? (সক্রোধে) বৎস, ভাগুরায়ণকে বলো, “যত শীঘ্র সম্ভব তাকে ধরে ফেল।”

(শিষ্যের নিষ্ক্রমণ ও প্রবেশ)

শিষ্য (বিষণ্নভাবে)—গুরুদেব, হায় হায়! কী দুঃখ! ভাগুরায়ণও পালিয়েছে।

চাণক্য—(স্বগত) কার্যসিদ্ধি যাতে হয় সেইভাবে ঘুরে বেড়াক। (প্রকাশ্যে—যেন রেগে গেছেন এইভাবে) বৎস, আমার নাম করে ভদ্রভট, পুরুষদত্ত, ডিঙ্গরাত, বলগুপ্ত, রাজসেন, রোহিতাক্ষ ও বিজয়বর্মাকে বল—সত্বর পেছনে ধাওয়া করে দুরাত্মা ভাগুরায়ণকে ধরে আনুক।

শিষ্য—আচ্ছা। (বেরিয়ে গিয়ে বিষণ্নভাবে পুনরায় প্রবেশ) হায় হায়, কী বিপদ! গোটা শাসনব্যবস্থাই কেমন ওলট-পালট হয়ে গেছে। ভদ্রভট প্রভৃতি সেই লোকগুলোও আগেভাগে আজ ভোরেই পালিয়েছে।

চাণক্য—(স্বগত) সবারই পথ মঙ্গলময় হোক। (প্রকাশ্যে) বৎস, দুঃখ করে কী হবে? দেখ—যারা মনে মনে একটা কিছু ঠিক করে চলে গেছে, তারা বলতে গেলে, আগে থেকেই চলে গেছে; যারা এখনও আছে, তারাও যার যেমন অভিরুচি চলে যাবার ব্যাপারে উঠে-পড়ে লাগুক। কিন্তু একমাত্র আমার এই বুদ্ধি—যা কাজ হাসিলের বেলায় শত শত সেনার শক্তিকেও হার মানায়, নন্দবংশধ্বংসের সময় যার প্রতাপের পরাকাষ্ঠা লোকে দেখেছে, সেই যেন শুধু আমাকে না ত্যাগ করে ॥২৫॥

(উঠে) এই আমি ভদ্রভট প্রভৃতি দুরাত্মাদের ধরে আনছি। (যেন সামনে দেখতে পাচ্ছে—এইভাবে আকাশের দিকে তাকিয়ে—আত্মগত) ) দুরাত্মা রাক্ষস, এখন কোথায় যাবে? অচিরেই আমি স্বচ্ছন্দ পদক্ষেপে একাকী ভ্রমণশীল, দান-গরিমায় উজ্জ্বল-মুখ, উদ্ধত, মদ-বলে বে-পরোয়া ধাবমান বনগজের ন্যায় তোমাকে বুদ্ধি-গুণে বেঁধে এনে বৃষলের স্বার্থে কাজে লাগাব।।২৬।।

॥ মুদ্ৰালাভ নামক প্রথম অঙ্ক সমাপ্ত।।

***

প্রসঙ্গকথা

১. ত্রিপুরবিজয়ী : দানব স্থপতি ‘ময়’ স্বর্ণ, রৌপ্য এবং লৌহ দিয়ে তিনটি পুর বা নগর নির্মাণ করেছিলেন : দেবগণের অনুরোধে শিব সেগুলোকে ধ্বংস করেছিলেন। তাই শিবের এক নাম ত্রিপুরারি বা ত্রিপুরবিজয়ী। ‘ত্রিপুর’ বলতে অবশ্য ওই তিন নগরের অধিপতি দানবকেও বোঝাত!

২. ভরত নাট্যশাস্ত্রে ‘নৃত্য’ ও ‘নৃত্তে’র মধ্যে কোনো ভেদরেখা টানা হয়নি। ধনঞ্জয়ের দশরূপকে বলা হয়েছে—‘অন্যদ্ভাবাশ্রয়ং নৃত্যম্’, ‘নৃত্তং তাললয়াশ্রয়ম্’ অর্থাৎ নৃত্যে অঙ্গন্যাসের মাধ্যমে ভাবের দ্যোতনা, কিন্তু নৃত্তে তাললয়ের আশ্রয়ে কেবল অঙ্গে আন্দোলন, ভাবানুকৃতি নেই শিবের এ ‘নৃত্ত’ এখানে উদ্ধত নৃত্ত অর্থাৎ তাণ্ডব।

