৮
একদিন সকাল নয়টা ত্রিশ মিনিটে দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে শিহাবের ঘুম ভাঙ্গে। দেরি করে ঘুম থেকে উঠার অভ্যাস তার দীর্ঘদিনের। রফিক সাহেব ছাতা হাতে অর্ধেক ভেজা শরীরে দাঁড়িয়ে আছেন।
শিহাব বললো, “আপনি?”
রফিক সাহেব বললেন, “তোমার পান্থপথের বাসাতেও একই সমস্যা ছিল। কলিংবেল নষ্ট।”
“এত সকালে? জরুরি কিছু?”
“এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম।”
রফিক সাহেব ছাতা রেখে বসার ঘরে গিয়ে বসলেন। তার বসার ভঙ্গিমা বলে দেয়, তিনি এমনি এমনি এদিক দিয়ে যেতে যেতে আসেননি। কোনো একটা কারণে এসেছেন।
“চায়ের ব্যবস্থা করা যায়?” বললেন রফিক সাহেব।
শিহাব চা বানাতে রান্না ঘরে যায়। রফিক সাহেব বললেন, “একা থাকো নাকি?”
“একজন থাকে আমার সাথে। হাসান নাম।”
‘কোথায় সে?”
“ঘুমোচ্ছে। আজ বন্ধের দিন। অফিস নেই তার।”
রফিক সাহেব চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, “গল্পটা কতদূর?”
শিহাবের ইচ্ছে করলো না সান্ত্বনা দিতে। বললো, “আপাতত এই গল্প লিখছি না।”
“তাহলে?”
“ভাবছি কবিতার একটা বই লিখব। নাম হবে, ‘আমি মাঝেমধ্যে কবিতা লিখি।”
রফিক সাহেব বিড় বিড় করে বললেন, “আমি মাঝেমধ্যে কবিতা লিখি?”
শিহাব বললো, “জি। গল্প তো এগোচ্ছে না।“
এর ভেতরে হাসানের ঘুম ভাঙ্গে। বাইরে থেকে নাশতা এনে তিনজন আলাদা মানুষ একসাথে নাশতা করলো। মুরগির মাংসের স্যুপ, পরোটা আর আলু ভাজি। আলাপে যোগ দেয় হাসান।
রফিক সাহেব বললেন, “আমার কাছে এই রুমমেটের বিষয়টা দারুণ লাগে। একের অধিক অচেনা মানুষ আলাদা জীবন, আলাদা আসবাবপত্র নিয়ে একসাথে থাকে।“
হাসান মাথা নাড়ে।
রফিক সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন, “এই যে সে সারারাত বাতি জ্বালিয়ে লিখে, তোমার অসুবিধা হয় না?”
হাসান বললো, “আলোতে আমার অসুবিধা হয় না।”
তারপর খানিকটা বিরতি নিয়ে মৃদু স্বরে বললো, “তবে নিতুর সমস্যা হতো। সে যখন ঘুমাতো, কবরের মতো অন্ধকার করে ঘুমাতো।”
“নিতু কে?” রফিক সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন।
“আমার স্ত্রী।”
“সে কোথায়?”
“চলে গেছে, দুবছর আগে।”
“কোথায়?”
হাসান কথার জবাব না দিয়ে ভাবলেশহীন হয়ে তাকিয়ে থাকে। নিতু কোথা থেকে এসেছে, কোথায় গিয়ে থেমেছে এসব এক কথায় বলা যায় না।
রফিক সাহেব শিহাবকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “এখন তাহলে কবিতা
লেখা হচ্ছে?”
শিহাব বললো, “জি। আপনাকে একটা কবিতা বলি।”
“নাইট ক্লাবে হঠাৎ একদিন বেহালা বেজে উঠে
ডিসকো তালের অন্তরমহলে কোথায় একটা অতীত,
যেটা ‘ভুলে গিয়েছি’ ভেবে এতকাল জানতে পারিনি।
হঠাৎ কাতর প্রাণে বেহালার শব্দে,
এই রঙিন বাতির ক্লাবে অন্ধকার নেমে আসে
যেন একটা অন্ধ চড়ুই পাখি,
আকাশের উত্তর দক্ষিণ ভুলে করে,
ধাক্কা খায় ইলেকট্রিসিটির তারে।
নাইট ক্লাবে হঠাৎ একদিন বেহালা বেজে উঠে।”
শিহাবের কাছে মনে হয় সে কবিতা লিখতে পারে না। তার কবিতাগুলো উপন্যাসের খণ্ডচিত্র হয়। কত বিস্তর প্রাচীন বিষণ্ন পথ পারি জমালে এই পথের শেষ হবে? সেটা কবিতায় লেখা থাকে না, কবিতায় শুধু ধাক্কাটা দেয়া হয়।
কত প্রেম- অশান্তি, কত মানুষের যোগ বিয়োগ গুণ ভাগে আজ এখানটায় এসে দাঁড়িয়ে। একা থাকাটা কেমন অভ্যাস হয়ে গেছে। সবাইকে নিয়ে একা থাকাটা অনেক বেশি কষ্টের সবাইকে ছাড়া একা থাকার চাইতে। একসময় দুপুর- রাতে ডাইনিং টেবিল ভর্তি মানুষ ছিল। তারপর একদিন একটা সাজানো গোছানো সংসার, ঠেলাগাড়িতে করে নিয়ে যাওয়া পুরাতন আসবাবপত্রের দোকানে।
.
সময়ের উৎখাতে শিহাবের চিন্তার বিষয় বস্তু বদলাতে শুরু করে। দুটো সরল অংক মেলাতে পারছে না, বহুদিন থেকে। একটা রফিক সাহেব, অন্যটা হাসান। রফিক সাহেবকে নিয়ে সমস্যা আসলে রফিক সাহেবকে নিয়ে না। যে গল্প শিহাব লিখছে,গল্প এগোচ্ছে না। একটা কিছু লিখে প্রশংসা কুড়িয়ে, সেইগুলো চোখের সামনে মাড়িয়ে আত্মতুষ্টিতে ভোগা; এসব তার ধাঁচে নেই।
শিহাবের দ্বিতীয় সমস্যা হাসানকে নিয়ে। শিহাব তার গল্প ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। কোনো কিছু বুঝতে যখন তার অসুবিধা হয় তখন সেটা সে আবার প্রথম থেকে চিন্তা করে। একই গল্প, একই বিষয় বস্তু, যখন আবার প্রথম থেকে চিন্তা করা হয় তখন সেখান থেকে দুর্দান্ত রকমের লুকায়িত জিনিস বের হয়ে আসে।
হাসানের ক্ষেত্রেও শিহাব তাই করে চলেছে। কথা প্রসঙ্গে একদিন জানতে পারে, হাসানের স্ত্রী দুবছর আগে চলে গেছে। নিতুর সাথে প্রথম যেদিন দেখা হয়েছিল, তারা দুজন ট্রেন থেকে একটা ভুল স্টেশনে নেমে গিয়েছিল। তখন শ্রাবণ মাস। মুষলধারে বৃষ্টি। অন্ধকার প্ল্যাটফর্মে একটু একটু আলাপ।
আলাপের বিষয়বস্তু ছিল ইডিপাসের গল্প। থিবস নগরের রাজা ইডিপাস। তিনি একদিন প্রচণ্ড অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও দেবতার অভিশাপে পিতার হত্যাকারী আর মায়ের শয্যাসঙ্গী হন।
শিহাব চোখ বন্ধ করে চিন্তা করতে থাকে, ইডিপাসের গল্প এসেছে কোথা থেকে? তারপর চিন্তামুক্ত হয়, কবি শেলির বই থেকে। নিতু কবি শেলির একটা বই পড়তে শুরু করলে, হাসান তাকে বলেছিল, এই কবি খুব অল্প বয়সে দুর্ঘটনায় মারা যায়। সেই সময় কবির জ্যাকেটের পকেটে পাওয়া গিয়েছিল সফোক্লিসের বিখ্যাত গ্রন্থ ইডিপাস।
সেদিন সকাল আটটায় একটা লোকাল ট্রেনে করে তারা পৌঁছায় খুলনা জংশন রেলওয়ে স্টেশনে। রাতের দীর্ঘ ঘটনার সহিত পরিচয়ের সূত্রধরে হাসান একটা সিএনজি করে নিতুকে তার বাসা অবধি পৌঁছে দেয়। নিতু বাসা থেকে পালিয়ে খুলনায় তার এক বান্ধবীর বাসায় গিয়ে উঠেছে।
আর হাসান? গিয়েছিল অফিসের কাজে। এরপর একটা মুহূর্তের প্রসঙ্গ ধরে তারা প্যারিস শহরের অলিগলি যেন একসাথে হেঁটে ক্লান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল আইফেল টাওয়ারের সামনে।
কয়েক লাখ রঙিন বাতি একসাথে রং বদলাতে শুরু করলে তারা ফিরে আসে কবি শেলির কাছে। নিতু হাসানকে বইটা দিয়ে বলে, “ফেরত দিতে হবে না।”
শিহাব চোখ বন্ধ করে চিন্তা করে। মূলত হাসানের বর্ণনা জটিল হতে শুরু করে এখান থেকে। বইয়ের ভাঁজে রেখে দেয়া এক চিরকুট হতে গল্পে রুদ্রের উত্থান। রুদ্রের সেই চিঠির ভেতরে তারাপদ রায়ের এক হৃদয় নিংড়ে উজাড় করে দেয়া কবিতা। কবিতার একেকটি অক্ষরের ভেতরে ছিল শত বছরের পুরানো ক্ষোভ।
তারপর একদিন হয়তো জানা যাবে
বা হয়তো জানা যাবে না, যে
তোমার সঙ্গে আমার
অথবা;
আমার সঙ্গে তোমার
আর দেখা হবে না।
শিহাব সেই চিঠি বিশেষ খন্ডে ব্যাখ্যা করার তাগিদ অনুভব করে। চিঠিতে রুদ্র নামে এক যুবকের সাথে নিতুর প্রণয়ের এক ঐতিহাসিক মুহূর্তের বর্ণনা পাওয়া যায়। রুদ্র ঘুম থেকে উঠে দেখে নিতু একটা পাগড়ি আর শেরওয়ানি নিয়ে এসেছে, তারা দুজন আজ বিয়ে করবে। কিন্তু তাদের বিয়ে হয়েছিল কি না সেই বয়ান চিঠিতে লেখা ছিল না।
যেহেতু বইয়ের ভাঁজে পাওয়া চিঠি হাসান পড়েই ফেলেছে, তাই ভুল ষ্টেশনে নেমে পড়া এই মেয়েটি বিবাহিত নাকি অবিবাহিত? সেটা জানবার তাগিদ থেকেই সেবার অফিস থেকে ছুটি নিয়ে খুলনায় যায়, নিতুর কাছে।
নিতু বলতে শুরু করে আরও গোড়া থেকে। সে যাচ্ছিলো কক্সবাজারে। তারপর বাসের সীট না পেয়ে অপেক্ষাকালীন অচেনা লোকের খপ্পরে পড়ে আকস্মিক রুদ্রের সাথে পরিচয়। সেই বর্ণনা রাতের টহল পুলিশ, পাগলের ঘুড়ি উড়ানো শেষ করে সকালে বনানীর বাসায় গিয়ে থামে। সেখান থেকে লিওনার্দো কোহেনের হাত ধরে চিলেকোঠার ছাদে গিয়ে একটু আকাশ দেখার জন্য শান্ত হয়ে বসে।
একসময় জানা যায় সেদিন সকালে রুদ্রের সাথে নিতুর বিয়ে হয়েছিল। বিয়ে করে তারা কথা বলছিল, মুহূর্ত নিয়ে। সুখের প্রত্যেকটা মুহূর্তকে তারা টেনে টেনে বড়ো করতে চেয়েছিল, অথচ আজ এইখানটায় নিতু বাসা থেকে পালিয়ে খুলনায় অচেনা এক আগন্তুক হাসানের সামনে দাঁড়িয়ে। জীবন ও জগতের এ এক অতি আশ্চর্যের বিভ্রম।