শেষ – ১০

১০

একটা জীবনের সাথে দূরে কোথাও অন্য একটা জীবনের এই যে সম্পর্ক, সেটাকে আত্মার সাথে তুলনা করা যেতে পারে। যার অস্তিত্ব আছে কিন্তু দেখা যায় না। শিহাব সেই অস্তিত্বের ভেতরে ঈশ্বরের সন্ধান খুঁজে পায়। মনে হয় কেউ একজন অনেক দূরে বসে সব নিয়ন্ত্রণ করছে।

ধরা যাক সেদিন রাতের কথা। নিতু একটা বাস কাউন্টারে কক্সবাজার যাবার বাসের টিকেট না পেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাত তখন এগারোটা। সে বাসায় ফিরে যাবে না। সকালের বাসে করে সমুদ্রে যাবে। এমন সময় একটা উটকো লোক তাকে উত্তপ্ত না করলে সে রুদ্র নামে এক অচেনা যুবকের কাছে গিয়ে লাইটার চাইতো না।

রুদ্রের উৎপত্তি না হলে বইয়ের ভাঁজে এরকম একটা চিঠির কোনো অস্তিত্ব থাকতো না। এর জন্য রুদ্রকে ঠিক সেই সময়ে এরকম একটা যাত্রী ছাউনির বেঞ্চে বসে থাকার সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। এই যে একটা গল্প তৈরি হওয়ার পেছনে অনেক গুলো মানুষকে মনের অজান্তে সিদ্ধান্ত নিতে হয়, কোথাও না কোথাও এর একটা যোগসূত্র আছে নিশ্চয়ই।

হাসান বলতে শুরু করে, “খুলনা থেকে ফিরে আসার পর আবার পুরোদমে অফিস। অফিসে তখন কাজের চাপ প্রচুর। ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যেতো। এসে দেখতাম, মেজো মামা বাতি বন্ধ করে শুয়ে আছেন। আমার আগমন আশংকা করলে মুখের ভেতরে একটা অভিযোগের ছাপ এনে বলতেন, “দেরি কেন?”

একদিন অফিস থেকে ফিরে এসে দেখি টিভির সামনে বসে হুইল চেয়ারের উপর ঘাড় বাঁকা করে ঘুমিয়ে গেছেন। তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। যখন জীবন খুব গতিময় তখন হয়তো ঘুণাক্ষরেও ভাবেননি, এরকম একটা জীবন ভোঁত পেতে অপেক্ষা করছে। অন্ধকার ঝোপের আড়ালে যেরকম অপেক্ষা করে শিকারি। যেরকম রিলিফের ত্রাণের জন্য অপেক্ষা করে, নদী ভাঙ্গা শোকে ক্ষুধার্ত পাকস্থলি।

একদিকে অফিসে কাজের চাপ, অন্যদিকে মেজো মামার মন খারাপ করে দেয়া সংসার। এরকম একটা সময়ে একদিন বিকেলে যাই নিতুদের বনানীর বাসায়। কলিংবেল বাজতেই দরজা খুলে দিলো তিশা। বললো, “কার কাছে এসেছেন?”

“নিতুর কাছে।”

“আপু তো বাসায় নেই।”

আমি বললাম, “ফোন বন্ধ পাচ্ছি।”

আমাকে বসতে দিয়ে তিশা চলে গেল। বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা। একা একা বসে আছি। বাসাটা এমন যে কেউ আমাকে না চিনলেও প্রত্যেকের ভেতরে কী চলছে আমি জানি।

সন্ধ্যা সাতটায় নিতু বাসায় এলো। আমাকে দেখে অস্বস্তি নিয়ে বললো, “আপনি?”

আমি বললাম, “এমনিতেই এসেছি। আপনার ফোন বন্ধ পাচ্ছি।” নিতু ক্লান্ত গলায় বললো, “রুবা আন্টির বাসায় গিয়েছি।

“আংকেল কোথায়?”

“তার সাথেই আছেন। অবশ্য আমি যখন গিয়েছি বাসায় ছিলেন না।”

“তারা বিয়ে করেছেন?”

“না। শীঘ্রই করবেন।”

“তাহলে কেন গিয়েছেন?”

‘কোনো কারণ নেই, এমনিতেই।”

আমি বললাম, “রুবা আন্টি কী বলেছেন?”

“তিনি বাবাকে নিয়ে স্পেনে চলে যেতে চান। সেখানেই বিয়ে করবেন।”

“আর মা?”

“মা আছেন তার মতো করে। সারাদিন নিজের ঘর থেকে বের হন না। “তিশা?”

“ওর বিয়ের কথা বার্তা চলছে। আগামী মাসে বিয়ে।”

“এই সময়ে বিয়ে?”

“বাবার বিয়ে হবার আগে ওর বিয়ে হওয়া জরুরি না?”

আমরা দুজন কথা বলছিলাম জীবনের এমন এক দোদুল্যমান সময়ে, এক পাশ ঢলে পড়লেই নৌকা ডুবে যাবে। শর্তহীন সরল সম্পর্কের চাপিয়ে দেয়া কৌতূহল আমাদের যতটা না ঘনিষ্ঠ করে তারচেয়ে বেশি, দূরত্ব কমিয়ে আনে।

হঠাৎ কলিংবেলের শব্দ। নিতু দরজা খুলে হা হয়ে তাকিয়ে থাকে। বাংলা অভিধানে ‘কিংকর্তব্যবিমূঢ় ‘ শব্দটা ঠিক এরকম সময়ের জন্য এসেছে। নিতু অপ্রস্তুত গলায় বললো, “আনিকা!”

আনিকা আড়ষ্ট হয়ে বসলো এক পাশে। বললো, “কেমন অদ্ভুত না? আমাদের আজই প্রথম দেখা।’

নিতু মৃদু স্বরে বলে, “আমি মাত্রই তোমাদের বাসা থেকে আসলাম।”

“হ্যাঁ আমি বাইরে ছিলাম।” একটু জিরিয়ে যোগ করে, “এবারই প্রথম বাংলাদেশে এসেছি।”

নিতুর ভেতরে তেমন কোনো চমকপ্রদ ব্যাপার লক্ষ্য করা গেল না। চাপা গলায় বললো, “হঠাৎ?”

“কোথাও না কোথাও আমাদের একসাথে থাকার কথা ছিল, অথচ আমরা কত আলাদা।“

নিতু চুপ করে থাকে। আনিকা তখন নিতুর হাতে একটা কাঠের বাক্স দিয়ে বললো, “এটা তোমার জন্য।”

“এটা কী?”