৩. সূত্রধার তার গুণবতী গৃহিণীকে ডাকছে। গৃহিণীর বিশেষগুলো সমভাবে নীতিবিদ্যার পক্ষেও সুপ্রযোজ্য। বস্তুত এ নাটকের উপজীব্য যে এই ‘নীতি’ তা এখানে ধ্বনিত (স্থিতিহেতো!)। উনটারনিৎস বলেছেন : “Polity, Niti, is directly the ‘heroine’ of the drama, as the author, in the prelude, that has two meanings, has indicated in a significant manner.” ভূমিকায় ‘অর্থশাস্ত্র ও মুদ্রারাক্ষস’ নিবন্ধে পূর্বোক্ত বিশেষণগুলোর অপ্রাকয়ণিক অর্থ আলোচিত হয়েছে; কৌটিল্যের ‘নীতি’র মতো সূত্রধার-গৃহিণীও যে দুর্লভ ষড়গুণে গুণবতী, সেই গুণগুলো কি এমনি :

“কার্যেষু মন্ত্রী বচনেষু দাসী ভোজ্যেষু মাতা শয়নেষু রম্ভা!
ধর্মানুকূলা ক্ষময়া ধরিত্রী ভার্যা চ ষাড়গুণবতীহ দুর্লভা!” (সুভাষিত

৪. শ্লেষ-প্রাণ শ্লোকটির দ্বারা নাট্যকার ‘প্রস্তুতাক্ষেপ’ বা নাট্যবৃত্তান্তের সংক্ষিপ্ত সূচনা করেছেন। চন্দ্রগ্রহণের ক্ষেত্রে ‘ক্রূরগ্রহঃ সকেতুঃ’ পাঠটি সঙ্গততর। ‘ক্রূরগ্রহ’ বলতে তখন রাহুকে বোঝাচ্ছে। কেতুর সঙ্গে রাহুর সম্পর্কও অঙ্গাঙ্গী। তাই অর্থ দাঁড়াচ্ছে—কেতুসমেত রাহু। নচেৎ, সেই কেতু (= রাহু)—এরূপ বুঝতে হবে। নাট্যার্থসূচনের দিক থেকে ক্রূরগ্রহ= রাক্ষস; কেতু= মলয়কেতু; ‘সকেতুঃ’ তখন রাক্ষসের বিশেষণ; চন্দ্র= চন্দ্রগুপ্ত (যেমন ভীম= ভীমসেন); মণ্ডল= রাজমণ্ডল (অরি, মিত্র, পাগ্রিাহ প্রভৃতি সহকারে বিজিগীষু রাজার কল্পিত রাজচক্র); বল= ম্লেচ্ছবল।

৫. নন্দরাজসভায় অপমানিত হয়ে চাণক্য শিখা মুক্ত করে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন-যে যতদিন নন্দবংশকে তিনি ধ্বংস না করেন, ততদিন ওই শিখা আর বাঁধবেন না। সম্প্রতি নন্দবংশ ধ্বংস হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তিনি শিখা বাঁধতে গিয়ে বাধা পাচ্ছেন, কারণ চন্দ্রগুপ্তের রাজলক্ষ্মীর সুপ্রতিষ্ঠার পথে অন্তরায় সৃষ্টি করছে মলয়কেতু, সহায় তার নন্দভক্ত অমাত্য রাক্ষস। অতএব শ্লোকটিতে চাণক্যের দৃঢ় সংকল্প তির্যকভাবে উচ্চারিত হয়েছে : মলয়কেতুকে নিগৃহীত না করে শিখা বন্ধন করা যাবে না।

৬. চন্দ্রগুপ্তকে চাণক্য বরাবর ‘বৃষল’ বলেই ডেকেছেন! ‘বৃষলী’ বা ‘শূদ্রনারী’র গর্ভে নাকি চন্দ্রগুপ্তের জন্ম। অতএব, মাতৃপরিচয়ে চন্দ্রগুপ্ত বৃষল বা শূদ্র (মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার প্রভাব?)

৭. বিষকন্যা : সুন্দরী তরুণী যার দেহসংস্পর্শমাত্রেই নির্ঘাত মৃত্যু। প্রাচীন ভারতে শত্রুর প্রতি বিষকন্যা প্রয়োগের এই নৃশংস প্রথার উল্লেখ করতে গিয়ে অধ্যাপক ধ্রুব সুশ্ৰুত থেকে একটি শ্লোক উদ্ধৃত করে বলেছেন যে বিষকন্যার সংসর্গে এলে প্রাণবিয়োগ সুনিশ্চিত!

৮. ক্ষপণক বলতে মুণ্ডিতমস্তক বৌদ্ধ বা জৈন ভিক্ষুকে বোঝায়। ‘ক্ষপণক’কে অনুবাদে ‘ভিক্ষু’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। ‘লিঙ্গ’ বলতে চিহ্ন বা বেশ (ছদ্মবেশ) বোঝায়! ইন্দুশর্মা ব্রাহ্মণ হয়েও ভিক্ষুর বেশ ধারণ করলেন, ভিক্ষু হলেন না। তাই বলা হয়েছে ‘ক্ষপণক লিঙ্গধারী’ :

৯. রাক্ষসের হৃদয়বৃত্তি এবং বন্ধু-প্রীতি সম্পর্কে চাণক্যের ধারণা কত স্বচ্ছ! সুহৃদের প্রাণরক্ষায় পরিতুষ্ট রাক্ষস সিদ্ধার্থককে তাঁর নিজের গা থেকে অলঙ্কার খুলে দান করবেন—এ ঘটনা পরে (২য় অঙ্কে) জানা যাবে এবং এই পারিতোষিক যে রাক্ষসকে কীভাবে অপদস্ত করবে, সেটা পঞ্চম অঙ্কে জানা যাবে।

১০. পতাকাস্থানের দৃষ্টান্ত। চাণক্যকে চিন্তামগ্ন দেখে তাঁর মনোযোগ আকর্ষণের জন্য সিদ্ধার্থক বলে উঠল ‘আর্য গৃহীতঃ’—সচকিত চাণক্যের কাছে মনে হল রাক্ষসই গৃহীত হয়েছে। ‘গৃহীত’ শব্দটি এখানে ভাবী শুভসূচক!

১১. বহু গ্রন্থে চাণক্যের সংলাপের মধ্যে ছেদ ঘটিয়ে চন্দনদাসের স্বগতোক্তিরূপে একটি শ্লোকের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। শ্লোকটির সংস্কৃত ছায়া এবং অনুবাদ দেওয়া হচ্ছে : উপরি ঘনং ঘনরটিতং দূরে দয়িত্য কিমেতদাপতিতম্।

হিমরতি দিব্যৌষধয়ঃ শীর্ষে সৰ্পঃ সমবিষ্টঃ!

এ কী হল? মাথার উপরে মেঘের গুরুগর্জন দূরে দয়িতা। মাথায় সাপ বসে আছে, দিব্যৌষধি হিমালয়ে।

শ্রেষ্ঠী চন্দনদাসের এমন ভয়ার্ত সংলাপ এখানে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। চাণক্যের কাছে তাঁর যে কী প্রাপ্তি হতে পারে—সেটা জেনেই তিনি গৃহ থেকে এসেছেন! এই ক্ষেত্রে এই শ্লোকের উপস্থিতি তাঁর মানসিক প্রস্তুতি, নির্ভীকতা ও ব্যক্তিত্বের স্বতোবিরোধিতাই তুলে ধরবে। অতএব শ্লোকটিকে আমরা মূলে বা অনুবাদে রাখিনি।

১২. মানবমন সম্পর্কে চাণক্যের কী গভীর অন্তর্দৃষ্টি! চাণক্য স্থির করলেন, চন্দনদাসের এই

আত্মত্যাগকেই তিনি কূটনীতিতে কাজে লাগাবেন। যে রাক্ষসের বিপদে প্রাণকেও চন্দনদাস তুচ্ছজ্ঞানে ত্যাগ করতে রাজি, রাক্ষসও নিশ্চিত এমন বন্ধু মৃত্যুর মুখে পড়েছেন শুনলে বিনিময়ে নিজ প্রাণ উৎসর্গ করতে এগিয়ে আসবেন। অতএব চন্দনদাস এদিক থেকে চাণক্যের বিরাট সহায়। চন্দদাসকে বাঁচাতে রাক্ষস আসবেনই—এটাই চাণক্যের স্থির সিদ্ধান্ত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *