ভূমিকা / কুশীলব

ভূমিকা

পূর্বকথা

মগধের ক্ষত্রিয়রাজবংশের এক মহৈশ্বর্যশালী রাজা ছিলেন সর্বার্থসিদ্ধি। সহায়-সম্পদে সমৃদ্ধ এই রাজা বহুকাল সুনামের সঙ্গে পৃথিবী শাসন করেছিলেন। এঁর সুদক্ষ ব্রাহ্মণ মন্ত্রীদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা খ্যাতিমান ছিলেন অমাত্য রাক্ষস। রাজনীতির মহান্ তাত্ত্বিক এই মন্ত্রীর শৌর্য ও প্রভুভক্তি ছিল সকলের বিস্ময়ের বিষয়।

রাজা সর্বার্থসিদ্ধির ছিল দুই রানি—ক্ষত্রিয়কন্যা সুনন্দা ও শূদ্রদুহিতা মুরা। রূপলাবণ্যে ও স্বভাবমাধুর্যে মুরাই রাজার মন বেশি জয় করেছিলেন। একদিন রাজবাড়িতে অতিথি হয়ে এলেন এক তপস্বী। দুই রানির সঙ্গে রাজা পরমশ্রদ্ধায় তাঁর সেবার্চনা করলেন। দুই রানি মাথা পেতে নিলেন তাঁর পূত পাদোদক। সুনন্দার মাথায় পড়ল নয় বিন্দু জল, আর মুরার মাথায় পড়ল মাত্র একটি বিন্দু। কিন্তু ওই একবিন্দু চরণামৃতই মুরা এমন ঐকান্তিক নিষ্ঠা ও আদরের সঙ্গে গ্রহণ করলেন যেন সেটুকুই তাঁর পরম প্রাপ্তি। তপস্বী পরম তুষ্ট হলেন তাঁর ভক্তিতে। যথাকালে মুরা প্রসব করলেন একটি পুত্রসন্তান। জননীর নামানুসারে বহু গুণের আকর সেই পুত্রের নাম হল মৌর্য। সুনন্দা কিন্তু একটি মাংসপিণ্ড প্রসব করলেন। মাংসপিণ্ডটি পরীক্ষা করে অমাত্য রাক্ষস একটি তৈলপাত্রে সেটিকে রেখে সযত্নে তার রক্ষণাবেক্ষণ করতে থাকলেন। সেই মাংসপিণ্ডই পরে নয়টি পূর্ণাবয়ব পুত্রসন্তানে পরিণত হল। নন্দ বলে পরিচিত হল এই নয় পুত্র। বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এদের বিক্রম প্রকাশ পেতে লাগল। এরা সাবালক হলে রাজা সর্বার্থসিদ্ধি এদের ওপর রাজ্যভার ন্যস্ত করলেন, আর অনন্যসামান্য মেধাসম্পন্ন মৌর্যকে দিলেন সেনাধ্যক্ষের পদ। তারপর তিনি শান্তিতে অবকাশে জীবন-যাপন করতে লাগলেন।

কালক্রমে সেনাপতি মৌর্য হলেন একশত মহাশক্তিধর পুত্রের পিতা। পুত্রদের মধ্যে অগ্রজ চন্দ্রগুপ্ত গুণবত্তায় ছিলেন সবার অগ্রণী। নিঃসন্তান নন্দরা মৌর্যের এই শুভ শক্তিবৃদ্ধিকে সুনজরে দেখল না। দুরাত্মা নন্দরা রাজশক্তির জোরে মৌর্য ও তাঁর শত পুত্রকে অন্ধকূপে নিক্ষেপ করলেন। নামমাত্র খাবার ও কয়েক ফোঁটা জল হল প্রত্যেকের জন্যে দৈনন্দিন বরাদ্দ। মৃত্যু অনিবার্য ভেবে তাঁরা ঠিক করলেন—প্রতিশোধ নেবার জন্যে অন্তত একজনকে বাঁচতেই হবে। আর সবার খাদ্য ও পানীয় তারই জীবন রক্ষার কাজে লাগুক, অন্যথা মৃত্যু সবাইকে গ্রাস করবে। অচিরেই অনশনে আত্মবিসর্জন দিলেন সবাই, বহুক্লেশে কোনোমতে বেঁচে রইলেন চন্দ্রগুপ্ত।

ইতিমধ্যে নন্দরাজ্যে একটি ধাঁধা নিয়ে সব বুদ্ধিমানরা মাথা খাটাচ্ছিলেন, কিন্তু কেউ-ই কিছু সমাধান করতে পারছিলেন না! ব্যাপারটা হল এই যে, সিংহলের রাজা নন্দরাজ্যে কার কত বুদ্ধির দৌড় তা যাচাই করতে একটি ধাঁধা পাঠিয়েছিলেন, সঙ্গে পাঠিয়েছিলেন খাঁচায় আবদ্ধ একটি সিংহ যা দেখতে অবিকল জীবন্ত সিংহের মতোই ভয়ংকর, কিন্তু সেটি আসলে সিংহ নয়। সমস্যাটি হল—খাঁচাটিকে অক্ষত রেখে দরজাটরজা না খুলে সিংহটিকে বের করে আনতে হবে। (‘দ্রাবয়েৎ’)। এ সমস্যার সমাধান করা মন্দবুদ্ধি নন্দদের পক্ষে সম্ভব হল না, তাঁদের মন্ত্রীদের পরামর্শে নেহাত কৌতূহলের বশে নন্দরা অর্ধমৃত অবস্থায় চন্দ্রগুপ্তকে অন্ধকূপ থেকে তুলে আনল। চন্দ্রগুপ্ত সব শুনে সিংহটিকে দেখামাত্রই ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন। আগুনে-লাল একটি লোহার শলা মূর্তিটির সামনে ধরে রাখলেন, অত্যল্পকাল মধ্যেই মোমের মূর্তিটি গলে গলে তরলরূপে খাঁচার বাইরে বেরিয়ে এল। ‘দ্রাবয়েৎ’ কথাটির ‘নিষ্ক্রামণ’ ছাড়াও যে ‘গলানো’ অর্থ হতে পারে, সেই বাক্‌চাতুরী ধরাটাই ছিল সমাধানের চাবিকাঠি।

প্রকাশ্যে চন্দ্রগুপ্তের বুদ্ধির তারিফ করলেও নন্দরা কিন্তু অন্তরে তাঁর প্রতি আরো বিরূপ হয়ে উঠলেন। চন্দ্রগুপ্তের চেহারায় ছিল রাজচক্রবর্তীর লক্ষণ; শৌর্য, ঔদার্য, গাম্ভীর্য, বিনয় প্রভৃতি বহুগুণে সমৃদ্ধ ছিল তাঁর হৃদয়। উপরন্তু তাঁর এই সর্বজয়ী মেধা। অতএব তাঁর প্রতি নন্দদের ঈর্ষা বেড়ে গেল বহুগুণ। কিন্তু চন্দ্রগুপ্তের সাম্প্রতিক জনপ্রিয়তা তাঁদের কাছে একটা বড়ো ভয়। তাই অসহিষ্ণুতা যতই থাক, জনমতের খাতিরে আপাতত বাইরে তার প্রকাশ চাপা পড়ল। ভেতরে ভেতরে চন্দ্রগুপ্তকে গোপনে হত্যা করার ষড়যন্ত্র চলতে লাগল।

নন্দদের ইচ্ছা অনুসারে চন্দ্রগুপ্ত নিযুক্ত হলেন অনুসত্রের তত্ত্বাবধানের কাজে। অন্তরে তাঁর তীব্র জ্বালা। প্রতীক্ষায় রইলেন—কবে সেই সুদিন আসবে যে-দিন তিনি নন্দদের দেবেন চরম শিক্ষা। এর মধ্যে একদিন চন্দ্রগুপ্ত ক্রোধ ও প্রতিহিংসার জ্বলন্ত মূর্তিস্বরূপ এক ব্রাহ্মণকে দেখলেন। পথে কুশাংকুরে ক্ষত হয়েছিল ব্রাহ্মণের চরণতল। প্রচণ্ড ক্রোধে ব্রাহ্মণ সমূলে উৎখাত করলেন সেই কুশস্তম্ভ, অগ্নিসংযোগ করলেন তাতে, আর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাঁর প্রতিশোধের আগুনে নিঃশেষে দগ্ধ হতে দেখলেন সেই কুশস্তম্ভকে। অদ্ভুত এই দৃশ্যে মুগ্ধ হলেন চন্দ্রগুপ্ত, এগিয়ে গিয়ে পরিচয় নিলেন ব্রাহ্মণের। ব্রাহ্মণ আর কেউ নন, নীতিশাস্ত্রপ্রণেতা চণক-পুত্র বিষ্ণুগুপ্ত, যাঁকে লোকে ‘চাণক্য’ বলেই জানে। কূটনীতিতে তিনি অদ্বিতীয়। চন্দ্রগুপ্ত চাণক্যকে পেয়ে উদ্দেশ্যসিদ্ধির পথে আশার উজ্জ্বল আলো দেখলেন। নন্দদের দুষ্কৃতি ও তাঁর প্রতি নিপীড়নের মর্মন্তুদ বৃত্তান্ত বললেন তিনি চাণক্যকে, সাহায্য চাইলেন তিনি তাঁর কাছে এর যথাযোগ্য প্রতিবিধানের। প্রতিশ্রুতি দিলেন চাণক্য—নন্দরাজ্য তাঁকে পাইয়ে দেবেন। এর পর ক্ষুধার্ত চাণক্য নন্দদের ভোজনশালায় প্রবেশ করে অগ্রাসনে গিয়ে বসে পড়লেন। অবিবেকী নন্দরা কিন্তু বয়সের দিক থেকে অপেক্ষাকৃত নবীন এই ব্রাহ্মণের অগ্রাসনে ভালো চোখে দেখলেন না। মন্ত্রীরা সকলে ‘না না’ করলেও তারা ক্ষুধার্ত চাণক্যকে অপমান করে টেনে নামাল। সেই ভোজনশালার মধ্যেই তাঁর শিখাবন্ধন মুক্ত করে প্রকাশ্যে প্রতিজ্ঞা করলেন—যতদিন তিনি এই অপমানের প্রতিশোধ স্বরূপ নন্দদের পৃথিবী থেকে উচ্ছেদ না করছেন, ততদিন তিনি আর এই শিখা বন্ধন করবেন না। প্রতিজ্ঞার পরেই তিনি দ্রুত রাজধানী ত্যাগ করে চলে গেলেন। চন্দ্রগুপ্তও তাঁর নিরাপত্তা বিঘ্নিত মনে করে নগর থেকে বেরিয়ে গিয়ে চাণক্যের সঙ্গে যোগ দিলেন।

নন্দকুলের সমূলে উচ্ছেদের জন্যে চাণক্য এবার তৎপর হলেন। শুরু হল তাঁর কূটনীতির জাল বিস্তার। তাঁর বাল্যমিত্র ইন্দুশর্মা নানা শাস্ত্রে পারদর্শী, বিশেষ করে জ্যোতিষশাস্ত্রে তাঁর ব্যুৎপত্তি সবার শ্রদ্ধার বিষয়। তাঁকে ডেকে চাণক্য গুপ্তচরবৃত্তিতে নিযুক্ত করলেন। ক্ষপণকবেশী ইন্দুশর্মা রাক্ষসদের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করে শেষে তাঁদের প্রতারিত করলেন। পার্বত্যরাজ পর্বতককেও চাণক্য নন্দরাজ্যের অর্ধাংশ দিয়ে দলে টানলেন। ক্রমে ম্লেচ্ছ রাজাদেরও তিনি সঙ্গে আনতে সমর্থ হলেন। শুরু হল নন্দদের বিরুদ্ধে সংগঠিত অভিযান।

যুদ্ধে নন্দরা নির্মূল হয়ে গেল। রাজধানী কুসুমপুর চন্দ্রগুপ্ত ও পর্বতকের অধিকারে এল। রাজধানীর পতনের পর অমাত্য রাক্ষস নন্দদের বৃদ্ধ পিতা সর্বার্থসিদ্ধিকে গোপনে সুড়ঙ্গপথে নগরের বাইরে পাঠিয়ে দিলেন। (তপোবনে চলে গেলেও বৃদ্ধ সর্বার্থসিদ্ধি পরে চাণক্যের নির্দেশে নিহত হন।) রাক্ষস অবশ্য আরও কিছুকাল কুসুমপুরে থেকে গেলেন। কীভাবে চন্দ্রগুপ্তের ক্ষতি করা যায়—সেই চেষ্টাতেই তিনি ব্যাপৃত থাকলেন। কিন্তু চাণক্যের সন্ধানী তৎপরতার কাছে তাঁর সব চেষ্টাই হল প্রতিহত।

চন্দ্রগুপ্তকে হত্যার উদ্দেশ্যে রাক্ষসের নিযুক্ত বিষকন্যাকে চাণক্য কৌশলে পর্বতকের শিবিরে পাঠিয়ে দিলেন। বেচারী পর্বতক হলেন সেই বিষকন্যার শিকার। কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুললেন চাণক্য। রাজ্যের ভাগ আর তাকে দিতে হল না। এদিকে কুমার মলয়কেতুকে ভয় দেখানো হল যে, তাঁর পিতা পর্বতককে চাণক্যই বিষকন্যা পাঠিয়ে হত্যা করেছেন। ভয় পেয়ে কুমার মলয়কেতুও অতঃপর আত্মরক্ষার তাগিদে নগর থেকে পালিয়ে গেলেন। রাক্ষসের পক্ষেও নগরে থাকা আর নিরাপদ ছিল না। নগর ত্যাগ করে রাক্ষস গিয়ে যোগ দিলেন মলয়কেতুর সঙ্গে; তিনি হলেন মলয়কেতুর প্রধান উপদেষ্টা। এঁরা দুজনে এবার চন্দ্রগুপ্ত ও চাণক্যের ওপর প্রতিশোধ নিতে তথা নন্দরাজ্য পুনরুদ্ধারের ব্রতে আত্মনিয়োগ করলেন। শুরু হল মগধরাজ্য আক্রমণের পরিকল্পনা। এরকম পরিস্থিতিতেই শুরু হয়েছে ‘মুদ্রারাক্ষস’ নাটক।

[টীকাকার ঢুন্টিরাজের ‘উপোদ্ঘাত’ অবলম্বনে]

নাট্যকার পরিচিতি

মুদ্রারাক্ষসে নাট্যকার বিশাখদত্ত তাঁর নিজের আত্মপরিচয় সম্পর্কে খুব অল্পই বলেছেন। ‘প্রস্তাবনা’ থেকে জানা যায় বিশাখদত্ত ছিলেন মহারাজ উপাধিধারী পৃথুর (বা ভাস্করদত্তের) পুত্র এবং সামন্ত বটেশ্বরদত্তের পৌত্র। বিশাখদত্ত নিজেও যে মহাসম্মানসূচক ‘দেব’ উপাধি লাভ করেছিলেন, কিছু কিছু প্রাচীন পাণ্ডুলিপি থেকে সে সাক্ষ্য মেলে। ওইসব পাণ্ডুলিপিতে ‘বিশাখদত্তের’ স্থলে লিখিত রয়েছে ‘বিশাখদেব’। ‘রাজনীতি’, বিশেষ করে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র এবং শুক্রনীতিতে বিশাখদত্তর ছিল অগাধ পাণ্ডিত্য। এছাড়াও নাট্যতত্ত্ব, দর্শনশাস্ত্র, বিশেষত ন্যায় এবং জ্যোতিষেও তাঁর ব্যুৎপত্তি ছিল অসামান্য। বৈদিক জীবনচর্যার আবহে মানুষ হলেও বিশাখদত্ত’র ধর্মমত ছিল অত্যন্ত উদার। নাটকের নান্দী দেখে মনে হয় ভগবান্ শিব ছিলেন তাঁর ইষ্টদেব। পরমতসহিষ্ণু বিশাখদত্ত বৌদ্ধধর্মকেও দেখতেন শ্রদ্ধার চোখে।

প্রস্তাবনায় সভা-প্রশংসা করতে গিয়ে নাট্যকার বলেছেন : উর্বরা ভূমিতে উপ্ত বীজ গুপ্ত গুচ্ছ গুচ্ছ শীষে শালিধান্যের সম্ভার নিয়ে আসে, এতে বপনকর্তার কৃতিত্ব কিছু বড়ো নয়। ওই প্রস্তাবনাতেই কিছু পরে নাট্যকার গৃহে উৎসবের প্রস্তুতি হিশাবে অন্যান্য গৃহকর্মের সঙ্গে নারীদের হাতে মুষলের উদ্যমন ও নিপতনের কথাও বলেছেন। নাটকের পঞ্চম অঙ্কে প্রসঙ্গত নাট্যকার গৌড়ীয় মহিলাদের লোধরেণুপ্রসাধিত কপোল এবং কুঞ্চিত ঘনকৃষ্ণ কেশদামের ভূয়সী প্রশংসা করছেন। পঞ্চম অঙ্কের একাদশ শ্লোকে নাট্যকার মলয়কেতুর সম্মিলিত সেনাবাহিনীর পুরোভাগে ‘খস’ সৈন্যদের সমাবেশের কথা উল্লেখ করেছেন। এই ‘খস’-জাতীয় লোকেরা উত্তর-পূর্ব ভারতের পার্বত্য অঞ্চলের অধিবাসী। শূর-শক্তির বিচারে বিশিষ্ট জাতি বা উপজাতি হিশাবে খসেরা যে মর্যাদা পাবার যোগ্য নয়, নাট্যকার মলয়কেতুর বিশাল বাহিনীর অগ্রভাগে এনে তাদের সেই মর্যাদা দিয়েছেন।

উপরের তথ্যগুলো বিশাখদত্তর বাসস্থানের ভৌগোলিকতা সূচিত করে এবং সে ভৌগোলিকতা নিঃসন্দেহে গৌড়-বঙ্গের। কারণ, বাংলার মতো উর্বর মাটি ভারতের আর কোথায় আছে যেখানে কোনোমতে বীজ বুনতে পারলেই সাধারণ চাষির ঘরেও রাশি রাশি সোনার ফসল উঠে আসে? তাই সূত্রধারের সংলাপের মাধ্যমে বিদ্বজ্জন সমাবেশকে নাট্যবীজের সফল পরিবেশনায় উপযুক্ত ক্ষেত্র বলার সমর্থনে বাংলার সুফলা জমির বৈশিষ্ট্যের দৃষ্টান্ত দিয়েছেন নাট্যকার। সুতরাং এ মন্তব্য স্বাভাবিক যে, নাট্যকার ধানের দেশের লোকদের উদ্দেশেই তাঁদের পরিচিত উপমাই প্ৰয়োগ করেছেন। আবার উৎসবের মরশুমে বা বিশিষ্ট অভ্যাগতের আপ্যায়ন উপলক্ষে উলুখলে বা হামানদিস্তায় ‘পিঠে’ তৈরির চাল গুঁড়ো করা বাংলার জনপদের এক পরিচিত দৃশ্য।

এরপর, বাংলা দেশের নারীদের শ্যামলশ্রী অপরের দৃষ্টি এড়ালেও তাদের প্রসাধনপেলব কমনীয় কপোল এবং ঘন কালো কুঞ্চিত কেশরাশির সৌন্দর্য যে সকলের মন কেড়ে নিতে পারে, এ কথা মনে রেখে সহৃদয় নাট্যকার বঙ্গনারীর সৌন্দর্যের ওই দিগুলোর সপ্রশংস উল্লেখ করেছেন। নাট্যকার যে এই নারীদের একান্ত আপন পরিবেশের লোক, এটা সহজেই অনুমেয়। খস-সৈনিকদের প্রতি কবির দুর্লভ সম্মান প্রদর্শনের প্রচেষ্টায় অনুমিত হয় যে, কবি বাংলার উপান্তের পর্বত-এলাকার এই অধিবাসীদের প্রতি প্রতিবেশীসুলভ সৌজন্য দেখিয়েছেন।

উপরি-উক্ত তথ্য-সূত্রগুলোর ভিত্তিতে তাই অনুমান করতে হয়, বিশাখদত্ত বাংলার লোক ছিলেন। এম্. আর. কালে মহোদয় তাঁর সম্পাদিত মুদ্রারাক্ষসের ভূমিকায় বিশাখদত্তকে বাংলারই কোনো এক ক্ষুদ্ররাজ্যের ভূপতিরূপে আখ্যাত করেছেন। অধ্যক্ষ এস্. রায় তাঁর সম্পাদিত মুদ্রারাক্ষসের উপক্রমণিকায় বিশাখদত্তকে বাংলার অধিবাসীরূপে চিহ্নিত করেছেন।

নাটকের তৃতীয় অঙ্কে বর্ণিত বর্ষার কূলপ্লাবী নদীমালা, শরতের স্বচ্ছ নীল আকাশ, রাশি রাশি কুমুদ-কমল-বাংলার ঋতুবৈচিত্র্যেরই পরিচায়ক। পঞ্চম অঙ্কের দশম শ্লোকে নাট্যকার যে দুরূহ নৈয়ায়িকতত্ত্বের অবতারণা করেছেন, তা বাঙালিদের বিশ্রুত ন্যায়চর্চার কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। এছাড়া বিশাখদত্তের রচনার রীতিও ‘গৌড়ীয়’। নাটকের মধ্যে এমনি আরো বহু সূক্ষ্ম সংকেত পাওয়া যায়, যাতে মনে করা স্বাভাবিক যে বিশাখদত্ত বাংলার জল-হাওয়ায় মানুষ হয়েছিলেন। অধ্যাপক Walimbe-ও বিশাখদত্তকে বাঙালি বলতে চেয়েছেন। অবশ্য, বাংলা ও বিহারের ভৌগোলিক সান্নিধ্য তথা পরিবেশগত কিছু সাদৃশ্য থেকে সম্ভাবনার অন্যতর দিকটিকে বড়ো করে তুলে ধরে শ্রীযুত তেলাঙ্ (Telang) কিন্তু নাট্যকার বিশাখদত্তকে বিহারবাসী রূপে প্রতিপন্ন করতে চেয়েছেন।

রচনা

মগধের রাষ্ট্রবিপ্লবোত্তর কাহিনীকে কেন্দ্র করে সাত অঙ্কে রচিত নাটক মুদ্রারাক্ষস বিশাখদত্তের মহত্তম সৃষ্টি। এ নাটকের মধ্য দিয়েই বিশাখদত্ত সংস্কৃত সাহিত্যে নাটক রচনার এক নতুন ধারার প্রবর্তন করেছেন। মগধের রাজপাটে মৌর্য চন্দ্রগুপ্তের প্রতিষ্ঠা ভারত-ইতিহাসের এক যুগান্তকারী ঘটনা।

নন্দবংশের পতন ঘটল, মৌর্যবীর চন্দ্রগুপ্ত পেলেন মগধের সিংহাসন। রাজকীয় উত্থান-পতনের এই ঐতিহাসিক পরিবেশের প্রেক্ষাপটে বিশাখদত্ত লিখেছেন তাঁর মুদ্রারাক্ষস।

সংস্কৃতসাহিত্যে বিশাখদত্তের তৃতীয় অবদান অভিসারিকা-বঞ্চিতক। অভিনবগুপ্তের অভিনবভারতী (২২শ অধ্যায়) এবং ভোজের শৃঙ্গারপ্রকাশে (১২শ প্রকাশ) এই রচনার উল্লেখ রয়েছে। বৎসরাজ উদয়নের জীবনচরিত অবলম্বনে রচিত এটি একটি নাটক।

কাল

সংস্কৃতসাহিত্যে কোনো গ্রন্থ বা গ্রন্থকারের কাল-নির্ণয় প্রায়ই এক দুরূহ সমস্যা। নাট্যকার বিশাখদত্তের বেলায়ও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। আত্মপরিচয় দিতে গিয়ে বিশাখদত্ত তাঁর পিতা ও পিতামহের নামোল্লেখ করলেও অন্য কোনোভাবে তাঁদের কোনো পরিচয় পাওয়া যায়নি। এর ফলে বিশাখদত্তের কালনির্ণয় বহুলাংশে অনুমান- নির্ভর হয়ে পড়েছে! মুদ্রারাক্ষসের শেষ শ্লোকে অর্থাৎ ভরতবাক্যে পৃথিবী-রক্ষায় রাজা চন্দ্রগুপ্তের শ্লাঘ্য ভূমিকার কথা বলতে গিয়ে বলা হয়েছে : …চিরমবতু মহীং পার্থিবশ্চন্দ্রগুপ্তঃ ॥ সংস্কৃত নাট্যসাহিত্যে গ্রন্থসমাপ্তির প্রচলিত প্রথা এই যে, গ্ৰন্থ শেষে ভরতবাক্যে সাধারণত পৃষ্ঠপোষকের নামের সপ্রশংস উল্লেখ করা হয়ে থাকে। এই দৃষ্টিভঙ্গীতেও দেখতে গেলে পূর্বোক্ত ভরতবাক্যের ‘চন্দ্রগুপ্ত’ শব্দটি বিশাখদত্তের পৃষ্ঠপোষক নৃপতি চন্দ্রগুপ্তকেই বোঝাবে। তবে এই চন্দ্রগুপ্ত যে মৌর্যচন্দ্রগুপ্ত নন—এ বিষয়ে মতানৈক্যের কোনো অবকাশ নেই।

কিন্তু সমস্যাটির জটিলতা বেড়ে গেছে অন্য একটি কারণে। বহু পুরাতন পাণ্ডুলিপিতে ভরতবাক্যের শেষ কথাটির ব্যত্যয় ঘটেছে। ওইসব পুঁথিতে রয়েছে ‘পার্থিবো রন্তিবর্মা’, ‘পার্থিবো দন্তিবর্মা’, ‘পার্থিবোহরন্তিবর্মা’ অর্থাৎ ‘চন্দ্রগুপ্ত’-র স্থলে পাঠান্তর ঘটেছে ‘রন্তিবর্মা’, ‘দন্তিবর্মা’ এবং ‘অবন্তিবর্মা’।

সুতরাং পাঠবৈষম্যের দরুন বিশাখদত্তের পৃষ্ঠপোষকরূপে চারটি ভিন্ন ভিন্ন নাম পাওয়া যাচ্ছে। এটা নিঃসন্দেহ যে এঁরা চারজনই যুগপৎ বিশাখদত্তের পৃষ্ঠপোষক নৃপতি ছিলেন না। তাছাড়া এঁদের পরিচিতির ব্যাপারটাও সুস্পষ্ট নয়। উপরি-উক্ত নামের কয়েকজন রাজার সন্ধান মিললেও তাঁদের মধ্যে কালগত ব্যবধান এত সুদূর যে তাঁদের সমকালিকতা অলীকতারই নামান্তর। অতএব এই ‘পার্থিব’-চতুষ্কের মধ্য থেকে বিশাখদত্তের পৃষ্ঠপোষক রূপে একজনকেই নির্ধারণ করতে হবে এবং তাঁর রাজত্বকালের ওপর নির্ভর করে বিশাখদত্তের কাল নির্ণয় করতে হবে।

প্রথমেই বলতে হয় মুদ্রারাক্ষসের কোনো কোনো পাণ্ডুলিপিতে ভরতবাক্যে ‘রন্তিবর্মা’ বলে যে পাঠটি রয়েছে, সেটির উদ্ভব হয়েছে নেহাতই লিপিকরপ্রমাদ থেকে। ওই নামের কোনো নৃপতির সন্ধান ইতিহাস জানে না। দেবনাগরী হরফে ‘দন্তিবর্মার ‘দ’-এর স্থলে ‘র’-এর লিখন-প্রমাদ ঘটেছে। অধ্যাপক ধ্রুব এবং শ্রীযুক্ত এ. আর. সরস্বতীর মতও তাই যে, ‘রন্তিবর্মা’ হল “দন্তিবর্মা’, পাঠেরই ভ্রান্তরূপ।

এবারে দেখা যাক্, এই দন্তিবর্মাই-বা কে? খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকের প্রথম পাদে ভারতের সুদূর দক্ষিণে ‘দন্তিবর্মা’ নামে এক পল্লব নৃপতি ছিলেন। মুদ্রারাক্ষসের ভরতবাক্যে ম্লেচ্ছদের উপদ্রব থেকে ধরণী রক্ষার বিষয়টি উল্লিখিত আছে। কিন্তু উক্ত পল্লব রাজত্বকালে ম্লেচ্ছ আক্রমণের কোনো ঘটনা জানা যায় না। অধ্যাপক ধ্রুব এক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন : মুদ্রারাক্ষসের ভরতবাক্যে পৃথিবী-রক্ষা প্রসঙ্গে বিষ্ণু বরাহ অবতারের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু পল্লব নৃপতিরা তো বিষ্ণুর ভক্ত ছিলেন না, তাঁরা ছিলেন শৈব।

অতএব ‘দন্তিবর্মা’ পাঠটি আদৌ নির্ভরযোগ্য নয় এবং সেই সূত্রে বিশাখদত্তের আবির্ভাবকাল যে খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকের প্রথম নয়—তাও সুনিশ্চিত।

সুতরাং প্রাচীনতম পুঁথিগুলোর আনুগত্যে অবশিষ্ট-পাঠান্তর দুটিকেই শেষ পর্যন্ত কালনির্ণয়ের সম্ভাব্য সূত্ররূপে স্বীকার করতে হচ্ছে। শ্রীযুক্ত তেলাঙ ‘দন্তিবর্মা’ পাঠটি অগ্রাহ্য করেছেন এবং অধ্যাপক ধ্রুবও ক্রমে ‘দন্তিবর্মা’ পাঠটিকে বর্জন করে ‘অবন্তিবর্মা’ পাঠটি পৃথক অস্তিত্বের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। এই ‘অবন্তিবর্মা’ যে বিশাখদত্তের পৃষ্ঠপোষক, অধ্যাপক ধ্রুব এ মতও পোষণ করেছেন।

ইতিহাসে কিন্তু ‘অবন্তিবর্মা’ নামে দুজন রাজার কথা জানা যায়। এঁদের মধ্যে একজন হলেন খ্রিস্টীয় নবম শতকের কাশ্মীররাজ অবন্তিবর্মা। শ্রীযুক্ত তেলাঙ্ মনে করেন, এই অবন্তিবর্মা নাট্যকার বিশাখদত্তের পৃষ্ঠপোষক হতে পারেন না। কারণ, যে দুটি পাণ্ডুলিপিতে ‘অবন্তিবর্মা’ পাঠ রয়েছে, তাদের হদিস পাওয়া গেছে এমন এমন স্থানে যা কাশ্মীর থেকে বহু দূরে। ‘অবন্তিবর্মা’ যে কাশ্মীরের রাজার নামরূপে ভরতবাক্যে উল্লিখিত হয়নি, সেই মতের সমর্থনে আর একটি যুক্তি এই যে, নাট্যকার নাটকের প্রথম অঙ্কে ম্লেচ্ছ নৃপতিদের পঞ্চ প্রধানের মধ্যে কাশ্মীরের রাজাকে অন্তর্ভুক্ত করেছেন (১।২০) অতএব ভরতবাক্যস্থ ‘অবন্তিবর্মা’র ম্লেচ্ছবিরোধী ভূমিকার সঙ্গে কাশ্মীররাজ অবন্তিবর্মার সামঞ্জস্য কোথায়? অধ্যাপক ধ্রুবের এ যুক্তি সত্যই প্রণিধানযোগ্য।

উপরন্তু লক্ষণীয় যে বিশাখদত্তর রচনা-নীতি গৌড়ী, গৌড়ভূমির বহু বিষয়ের মুগ্ধ ও প্রাণবন্ত উল্লেখ রয়েছে তাঁর নাটকে। সুতরাং বিশাখদত্ত যে বঙ্গ-অঞ্চলেরই অধিবাসী এবং তাঁর পৃষ্ঠপোষকও যে এদেশেরই ভূস্বামী, এই অভিমত পোষণ করতে গিয়ে শ্রীযুক্ত তেলাঙ্ বলেছেন—আর এক অবন্তিবর্মাই হচ্ছেন বিশাখদত্তের বন্দিত নৃপতি। ইনি হলেন কান্যকুব্জের মৌখরীরাজ অবন্তিবর্মাই। সম্ভবত সপ্তম খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি কোনো এক সময়ে ইনি সিংহাসনে আসীন ছিলেন। ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, এই মৌখরীরাজ অবন্তিবর্মার জ্যেষ্ঠ পুত্র গ্রহবর্মার সঙ্গে হর্ষবর্ধনের ভগিনী রাজশ্রীর বিবাহ হয়। ৬০৬ খ্রিস্টাব্দে হর্ষবর্ধন সিংহাসনে আরোহণ করেন, কিন্তু এর পূর্বেই মালবরাজের নিষ্ঠুর চক্রান্তে গ্রহবর্মার মৃত্যু ঘটে। মৌখরীরাজ অবন্তিবর্মা তাই খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকের পূর্তি পর্যন্তও সম্ভবত জীবিত ছিলেন না। ম্লেচ্ছদের উপদ্রবের প্রসঙ্গেও এ তথ্যের সমর্থন পাওয়া যায়। ম্লেচ্ছ বলতে এখানে শ্বেতবর্ণ হূণদের কথা বলা হচ্ছে। খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকের শেষার্ধে মৌখরীরাজ অবন্তিবর্মা স্থানীশ্বরের প্রভাকর বর্ধনের সহায়তায় ম্লেচ্ছদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছিলেন। দীর্ঘস্থায়ী এই সংঘর্ষে শেষ অবধি হূণরা পর্যুদস্ত হয়। এই ঘটনার সূত্র ধরে বাণভট্ট তাঁর ‘হর্ষচরিতে’ প্রভাকর বর্ধনকে ‘হূণ হরিণ কেশরী’ বিশেষণে অলঙ্কৃত করছেন।

অতএব খ্রিস্টীয় ষষ্ট শতকের উত্তরার্ধকেই নাট্যকার বিশাখদত্তের আবির্ভাব-কাল রূপে চিহ্নিত করা যায়। এই সময়-সীমার সমর্থনে অধ্যাপক ধ্রুব অন্যতর যুক্তিও দেখিয়েছেন। ভারবির ‘কিরাতার্জনীয়’ মহাকাব্যের দ্বিতীয় সর্গের ৪৭শ শ্লোকের উত্তরাধটি হচ্ছে—

“সহতে ন জনোহপ্যধঃ ক্রিয়াং
কিমু লোকাধিকধাম রাজকম্ ॥

আর মুদ্রারাক্ষসের চতুর্থ অঙ্কের দশম শ্লোকের উত্তরাধটি হচ্ছে—“কিং নু লোকাধিকং তেজো বিভ্ৰাণঃ পৃথিবীপতিঃ ॥”

উদ্ধৃত পদ্যাংশ দুটির সাদৃশ্যের ভিত্তিতে অধ্যাপক ধ্রুব মনে করেন, বিশাখদত্তের প্রতিভার উন্মেষ ঘটেছে ভারবির পরে। তাঁর মতে খ্রিস্টীয় পঞ্চম খ্রিস্টাব্দের শেষভাগ হচ্ছে ভারবির কালসীমা, আর খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকের প্রথমার্ধ হচ্ছে শিশুপাল খ্যাত মহাকবি মাঘের কালসীমা। অধ্যাপক ধ্রুব বলেন—নাট্যকার বিশাখদত্ত এই দুই মহাকবির মধ্যবর্তী অর্থাৎ তাঁরও মতে খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকের শেষার্ধকেই বিশাখদত্তের কালসীমা বলে মানতে হয়।

কিন্তু ‘চন্দ্রগুপ্ত’ পাঠটিকে যে বর্জন করা কঠিন। অনেকেই এই পাঠটিকে সঠিক বলে গ্রহণ করেছেন। বেশিরভাগ পাণ্ডুলিপিতেই ‘চন্দ্রগুপ্ত’ পাঠটি দেখা যায় এবং ‘চন্দ্রগুপ্ত’ শব্দটি সেখানে তার শ্লিষ্ট প্রয়োগে বিশেষ তাৎপর্যবহ হয়ে ওঠে। মুদ্রারাক্ষসের বিখ্যাত টীকাকার ঢুণ্ডিরাজও এই পাঠটিকেই গ্রহণ করেছেন। অধ্যক্ষ রায় ভরতবাক্যে ‘চন্দ্রগুপ্ত’ পাঠটির যৌক্তিকতা তাঁর সংস্করণে খুব সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন বক্তব্যে বুঝিয়ে দিয়েছেন। টীকাকার ঢুন্টিরাজ অবশ্য ‘চন্দ্রগুপ্ত’ বলতে নাটকের নায়ক মৌর্য চন্দ্রগুপ্তকে বুঝেছেন, কিন্তু তা যুক্তিসহ নয়। প্রথম কথা, ভরতবাক্যে নায়কের প্রশস্তি থাকতেই হবে, এমন কোনো অনুশাসন নেই। দ্বিতীয়ত, নাটকে চন্দ্রগুপ্ত যথাযথ নায়কোচিত গুণ ও গৌরবের উজ্জ্বল আধার রূপে চিত্রিত হননি, তাই ভরতবাক্যে সেই একই চন্দ্রগুপ্ত সম্বন্ধে উদাত্ত প্রশস্তি ও শুভ-সংশন সঙ্গতিপূর্ণ নয়। তৃতীয়ত, নাট্যকারদের এটাই প্রথাসিদ্ধ যে, তাঁরা ভরতবাক্যে স্বীয় শুভানুধ্যায়ী পৃষ্ঠপোষক নৃপতিদের ওপরই মঙ্গল-আশিস বর্ষণের প্রার্থনা করেন। মৌর্য চন্দ্রগুপ্তের তিরোধানের বহু শতাব্দী পরে রচিত এ নাট্যকার কখনই তাঁকে উদ্দেশ্য করে পৃথিবী রক্ষার প্রস্তাব করতেন না। অতএব ‘চন্দ্রগুপ্ত’ পাঠটিকেই মূল পাঠ বলে স্বীকার করতে হলে মৌর্য চন্দ্রগুপ্তের প্রসঙ্গ পরিহার করে ইতিহাসের অন্য চন্দ্রগুপ্তকে খুঁজতে হয় এবং এই চন্দ্রগুপ্ত যে মগধের গুপ্ত রাজবংশের দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত (খ্রি. ৩৭৫-৪১৩) সে বিষয়ে বহু পণ্ডিতই একমত। এই মহাপ্রভাবশালী সম্রাট প্রায় সমগ্র ভারতকেই তাঁর সাম্রাজ্যের অধীনে এনেছিলেন এবং ভারতে বিদেশি আক্রমণকারীদের উপদ্রবও দৃঢ়হস্তে দমন করেছিলেন। এই আক্রমণকারীদের ম্লেচ্ছ বা যবন বলা হত। এই দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তই যে বিশাখদত্তের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন, বিশাখদত্তের সম্প্রতি-আবিষ্কৃত দেবীচন্দ্রগুপ্ত নাটকের আভ্যন্তর সাক্ষ্যে সেটা আরো সুপ্রকট। দেবীচন্দ্রগুপ্তের লেখক বিশাখদত্ত যে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের অত্যন্ত কাছের মানুষ ছিলেন, বহু পণ্ডিতই তা স্বীকার করেন। অধ্যাপক কোনো (Konow) এই মতের অন্যতম প্রবক্তা। শ্রীযুক্ত আর. এস. পণ্ডিতও বলেন যে, দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তকে লক্ষ্য করেই বিশাখদত্ত পূর্বোক্ত ভরতবাক্যে ‘চন্দ্রগুপ্ত’ নামটির উল্লেখ করেছেন। এই চন্দ্রগুপ্তই সাহিত্যে, শিল্পে, নানা আখ্যান-উপাখ্যানে বিক্রমাদিত্য নামেও প্রসিদ্ধ। একাদশ শতকের কবি অভিনন্দ বলেছেন, “শকারাতি’ বা শকদের শত্রুর অনুগ্রহে কালিদাসের কবিকৃতি খ্যাতির শিখরে পৌঁছেছিল (“খ্যাতিৎ কামপি কালিদাসকৃতয়োঃ নীতঃ শকারাতিনা।”) ‘শকারাতি’ (শক+অরাতি) বলতে এখানে শকদের অরি দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বা বিক্রমাদিত্যকেই বোঝায়, কারণ খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতকের শেষে এই চন্দ্রগুপ্তই বিদেশি শকদের পর্যুদস্ত করেছিলেন। দেবী চন্দ্রগুপ্তে বর্ণিত শকদের সঙ্গে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের শত্রুতার কথাও এই বক্তব্যের সপক্ষেই সাক্ষ্য দেয়। শ্রীযুক্ত পণ্ডিত দৃঢ়তার সঙ্গেই বলেছেন যে, সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত ও তাঁর পরিবার-পরিজনকে খুব কাছে থেকে না দেখলে দেবীচন্দ্রগুপ্তের তিন মুখ্য চরিত্রের প্রাণবন্ত আলেখ্য সৃষ্টি বিশাখদত্তের পক্ষে সম্ভব হত না। অধ্যাপক কোনো’র (Konow) উক্তিও এই প্রসঙ্গে স্মরণীয়। তিনি বলেছেন, বিশাখদত্ত ছিলেন কালিদাসের অনুজ সমসাময়িক (Yonger Contemporary of Kalidasa)। শ্রীযুক্ত পণ্ডিত নাট্যকার বিশাখদত্তের পারিবারিক অভ্যুদয়ের প্রসঙ্গে চন্দ্রগুপ্তের পরিবারের সঙ্গে তাঁদের বৈবাহিক সম্পর্কের কথাও উত্থাপন করেছেন। এই সম্পর্কের প্রভাবেই নাট্যকারের নিজ পরিবারের উন্নতির সোপান-বিন্যাস।

মুদ্রারাক্ষসে বৌদ্ধধর্মের প্রতি যে উদার শ্রদ্ধার নিদর্শন (৭/৫) পাওয়া যায়, তাতে খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতকের পূর্বার্ধকেই নাটক-রচনার কাল বলে মনে করতে হয়। কারণ, ভারতে তখন বৌদ্ধধর্ম তার উন্নতির উচ্চশিখরে সমারূঢ় এবং এর পর থেকেই ক্রমে ভারতবর্ষে বৌদ্ধধর্মের হ্রাসের যুগ শুরু হয়। চৈনিক পরিব্রাজক ফা-হিয়েনের বিবরণীতেও এ মতের অনুকূলে সাক্ষ্য মেলে। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্যের আমলে মগধের রাজধানীরূপে পাটলিপুত্রের সমৃদ্ধি এবং ভারতে বৌদ্ধধর্মের বিস্তৃতির কথা এই বৌদ্ধ পরিব্রাজক তাঁর ভ্রমণ-বিবরণীতে উল্লেখ করেছেন। উত্তরকালে আগত হিউ-য়েন- সাভ্ কিন্তু তাঁর ভ্রমণকালে প্রাচীন রাজধানী পাটলিপুত্রের ধ্বংসাবশেষ মাত্র দেখেছিলেন। শ্রীযুত কালে এবং অধ্যক্ষ রায়ও বিশাখদত্তের কাল নির্ণয়ে অনুরূপ মতেরই প্রবক্তা।

প্রখ্যাত সাহিত্য-সমালোচক উইনটারনিৎস মহোদয়ও বিশাখদত্তকে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বকালের লোক বলে চিহ্নিত করতে চেয়েছেন। মুদ্রারাক্ষসের ভরতবাক্যে ‘চন্দ্রগুপ্ত’ পাঠটির সঙ্গতি উপলব্ধি করে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তকে বিশাখদত্তের পৃষ্ঠপোষকরূপে মেনে নেওয়াই শ্রেয়। এই মত অনুসারে খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতকই নাট্যকার বিশাখদত্তের আবির্ভাব তথা সারস্বত অভ্যুদয়ের কাল।

নাট্যবিশ্লেষণ

মুদ্রারাক্ষস নাটকে দেখি চাণক্য ‘মুদ্রা’র কূটনৈতিক কার্যকারিতায় শেষ পর্যন্ত রাক্ষসকে জয় করে নিয়েছেন। রাক্ষসের ‘নামমুদ্রা’ লাঞ্ছিত অঙ্গুরীয়ক প্রাপ্তিই হয়েছে চাণক্যের সিদ্ধির চাবিকাঠি। নামের মধ্যেই এ নাটকের মুখ্য বৃত্তান্ত ধরা পড়ছে। তাই এ নাটকের মুদ্রারাক্ষস নাম-করণ সঙ্গত, সার্থক ও সুন্দর। [মুদ্রয়া জিতঃ রাক্ষসঃ মুদ্রারাক্ষসঃ, স এব অভেদোপচারাৎ, তদাখ্যং নাটকম্]।

‘বীররস’ এ নাটকের প্রধান বা ‘অঙ্গী’রস। অতিগহন কৌটিল্যনীতিরূপ অদ্ভুতরস এর প্রধান অঙ্গ। ধীরোদাত্ত লক্ষণান্বিত চন্দ্রগুপ্ত এ নাটকের নায়ক। এ নাটকের বৃত্তান্তও প্রসিদ্ধ, কারণ পুরাণেতিহাস ও কিংবদন্তীর সঙ্গে কবির কল্পনার মেলবন্ধনে রচিত হয়েছে এ নাটকের সুবদ্ধ কাহিনী। মুদ্রারাক্ষসের রচনারীতি গৌড়ী।

মুদ্রারাক্ষস নাটকের মুদ্রাপ্রাপ্তির বৃত্তান্ত এবং তার সহায়তায় রাক্ষস জয়ের পরিকল্পনার ব্যাপারটাই ‘বিন্দু’। সমগ্র নাটকে বহু বিচিত্র ক্রিয়াকাণ্ড ঘটলেও এই বিন্দু তার অমোঘ শক্তিতে যাবতীয় ঘটনার ‘ঐক্য’ ও ‘সংহতি’ বজায় রেখেছে। অন্য কোনো সংস্কৃত নাটকের ক্রিয়াগত ঐক্যের এমন সার্থক রূপায়ণ দেখা যায় না। প্রথিতযশা ভারততত্ত্ববিদ্ Wilson বলেছেন : It may be difficult in the whole range of dramatic literature to find a more successful illustration of the rule. অর্থাৎ নাট্যসাহিত্যের সমগ্র পরিধিতে এই ঐক্য-বিধির সার্থকতার আর কোনো নিদর্শন পাওয়া কঠিন

উৎসচিন্তা

মুদ্রারাক্ষসে বর্ণিত বৃত্তান্তের সঠিক কোনো উৎস পাওয়া যায় না বটে, তবুও নাটক রচনাকালে যেসব আকরগ্রন্থ, কাহিনী বা ঘটনা নাট্যকার বিশাখদত্তের নিকট সম্ভাব্য উৎসরূপে গৃহীত হয়ে থাকতে পারে সেগুলোকে আমরা প্রধানত তিনটি শ্রেণিতে বিন্যস্ত করতে পারি : পুরাণ, লোককথা ও ইতিহাস।

পুরাণ

পৌরাণিক সাক্ষ্য এ বিষয়ে আজ পর্যন্ত মোটামুটি যা সংগৃহীত হয়েছে, তাতে এই প্রতীতি জন্মায়—ভারতবর্ষে সুপ্রাচীন কাল থেকে এটা এক সুবিদিত কাহিনী যে ব্রাহ্মণ চাণক্যই রাজা নন্দ ও তার আট পুত্রকে নিধন করেছেন। নন্দবংশের উচ্ছেদ সাধনের পর তিনি মৌর্য চন্দ্রগুপ্তকে মগধের সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত করেন। এ বিষয়ে বিষ্ণুপুরাণের চতুর্থাংশের চতুর্দশ অধ্যায়ে বলা হয়েছে : মহানন্দীর শূদ্রাজায়ার গর্ভজাত অতিলোভী এক পুত্র হবে। মহাপদ্ম নামে সেই পুত্র দ্বিতীয় পরশুরামের ন্যায় অখিল ক্ষত্রিয়কুলের বিনাশ করবে। তখন থেকে শূদ্রেরা হবে রাজা! সেই মহাপদ্মের আজ্ঞা হবে সবার শিরোধার্য। একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে সে পৃথিবী শাসন করবে। সুমাল্য প্রমুখ তার আট পুত্র জন্মাবে। মহাপদ্ম ও তার পুত্রেরা এক শত বৎসর পৃথিবীতে আধিপত্য করবে। কৌটিল্য নামে ব্রাহ্মণ ওই নয়জন নন্দকেই বিনাশ করবে। তাদের অবর্তমানে মৌর্যেরা পৃথিবী শাসন করবে। কৌটিল্যই চন্দ্রগুপ্তকে রাজ্যে অভিষিক্ত করবে (৪-৭)।

এখানে উল্লেখ যে ‘মহাপদ্ম’ সংখ্যক সৈন্যের অধিপতি বলে মহানন্দীর পুত্রের ওইরূপ ‘মহাপদ্ম’ নাম বিশ্রুত। আর কৌটিল্য চাণক্যেরই নামান্তর। চাণক্যের বহু নাম প্রচলিত ছিল।

শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণের দ্বাদশ স্কন্দের প্রথম অধ্যায়ে (৮-১৩) আমরা বিষ্ণুপুরাণের অনুরূপ বিবৃতিই পাচ্ছি। তাই পুরাণের কোনো পুরাতনী কথাকে অবলম্বন না করেই বিশাখদত্ত রচিত অভিনব নাটক মুদ্রারাক্ষস নাট্যসাহিত্যে যথার্থই তার অভিনবত্ব বজায় রেখেছে।

লোককথা

লোকসাহিত্যের অফুরন্ত ভাণ্ডার থেকে বিশাখদত্ত তাঁর মুদ্রারাক্ষসের পটভূমিকার জন্য কতটুকু কী আহরণ করেছেন। মুদ্রারাক্ষস নাটকের উৎস সম্ভবত ভারতীয় লোককথার সর্ববৃহৎ আকার অধুনালুপ্ত গুণাঢ্যের বৃহৎকথা। বৃহৎকথাই হচ্ছে মুদ্রারাক্ষসের মূল। বৃহৎকথা-বিধৃত কথাচুম্বকটিও তিনি উল্লেখ করতে ভোলেননি: চাণক্য নামে সেই ব্রাহ্মণ শকটালের গৃহে থেকে গোপনে অভিচারক্রিয়ার অনুষ্ঠান করলে সহসা নন্দ সপুত্র নিহত হল। (শকটাল হচ্ছেন ক্ষপণকলিঙ্গধারী চাণক্যমিত্র ইন্দুশর্মা–ঢুন্টিরাজ) যোগানন্দের যশের দিন হল শেষ; মহাতেজস্বী চাণক্য অতঃপর প্রকৃত নন্দের পুত্র চন্দ্রগুপ্তকে রাজা করলেন। তাহলে কথাসরিৎসাগরে বিবৃত নন্দ-কথার ছায়ারূপ দেখে সুচিরবিলুপ্ত বৃহৎ কথায় ওই বৃত্তান্তের কায়ারূপটি ধারণা করা সম্ভব।

কিন্তু নন্দের তথা যোগনন্দের যে কাহিনী আমরা কথাসরিৎসাগরে পেয়েছি সেই কাহিনী যদি হুবহু বৃহৎকথারই নিজস্ব কাহিনী হয়ে থাকে, তাহলেও বলতে হয় বৃহৎকথার ওই কাহিনীর শেষটুকুই শুধু মুদ্রারাক্ষসনাটক রচনার ক্ষেত্রে কিছুটা পটভূমির কাজ করে থাকতে পারে। বৃহৎকথা থেকে অনুরূপ নাটক রচনার প্রেরণা পাবার সম্ভাবনাও কিন্তু অনুমিত হয় না। মুদ্রারাক্ষসের পশ্চাৎপটের জটিলতা, তার ঐক্য, মৌল বৃত্তকে ঘিরে আখ্যানভাগের পরিবৃদ্ধি ও পরিপুষ্টির জন্যে সৃষ্ট নানা আবর্ত—এর কোনোটারই কিন্তু কোনো সন্ধান আমরা উদ্ধৃত কথাংশে পাই না। যাকে কেন্দ্র করে নাট্যকারের নাটক সৃষ্টির সাধনা ও সিদ্ধি সম্ভব হয়েছে সেই রাক্ষস চরিত্র বৃহৎকথায় সম্পূর্ণ অনুপস্থিত, তার উপস্থিতির সম্ভাবনার কোনো ইঙ্গিত বা আভাসও সেখানে মেলে না। সেজন্য বৃহৎকথাকে ঠিক মুদ্রারাক্ষসের বৃত্তান্তের উৎস বলতে পারি না।

ইতিহাস

মুদ্রারাক্ষসের ঐতিহাসিক তথ্য কী দেখা যাক।

খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকের প্রথম পাদে নন্দবংশের উচ্ছেদ ও মগধের সিংহাসনে মৌর্যের প্রতিষ্ঠা ভারত-ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। বহুনিন্দিত রাজা ধননন্দকে চন্দ্রগুপ্ত বাহুবলে মগধের সিংহাসন থেকে উৎখাত করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু এ কথাও ইতিহাস ভোলেনি যে এই বিরাট রাষ্ট্রবিপ্লবের পশ্চাতে মন্ত্রী চাণক্যের এক অনন্য ভূমিকা রয়েছে। হিমালয় অঞ্চলে পার্বত্য নৃপতি পর্বতকের সঙ্গে চন্দ্রগুপ্তের মিত্রতার সেতুবন্ধন চাণক্যই করেছিল। চাণক্যের অপরিমেয় সহায়তাই চন্দ্রগুপ্তের বিপুল সমরশক্তিকে সম্ভব করে তুলেছিল। শক, যবন, কিরাত, কম্বোজ, বাত্ত্বিক, পারসিক প্রভৃতি বিভিন্ন জাতির সৈন্যে সমৃদ্ধ ছিল তাঁর বিশাল বাহিনী। এই বিরল সমরশক্তির অধীশ্বর চন্দ্রগুপ্ত চাণক্যের সহায়তায় কেবল মগধের সিংহাসনই যে অধিকার করেছেন তা নয়, উপরন্তু তিনি ক্রমে বিদেশি শাসকদের অধিকৃত ভারত-ভূভাগের স্বাধীনতাও ফিরিয়ে আনেন। বহুধাবিভক্ত ভারতবর্ষে চন্দ্রগুপ্তই যথার্থ রাজনৈতিক ঐক্য-প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে মুখ্য পুরোহিত। তাঁর সাম্রাজ্য ছিল হিন্দুকুশ থেকে কুমারিকা পর্যন্ত বিস্তৃত। ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট স্মিথ তাঁকে ভারতবর্ষের সর্বপ্রথম সার্বভৌম সম্রাট্ আখ্যায় অভিহিত করেছেন।

সম্রাট্ হিশেবে চন্দ্রগুপ্তের বিস্ময়কর সাফল্য কেবল সামরিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ ছিল না, প্রশাসনিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও সেই সাফল্যের যুগপৎ প্রসার ঘটেছিল। কিন্তু চন্দ্রগুপ্ত চরিত্রের অপূর্ব সংযম-সুন্দর দৃঢ়তা এখানেই যে, ন্যায়-নীতি-বোধে উদ্বুদ্ধ এই সম্রাট্ শক্তিমদমত্তায় বিহ্বল হয়ে কখনও ভারতের ভৌগোলিক সীমার বাইরে সাম্রাজ্য-প্রসারের কোনো স্বপ্ন দেখেননি।

ইতিহাস ও লোকপ্রসিদ্ধি-অনুযায়ী সুবিশাল ভারতের একচ্ছত্র সম্রাট্ চন্দ্রগুপ্তের যে ভাবমূর্তি জনমানসে চিরভাস্বর, বিশাখদত্ত-কৃত মুদ্রারাক্ষস-নাটকে তা অত্যন্ত ম্লান। তাই ইতিহাস-পুরুষ চন্দ্রগুপ্ত ও বিশাখদত্ত-সৃষ্ট চন্দ্রগুপ্তের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান। নাটকের চন্দ্রগুপ্তকে দেখে মনে হয়, ইতিহাসের পুরুষ-শার্দূল চন্দ্রগুপ্ত এখানে চাণক্যের হাতের ক্রীড়নক। সচিবের ওপর রাজচালনার সব দায়িত্ব ন্যস্ত করে তিনি পরম ঔদাসীন্যে কালাতিপাতের মাধ্যমে রাজসুখ ভোগ করেন। চাণক্যের নির্দেশ পালনের চেয়ে বেশি স্বাধীনতার শখ তাঁর নেই। লোকাচারে অনভিজ্ঞ, অতিবিনয়ী রাজকার্যে উদাসীন এই জনগণাধীশ কূটনীতির স্বার্থে চাণক্যের সঙ্গে সাময়িক কপটকলহেও ভয় পান, পাছে গুরুর গৌরব লঙ্ঘন হয়।

বজ্রকঠিন ব্যক্তিত্বের অধিকারী যে পুরুষের অভিচার-বজ্রের আঘাতে নন্দ-রূপ দৃঢ়মূল পর্বতও সমূলে উৎপাটিত হয়েছিল, মন্ত্রণার বলে যিনি সমগ্র পৃথিবীকে নরচন্দ্রমা চন্দ্রগুপ্তের নিকট সাম্রাজ্যরূপে ডালি দিয়েছিলেন, যে মহামতি অর্থশাস্ত্ররূপ মহোদধি থেকে নীতিশাস্ত্ররূপ অমৃত উদ্ধার করেছিলেন, সেই বিষ্ণুগুপ্তকে সশ্রদ্ধ প্রণতি জানিয়েছিলেন তাঁরই যোগ্য উত্তরসূরি কামন্দক।

মুদ্রারাক্ষসের চাণক্য-চরিত্রের কূটনীতির প্রয়োগ থেকে একথা অনুমিত হয় যে, নাট্যকার বিশাখদত্ত অর্থশাস্ত্রের আদলেই নির্মাণ করেছেন এ নাটকের চাণক্য-চরিত্র।

বিশাখদত্ত যে অর্থশাস্ত্রের চাণক্যকে তাঁর কল্পনার রঙে ঈষৎ রঞ্জিত করে মুদ্রারাক্ষসে উপস্থাপিত করেছেন, এরূপ মতের সপক্ষে অর্থশাস্ত্রের অন্তিম শ্লোকটিও নিশ্চিত সমর্থন যোগায় :

ক্রোধ-কুটিল চাণক্যই, শস্ত্র ও নন্দরাজ-শোষিত পৃথিবীকে বলপ্রয়োগে সত্বর উদ্ধার করেছিলেন।

অতএব বিদ্বান্ বিচক্ষণ ও কূটনীতিবিশারদ যে চাণক্য সর্বদমন ব্যক্তিত্বের প্রতিমূর্তি রূপে নাটকে উপস্থিত, তাঁর চরিত্র-চিত্রণে বিশাখদত্ত যে তাঁর জানা ইতিহাস থেকে উপাদান আহরণ করেছিলেন, একথা বেশ জোরের সঙ্গেই বলা চলে। কিন্তু চাণক্যের মধ্যে বন্ধুত্ব, প্রভুভক্তি, সততা প্রভৃতি গুণের অনুরাগী এক শ্রদ্ধানম্র ব্যক্তিত্ব যে প্ৰচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে, সে পরিচয় কিন্তু বিশাখদত্তই তাঁর নাটকে উদ্ঘাটন করেছেন। চাণক্য চরিত্রে যেটুকু অন্তর্দ্বন্দ্বের প্রকাশ, তাঁর সবটাই বিশাখদত্তের ব্যক্তিত্ব। প্রতিহিংসা পূরণের পর চাণক্য সব ত্যাগ করে তপোবনে চলে গেলেন বলে কিংবদন্তী—শ্রুত হয়, চাণক্যের অন্তরের এই বিবিক্ত বিসর্জনের সুর সারা নাটকে আমরা অন্য কোথাও পাই না ঠিকই, তবে চাণক্য যেখানে রাক্ষসকে পেয়ে তাঁরই হাতে তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্বের অভিজ্ঞানরূপ শস্ত্র অর্পণ করলেন, তখন উপলব্ধি হয় যে চাণক্যের কুটিলতা সেই নীতির ওপরেই প্রতিষ্ঠিত যে নীতিতে জয়লাভই বড় কথা, সম্ভোগ নয়। মুদ্রারাক্ষসে চাণক্যের কূটনীতির আর এক বড় দিক সুপরিস্ফুট হয়েছে, সেটি হল বাহুবলের ওপর বুদ্ধিবলের প্রভুত্ব। চাণক্য সগর্বে ঘোষণা করেছেন—শতসেনার চেয়েও শক্তিশালী তাঁর বুদ্ধি যেন তাঁকে ছেড়ে না যায় (৯/২৫)। কার্যত তাই দেখা গেল যে, বুদ্ধিবলে বিনা যুদ্ধেই তিনি প্রধান প্রতিপক্ষ রাক্ষসকে তাঁর করায়ত্ত করে ফেললেন।

মুদ্রারাক্ষস নাটকে, ‘রাক্ষসকে নাট্যকার কোত্থেকে পেলেন? পুরাণে ‘রাক্ষস’, অনুপস্থিত, ইতিহাসেও ‘রাক্ষস’ নামে নন্দদের বহুগুণোপেত পরম-প্রভুভক্ত কোনো মন্ত্রীর কোনো স্পষ্ট উল্লেখ কোথাও নেই। লোকসাহিত্যেও রাক্ষস বা রাক্ষসের মতো কোনো চরিত্র পরিলক্ষিত হয় না। বিশাখদত্ত তাঁর জানা ইতিহাসের একটি অংশ নির্বাচন করে পুরাবৃত্ত ও লোককথার উপাদান মিশিয়ে তৈরি করেছেন তার নাটকের আখ্যানভাগ।

নিবিড় অনুশীলনের মাধ্যমে বিশাখদত্ত দেখেছেন অর্থশাস্ত্রেই ঘটেছে চাণক্যের অনন্য ব্যক্তিত্বের সংহত প্রকাশ, প্রতিটি পৃষ্ঠায় দেখেছেন তিনি তীক্ষ্ণধী চাণক্যের মহৎ বাঙ্ময় রূপ। মগধের রাজপাট মৌর্যের অধিকারে আসার পর চাণক্য-সম্পর্কিত ঐতিহাসিক তথ্যের অপ্রতুলতা নিশ্চয়ই তাঁর দৃষ্টি এড়ায়নি। তাই ইতিহাস তথা কিংবদন্তী যেখানে তাঁকে মন্ত্রী চাণক্যের ব্যক্তিসত্তার এক সীমিত কাঠামো জুগিয়েছে বিশাখদত্তের মহতী প্রতিভার স্পর্শে সেখানে চাণক্য হয়ে উঠেছেন এক অদ্বিতীয় মহান্ নায়ক।

নাট্যকার বরাবর ইতিহাসের যথাযথ অনুবৃত্তি করে তাঁর নাটক লিখবেন, এমন নির্দেশ কোথাও নেই। এ প্রসঙ্গে বিশ্ববিশ্রুত মনীষী অ্যারিস্টটলের মন্তব্যটি স্মরণীয়—“It is not the function of the poet relate to what has happend, but what may happen according to the law of probability and necessity.” অর্থাৎ যা ঘটেছে, তা বিবৃত করাই কবির কাজ নয়, বরং কাব্যের প্রকরণগত উপযোগিতা এবং সম্ভাব্যতার দিক থেকে যা ঘটতে পারে, তাই হবে কবির বর্ণনীয়। তাছাড়া,

“অপারে কাব্যসংসারে কবিরেকঃ প্রজাপতিঃ।
যথাস্মৈ রোচতে বিশ্বং তথেদং পরিবর্ততে ।।”

কবি-স্বাতন্ত্র্যের এই সনদপ্রাপ্ত নাট্যকার যে তাঁর মনোমতো চরিত্র সৃষ্টি করবেন, সে নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা তো তাঁর রয়েছেই।

অতএব আমাদের মতে, ইতিহাস এ নাটকে নাট্যকারের সর্বৈব অবলম্বন নয়, কিন্তু এটা সত্য যে ঐতিহাসিক পরিবেশ এ নাটকের পটভূমি। এ কথা স্বীকার করতে হয়, ঐতিহাসিক বাতাবরণে কবি-প্রজাপতি বিশাখদত্ত এখানে এমন এক সম্ভাব্যের মূর্তি গড়ে তুলেছেন যা অনৈতিহাসিক বলে কোনোও মতেই উপেক্ষণীয় নয়। তাই দেখি, উত্তরকালেও বহু প্রথিতযশা ঐতিহাসিক মৌর্যযুগের ভারতইতিহাসের বিষয়ে বলতে গিয়ে মুদ্রারাক্ষসের সশ্রদ্ধ উল্লেখ করেছেন, অনৈতিহাসিক বলে তাকে কোথাও অবজ্ঞা করেননি।

জনপ্রিয়তা

মুদ্রারাক্ষস তার স্বতন্ত্র স্বাদের জন্য সাহিত্য-অনুরাগীদের নিকট জনপ্রিয়তা সৃষ্টির ক্ষেত্রেও এক বিরল নিদর্শনের মর্যাদা লাভ করেছে। জনপ্রিয়তা ব্যাপারটি এমনি যে, জনমানসে যা একবার প্রেয়-রূপে প্রতিষ্ঠিত, তার পূর্বাপর-সংযোগ আপাতদৃষ্টিতে কিছু না পাওয়া গেলেও অনুরাগে-রাঙা কৌতূহলী মন থেমে থাকে না। কল্পনার অপার শক্তিতে অভীষ্ট কোনো সেতুবন্ধন সে করবেই। এই প্রচেষ্টার পরিণতিতেই মুদ্রারাক্ষস নাটকের জনপ্রিয়তার বিস্তৃত পরিধি নাট্যবৃত্তান্তের ব্যাপ্তি ঘটিয়েছে বহুতর ভিন্ন রূপ ও রীতিতে। ফলে যা ছিল মুদ্রারাক্ষস নাটক, তাকে ঘিরে গদ্যে ও পদ্যে গড়ে উঠেছে বহু বিচিত্র সাহিত্যকর্ম। এ-জাতীয় সাহিত্যকৃতির এক উজ্জ্বল নিদর্শন গদ্যে রচিত মহাদেবের মুদ্রারাক্ষস-নাটককথা। এ গ্রন্থটি যেমন মুদ্রারাক্ষস নাটকের জটিল বৃত্তান্তকে সহজ-সুন্দর গদ্যে উপস্থাপিত করেছে, তেমনি মুদ্রারাক্ষস নাটকের একটি আস্বাদ্য পূর্বপীঠিকাও যোজনা করেছে। এই শ্রেণির আর একটি উল্লেখ্য রচনা পদ্যে রচিত রবিনর্তকের মুদ্রারাক্ষস কথাসার। অনন্তভট্ট-রচিত মুদ্রারাক্ষস-পূর্বপীঠিকা বা মুদ্রারাক্ষস-পূর্ব-সংকথানক অনুরূপ আর একটি রচনা। কিন্তু এই সংক্ষিপ্ত গদ্যরচনাটি মুদ্রারাক্ষস নাটকে একটি ভূমিকা বা কথোদ্‌ঘাতমাত্র। মুদ্রারাক্ষসোত্তর যুগে কেবল সংস্কৃতেই যে এ-জাতীয় বহু রচনা পরিদৃষ্ট হয় তা নয়, কিন্তু প্রাকৃত ও পালি-ভাষাতেও এ ধরনের সাহিত্যকর্মের প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হয়।

এ ছাড়া মুদ্রারাক্ষসের জনপ্রিয়তা উৎসাহিত করেছে মহাকবি ভীমকে, তাঁর পূর্ণাঙ্গ নাটক প্রতিজ্ঞা চাণক্য রচনায়। অভিনবগুপ্ত তাঁর রসভাষ্য অভিনব-ভারতীতে এ নাটক সম্বন্ধে যেটুকু উল্লেখ করেছেন, তাতে দেখা যায়, এ নাটকে মুদ্রারাক্ষসের মলয়কেতুরই অনুরূপ এক চরিত্র অলিখিত হয়েছে যার নাম বিন্ধ্যকেতু। সংস্কৃত সাহিত্যে মুদ্রারাক্ষসের অনুগ নাট্যসৃষ্টি হিশেবে প্রতিজ্ঞাচাণক্যই সম্ভবত এক এবং অদ্বিতীয়।

পরবর্তী এই সাহিত্যকর্মগুলো থেকেই চিরাচরিত নাট্যধারা থেকে স্বতন্ত্র এই নাটকটির উত্তরাধিকার এবং জনপ্রিয়তার পরিধিটি সহজেই অনুমেয়।

দর্শকের দৃষ্টিতে

বিশাখদত্ত সচেতন নাট্যকার। মুদ্রারাক্ষস নাটকে তাঁর সুমিত ও সুষম শিল্পবোধের শুভ অন্বয় ঘটেছে। বীররসাশ্রিত এ নাটকের বাচনভঙ্গী সর্বাংশে বর্ণনীয় বিষয় বা উপস্থাপ্য বৃত্তান্তের আনুগুণ্য বজায় রেখেছে। নাট্যপরিবেশনার যথাযথ মাধ্যম হিশেবে এ নাটকের ভাষাও তাই সযত্নে কাব্য-লালিত্য বর্জনের নিষ্ঠা পালন করেছে। নাটক রচনা করতে গিয়ে মুদ্রারাক্ষসকার কবিত্বের পরিচয় দিতে ব্যগ্র নন। তাই তাঁর রচনা পৌরুষদীপ্ত-বাচনভঙ্গী ওজোময়, উর্জস্বি ও বাস্তবধর্মী এবং দ্রুতিময়তার মধ্যেও এই পৌরুষের পরিচয় রয়েছে। তারল্য, প্রণয় বা হৃদয়ের কোমলতার অনুকূল পরিবেশে এ নাটকের সৃষ্টি হয়নি, তাই তদনুরূপ কল্পনাবিলাসও এ নাটকে বিরল। ভাস, কালিদাস, ভবভূতির নাটকে চিরন্তন উদ্ধৃতি-যোগ্য বহু শ্লোক পাওয়া যায়, কিন্তু মুদ্রারাক্ষসের নাট্যকার সে ধরনের শ্লোক রচনার চিরাচরিত প্রলোভন পরিহার করেছেন। বাস্তবানুগ নাটকের নির্মাতা বিশাখদত্ত তাই ভালো ভালো সুশ্রাব্য শ্লোক বা ‘উৎকলিকা’ রচনা করে মুদ্রারাক্ষসে গীতি-ধর্মিতার প্রশ্রয় দেননি।

মুদ্রারাক্ষস নাটকের গঠন-বৈশিষ্ট্য থেকে বিশাখদত্তের নাট্যভাবনার পরিচয় সুপরিস্ফুট হয়ে ওঠে। নাটকের প্রথম অঙ্কে যথারীতি কথাবস্তুর সূচনা হলেও চাণক্যের বুদ্ধি যুদ্ধের কূটকৌশলগুলোর আভাস ছাড়া কার্যত তাদের প্রয়োগ পদ্ধতি, ও পরিণতির আর কোনো বার্তা সেখানে জানানো হয়নি। ফলে কী হবে, কী হতে পারে—এসব জল্পনা-কল্পনা স্বভাবতই দর্শকের মনে রহস্যঘন ঔৎসুক্য সৃষ্টি করে। রহস্য চাণক্যকে ঘিরে, রহস্য তাঁর গুপ্তচরদের ঘিরে, রহস্য রাক্ষসেরও চারদিকে। ঘটনার পর ঘটনার জালে জড়িয়ে এ রহস্য ক্রমে ঘনীভূততর হতে থাকে। পর্বতকের শ্রাদ্ধোপলক্ষে দেয় অলঙ্কার ব্রাহ্মণ পাঠিয়ে চাণক্য হস্তগত করলেন, কিন্তু সে অলঙ্কারে কোন অভীষ্ট সিদ্ধি হবে, তা পঞ্চম অঙ্কের পূর্বে জানবার উপায় নেই। রাক্ষসের মুদ্রা হাতে পেয়ে শকটদাসকে দিয়ে লেখালেন চাণক্য, কিন্তু নাম-ঠিকানাহীন সে চিঠিতে কী ছিল, তা জানা গেল পঞ্চম অঙ্কে। প্রথম অঙ্কে সিদ্ধার্থককে চাণক্য নির্দেশ দিয়েছেন, বধ্যস্থান থেকে শকটদাসকে ছিনিয়ে নিয়ে পালিয়ে যেতে হবে রাক্ষসের আবাসে। তারপর আরো কিছু সময়োচিত নির্দেশ দিয়ে তিনি কানে কানে সিদ্ধার্থককে বললেন—‘শত্রুরা কাছাকাছি এলে এই কাজটি সারতে হবে।’ কিন্তু কী সেই কাজ? চাণক্য তো কেবল বলেছেন—‘এবমিব’ (এরকম)। পঞ্চম অঙ্কে সিদ্ধার্থক যখন বিনা অনুমতিতে মলয়কেতুর শিবির ত্যাগ করতে গিয়ে প্রহরীর হাতে ধরা পড়ল এবং অতঃপর তল্লাশি করে তার কাছে যখন সেই কূট চিঠি ও গহনার পেটিকা পাওয়া গেল, তখনই বোঝা গেল চাণক্যের নির্দেশিত সেই কাজের স্বরূপ। প্রথম অঙ্কে আমরা জেনেছি চাণক্যের বিশ্বস্ত কয়েকজন রাজকর্মচারী চন্দ্রগুপ্তের কাছ থেকে পালিয়ে গিয়ে মলয়কেতুর শরণাপন্ন হয়েছে। কিন্তু এর চেয়ে বেশি আর কিছুই সেখানে জানা যায়নি। পঞ্চম এবং ষষ্ঠ অঙ্কে তাদের তৎপরতা দেখে আমরা বুঝি, সবই চাণক্যের বুদ্ধির খেলা। চাণক্য নিজেই বলেছেন যে স্বপ্নেও তিনি অর্থহীন কিছু করেন না। আর চাণক্যের ক্রিয়াকাণ্ডের তাৎপর্য যে কত রহস্যাবগুণ্ঠিত, তা বলাই বাহুল্য। চন্দ্রগুপ্তও তাঁর সব কাজের গুরুত্ব বুঝতে পারতেন না। চাণক্যের ডান হাত কী করল, বাম হাতও সে খবর জানতে পারত না। দ্বিতীয় অঙ্কে দেখি, অত্যন্ত সৌষ্ঠবপূর্ণ তিনখানি অলঙ্কার বিক্রয়ের জন্যে এক ব্যক্তি এসেছে রাক্ষসের কাছে। রাক্ষস মুগ্ধ হলেন সে অলঙ্কার দেখে এবং বিক্রেতাকে পরিতুষ্ট করে সে অলঙ্কার রেখে দেবার নির্দেশ দিলেন তাঁর একান্ত সচিব শকটদাসকে। কিন্তু এই অলঙ্কারের গূঢ় রহস্য ভেদ হবে পঞ্চম অঙ্কে। এমনিভাবে জটিল ঘটনাজাল সৃষ্টিতে দক্ষ বিশাখদত্ত মুদ্রারাক্ষসে রহস্য, কৌতূহল, উৎকণ্ঠা, আবেগ এবং বিস্ময়ের এক অপূর্ব আবহ সৃষ্টি করেছেন। বহু চরিত্র, বহু ঘটনার সমাবেশ ঘটলেও এ নাটকের কাহিনীসূত্র কোথাও ছিন্ন হয়নি। সহযোগী উপকথারূপ নানা খাত্ বা উপনদীর ধারায় সমৃদ্ধ হয়ে কাহিনীর মূল স্রোত কিন্তু অবাধ ধারায় বয়ে গেছে উপসংহৃতিরূপ মোহনার অভিমুখে।

মুদ্রারাক্ষসে দুটি প্রলম্বিত স্বগত সংলাপ রয়েছে—প্রথম অঙ্কে চাণক্যের এবং দ্বিতীয় অঙ্কে রাক্ষসের। এই দুই স্বগত ভাষণের গুরুত্ব এ নাটকে অপরিসীম। দুই বিবদমান গোষ্ঠীর প্রতিভূস্থানীয় এই দুই মোহনীয় পুরুষের বোধি এবং ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে একটা অন্তরঙ্গ ধারণা এই স্বগতোক্তির মাধ্যমে সুস্পষ্ট হয়। চাণক্য ও রাক্ষসের নিজ নিজ প্রকল্প এবং তাঁদের ব্যবহারিক অভিজ্ঞতার বেশ একটা নিবিড় পরিচয়ও এখান থেকে পাওয়া যায়।

ঘটনার গতি ও প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাণী-আলেখ্য নির্মিতিতেও বিশাখদত্ত সিদ্ধহস্ত। গুপ্তচর বিরাধগুপ্তের মুখে রাক্ষস যখন কুসুমপুর বৃত্তান্ত শুনছিলেন, তখন মধ্যে মধ্যেই তিনি আবেগে আপ্লুত অথবা উত্তেজিত হয়ে উঠছিলেন। অতীত তাঁর কাছে বর্তমানের মতো প্রতিভাত হচ্ছিল। বিশাখদত্তের প্রাণবন্ত বর্ণনার গুণে এ অনুভূতি একা রাক্ষসের নয়, সমস্ত দর্শকের কাছেই এর সমান স্বীকৃতি। সুগাঙ্গ প্রাসাদে প্রবেশ, বিরোচকের অভিষেক এবং শোভাযাত্রা প্রভৃতি স্থলেও বিশাখদত্তের বর্ণনাগুণ ও গদ্যগাঁথুনি অতীব উচ্চ কোটির। কাব্যিক বর্ণনার উৎকৃষ্ট নিদর্শনরূপে উল্লেখযোগ্য তৃতীয় অঙ্কে শরতের বর্ণনা, চাণক্যের কুপিত রূপের বর্ণনা, চতুর্থ অঙ্কে মলয়কেতুর ভাবী যুদ্ধাভিযানের আবেগোচ্ছল বর্ণনা, ষষ্ঠ অঙ্কে জীর্ণ পরিত্যক্ত উদ্যানের বর্ণনা। বিশাখদত্তের কাব্যিক অথচ বাস্তবধর্মী বর্ণনা-নৈপুণ্যের অনুপম দৃষ্টান্ত চাণক্যের জীর্ণ কুটির (৩/১৫)।

মুদ্রারাক্ষসে বিশাখদত্ত উপমা, রূপক, শ্লেষ প্রভৃতি বহু অলঙ্কারের প্রয়োগ করেছেন। বর্ণনীয় বস্তু, চরিত্র বা পরিবেশের সঙ্গে অলঙ্কার-রুচির একীভাব না ঘটলে সে অলঙ্কার রচনাকে ভারাক্রান্ত করে। মুদ্রারাক্ষসের কিছু কিছু স্থলে এ ত্রুটি চোখে পড়ে, বিশেষ করে শ্লেষের বহুল প্রয়োগ অনেক ক্ষেত্রে রচনাসৌকর্যের হানি করেছে। তবে ‘অপৃথগ্যতুনিবর্ত্য’ অলঙ্কারেরও পর্যাপ্ত দৃষ্টান্ত এ নাটকে রয়েছে।

পতাকাস্থান বা dramatic irony-র বহু সার্থক নজির এ নাটকে রয়েছে। বিশাখদত্তের পতাকাস্থান প্রয়োগের অন্যতম সার্থক একটি উদাহরণ :

রাক্ষস চিন্তান্বিতভাবে স্বগতোক্তি করেছে—

“তদপি নাম দুরাত্মা চাণক্যবটুঃ’– (তবে কি দুরাত্মা ব্যাটা চাণক্য-–)

দৌবারিকঃ—(উপসৃত) জয়তু (জয়ী হোন)।

রাক্ষসঃ—অতিসদ্ধাতুং শক্যঃ স্যাৎ। (ফাঁদে পা দেবে?)

দৌবারিকঃ—অমাত্যঃ। (অমাত্য)।

রাক্ষসের বুঝতে বাকি রইল না যে এ তাঁর ভাবী সঙ্কটেরই সূচক।

অবশ্য পতাকাস্থানের প্রয়োগ সর্বত্র সহজ ও শোভন হয়নি, কষ্টকল্পনার প্রশ্রয় পরিলক্ষিত হয়।

বিশাখদত্তের রচনা-রীতি গৌড়ীয়। বিরোধগুপ্তের প্রতিবেদনে স্থানে স্থানে বিশেষণের আড়ম্বর এবং কিছু দীর্ঘ সমাস থাকাটা তাই গৌড়ীয় রীতির রচনার পক্ষে অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু নাটকের সংলাপ হিশেবে এ-জাতীয় গদ্যাংশে সন্ধি, সমাস ও বিশেষণ-বাহুল্য কম থাকলে বর্ণনীয় আস্বাদ্যত বেড়ে যায় এবং নাটকের গতিও ত্বরান্বিত হয়। অবশ্য, বিশাখদত্ত যে সহজ-সুন্দর স্বচ্ছন্দ গদ্য রচনা করতে অপটু নন, তার বহু প্রমাণ ছড়িয়ে রয়েছে মুদ্রারাক্ষসের প্রতিটি অঙ্কে। ‘সূক্তিরত্ন’ রূপে পৃথকভাবে এমন কিছু কিছু পঙ্ক্তির আমরা উল্লেখ করেছি। সংক্ষিপ্ত সংলাপ তথা ‘চূর্ণক’ জাতীয় গদ্যাংশে বিশাখদত্তের সাবলীল গদ্যরীতির অনবদ্য পরিচয় সুস্পষ্ট। যেমন—তন্ময়াপ্যস্মিন্ বস্তুনি ন শয়ানেন স্থীয়তে, যথাশক্তি ক্রিয়তে তদ্‌গ্রহণং প্রতি যতুঃ। (১ম অঙ্ক) [– তা, এ ব্যাপারে আজও ঘুমিয়ে নেই, তাকে ধরবার জন্যে যথাসাধ্য চেষ্টা করছি।] আবার তৃতীয় অঙ্কের শেষ দিকে চন্দ্রগুপ্তের মুখে কত সহজ গদ্য আমরা শুনতে পাই—শোণোত্তন্তরে, অনেন শুষ্ককলহেন শিরোবেদনা মাং বধতে। শয়নগৃহমাদেশয়।

ভবভূতির নাটকের মতো অরুচিকর সমাস-বাহুল্য বা দীর্ঘসমাসবদ্ধতা মুদ্রারাক্ষসে নেই। বিশাখদত্তের এ নাটকে চিত্রকল্পগুলো কোথাও কোথাও কৃত্রিমতা দোষে দুষ্ট হলেও সার্থকসুন্দর বহু চিত্রকল্প এ নাটকের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে। চতুর্থ অঙ্কের শেষ শ্লোকটি এ-জাতীয় চিত্রকল্পের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তবে বিশাখদত্তের গদ্যে যে ওজস্বিতা, গাঢ়তা এবং সৌন্দর্য লক্ষিত হয়, তাঁর গদ্যগুলো সেই তুলনায় অনেকটা ম্লান।

কালিদাসের নাটকের কমনীয়তা বা কোমলতা মুদ্রারাক্ষসে নেই, নেই ভবভূতির চিত্তপ্লাবী কারুণ্য, নেই ভট্টনারায়ণের নাটকের যুদ্ধোদ্যম-সর্বস্ব উগ্র কলকোলাহল। কিন্তু এ নাটকে ধুরন্ধর রাজনীতিজ্ঞের সুতীক্ষ্ণ বুদ্ধির নানা বিস্ময়োদ্দীপক ক্রিয়াকৌশল যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে হৃদয়ধর্মেরও বহু বৈভব। বুদ্ধি ও হৃদয়ের চিরন্তন দ্বন্দ্ব এখানে বাস্তবের প্রেক্ষাপটে এক অভিনব তাৎপর্য লাভ করেছে। বিশাখদত্তের এ নাটক সংস্কৃত সাহিত্যেই যে শাশ্বত গৌরব অর্জন করেছে তা নয়, বিশ্ব-সাহিত্যের বিশাল দরবারেও তার যোগ্য আসন পাতা হয়ে রয়েছে।

নাট্যগুণোৎকর্ষে মুদ্রারাক্ষস দর্শকসাধারণের কাছে যতই উপভোগ বলে গৃহীত হোক না কেন, দর্শকের দৃষ্টিভঙ্গী থেকে সচেতনভাবে সব শেষে এ কথা বলা বোধ হয় অসমীচীন হবে না যে রাজনীতি ও কূটনীতির গহন-তত্ত্বনির্ভর বুদ্ধিদীপ্ত এ নাটক সর্বসাধারণের জন্যে নয়। কাব্যবিশেষবেত্তা যে দর্শকগোষ্ঠী (‘কাব্যবিশেষবেদিন্যাং পরিষদি’) তদানীন্তন সমাজের শাস্ত্রজ্ঞ প্রতিভূস্বরূপ ছিলেন, তাঁদের উদ্দেশ্যেই এ নাটক রচিত হয়েছিল। প্রস্তাবনাতে নাট্যকার স্বয়ং এ কথা বলেছেন। এটা অনস্বীকার্য যে এ নাটক যে যুগের আলোকপ্রাপ্ত কাব্যতত্ত্ববিদ্ সুধী সমাজের চিত্তবিনোদনে সার্থক ভূমিকা পালন করেছিল। বহুশত বৎসর পরে আজও মুদ্রারাক্ষস সম্পর্কে এ মন্তব্য সমভাবেই প্রযোজ্য যে এ যুগের সীমিত সহৃদয় সমাবেশে এ নাটকের অবদান অক্ষীণ এবং অম্লান।

চরিত্র-চিত্রণ

প্রধান প্রধান চরিত্রচিত্রণেই বিশাখদত্তের শিল্পনিষ্ঠা ব্যয়িত হয়নি, তাঁর সৃষ্ট গৌণ চরিত্রগুলোর আলেখ্যও কোনো অংশে কম শিল্পরীতিসম্মত নয়। নাটকের প্রতিটি চরিত্রের স্বকীয়তা ও শ্রেষ্ঠতা ফুটিয়ে তোলার জন্য প্রয়োজনমতো তিনি আরেকটি চরিত্র সৃষ্টি করেছেন। যুগ্ম চরিত্র নির্মাণে পরস্পরের তারতম্যের নিরিখে উভয় চরিত্রেরই স্বীয় বৈশিষ্ট্য সুপ্রকট হয়েছে। চাণক্য এবং রাক্ষস, চন্দ্রগুপ্ত এবং মলয়কেতু—এমনি দুটি যুগ্ম।

চাণক্য : চাণক্য চরিত্রটি বিশাখদত্তের এক অপূর্ব সৃষ্টি। বিদ্বান্, বিচক্ষণ, তীক্ষ্ণধী চাণক্যই এ নাটকের মধ্যমণি। তাঁর অসামান্য দীপ্ত ব্যক্তিত্ব অপর চরিত্রগুলোকে ম্লান করেছে। চাণক্যের সর্বদমন ব্যক্তিত্ব দেখে সংশয় হতে পারে—মগধের মহারাজ চন্দ্রগুপ্ত না চাণক্য। চাণক্যের আজ্ঞাই সে দেশের আইন ও অনুশাসন। সঙ্কল্পে তিনি অবিচল। অনড় তাঁর আত্মপ্রত্যয়। সঙ্কল্পসিদ্ধির পথে কোনো অন্তরায়কে তিনি গ্রাহ্য করেন না।

চাণক্য সদা-সতর্ক এক রাজনীতিক। কূটনীতিই তাঁর মুখ্য হাতিয়ার। অসির যুদ্ধ প্রয়োজন হলে তিনি চালাতে জানেন কিন্তু বুদ্ধির যুদ্ধেই তাঁর অতি আসক্তি। এ যুদ্ধের রীতি-নীতি তিনি ছাড়া অন্য কারও পক্ষে অনুধাবন করা সম্ভব নয়। মহারাজ চন্দ্রগুপ্তও তাঁর বুদ্ধিবৈভবে স্তম্ভিত হন বারবার। অমাত্য রাক্ষসের পক্ষেও যে চাণক্যচরিত্র বোঝা সম্ভব নয়, সেকথা ষষ্ঠ অঙ্কে চণ্ডালবেশী রাজপুরুষ সিদ্ধার্থকের মন্তব্য থেকেও সমর্থিত হয়। (…অমাত্যরাক্ষসেনাপি অনবগাহিতপূর্বম্‌ আর্যচাণক্য-চরিতম্…)। চাণক্যের প্রতিটি চেষ্টায়, প্রতিটি কাজে কোনো না কোনো মন্তব্য প্রচ্ছন্ন থাকে। স্বপ্নেও তিনি কোনো বৃথা চেষ্টা করেন না—‘ন প্রয়োজনমন্তরা চাণক্যঃ স্বপ্নেঽপি চেষ্টতে’।

অতুলনীয় তাঁর দূরদৃষ্টি, স্বচ্ছ তাঁর ধ্যান-ধারণা, মানুষ চিনতে তাঁর ভুল হয় না। শত্রুর ছিদ্রান্বেষণে তাঁর দৃষ্টি সদা-জাগরূক। প্রতিপক্ষের সম্ভাব্য সব রকম দুরভিসন্ধিই তাঁর নখদর্পণে। চন্দ্রগুপ্তের রাজপুরী-প্রবেশ উপলক্ষে সূত্রধর দারুবর্মা আগেভাগেই যন্ত্রতোরণ নির্মাণ করে বাহাদুরি পেতে চেয়েছিল কিন্তু চাণক্যের কাছে সে চালাকি শিশুর চাপল্যমাত্রে পর্যবসিত হয়েছে। তৃতীয় অঙ্কে বৈতালিকের কণ্ঠে উত্তেজনার আবহ সৃষ্টি দেখে চাণক্য তৎক্ষণাৎ বুঝতে পারেন যে এই বৈতালিক এবং এদের সুপরিকল্পিত শ্লোক রচনা—এ সবই রাক্ষসের কৃতিত্ব (রাক্ষসস্যায়ং প্রয়োগঃ)। রাক্ষসের কৌশল ধরে ফেলতে তাঁর বিশেষ কষ্ট হয় না। চাণক্যের নিজের উক্তিতেই আমরা তাঁর সন্ধানী শ্যেনদৃষ্টির সাক্ষ্য পাই—‘জাগতি খলু কৌটিল্যঃ’। চাণক্যের তীক্ষ্ণধীর স্বচ্ছ দর্পণে প্রতিপক্ষের সব কলাকৌশলই একে একে ধরা পড়ে। তাঁর যে কী অসাধারণ পর্যবেক্ষণশক্তি এবং চন্দ্রগুপ্তের প্রতি তাঁর যে কী নিশ্ছিদ্র সতর্কতা, তা চন্দ্রগুপ্তের শয়নগৃহের পরীক্ষণে প্রমাণিত হয়েছে।

গুপ্তচর নিয়োগের ক্ষেত্রেও দেখি তাঁর অসামান্য পারদর্শিতা। পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা না করে কোনো ব্যক্তিকেই তিনি বিশ্বাস করেন না, যোগ্যতার সঠিক বিচার না করে কাউকে তিনি কোনো কাজে লাগান না। তাঁর নিযুক্ত চরেরা পরস্পর জানতেও পারে না যে, তারা একই নিয়োগকর্তার উদ্দেশ্য সাধনে ব্যাপৃত আছে। চাণক্যের উক্ত কূটনীতির বীজ কখন কীভাবে অঙ্কুরিত হয়, তা বোঝা যে কত দুঃসাধ্য—রাক্ষসের মতো মনস্বী ব্যক্তির অকপট স্বীকৃতিই তার প্রমাণ। চাণক্যের কূটনীতির যুদ্ধে রীতি ও পদ্ধতি দেব-দুর্জ্ঞেয়—কোন মিত্রকে তিনি মেরে ফেলবেন বা কোন শত্রুকে তাঁর প্রয়োজনে বাঁচিয়ে রাখবেন, সেকথা পূর্বাহ্নে জানা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। তাঁর কাজের পরিণতি দেখে শত্রু-মিত্র সবাইকে বিস্ময়ে অভিভূত হতে হয়। বৈরোচকের অভিষেক এবং শোভাযাত্রা, চাণক্যের উদ্ভাবনশীলতার এক অনুপম নিদর্শন।

আন্তর স্বরূপকে অপরের কাছে প্রচ্ছন্ন করে রাখতে চাণক্যের জুড়ি নেই। আবার তিনি আদৌ যা নন, চলনে-বলনে আবশ্যকমতো সেই রূপটি ফুটিয়ে তুলতেও তাঁর দক্ষতা অনবদ্য। চাণক্য চরিত্র যথার্থই দুয়ে। কপট কলহের শেষ দিকে চাণক্যের চণ্ডমূর্তি দেখে চন্দ্রগুপ্ত পর্যন্ত হতভম্ব—তবে কি আচার্য তাঁর প্রতি সত্যই ক্রুদ্ধ? তার্কিকরূপেও যে চাণক্য অপ্রতিদ্বন্দ্বী, সে কথা প্রথম অঙ্কে শ্রেষ্ঠী চন্দনদাসকে এবং তৃতীয় অঙ্কে মহারাজ চন্দ্রগুপ্তকে স্বীকার করতে হয়েছে।

শত্রুর গুণ বা যোগ্যতার অকুণ্ঠ প্রশংসা চাণক্য-চরিত্রের উদারতার সাক্ষ্য বহন করে। নিজের মনের ওপর তাঁর অপরিসীম নিয়ন্ত্রণ। কোনো সঙ্কটে তিনি কাতর হন না। পুরুষকারের প্রমূর্ত রূপ এই চাণক্য কখনও দৈবের দোহাই দেন না। রাজনীতির ছায়াবর্জিত ব্যক্তিজীবনে তিনি এক উদার-হৃদয় স্নেহশীল আচার্য, পরিজনদের প্রতি তাঁর সৌজন্য বিশেষ উল্লেখযোগ্য। অন্তরে তিনি সর্বত্যাগী বিবিক্ত ব্রাহ্মণ। কঞ্চুকীর বর্ণনায় তাঁর কুটিরের দীনতা চাণক্য-চরিত্রটিকে আরো মোহনীয় করে তুলেছে। লোভ তাঁর নেই, তাই ভারতের অধীশ্বরও তাঁর কাছে তৃণবৎ অকিঞ্চিৎকর।

জাগতিক ক্ষমতা বা ঐশ্বর্য তাঁর মূল কাম্য নয়। অপমানের প্রতিশোধ নিতে মৌর্য চন্দ্রগুপ্তকে তিনি মগধের সিংহাসনে বসিয়েছেন, এবারে তাঁর অভিপ্রায়, সে সিংহাসন নিষ্কণ্টক হোক্। অমাত্য রাক্ষসকে তাই তাঁর চাই-ই। প্রতিপক্ষের প্রধান বৈরী রাক্ষসকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়া তাঁর উদ্দেশ্য নয়। রাক্ষস তাঁর শত্রু হলেও রাক্ষসকে অমর্যাদাকর কোনো পরিস্থিতির মুখে ঠেলে দিতে তিনি চান না, কেননা অভিমানী রাক্ষসকে তাহলে হারাতে হবে। অসাধারণ শৌর্য এবং মানবিকতার সমন্বয়ে রাক্ষস তাঁর কাছে মুগ্ধ শ্রদ্ধার পাত্র। তাই এই রাক্ষসকে জব্দ করাই তাঁর পক্ষে যথেষ্ট নয়, তাঁকে তিনি বুদ্ধির অভূতপূর্ব সংগ্রামে জয় করে আত্মপক্ষে অশেষ দায়িত্বের পদে নিযুক্ত করতে চান। এখানেই অনুভূত হয়, চাণক্য-চরিত্রের অসামান্য বিচক্ষণতা।

অমাত্য রাক্ষসকে জয় করার উদ্দেশ্যে চাণক্য যা কিছু করেছেন, তার পেছনে রয়েছে বৃহত্তর রাজনৈতিক প্রকল্প। তাঁর কর্মকাণ্ড যতই অবাঞ্ছিত বা ঘৃণ্য প্রতীত হোক্ না কেন, কোনোটাই তিনি ব্যক্তিগত স্বার্থে বা কোনো খামখেয়ালিবশে করেননি। নির্বাসন, প্রতারণা, নির্যাতন, গুপ্তহত্যা—প্রভৃতি সবই তাঁর কূটনীতির চাল। নাটকের শুরুতে সূত্রধারের কণ্ঠে তারই আভাস ধ্বনিত হয়েছে—কৌটিল্যঃ কুটিলমতিঃ। বহু নিষ্ঠুর ক্রিয়াকলাপের যোগ্য জবাব দিতে গিয়ে তাঁকে অনেক কূটনৈতিক চাল চালতে হয়েছে। সুতরাং মারাত্মক পাল্টী চাল দিয়েই তাঁকে রাক্ষসের জিঘাংসা প্রতিহত করতে হয়েছে। যেমন রাক্ষস ভেবেছিলেন, তাঁর নিযুক্ত বিষকন্যা চন্দ্রগুপ্তকে নিহত করবে। কিন্তু বিষম বাদ সাধলেন চাণক্য। সেই বিষকন্যাই তাঁর প্রয়োগনৈপুণ্যে নিহত করল পর্বতককে। রক্ষা পেলেন চন্দ্রগুপ্ত, রাজ্যের ভাগ দিতে হল না পর্বতককে, পর্বতক-হত্যার অপবাদ রটল রাক্ষসের নামে।

বৃথা কোনো আস্ফালন চাণক্যের চরিত্রে নেই। তিনি বড়ো কথা বলেন, বড়ো কাজ করেন। বৈরী চন্দনদাসকেও তাঁর চরিত্রের এই বৈশিষ্ট্যের কথা অকপটে স্বীকার করতে হয়েছে। (‘ফলেন সাংবাদিতমস্য বিকত্থিতম্’)। শত্রুর ত্যাগ-তিতিক্ষার মহান্ আদর্শের প্রতিও চাণক্যের অন্তর কম শ্রদ্ধাশীল নয়। চন্দনদাসকে তিনি আত্মত্যাগী শিবির সঙ্গে তুলনা করেছেন। অমাত্য রাক্ষসকে ‘মহাত্মা’ বলে তিনি সম্মান জানিয়েছেন। সব দ্বন্দ্বের শেষে চরম শত্রুকে পরম মিত্র বলে গ্রহণ করতে তাঁর কোনো দ্বিধা নেই। তাই তিনি অমাত্য রাক্ষসের পা ছুঁয়ে প্রমাণ করতে আদৌ সঙ্কুচিত নন। রাক্ষসকে চাণক্য যতটা বুঝেছিলেন, তা রাক্ষসের একান্ত কাছের লোকের পক্ষেও বোঝা সম্ভব ছিল না। রাক্ষসের প্রতি অন্তিমে তাই চাণক্য নিবেদন করেছেন শ্রদ্ধার বিরল অর্ঘ্য—অমাত্যরাক্ষসে নেতরি কিং হস্ত্যশ্বেন প্রয়োজনম্? (অমাত্য রাক্ষস সেখানে নেতা, সেখানে হস্তী-অশ্বে কী প্রয়োজন?) অতএব নিঃসংশয়ে বলতে হয়, মুদ্রারাক্ষস-কার বিশাখদত্তের প্রতিভার মহত্তম সৃষ্টি এই চাণক্য-চরিত্র I

রাক্ষস : মুদ্রারাক্ষসের রাক্ষস-চরিত্রও কয়েকটি চিত্তগ্রাহী বৈশিষ্ট্যে চাণক্যের সমমর্যাদার অধিকারী। এঁরা দুজনেই নিঃস্বার্থ অনলস সংগ্রামী। চাণক্যের শিষ্যস্নেহের মতো রাক্ষসের প্রভুভক্তি এই সংগ্রামের প্রেরণা। সংকল্প এবং নিষ্ঠায় দুজনেই উত্তাল, ত্যাগ এবং তিতিক্ষায় কেউ কারো চেয়ে কম নন। কূটনীতির কুটিল খেলায় হিংস্র-অহিংস যে কোনো উপায় অবলম্বনে এঁরা দুজনেই সমান কুশলী।

এর বাইরে দুজনের দুই স্বতন্ত্র ভূমিকা। স্বীয় ভূমিকায় রাক্ষস-চরিত্রে অনন্য স্বাতন্ত্র্যে প্রোজ্জ্বল চাণক্যের তুলনায় রাক্ষসের আত্মনিয়ন্ত্রণের শক্তি খুবই কম। হৃদয়দৌর্বল্য তথা আবেগপ্রবণতা বহুবার তাঁকে শৌর্যভ্রষ্ট পুরুষরূপে চিহ্নিত করেছে। অথচ নন্দরাজত্বে রাক্ষস শৌর্যগুণে যে এক অদ্বিতীয় যোদ্ধা, সে পরিচয় রাক্ষসের উক্তি থেকেই নাটকে পাওয়া গেছে। নাটকের শেষেও দেখি চাণক্যের কাছে রাক্ষস এক অসাধারণ সমরশক্তির মূর্ত বিগ্রহরূপে অভিনন্দিত। কূটনৈতিক যুদ্ধে কিন্তু রাক্ষসের ভাবমূর্তি চাণক্যের তুলনায় অনেক ম্লান। চাণক্যের ক্ষুরধার মেধার কাছে রাক্ষসের বুদ্ধি কেমন নিষ্প্রভ। সম্মুখসমরে তাঁর যত বীরত্বই থাক্, কূটনীতির যুদ্ধে রাক্ষসের দৈন্য দর্শকের দৃষ্টি এড়ায় না। চাণক্যের চালের কাছে রাক্ষসকে বারবার অপ্রতিভ হতে হয়েছে। দেহ-মনে রাক্ষস যুদ্ধাভিমানী ব্রাহ্মণ, তাই কুসমপুর আক্রমণের উদ্দেশ্যে যুদ্ধাভিযানের প্রস্তুতি তাঁকে ব্যতিব্যস্ত করে।

শত্রুকে বিপর্যস্ত করার জন্যে তিনি ভেদনীতির প্রয়োগ করেন, কিন্তু তাঁর সে ভেদনীতির বিভেদক শক্তি যে ভিত্তিহীন চিত্রকর্মের মতো কল্পনা-বিলাসের পর্যায়ভূত হয়, তা দর্শকের বুঝতে বাকি থাকে না। অথচ তিনি নিজেই একদিন পাকাপাকি শত্রুর ভেদনীতির শিকার হলেন। চাণক্য সেখানে চরম বৈরী, রাক্ষস সেখানে কী করে যাকে-তাকে এত প্রশ্রয় দেন? তাঁর চারদিকে শত্রুর চক্রান্তের দংষ্ট্রাকরাল মূর্তি, অথচ তিনি নিজে পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করেই আগন্তুক মাত্রকে তাঁর আবাসে প্রবেশের এবং এমনকি তাঁর সেবারও সুযোগ দেন। হৃদয়বত্তার সুযোগ নিয়ে শত্রুর চর তাঁকে সহজেই প্রতারিত করে। বস্তুত, চাণক্যের ‘কৌটিল্য’ বা কুটিলতার পরিধি যে কী ব্যাপক হতে পারে, সেটা অপেক্ষাকৃত সরলমতি রাক্ষসের বুদ্ধিতে কুলোয় না।

চাণক্যের মতো রাক্ষস নিজেকে নিজে-যা-নন-তাই বলে প্রতিপন্ন করতে পারেন না। নিজের স্বরূপে প্রচ্ছন্ন করে রাখার অভিনয়েও তিনি অপটু। নিজেরই গুপ্তচরদের তিনি সবসময় মনে রাখতে পারেন না, আবার ভুল করে প্রকাশ্যে গুপ্তচরকে স্বনামে ডেকে ফেলেন। দ্বিতীয় অঙ্কে ভৃত্যদের সামনে গুপ্তচর বিরাধগুপ্তের নাম অর্ধোচ্চারণ করেই তিনি নিজের ভুল বুঝতে পারলেন। ফলে তখন তাঁকে ‘বিরাধ’ শব্দের অর্থ নির্ণয়ে ব্যাখ্যার আশ্রয় নিতে হল (বিরাধ = বিশ্রী পোশাক-পরা)।

দৈব বা নিয়তির উল্লেখ রাক্ষসের মুখে বারবার আমরা শুনেছি। নিজের বিপর্যয় বা পরাভবের জন্যে দুরদৃষ্টকে তিনি একাধিকবার দায়ী করেছেন। শত্রুর কৃতিত্বকে দৈবের দান বলতেও কুণ্ঠাবোধ করেননি। রাক্ষসের উদারতা যেমন লক্ষণীয়, তেমনি লক্ষণীয় তাঁর কুসংস্কার। শুভ কাজের শুরুতে সাপ দেখার কথায় তিনি আঁতকে ওঠেন, সন্ন্যাসীর কিম্ভূতকিমাকার রূপ তাঁর কাছে অশুভ লক্ষণ। সপ্তম অঙ্কে দেখি, চণ্ডালের স্পর্শে কলুষিত বলে তিনি নিজেকে ধিক্কার দিচ্ছেন।

রাক্ষসের ব্যক্তিত্ব মলয়কেতু বা তাঁর নিজের অনুচরবর্গের ওপর বিশেষ প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। চাণক্যের লোকেরা চাণক্যকে যমের মতো ভয় করে, আদেশের প্রতিটি অক্ষর মনে গেঁথে রাখে; অথচ রাক্ষসের সেবক সিদ্ধার্থক তাঁকে মুখের ওপর অবজ্ঞা করে। রাক্ষসের সুকুমাররুচি ও মানসিকতায় আমরা মুগ্ধ হই, কিন্তু তাঁর নৃশংসতাও দর্শকের ভুলবার নয়। চন্দ্রগুপ্ত তাঁর চোখের বিষ, চন্দ্রগুপ্তকে হত্যা করার জন্য কত কৌশল তিনি উদ্ভাবন করেছিলেন। বিষকন্যা প্রেরণ আততায়ী নিয়োগ, বিষপ্রয়োগ, যন্ত্রতোরণ-নির্মাণ প্রভৃতি বিবিধ উপায়ে তিনি তাঁর প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে চেয়েছিলেন।

অবশ্য রাক্ষসচরিত্রের এই দুর্বল দিকগুলো বাদ দিলে বহু গুণের সমাহারে তিনি এক বরণীয় মানুষ। তাঁর স্নিগ্ধ ব্যবহার, উদার মানবতা, সুকুমার শিল্পবোধ, অলোকসামান্য বন্ধুপ্রেম, একনিষ্ঠ প্রভুভক্তি, কাব্যিক মানসিকতা সকলের কাছে কত আদরের বিষয়। গুপ্তচর বিরাধগুপ্তের কাছে রাক্ষস শুনতে পেলেন—চন্দনদাসের গৃহের যাবতীয় সামগ্রী বাজেয়াপ্ত করে চাণক্য স্ত্রীপুত্রসহ তাঁকে কারাগারে দিয়েছেন। শোনামাত্র রাক্ষস বলে উঠলেন, “…ননু বক্তব্যং সংযমিতঃ সপুত্রকলত্রো রাক্ষসঃ” (বলো না কেন—স্ত্রীপুত্রসমেত রাক্ষসকে কারাগারে নিয়ে গেছে।) চন্দনদাসের খবর জানার জন্যে উৎকণ্ঠায় অধীর হয়ে তিনি পোড়ো বাগানে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। পেলেন বন্ধুর আসন্ন বধের খবর। ছুটলেন তিনি বধ্যভূমিতে। বন্ধুর মুক্তিপণ রূপে নিজেকে সমর্পণ করলেন তিনি শত্রুর হাতে। বন্ধুর মুক্তির স্বার্থে মান-অপমান ভুলে শত্রুর সচিবের দায়িত্বভার তুলে নিলেন নিজের কাঁধে। চন্দ্রগুপ্তের প্রতি রাক্ষসের গভীর বিদ্বেষের মূলে ছিল তাঁর সুবিরল প্রভুভক্তি। এই চন্দ্রগুপ্তই যে নন্দদের সিংহাসন অধিকার করেছেন—এ ব্যাপারটা সর্বদাই রাক্ষসের মন বিষিয়ে রাখত। কিন্তু রাক্ষস যে চন্দ্রগুপ্তের গুণগ্রাহীও ছিলেন তার প্রমাণ পাওয়া গেছে একাধিকবার। চন্দ্রগুপ্তের বিনয় তাঁকে মুগ্ধ করত। সপ্তম অঙ্কের চতুর্দশ শ্লোকে রাক্ষস মলয়কেতুকে ‘অপাত্র’ বলে উল্লেখ করেছেন, কিন্তু চন্দ্রগুপ্তকে বলেছেন ‘সুপাত্র’। রাক্ষসচরিত্রের ঔদার্যের বড়ো দিক হল শত্রুর সঙ্গত মাহাত্ম্যকীর্তনে তিনি মুখর। চাণক্যের নীতির জয়কে সোচ্ছ্বাসে অভিনন্দিত করতে তাঁর কুণ্ঠা হয়নি। রাক্ষসের কাব্যিক কল্পনাশক্তির কালোচিত মনোগ্রাহী প্রকাশ ঘটেছে তাঁর প্রভুর পরিত্যক্ত উদ্যানের দৈন্যদশার বর্ণনায় (ষষ্ঠ অঙ্ক)। নন্দভক্তদের শোচনীয় দশা দেখেও রাক্ষস অশ্রুমোচন করেন। চাণক্য যেমন কোনো কোনো অবস্থা বা পরিস্থিতির কাছে নতি স্বীকার করেন না বা আত্মহারা হন না, রাক্ষস কিন্তু তা নন! তাঁর আবেগ ও উচ্ছ্বাস সহজেই উৎসারিত হয়।

মলয়কেতুর তিরস্কারে জর্জরিত রাক্ষস যখন দেখলেন যে হয়তো তাঁরই নীতির দোষে চিত্রবর্মা প্রভৃতি পাঁচজন রাজা মলয়কেতুর অকারণ সন্দেহের শিকার হল, তখন তাঁর অনুতপ্ত হৃদয়ে প্রশ্ন জেগেছে—তৎ কিমিদানীং মন্দভাগ্যঃ করবাণি (হতভাগা আমি এখন কী করি)। তদুত্তরে নৈরাশ্য, পৌরুষ, প্রতিহিংসা এবং কৃতজ্ঞতার সমূহ দ্বন্দ্বে রাক্ষস চরিত্রের স্বরূপটি তাঁর নিজের মর্মান্তিক বিলাপে কী সুন্দর অভিব্যক্তি লাভ করেছে : “তপোবনে যাব কি? কী লাভ? প্রতিহিংসার আগুন তপস্যায় প্রশমিত হবে না। শত্রুকে জীবন্ত রেখে প্রভুর অনুগামী হব কি (আত্মহত্যা করব কি?)? এ কাজ স্ত্রীলোককে মানায়। তবে কি এই অসি হাতে শত্রুসৈন্যের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ব? এও তো সঙ্গত নয়। চন্দনদাসের বন্ধন-মোচনের অপেক্ষায় ব্যগ্ৰ হৃদয় আমাকে তা করতে দেবে না, তা যদি করি তবে সেটা হবে কৃতঘ্নতার কাজ।” (৫/২৪)। তিনি মলয়কেতুর আশ্রয়ে ছিলেন। শত অপমানে মলয়কেতু তাঁকে আহত করলেও তিনি মলয়কেতুর উপকারের জন্যে কৃতজ্ঞ। মলয়কেতু তাঁকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি চন্দ্রগুপ্তের মন্ত্রিত্ব নেবার পর সর্বপ্রথম সেই মলয়কেতুরই মুক্তি তাঁর কাছে যাচ্ঞা করেছিলেন। মানুষের যা কিছু সুন্দর সংবেদনশীল রাক্ষস সেগুলোকে বড়ো আদরের দৃষ্টিতে দেখেন। তাই চাণক্যের মধ্যে দেখি বুদ্ধিতত্ত্বের প্রাচুর্য আর রাক্ষস চরিত্রে দেখি হৃদয়তত্ত্বের নিবিড় প্রতিষ্ঠা।

চন্দ্রগুপ্ত : মুদ্রারাক্ষসের নায়ক চন্দ্রগুপ্ত ধীরোদাত্ত লক্ষণান্বিত পুরুষ। আচার্য চাণক্যের প্রতি তাঁর অপার ভক্তি এবং অগাধ বিশ্বাস। চাণক্যের সঙ্গে কৃত্রিম কলহে তাঁর একান্ত অনীহা। কৃত্রিম কলহের শেষে দেখি চন্দ্রগুপ্ত শিরঃপীড়ায় কাতর। বিনয় তাঁর চরিত্রের ভূষণ। চন্দ্রগুপ্ত যে প্রায় নিখিল ভারতের অধিপতি এবং তাঁর আজ্ঞা যে সব রাজাই শিরোধার্য করে, সে কথা রাক্ষসের উক্তিতেও আমরা শুনেছি। কিন্তু চন্দ্রগুপ্ত জানেন চাণক্যই তাঁর সবকিছুর মূলে। গুরুবাক্যই তাঁর কাছে বেদবাক্য। মহারাজ হয়েও চন্দ্রগুপ্ত চাণক্যের কাছে স্নেহভাজন প্রিয়-শিষ্য। রাজ্য-কাঠামোয় চন্দ্রগুপ্ত সবার ওপরে, কিন্তু রাজশক্তির নিয়ন্ত্রণ মহামান্য চাণক্যের মুষ্ঠিতে। ‘সচিবায়ত্তসিদ্দি’ হতে চন্দ্রগুপ্তের কোনো কুণ্ঠা নেই। “স্বতন্ত্র্য’ বলতে তিনি স্বৈরাচারিতা বোঝেন না। অবশ্য চন্দ্রগুপ্ত চাণক্যকে পেয়ে রাজ্য পরিচালনায় যে কম ঔদাসীন্য দেখাননি, তাও চাণক্যের উক্তিতে স্পষ্ট হয়েছে। আচার্যের স্নেহচ্ছায়ায় থাকায় চন্দ্রগুপ্তের লোকাচার-অভিজ্ঞতা যে খুব বেশি হয়নি, সে কথা রাক্ষসের প্রাসঙ্গিক বিশ্লেষণে জানা গেছে। কাব্য ও নিসর্গ-সৌন্দর্যের প্রতি অনুরাগ চন্দ্রগুপ্ত চরিত্রের এক মহৎ বৈশিষ্ট্য। [লক্ষণীয় মুদ্রারাক্ষসে চন্দ্রগুপ্তের কুলপরিচয় বা পিতৃপরিচয় খুব স্পষ্ট নয়। তাঁকে বিভিন্ন স্থলে ‘মৌর্য’, মৌর্যপুত্র’, ‘নন্দান্বয়’, ‘কুলহীন’ বা ‘বৃষল’ রূপে উল্লেখ করা হয়েছে।]

মলয়কেতু : চন্দ্রগুপ্তের বিপরীত চরিত্র মলয়কেতু। তাকে দেখে এক অপরিণতবুদ্ধি তরলমতি অনভিজ্ঞ যুবক বলে মনে হয়। বিজিগীষু বলে রাক্ষস তাঁকে আশ্রয় করেছিলেন। কিন্তু তাঁর চরিত্রের খামখেয়ালিপনা, সন্দেহবাতিক, হঠকারিতা প্রভৃতি দোষের ব্যাপার রাক্ষস ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন। রাক্ষসের গৃহে প্রবেশের মুখে আড়িপেতে ভেতরের সংলাপ শোনা, শিবিরের ছাত্রপত্র দিতে ব্যস্ত ভাগুরায়ণের চোখ পেছনে থেকে চেপে ধরা প্রভৃতি কাজের মধ্য দিয়ে মলয়কেতুর ছেলেমানুষি প্রকট হয়ে উঠেছে। অনেক সাধারণ সমস্যারও সমাধান তিনি করতে পারেন না। সহজেই অপরের পরামর্শ নিতে তিনি উৎসুক হন। শত্রুমিত্র চিনতে কিন্তু তিনি একান্তই অপটু। চাণক্যের লোকেরা সহজেই তাঁকে কবলে পেয়ে যায়। উপদেষ্টার মর্যাদা দিয়েও রাক্ষসকে তিনি পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারেননি। পিতৃবন্ধু রাক্ষসকে নির্মম ভাষায় ব্যঙ্গ ও ভর্ৎসনা করতেও তাঁর বাধে না। তাঁর অপরিণামদর্শিতার ফলে পাঁচজন নিরপরাধ রাজাকে নিহত হতে হয়েছে। স্বৈরাচারী এই যুবকের আস্ফালনও অদ্ভুত, পঞ্চম অঙ্কের শেষে রাক্ষসকে তিরস্কার করতে গিয়ে বলেছেন—রাক্ষস, চাণক্য ও চন্দ্রগুপ্ত—এরা তিনজন একসঙ্গে এলেও তিনি তাঁদের পরাজিত করতে পারেন। চাণক্যের পর ভাগুরায়ণ হয়েছে তাঁর পরম আপ্তজন, অথচ পরম শুভানুধ্যায়ী রাক্ষসকে অবিশ্বাস করে দিলেন তাড়িয়ে। রাক্ষস যে তাঁকে ‘অপাত্র’ বলেছেন, তা সর্বাংশে সত্য! নাট্যকার মলয়কেতুকে চন্দ্রগুপ্তের পাল্টা চরিত্র করেছেন ঠিকই, কিন্তু মলয়কেতুর মধ্যে যুদ্ধোন্মাদনা ছাড়া যথার্থ আকর্ষণীয় রাজগুণ বেশি কিছু পরিলক্ষিত হয় না।

গৌণচরিত্র। চন্দনদাস : চন্দনদাস এক গৌণ চরিত্র। বন্ধুবাৎসল্য তাঁর কাছে জীবনের ব্রত। তাঁর পুত্র ঠিকই বলেছে—এ তাঁদের কুলধর্ম। চন্দনদাসের চরিত্রের নির্ভীকতা ও দৃঢ়তা সকলের মনেই গভীর শ্রদ্ধার উদ্রেক করে। প্রথম অঙ্কে সর্বদমন চাণক্যের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের দৃশ্যে চন্দনদাস এক মোহনীয় ব্যক্তিত্ব। স্ত্রী-পুত্রসহ তাঁকে নির্যাতিত হতে হবে—এ কথা শুনে তিনি তৎক্ষণাৎ দৃপ্ত উত্তর দিলেন : ‘আর্য, কিং মে ভয়ং দর্শয়সি?’ অমাত্য রাক্ষসের পরিজন আমার গৃহে থাকলেও আমি আপনার কাছে এনে দিতাম না, নেই, তার আর কথা কি?

চাণক্য জানতে চাইলেন—এই তোমার পাকা কথা?