“এটা হলো টরোর শিং দিয়ে বানানো শোপিস।”

“টরো কী?”

“টরো হচ্ছে ষাঁড়ের স্প্যানিশ নাম। সেখানে একটা ‘বুল রানিং ফেস্টিভ্যাল’ হয়। সবাই যে খুব উৎসাহ নিয়ে এই খেলাটা খেলে ঠিক তা না, যারা সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে, তারাও একটা শেষ চেষ্টা হিসেবে এই খেলায় অংশ নেয়।”

তাদের কথার মাঝখানে ব্যাঘাত ঘটিয়ে আমি বললাম, “শেষ চেষ্টা হিসেবে কেন?”

আনিকা বললো, “নিয়মটা হলো এমন, আপনাকে দৌড়াতে হবে। আপনার পেছনে ছুটছে ক্ষিপ্ত ষাঁড়ের দল। কেউ কেউ রেইস থেকে সরে যায়, কিংবা ষাঁড়ের পদপিষ্ট হয়ে মারা যায়। আর যারা টিকে থাকে রেইসের শেষ পর্যন্ত, তারা মনে করে জীবন তাদেরকে আরেকটা সুযোগ দিয়েছে, সেকেণ্ড চান্স লাইফ।”

নিতু বললো, “আমাদেরও তাড়া করছে ষাঁড়ের দল। আমার মা ষাঁড়ের পদপিষ্ট হয়ে দেখছেন একটা হিংস্র ষাঁড় করুণ চোখে তাকিয়ে আছে।”

“করুণ চোখে তাকিয়ে আছে কেন?” জিজ্ঞাসা করে আনিকা।

নিতু জবাব না দিয়ে বলে, “একটা কথা আছে প্রকৃতি কিছুই ভুলে না। সময়ের ব্যবধান মাত্র।“

“কীরকম?”

“বাবার সাথে ছাব্বিশ বছর আগেই তোমাদের একসাথে থাকার কথা ছিল। আজ আমরা যে কারণে একসাথে হয়েছি সেদিন একই কারণে আলাদা হয়েছি।”

“সবকিছু ভুল হলে, নিয়তি কোনটা?”

নিতু মন খারাপ করে টরোর শিং এর দিকে তাকিয়ে থাকে। ইন্দ্রিয়ের ভেতরে ইচ্ছেগুলো ডানা ঝাপটায়, রাজহাঁসের মতো। এখনি ডুবে যাবে বস্তুগত সূর্য, ভাবগত প্রেম অথবা জীবন।

আলোচনায় যোগ দেয় তিশা। আমি চলে যাবার জন্য উঠে দাঁড়ালে নিতু বললো, রাতের খাবার খেয়ে যেতে। সেই খাবার খেতে খেতে রাত দশটা। নিতুর মাকে জানানো হয়েছে আনিকা এসেছে।

তিনি দীর্ঘসময় পর উপস্থিত হলেন। বললেন, “তুমি আনিকা?”

আনিকা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়িয়ে চুপচাপ বসে থাকে। বলবেও বা কী! কিছু কিছু সম্পর্ক থাকে; জীবনে খুব প্রভাব ফেলে কিন্তু বলবার মতো কথা থাকে না।

খাবার শেষ করে আবিদা সুলতানা তার ঘরে চলে গেলেন। নিতু আর আনিকা কথা বলছিল ছাব্বিশ বছর আগের একটা ভুলের ভিন্ন ভিন্ন গল্প নিয়ে। কেউই তার বৃত্তের বাইরে থেকে চিন্তা করতে পারে না।

নিতুর কাছ থেকে শোনা একই গল্প যখন আনিকার কাছ থেকে শুনছিলাম, গল্পটা অন্যরকম মনে হলো। সবই সত্য, পার্থক্য হলো আপনি কোন সত্যটাকে সত্য মনে করেন। সকাল হয়ে গেছে; এর মানে এই না যে, কোথাও কোনো রাত নেই। এর মানে হলো আলোর প্রতিফলনে অন্ধকার ঢেকে গেছে।

আনিকা বললো, “আমার জন্ম হয়েছে স্পেনে। যখন একটু বড়ো হই তখন জানতে পারি, আমার বাবা আমার মাকে বিয়ে করেননি। জন্মের দুবছর পর এক বাঙালির সাথে মায়ের বিয়ে হয়। সেই সম্পর্কটা অবশ্য বেশিদিন টিকেনি। মায়ের সাথে ডিভোর্স হবার পর সেই ভদ্রলোক বাংলাদেশে ফিরে গেছেন।

এদিকে আমি স্কুল থেকে কলেজ পেরিয়ে চাকরি করতে শুরু করি। কিন্তু আমার বাবার সাথে আমার কখনো দেখা হয়নি। কীরকম স্যাঁতসেঁতে একটা দুঃখ। একদিন দেখতে চাইলে মা আমাকে বাবার একটা ছবি দেখায়। বাবার সাথে আমার সম্পর্ক, ঐ ছবি পর্যন্তই।

বাবাও কখনো যোগাযোগ করেনি, মাকেও এই নিয়ে কোনো কথা বলতে দেখতাম না। বোধহয় মা বলতে চাইতেন না। একদিন শুধু বললেন, বাবা তার বান্ধবীকে বিয়ে করেছেন। সেই বান্ধবী হলো তোমার মা। আমাদের দুজনের সম্পর্ক কত আলাদা অথচ কষ্টটা একই রকম।”

নিতু গালে হাত দিয়ে শুনছে। আনিকা বলতে থাকে, “এরপর বহুবছর পর মা একদিন থাইল্যান্ড গেলেন ট্যুরে। আমার যাবার কথা থাকলেও শেষ মুহূর্তে বাতিল করি। সেখানেই বাবার সাথে মায়ের দেখা। হয়তো এরকমটাই হবার ছিল।”

নিতু বললো, “বাবার সাথে তোমার আগে দেখা হয়নি?”

“না। দেখা হয়নি। আমি যখন ছোটো ছিলাম তখন মা বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলতেন। যে ভদ্রলোকের সাথে মায়ের বিয়ে হয়েছিল একসময় আমি তাকে বাবা বলেই জানতাম। ছোটো ছিলাম তো, স্মৃতি হাতড়ে যতটুকু শুনেছি, তিনি আমাকে আদর করে ডাকতেন আনু।”

নিতু জিজ্ঞাসা করে, “তিনি কোথায়?”

“এবার যখন দেশে আসি, সেই ভদ্রলোকের সাথে যোগাযোগ করি। তিনি আরেকটা বিয়ে করেছেন। মগবাজার থাকেন।”

“দেখা হয়েছিল?”

“হ্যাঁ। আমাকে দেখে চিনতে পারলেন না। আমি বললাম, আমি আনিকা। আমি যখন খুব ছোটো ছিলাম তখন আপনি আমাকে আদর করে, ‘আনু’ বলে ডাকতেন।”

নিতু বললো, “বাবা স্পেনে গিয়ে তোমার মাকে বিয়ে করবেন। তোমরা একসাথে থাকবে। সমস্যা তো আর নেই।

আনিকা বললো, “আমি থাকছি না তাদের সাথে।”

“কেন?”

“বাবাকে আমি ঘৃণা করি।“

“বাবাকে ভালোবাসার একটা কারণও কি নেই?”

“আমি যখন মায়ের গর্ভে, বয়স চার মাস, তিনি আমাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিলেন। চার মাস বয়সের একটা ভ্রূণের শ্রবণেন্দ্রিয় কাজ করে। সে মায়ের হৃদস্পন্দন শুনতে পায়।”

আনিকা ব্যাগ থেকে কয়েকটা ছবি বের করে বললো, “ছবির মানুষগুলো প্রত্যেকে আমাকে বৃত্তের চারপাশ থেকে ডাকছে। তাদের সাথে আমার কখনো দেখা হয় না কিন্তু তাদের নিয়েই আমার জীবন।”

নিতু হাতে নিয়ে ছবিগুলো দেখছে। ছবিতে ঘুরে ফিরে কয়েকজন মানুষ। নিতু, তিশা, আবিদা সুলতানা, আজগর হোসেন। নিতু বললো, “তাই বুঝি বাংলাদেশে এলে?”

এর ভেতরে একটা ছবি দেখে আমার চোখ কপালে উঠে গেল। আমি বললাম, “এই ছবি এখানে কেন?”

আনিকা বললো, “মানে?”

আমি বললাম, “এই ভদ্রলোক আমার পরিচিত।’

আনিকা বললো, “আপনি চিনেন উনাকে?”

আমি বললাম, “জি। ইমতিয়াজ আংকেল।”

আনিকা বললো, “উনার কথাই তো বলছিলাম। আমার মা স্পেনে চলে যাবার পর উনাকে বিয়ে করেন। পরে অবশ্য সম্পর্কটা টিকে নাই। মা আমাকে নিয়ে দীর্ঘ পথ একা পাড়ি দিলেন।’

আমি বললাম, “তারপর তিনি দেশে ফিরে একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। বহুবছর পর সেখানেই এক কলিগের সাথে তার বিয়ে হয়।”

আনিকা বললো “আপনি এত কিছু জানলেন কী করে?”

নিতু বিস্মিত হয়ে তাকায় আমার দিকে।

আমি বললাম, “আমি বড়ো হয়েছি মেজো মামার বাসায়। মেজো মামির সাথে তার অফিসের এক কলিগের সম্পর্ক ছিল। একসময় মামা প্যারালাইজড হয়ে পড়লে, মেজো মামি ডিভোর্স দিয়ে চলে যান। পরে জানতে পারি, সেই কলিগের সাথেই বিয়ে হয় মামির। ইনিই সেই ইমতিয়াজ আংকেল।”

আমরা প্রত্যেকে একে অন্যের দিকে চুপ করে তাকিয়ে রইলাম। আনিকা ঠিকই বলেছিল, সবকিছু ভুল হলে নিয়তি কোনটা?”

কথার এই পর্যায়ে হাসানকে থামিয়ে দিয়ে শিহাব বললো, “তুমি গল্পটা বেশ জটিল করে ফেলছো।”

“কীরকম?”

এই গল্পের সাথে ইমতিয়াজ নামে ভদ্রলোকের সম্পর্ক কোথায়?”

“আপনি কি বুঝতে পারছেন না?”

শিহাবকে চিন্তিত মনে হয়।

কেউ কারো জায়গা নিতে পারে না। একজনের শূন্যস্থান কখনো অন্যজন পূরণ করতে পারে না। শূন্যস্থানের নিচে যেমন দাগ (——) থাকে; অন্তরেও থাকে।

১১

“একদিন-
নাইট ক্লাবে ডিস্কো বিট উপেক্ষা করে বেহালা বেজে উঠে
বুকের ভেতরে খঞ্জর দিয়ে গাঁথা বিশ্বাস উস্কানি দিয়ে উঠে”

রফিক সাহেব কবিতার এই জায়গায় আপত্তি করে বললেন, “পরপর দুবার ‘উঠে’ শব্দটা দিয়ে শেষ হয়েছে। এটা চোখে লাগছে।“

শিহাব বললো,”
‘যখন নাইট ক্লাবে ডিস্কো বিট উপেক্ষা করে বেহালা বাজে,
বুকের ভেতরে খঞ্জর দিয়ে গাঁথা বিশ্বাস উস্কানি দেয়।’
এবার ঠিক আছে?”

রফিক সাহেব হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে বললেন, “এবার ঠিক আছে। কিন্তু নাইট ক্লাবে এই বেহালা বাজার বিষয়টা ঠিক বুঝতে পারছি না।”

“নাইট ক্লাবে কেউ বেহালার শব্দ শুনতে যায় না। একটা অপ্রত্যাশিত মুহূর্তকে পোট্রে করতে চেয়েছি।

“জীবনের চরম সত্য অপ্রত্যাশিত কেন হবে?”

“কারণ আমাদের প্রত্যাশা সত্য ছিল না।”

রফিক সাহেব উদগ্রীব হয়ে জানতে চাইলেন, “সত্য কী?”

শিহাব বললো, “আলোই জীবনের সার্থকতা না। সার্থক জীবন অন্ধকারেও হয়।”

রফিক সাহেবকে আলো এবং অন্ধকার নিয়ে চিন্তিত মনে হলো না। তিনি বললেন, “এখন তাহলে মাঝেমধ্যে কবিতা লিখছো?”

শিহাব মাথা নাড়ে। রফিক সাহেবের হঠাৎ আগমন তার কাছে পরিষ্কার না। সে বললো, “কোনো বিশেষ কাজে এসেছেন?”

“তুমি একা মানুষ, ভাবলাম দেখে যাই। “একা থাকার মানেই একাকিত্ব না।”

“তোমার কাছে একাকিত্ব মানে কী?”

“যার কেউ নেই, সে একা না। যে কারো না, সে একা।“

শিহাব একটা সত্য জানতে চায়। অর্ধেক দ্বিখন্ডিত জ্যান্ত আধমরা সত্য। পোড় খাওয়া তাপের মতো মাঝরাতে ঘুম ভেঙে আর ঘুম না আসার মতো সত্য। এরপর হাসানের সাথে যখন দেখা হলো, বললো, “তারপর কী হলো? আজগর হোসেন বিয়ে করেছিলেন?”

হাসান বললো, “জি। বট পাতায় করে অতিথিদের নিমন্ত্রণ পত্র পাঠানো হয়েছিল।”

“ধুমধাম করে বিয়ে নাকি?”

“আজগর হোসেন তার প্রথম বিয়ে করেছিলেন কাপুরুষের মতো। তাই দ্বিতীয় বিয়ে খুব ঢাক ঢোল বাজিয়ে করলেন। “

শিহাব জানতে চাইলো আনিকার কথা। হাসান বললো, “একদিন রাস্তায় দেখা হয়েছিল। আমাকে দেখে বললো, শুনেছেন নিশ্চয়ই, বাবার বিয়ে।”

“জি, নিতুর কাছ থেকে শুনেছি।”

আনিকা রসিকতা করে বললো “এত বছর পর আমার বাবা-মায়ের বিয়ে! আমার তো ব্যস্ততার শেষ নেই।”

আমরা রাস্তার পাশে একটা ফাস্টফুডের দোকানে গিয়ে বসলাম। সে ইমতিয়াজ আংকেলকে বিয়ের কার্ড পাঠাতে চায়। আমি বললাম, “ ইমতিয়াজ আংকেল?”

আনিকা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলে, “কেন না?”

আমাদের সবাইকে অবাক করে দিয়ে বিয়েতে ইমতিয়াজ আংকেল এসেছিলেন। রুবা আন্টির সামনে গিয়ে যখন দাঁড়ালেন, ফটোগ্রাফাররা সেই সময় ছবি তুলছিল। তিনি হাসি মুখ করে ক্যামেরার দিকে তাকালেন। ছবিতে চোখ বন্ধ আসার কারণে একই কায়দায় দাঁড়িয়ে আরও কটা ছবি তুললেন।

আজগর হোসেন বললেন, “আপনি তাহলে ইমতিয়াজ সাহেব?”

ইমতিয়াজ আংকেল ছবি তোলার সময় যে হাসিটা দিয়েছেন, সেটা ধরে রাখলেন মুখে। তারপর একসময় আমাকে দেখে হয়তো বা বিব্রতবোধ করছিলেন। বিস্মিত হয়ে বললেন, “তুমি?”

আমি বললাম, “আনিকা আমার পরিচিত।”

সম্পর্কের কিছু ঋণ হয়তো বা থেকে যায়, সেটা শোধ করতে গেলে ঋণ কমে না, বরং বেড়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ এর একটা দারুণ ব্যাখ্যা দিয়েছেন “তোমারে যা দিয়েছিনু সে তোমারি দান- গ্রহণ করেছো যত, ঋণী তত করেছো আমায়। “

১২

কিছু কিছু মেঘ থাকে যে মেঘ থেকে কখনো বৃষ্টি হয় না। তেমনি কিছু কিছু বৃষ্টি থাকে যা কখনো জমিনে এসে পড়ে না। যেরকম সমুদ্রের সব ঢেউ তীরে এসে পৌঁছায় না, সেরকম মানুষের সব আবেগ জীবনের দেখা পায় না।

শিহাব জানতে চায় জীবনের করুণ পরিণতির কথা। যে পরিণতির আশঙ্কা মনে করিয়ে দেয়, ফুলের সব চাইতে সুন্দর দিক হলো ফুল পচনশীল।

হাসান বলতে থাকে, “তিশার বিয়ে হয় বেশ দেরি করে। তার দুদিন পর গিয়েছিলাম নিতুদের বনানীর বাসায়। নিতুকে দেখে মনে হলো বিষণ্ন একা কবিতার মতো, সঠিক শব্দের অভাবে যে জন্ম নিতে পারছে না। বললাম, একটা ব্যাপার কিছুতেই আমার মাথায় আসছে না।”

“কী?”

“রুদ্র কোথায়?’

নিতু চুপ করে তাকিয়ে থাকে। তার তাকানোটা একটা স্থিরচিত্রের মতো। চোখে কোনো পলক ফেলছে না। পলক ফেললেই একটা মুহূর্ত অন্ধকার হয়ে যাবে।

বললাম, “সেদিন লিওনার্দো কোহেনের গান গাড়িতে বাজিয়ে আপনারা দুজন বিয়ে করেছিলেন। সে কোথায়?”

নিতু চুপ করে থাকে। কিন্তু তার চোখ কথা বলছিল। বোধহয় হঠাৎ রুদ্র নামটা তাকে এমন একটা অতীতে নিয়ে গেছে, যে অতীত তার চোখের চাহনিতে খরগোশের মতো শান্ত হয়ে বসে ছিল।

তার চোখের ভেতরে এমন একটা আর্তি ছিল, যা অনুমতি ছাড়া মৌনতার কাছে গিয়ে আশ্রয় নেয়। আমি সেই মৌনতার প্রতি পূর্ণ সমর্থন রেখে চুপ করে রইলাম।

নিতু বললো, “আর কী জানতে চান?”

বললাম, “আপনার সাথে যেদিন আমার পরিচয়, সেদিন প্ল্যাটফর্মে বলেছিলেন, বাসা থেকে পালিয়ে এসেছেন। বিয়ের জন্য ছেলে খোঁজা হচ্ছে তাই। কিন্তু তারও আগে রুদ্রের সাথে আপনার বিয়ে হয়েছে।”

রুদ্র নামের যে অতীত আমাদের মাঝখানে সাংকেতিক প্রশ্নের মতো দাঁড়িয়ে ছিল, নিতু সেই অতীত স্মৃতির তলানি থেকে হাতড়ে আমার সামনে উন্মোচন করলো। যে মুহূর্তে আমরা দুজন অন্ধকার প্ল্যাটফর্মে ইডিপাসকে সাক্ষী রেখে আলো ফোটার জন্য অপেক্ষা করছি, তখন রুদ্র কোথায়?

সমস্ত বর্ণনা শুনে যখন সব প্রশ্নের অবসান হয়, বুঝলাম রুদ্র হলো আমার আর নিতুর মাঝখানের একটা সেতু। নিতুর কাছে যেতে হলে সেই সেতুর উপর দিয়েই যেতে হবে।

.

শিহাব নতুন করে গল্পটা মেলাবার চেষ্টা করে। নিতুর সাথে রুদ্রের বিয়ে হলে পরে খুলনায় সে পালিয়ে এসেছে কেন?

হাসান বলতে শুরু করে, “সেদিন শীতের সকালে রুদ্র আর নিতু মগবাজার কাজী অফিস থেকে রাজশাহীর উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। সেখানে কিছুদিন থেকে ফিরে আসার সময় রুদ্র জিজ্ঞাসা করে, “কাছেই একটা রাজবাড়ি আছে। যাবে নাকি?”

দুটো জিনিস নিতুকে খুব টানে। একটা হলো পরিত্যক্ত রাজবাড়ি আর অন্যটা সমুদ্র।

নিতু বললো, “মৃত রাজবাড়ি আর জীবিত রাজার ভেতরে পার্থক্য কী জানো?”

রুদ্র না সূচক মাথা নাড়ে।

নিতু বললো, “ফাঁসির আসামির পেট ভরে খাওয়া বিরিয়ানি। স্বাদ আছে, তৃপ্তি নেই।”

রুদ্র বললো, “বেশিদিন আগের কথা না, ১৯৫০ সালে যখন সারা দেশে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হয় তখন এই রাজবাড়িটা পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। এর নাম পুঠিয়া রাজবাড়ি।”

“কারা থাকত এখানে?”

“মাত্র আঠারো বছর বয়সের এক নারী পুঠিয়া জমিদারীর দায়িত্ব নেয়। তার নাম মহারানি হেমন্ত কুমারী।”

রাজবাড়ির উঠোনে জরাজীর্ণ এক যুবক হাঁটু গেড়ে বমি করছিল। রুদ্র বললো, “নেশা-টেশা করেছে।”

নিতু যুবকটির কাছে গিয়ে পানি খেতে দিলো। সে পানি হাতে নিয়ে দ্বিতীয় দফায় বমি করে। প্রিজন সেলের সামনে কয়েকটা কুকুর বেকায়দায় শুয়ে বসে জানান দেয়, এক সময় এখানে যাদের শাস্তি দেয়া হতো, আর যারা শাস্তি দিত তাদের পোড়া মাটির গন্ধ নিতে কেউ আর ব্যাকুল থাকে না। বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন রাজ প্রাসাদ সাক্ষী দেয়, একদিন পৃথিবীতে জীবজন্তু, ফুল,পাখি সব ছিল। তখন বসন্তের পাতা ঝরে যেত দক্ষিণ সমুদ্রে।

ফেরার সময় রুদ্র বললো, “একজন মৃত বাদশার চেয়ে জীবিত ভিখারির মূল্য অনেক বেশি।”

নিতু বললো, “আমার তো উল্টোটা মনে হয়। কেননা যখন সে মৃত তখনও সে বাদশা।”

সন্ধ্যার কিছু পর তারা ফিরে এলো রুদ্রের সেই পুরানো প্রাচীর ঘেরা চিলেকোঠার ঘরে।

ছাদের যেখানটায় বসে আগে প্রশ্নের মতো সাংকেতিক চিহ্নের (?) নক্ষত্র দেখতো, সেই সব অতীত তাদের নিয়ে যায় সঙ্গীহীন হৃদয়ের করুণ ভবিষ্যতের কাছে।

নিতু কখনো সমুদ্র দেখেনি। রুদ্র তাকে নিয়ে সমুদ্রে যায়। তাবুর ভেতর থেকে এক অষ্টপ্রহরে বঙ্গোপসাগরের ঢেউ আঁছড়ে পড়ে।

নিতু বললো “সমুদ্রকে না জেনে দেখা আর দেখে না জানার ভেতরে যেরকম একটা তফাত আছে তেমন একটা তফাত আছে সত্য আর অর্ধেক সত্যের মাঝে।”

“কিন্তু দুটোই এই সাক্ষ্য দেয়, তুমি সমুদ্রকে জানো না।”

নিতু চুপ করে থাকে। রুদ্র বলে, “তাহলে মিথ্যা কোনটা?”

“মিথ্যার চেয়েও ভয়ংকর হলো অর্ধেক সত্য। কারণ সেটাকে সত্য থেকে আলাদা করা যায় না।”

তাবুর পকেটে রাখা কবিতার বই, মাথার উপর লাইট লাগানোর লুপ, অন্ধকার রাতে উত্তাল সমুদ্রের হাতছানি তাদের কথোপকথনে এক ধরনের বিভ্রম সৃষ্টি করে। দুজন মানুষ যখন একই সময়ে একে অন্যের প্রতি সম্মোহিত হয়, তখন একজন অন্যজনকে অপ্রকৃতস্থ করে। কিন্তু সেখানে কেমন ধরনের রেডিয়েন্স ব্যবহার হয়, সেটা মানুষের জানার বাইরে।

তাদের কথা হতো জীবন নিয়ে, প্রেম অথবা প্রেম না জাতীয় এক অনুভূতি নিয়ে কথা হতো তাদের। নিতু বললো, “জিবরানের একটা আকুতি আছে, তুমি যখন ভালোবাসো তখন তোমার বলা উচিত না ঈশ্বর আছেন আমার অন্তরে, বরং বলা উচিত আমি আছি ঈশ্বরের অন্তরে।”

রুদ্র বললো, “আর আমি যখন কাউকে ঘৃণা করি?”

“ঘৃণা সবসময় অসুন্দর হয় না। ভালোবাসাও সবসময় সুন্দর হয় না।”

.

একদিন রাতে তারা দুজন আসাদ গেটের সেই রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকে। খুঁজে বের করে এটিএম বুথের সেই সিকিউরিটি গার্ডকে। রুদ্র বললো, “কয়েক বছর আগে দুইটা বদ্ধ উন্মাদ ঘুড়ি উড়াতো। আপনি জানেন তারা কোথায়?”

“আপনারা কারা?”

“তেমন কেউ না, পরিচিত।”

সিকিউরিটি গার্ড সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, “একজন বাসের সাথে ধাক্কা খেয়ে মারা গেছে। লাশটা পরে ছিল ভোর পর্যন্ত। ভোরের দিকে একটা ভ্যানগাড়ি করে ওসমান তাকে নিয়ে যায়।”

নিতু রুদ্রকে উদ্দেশ্য করে বললো, “চিনেছো ওসমানকে?”

রুদ্র না সূচক মাথা নাড়ে।

“রাস্তার ওপারের ছেলেটা। যে ছেলেটা মাঞ্জা দিয়ে সুতা ধার করাতো।”

“সুতাই তো নেই। আবার ধার করাবে কেন?”

“সেটা আমরা এখান থেকে বুঝতে পারব না।”

নিতুর শেষ কথাটা রুদ্রের মনে ধরলো। একদিন সেও ছাদের উপর ঘুড়ি উড়াতে শুরু করে। কালো মেঘে যখন চাঁদটা ঢেকে যায়, রুদ্র হতাশ হয়ে বলে, “ঘুড়ি কাটা পড়েছে।”

নিতু অবাক হয়ে বলে, “কে কেটেছে?”

“ওসমান।”

নিতু তারচেয়েও অবাক হয়ে দেখে, রুদ্র শূন্য হাতে নাটাই ধরে সুতা টানছে। চাঁদটাকে সে ঘুড়ি বানিয়ে ফেলেছে।

প্রাত্যহিক জীবনের নিত্য নতুন ঘটনা নিয়ে তাদের কথা হতো। এর ভেতরে চিলেকোঠার বাসাটা অবশ্য বদলাতে হয়েছে। নানান রকমের আসবাবপত্র আর কাপড়ের সাথে যেটা বদলায়নি সেটা হলো, ভুলে ভরা অতীতকে কোলে পিঠে মানুষ করার অক্লান্ত পরিশ্রম। ভুল মানেই ফেলে দেয়া না, ভুল মানে শুধরে নিয়ে সাথে রাখা।

নিতান্ত ছেলেমানুষি ইচ্ছে আর স্বপ্ন ভঙ্গের কথা হতো তাদের। পরম আত্মার ভালোবাসার মতো তাদের ছিল অভিমান, অভিযোগ আর দোষারোপ করবার মানবীয় সমস্যা। সেই সব অভিমান সাথে নিয়ে সুটকেস গুছিয়ে নিতু একবার চলে যায় বনানীর বাসায়। যায় কেটে দিন, রাত যায় কেটে। একের অধিক দিন, একের অধিক সপ্তাহ। তারপর একদিন রুদ্র লিখতে বসে চিঠি। চিঠি শেষ করে তারাপদ রায়ের একটা কবিতা দিয়ে।

“তারপর একদিন হয়তো জানা যাবে
বা হয়তো জানা যাবে না,যে
তোমার সঙ্গে আমার
অথবা;
আমার সঙ্গে তোমার
আর দেখা হবে না।“

তাদের সুখগুলো ছিল আলাদা রকমের, সুখের কারণগুলো একই। আর দুঃখগুলো ছিল একই রকমের কিন্তু কারণগুলো আলাদা।

একদিন তারা রূপক শব্দের বিচিত্র এক খেলা খেলতে শুরু করে।

শুরু করেছিল রুদ্র, “অশ্ৰু মানেই দুঃখ না।“

নিতু বললো, “পাখি মানেই উড়তে পারা না।“

রুদ্র চিন্তা করার জন্য সময় চাইলো।

নিতু বললো, “এক ধরনের শকুন আছে। মৃত প্রাণীর হাড় খাবার জন্য এরা প্রথমে শক্ত হাড় মুখের ভেতরে নিয়ে অনেক উপরে উড়ে যায়। তারপর সেখান থেকে হাড় ফেলে দেয়। হাড়টা নিচে পড়ে ফেটে গেলে, তারা নিচে নেমে আসে।”

শকুনের এই রুপক ব্যাখ্যা রুদ্রের মাথায় কাজ করে না। শকুনকে যদি ধূর্ত মানুষের সাথে তুলনা করা যায়, মৃত প্রাণীকে তুলনা করা যেতে পারে দুর্বল মানুষের সাথে। তাহলে এখানে ‘হাড়ের’ রূপক শব্দ কী হবে?

যবে থেকে রুদ্রের সাথে নিতুর আলাপ তখন আগুন পোহানো শীতের রাত। সেই চিলেকোঠার ছাদ থেকে বিয়ে করে তারা চলে গিয়েছিল রাজশাহী। তারপর আরও কিছু শীত, মাঝে দুবার বদলেছে রুদ্রের অফিসের ঠিকানা। বদলে গেছে প্রিয় গান, শুধু বদলায়নি গানের পেছনের মানুষ। তেমনি একদিন নিতু বললো, “এই যে বার্থডে বয়, আমার চিঠি কোথায়?”

রুদ্র আকাশ থেকে পড়লো, “আমার জন্মদিন?”

নিতু হেসে বলে, “সেই সাথে হ্যাপি ম্যারেজ ডে।”

রুদ্র চোখ বন্ধ করে চিন্তা করতে শুরু করে। চোখ বন্ধ করলে কল্পনা করতে সুবিধা হয়।

১৩

অনেকদিন পর এক সন্ধ্যায় নিতুর কাছে একটা ভয়ংকর ফোন আসে। ফোনের ওপাশ থেকে রুদ্র বললো, “আমি ভুল করে আগের বাসায় চলে এসেছি। সেখানে একজন খ্রিষ্টান পাদ্রী থাকেন।”

নিতু বললো, “গত মাসে দুবার তুমি আগের অফিসে চলে গিয়েছিলে।” রুদ্র বলে, “সেটা দীর্ঘদিনের অভ্যাস থেকে। কিন্তু আমি আরও একটা সমস্যায় পড়েছি।”

“কী?”

“আমাদের নতুন বাসাটা কোথায়?”

নিতু চুপ করে রইলো। রুদ্র বললো, “যতদূর মনে পড়ে বাসার পাশেই একটা মন্দির ছিল। মন্দিরের গেট সবসময় বন্ধ থাকে।”

রিকশাওয়ালা রিকশা থামিয়ে রুদ্রের কথোপকথন শুনছে। রুদ্র গত এক ঘন্টা ধরে তার বাসার ঠিকানা খুঁজে পায় না।

রিকশাওয়ালা বললেন, “মেলাদিন আগে আসছিলেন?”

রুদ্র সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে নিতুর সাথে কথা বলে। কিন্তু নিতু এরকম কাঁদছে কেন? কত কিছুই তো মানুষ ভুলে যায়। একটা ঠিকানা ভুলে গেলে কাঁদতে হবে কেন?

বাসায় ফেরার পর নিতু অবশ্য খুব স্বাভাবিক ছিল। টেবিলে খাবার গরম করে দিয়ে বললো, “কয়েকটা দিন অফিস থেকে ছুটি নাও। রাজশাহী যাবে?”

রুদ্র বললো, “এবার গিয়ে মাকে নিয়ে আসব।”

“আচ্ছা।”

রুদ্রের বাবা মারা যায় গত বছর। সে তখন ঘুমের ভেতর স্বপ্ন দেখছিল। স্বপ্নটা তার মনে আছে। গ্রিক দেবতা কিউপিডকে সে জিজ্ঞাসা করে, “দেবতা হয়েও কেন তুমি মানবীর প্রেমে পড়েছিলে?”

কিউপিড তাকে একটা সমুদ্রের সামনে নিয়ে যায়। যে সমুদ্রে কোনো জল নেই। রুদ্র জিজ্ঞাসা করে, “সমুদ্রের জল কোথায়?”

দেবতা উত্তর দেয়, “মানুষের চোখে।”

এমন সময় নিতু মুখে পানি ছিটিয়ে বলে “বাবা মারা গেছে।”

রুদ্র ঘুম ভেঙ্গে দেখে নিতু অস্থির চিত্তে হাঁপাচ্ছে। চোখে তখনও পানি লেগে আছে। দেবতা বলেছিল সমুদ্রের সব জল মানুষের চোখে। সে কি স্বপ্ন দেখছে? স্বপ্নের ভেতরে অন্য আরেকটা স্বপ্ন। যেরকম লাকা বলেছিল, আমি একটা প্রজাপতিকে স্বপ্নে দেখছি। ঘুম ভাঙ্গার পর মনে হলো, আমি কি এখন জেগে আছি? নাকি প্রজাপতিটা আমাকে স্বপ্নে দেখছে? আমি হলাম প্রজাপতির স্বপ্ন।

নিতু এবার শান্ত হয়ে বলে, “তোমার বাবা মারা গেছে।”

নিতুর হাতে মোবাইল। ফোনের ওপাশ থেকে মায়ের বাঁধ ভাঙ্গা কান্না। বাইরে তখন বৃষ্টি। মাঝরাস্তায় গাড়ি নষ্ট। বাদ আসর কবর দেয়া হবে।

রুদ্র গাড়ি থেকে নেমে হাত দিয়ে একটা বাস থামালো। বাসে সিট খালি নেই। ইঞ্জিনের উপর বসে সে যখন রাজনৈতিক আলাপ শুনছে, সেই সময়ে মকবুল চাচা জানিয়েছেন পুকুরের পাশে কবর খোঁড়া হয়েছে। ছেলেবেলায় সাঁতার শিখতে গিয়ে এই পুকুরটায় রুদ্র ডুবে গিয়েছিল। পানির নিচ থেকে কে যেন পা ধরে নিচের দিকে টেনে নিয়ে যায়।

স্যাঁতসেঁতে ভেজা মাটি মাড়িয়ে রুদ্র যখন কবরের সামনে, ভারী মেঘে বজ্রপাতের শব্দে মকবুল চাচা বললেন, “মাটি রাখার সময়; প্রথম বার বলবে, মিনহা খালাক্বনাকুম। দ্বিতীয়বার বলবে, ওয়া ফিহা নুঈদুকুম। তৃতীয়বার বলবে, ওয়া মিনহা নুখরিজুকুম তারাতান উখরা।“

.

একদিন রুদ্র অফিসে গিয়ে দেখলো তার চেয়ারে পানপাতার মতো আকৃতি মুখের এক লোক বসে আছেন।

লোকটি কম্পিউটারের স্ক্রিন থেকে চোখ না সরিয়ে বললেন, “বসুন।”

রুদ্র সামনের চেয়ারে গিয়ে বসে।

“কী কাজে এসেছেন?”

রুদ্র বিস্মিত হয়ে বলে, “আপনি টেবিলের উপর থেকে অর্কিড দুটো সরিয়ে ফেললেন কেন?”

লোকটি রুদ্রের দিকে চোখ মেলে তাকালেন। রুদ্র বুঝতে পারে না তার কী বলা উচিত। কোথায় যেন জট লেগে গেছে। তারা কি তাকে ছাটাই করেছে?

লোকটি বললো, “আপনার নাম?”

রুদ্র চুপ করে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর লজ্জিত হয়ে বললো, “কিছু মনে করবেন না। আমি ভুল করে আমার আগের অফিসে চলে এসেছি।”

অফিস থেকে বের হয়ে রুদ্র একটা সিএনজি ঠিক করলো। নিতুকে ফোন করে বললো, “আমার নতুন অফিসটা কোথায়?” নিতু চুপ করে রইলো।

রুদ্র বললো, “যতদূর মনে পড়ে পাশেই একটা শপিংমল ছিল। তোমাকে নিয়ে একবার চাদর কিনতে এসেছিলাম।”

নিতু কাঁদতে শুরু করলো। রুদ্রের বোধোদয় হয় না। কত কিছুই তো মানুষ ভুলে যায়। একটা ঠিকানা ভুলে গেলে কাঁদতে হবে কেন?

বাসায় ফেরার পর নিতু খুব স্বাভাবিক আচরণ করলো। বললো, “চলো একদিন ঘুরতে যাই কোথাও।”

“কোথায়?”

“তোমার যেখানে ইচ্ছে।”

রুদ্র বললো, “বিয়ের আগে তোমাকে নিয়ে একবার এক বন্ধুর বাংলোয় গিয়েছিলাম।”

“পাহাড়ের ভেতর জঙ্গলে?

“হ্যাঁ। তাঁবুর ভেতর থেকে দেখব জঙ্গলের জোছনা।“

“আদি মানুষের কাছে?”

রুদ্র জবাব না দিয়ে চুপ করে থাকে। অফিসের ঠিকানা তার মনে পড়েছে। তার আরও মনে পড়েছে, আগের অফিসের সেই অর্কিড দুটো, সে যাবার সময় সাথে করে নিয়ে গিয়েছিল।

১৪

রুদ্রের এই স্মৃতি-বিভ্রাট বেড়ে গিয়ে একসময় সে প্রচন্ড রকমের অসুস্থ হয়ে পড়ে। কথা বলার সময় সঠিক শব্দ খুঁজে পেতে তার অসুবিধা হয়। মাঝে মাঝে মাত্র দশ মিনিট আগের ঘটনাও সে মনে করতে পারে না।

তেমনি একদিন রুদ্র ঘুম থেকে উঠে দেখে বাসায় কেউ নেই। ঘরের দক্ষিণ দিকে পুরানো স্মৃতি নিয়ে ঝুলে থাকা দেয়াল ঘড়ির উপর একটা দ্বিখণ্ডিত টিক- টিকি নাড়াচাড়া করছে। টিকটিকির শরীর থেকে লেজটা আলাদা হয়ে আছে এবং কোনো এক কারণে লেজটাকে ঘড়ির মিনিটের কাঁটার মতো মনে হলো।

টিকটিকির লেজটি মাটিতে পড়ে গেলে রুদ্র অবাক হয়ে একটা জিনিস লক্ষ্য করলো। ঘড়িতে তিনটা কাঁটা থাকলেও একটা চলছে। বাকি দুটো থেমে আছে। দেয়াল ঘড়ি থেকে চোখ সরিয়ে রুদ্র এবার একটা ছবির দিকে তাকায়।

ছবিতে একজন নারী ছোট একটা বাচ্চার জুতা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ছবির নিচে লেখা, “For sale: baby shoes, never worn”

.

রুদ্র বিছানা থেকে উঠে লাইটের সুইচে চাপ দিলে, বাতি বন্ধ হয়ে যায়। ভয় পেয়ে রুদ্র বিকট শব্দে চিৎকার করে। সে কি অন্ধ হয়ে গেছে? কলিংবেলের শব্দ বেজে উঠলে দরজার সামনে এগোতে থাকে। ভেতর থেকে জিজ্ঞাসা করলো, “কে?”

“আমি।”

দরজা খুলে দেখলো প্রচন্ড বৃষ্টিতে নিতু ছাতা হাতে দাঁড়িয়ে আছে। রুদ্র বললো, “কোথায় গিয়েছিলে?”

“কোথায় আর যাবো? অফিস থেকে ফিরলাম।”

নিতু কবে থেকে অফিস করে, রুদ্র সেটা মনে করতে পারছে না।

রুদ্র বললো, “আমি কিছু মনে করতে পারছি না।”

নিতু ঘরে ঢুকে বাতি জ্বালালো। রুদ্র শঙ্কিত গলায় বললো, “আমি কিছু মনে করতে পারছি না কেন?”

“তোমার একটা অসুখ করেছে। চিকিৎসা চলছে।”

রুদ্র চিন্তিত হয়ে বলে, “আমার অসুখ!”

“হুম, চিকিৎসা চলছে।”

রুদ্র দেয়ালের ছবিটা দেখিয়ে বলে, “এই ছবিটার অর্থ কী?”

নিতু বললো, “ছবিতে আমরা একজন মাকে দেখছি, যে জুতাটা সে বিক্রি করছে, জুতাটা তিনি তার বাচ্চার জন্য কিনেছিলেন।”

“বাচ্চাটা কোথায়?”

“পৃথিবীতে জন্ম নেবার আগেই মারা গেছে।’

রুদ্র অবাক হয়ে বলে, “মাত্র ছয়টা শব্দে জীবনের গল্প বলে দিলো!”

“এই গল্পকে পৃথিবীর সবচেয়ে ছোটো গল্প মনে করা হয়। যিনি এই গল্পটা লিখেছেন তিনি শেষ বয়সে মাথায় গুলি করে আত্মহত্যা করেন।”

রুদ্র জিজ্ঞাসা করে, “কেন?”

“তিনি মনে করেছিলেন পৃথিবীকে তার আর দেবার মতো কিছু নেই।“

“আচ্ছা, তুমি কতদিন থেকে অফিস করছো?”

“ছয়/সাত মাস হবে।”

.

রুদ্র চিন্তিত হয়ে পড়লো। সব আবার কেমন জট লেগে যাচ্ছে। তার অফিস কোথায়, কিছুতেই মনে করতে পারছে না। বললো, “আমার অফিস কোথায়?”

“তুমি অফিস থেকে ছুটি নিয়েছো। তোমার একটা অসুখ করেছে।“

“আমি কি আবার সুস্থ হবো?”

“অবশ্যই। যে স্মৃতি আমরা ভুলে যাই সেই স্মৃতি আমাদের মস্তিষ্কে থেকে যায়।”

“স্মৃতির জন্ম হয় কীভাবে?”

“ঘটনা থেকে। মস্তিষ্ক প্রথমে স্মৃতি তৈরি করে। তারপর সেটা একটা জায়গায় জমা করে। সব শেষে প্রয়োজন হলে সেটাকে মনে করিয়ে দেয়।”

রুদ্র বললো, “তুমি এত কিছু জানো কী করে?”

“তোমার ডাক্তারের কাছ থেকে জেনেছি।”

“ডাক্তার আর কী বলেছে?”

“ডাক্তার বলেছে প্রতিদিন চল্লিশ মিনিট করে হাঁটতে।”

রুদ্র চুপ করে থাকে। নিতু বললো, “আসো আমরা মস্তিষ্কের ভেতর থেকে কিছু স্মৃতি বের করে আনার চেষ্টা করি।”

“কীরকম?”

“আমি তোমাকে একটা রঙের নাম বলব। তুমি সেই রঙের যা কিছু দেখেছো, চিন্তা করে বলতে থাকবে।”

“আচ্ছা।”

“মনে করো, নীল। গত সাত দিনে নীল রঙের কী কী জিনিস দেখেছো?”

রুদ্র চিন্তা করতে শুরু করে। নীল ছাড়া আর সব রং রুদ্রের মনে পড়ে। তার জগৎ নীলহীন হয়ে উঠে।

নিতু এবার অন্য একটি রঙের নাম বলে, “সবুজ!” সঙ্গে সঙ্গে সবুজ ছাড়া আর সব রং রুদ্রের মনে পড়তে শুরু করে। তার চেনা জগতে সবুজ নামে কোনো রং নেই।

নিতু রুদ্রকে চোখ বন্ধ করতে বলে। রুদ্র চোখ বন্ধ করে।

“আমি যা বলব তার একটা ছবি মনের ভেতরে আনার চেষ্টা করবে।”

রুদ্র মাথা নাড়ে, “আচ্ছা।”

নিতু বললো, “ক্লাসরুম।”

রুদ্র একটা ক্লাস রুম মনে করার চেষ্টা করে।

‘ক্লাস রুমে কয়টা সিলিং ফ্যান দেখতে পাচ্ছো?”

“দুইটা।”

“ফ্যান কি চলছে নাকি বন্ধ হয়ে আছে?”

রুদ্রের অস্থির লাগতে শুরু করে। ফ্যান কি চলছে নাকি বন্ধ হয়ে আছে,

এই ব্যাপারটা সে কল্পনা করতে পারছে না।

নিতু জিজ্ঞাসা করে, “জানালার বাইরে কি খেলার মাঠ? নাকি করিডোর?”

“করিডোর।”

“করিডোরে কেউ আছে?”

রুদ্র জবাব দেয়, “না।”

“ক্লাসরুমে?”

“সেখানেও কেউ নেই।”

রুদ্রের অস্থির লাগতে শুরু করে। কোথাও কেউ না থাকলে সব কিছু দেখছে কে? রুদ্রের মাথা ভারী হতে শুরু করলো। সে বললো, “তুমি কি একটা জিনিস খেয়াল করেছো?”

“কী?”

দেয়াল ঘড়িতে তিনটা কাঁটা থাকলেও একটা চলছে। বাকি দুটো থেমে আছে।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *