চতুৰ্থ অঙ্ক – রাক্ষসোদ্যোগ

চতুৰ্থ অঙ্ক – রাক্ষসোদ্যোগ

(তারপর পথিকবেশে পুরুষের প্রবেশ)

পুরুষ—আশ্চর্য, আশ্চর্য! রাজ-আজ্ঞার কী অমোঘ প্রভাব! এই যে স্থান-কালের দোহাই দিয়ে এড়ানো যায় না—এমন কড়া আদেশ যদি প্রভুর না থাকত, তবে কে আর এই যাতায়াতটা করত? ॥১॥

অমাত্য রাক্ষসের এই বাড়িতে তবে যাই। (শ্রান্তভাবে পরিক্রমা করে) দ্বারীদের কে আছ হে এখানে? প্রভু অমাত্য রাক্ষসের কাছে নিবেদন কর যে, করভক পাটলিপুত্র থেকে ছুটতে ছুটতে এইমাত্র এসে পৌঁচেছে।

দৌবারিক—(প্রবেশ করে) ভদ্র, জোরে কথা বলো না। কাজের চিন্তায় অমাত্য রাত জেগেছিলেন, তাই মাথা ধরেছে। এখনো বিছানা ছেড়ে ওঠেননি। অতএব একটু দাঁড়াও। সুযোগ বুঝে তোমার আগমনের সংবাদ তাঁকে দেব।

করভক—ভদ্রমুখ, তাই কর।

(তারপর শয়নগৃহে আসনে উপবিষ্ট চিন্তামগ্ন রাক্ষস এবং সঙ্গে শকটদাসের প্রবেশ)

রাক্ষস—(স্বগত) কাজ শুরু করতে-না-করতে বিধি আমার বাম হয়েছেন। কুটিল বটে চাণক্যের নীতি! আবার, কাজ শুরু করার পরেও দেখলাম আমার সমস্ত প্রকল্পই কীভাবে নিদারুণভাবে ব্যর্থ হল। এসব কথা যখন ভাবি, “তখন এখানে এটা কীভাবে হল?’—এই চিন্তা করতে করতে রাতের-পর-রাত আমার বিনিদ্র কাটে ॥২॥

যিনি নাটক লেখেন আর যিনি আমার মতো রাজনীতি করেন, উভয়কেই এই ক্লেশ স্বীকার করতে হয়। গোড়াতে সূক্ষ্ম হলেও কার্যের যা প্রথম হেতু সেই বীজ স্থাপন করতে হয়, তারপর ওই বীজের বিস্তার ঘটাতে হয়। এরপর বীজের গর্ভসঞ্চার হলে গূঢ় ভাবী ফলের ঈষৎ প্রকাশ ঘটিয়ে অনন্তর বুদ্ধি দিয়ে সেই ফলের কোনো বিপত্তি দেখা দিলে তার সমাধানের কথা আলোচনা করতে হয় এবং শেষে বিক্ষিপ্ত কার্যফলকে একত্র করে উপসংহার করতে হয়[১] ॥৩॥

তবে কি দুরাত্মা চাণক্য—

দৌবারিক—(নিকটে এসে) জয়ী হন। রাক্ষস—ফাঁদে পা দেবে?

দৌবারিক—অমাত্য।

রাক্ষস—(বাম চোখ কেঁপে ওঠার অভিনয়। স্বগত।)

প্রকরণগত তাৎপর্য এবং বাম চক্ষুর স্পন্দন- এ দুটিকেই মেলালে, বাগদেবীর এই অভিপ্রায়ই প্রতিপন্ন হয় যে, দুরাত্মা কূট চাণক্য হোক জয়ী, আর অমাত্য ধরা দিক ফাঁদে। চেষ্টা তবুও ছাড়তে নেই। (প্রকাশ্যে) ভদ্র, কী বলতে চাইছ?

দৌবারিক—অমাত্য, করভক দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। রাক্ষস—শীঘ্র নিয়ে এস।

দৌবারিক—আচ্ছা। (বেরিয়ে পুরুষের কাছে গিয়ে) ভদ্র, অমাত্যের কাছে যাও।

(নিষ্ক্রান্ত।)

করভক—(কাছে গিয়ে) অমাত্যের জয় হোক।

রাক্ষস—ভদ্র, বসো।

করভক—অমাত্যের যা আদেশ। (মাটিতে বসে পড়ল)।

রাক্ষস—(আত্মগত) কোন কাজে যে একে পাঠিয়েছিলাম, কাজের ভিড়ে তা মনে করতে পারছি না।

(চিন্তার অভিনয়।)

[তারপর বেত হাতে দ্বিতীয় পুরুষের প্রবেশ]

পুরুষ–সরুন, মশাইরা, সরুন। লোকজন দূরে সরে যাও। দেখছ না কি? ভাগ্যের জোর না থাকলে দেবতাদের মতো কল্যাণরাশির উৎস নরদেবতা স্বরূপ[২] এই রাজাদের সান্নিধ্য লাভ তো দূরের কথা, দর্শনলাভও বড়ো ঘটে না ॥৪॥

(আকাশের দিকে তাকিয়ে) মশাইরা কী বলছেন? লোকজন সরানো হচ্ছে কেন?

এই যে ভদ্রজনেরা, ইনি হচ্ছেন কুমার মলয়কেতু, অমাত্য রাক্ষসের মাথার যন্ত্রণা হওয়ায় ইনি তাঁকে দেখতে এদিক দিয়েই আসছেন। তাই লোকজন সরানো হচ্ছে। (পুরুষের প্রস্থান)।

(তারপর মলয়কেতুর প্রবেশ, পশ্চাতে ভাগুরায়ণ ও কঞ্চুকী)।

মলয়কেতু—(নিশ্বাস ফেলে স্বগত) আজ দশ মাস হয়ে গেল পিতৃদেব গত হয়েছেন, অথচ তাঁর উদ্দেশে এক অঞ্জলি জলও দান করিনি। বৃথাই আমি নিজে পুরুষ বলে অভিমান করি।

পূর্বে তখন এই প্রতিজ্ঞা করেছিলাম—আমার মায়েরা যখন (পিতার মৃত্যুজনিত) শোকে বিহ্বল হয়ে বুকে করাঘাত করছিলেন, তখন ভেঙে গিয়েছিল তাঁদের রত্নবলয়, খসে পড়েছিল চিক্কণ উত্তরীয়-বাস। হাহা-রবে মুখর হয়েছিল তাঁদের করুণ আর্তনাদ, ধূলায় ধূসর হয়েছিল তাঁদের মাথার কেশ। মায়েদের সেই শোচনীয় দশা দেখে স্থির করেছিলাম, অচিরেই শত্রুজায়াদেরও সেই দশা ঘটাব এবং তারপর পিতার উদ্দেশে অঞ্জলিভরে তর্পণ করব ॥৫॥

এতে আর বেশি বলার কী আছে?

বীরের কার্যভার বহন করতে গিয়ে হয় আমি যুদ্ধে মৃত্যুবরণ করে পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করব, নয় তো আমার মায়েদের চোখ থেকে অশ্রুভার তুলে নিয়ে তা রিপুবধূদের চোখে চাপাব ৬

(প্রকাশ্যে) আর্য জাজলি, আমি একাকী অতর্কিতভাবে উপস্থিত হয়ে অমাত্য রাক্ষসের প্রীতিবিধান করতে চাই। অতএব আমার কথামতো অনুগামী রাজাদের বলুন যে, অনুগমনের কষ্ট করার দরকার নেই!

কঞ্চুকী—কুমার যা আজ্ঞা করেন। (পরিক্রমা করে, আকাশে) ওগো রাজা মহাশয়েরা, কুমার আদেশ করছেন : কেউ যেন আমার অনুগমন না করে। (দেখে সহর্ষে) কুমারের আজ্ঞা শোনামাত্রই রাজারা সব ফিরে যাচ্ছেন। কুমার নিরীক্ষণ করুন :

‘কেউ কেউ অতি কড়া লাগাম সজোরে টেনে ধরে ঘোড়াগুলোকে থামিয়ে দিয়েছেন। ঘোড়াগুলোর উঁচু কাঁধ গেছে অত্যন্ত বেঁকে, সামনের দুই পা মাটি থেকে ঊর্ধ্বে, যেন খুরের আগায় আকাশ খুঁড়ছে। কেউ কেউ তাঁদের মহাকায় হাতিগুলোর গতি রুদ্ধ করে নিজেরাও আর এগোচ্ছেন না। হাতির গতি রুদ্ধ হওয়ায় ঘণ্টাগুলো আর বাজছে না। হে দেব, সমুদ্র যেমন তার সৈকতসীমা লঙ্ঘন করে না, তেমনি এই রাজারা আপনার আজ্ঞা লঙ্ঘন করেন না ॥৭॥

মলয়কেতু—আর্য, আপনিও পরিজনদের নিয়ে ফিরে যান। ভাগুরায়ণ একা আসুক আমার পেছনে।

কঞ্চুকী—কুমারের যা আদেশ। (পরিজনসহ প্রস্থান)

মলয়কেতু—সখা ভাগুরায়ণ, ভদ্রভট-প্রমুখ এখানে আসার সময় আমাকে বলেছিল, আমরা অমাত্য রাক্ষসকে ধরে আমাদের শরণ্য কুমারের আশ্রয়ে আসিনি, কিন্তু দুষ্ট মন্ত্রীর করায়ত্ত চন্দ্রগুপ্তের প্রতি বিরক্ত হয়ে মনোহর গুণের আকর কুমারকে আশ্রয়ের যোগ্য বিবেচনা করে কুমারের সেনাপতি শিখরসেনের মাধ্যমে আমরা কুমারকে আশ্রয় করছি।’ আমি বেশ বহুক্ষণ ভেবে-চিন্তে ও কিন্তু তাদের কথার যে কী মানে তা বুঝে উঠতে পারিনি।

ভাগুরায়ণ—কুমার, এর মানে বোঝা শক্ত নয়। বিজিগীষু, আত্মগুণসম্পন্ন আশ্রয়ের যোগ্য রাজাকেই তার প্রিয় ও শুভার্থী পুরুষের মাধ্যমে আশ্রয় করতে হয়—এই মানেটাই তো ন্যায্য।

মলয়কেতু—সখা ভাগুরায়ণ, বলি অমাত্য রাক্ষসই যে আমার সর্বাধিক প্রিয় এবং পরম শুভার্থী।

ভাগুরায়ণ—তা বটে। কিন্তু অমাত্য রাক্ষসের শত্রুতা চাণক্যের সঙ্গে, চন্দ্রগুপ্তের সঙ্গে নয়। তাই যদি অতি গর্বোদ্ধত চাণক্যকে সহ্য করতে না পেরে চন্দ্রগুপ্ত কখনও তাঁকে মন্ত্রিত্ব থেকে সরিয়ে দেন, তখন অমাত্য রাক্ষস বন্ধুজনের স্বার্থে চন্দ্রগুপ্তের সঙ্গে সন্ধিসূত্রে মিলিত হতে পারেন, কারণ রাক্ষসের রয়েছে নন্দবংশের প্রতি ভক্তি, আর চন্দ্রগুপ্ত নন্দের বংশধর তো বটে। পিতার সময় থেকে ইনি মন্ত্রিত্ব করে আসছেন, এই ভেবে চন্দ্রগুপ্তও তাঁর সঙ্গে সন্ধিতে রাজি হবেন। এমনটা ঘটলে কুমার আর আমাদের ওপর বিশ্বাস রাখবেন না—এটাই এদের কথার মানে।

মলয়কেতু—তা ঠিক। অমাত্যের গৃহের পথ দেখিয়ে চল। ভাগুরায়ণ—এদিকে আসুন কুমার, এদিকে। (উভয়ের পরিক্রমণ এই অমাত্যের গৃহ। কুমার প্রবেশ করুন।

মলয়কেতু—এই যে প্রবেশ করছি।

রাক্ষস–(স্বগত) হ্যাঁ, মনে পড়েছে। (প্রকাশ্যে) ভদ্র, কুসুমপুরে তুমি স্তনকলশের সঙ্গে দেখা করেছিলে?

পুরুষ—অমাত্য, করেছি।

মলয়কেতু—(শুনতে পেয়ে) ভাগুরায়ণ, কুসুমপুরের কথা আলোচনা হচ্ছে। এখন তবে ওখানে ঢুকছি না। শুনে নি আগে। কেননা, পাছে রাজাদের মেজাজ খারাপ হয়ে যায়—এই ভয়ে মন্ত্রীরা তাঁদের সামনে যখন কথা বলেন, সেটা এক রকমের, কিন্তু নিজেদের মধ্যে যখন স্বচ্ছন্দে সব খোলাখুলি আলোচনা করেন, তখন সেটা আবার অন্য রকমের।।৮।।

ভাগুরায়ণ—কুমারের যা আজ্ঞা।

রাক্ষস—ভদ্র, সে কার্য সিদ্ধ হয়েছে তো?

পুরুষ—অমাত্যের অনুগ্রহে সিদ্ধ হয়েছে।

মলয়কেতু—সখা ভাগুরায়ণ, কী সেই কাজ?

ভাগুরায়ণ—কুমার, মন্ত্রীদের কাজকর্ম রহস্যময়। কেবল এটুকুতে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না। কুমারকে মন দিয়ে ব্যাপারটা শুনতে হবে।

রাক্ষস—ভদ্র, সবিস্তারে শুনতে চাই।

পুরুষ—অমাত্য শুনুন। অমাত্য তখন আমাকে আদেশ করলেন, ‘করভক, কুসুমপুরে যাও, আমার কথামতো বৈতালিক স্তনকলশকে বল যে, অভাগা চাণক্য যখনই আজ্ঞাভঙ্গের কাজ করবেন, তখনই চন্দ্রগুপ্তকে উত্তেজিত করতে পারে—এমন সব শ্লোক উচ্চারণ করে তাঁর বন্দনা করবে।’

রাক্ষস—তারপর, ভদ্র, তারপর?

করভক—তারপর আমি পাটলিপুত্রে গিয়ে বৈতালিক স্তনকলশকে অমাত্যের নির্দেশ শোনালাম। ইত্যবসরে নন্দকুলের উচ্ছেদের ফলে বিষণ্ন পৌরজনদের বিনোদনের উদ্দেশ্যে রাজা কৌমুদীমহোৎসব উদ্‌যাপনের ঘোষণা করলেন। বহুদিন পরে অতি পরিচিত এই উৎসবকে ফিরে পেয়ে ঠিক মনের মতো বধূর সঙ্গে যেন মিলন হচ্ছে—এইভাবে সাদরে নগরবাসীরা তাকে স্বাগত জানাল।

রাক্ষস—(সাশ্রুনেত্রে) হা প্রভু নন্দ! কেবল কুসুমের প্রীতির উৎস চন্দ্রের উদয় হলেও, হে নৃপতিচন্দ্রমা, জগতের আনন্দের নির্ঝর আপনি যেখানে নেই, সেখানে কেমনতরো কৌমুদী (মহোৎসব)[৫] ॥৯॥

করভক—তারপর জনগণের নয়নাভিরাম সেই উৎসব রাজার অনিচ্ছাসত্ত্বেও হতভাগ্য চাণক্যের নির্দেশে নিষিদ্ধ হল। এই সুযোগে স্তনকলশ চন্দ্রগুপ্তের উদ্দেশে উত্তেজক শ্লোকগুচ্ছ আবৃত্তি করল।

রাক্ষস—সেটা কী রকম?

পুরুষ–(‘হে নরোত্তম…’ ইত্যাদি পূর্বোক্ত শ্লোক পাঠ।)

রাক্ষস—(সহর্সে) উত্তম, স্তনকলশ, উত্তম। সময়মতো যে ভেদের বীজ বুনেছ তার ফল নিশ্চিত মিলবে। কারণ, সাধারণ মানুষও তার অভ্যস্ত ক্রীড়াকৌতুক হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেলে সহ্য করতে পারে না, আর যিনি লোকাতিগ তেজের অধিকারী পৃথিবীর পতি, সেক্ষেত্রে আর কী কথা? ॥ ১০॥

মলয়কেতু—এটা ঠিক। (‘সাধারণ মানুষও…’ ইত্যাদি পুনরায় পাঠ)

রাক্ষস—তারপর, তারপর?

করভক—তারপর, আজ্ঞাভঙ্গে চটে গিয়ে চন্দ্রগুপ্ত প্রসঙ্গক্রমে অমাত্যের গুণাবলির প্রশংসা করে হতভাগা চাণক্যকে মন্ত্রিত্ব থেকে দিলেন ছাড়িয়ে। মলয়কেতু—সখা ভাগুরায়ণ, গুণের প্রশংসা থেকে বোঝা যাচ্ছে, রাক্ষসের প্রতি

চন্দ্রগুপ্তের ভক্তির টান আছে।

ভাগুরায়ণ—গুণকীর্তনে ততটা না হলেও ধূর্ত চাণক্যের বৃত্তি ঘুচিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে তা পরিষ্কার।

রাক্ষস—এই কৌমুদিমহোৎসব নিষেধ করাটাই কি চাণক্যের প্রতি চন্দ্রগুপ্তের কোপের একমাত্র কারণ, না অন্য কিছুও আছে?

মলয়কেতু—সখা, চন্দ্রগুপ্তের কোপের অন্য কারণ খুঁজে এর কী লাভ?

ভাগুরায়ণ—কুমার, বুদ্ধিমান্ চাণক্য অকারণে চন্দ্রগুপ্তকে রাগাবেন না, আর কৃতজ্ঞ চন্দ্রগুপ্ত কেবল এইটুকুতে গুরুর মর্যাদা-হানি করবেন না। আসল কথা, সেরকম বড়ো কারণে যদি চাণক্য ও চন্দ্রগুপ্তের মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়, তবে সেটাই হবে পাকা।

করভক—চন্দ্রগুপ্তের কোপের অন্য কারণও আছে। মলয়কেতু ও অমাত্য রাক্ষসের পালিয়ে আসার সময় চাণক্য ব্যাপারটা দেখেও দেখেননি।

রাক্ষস—সখা শকটদাস, চন্দ্রগুপ্ত আমার হাতের মুঠোয় এই এলেন বলে। এবার কারাগার থেকে চন্দনদাসের মুক্তি এবং স্ত্রী-পুত্রের সঙ্গে তোমার মিল ঘটবে।

মলয়কেতু—সখা ভাগুরায়ণ, ইনি যে ‘হাতের মুঠোয় এলেন বলে’—বললেন, এর তাৎপর্য কী?

ভাগুরায়ণ—আর কী? চাণক্যের থেকে চন্দ্রগুপ্ত যখন আলাদাই হলেন, তখন নিশ্চয় ভাবছেন—‘একে মেরে আর কাজ নেই’।

রাক্ষস—ভদ্র, চাকরিটা তো গেছে, সে ভাগ্যাহত এখন কোথায়?

করভক—সেই পাটলিপুত্রেই রয়েছে।

রাক্ষস—(আবেগপূর্ণ কণ্ঠে) ভদ্র, সেখানেই রয়ে গেছে? তপোবনে গেল না, কিংবা কোনো প্রতিজ্ঞাও আর ঘোষণা করল না?

করভক—অমাত্য, তপোবনে নাকি যাবেন, শোনা যাচ্ছে।

রাক্ষস- শকটদাস, এটা সামঞ্জস্যপূর্ণ হচ্ছে না। দেখ—পৃথিবীতে যিনি ইন্দ্রস্বরূপ ছিলেন, সেই প্রভু তাকে তার নিজ সম্মানের আসন থেকে নামিয়ে দিলে সে সেই অপমান সহ্য করেনি; আর মৌর্য যে তার নিজের হাতে গড়া রাজা, তার কাছ থেকে এই লাঞ্ছনা সেই অভিমানী পুরুষ কী করে সহ্য করবে ॥১১।।

মলয়কেতু—সখা, চাণক্য বনেই যাক বা নতুন প্রতিজ্ঞাই করুক, তাতে এঁর কী স্বার্থসিদ্ধি?

ভাগুরায়ণ—অমাত্য, অন্যরকম ভেবে কাজ নেই। এটাই সামঞ্জস্যপূর্ণ। অমাত্য দেখুন, সামন্ত রাজাদের মাথার চূড়ার এক-একটা মহামণি এক-একটা চন্দ্রের মতো প্রভা বিচ্ছুরণ করে। ওঁদের ওইরূপ রত্নপ্রভা-রঞ্জিত মাথায় চন্দ্রগুপ্ত স্বয়ং পদ স্থাপন করেছেন। এ হেন মৌর্য নিজের লোকের কাছে তার আজ্ঞার অবমাননা সইবেন কেন? অভিচার ক্রিয়ার[৬] মাধ্যমে প্রতিজ্ঞা পালনের যে কী কষ্ট সে অভিজ্ঞতা চাণক্যের ভালোই আছে, তাই একবার দৈবাৎ প্রতিজ্ঞা পূরণ হলেও ভবিষ্যতে প্রতিজ্ঞা পালনের নানা সংকটের ভয়ে আর প্রতিজ্ঞার মধ্যে যাচ্ছে না ॥ ১২॥

রাক্ষস—সখা শকটদাস, এরকমটাই হবে। যাও, করভকের বিশ্রামের ব্যবস্থা করে দাও।

শকটদাস—অমাত্যের যা আদেশ। (করভকের সঙ্গে প্রস্থান।)

রাক্ষস—আমারও ইচ্ছা, কুমারকে দেখি।

মলয়কেতু—(নিকটে গিয়ে) আমিই এসেছি আর্যকে দেখতে।

রাক্ষস—(দেখার অভিনয় করে) এ যে কুমার। (আসন থেকে উঠে) এই আসন। কুমারের বসতে আজ্ঞা হোক!

মলয়কেতু—এই বসছি। আর্য উপবেশন করুন। (যে যাঁর মতো বসলেন।) আর্য মাথার ব্যথাটা কমেছে তো?

রাক্ষস—কুমারের ‘কুমার’ অভিধার স্থলে যতদিন না ‘অধিরাজ’ শব্দটা বসাতে পারছি, ততদিন কী করে আমার মাথাব্যথা কমবে?

মলয়কেতু—আর্য যখন এটা অঙ্গীকার করছেন তখন এ আমার দুর্লভ হবে না। এখন আমাদের সৈন্যসামন্ত সব যোগাড় হয়ে গেছে। সুতরাং শত্রুর দুর্বলতার সুযোগের অপেক্ষায় এভাবে কতকাল চুপচাপ বসে থাকতে হবে?

রাক্ষস–কুমার, এখন আর কালহরণের অবকাশ কোথায়? বিজয়-অভিযানে বেরিয়ে পড়ুন।

মলয়কেতু—আর্য, শত্রুর কোনো ছিদ্র পাওয়া গেছে?

রাক্ষস—পাওয়া গেছে।

মলয়কেতু—সেটা কী ধরনের?

রাক্ষস—মন্ত্রীঘটিত সঙ্কট? আর কী? চন্দ্রগুপ্ত চাণক্যের কাছ থেকে সরে এসেছে। মলয়কেতু—আর্য, মন্ত্রীঘটিত সঙ্কট সঙ্কটই নয়।

রাক্ষস—অন্য রাজাদের বেলায় কখনও কখনও অমাত্য না থাকাটা দুর্বলতা নয় ঠিকই, কিন্তু চন্দ্রগুপ্তের বেলায় তো বটেই।

মলয়কেতু—আর্য, ব্যাপারটা এরকম নয়। চন্দ্রগুপ্তের প্রতি প্রজাদের বিরক্তির কারণই হচ্ছে চাণক্যের বাড়াবাড়ি। সুতরাং তাকে সরিয়ে দেওয়ায়, প্রজারা চন্দ্রগুপ্তের প্রতি আগে থেকেই অনুরক্ত তো ছিলই, ইদানীং তার প্রতি আরও বেশি অনুরাগ দেখাবে।

রাক্ষস– না না, এরূপ বলা যায় না। ওই প্রজারা হচ্ছে দুশ্রেণির—এক শ্রেণি হচ্ছে চন্দ্রগুপ্তের অভ্যুত্থানের সহযোগী, আর এক শ্রেণি নন্দদের প্রতি অনুরক্ত। ওদের মধ্যে যারা চন্দ্রগুপ্তের অভ্যুত্থানের সহযোগী, চাণক্যের দোষগুলো বিরক্তির হেতু হচ্ছে তাদেরই কাছে, নন্দবংশানুরাগীদের কাছে নয়। চন্দ্রগুপ্তকে তারা মোটেই সুনজরে দেখে না, কারণ তার নিজের পিতৃসম্পর্কে সম্পর্কিত নন্দবংশের সে বিনাশ ঘটিয়েছে। তজ্জনিত ক্রোধ ও বিরাগ তাদের রয়ে গেছে। কিন্তু তাদের আশ্রয় করার মতো ভালো কোনো নৃপকে তারা পাচ্ছে না, তাই অগত্যা চন্দ্রগুপ্তকে মেনে চলছে। প্রতিপক্ষকে পর্যুদস্ত করার পর্যাপ্ত-শক্তি-সম্পন্ন আপনার মতো আক্রমণকারীকে যখন তারা পাবে, তখন যত শীঘ্র সম্ভব তাকে ত্যাগ করে আপনাকেই আশ্রয় করবে। এ ব্যাপারে দৃষ্টান্ত স্বয়ং আমি।

মলয়কেতু—চন্দ্রগুপ্তের মন্ত্রী-জনিত এই বিপত্তিই কি একমাত্র তার প্রতি আক্রমণের কারণ, না অন্য কিছুও আছে?

রাক্ষস—আরো অনেক কারণ থাকলেই-বা কী? এটাই মুখ্যতম।

মলয়কেতু—আর্য, কীভাবে মুখ্যতম? চন্দ্রগুপ্ত কি এখন স্বীয় কার্যভার অন্য মন্ত্রীর স্কন্ধে আরোপিত করে কিংবা নিজের কাঁধে রেখে নিজে এর প্রতিবিধান করতে পারে না?

রাক্ষস—অবশ্যই পারে না। কারণ স্বায়ত্তসিদ্ধি বা উভয়াত্তসিদ্ধি রাজাদের পক্ষে সেটা সম্ভব। কিন্তু দুরাত্মা চন্দ্রগুপ্ত কার্যসিদ্ধির জন্য বরাবর মন্ত্রীর ওপরই নির্ভর করে এসেছে; নিজে থেকে লোকব্যবহার না দেখে দেখে যে নিজে অন্ধের মতো হয়ে গেছে, সে কী করে স্বয়ং প্রতিবিধান করতে পারে? রাজা এবং মন্ত্রী দুজনেই যদি অতি-উন্নতমানের হয়, তবে রাজ্যলক্ষ্মী তাদের দুজনের কাঁধে দুই পা দিয়ে ভারসাম্য বজায় রেখে স্থির হয়ে থাকেন। কিন্তু স্ত্রী-স্বভাবসুলভ অপটুতার ফলে ভারসাম্য বজায় রাখা যখন তাঁর পক্ষে দুঃসহ হয়ে পড়ে, তখন তিনি তাদের দুজনের মধ্যে একজনকে ত্যাগ করেন ॥ ১৩॥

যে স্বয়ং সমস্ত কাজের ভার মন্ত্রীর ওপর অর্পণ করেছে, তাতে মন্ত্রীর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিলে তার দশা হয় সহসা মাতৃস্তনবঞ্চিত দুগ্ধপোষ্য ক্ষুদ্ৰ শিশুর মতো এবং সে তখন লোকব্যবহার না জানায় হতবুদ্ধি হয়ে এক মুহূর্তও বাঁচতে পারে না ॥ ১৪॥

মলয়কেতু—(স্বগত) কী ভাগ্যি আমার! রাজ্যভার মন্ত্রীর ওপর দিইনি। (প্রকাশ্যে যদি-বা তা-ই হয়, তবুও আক্রমণের অনেক কারণ যুগপৎ থাকায় শত্রুর ছিদ্রপথে তার ওপর ঠিকমতো চড়াও হলে আক্রমণকারীর ঐকান্তিক কার্যসিদ্ধি হতে পারে।

রাক্ষস—ঐকান্তিক কার্যসিদ্ধিই কুমার লাভ করতে পারবেন। কারণ, উৎকৃষ্ট সেনাবলে বলীয়ান্ আপনার মতো রাজা আক্রমণকারী, নগরবাসীরা নন্দদের প্রতি অনুরক্ত, মন্ত্রীপদচ্যুত চাণক্য চন্দ্রগুপ্তের প্রতি বিরূপ, মৌর্য নতুন রাজা, আমি রয়েছি স্বাধীনভাবে (এইমাত্র বলে কথা সম্পূর্ণ না করে লজ্জার অভিনয়) একান্তভাবে পথপ্রদর্শনের বিষয়ে যা কিছু তৎপরতা ও উদ্যোগ, তার দায়িত্ব নিয়ে। এমতাবস্থায় হে প্রভু, আমাদের সাধ্য ও সিদ্ধির মাঝখানে এখন কেবল আপনার ইচ্ছামাত্রের ব্যবধান রয়েছে ॥১৫॥

মলয়কেতু—আর্য যদি এভাবে আক্রমণের প্রশস্ত সময় নির্ধারণ করে থাকেন, তবে আর বসে থাকা কেন? অতি-উচ্চ যার তটদেশ, বেগবান্ যার জলস্রোত, দুই তীরে যার শ্যামল তরুর সারি, ঊর্মিভঙ্গে মুখর যার বহতা জলধারা, প্রবাহ-সংঘাতে বিদীর্ণমান যার তটাঞ্চল এবং শোণবর্ণ (লাল) যার জলরাশি, সেই শোণনদকে পান করুক আমার শত শত মহাকায় মাতঙ্গ—অতি-উন্নত যাদের পৃষ্ঠদেশ, (যৌবন-মদে মত্ত) যাদের গা বেয়ে ঝরে পড়ে মদজলধারা, দেহ যাদের শ্যামবর্ণ, (কণ্ঠলগ্ন ধাতব ঘণ্টাধ্বনি তথা বৃংহণে) যারা মুখর, তীরের বুকে উৎখাত কেলির ক্ষতচিহ্ন এঁকে দেবে যাদের বড়ো বড়ো দাঁত এবং যাদের ললাটগুলো সিঁদুরের রঙে লাল। আরও—বর্ষার মেঘমালা যেমন মুহুর্মুহু গুরুগম্ভীর বজ্রনাদে (দশ দিক চকিত করে) ধারাসার বর্ষণে সর্বত্র জলে জলে একাকার করে দিয়ে বিন্ধ্যগিরিকে ঘিরে ফেলে, তেমনি আমার যূথপতিরা ঘোর গর্জন করতে করতে নিজেদের মদবারি-মিশ্র জলকণার ফোয়ারা ছড়িয়ে ছড়িয়ে (কুসুমপুর) নগর অবরোধ করুক ॥১৭।। (ভাগুরায়ণের সঙ্গে মলয়কেতুর প্রস্থান)

রাক্ষস—কই এখানে কে আছে হে?

পুরুষ—(প্রবেশ করে) অমাত্য আদেশ করুন।

রাক্ষস—প্রিয়ংবদক, দেখ তো জ্যোতিষী দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে?

পুরুষ—অমাত্যের যা আদেশ। (বেরিয়ে গিয়ে আবার এসে) অমাত্য, এই যে জ্যোতিষী ভিক্ষু।

রাক্ষস- (স্বগত। অশুভ নিমিত্ত দেখার অভিনয় করে) কী, প্রথমেই ভিক্ষু!

পুরুষ—জীবসিদ্ধি।

রাক্ষস—(প্রকাশ্যে) বিশ্রী যাতে না দেখায় সেভাবে নিয়ে এস।

পুরুষ—আচ্ছা। (নিষ্ক্রান্ত )

ভিক্ষু—‘অহৎ’গণ মোহব্যাধির চিকিৎসক। তাঁরা আপাতমাত্র কটু কিন্তু পরিণাম-মধুর হিতকর উপদেশ বিতরণ করেন। তাঁদের অনুশাসন আপনি পালন করুন ॥১৮॥

(এগিয়ে এসে) শরণাগতের কার্যসিদ্ধি হোক!

রাক্ষস—ভদন্ত[৯], আমাদের যাত্রার দিনটা দেখুন।

ভিক্ষু—(চিন্তার অভিনয় করে) শ্রাবক[১০] বিচার করে দেখলাম : এই পৌর্ণমাসীতে

চন্দ্র পূর্ণমণ্ডলেই থাকছেন। মধ্যাহ্নের পর থেকেই এই তিথিতে সর্বপ্রকার কল্যাণকর্ম প্রশস্ত। উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে আপনারা যাচ্ছেন, নক্ষত্রটাও আপনাদের অনুকূলে থাকছে। আর, এ সময় সূর্য অস্তাচলে ঢলে পড়বেন, চন্দ্র পূর্ণমণ্ডলে উদিত হবেন এবং কেতু উদিত হয়েই অস্ত যাবেন; সেই সময়ে বুধের অধিষ্ঠিত মিথুন লগ্নে যাত্রা করবেন[১১] ॥১৯॥

রাক্ষস—ভদন্ত, তিথিটাই যে শুদ্ধ নয়।

ভিক্ষু—শ্রাবক, তিথির ফল একগুণ, নক্ষত্রের ফল চতুর্গুণ এবং লগ্নের ফল চৌষট্টি গুণ—এটাই জ্যোতিষশাস্ত্রের সিদ্ধান্ত। কাজেই, লগ্নের শুভ যোগ রয়েছে

(অযথা কালক্ষেপের) দুষ্ট আগ্রহ অবিলম্বে ত্যাগ করুন। চন্দ্রের বলে যাত্রা করে আপনি স্থায়ী সিদ্ধি লাভ করবেন[১২] ॥২১।।

রাক্ষস—ভদন্ত, অন্য জ্যোতিষীদের সঙ্গে মিলিয়ে দেখুন।

ভিক্ষু—শ্রাবক মিলিয়ে দেখুন। আমি তবে চললাম।

রাক্ষস—ভদন্ত রাগ করলেন না তো?

ভিক্ষু—আপনার ওপর রাগ ভদন্ত করেননি।

রাক্ষস—কে করেছেন তবে?

ভিক্ষু—যম ঠাকুর। কেননা, নিজের লোকদের ছেড়ে আপনি পরের লোকদের পাত্তা দিচ্ছেন। (ভিক্ষুর প্রস্থান)

রাক্ষস—প্রিয়ংবদক, দেখ তো বেলা কত হল?

প্রিয়ংবদক—ভগবান্ সূর্য অস্তোন্মুখ।

রাক্ষস—(উঠে দেখে) তাই তো, ভগবান্ ভাস্কর অস্তগমনোন্মুখ। অতএব এই যে—যতক্ষণ উদয়াচল ছেড়ে সূর্য উপরের দিকে এগোচ্ছিলেন, ততক্ষণ তাঁর প্রতি অনুরাগে-রাঙা এই উপবন-তরুরা অবিলম্বে তাদের নিবিড় পত্রালির ছায়া রূপে সূর্যের আগে আগে বহুদূর এগিয়ে চলছিল! কিন্তু সূর্যের বিম্ব যখন পশ্চিমগিরি-প্রান্তে ডুবছে, তখন তারা তাঁর দিকে মুখ ফিরিয়ে চলে যাচ্ছে। প্রভুর সেবায় রত ভৃত্যগণ প্রায়ই প্রভুর ঐশ্বর্যক্ষয় হলে তাঁকে ত্যাগ করে চলে যায় ॥ ২২।।

[সকলে নিষ্ক্রান্ত]

।।’রাক্ষসোদ্যোগ’ নামে চতুর্থ অঙ্ক সমাপ্ত ॥

***

প্রসঙ্গকথা

চতুর্থ অঙ্ক

১. আচার্য ভরত বলেছেন :

“ইতিবৃত্তং তু নাট্যস্য শরীরং পরিকীর্তিতম্।
পঞ্চভিঃ সন্ধিভিস্তস্য বিভাগঃ সংপ্রকল্পিতঃ
(নাট্যশাস্ত্র ১৯/১)

এই পাঁচটি বিশেষ বিভাগ বা সন্ধির কথা বিশাখদত্ত এই শ্লোকে সুকৌশলে সূচিত করেছেন : আদি>মুখসন্ধি, বিস্তার>প্রতিমুখসন্ধি, গর্ভিত>গর্ভসন্ধি, বিমর্শ>বিমর্শসন্ধি এবং সংহরণ>নির্বহণসন্ধি। সন্ধি পাঁচটির সঙ্গে পাঁচটি অর্থপ্রকৃতির সম্পর্ক সংক্ষেপে দেখানো যাক্ : (১) মুখ শব্দের অর্থ আরম্ভ। মুখসন্ধিতে নাটকীয় বস্তু ‘বীজ’রূপে উপক্ষিপ্ত হয়! (২) মুখসন্ধির প্রতিকূল হচ্ছে প্রতিমুখ সন্ধি। এখানে ‘জলে তৈলবিন্দুর মতো’ নাট্যবস্তুর বিস্তার হতে থাকে। (৩) ‘বীজের হ্রাস, বৃদ্ধি, বিনাশ ও বিকাশের অনুরূপ সন্ধিস্থল’ হচ্ছে গর্ভসন্ধি। (৪) চতুর্থ সন্ধিতে বীজের বিকাশ বিশেষভাবে বিপৎসঙ্কুল হয়, ফলপ্রাপ্তি বিষয়ে বিশেষ চিন্তা বা ‘বিমর্শ” দেখা দেয়; তাই এর নাম ‘বিমর্শসন্ধি’। (৫) পঞ্চম বা অন্তিম সন্ধিতে নাটকীয় বস্তু রূপায়িত হয় অভিলষিত কার্যে, বীজ পরিণত হয় ফলে, সব কিছুর সমন্বিত ও যথাযথ প্রয়াস-পরিপাট্যে সাধিত হয় মুখ্য প্রয়োজন, নাটকের ইতিবৃত্ত পৌছে যায় উপসংহারে; তাই এই সন্ধির নাম নির্বহণ বা উপসংহৃতি। সমস্ত সন্ধির সুষ্ঠু পরিবেশন ও সমন্বয় সাধন করে সার্থক নাট্যসৃষ্টি যে কত কঠিন নাট্যকারের সেই স্বীকারোক্তিই এ শ্লোকে অকুণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে।

২. ‘মনুষ্যদেবতা’ শব্দটি প্রয়োগ করা হয়েছে রাজার সম্বন্ধে। রাজার দিব্যোৎপত্তির মতবাদ স্মরণীয় :

“বালেহপি নবমন্তব্যো মনুষ্য ইতি ভূমিপঃ।
মহতী দেবতা হোষা নররূপেণ তিষ্ঠতি।” (মনু ৭/৮)

৩. অর্থশাস্ত্রের ষষ্ঠ অধিকরণের প্রথম অধ্যায়ে রাজার আত্মগুণ বা আত্মসম্পদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কৌটিল্য বলেছেন, বাগ্মিতা, প্রগল্ভতা, স্মৃতিশক্তি, মননশীলতা, বলবত্তা, উদগ্রতা প্রভৃতি আত্মগুণ-সম্পন্ন রাজা নিজ নিজ গুণসম্পিिবহীন প্রকৃতিদেরও গুণসম্পন্ন করতে সমর্থ হন। আত্মসম্পদ্যুক্ত নীতিজ্ঞ রাজা ক্ষুদ্র ভূখণ্ডের অধিকারী হলেও প্রকৃতি-সম্পদের সহায়তায় সমগ্র পৃথিবীও জয় করতে পারেন।

৪. ভাগুরায়ণের অভিপ্রায়টা অনেকটা এরকম : নন্দভক্ত রাক্ষসের কাছে নন্দবংশ ধ্বংসের পর নন্দদের সঙ্গে বংশসম্পর্কের দিক থেকে চন্দ্রগুপ্তই যেন সমুদ্রে দিশাহারা পাখির কাছে জাহাজের মাস্তুলের মতো একমাত্র অবলম্বন : চতুর চর ভাগুরায়ণ রাক্ষসের বিরুদ্ধে মলয়কেতুর মন বিষিয়ে দিতে গিয়ে চন্দ্রগুপ্তের বংশসম্পর্ককেই (নন্দান্বয়) বিভেদের অন্যতম প্রধান হাতিয়াররূপে কাজে লাগাতে চাইল। আপাতদৃষ্টিতে রাক্ষস চন্দ্রগুপ্তের শত্রু, কিন্তু ভেতরে ভেতরে দুজনেই দুজনকে চায়! চন্দ্রগুপ্তও তো রাক্ষসকে পিতৃপরম্পরাক্রমে একান্ত অনুগত্য অমাত্যরূপেই জানে। অতএব সন্দেহ নেই, ভাগুরায়ণের এই ধূর্ততা সফল হয়েছিল।

৫. তাৎপর্য : নন্দ যেন রাজাদের মধ্যে চন্দ্রবিশেষ। নৈসর্গিক চন্দ্র কেবল কুমুদকে আনন্দ দেয়, কিন্তু নন্দরাজরূপ চন্দ্র সমগ্র জগতেরই আনন্দের হেতু। দুই চন্দ্রের মধ্যে দুস্তর ব্যবধান। আকাশের চন্দ্র থাকলেও নন্দরূপ পার্থিব চন্দ্র ব্যতীত কৌমুদী অর্থাৎ জ্যোৎস্না সকলকে পূর্ণাঙ্গ আনন্দ দিতে পারে না। অনুরূপ, কু-মুদ অর্থাৎ দুর্জনদের আমোদ বিধায়ক চন্দ্ৰ (‘কুমুদানন্দ’) অর্থাৎ চন্দ্ৰগুপ্ত থাকলেও ‘নৃপচন্দ্ৰ’ নন্দের অভাবে ‘কৌমুদী’ উৎসব সকলের নিকট আনন্দপ্রদ হবে না।

৬. অভিচরণ= অভিচার। সাধারণভাবে অভিচার বলতে ‘হিংসাকর্ম’ বোঝায় (‘হিংসাকর্মাভিচারঃ স্যাৎ’—অমরকোষ)। অথর্ববেদে ও তন্ত্রে অভিচারক্রিয়ার কথা বিশদভাবে বলা হয়েছে। সংক্ষেপে অন্যের হিংসাভিপ্রায়ে মারণ, মোহন, স্তম্ভন, বিদ্বেষণ, উচ্চাটন ও বশীকরণ নামক তন্ত্রোক্ত প্রক্রিয়াকে ‘অভিচার’ বলা হয়।

৭. ‘ব্যসন’ শব্দের অর্থ হচ্ছে—যা শ্রেয়োমার্গ বা ধর্ম তথা কল্যাণের পথ থেকে মানুষকে ভ্রষ্ট করে বা বিপরীত দিকে নিয়ে যায়, তাই ব্যসন প্রকৃতি। ব্যসনবর্গের আলোচনায় (অর্থশাস্ত্র ৮/১) কোটিল্য বলেছেন যে, মন্ত্রিব্যসন থেকে রাজব্যসনই অধিকতর অনিষ্টকর। কিন্তু আচার্য ভারদ্বাজের মতে এর বিপরীত—‘স্নাম্যমাত্যব্যসনয়োর- মাত্যব্যসনং গরীয়ঃ।’ কৌটিল্য অবশ্য ভারদ্বাজের মত মানেননি।

৮. ‘ভূত’ শব্দের অর্থ ‘সম’ করে কেউ কেউ অর্থ করেছেন পিতৃসম অর্থাৎ নন্দকুল চন্দ্রগুপ্তের কাছে পিতৃসম বা পিতৃকুলসম। অধ্যক্ষ রায় এই মতকে আরো জোরালো করেছেন এই বলে : ‘This is another proof that Chandragupta was not born in wedlock.’ Telang অবশ্য ‘পিতৃভূতম্’ পদটিকে ‘প্রজাদের নিকট পিতৃভূত বা পিতৃতুল্য’ অর্থে গ্রহণ করেছেন (পিতা ইব ভূতম্—সুপা)। তুলনীয় :

“প্রজানাং বিনয়াধানাদ্ রক্ষণাদ্ ভরণাদপি।
স পিতা পিতরস্তাসাং কেবলং জন্মহেতবঃ “ (রঘু ১/২৪ )

৯. বৌদ্ধ সাধু সন্ন্যাসীদের ‘ভদন্ত’ বলে সে যুগে সম্বোধন করা হত। ‘ভদন্ত’ শব্দটি ‘ভবৎ’ শব্দ থেকে নিষ্পন্ন।

১০. শ্রোতা, শিষ্য বা বুদ্ধের উপাসককে ‘শ্রাবক’ বলে অভিহিত করার প্রথা আছে।

১১. শ্লোকে বর্ণিত অবস্থা অনুযায়ী সন্ধ্যাকাল যাত্রার পক্ষে অতি প্রশস্ত সময়। ক্রুর গ্রহ সূর্য অস্ত যাবে, চন্দ্রের উদয় হবে, চন্দ্রোদয়ের অনুকূল প্রভাব ওই সময়ে পড়বে! কথায় বলে—‘চন্দ্রো লক্ষগুণাধিক্যঃ।’ ওই সময় লগ্ন থাকবে মিথুন, এবং বুধ তার অধিপতি! দক্ষিণে যারা যাবে, তাদের দক্ষিণদিকেই পড়বে সেই চন্দ্র। ওই চন্দ্র তো শুভই বটে। দুষ্ট গ্রহ কেতুও যাত্রার কালে উদিত হয়েই অস্তমিত হবে।

সূক্ষ্মবুদ্ধি সহৃদয় দর্শকের কাছে অবশ্য জীবসিদ্ধির ইঙ্গিত এই যে : হে বীর রাক্ষস, বুদ্ধের ‘লগ্নে’ অর্থাৎ চাণক্যের সঙ্গে সংযোগ স্থাপিত হলে মুখ্যামাত্যরূপ উচ্চ-পদমর্যাদা লাভের উজ্জ্বল সম্ভাবনা তোমার সুমুখে দেখা দেবে মলয়কেতু অভিযানে উদ্যোগী হবে, কিন্তু উত্থানমাত্রই তার পতন হবে, চন্দ্রগুপ্তের সার্বভৌমত্ব তখন পূর্ণমণ্ডলে প্রতিষ্ঠিত হবে।

১২. পূর্ণিমা তিথিতে যাত্রা ‘নাস্তি’।–রাক্ষস সেদিনের তিথির শুদ্ধতা সম্বন্ধে তাই সংশয় তুলেছিলেন। জীবসিদ্ধি কিন্তু রাক্ষসকে প্রায় ধমকে দেবার মতো করে একের-পর-এক স্বমতের অনুকূলে যুক্তি দেখাতে লাগলেন। তাঁর শেষের সারকথা হল : কার্যঘাতী দুষ্ট আগ্রহকে প্রশ্রয় দিও না। সংশয়ে বা বিকল্পে কাজ কী? বেরিয়ে পড়। লগ্ন শুভ; ক্রূর গ্রহ সূর্য এবং দুষ্ট কেতু তো বাদ পড়েই যাচ্ছে। অতএব শুভস্য শীঘ্রম্।

গূঢ় অর্থ হচ্ছে : এই সময়ে (চাণক্যের সঙ্গে তোমার) মিলন অতি কল্যাণকর হবে, নন্দবধের প্রতিশোধ নেবার নিষ্ঠুর অভিসন্ধি পরিহার কর। চন্দ্রের অর্থাৎ চন্দ্রগুপ্তের ভদ্রভটপ্রমুখ বাহিনীর সঙ্গে (‘বলেন’) গিয়ে তুমি চিরলাভবান হবে অর্থাৎ চন্দ্রগুপ্তের মুখ্যামাত্য হয়ে সুচিরকাল সুখসমৃদ্ধি লাভ করবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *