১৫
একটু একটু করে রুদ্র মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। একদিন ঘর থেকে সব আসবাবপত্র সরিয়ে অন্যত্রে রাখছিল। নিতু জিজ্ঞাসা করে, “কী করছো?”
“দেয়ালের সাথে কথা বলবো।”
“দেয়ালের সাথে কথা বলতে হলে জিনিসপত্র সরাতে হবে কেন?”
রুদ্র কথার জবাব দেয় না। নিতু অবশ্য আশাও করেনি। তারপর প্রায় সময় রুদ্রকে দেখা যেত, দেয়ালের সাথে কথা বলছে। দেয়ালের প্রাণ নেই, কিন্তু দেয়াল কথা বলে, এই ব্যাপারটা তাকে ভাবিত করে।
খালি ঘরে শব্দের ইকোতে নিতুর প্রায় সময় আগের একটা কথা মনে পড়তো। একদিন তারা তাদের সুখের মুহূর্তগুলো টেনে টেনে বড়ো করার শপথ নিয়েছিল, অথচ মুহূর্তকে টেনে বড়ো করা যায় না।
গল্পের এই পর্যায় হাসানকে থামিয়ে দিলো শিহাব। বললো, “রুদ্র এখন কোথায়?”
“নিতু তাকে একটা বেসরকারি মানসিক হসপিটালে ভর্তি করায়।”
শিহাব জানতে চায়, “তারপর?”
হাসান নিতুর কথা বলে। নিতু তখন সারাদিন অফিস করে অনেক রাত করে বাসায় ফিরে। ঘরে দ্বিতীয় কোনো প্রাণী নেই। একা একা রান্না করে খেতে হয় একা। একা থাকার সবচেয়ে বড়ো কষ্ট এই না যে, কথা বলার কেউ নেই। সবচেয়ে বড়ো কষ্ট হলো, বলার মতো কথা নেই।
.
মাঝে একবার রুদ্রের মা অসুস্থ হয়ে পড়ে। নিতু অফিস থেকে ছুটি নিয়ে রাজশাহী যায়। রুদ্রের মায়ের বয়স হয়েছে। হার্টের অবস্থাও ভালো না। নিতু তাকে ঢাকায় যাবার অনুরোধ করলে তিনি বললেন, “আমি চলে গেলে সংসার দেখবে কে?”
রুদ্রের বড়ো বোনের বিয়ে হয়েছে সেই কবে। দুই ইদে দুবার এসে মাকে দেখে যান। রুদ্র ঢাকায় একটা মানসিক হসপিটালে। রুদ্রের বাবা মারা গেছে সেটাও মেলা দিন। নিতু ভেবে পায় না, রুদ্রের মা এই একলা ঘরে, ‘সংসার দেখলেন কোথায়!’
ফেরার সময় একটা বিকেল জিরিয়ে নেয় ফেলে আসা রাজবাড়ির উঠোনে প্রিজন সেলের সামনে দুটো কুকুর সঙ্গমে মত্ত। গাড়িতে বেজে চলে কোহেনের অক্লান্ত আকুতি। কোনো কিছুই থেমে যায়নি, আবার থেমে গেছে সবকিছু। যখন রুদ্রের সাথে দেখা হয়, খুব মায়া হয়। নিতু ভেবে পায় না, রুদ্র এরকম মায়া নিয়ে তাকায় নাকি তার তাকানোটাই মায়ার।
.
নিতু জিজ্ঞাসা করে, “এখানে কষ্ট হয়?”
রুদ্র হেসে বলে, “কষ্ট কী?”
‘কষ্ট হলো আনন্দের আগ মুহূর্ত।”
“আনন্দ কী?”
“আনন্দ হলো কষ্টের ছায়া।”
নিতুর কথা শুনে রুদ্র হাসতে থাকে। জীবন কোথায় গিয়ে থামে, কোথা থেকে শুরু হয়; কে বলতে পারে! যে জীবন আদি মানুষের কাছে সপে দেয় সম্পর্কের দায়। তাঁবুর ভেতর থেকে সমুদ্র দেখে বুঝেছিল, সমুদ্রকে দেখে না জানা আর না জেনে দেখার মাঝে তফাৎ আছে।
শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার মতো, ‘এসেছে বলেই গেলো, না এলে যেতো না দূরে আজ’।
“একজন দীর্ঘ লোক সামনে থেকে চলে গেলো দূরে-
দিগন্তের দিকে মুখ, পিছনে প্রসিদ্ধ বটচ্ছায়া
কে জানে কোথায় যাবে কোথা থেকে এসেছে দৈবাৎ-ই
এসেছে বলেই গেলো, না এলে যেতো না দূরে আজ।”
১৬
শিহাব বললো, “একটা ভুল স্টেশনে নিতুর সাথে যখন তোমার পরিচয় হয়, রুদ্র তখন মানসিক হসপিটালে?”
হাসান বললো, “হুম।”
“নিতু সেদিন পালিয়ে খুলনায় কেন গিয়েছিল?”
“নিতুর বাবা-মা তাকে বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন।”
শিহাব ভেবে পায় না, “তাহলে রুদ্র?”
“রুদ্র তখন মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন।”
শিহাব চোখ বন্ধ করে মুহূর্তের পুনরাবৃত্তি করার চেষ্টা করে।
হাসান বললো, “একা বাসায় নিতুর দম বন্ধ হয়ে আসছিল। মানুষ না থাকলে সংসারও থাকে না। নিতু ফিরে যায় তার বনানীর বাসায়। সেখান থেকে মাঝেমধ্যে দেখা করতে যেত রুদ্রের সাথে। রুদ্র তখন ঘুড়ি উড়াতে ব্যস্ত। নিতুকে দেখে বলে, “ওসমানের খবর আছে?”
নিতু চোখ ভর্তি পানি নিয়ে রুদ্রের মাথায় হাত রাখে। এরকম একটা সময়ে নিতুর বাবা-মা তাকে বিয়ে দিতে চাইলে সে পালিয়ে খুলনায় চলে যায়। যাবার সময় ট্রেনে আমার সাথে পরিচয়। আপনি কি গল্পটা বুঝতে পারছেন?”
শিহাব বললো, “নিতুর সাথে তোমার বিয়ে হয়েছে কীভাবে? সে এখন কোথায়?”
হাসান চুপ করে থাকে। বোধহয় সে বুঝতে পারছে না কোথা থেকে শুরু করবে। বললো, “নিতুর বাবা রুবা আন্টিকে বিয়ে করে চলে যান স্পেনে। বিয়ের পর তিশা তখন চট্টগ্রামে। বনানীর বাসায় তখন দুটো মাত্র মানুষ। নিতু আর নিতুর মা। দুজনের একটা জায়গায় ভীষণ মিল, একদিন তাদের সংসার ছিল, খেলনার।”
শিহাব আপত্তি করে বললো, “সংসার কখনো খেলনার হয় না, খেলনার সংসার হয়। যেরকম খেলনার পিস্তল, পুতুল।”
হাসান বললো, “সেরকম একটা সময়ে নিতুর অবস্থা ছিল এরকম, একটা প্লাস্টিকের বোতল গড়িয়ে যাচ্ছে রাস্তায়। বোতলটি কোথায় গিয়ে থামবে সেটার একটা গন্তব্য আছে কিন্তু উদ্দেশ্য নেই। একদিন নিতু আমাকে নিয়ে যায় সেই জঙ্গলে। পাহাড়ের অন্ধকার আঁকাবাঁকা রাস্তা, একটা দুটো ঘরবাড়ি অতিক্রম করে আমরা হাতড়ে বেড়িয়েছি জঙ্গলের জোছনা।
হঠাৎই মনে হলো, বছর কয়েক আগে এই রাস্তা ধরে একই গাড়িতে আমার এই সিটে রুদ্র নামে আরেকটা মানুষ বসে ছিল। মানুষটা মদ খেয়ে কথা বলছিল চোখ বন্ধ করে। ফেরার সময় গাড়ি ইউটার্ন করলে সে চিন্তায় অস্থির, বাম পাশের ঘন জঙ্গল ডান পাশে এলো কী করে!
নিতুকে জিজ্ঞাসা করলাম, “রুদ্রকে দেখতে যান হসপিটালে?”
নিতু বললো, “গত সপ্তাহে গিয়েছিলাম। সে একটা অন্য জগতের মানুষ হয়ে গেছে। আমরা একসাথে দাঁড়িয়ে কথা বলি কিন্তু আমরা কেউ কারো কথা বুঝতে পারি না।”
নিতুর সাথে পরিচয় হবার পর তিনটা কঠিন সত্যের মুখোমুখি হতে হয়েছে। প্রথমটি রুদ্রের চিঠির মধ্য দিয়ে এক প্রেমিকের আগমন। দ্বিতীয়টি, মগবাজার কাজী অফিসে সেই প্রেমিকের সাথে বিয়ে। আর তৃতীয় সত্যটা হলো, রুদ্র একজন মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষ।
.
বাংলো থেকে ফিরতে ফিরতে রাত হলে নিতু আমাকে বাসায় নামিয়ে দেয়। নিতু বললো, “আপনার বাসায় মেজো মামা ছাড়া আর কে থাকেন?”
“কেউ না।”
নিতুর জিজ্ঞাসা এবার জোরালো, “আর কেউ না?”
বললাম, “রহমত নামে একটা ছেলে আছে, রান্নাটান্না করে দেয়।”
সেদিন প্রথমবারের মতো নিতু আমার বাসায় আসে। মেজো মামা যথারীতি শুয়ে ছিলেন বিছানায়। রহমত জানালো, “মামার শরীর খারাপ করেছে। গায়ে জ্বর।”
আমরা দুজন মামার কাছে গিয়ে বসলাম। মামা বললেন, “টেবিলে খাবার রাখা আছে।”
বললাম, “খেয়ে এসেছি।”
কপালে হাত দিয়ে দেখি জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। মামা তাকিয়ে রইলেন শূন্য দৃষ্টিতে। পাশে একটা হুইল চেয়ার সাক্ষী দেয় তোমার জীবন থেমে গেছে। যেটুকু চলছে, ধাক্কা দিয়ে।
“পুরানো সেই নক্ষত্রের দিন শেষ হয় নতুনেরা আসিতেছে বলে।” জীবনানন্দের এই কবিতা সবার জীবনে সত্য হয় না। কেউ কেউ অতীত আঁকড়ে দগ্ধ হয় টাইম মেশিনে। কেবল শ্বাস ফেলে জানান দেয়, এখনো বেঁচে আছে।
চলে যাবার সময় নিতু মামার কথা জানতে চায়। কী করেন সারাদিন, এসব আর কী।
বললাম, “বারান্দা থেকে হুইল চেয়ারে বসে আকাশ দেখেন। বেঁচে থাকার একটা না একটা অজুহাত মানুষ রপ্ত করে ফেলে।”
“অজুহাত?” প্রশ্ন করে নিতু।
“তাই নয়তো কী।”
“সব কষ্টই একদিন সহনীয় হয়, এই কথাটা আপনি বিশ্বাস করেন?”
“সব সুখ যদি সহনীয় হয়, তাহলে কষ্ট কেন না?”
আমার কথা শুনে নিতু শব্দ করে হাসলো। রুদ্র ঠিকই ধরেছিল, নিতুর হাসি মোনালিসার হাসির চেয়েও বেশি রহস্যময়।
এরপর প্রায় যেতাম বনানীর বাসায়। একদিন নিতুর মা আমাকে আলাদা করে ডেকে বললেন, “তোমার সাথে একটা বিষয় নিয়ে কথা বলতে চাই।”
আমি মাথা নেড়ে বললাম, “বলুন।”
তিনি অত্যন্ত করুণ গলায় বললেন, “নিতু কি বিয়ে করবে না বলে ঠিক করেছে?”
“আমাকে কিছু বলেনি তেমন।”
“কিছু বললে শুনতে চায় না। একবার তো রাগ করে খুলনায় চলে গেল।” নিতুর বিয়ে হয়ে গেলে তিনি এই বাড়িটায় একা কী নিয়ে থাকবেন, এরকম একটা প্রশ্ন মনের ভেতরে চেপে আমি বললাম, “হয়তো অপেক্ষা করছে।”
“কীসের অপেক্ষা?”
“রুদ্রের জন্য।”
একদিকে জীবনের জাগতিক সমস্যা, অন্যদিকে মেজো মামা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে গেলে তাকে নিয়ে ভর্তি করলাম গ্রীন লাইফ হসপিটালে। একদিন অফিস থেকে ফিরে এসে দেখি, নিতু একটা হালকা সবুজ রঙের শাড়ি পরে বসে আছে কেবিনের বেডে। ‘নিতু আমি আপনাকে চাই’ এই কথাটা বললেই সব চুকে যায়। তাই বলতে পারি না কিছু।
বললাম, “কখন এসেছেন?”
“ঘন্টাখানেক আগে।”
তার হাতে স্যুপের বাটি। আর মামার হাতে টরোর শিং দিয়ে বানানো শোপিস। মামা আঙুল বুলিয়ে বললেন, “এটা কীসের?”
নিতু বললো, “এটা হলো সেকেন্ড চান্স লাইফ। জীবন যখন থামিয়ে দেবে সব কিছু, তখনও দৌড়াতে হয়। পেছনে এক পাল ষাঁড়, সামনে সুন্দর সমুদ্র।’
মামা বললেন, “সমুদ্র সবসময় সুন্দর হয় না। সুনামি দেখেছো কখনো?”
১৭
শিহাব বুঝতে পারে, হাসানের গল্প এমন একটা জায়গায় গিয়ে পৌঁছেছে, যেখানে চারপাশে পানি। কিন্তু জাহাজের ছাদ থেকে দাঁড়ালে দেখা যায় সমুদ্রের তীর। তীরটা এমন যে সব কিছু দেখা যায় কিন্তু স্পষ্ট দেখতে হলে তাদেরকে ডাঙায় নেমে আসতে হবে।
শিহাব জিজ্ঞাসা করে, “নিঃসঙ্গ মেজো মামাকে ফেলে তুমি এই যে আমার সাথে একসাথে থাকছো, এর কারণ কী?”
“সেবার হসপিটাল থেকে মামা আর বাসায় ফিরে আসেননি। একদিন ভোরবেলায় মারা গেছেন নিঃসঙ্গ কেবিনে। যাবার সময় আমাকে খুঁজেছিলেন কি না, জিজ্ঞাসা করেছিলাম নার্সকে। তিনিও বলতে পারেননি। বিছানায় পড়ে ছিল টরোর শিং, কাঁচ ভাঙ্গা চশমা আর একটা তসবিহর ছড়া।
মামার মরদেহ নিয়ে বাসায় আসার পর মেজো মামিকে ফোন করে খবরটা জানাই। বিকেল পাঁচটায় মামি এলে তাকে চলে যেতে বলেন আমার বড়ো মামা। উঠোনেই মামার মরদেহ।
পরিচিত অর্ধ পরিচিত মানুষের পদচিহ্নে থমথমে মরা বাড়ি। মামি গেটের সামনে থেকে ফিরে চলে গেলেন। বিদায়লগ্নে শোধ করা হলো না, শেষ যেটুকু অবশিষ্ট ছিল সম্পর্কের ঋণ।
এরপর অবশ্য একদিন দেখা হয়েছিল মামির সাথে। আমার সাথে তখন নিতু। সাইন্সল্যাবের সিগনালে একটা রিকশায় বসে আছি। আমাদের পাশেই একটা রিকশা থেকে ডাক দিলেন মামি।
ইতস্থত হয়ে শুরু করা সৌজন্য আলাপ থেকে জানতে পারি, মামির একটি মেয়ে সন্তান হয়েছে। নাম এখনো ঠিক হয়নি। আমাদের আলাপ হঠাৎই মিলিয়ে যায় সিগনাল ছেড়ে দিলে। নিতুকে বললাম, “চিনেছেন উনাকে?”
নিতু প্রশ্ন করে, “কে?”
“আমার মেজো মামি। ইমতিয়াজ আংকেলের ওয়াইফ।”
ইমতিয়াজ আংকেলের নামটা বোধহয় নিতুর মেমোরি থেকে সরে গিয়েছিল। বললো, “রুবা আন্টির স্বামী?”
আমি যোগ করলাম, “ছিলেন।”
আমি নিতুর দিকে তাকিয়ে থাকি। তার চোখের অগণিত জলের সমাবেশ আমাকে বেহেশতে নিয়ে যায়।
এক কার্তিক মাসের সন্ধ্যায় নিতু উদাস ভঙ্গিতে বললো, “পৃথিবীর প্রথম কবি কে? আপনি জানেন?”
হেসে বললাম “এও জানা সম্ভব?”
“তার নাম এনহেদুয়ান্না। তিনি একজন নারী ছিলেন।”
বললাম, “তিনি জন্মেছেন কবে?”
“প্রায় চার হাজার বছর আগে।”
নিতুর কথা শুনে আমার চোখ কপালে উঠে গেল।
“তোমার চেতনা, সমবেদনা আমার প্রতি
করুণার্দ্র হোক
তোমার কঠিন শাস্তির স্বাদ আমি উপলব্ধি করেছি।”
আমার বোধগম্য হয় না, তিনি আমার হৃদয়ের খবর চার হাজার বছর আগে জানলেন কেমন করে!
বললাম, “সেই সময়ে বর্ণমালা ছিল?”
“কিউনিফর্ম পদ্ধতিতে লিপিবদ্ধ হয়েছিল।”
.
ডুবন্ত মানুষ ডুবে যাবার সময় খড় কুঠরি যা পায়, তাই আঁকড়ে ধরে বাঁচার চেষ্টা করে। আমাদের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। নিতুর সাথে আমার বিয়ে হয় কার্তিকের শেষ সময়ে। আমাদের মাঝে ব্যবধান যা ছিল সেটা দৈর্ঘ্য কিংবা প্রস্থের মানদণ্ডে অসীম। কিন্তু দূরের কোনো জিনিস, কাছ থেকে দেখলে সেটা আরও দূরের মনে হয়। কাছের কোনো জিনিস দূর থেকে দেখলে সেটা আরও কাছের মনে হয়।
ধ্বংসস্তূপের উপর থেকে দাঁড়িয়ে দেখতে গেলে, রুদ্র তখন আলাদা করে কষ্ট বোঝার কিংবা না বোঝার কোনো মানসিক অবস্থাতে নেই। তাকে ডিভোর্স দেয়া হয়েছে। সে জানার পর বললো, “ডিভোর্স কী?”
নিতু জবাব দেয়, “ডিভোর্স মানে আলাদা থাকা।”
রুদ্র হেসে বলে, “আমরা কি একসাথে আছি?”
১৮
শিহাব উদগ্রীব হয়ে জানতে চায়, “নিতু এখন কোথায়?”
হাসান বলতে থাকে “আমি বড়ো হয়েছি মেজো মামার সংসারে। মামা চলে গেলেন কোনো পূর্বাভাস না দিয়ে। আর, মামির সাথে রাস্তায় দেখা হলে এমন একটা সংকোচ নিয়ে আমরা একে অন্যের দিকে তাকাই; কে বলবে এই মানুষটা কোলে-পিঠে বড়ো করেছে আমাকে। এরপর সংসারের দেয়ালে আসবাবপত্রে, শোকেসে সজ্জিত প্রত্যেকের আলাদা খাবারের গ্লাসে, কিংবা বহুবছর আগে শীতে কেনা কাপড়ের নেপথলিনে দম বন্ধ হয়ে আসে।
নিতুকে নিয়ে চলে যাই নতুন একটা বাসায়, শুধু সাথে করে নিয়ে আসি মামার হুইল চেয়ার, পুরানো একটা সাদা কালো লেমিনেটিং করা ছবি আর কবি শেলির বইটা। নিতুর সাথে প্রথম আলাপের পর বইটা আমাকে সে দিয়েছিল। কে জানতো, নিয়তি আমাদের নিয়ে অন্য এক পরিকল্পনা করে রেখেছে।
.
এভাবে কয়েকটা বছর কেটে গেল বেশ। একদিন শ্রাবণ মাসের গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টিতে দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে ঘুম ভাঙ্গে আমার। বেলা গড়িয়ে তখন বারোটা। দরজা খুলে দেখি, রুদ্র দাঁড়িয়ে আছে ভেজা শরীরে। আমাকে
বললো,
“এটা কি হাসান সাহেবের বাসা?”
“জি।”
“ভেতরে আসতে পারি?”
আমি দরজা ছেড়ে দাঁড়ালে সে বসার ঘরে গিয়ে বসে। শান্ত হয়ে বলে, “একটু পানি হবে?”
এই জাতীয় একটা স্বপ্ন আমি প্রায় সময় দেখতাম, একদিন রুদ্র এসে উপস্থিত হয়েছে আমাদের মাঝখানে। স্বপ্নে নিতু দুকাপ চায়ে চিনি মেশাচ্ছে। আমি বলি, “আমি তো চায়ে চিনি খাই না।
নিতু বলে, “চা আপনার জন্য না। “
“তাহলে?”
“রুদ্র এসেছে।“
আমি অবাক হয়ে বলি, “কখন?”
“এই তো কিছুক্ষণ আগে। আপনি ঘুমোচ্ছিলেন।”
ঘুম ভেঙ্গে দেখি নিতু চায়ে চিনি নাড়ছে। স্বপ্নের রেশ তখনো কাটে না। বললাম, “কেউ এসেছিল?”
নিতু না সূচক মাথা নাড়ে। আমি বিছানা থেকে উঠে প্রাত্যহিক জীবনের ন্যায় অফিসের উদ্দেশ্যে বের হই। নিতুকে বুঝতে দেই না, নিরেট হাসির ছলে এরকম একটা আতঙ্ক আমি পুষে রেখেছি।
কিন্তু সেদিন শ্রাবণ মাসের গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিতে রুদ্র এসেছিল সত্যি সত্যি। তার চোখে মুখে, খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে বিষাদের কোনো চিহ্ন নেই। আমি ভেতরের ঘর থেকে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি এনে রুদ্রকে দেই। রুদ্র এক ঢোঁকে খেয়ে বললো, “আপনিই হাসান সাহেব?”
মাথা নেড়ে বললাম, “জি।”
“আমি রুদ্র বলছি।”
“জি, আমি আপনাকে চিনতে পেরেছি। আপনার সাথে দেখা না হলেও আপনার ছবি দেখেছি।”
“এই বাসার ঠিকানা পেয়েছি নিতুদের বনানীর বাসা থেকে।”
আমি মাথা নাড়ছি। তার কথা আমার কান দিয়ে মস্তিষ্কে প্রবেশ করার সুড়ঙ্গ পথে জমাট বেঁধে ঘুরপাক খায়। একটা শব্দ অন্য একটা শব্দের সাথে ধাক্কা লেগে বিকৃত অর্থহীন বাক্য তৈরি হতে লাগলো।
“নিতু কোথায়?”
বললাম, “বাসায় নেই।”
“আমি কি অপেক্ষা করতে পারি?”
“ফিরতে দেরি হবে।
“আমার অপেক্ষা করতে অসুবিধা নেই।”
বললাম, “আমিও বের হবো। আপনি বরং অন্য একদিন আসুন।”
“বাসায় কাগজ হবে?”
কাগজ, কলম দেবার পর রুদ্র দীর্ঘ সময় নিয়ে একটা চিঠি লিখলো। তারপর চিঠি আমার হাতে দিয়ে বললো, “নিতুকে দিবেন।”
শিহাব চোখ বন্ধ করে মুহূর্তের যে অনুভূতি, সেটা কল্পনায় এনে ব্যথিত হয়। একজন মানুষ হসপিটাল থেকে সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরে দেখে ঠিকানা বদলেছে। সেই ঠিকানা জানার জন্য বনানীর বাসায় গিয়ে জানতে পারে, তার স্ত্রী কয়েক বছর আগেই অন্য একটি বিয়ে করেছে। তাদের ডিভোর্সও হয়েছে। কিন্তু সে জানে না কিছু।
শিহাব জানতে চায়, “তারপর?”
হাসান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করে রইলো।
শিহাব বললো, “তুমি সেই চিঠি নিতুর হাতে দাওনি?”
হাসান ব্যথিত হৃদয়ে বললো, “না।“
“কিন্তু সেটা বলতে তোমার এত কষ্ট হচ্ছে কেন?”
“কারণ তার এক সপ্তাহ পর রুদ্র আত্মহত্যা করে।”
“কী!”
“খবরটা দিয়ে যায় একজন খ্রিস্টান পাদ্রী। বললেন, গলায় ফাঁস নিয়েছে।’
শিহাবের চোখ ভিজে যায় সামান্য, সেটা চোখেই রেখে বললো, “তারপর?”
“চিঠিটা নিতুর হাতে আসে এক বছর পর। পুরানো আলমারির রেকে অপ্রত্যাশিত কাগজের ভিড়ে কেমন করে খুঁজে পায় জানি না। আমার সামনে এসে জিজ্ঞাসা করে, “রুদ্র এসেছিল এ বাসায়?”
আমি তাকিয়ে রইলাম তার দিকে। বললাম, “হুম, এসেছিল।”
নিতু কোনো কথা না বলে এক কাপড়ে চলে যায়। দুবছর হলো, আমরা আলাদা।”
“দুটি পথ গেছে দু’দিকে বনের মাঝে হারিয়ে, আর আমি?
এই আমি—বেছে নিয়েছি সে পথ, যে পথে গিয়েছে কম লোকে
আর সেটাই ভিন্নতা গড়ে দেয় সবকিছুতে, পৃথিবীর বুকে।”
–রবার্ট ফ্রস্ট
১৯
সময়ের স্রোতে শিহাবের চিন্তার বিষয়বস্তু বদলাতে শুরু করলো। তারপর ভাদ্র মাসের এক সকালে শিহাব একটি কঠিন সমস্যায় পড়েছে। সমস্যাটা এই যে, সে হাসানকে আত্মহত্যা করবার জন্য একটা দড়ি কিনতে পাঠিয়েছে। বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যায় হাসান ফেরে একটা অ্যাকুরিয়াম নিয়ে। সে আত্মহত্যা করবে না।
শিহাব কোনো ভুল করতে চায় না। সে পুনরায় চিন্তা করে আস্ত একটা অতীত হাতড়ে আরও অধিক ব্যথিত হলো।
হাসানকে বললো, “অর্ধেক উপন্যাসের মাঝখানে মারা যেতে চাও?” হাসান অস্বস্তি নিয়ে তাকায়। শিহাবের এই সব উদ্ভট পটাসিয়াম সায়ানাইডের আইডিয়ায় সে বিরক্ত।
শিহাব বললো, “ঘুমের ভেতরে? স্বপ্ন দেখতে দেখতে হঠাৎ কোনো ইন্দ্ৰিয় কাজ করবে না।“
হাসান ধীর পায়ে রান্নাঘরে ছুটে গেল। যখন ফিরলো তখন তার হাতে একটা ধারালো ছুরি। ছুরিটা সে মুখের সামনে দুই চোখের মাঝখানে ধরে রেখেছে।
এমন সময় শিহাবের মোবাইলে অচেনা একটা নাম্বার থেকে ফোন আসে।
“হ্যালো”
“আমি রফিক সাহেব বলছি।”
“জি বলুন।”
“তুমি কি বাসায় আছো?”
“জি আছি।”
রফিক সাহেব ওপাশ থেকে ফোন কেটে দিলেন।
শিহাব ভীত চোখে হাসানের দিকে তাকায়। হাসান সামনে এসে ছুরিটা শিহাবের হাতে দিয়ে বললো, “এই নিন।”
“ছুরি কেন?”
“আমাকে হত্যা করুন।”
“আমি কেন তোমাকে হত্যা করব?”
“আপনি সেটাই চেয়েছিলেন, তবে আমাকে দিয়ে।”
“এতে আমার কী স্বার্থ?”
“কারণ আপনি লিখতে লিখতে অসুস্থ হয়ে গেছেন।”
শিহাব চিন্তিত হয়ে পড়ে। “আমি অসুস্থ হয়ে গেছি?”
“পৃথিবীতে এই ঘটনা এটাই প্রথম না। আগেও হয়েছে অনেক। আর্নেস্ট হেমিংওয়ে নিজের মাথায় গুলি করে কেন হত্যা করেছিলেন জানেন?”
“কেন?”
“কারণ তিনি মনে করেছিলেন, তিনি আর আগের মতো লিখতে পারছেন না।”
আর্নেস্ট হেমিংওয়ের লেখা সেই ছোটো গল্পের আক্ষেপ মনে করে শিহাবের হৃদয় ব্যথিত হয়।
“For sale: baby shoes, never worn” পৃথিবীতে জন্ম নেবার আগেই যে বাচ্চাটি মারা গেছে, তার জুতা জোড়া বিক্রি করা হবে, ব্যবহৃত হয়নি।
একটু যদি পেছনে ফিরে তাকাই, একদিন পড়ন্ত রোদে শিহাব এবং রফিক সাহেবের মধ্যে তিনশো টাকার স্ট্যাম্পে একটা চুক্তি হয়। চুক্তির শর্তানুযায়ী কিছু টাকা অগ্রিম নিয়ে শিহাব তখন ফেরিওয়ালার মতো গল্প খুঁজে হয়রান। অনেকেই মনে করে, মানুষের কাছে অনেক গল্প থাকে, কথাটা আসলে সত্য না। মানুষের কাছে ঘটনা থাকে, গল্প খুঁজে বের করতে হয়।
অতপর খরা মৌসুমে শিহাব একদিন লিখতে বসলে, তার সদ্য পরিচিত রুমমেট হাসানকে জিজ্ঞাসা করে, আলোতে তার অসুবিধা হয় কি না। সেই প্রসঙ্গের অলিগলি ঘুরে গল্পে রুদ্রের উত্থান। যে গল্পের শুরু হয়েছিল একটা লাইটার দিয়ে আর শেষটা হয়েছে বৃষ্টিস্নাত বিতর্কিত জানাজায়।
কেউ কেউ বলাবলি করছিল, রুদ্র যেহেতু গলায় ফাঁস নিয়েছে তাই তার জানাজার বিধান নেই। পরে অবশ্য মুরুব্বি করে একজন বলে গেলেন, যেহেতু সে মুসলমান তাই, জানাজা পড়া যাবে তবে দ্বীনি ব্যক্তিরা অংশ নেবে না। আল্লাহ তায়ালা সবচেয়ে ভালো জানেন।
হাসানের ব্যক্তিগত অধ্যায়ে একটা সার্থক উপন্যাসের সকল আলামত খুঁজে পায় শিহাব। কিন্তু লিখতে শুরু করলে গল্প এগোচ্ছিল না, কারণ হাসান গল্প বলে বেশ ধীর গতিতে
হাসানের বয়ানে মাঝের দিকে যখন একটু ঝিমুনির মতো চোখ লেগে আসে, তখন শোভা বাড়ায় ছাব্বিশ বছর আগের এক আক্ষেপ। কেউ আক্ষেপ খুঁজে পায় হুইল চেয়ারে বসে দেখা নিঃসঙ্গ নক্ষত্রে। কেউ টরোর শিং সাথে নিয়ে বাঁচতে চায়, পেছনে তাকানো যাবে না। পেছনে এক পাল ষাঁড়। কেউ জীবন ছেড়ে পালিয়ে যায় পুরানো রেকে অপ্রত্যাশিত কাগজের ভিড়ে; সম্বোধন ছাড়া লেখা রুদ্রের শেষ চিঠিতে। কেউ অতীত জলাঞ্জলি দেয় বৃষ্টির ফোঁটায়, প্লাস্টিকের বালতিতে। গুনতে ভুল হলে আবার শুরু করা যায়, কিন্তু যায় কি?
.
সমস্যা জটিল আকার ধারণ করে মূলত আরও পরে। গল্পটা লেখার পর হঠাৎই শিহাবের মনে হলো, রুদ্রের মৃত্যুর দায়ভার নেবার জন্য হাসানের আত্মহত্যা করা উচিত। সে ভাবতে থাকে হাসানকে কীভাবে আত্মহত্যা করার নির্দেশনা দিবে। নির্দেশনা এই কারণে যে তখন পর্যন্ত হাসান নিছক একটা গল্পের চরিত্র।
একজন লেখক হিসেবে তার একটা চরিত্রকে এই শাস্তি দেবার পূর্ণ স্বাধীনতা সে রাখে। কিন্তু মুশকিল হলো, শিহাব একটা সত্য ঘটনা লিখছে। সেক্ষেত্রে হাসানের আত্মহত্যা করার ঘটনাটাও সত্য হওয়া জরুরি।
চিন্তার তিনটা স্তরে পৃথক পৃথক দ্বন্দ্ব নিয়ে শিহাব প্রায় সময় কাগজ কলম নিয়ে বসে। প্রথম স্তরে রয়েছে, সে কেন মনে করছে হাসানের আত্মহত্যা করা উচিৎ? দ্বিতীয় স্তরে তাকে চিন্তা করতে হয়, কীভাবে সে হাসানকে এরকম একটা কাজে প্রলুব্ধ করবে? প্রকৃতির প্রতি একটা মানুষের প্রায়শ্চিত্ত করার যে দায়বদ্ধতা থাকে, সেটা নিয়ে বিস্তর আলাপ করে সে হাসানকে বোঝাতে চায়, তার আত্মবিসর্জন দেয়া উচিত।
আত্মহত্যা করার সবচেয়ে সহজ উপায় কী! একজন মানুষ যদি স্বপ্ন দেখতে দেখতে মারা যায় তাহলে সেই স্বপ্নটা কি থেমে যায়?
শিহাব উদ্ভ্রান্ত হয়ে বিছানার উপর বসলো। হাসান বললো, “চলেন একদিন বেড়াতে যাই কোথাও। লিখতে লিখতে আপনি অসুস্থ হয়ে গেছেন।”
“আমি অসুস্থ?”
“জি।”
কেন?”
“কারণ আপনি গল্পের চরিত্রকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছেন, এরা পৃথক সত্তা।”
হাসানের এই কথাটা শিহাবের মনে ধরেছে। একজন লেখক যেভাবে চিন্তা করে, গল্পের চরিত্র সেভাবে চিন্তা করে না। লেখকের কাজ তার চরিত্রের ভেতরে ঢুকে পড়া; তার উপর নিজের ইচ্ছে চাপিয়ে দেয়া না।