চন্দনদাস উত্তর করলেন—হ্যাঁ, এটাই আমার পাকা কথা (বাঢ়ম্। এষ মে নিশ্চয়ঃ)। চন্দনদাসের এমন বন্ধুপ্রেম ও চারিত্রিক উৎকর্ষে অন্তরে একান্ত মুগ্ধ চাণক্য স্বগতোক্তি করলেন—‘সাধু চন্দনদাস সাধু’। চাণক্য, সুতরাং, চন্দনদাসকেই রাক্ষস জয়ের অন্যতম প্রধান হাতিয়াররূপে ব্যবহার করলেন। এমন বন্ধু সর্বযুগের মানুষের কাছেই চিরন্তন শ্রদ্ধার পাত্র।

চন্দনদাসের চরিত্রের দৃঢ়তা সপ্তম অঙ্কে রাক্ষসের প্রতি তাঁর তিরস্কারেও পরিস্ফুট হয়েছে। (অমাত্য, সর্বমপীনং প্রয়াসং নিষ্ফলং কুর্বতা ত্বায় কিমমুষ্ঠিতম?) রাক্ষসের চন্দনদাসকেও ‘বিশুদ্ধাত্মা’ বিশেষণ সত্যসত্যই চন্দনদাসের মতো লোকের পক্ষেই প্রযোজ্য। সুকৃতিতে তিনি বৌদ্ধদের কৃতিত্বকেও হার মানিয়েছেন। ‘সর্বনগর-শ্রেষ্ঠী’র পদে বসিয়ে চাণক্য চন্দনদাসকে অবশেষে তাঁর যোগ্য মর্যাদাই দিয়েছেন।

মুদ্রারাক্ষসের অন্য গৌণ চরিত্রগুলোও বেশ চিত্তাকর্ষক সিদ্ধার্থক ও সমিদ্ধার্থক। রাজপুরুষ হয়েও চাণক্যের আজ্ঞা ফেলতে না পেরে বধ্যস্থানের ঘাতকরূপে চণ্ডালের ছদ্মবেশ ধরেছে। যমপটধারী নিপুণক যে কত নিপুণ তা তার রাক্ষসের নাম মুদ্রা প্রাপ্তির ঘটনা থেকেই জানা যায়। শকটদাসের সততা ও সারল্য দর্শকদের মুগ্ধ করে। মলয়কেতুর বিশ্বাসভাজন বন্ধুর বেশে ভাগুরায়ণের চরিত্রও উল্লেখযোগ্য। নিয়োগকর্তা চাণক্যের নির্দেশে মলয়কেতুকে বঞ্চনা করতে গিয়ে তার মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব দেখা যায়। কিন্তু আজ্ঞাবহ ভৃত্যের কাছে অন্তরের সংবেদনশীলতা যে পরিহারের বস্তু, ন্যায়-অন্যায় বিচার যে তার মানায় না—এ সরল সিদ্ধান্তে আসতেও তার দেরি হয়নি। সাপুড়ের ছদ্মবেশে বিরাধগুপ্ত চরিত্রটিও দর্শক-চিত্তে আমোদ এবং আনন্দ সঞ্চার করেছে।

মুদ্রারাক্ষসে সমাজ-চিত্র

মুদ্রারাক্ষস নাটকে জনজীবনের সামগ্রিক পরিচিতি নেই, সমাজের সর্বাংশের প্রতিনিধিত্বমূলক মানুষের অপ্রতুলতা এ নাটকে তো রয়েছেই।

প্রথমেই ধরা যাক্—জাতিভেদের কথা। মৌল জাতিভেদ মুদ্রারাক্ষসের যুগে তো ছিলই, উপরন্তু জাতিবিচারে ব্রাহ্মণাদি চার প্রধান ভেদ ছাড়াও বহু নব্য উপভেদ এসে গেছে। এর সঙ্গে যোগ দিয়েছে কুল-কৌলীন্যের সংস্কার। মহামাত্য ব্রাহ্মণ চাণক্য রাজা চন্দ্রগুপ্তকে ‘বৃষল’ বলে সম্বোধন করতেন। শকটদাসকে চাণক্য সম্বোধন করেছেন ‘কায়স্থ শকটদাস’ বলে, আবার ‘অচল’ নামে এক কায়স্থ কর্মচারীকে তিনি অভিহিত করেছেন ‘কায়স্থ অচল’ বলে। ‘বৃষল’ সম্বোধনের মধ্যে চন্দ্রগুপ্তের প্রতি চাণক্যের যত স্নেহাধিক্যই থাক্, চন্দ্রগুপ্ত, যে চাণক্যের কাছে নিতন্তই বৃষল, সেটা পরিষ্কার বোঝা যায় কঞ্চুকীর উক্তি থেকে—‘তৎ স্থানে খল্বস্য বৃষলো দেবশ্চন্দ্রগুপ্তঃ। নাটকের দ্বিতীয় অঙ্কের ষষ্ঠ ও সপ্ত শ্লোকে রাক্ষস চন্দ্রগুপ্তের নীচ বংশের অমর্যাদাকর উল্লেখ করেছেন। চন্দ্রগুপ্তের রাজলক্ষ্মীকে রাক্ষস ‘বৃষলী’র সঙ্গে উপমিত করেছেন (৬/৬)। চন্দ্রগুপ্তের তথা রাজলক্ষ্মীর আভিজাত্যহীনতার বহু উল্লেখ এ নাটকে রয়েছে। এ থেকে তো এ ধারণাই বদ্ধমূল হয় যে, সমাজের উচ্চস্তরে বুদ্ধিজীবী মানুষের মধ্যে জাতবিচার তথা কুল কৌলীন্য বিচার বেশ পাকাপোক্তভাবেই তার বিষাক্ত শিকড় গেড়েছিল। মূল ব্যাধির সঙ্গে তাই স্বাভাবিকভাবেই আরো বহু উপসর্গের ব্যাপার এসে পড়ে। যেমন, অস্পৃশ্যতা। এ বিষম অভিশাপ বিশাখদত্তের যুগেও প্রচণ্ডভাবেই ছিল। সপ্তম অঙ্কে চাণক্য রাক্ষসকে প্রণাম করতে এলে রাক্ষস সসম্ভ্রমে বলে উঠলেন, “বিষ্ণুগুপ্ত, চণ্ডালের স্পর্শে কলুষিত আমাকে তোমার ছোঁওয়া উচিত নয়” (বিষ্ণুগুপ্ত, ন চাণ্ডালস্পর্শদূষিতং স্পর্ষ্টুমর্হসি।)

কুসংস্কারের পরিচয় পাওয়া গেছে শুভাশুভ বিচারের লৌকিক মানদণ্ডে। যেমন বাম চোখ কেঁপে ওঠা, সাপ দেখা, অর্ধ-নগ্ন মুণ্ডিত মস্তক বীভৎস সন্ন্যাসীদর্শন প্রভৃতিতে শুভ কাজ শুরুর পক্ষে বিঘ্নস্বরূপ মনে করা হত। এ যুগেও হয়। [মৃচ্ছকটিকের যুগেও অনুরূপ কুসংস্কার ছিল, যেমন—কথমভিমুখমনাভ্যুদয়িকং শ্রমণকদর্শনম্—এ কী প্রথমেই অভ্যুদয়ের বিরুদ্ধ লক্ষণসূচক ভিক্ষুর দর্শন! সপ্তম অঙ্ক]। মুদ্রারাক্ষসের চতুর্থ অঙ্কে যুদ্ধযাত্রার সময় নির্ধারণ মনস্থ করে রাক্ষস গণক ডাকতে বলেছিলেন, কিন্তু সন্ন্যাসী দেখে সন্ত্রস্ত হয়ে বলে উঠলেন—‘কথং প্ৰথমমেব ক্ষপণকঃ!’ দ্বিতীয় অঙ্কেও রাক্ষস সাপুড়ের সাপখেলা দেখানোর প্রস্তাবে অশুভ আশঙ্কার প্রকাশ করে বলেছেন, ‘কথং প্রথমমেব সর্পদর্শনম্’! (কী! প্রথমেই সাপ দেখতে হবে!) অশুভ পরিহারের উদ্দেশ্যে সাপের খেলা না দেখেই রাক্ষস পারিতোষিক দিয়ে সাপুড়েকে বিদায় দিতে বললেন।

বিশাখদত্তের যুগে বুদ্ধিজীবী হিশেবে ব্রাহ্মণদের প্রতিষ্ঠাই ছিল সবার উপরে। বেদাদি শাস্ত্রের অধ্যয়ন-অধ্যাপনা, সমাজের নানাবিধ নীতিনির্ধারণ, রাজসভার মন্ত্রণা প্রভৃতি কাজে ব্রাহ্মণরা তখনও অগ্রণী ছিলেন। চাণক্য, বক্রনাশ, রাক্ষস প্রমুখ ব্রাহ্মণ অমাত্যরা যে কোনো যুগের শ্রেষ্ঠ মন্ত্রীদের অন্যতম। নানা শাস্ত্রবিদ্ জ্যোতির্বিজ্ঞানী ইন্দুশর্মা নিঃসন্দেহে সমাজের এক বিশিষ্ট সম্পদ। তবে ব্রাহ্মণদের নিরঙ্কুশ আধিপত্যও একেবারে ছিল না। গুরুতর অপরাধ করলে ব্রাহ্মণকে চরম দণ্ড অর্থাৎ মৃত্যুদণ্ড না দেওয়া হলেও নির্বাসন দেওয়া হত। রাক্ষসের মতো মহামহিমশালী ব্রাহ্মণের প্রতিও মলয়কেতুর অবিশ্বাস চরম দণ্ডের রূপ নিতে যাচ্ছিল, চাণক্যের গূঢ় পুরুষ ভাগুরায়ণের পরামর্শেই কেবল রাক্ষসকে মলয়কেতু প্রাণে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন, অপমানের চূড়ান্ত আঘাত করতে বাকি রাখেননি। ভিক্ষু বা সন্ন্যাসীরাও যদি রাজদ্রোহী বা কপটাচারী বলে প্রমাণিত হত, তবে তারাও দণ্ড থেকে নিষ্কৃতি পেত না! সে দণ্ড ছিল অপমান, লাঞ্ছনা, প্রকাশ্যে অপবাদ রটিয়ে নগর বা রাজ্য থেকে বহিষ্কার প্রভৃতি। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রেও এ ধরনের দণ্ডের নির্দেশ রয়েছে।

সমাজে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও সংস্কৃতির নিবিড় প্রভাব থাকায় বৈশ্য সভ্যতার নগ্নরূপ তখনও আত্মপ্রকাশ করেনি। ক্ষত্রিয়রা তাদের সামাজিক অবস্থান তখনও অপরিবর্তিতই রেখেছিল। যুদ্ধ, দ্যূতক্রীড়া প্রভৃতিতে তাদের পারদর্শিতা অটুট ছিল। কিন্তু রাক্ষসের মতো ব্রাহ্মণ মহাযোদ্ধাও সে সমাজে ছিল। অর্থাৎ তথাকথিত জাতিগত ‘চাতুর্বর্ণ’ ব্যাপারটা পুরোপুরি বজায় ছিল না, গুণ ও ক্রিয়াগত যোগ্যতায় সামাজিক স্তরবিশেষে অনুপ্রবেশের পথ খোলাই ছিল। চন্দনদাস একজন বিরাট বণিক্। এই শ্রেষ্ঠী চন্দনদাস যে বৈশ্য জাতীয়, এ কথা নিশ্চিত বলা যায় না। বাণিজ্য প্রধানত বৈশ্যদের বৃত্তি হলেও, সর্বযুগেই ‘চারুদত্তে’র মতো ব্যতিক্রমও তো কম নেই। মুদ্রারাক্ষসের শ্রেষ্ঠীরা বৈশ্য হলে বুঝতে হবে তাদের সাংস্কৃতিক অবনতি ঘটেছে, কারণ, নাটকে তাদের মুখে সংস্কৃতের পরিবর্তে প্রাকৃত ভাষা শোনা গেছে। নাট্যশাস্ত্রীয় বিধানে বৈশ্যরা ‘অনীচ’, ‘অনীচে’র নাটকীয় ভাষা সংস্কৃত, এ নাটকে এদের প্রাকৃত ভাষণ তবে সামাজিক অধঃপতনের সূচক। গোষ্ঠী বা শ্রেণিগতভাবে বৈশ্যদের এই সামাজিক অবস্থানের সঙ্গে শ্রেষ্ঠী চন্দনদাসকে একাত্ম করে দেখতে কিন্তু মন চায় না।

মুদ্রারাক্ষসে কায়স্থরা সেদিক থেকে বৈশ্যদের তুলনায় কিছুটা বেশি মর্যাদা পেয়েছে। বৃত্তিগতভাবে কায়স্থদের প্রধানত কলমচিরূপেই এ নাটকে দেখা গেছে। কায়স্থ শকটদাসের সুন্দর হস্তাক্ষরের প্রশংসা স্বয়ং চাণক্যই করেছেন—অহো দর্শনীয়ান্যক্ষরাণি (আহা! দেখবার মতো হস্তাক্ষর!)। মুহুরিগিরি ছাড়াও দলিল-দস্তাবেজ ও ফাইলপত্রের সংরক্ষক হিশেবে কায়স্থরা সে যুগেও প্রশাসনের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে পড়েছিল। শকটদাস যখন অমাত্য রাক্ষসের আশ্রয়ে গেছে, তখনও দেখি, রাক্ষস তাকে নিজের ‘একান্ত সচিবের দায়িত্ব দিয়েছেন। ঘটনাচক্রে ফিরে-পাওয়া স্বনামাঙ্কিত মুদ্রাটিও তিনি শকটদাসের হেফাজতে দিয়ে বলেছেন—‘সখে শকটদাস, অনয়ৈব মুদ্রয়া স্বাধিকারে ব্যবহত্তব্যাং ভবতা’। (সখা শকটদাস, তোমার ওপর অর্পিত কার্যক্ষেত্রে এ মুদ্রা তুমি ব্যবহার করবে।) অনুরূপ ‘অচল’ নামধারী কায়স্থকে দেখি চাণক্যের ফাইল-রক্ষক রূপে। তৃতীয় অঙ্কে চাণক্য প্রতীহারী শোণোত্তরার মাধ্যমে নির্দেশ দিয়েছেন—কায়স্থ অচল যেন ভদ্রভট প্রভৃতি বিরক্ত রাজপুরুষদের সম্পর্কে প্রস্তুত ফাইলটি চাণক্যের কাছে পাঠিয়ে দেয়। প্রশাসনিক কাজকর্মের সাথে একান্তভাবে যুক্ত থাকার দরুনই হয়তো কায়স্থরা বৈশ্যদের অপেক্ষায় সমাজে বেশি মর্যাদা পেয়েছে। ষষ্ঠ অঙ্কের শেষাংশে রাক্ষসকে (জীর্ণোদ্যানে উদ্বন্ধনে আত্মহত্যার উদ্দেশ্যে আগত) পুরুষ বধ্যস্থানে ভূতপূর্ব ঘটনার কথা বলতে গিয়ে কায়স্থ শকটদাসের নামের পূর্বে সম্ভ্রমসূচক ‘আর্য’ শব্দের উচ্চারণ করলেও শ্রেষ্ঠী চন্দনদাসের নামোচ্চারণের বেলায় তদ্রূপ কোনো বিশেষণাত্মক শব্দের প্রয়োগ করেনি। কায়স্থরা এ নাটকে সংস্কৃতভাষী, এটাও তাদের মর্যাদার পরিচায়ক।

লিপিকর বা ফাইলরক্ষক হিশেবে প্রশাসনের কাজে অপরিহার্য হলেও শৌর্য, উদ্ভাবনী মেধা বা তেজস্বিতার কোনো উজ্জ্বল ভাবমূর্তি সম্ভবত কায়স্থরা গড়ে তুলতে পারেনি। সে জন্যেই হয়তো চাণক্য অত সহজে বলতে পেরেছেন—‘কায়স্থ ইতি লম্বী মাত্রা’ (কায়স্থ তো সামান্য ব্যাপার)।

প্রায় নারীচরিত্রবর্জিত এ নাটকে নারীদের সম্পর্কে কিছু কিছু উল্লেখে তদানীন্তন সমাজে নারীদের কী দৃষ্টিতে দেখা হত তার কিছু কিছু আভাস পাওয়া যায়। যেমন দ্বিতীয় অঙ্কে রাক্ষসের সংলাপ থেকে এ ধারণা জন্মায় যে নারীদের মন পুরুষদের গুণবিচারে বিমুখ (২/৭)। রাজভৃত্যের যোগ্যতা-নিরূপণ করতে গিয়ে চাণক্য বলেছেন বুদ্ধি, বিক্রম এবং ভক্তি এই তিনের যুগপৎ সমন্বয় যাদের মধ্যে ঘটে, তারাই রাজার সমৃদ্ধির সহায় হয়, অন্যান্য ভৃত্যেরা কি সম্পদে, কি বিপদে রাজার পোষ্য নারীদের মতোই গণ্য। (১/১৫) এ থেকে সহজেই মনে হয়, সমাজের কোনো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব নারীদের ওপর ন্যস্ত করা হত না। তবে সে যুগেও নারীরা কেবলই অন্তঃপুরচারিণী ছিল না। স্বামীদের সঙ্গে উৎসবাদি উপলক্ষে তারা পথে তথা প্রকাশ্য জনসমাবেশেও বেরুত। (৩/১০)

যুদ্ধবিগ্রহে তথা কূটনীতির ক্ষেত্রে চিরাচরিত সামাজিক রীতিনীতির বহু বিপর্যয় ঘটত, প্রতিষ্ঠিত মানবিক মূল্যবোধ হত বিসর্জিত, শিক্ষা-দীক্ষা রুচি-কৃষ্টি সব সমর্পিত হত বাঞ্ছিত রাজা বা রাজন্যের অভ্যুদয়ের স্বার্থে। অতএব রাজনৈতিক উদ্দেশ্য-সিদ্ধির জন্য অনুপানে বর্ধিত একান্ত অনুগত ভৃত্যও প্রভুর বিরুদ্ধাচারণ করত, যেমন—পঞ্চম অঙ্কে ভাগুরায়ণ অন্তর্দ্বন্দ্বে ক্লিষ্ট হয়ে স্বগতোক্তি করেছেন—‘কী কষ্ট! আমাকে কুমার মলয়কেতু এত স্নেহ করেন, অথচ তাঁকেও ঠকাতে হবে।’ পরে অবশ্য ভাগুরায়ণ কর্তব্য পালনের পক্ষে যুক্তি খাড়া করেছে যে পরোপজীবীর আজ্ঞা পালন করাটাই কাজ, তার হিতাহিত বিচার নয়। ষষ্ঠ অঙ্কের প্রবেশকেও সমিদ্ধার্থকের মুখে অনুশোচনা ধ্বনিত হয়েছে, চন্দনদাসের হত্যার জন্য নৃশংস ঘাতকের কাজ করার আর কি লোক ছিল না? উত্তরে সিদ্ধার্থক জানায় যে—আর্য চাণক্যের আজ্ঞার বিরোধিতা করে বেঁচে থাকা তো সম্ভব নয়। এমনিভাবে দেখি—কূটনীতির ওই যুযুধান পরিবেশেও সব মানুষ অমানুষ হয়ে যায়নি।

রাজনীতি বা কূটনীতি যেখানে নেই, সেখানে ‘কুটিলমতি’ চাণক্যও অনেক সরল, সহৃদয়। শিষ্যকে কাজের তাড়া দিতে তাই তাঁর কণ্ঠে সহাভূতির স্বর প্রকাশ পায়—কাজের ব্যতিব্যস্ততাই তাঁকে ব্যাকুল করে তোলে, কিন্তু শিষ্যজনের প্রতি এটা তাঁর সহজাত অসৌজন্য নয়। এমনিভাবে মুদ্রারাক্ষসের দর্পণেও আমরা খণ্ডিত বা বিচ্ছিন্নভাবে হলেও চিরন্তন মনুষ্য-সমাজের চিত্র প্রতিবিম্বিত দেখি।

বঞ্চনা, বিশ্বাসঘাতকতা, জিঘাংসা সমাজকে ক্ষতবিক্ষত করেছে ঠিকই, কিন্তু রাজনীতির অতিকুটিল শর্তপূরণের জন্যেই এসব ঘটেছে, ব্যক্তিগত স্বার্থে এদের কোনো ভূমিকা ছিল না। কূটনীতির কুটিলতা সমাজের সবাইকে কলুষিত করতে কোনো যুগেই পারে না, সে যুগেও পারেনি। মুদ্রারাক্ষসে বিধৃত গোটা সমাজটাই চাণক্যের চাল অনুসারে চলেনি। ত্যাগ, তিতিক্ষা, প্রভুভক্তি, বন্ধুবাৎসল্য, দাম্পত্য অনুরাগ, কুলধর্মের অনুসরণ প্রভৃতি বহু মানবিক মূল্যবোধের সামনে চাণক্য বহুবার শ্রদ্ধানত হয়েছেন। রাজনৈতিক সংগ্রামের শেষে স্বয়ং চাণক্যকেই দেখি—

চিরন্তন বিবিক্ত ব্রাহ্মণ সর্বদায়িত্ব থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে তপোবনবাসের জন্য উদগ্রীব হয়ে রয়েছেন।

তাই বলতে হয়—রণাঙ্গনে সাধারণ সমাজের ছবি ফুটে উঠতে পারে না। সমগ্র সমাজ নীতিবর্জিত—এমন কথা বললে তাই মুদ্রারাক্ষসের প্রতি অবিচার করা হবে।

অর্থশাস্ত্র ও মুদ্রারাক্ষস

মুদ্রারাক্ষস নাটকটির প্রায় সারা অঙ্গেই ছড়ানো রয়েছে বহু লক্ষণ যাতে করে তাকেও শাস্ত্রকাব্য জাতীয় রচনার পক্তিভুক্ত করা যায়। রত্নাবলীর রীতিতে নাট্যতত্ত্বের বিধিবিধানের পরিবর্তে এ নাটকে স্থান পেয়েছে চাণক্যের নীতি। এ নীতি এখানে রাজনীতি—কেন্দ্রে যার কূটনীতি। উপজীব্য কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র। মুদ্রারাক্ষসের পাতায় পাতায় কৌটিল্যের নিবিড় পদসঞ্চার; কণ্ঠ তাঁর কখনও মৃদুভাষ, কখনও সোচ্চার।

অর্থশাস্ত্রে সুপণ্ডিত বিশাখদত্ত অর্থশাস্ত্রের বিধি-নিষেধই শুধু নয়, বহু পরিভাষাও হুবহু তাঁর নাটকে নিয়ে এসেছেন। এ কথা বললে বোধহয় খুব অত্যুক্তি হবে না যে অর্থশাস্ত্রের কৌটিল্যই যেন স্বয়ং মুদ্রারাক্ষসে চাণক্যের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন।

কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্র সম্পর্কে মনীষীদের মধ্যে একটি বিতর্কিত প্রশ্ন শোনা যায় : অর্থশাস্ত্রে বর্ণিত বিষয়গুলো কি কোনো ঐতিহাসিক রাজ্যে প্রচলিত শাসন-প্রণালীর চিত্র বলে গৃহীত হতে পারে, অথবা সেগুলোকে কাল-নিরপেক্ষ একটি আদর্শ শাসন পদ্ধতির খসড়া বলে ধরা যেতে পারে?

এ প্রশ্নের সম্ভাব্য উত্তর যাই হোক্, অর্থশাস্ত্রে বর্ণিত বিষয়গুলো নিয়ে যে সুধীজনগ্রাহ্য উপাদেয় নাটক লেখা যেতে পারে, এটা বিশাখদত্ত প্রশ্নাতীতভাবে প্ৰমাণ করেছেন তাঁর অপূর্ব সৃষ্টি মুদ্রারাক্ষস রচনা করে।

অতঃপর পূর্বোক্ত প্রশ্নটির সদুত্তর দিতে গিয়ে অর্থশাস্ত্র-বিশেষজ্ঞ ড. রাধাগোবিন্দ বসাক যে মত ব্যক্ত করেছেন তা এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। তাঁর মতে, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সচিবায়ও সাম্রাজ্যে রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজনীতির যে প্রচলিত অবস্থা মহামন্ত্ৰী হিশেবে কৌটিল্য লক্ষ করেছিলেন, তারই প্রতিফলন ঘটেছে তাঁর অর্থশাস্ত্রে এবং সার্বভৌম সম্রাট্ হতে হলে যে-কোনো বিজিগীষু রাজার পক্ষে যে রূপ আদর্শ শাসন-প্রণালী ও ব্যবহার-পদ্ধতির প্রচলন করা আবশ্যক, সেসব বিষয়ও যথেষ্ট বিচার-বিশ্লেষণসহ অর্থশাস্ত্রে উপস্থিত হয়েছে।

মুদ্রারাক্ষস তাই নাটক হয়েও বহুক্ষেত্রে অর্থশাস্ত্রের নিপুণ প্রায়োগিক দৃষ্টান্তের এক অসাধারণ সংগ্রহশালা। তবে এটাও এক্ষেত্রে লক্ষণীয় যে নাট্যকার বিশাখদত্তের অসামান্য প্রতিভার রসায়নে এ সব ‘আহরণ’ মুদ্রারাক্ষসে একান্তভাবে ‘স্বীয়করণে’ পরিণত হয়েছে। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অর্থশাস্ত্রের অনুগত হয়েও মুদ্রারাক্ষস তাই আগাগোড়া ‘নাটকীয়’, রসোত্তীর্ণ অভিনব নাট্যসৃষ্টি রূপেই তার চিরপ্রতিষ্ঠা।

এ নাটকের বিশেষত্ব

বহু দিক থেকে মুদ্রারাক্ষস নাটক সংস্কৃত সাহিত্যে এক অদ্বিতীয় মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত। এ নাটকের প্লট্ নাট্যকারের সম্পূর্ণ আবিষ্কার নয়, কিন্তু সাধারণত নাট্যকাররা যেসব উৎস বা আকার থেকে তাঁদের প্লট্ আহরণ করেন, এ নাটকের ক্ষেত্রে নাট্যকার সেই চিরাচরিত প্রথার ব্যতিক্রমই ঘটিয়াছেন। প্লট্ পরিকল্পনায় এবং বিষয়বস্তুর উপস্থাপনায়ও এ নাটক এক নতুন দিগন্তের দিশারী।

এ নাটকে কোনো প্রণয়কাহিনী নেই। প্রণয় মুদ্রারাক্ষস থেকে নির্বাসিত—এটুকু বলাই যথেষ্ট নয়। সাধারণ নাট্যধারা থেকে এভাবে সরে এলেও কিন্তু মুদ্রারাক্ষসের আকর্ষণ প্রণয়ধর্মী নাটকের আকর্ষণকেও হার মানায়। এ নাটকে পুরোপুরি রাজনৈতিক, যা সংস্কৃত সাহিত্যে দ্বিতীয় আর নেই। স্ত্রী-চরিত্র এ নাটকে নেই বললেই হয়। যা রয়েছে তা হল বধ্যভূমিতে শ্রেষ্ঠী চন্দনদাসের অনুসরণরতা শোকার্তা সহধর্মিণী। নাটকের মুখ্য বা সহকারী কোনো বৃত্তান্তেই এঁর কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেই। চন্দনদাসের পত্নীর মধ্যে এখানে কোনো কমনীয়তা বা কারুণ্য প্রকট হয়নি, যেটা হয়েছে তা হল কঠোর কর্তব্যনিষ্ঠা ও ত্যাগ-তিতিক্ষার দৃঢ়তা। অতএব এ নাটকে স্নিগ্ধ লালিত্যের কোনো অবকাশ নেই, নেই প্রেমমুগ্ধ গীতিময়তা। পাছে কোনো চটুলতা বা ভাঁড়ামির লঘুতা মুখ্য বস্তুর পরিবেশনাকে ব্যাহত করে, সেই আশঙ্কাতেই সম্ভবত এ নাটকে কোনো ‘বিদূষক’ চরিত্রও নেই। সুতরাং শুরু থেকে শেষ অবধি এ নাটকের সুর সর্বদা উচ্চগ্রামে বাঁধা, পৌরুষদীপ্ত ওজস্বী নিত্য-অতন্দ্ৰ এক প্রাণময় বেগবত্তা এ নাটকের বড় আকর্ষণ। রাক্ষসের হৃদয়-ধর্মের গভীরতা এবং চাণক্যের বুদ্ধিবৃত্তির প্রাখর্য—এ দুইয়ের সতত দ্বন্দ্বে এ নাটক সংস্কৃত সাহিত্যে এক ভিন্ন স্বাদের অভিজ্ঞতা এনে দিয়েছে।

অন্যান্য বীররসাশ্রয়ী নাটকের তুলনায় এ নাটকের স্বাতন্ত্র্য সুস্পষ্ট। ভাসের প্রতিজ্ঞা-যৌগন্ধরায়ণে প্রতিশোধ নেবার দৃঢ় সংকল্প, মন্ত্রীর কূটমন্ত্রণা প্রভৃতি রাজনৈতিক বিষয় কিছু কিছু থাকলেও মুদ্রারাক্ষসের মতো সংহত প্রণালীপরম্পরা ও ওজস্বিতা সেখানে দুর্লভ। ভট্টনারায়ণের বেণীসংহার নাটকেও প্রতিহিংসা এবং যুদ্ধবিগ্রহের ব্যাপার থাকলেও মুদ্রারাক্ষসের সঙ্গে তার তুলনা হয় না। কারণ, নানা ঘটনার সন্নিবেশে মূল বস্তু সেখানে বিব্রত। যুদ্ধ যখন আসন্ন, তখনও বেণীসংহারে দুর্যোধন-ভানুমতীর প্রেমের প্রসঙ্গ পরিত্যক্ত হয়নি। বেণীসংহারে সমরাঙ্গণের ভয়ঙ্করতা অসির ঝনৎকার, প্রতিদ্বন্দ্বীর অসফল আস্ফালন, অশ্বের হ্রেষা প্ৰভৃতি যতই রণস্থলের এক পূর্ণাঙ্গচিত্র পরিবেশনের চেষ্টা করুক না কেন, নাটিকাটি বহু ক্ষেত্রেই হয়ে পড়েছে অনাটকীয়, রণস্থলের ভয়ালতা কখনও কখনও রঙ্গস্থলোচিত লঘুতায় পর্যবসিত হয়েছে। অথচ মুদ্রারাক্ষসও তো বীররসের নাটক, কিন্তু সে বীরত্ব কেবল অসির আস্ফালনে বা প্রতিস্পর্ধী যোদ্ধার দুরন্ত যুদ্ধোদ্যমের মধ্যে আবদ্ধ থাকেনি। সৈনিকের শানিত অস্ত্রে যুদ্ধ এখানে বেশি বড় কথা নয়, চাণক্য এবং রাক্ষসের বুদ্ধি এবং কূটনীতির অভূতপূর্ব যুদ্ধের এ এক নতুন কুরুক্ষেত্র। উভয়পক্ষই যে যার মেধা, অভিজ্ঞতা, নীতি ও কৌশলের যুদ্ধে দর্শককে করেছে চমকিত। চন্দ্রগুপ্ত ঠিকই বলেছেন যে যুদ্ধ না করেও আর্য দুর্জয় শত্রুসেনাকে নিদারুণ পরাস্ত করেছেন (“বিনৈব যুদ্ধাদার্যেণ জিতং দুর্জয়ং পরবলমিতি লজ্জিত এবাস্মি”—সপ্তম অঙ্ক)।

এই নাটকে আমরা দেখি শৌর্যের প্রশংসা, পুরুষকারের জয়! চাণক্য রাক্ষসকে তাঁর গুণের জন্যে, তাঁর মানবতার জন্যে প্রশংসা করেন, তাঁকেই চান তাঁর পরমপ্রিয় চন্দ্রগুপ্তের প্রধানমন্ত্রীরূপে। রাক্ষসের শৌর্য এক বিস্ময়ের ব্যাপার ছিল নন্দরাজার কাছে—এ বার্তাও আমরা পেয়েছি। কিন্তু বারবার বিঘ্নোপহত রাক্ষস দৈবের দোহাইও কম দেননি। অথচ, চাণক্য কখনও দৈবের ধারে কাছে যাননি। এ নাটকে চাণক্যের দৈবনির্ভরতার কোনো সাক্ষ্য নেই। মানুষের বুদ্ধি, পরিকল্পনা এবং পদ্ধতিগত পারিপাট্য—এই তিনের সমন্বিত প্রয়োগে এ নাটকের শত্রুজয়ের চরম উদ্দেশ্য সু-সাধিত হয়েছে। যেখানে কূটনীতির এমন বৈজ্ঞানিক প্রয়োগ সবাইকে স্তব্ধ করে, সেখানে ‘অতি-প্রাকৃত’ কোনো কিছুর উপস্থিতি নাটকের সকল গৌরবকে মুহূর্তে নস্যাৎ করে দিত, তাই মুদ্রারাক্ষস নাটকে ‘অতি-প্রাকৃত’ (Supernatural) কোনো উপাদান আদৌ গৃহীত হয়নি।

পাশ্চাত্য নাট্য-সমালোচকগণ দুখানি মাত্র সংস্কৃত নাটকের মঞ্চাবতরণের পক্ষে উপযোগী বলে স্বীকার করেছেন, একটি মুদ্রারাক্ষস, অপরটি মৃচ্ছকটিক।

কথা-সার

প্রস্তাবনার পর মঞ্চে এলেন কুপিত চাণক্য। তাঁর নিজের কথাতেই জানা গেল তাঁর কর্মকাণ্ডের কতটা এখনও অসমাপ্ত। নন্দবংশের উচ্ছেদ করেই তিনি থামেননি, পাছে ওই বংশের সংশ্লিষ্ট কোনো ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে রাক্ষস তৎপর হয়ে ওঠেন তাঁর প্রভুভক্তির পরাকাষ্ঠা দেখাতে, তাই বৃদ্ধ বেচারী সিদ্ধার্থসিদ্ধিকে পর্যন্ত চাণক্য নিষ্কৃতি দেননি। তপোবনে গেলেও তাকে সেখানেই শেষ করেছেন। কিন্তু রাক্ষস তাতেও দমেননি। পর্বতক-পুত্র মলয়কেতুকে ধরেই তিনি রাজধানী কুসুমপুর আক্রমণের তোড়জোড় করছেন। অথচ চাণক্যের সংকল্প হল যুগপৎ বীরত্ব, বিচক্ষণতা ও আনুগত্যের বিরল দৃষ্টান্ত এই রাক্ষসকে যেনতেন প্রকারেণ করে চন্দ্রগুপ্তের মুখ্যামাত্যের পদ গ্রহণে তাঁকে সম্মত করানো। সুতরাং সব দিক সামলে চলায় সব ব্যবস্থাই চাণক্য পাকা করে ফেলেছেন। সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে তাঁর চরেরা। খবর চাই—রাক্ষস কোথায় কী করছেন, কারা তাঁর সহযোগী, কারা চন্দ্রগুপ্তের রাজ্যপ্রাপ্তিতে বিরূপ, ইত্যাদি। এদিকে রাজা চন্দ্রগুপ্তের একান্ত পার্শ্বচর হিশেবে তাদেরই রাখা হয়েছে যাদের আনুগত্য ও তৎপরতা সন্দেহাতীত।

কুসুমপুরের মণিকার শ্রেষ্ঠ চন্দনদাস। এই চন্দনদাসের বাড়িতেই পরিজনদের রেখে রাক্ষস নগর ত্যাগ করেছেন। এ সংবাদের সত্যতার প্রমাণ স্বরূপ নিপুণক চাণক্যকে রাক্ষসের নাম মুদ্রাঙ্কিত অঙ্গুরীয়ক দিল। অঙ্গুরীয়কটি সে পেয়েছিল চন্দনদাসের বাড়ির দোরগোড়ায়। আংটিটি পেয়ে চাণক্য যেন হাতে স্বর্গ পেলেন। উদ্দেশ্য সিদ্ধির চাবিকাঠি তাঁর হাতে, রাক্ষসের ঘনিষ্ঠ সুহৃদ শকটদাসকে দিয়ে শিরোনাম ও স্বাক্ষরহীন পত্রে নিজের মনোমতো কথা লিখিয়ে নেবার ব্যবস্থা করলেন তিনি। সারল্যের শিকার হয়ে শকটদাস তার সুন্দর হস্তাক্ষরে লিখে দিলেন সেই পত্র। সেই পত্রে চাণক্য সদ্যঃপ্রাপ্ত রাক্ষসের সেই নাম-মুদ্রার ছাপ দিতে কার্পণ্য করলেন না। পত্রলিখনপর্ব সমাধা হবার আগে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটল। পর্বতেশ্বরের মাসিক শ্রাদ্ধে তাঁর ব্যবহৃত অলঙ্কার ব্রাহ্মণদেরকে দান করার জন্যে চন্দ্রগুপ্ত চাণক্যের অনুমতি চেয়ে পাঠালে চাণক্য তাঁর পছন্দমতো তিনজন ব্রাহ্মণকে সেই দান গ্রহণের জন্যে পাঠালেন এবং নির্দেশ রইল যে অলঙ্কারসহ সেই তিন ব্রাহ্মণ শ্রাদ্ধ-বাড়ি থেকে সোজা চাণক্যের কাছে চলে যাবে। এবারে চাণক্য রাক্ষসের নামমুদ্রার ছাপ-দেওয়া সেই পত্র এবং আংটিটি তাঁর এক চর সিদ্ধার্থকের হাতে দিয়ে তাকে নির্দেশ দিলেন যে শকটদাসকে বধ্যস্থান থেকে উদ্ধার করে পালিয়ে গিয়ে সে রাক্ষসের কাছে তাঁকে পৌঁছিয়ে দেবে। রাক্ষস প্রতিদানে যা দেবেন তা সে নেবে তো বটেই, উপরন্তু তাকে কিছুকাল রাক্ষসের সেবা করতে হবে। এরপর রাক্ষসের অভিযানের সময় সিদ্ধার্থককে আর কী-কী করতে হবে,—সে কথা চাণক্য তার কানে কানে বলে দিলেন। সিদ্ধার্থক বেরিয়ে পড়ল তার কাজে।

এরপর বিষকন্যা-প্রয়োগে পর্বতকের প্রাণনাশের অভিযোগে সন্ন্যাসী জীবসিদ্ধিকে নির্যাতিত করে নগর থেকে বহিষ্কারের আদেশ দেওয়া হল। চাণক্যের ওপর দৈহিক আক্রমণের চেষ্টায় উঠে-পড়ে লেগেছেন—তাই অছিলায় শকটদাসকে শূলে চড়াবার আদেশ দেওয়া হল। অতঃপর স্মরণ করলেন চাণক্য মণিকার চন্দনদাসকে। ভয়ে ভয়ে চাণক্যের কাছে এলেন নগরের শ্রেষ্ঠ মণিকার। প্রাথমিক সম্ভাষণের পর সৌজন্যের মুখোশ খুলে গেল চাণক্যের, রাক্ষসের পরিজনদের সমর্পণ করতে বললেন তিনি। চন্দনদাস প্রথমে অস্বীকার করলেও পরে তাঁকে চাণক্যের জেরায় পড়ে স্বীকার করতে হল যে রাক্ষসের পরিজন তাঁর গৃহে ছিল; কিন্তু সম্প্রতি তারা কোথায়—সে খবর তাঁর জানা নেই। চাণক্য সে তথ্য উদ্ঘাটনের জন্যে নানাভাবে নৃশংস উত্পীড়নের ভয় দেখালেও চন্দনদাস জানালেন যে, যে কোনো অবস্থার জন্যেই তিনি প্রস্তুত। সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে স্ত্রী-পুত্র-সহ শ্রেষ্ঠীকে কারাগারে রুদ্ধ করবার আদেশ দিলেন চাণক্য। অথচ চন্দনদাসের এই দুর্লভ বন্ধুপ্রীতি দেখে চাণক্য অন্তরে আশ্বস্ত হলেন যে, এই প্রীতির বন্ধনই প্রয়োজনে রাক্ষসকেও বেঁধে আনবে তাঁর কাছে। এরপর জানা গেল যে চন্দ্রগুপ্তের প্রধান প্রধান কয়েকজন রাজকর্মচারী তাঁর প্রতি বিরক্ত হয়ে তাঁকে ছেড়ে চলে গেছে। [প্ৰথম অঙ্ক]

নন্দবংশের বিনাশে রাক্ষস শোকাভিভূত হলেও প্রতিশোধের তৎপরতায় তাঁর কোনো ছেদ নেই। মিলিত হয়েছেন তিনি পার্বত্যরাজ পর্বতকের পুত্র মলয়কেতুর সঙ্গে—যাঁর অন্তরে পিতৃহন্তার প্রতি বিদ্বেষের অনল অনির্বাণ জ্বলছে। নন্দের বিপক্ষে চন্দ্রগুপ্তের সঙ্গে একজোট হয়ে লড়েছিলেন পর্বতক। চাণক্য প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন—বিজিত রাজ্যের অর্ধাংশ তাঁকে দেবেন। কিন্তু অর্ধরাজ্যের দাবিদারকে চাণক্য তো বাঁচিয়ে রাখতে পারেন না। পথের কাঁটা সরাতে তাঁর দেরি হয়নি খুব। বিষকন্যা দিয়েই চাণক্য পর্বতককে নিহত করলেন। অতএব প্রতিশোধের স্পৃহাই হল দুজনের মেলবন্ধন; রাক্ষস আর মলয়কেতু যৌথপ্রয়াসে চাণক্য ও চন্দ্রগুপ্তের শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হবার প্রস্তুতি চালাতে লাগলেন নানাভাবে নানা দিক থেকে। মলয়কেতুর শিবিরেই এখন তাই রাক্ষসের অবস্থান।

মলয়কেতুর অনুরোধ নিয়ে কঞ্চুকী জাজলি এসেছে রাক্ষসের কাছে। মলয়কেতু নিজের দেহ থেকে কিছু অলঙ্কার খুলে পাঠিয়েছেন অমাত্য রাক্ষসের নিরলঙ্কার দেহের অলঙ্করণের জন্যে! রাক্ষস কেমন করে সেগুলো তাঁর পরাজয়ের প্লানিমাখা অঙ্গে ধারণ করবেন? কঞ্চুকীর সনির্বন্ধ অনুরোধে রাক্ষস অবশ্য শেষ পর্যন্ত মলয়কেতুর প্রেরিত অলঙ্কার অঙ্গে ধারণ করলেন! ইতিমধ্যে সাপুড়ের ছদ্মবেশে বিরাধগুপ্ত নামে রাক্ষসের এক চর এসে কুসুমপুরের বৃত্তান্ত সবিস্তারে রাক্ষসকে জানাল। রাক্ষস শুনলেন কেমন করে একে একে তাঁর সমস্ত চক্রান্তই চাণক্যের কূটবুদ্ধির কাছে পরাস্ত হয়েছে। বিরাধগুপ্তের মর্মস্পর্শী বিবরণে রাক্ষস শুনতে থাকেন—চন্দ্রগুপ্ত ও পর্বতেশ্বরের মিলিত সমরশক্তির প্রচণ্ড আক্রমণে কুসুমপুরের প্রতিরক্ষার বাঁধ কীভাবে ভেঙে পড়ল, নগর হল অবরুদ্ধ, দিনের-পর-দিন চলল সে অবরোধ। পুরবাসীদের কষ্ট আর সইতে পারলেন না নন্দবংশীয় রাজা সর্বার্থসিদ্ধি। সুড়ঙ্গপথে নগর ছেড়ে চলে গেলেন তিনি তপোবনে। নগর এল মৌর্যের অধিকারে। চন্দ্রগুপ্ত রাজপুরীতে প্রবেশ করবেন, চাণক্য উপযুক্ত শোভাযাত্রার ব্যবস্থা করলেন।

সিদ্ধার্থক পেল রাক্ষসের কাছে কাজের সুযোগ। সাপুড়ের বেশধারী সেই চর রাক্ষসকে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ দিল যে, চন্দ্রগুপ্ত ও চাণক্যের মধ্যে কর্তৃত্বের দ্বন্দ্ব মাথাচাড়া দিয়েছে। রাক্ষস তাকে নির্দেশ দিলেন কুসুমপুরে ফিরে গিয়ে রাক্ষসের চর দুই বৈতালিককে বলতে যে তারা যেন সুযোগমতো চন্দ্রগুপ্ত ও চাণক্যের এই বিবাদকে তাদের স্তুতিবন্দনার মাধ্যমে আরও বাড়িয়ে তোলে। ইত্যবসরে আরও একটি ব্যাপার ঘটল। সুন্দর গড়নের তিনখানি মূল্যবান অলঙ্কার বিক্রয়ের জন্যে এক ব্যক্তি রাক্ষসের দ্বারস্থ হলে তিনি অলঙ্কার তিনটি দেখে মুগ্ধ হয়ে ওগুলো কিনে রাখতে বললেন শকটদাসকে। অতঃপর চন্দ্রগুপ্ত ও চাণক্যের মধ্যে বিভেদ কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় সে খবর নেবার জন্যে তাঁর চর অমাত্য করভককে কুসুমপুরে পাঠালেন। [দ্বিতীয় অঙ্ক]

কুসুমপুরে দেখা গেল চাণক্য চন্দ্রগুপ্তের বিরুদ্ধাচরণ করছেন। (আসলে শত্রুপক্ষকে বিভ্রান্ত করার জন্যে চাণক্য চন্দ্রগুপ্তের সঙ্গে কপট কলহে লিপ্ত হয়েছেন)। সুগাঙ্গপ্রাসাদে আরোহণ করে রাজা চন্দ্রগুপ্ত পূর্ণিমায় শরতের অপূর্ব শোভা নিরীক্ষণ করছিলেন। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে তিনি লক্ষ করলেন যে, তাঁর আদেশ সত্ত্বেও রাজধানী কুসুমপুরে কৌমুদী-মহোৎসব উদযাপনের কোনো লক্ষণ নেই। কঞ্চুকী বৈহীনরিকে জিগ্যেস করে চন্দ্রগুপ্ত জানলেন যে, কৌমুদী-মহোৎসব নিষিদ্ধ করেছেন স্বয়ং চাণক্য; অতএব প্রজারা চন্দ্রগুপ্তের আজ্ঞা লঙ্ঘন করেছে—বলা যায় না, আজ্ঞা লঙ্ঘন করেছেন চাণক্য। চন্দ্রগুপ্ত ডেকে পাঠালেন চাণক্যকে। এলেন চাণক্য। শুরু হল দুজনের মধ্যে বাদ-প্রতিবাদ। কোনো মতেই চাণক্য কৌমুদী-মহোৎসব নিষেধের প্রয়োজন চন্দ্রগুপ্তকে বলবেন না। তাঁর বক্তব্য—চন্দ্রগুপ্তের সিদ্ধি মন্ত্রীর ওপর নির্ভরশীল, তাই চন্দ্রগুপ্তের তিনিই যেখানে প্রধানমন্ত্রী প্রয়োজনের ব্যাপারটা তাঁরই জ্ঞাতব্য। চন্দ্রগুপ্তের তা শোনা অনাবশ্যক।

চাণক্যের এই উদ্ধত বাক্য শুনে ক্রোধে মুখ ফিরিয়ে নিলেন চন্দ্রগুপ্ত। সুযোগ বুঝে রাক্ষসের চর দুই বৈতালিক জুড়ে দিল চন্দ্রগুপ্তের স্তুতিগান, যার মর্মার্থ হল যথার্থ প্রভুর আজ্ঞা অলঙ্ঘনীয়। বৈতালিক দুজনকে লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা পারিতোষিক দিতে বললেন চন্দ্রগুপ্ত। অকারণে এত অর্থব্যয়ে বাধা দিলেন চাণক্য; রাজার প্রভুত্বে এ এক প্রচণ্ড আঘাত! প্রতিক্রিয়াও হল তেমনি। চাণক্যের মুখের ওপর বললেন তিনি—তাঁর ইচ্ছামতোই তিনি চলবেন। চাণক্যও বললেন—তথাস্তু। কিন্তু তবুও চন্দ্রগুপ্ত তাঁকে ছেড়ে কথা কইলেন না। একের-পর-এক অভিযোগে তাঁকে ব্যতিব্যস্ত করে তুললেন। বিবাদ যখন তুঙ্গে, তখন কথাপ্রসঙ্গে চন্দ্রগুপ্ত মুক্তকণ্ঠে রাক্ষসেরই গুণগান করতে লাগলেন। এতবড় অপমান চাণক্যের সইল না। বেশি যোগ্য রাক্ষসকেই তবে চন্দ্রগুপ্তের জায়গায় বসান—নিক্ষিপ্ত হল এই নিষ্ঠুর মন্তব্য। মন্ত্রিত্ব ত্যাগ করলেন চাণক্য। প্রচারিত হল রাজঘোষণা—এখন থেকে মৌর্য নিজেই তাঁর রাজ্য পরিচালনা করবেন। [তৃতীয় অঙ্ক]

মলয়কেতুর শিবিরে চাণক্যের গুপ্তচররা নানা ফন্দিফিকিরে রাক্ষসের বিরুদ্ধে তাঁর মনে বিষোদ্গারের চেষ্টায় তৎপর। এমনি এক ধুরন্ধর গুপ্তচর ভাগুরায়ণকে সঙ্গে নিয়ে কুমার মলয়কেতু চলেছেন অমাত্য রাক্ষসকে দেখতে। রাক্ষস অসুস্থ। মলয়কেতু আর সব অনুগামীদের পথেই থামিয়ে দিয়েছেন। যেতে যেতে নিভৃতে মলয়কেতু ভাগুরায়ণকে বললেন—চাণক্যের বাড়াবাড়ি সইতে না পেরে চন্দ্রগুপ্ত যদি তাকে সরিয়ে দেন, তবে রাক্ষস গিয়ে চন্দ্রগুপ্তের সঙ্গে মিলিত হতে পারেন। কারণ, নন্দবংশের প্রতি রাক্ষসের ভক্তি সুবিদিত, আর চন্দ্রগুপ্ত বংশসূত্রে নন্দসন্তান তো বটেই। সেরকম যদি ঘটে, তখন কুমার হয়তো তাদের আর বিশ্বাস করবেন না।

রাক্ষসের আবাসে প্রবেশ করলেন মলয়কেতু। রাক্ষস তাঁকে পেয়ে সোচ্ছ্বাসে জানালেন—আক্রমণের প্রশস্ত সময় উপস্থিত। চন্দ্রগুপ্ত লোকব্যবহারে অনভিজ্ঞ নবীন রাজা। পরামর্শদাতা চাণক্য তাঁকে ছেড়ে গেছেন। নন্দভক্তদের অধ্যুষিত কুসুমপুরে জনমতও তাঁর বিপক্ষে। এদিকে তাঁরা নিজেরা সৈন্যসামন্তে সুসজ্জিত। অভিযানের নায়ক স্বয়ং মলয়কেতু। রাক্ষস তো তাঁর নীতির প্রয়োগে সতত অতন্দ্ৰ। সবই এখন অনুকূল, অপেক্ষা কেবল কুমারের সদিচ্ছার। রাক্ষসের আগ্রহে ও অনুপ্রেরণায় মলয়কেতু সায় দিলেন তাঁর প্রস্তাবে। জ্যোতিষীর মতামত নিয়ে রাক্ষস অভিযানের শুভ দিনক্ষণ স্থির করতে লাগলেন। [চতুর্থ অঙ্ক]

কুসুমপুর আক্রমণ করতে হবে। কুসুমপুরের সন্নিকটেই তাই এখন মলয়কেতুর শিবির। বিভিন্ন রাজার সম্মিলিত সমরশক্তিতে তিনি বলীয়ান্। পরামর্শদাতা রাক্ষস রয়েছেন শিবিরে। শিবিরের সর্বত্র সতর্ক প্রহরা। ঢুকতে বা বেরোতে হলে চাই ছাড়পত্র। সন্ন্যাসী জীবসিদ্ধি এলেন ভাগুরায়ণের কাছে, তাঁর শিবির ত্যাগের একখানি ছাড়পত্র চাই। কিন্তু কেন এই শিবির ত্যাগ? বহু পীড়াপীড়িতে সন্ন্যাসী শেষ পর্যন্ত জানালেন যে বহু কুকর্মের নায়ক রাক্ষসের আশ্রয় নিরাপদ নয়, যে কোনো অজুহাতে রাক্ষস তাঁকে মেরে ফেলতে পারেন, কেননা পর্বতেশ্বরের মতো রাজাকে রাক্ষসই তো বিষকন্যা-প্রয়োগে হত্যা করেছেন। মলয়কেতুর অগোচর রইল না এ নির্মম-তথ্য। রাক্ষস তবে বিশ্বাসঘাতক। মলয়কেতুর মনোভাব বুঝতে পেরে ভাগুরায়ণ তাঁকে সামলে চলতে পরামর্শ দিল, নইলে হিতে বিপরীত ঘটতে পারে। রাক্ষসের সঙ্গে তাই এখন কোনো সংঘাত সমীচীন হবে না, নন্দদের হৃতরাজ্যের পুনরুদ্ধার হোক, তারপর তাঁর সঙ্গে হবে বোঝাপড়া। আপাতত মলয়কেতু সামলে নিলেন তাঁর উত্তেজনা।

ছাড়পত্রসহ জীবসিদ্ধি শিবির ত্যাগ করে চলে গেছেন। সিদ্ধার্থকও চলে যাচ্ছিল, কিন্তু তার ছাড়পত্র ছিল না। অতএব প্রহরী তাকে ধরে নিয়ে এল মলয়কেতুর কাছে। তল্লাশি করে তার কাছে পাওয়া গেল স্বাক্ষর-শিরোনামবিহীন সেই পত্র যার মধ্যে রয়েছে রাক্ষসের নাম-মুদ্রার ছাপ। পত্রের মর্মার্থ হল—বিরুদ্ধাচারীকে বর্জন করাটা ভালোই হয়েছে। এবার সন্ধি-স্থাপন হলেই মলয়কেতুর সহযোগী রাজারা তাঁকে ত্যাগ করে উপকারীকে আশ্রয় করবে। বরাবরই এরা মলয়কেতুর হস্তী, কোষ ও রাজ্য নিজেদের মধ্যে বণ্টন করে নিতে উদ্‌গ্রীব। প্রেরিত ভূষণ তিনখানি হস্তগত হয়েছে। বিশ্বস্ত পত্রবাহক মারফত কিছু উপহার-সামগ্রী প্রেরিত হচ্ছে। অপরাপর জ্ঞাতব্য পত্রবাহকের প্রতিবেদনেই জানা যাবে।

পত্র-সম্পর্কে সিদ্ধার্থকের নিকট প্রথমে কোনো সদুত্তর পাওয়া গেল না। তখন শুরু হল প্রহার। অতএব তাকে স্বীকার করতে হল যে এ পত্র রাক্ষসের, চন্দ্রগুপ্তের কাছে সে বয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। ইতিমধ্যে মারের চোটে তার বগলের তলা থেকে বেরিয়ে এল একটি পুঁটলি, সে পুঁটলিতেও রাক্ষসের নামমুদ্রার ছাপ। মলয়কেতু অবাক হলেন দেখে সে পত্রখানি সম্পূর্ণ রাক্ষসের পরমবন্ধু শকটদাসের হস্তাক্ষরে লিখিত, আর পুঁটলিতে পাওয়া গেল সেই তিনখানি অলঙ্কার যা তিনিই পূর্বে রাক্ষসকে দান করেছিলেন।

ডাকা হল রাক্ষসকে। এ সবের বিন্দুবিসর্গও তিনি জানেন না। বিশ্বাসভঙ্গের অভিযোগ তাই তিনি অস্বীকার করলেন। কিন্তু কৌটিল্যের নীতি যে বড়ই কূট! রাক্ষস নিজেই তাঁর দেহে ধারণ করে আছেন সেই অলঙ্কার যা পূর্বে মলয়কেতুর পিতা স্বগত পর্বতেশ্বরের দেহকে অলঙ্কৃত করত। অথচ এ অলঙ্কারের মালিকানা এখন চন্দ্রগুপ্তের কাছে রক্ষিত সে অলঙ্কার কী করে হল আজ রাক্ষসের গাত্রভূষণ? চন্দ্রগুপ্ত শুধু অর্থের লোভে এ অলঙ্কার হস্তান্তরিত করেছেন—এ উত্তর যথেষ্ট নয়। সুতরাং শকটদাসের হস্তাক্ষরে সেই পত্র, সিদ্ধার্থকের সংযোজন এবং উপহারস্বরূপ সেই অলঙ্কার এ সবের একটাই মানে দাঁড়ায় যে রাক্ষস বিশ্বাসঘাতক। এবারে মলয়কেতু ব্যক্ত করলেন তাঁর প্রত্যয়ের কথা যে বিষকন্যা দিয়ে রাক্ষসই তাঁর পিতাকে হত্যা করিয়েছেন। এজন্যে সন্ন্যাসী জীবসিদ্ধির বক্তব্যের উল্লেখ করতে তিনি ভুললেন না। রাক্ষসের বিহ্বল কণ্ঠে এটুকুই শুধু উচ্চারিত হল—‘দৈবমত্র প্রষ্টব্যম’ (এ ব্যাপারে প্রশ্ন করতে হয় দৈবকে।)

ক্ষোভে, ক্রোধে, উত্তেজনায় বে-সামাল মলয়কেতু পূর্বোক্ত পত্রের ভাষা ও চাণক্যের চর সিদ্ধার্থকের ভাষ্যের ওপর ভিত্তি করে তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অলীক সন্দেহে চিত্রবর্মা প্রমুখ পাঁচজন সহযোগী রাজার প্রাণনাশের হুকুম দিলেন। প্রাণে মারলেন না রাক্ষসকে, কিন্তু ক্রোধাবেগে চরম অপমান করলেন তাঁকে। বিদ্রূপবাণ নিক্ষিপ্ত হল তাঁর প্রতি—‘তদ্ গচ্ছ, সমাশ্রীয়তাং সর্বাত্মনা চন্দ্রগুপ্তঃ।’ (যাও তবে মনেপ্রাণে চন্দ্রগুপ্তকে আশ্রয় করো।) আস্ফালন করে বললেন তিনি যে, রাক্ষস, চাণক্য ও চন্দ্রগুপ্ত—এঁরা তিনজনে একজোট হলেও মলয়কেতু একাই এঁদের শায়েস্তা করতে সক্ষম। অতএব কুসুমপুর আক্রমণে পিছপা হবেন না তিনি, অভিযান তাঁর চলবেই। [পঞ্চম অঙ্ক]

কিন্তু অভিযানের ফল হল বড়ই করুণ। চিত্রবর্মাদের হত্যার পর আর যে কজন মিত্র রাজা মলয়কেতুর সঙ্গে ছিল, তারাও তাঁর হঠকারিতায় সন্ত্রস্ত হয়ে একে একে তাঁকে ছেড়ে চলে গেল যার যার রাজ্যে। উৎসাহে ভাঁটা পড়ল সামন্তরাজদের। ভয়ে-ভাবনায় সৈন্যরা হল ছত্রভঙ্গ। মুষ্টিমেয় সৈন্যের ভরসায় সংগ্রামে অবতীর্ণ হলেন মলয়কেতু, কিন্তু অচিরেই তিনি ভাগুরায়ণ প্রভৃতি চাণক্যের চরদের হাতেই হলেন বন্দি।

মলয়কেতুর শিবির ত্যাগ করে রাক্ষস আত্মগোপন করে ঘুরতে ঘুরতে এসে পৌঁছলেন কুসুমপুরের কাছে এক পরিত্যক্ত জীর্ণ উদ্যানে। জীবনের প্রতি তাঁর কোনো আসক্তি নেই, কিন্তু তাঁর অভিন্নহৃদয় সুহৃদ চন্দনদাসের কী গতি হবে? রাক্ষসের গতিবিধি কিন্তু চাণক্যের চরদের নখদর্পণে। রাক্ষস দেখলেন তাঁরই অনতিদূরে এক বেচারী উদ্বন্ধনে আত্মহত্যায় প্রয়াসী। ছুটে গেলেন রাক্ষস। সহানুভূতির স্বরে তার এ হেন প্রয়াসের কারণ জিগ্যেস করলেন। লোকটি জানাল শ্রেষ্ঠী চন্দনদাসের মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞা শুনে তাঁর পরম প্রিয়সখা বিষ্ণুদাস অগ্নিপ্রবেশের সংকল্প করেছেন। বিষ্ণুদাসের মতো সুহৃদদের বিরহে তাঁর বেঁচে থাকা অর্থহীন, তাই সে এভাবে উদ্বন্ধনে প্রাণনাশে প্রয়াসী হয়েছে। বন্ধুত্বের এই বিরল দৃষ্টান্ত হল রাক্ষসের জ্ঞানাঞ্জনশলাকা। তৎক্ষণাৎ তিনি ব্যাকুলকণ্ঠে বলে উঠলেন যে, তাঁর নিজের জীবনের বিনিময়ে তিনি আশ্রিতবৎসল পরমসুহৃদ চন্দনদাসকে রক্ষা করবেন। [ষষ্ঠ অঙ্ক]

স্ত্রী-—পুত্রের হৃদয়বিদারক আর্তনাদের মধ্য দিয়ে শ্রেষ্ঠী চন্দনদাসকে শূলে চড়ানোর উপক্রম হচ্ছিল, এমন সময় অকস্মাৎ বধ্যভূমিতে রাক্ষস এসে আত্মপ্রকাশ করলেন। তাঁর আকুলকণ্ঠে তারস্বরে উচ্চারিত হল নিষেধের তীক্ষ্ণ বাণী। বধ্যভূমির সকলে সচকিত হল তাঁর কণ্ঠরোলে। অনুনয় করলেন তিনি ঘাতকদের—চন্দনদাসকে তারা যেন শূলে না দেয়, তিনি নিজেই এসে গেছেন তাঁর জন্যে প্রাণ দিতে। চন্দনদাস রাক্ষসের এই চিত্ত-দৌর্বল্যের নিন্দা করলেন। রাক্ষস কিন্তু তাঁর আত্মবিসর্জনের সংকল্পের কথা ঘাতকমুখে চাণক্যকে জানালেন। রাক্ষস ধরা পড়েছেন—শুনে উল্লসিত চাণক্য কালক্ষেপ না করে চলে এলেন সেখানে। ‘মহাত্মা’ বিশেষণে ভূষিত করে রাক্ষসকে তিনি প্রণাম জানালেন। চাণক্য রাক্ষসকে বললেন যে বধ্যভূমির চণ্ডাল দুজন আসলে তাঁরই গুপ্তচর, রাজপুরুষ সিদ্ধার্থক ও সমিদ্বার্থক, রাক্ষস এদের ওই বেশে চিনতে পারেননি। একে একে সব রহস্যই অনবগুণ্ঠিত হল রাক্ষসের কাছে।

পত্র, অলঙ্কার, সন্ন্যাসী জীবসিদ্ধি, উদ্বন্ধনে আত্মহত্যায় প্রয়াসী সেই পুরুষ, চন্দনদাসের কারাবাস প্রভৃতি সবই যে কৌটিল্যের কূটনীতির চাল—সেকথা রাক্ষস স্বয়ং চাণক্যের মুখ থেকেই শুনলেন এবং জানলেন যে এ-সবের একটাই লক্ষ্য—সেটা হচ্ছে চন্দ্রগুপ্তের সঙ্গে রাক্ষসের মিলন। রাক্ষসকে সঙ্গে করে চাণক্য গেলেন চন্দ্রগুপ্তের কাছে, তাঁকে মহামাত্যপদে বরণ করার নির্দেশ দিলেন তিনি চন্দ্রগুপ্তকে। রাক্ষসকে দেখে চন্দ্রগুপ্ত তাঁর প্রণাম জানালেন। চন্দনদাসের মুক্তির প্রসঙ্গ আলোচিত হল। চাণক্য শর্ত আরোপ করলেন—রাক্ষস যদি চন্দ্রগুপ্তের মহামাত্যের পদগ্রহণে সম্মত হন, তবে সেটাই হবে চন্দনদাসের মুক্তিপণ। অনন্যোপায় রাক্ষস মিত্রস্নেহের কাছে নতি স্বীকার করে মৌর্যের মহামাত্য পদ গ্রহণে সম্মত হলেন।

চাণক্য ও চন্দ্রগুপ্তের মুখে অপার আনন্দের দীপ্তি হল উদ্ভাসিত। রাক্ষসের অনুরোধ রক্ষা করতে মুক্তি দেওয়া হল রাজবন্দি মলয়কেতুকে, তাঁর পৈতৃক সম্পত্তিও সব তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়া হল। এরপর চাণক্যের নির্দেশানুসারে চন্দ্রগুপ্ত চন্দনদাসকে সপরিবারে মুক্ত করে তাঁকে পৃথিবীর সমস্ত নগরীর ‘শ্রেষ্ঠী’পদে প্রতিষ্ঠিত করলেন। অতঃপর বিরাট জয়োৎসবের মধ্যে কারাগৃহের সকল রুদ্ধ দ্বার হল উন্মুক্ত। হাতি আর ঘোড়া ছাড়া সবার বাঁধন গেল খুলে। কিন্তু বাঁধন পড়ল এবার চাণক্যের শিখায়, কেননা আজ তাঁর সংকল্প সিদ্ধ হয়েছে।

চাণক্য যা পেলেন, তার চেয়ে প্রিয়তর কাম্য আর কী থাকতে পারে?

[সপ্তম অঙ্ক]

সূক্তিরত্নাবলী

মুদ্রারাক্ষসের সারা অঙ্গে কত বিচিত্র সূক্তিরত্নের বিপুল সমাবেশ! এদের সুশোভন সাযুজ্যে মুদ্রারাক্ষস তাই এক বিরল রত্নকোষ। এর প্রতিটি সূক্তিরতুই সৌন্দর্যে নিটোল, তাৎপর্যে স্বতন্ত্র, অলঙ্করণে অপ্রতিম। প্রবচনমূল্যে প্রত্যেকেই মহার্ঘ্য। মুদ্রারাক্ষসের সমৃদ্ধ ভাণ্ডার থেকে কিছু সূক্তিরত্ব চয়ন করে এখানে দেওয়া হল : ১. চীয়তে বালিশস্যাপি সৎক্ষেত্ৰপতিতা কৃষিঃ। (১।৩)—হোক না চাষি মূৰ্খ, ভালো জমিতে বোনা বীজ ভালো ফসল দেয়।

২. ঐশ্বর্যাদনপেতমীশ্বরময়ং লোকোহর্থতঃ সেবতে। (১। ১৪) এ সংসারে মানুষ স্বার্থের তাগিদে প্রভাব-প্রতিপত্তি যার অক্ষুণ্ণ, তেমন প্রভুরই সেবা করে।

৩. ন হি সর্বঃ সর্বং জানাতি। সবাই তো সবকিছু জানে না।

৪. ন যুক্তং প্রাকৃতমপি রিপুমবজ্ঞাতুম্। শত্রু সাধারণ লোক হলেও তাকে তুচ্ছজ্ঞান করা সমীচীন নয়।

৫. অত্যাদরঃ শঙ্কনীয়ঃ। বেশি সৌজন্যে ভয় হয়।

৬. কীদৃশস্তণানামগ্নিনা বহু বিরোধঃ।—আগুনের সঙ্গে তৃণের বিরোধ কিরূপে সম্ভব!

৭. ফলেন সংবাদিমস্য বিকথিতম্।—বড় বড় কথাগুলো এঁর কাজের সঙ্গে মিলে গেছে।

৮. প্রারদ্ধমুত্তমজনা ন পরিত্যজন্তি। (২।১৭)—উত্তম পুরুষেরা আরদ্ধ কার্য পরিত্যাগ করেন না।

৯. পরায়ত্তঃ প্রীতেঃ কথমিব রসং বেত্তি পুরুষঃ। (৩। ৪)–পরাধীন পুরুষ কী করে আনন্দরসের আস্বাদ পাবেন?

১০. ন প্রয়োজনমন্তরা চাণক্যঃ স্বপ্নেঽপি চেষ্টতে। প্রয়োজন ব্যতিরেকে চাণক্য স্বপ্নেও কিছু করেন না।

১১. দৈবমবিদ্বাংসঃ প্ৰমাণয়ন্তি।–দৈবের দোহাই মূর্খেরা দেয়।

১২. যান্তি যন্তুঃ প্রমাদেন গজো ব্যালতৃবাচ্যতামু। (৩। ৩২)—মাহুতের দোষেই হাতির ভাগ্যে ‘খ্যাপা’ দুর্নাম জোটে।

১৩. প্রায়ো ভৃত্যান্ত্যজন্তি প্রচলিতবিভবং স্বামিনং সেবমানাঃ। (৪। ২২)–প্রভুর সেবায় রত ভৃত্যগণ প্রভুর বিত্তনাশ হলে প্রায়ই তাকে ছেড়ে চলে যায়।

১৪. গতিঃ সোচ্ছ্বায়াণাং পতনমনুকূলং কলয়তি। (৫। ১২)—উচ্চে যারা আরোহণ করে, তাদের তদনুরূপ পতনের সম্ভাবনাও থাকে।

শ্রী সুরেন্দ্রনাথ দেব

.

কুশীলব

পুরুষ-চরিত্র

চন্দ্ৰগুপ্ত—মগধের নতুন অধিপতি। [বৃষল, মৌর্য, চন্দ্রশ্রী প্রভৃতি নামেও অভিহিত। ] নায়ক।

চাণক্য— নানা শাস্ত্রে সুপণ্ডিত ধুরন্ধর রাজনীতিজ্ঞ ব্ৰাহ্মণ, চন্দ্রগুপ্তের আচার্য এবং প্রধানমন্ত্রী [বিষ্ণুগুপ্ত, কৌটিল্য প্রভৃতি নামেও অভিহিত।]

রাক্ষস- প্রাক্তন নন্দরাজবংশের একান্ত অনুগত ব্ৰাহ্মণ অমাত্য।

মলয়কেতু- পার্বত্যরাজ পর্বতের পুত্র। প্রতিনায়ক।

ভাগুরায়ণ— মলয়কেতুর সখা এবং সচিব, কিন্তু বস্তুত চাণক্যের চর।

নিপুণক, জীবসিদ্ধি, সিদ্ধার্থক, সমিদ্ধার্থক–চাণক্যের চর এবং গুপ্ত প্রণিধি।

শার্ঙ্গরব—চাণক্যের শিষ্য।

চন্দনদাস, শকটদাস—রাক্ষসের অন্তরঙ্গ বন্ধু।

প্রিয়ংবদক—রাক্ষসের ভৃত্য।

বিরাধগুপ্ত— রাক্ষসের গুপ্তচর।

বৈহীনরি— চন্দ্রগুপ্তের কঞ্চুকী।

জাজলী— মলয়কেতুর কঞ্চুকী।

চন্দনদাসের পুত্র।

স্ত্রী-চরিত্র

চন্দনদাসের স্ত্রী।

শোনোত্তরা- চন্দ্রগুপ্তের প্রতিহারী।

বিজয়া— মলয়কেতুর প্রতিহারী।

উল্লেখিত চরিত্র

নন্দ- মগধের প্রাক্তন রাজা, চাণক্য এই নন্দকে সবংশে নিধন করেছিলেন।

পর্বতক বা পর্বতেশ্বর—পার্বত্য অঞ্চলের রাজা। নন্দের বিরুদ্ধে চন্দ্রগুপ্তকে সহায়তা করেছিলেন। চন্দ্রগুপ্ত রাজা হলে অর্ধেক নন্দরাজ্য এঁকে দেবার প্রতিশ্রুতি চাণক্য দিয়েছিলেন।

সর্বার্থসিদ্ধি– নন্দবংশের শেষ জীবিত পুরুষ হিশেবে রাক্ষস এঁকে সিংহাসনে বসিয়েছিলেন। কিন্তু চন্দ্রগুপ্তের নগর-অবরোধের সময় ইনি সুড়ঙ্গপথে পালিয়ে তপোবনে যান।

বৈরোচক—পর্বতকের ভ্রাতা। পর্বতকের নিকট প্রতিশ্রুত রাজ্যার্ধ এঁকে দেবার কথা ছিল।

দৃশ্য

অঙ্ক- ১ম, ৩য়, ৬ষ্ঠ, ৭ম—পাটলিপুত্র বা কুসুমপুর।

অঙ্ক—২য়, ৪র্থ–-পর্বতকের রাজধানী

অঙ্ক—৫ম–মলয়কেতুর শিবির (পাটলিপুত্রের কাছে)।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *