শেষ – ৫

হাসান বলতে থাকে, “গেটের ভেতরে ঢুকতেই দেখি নিতু উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখে হঠাৎ উদ্বিগ্ন। বললাম, “আবার আসতে হয়েছে অফিসের কাজে।”

সে বললো, “আমার কাছে কেন?”

আমি বললাম, “বিশেষ কোনো কারণ নেই। আপনার বইয়ের ভেতরে একটা চিরকুট রাখা ছিল। ভাবলাম আপনাকে দেয়া প্রয়োজন।“

নিতু কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে চিরকুট হাতে নিলো। আমি বললাম, “চিঠিটা আমি পড়েছি। রুদ্র নামে এক যুবক তার সীমাহীন ভালোবাসার কথা লিখে গেছে।“

নিতু চুপ করে রইলো কিছুক্ষণ, তারপর ভেতরে আসতে বললো। যথারীতি আমাকে চা দেয়া হলো। একটা কাচের বাটিতে করে পায়েস। আমি চায়ে চুমুক দিয়ে বললাম, “কিছু মনে করবেন না, চিঠি পড়াটা আমার অন্যায় হয়েছে।”

নিতু শান্ত হয়ে আমার দিকে তাকালো। তার চোখে রাগ-বিস্ময় কিছু নেই। আমি বললাম, “যুবক কি তার প্রেমিকার ভালোবাসা পেয়েছে?”

নিতু মলিন হেসে বললো, “থাক সেসব।“

কিন্তু আমার নিতুকে জানতে ইচ্ছে করে। সেদিন প্ল্যাটফর্মে বলেছিল একটা জায়গায় তার বিয়ের কথা চলছে, তাই পালিয়ে এসেছে। তার পালিয়ে আসার পেছনে রুদ্র নামে এই যুবকের কোনো সম্পর্ক আছে কি না জানতে ইচ্ছে করে।

কথার এই পর্যায়ে শিহাব হাসানকে থামিয়ে দিয়ে জানতে চায়, চিঠিতে কী লেখা ছিল?

হাসান বললো, “টানা টানা হাতে লেখা চিঠি। চিঠির শেষে তারাপদ রায়ের কবিতা।” বলেই হাসান বিড়বিড় করে বলতে থাকে,

“অনেকদিন দেখা হবে না
তারপর একদিন দেখা হবে।
দুজনেই দুজনকে বলবো,
‘অনেকদিন দেখা হয়নি’।
এইভাবে যাবে দিনের পর দিন
বছরের পর বছর,
তারপর একদিন হয়তো জানা যাবে
বা হয়তো জানা যাবে না, যে
তোমার সঙ্গে আমার
অথবা;
আমার সঙ্গে তোমার
আর দেখা হবে না।”

হাসান বললো, “আমি নিতুর কাছ থেকে দ্বিতীয়বার সেই চিঠির প্রেরকের কথা জানতে চাইলাম। বললাম, “তারপর একদিন কী জানা গেল? তার সাথে কি আর দেখা হয়েছিল?”

হাসানের কাছ থেকে গল্প শোনার এক তৃপ্তি আছে। কোথায় থামতে হয়, কোথায় জিজ্ঞাসা করতে হয় সেসব তার জানা। কিছুটা ঝুঁকে এসে হাসান বললো, “আপনাকে পুরো চিঠি পড়ে শোনাবো?”

শিহাব হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ে।

হাসান বইয়ের ভাঁজ থেকে চিঠি বের করে বলতে শুরু করে…

নিতু,

তখন শীত নেমেছিল। আমি কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছি, হঠাৎ একদিন সকালে তোমার উপস্থিতি। আমাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে বললে, আমার চিঠি কই?

আমি দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম ভোর পাঁচটা বাজে। তারপর খেয়াল হয়, এই ঘড়ি দুদিন ধরে নষ্ট। রাতে অনেক দেরি করে ঘুমিয়ে ছিলাম।

ঘুমের রেশ কাটছিল না। চোখ মিটমিট করে তাকিয়ে দেখি, তুমি একটা শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে আছো। আমাকে তাড়া দিয়ে বললে, “তোমাকে চমকে দেবার জন্য এসেছি।”

আমি বললাম, “চমকে দেবার কী আছে? গত তিন বছর ধরেই তো এই দিনে সকাল সকাল কেক নিয়ে এসে বলছো- এই যে বার্থডে বয়, আমার চিঠি কই?”

তুমি বললে, “কিন্তু এবার আরও একটা সারপ্রাইজ আছে। তার আগে আমার চিঠি দাও।”

আমি বালিশের নিচ থেকে চিঠি বের করলাম। তুমি প্যাকেটে মোড়ানো একটা বাক্স দিয়ে বললে, “তাড়াতাড়ি উঠে ফ্রেশ হয়ে নাও। “

বাক্স খুলে আমার চোখ কপালে উঠে গেল। বললাম, “পাগড়ি?”

একটা উজ্জ্বল তামাটে পাগড়ি। অফ হোয়াইট কালারের শেরওয়ানি।

তুমি বললে, “আজ তোমার বিয়ে।”

“আমার বিয়ে অথচ আমি জানি না?”

“ জানলে আর সারপ্রাইজ থাকে কি না?”

আমি বিছানা থেকে উঠে পাগড়ি হাতে নিয়ে বললাম, “পৃথিবীতে এই বিরল ঘটনা আর কারো সাথে হয়েছে বলে মনে হয় না।”

তুমি হাসতে লাগলে। তোমার হাসি মোনালিসার হাসি থেকেও রহস্যময়। মোনালিসার হাসি বুঝতে লিওনার্দোর বারো বছর লেগেছিল। তোমার হাসি বুঝতে তার পঞ্চাশ বছর লাগার কথা।

চিঠি আর বেশি বড়ো করবো না। আকাশ ভর্তি তারার মাঝে যেভাবে আমরা নিজের তারার সাথে অন্য তারা মিশিয়ে ফেলি, সেভাবে তোমাকেও হারিয়ে ফেলেছি ক্ষণিকের জন্য সামান্য একটু চোখের আড়ালে!

কেন যেন মাঝে মধ্যে জানতে ইচ্ছে করে, অনেকদিন পর তোমার সাথে আবার দেখা হলে কিংবা দেখা না হলে কী কথা হবে আমাদের মধ্যে! তারাপদ রায়ের কবিতার মতো।

তারপর একদিন হয়তো জানা যাবে
বা হয়তো জানা যাবে না, যে
তোমার সঙ্গে আমার
অথবা;
আমার সঙ্গে তোমার
আর দেখা হবে না।
ইতি,
রুদ্র

শিহাব কিছুটা চিন্তিত হয়ে বললো, “এই চিঠি তুমি নিতুকে ফেরত দিতে গিয়েছিলে। তাহলে বইয়ের ভাঁজ থেকে বের করলে কী করে?”

হাসান বললো, “আপনি বোধহয় ভুলে গেছেন নিতুর সাথে আমার বিয়ে হয়েছে।”

শিহাব জানতে চায়, “সে এখন কোথায়?”

সেদিন কথায় কথায় বেলা গড়িয়ে দুপুর হতে চলেছে। নিতু ঠিক কোথায়

দাঁড়িয়ে আছে বোঝার চেষ্টা করছিলাম। বললাম, “আমার একটা দারুণ কৌতূহল হচ্ছে।”

নিতু বললো, “কী?”

“চিঠির যে অংশ লেখা হয়নি, সেই অংশে কী ছিল?”

“মানে?”

নিতু বিস্মিত হয়ে বলে, “মানে?”

“মানে, আপনি সেদিন রুদ্র নামে এক ভদ্রলোকের জন্মদিনে সকাল দশটায় উপস্থিত হলেন। তিনি ঘুম থেকে উঠে চমকে দেখলেন তার প্রেমিকা পাগড়ি আর শেরওয়ানি দিয়ে বললো, আজ আমরা বিয়ে করব। তারপর কী?”

নিতু বাটি এগিয়ে দিয়ে বললো, “পায়েস নিন। খেজুরের গুড় দিয়ে বানানো হয়েছে।”

আমি পায়েস খেতে শুরু করলাম। বললাম, “আপনার বলতে অসুবিধা থাকলে, থাক।”

নিতু বললো, “আমি সেদিন সত্যি সত্যি বাসা থেকে এটা ঠিক করে বের হয়েছিলাম যে, আজ আমি রুদ্র নামে এই পাগল পাগল ছেলেটাকে বিয়ে করবো। বাসায় কাউকে না বলে চলে গেলাম রুদ্রের বাসায়।

রুদ্রের বাসায় আগেও আমি অনেকবার গিয়েছি। রুদ্র একা একটা চিলেকোঠায় ভাড়া থাকে। তার বাবা- মা রাজশাহী থাকেন। রুদ্র যেখানটায় থাকে, দরজার খিলটা এমন যে বাইরে থেকে টান দিয়ে খোলা যায়। এই জিনিসটা সে একদিন শিখিয়ে দিয়েছিল আমাকে। ভেতরে ঢুকে দেখি সে কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছে। জাগিয়ে বললাম, “আমার চিঠি কই?”

.

রুদ্র চোখ ভর্তি ঘুম আর বিস্ময় নিয়ে বালিশের নিচে থেকে চিঠি বের করে দেয়। তারপর একসময় মাথায় পাগড়ি পরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে বলে, “নিজেকে কেমন মোঘল সম্রাট মনে হচ্ছে।”

আমি বললাম, “আজকে সারাদিন আমরা কী করব, সব ঠিক করা আছে। প্রথমে আমরা একটা কেক কাটব। অর্ডার করা আছে। কিছুক্ষণ পরই একজন ডেলিভারি ম্যান এসে দিয়ে যাবে। জন্মদিন উদযাপন করে আমরা বের হয়ে মগবাজার যাবো। সেখানেই কাজী অফিস। যাবার পথে গাড়িতে বাজবে লিওনার্দো কোহেনের গান।”

.

রুদ্র আয়না থেকে চোখ না সরিয়ে এক বাক্যে তিনটা প্রশ্ন করে। লিওনার্দো কোহেনের গান কেন? সাক্ষী কোথায়? আংকেল আন্টি জানে কিছু?

“সাক্ষী তৈরি করা আছে।”

.

খোঁচা খোঁচা দাড়ি আর শেরওয়ানিতে রুদ্রকে দারুণ লাগছিল। আমি বললাম, “হঠাৎ বিয়ের কথা শুনে তোমাকে যেরকম চমকে যেতে দেখব ভেবেছিলাম তেমনটা হয়নি।”

রুদ্র বললো, “আশাহত হলে?”

“হুম।”

“চিঠিটা পড়।”

সেই যে তখন রুদ্র চিঠি দিয়েছিল আমি হাতে নিয়েই বসে ছিলাম। চিঠি না পড়ে থাকাতেও একটা আনন্দ আছে। পৃথিবীর সব আনন্দ একদিন কোথায় গিয়ে শেষ হয় জানেন? যখন মানুষের কোনো আশা থাকে না।

শিহাব বেশ মুগ্ধ হয়ে শুনছে হাসানের কথা। একটা গাছের শুকনো পাতা কেমন করে ঝরে পড়ে, একটা ভিখারি কেমন মিতব্যয়ী হয়ে মেলায় তার সন্তানের জন্য খেলনার গাড়ি কেনে, শহরের রাস্তায় কেন বৃদ্ধ হিজড়া দেখা যায় না? একটা চড়ুই কি স্বপ্ন দেখে? দেখলে সেটা কী? এসব উচ্চ বর্গীয় আলোচনা (?) হাসানের সাথে করতে খুব ভালো লাগে।

হাসানের গল্পে একটি চরিত্র থেকে অন্য আরেকটি চরিত্র উঠে আসতে শুরু করে। তার স্ত্রী নিতু, দুবছর আগে চলে গেছে। কেন কিংবা কোথায় গেছে সেটা এখনও জানা যায়নি। গল্পের এই পর্যায়ে রুদ্র নামে আরেকটি চরিত্র এসে হাজির। রুদ্রের উত্থান ঘটে কবি শেলির বইয়ের ভাঁজে রেখে দেয়া এক চিরকুট হতে। সেই চিঠির সূত্র ধরে এই চরিত্র ডালপালা মেলতে শুরু করে।

প্রথমে মনে হয়েছিল এই চরিত্রের সাথে হাসানের মূল গল্পের খুব বেশি সম্পর্ক হয়তো থাকবে না। কিন্তু একটা পর্যায়ে বোধগম্য হয়, হাসানের জীবনে রুদ্র হলো শিউলি ফুলের মতো। যেটা রাতে ফোটে আর সকালে ঝরে পড়ে। কবি শেলির বইটি যদি শিউলি ফুল হয়ে থাকে, তবে বইয়ের ভেতরে রাখা চিরকুট হলো সেই ফুলের ঝরে পড়া।

সেবার অফিস কামাই করে হাসান এক সপ্তাহ খুলনায় ছিল। এই এক সপ্তাহে বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছে নিতুর সাথে। একদিন তারা শহর থেকে দূরে নদীর কিনারায় বেড়াতে যায়।

হাসান বললো, “এখানে আগে এসেছেন কখনো?”

“আসা হয়নি। তবে এই নদীটা আমার কাছে ব্যক্তিগত মনে হয়। জীবনানন্দ দাশ তার কবিতায় এই রূপসার ঘোলা জলের কথা লিখে গেছেন।

“হয়তো দেখিবে চেয়ে সুদর্শন উড়িতেছে সন্ধ্যার বাতাসে; হয়তো শুনিবে এক লক্ষীপেঁচা ডাকিতেছে শিমুলের ডালে; হয়তো খইয়ের ধান ছড়াতেছে শিশু এক উঠানের ঘাসে রূপসার ঘোলা জলে হয়তো কিশোর এক শাদা ছেঁড়া পালে ডিঙা বায়; রাঙা মেঘ সাঁতরায়ে অন্ধকারে আসিতেছে ধবল বক; আমারেই পাবে তুমি ইহাদের ভিড়ে-”

তাদের কথা হয়েছে ছোটো ছোটো প্রাসঙ্গিক বিষয়ে। একটা মুহূর্ত যেভাবে টেনে নিয়ে যায় অন্য একটা মুহূর্তে। এই ঘোলা জলের রূপসা নদীতে আসা হতো না, যদি না একদিন ভুল স্টেশনে নেমে না পড়তো। সেই ভুল স্টেশনে দুজনের দেখা হবার সাথে রুদ্রের সম্পর্কটা কোথায় এসে এই গল্পে মিলিত হয়েছে সেটা বলা দরকার।

রাত তখন এগারোটা। নিতু একটি বাস স্টেশনের কাউন্টারে বসে আছে। কাউন্টারে গিয়ে জানতে পারে, কোনো সীট খালি নেই। সে যাচ্ছে কক্সবাজার। সেখান থেকে কোথায় যাবে সেটা সেখানে গিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

বাসায় ফিরে না যাবার পেছনে তার কাছে যথেষ্ট কারণ আছে, সব চাইতে বড়ো কারণ হলো, এই বাসায় তার দম বন্ধ হয়ে আসে। এর ভেতরে রাত বাড়তে শুরু করলে কাউন্টারে ভিড় কমতে শুরু করে এবং যথারীতি অপরিচিত একজন তাকে লক্ষ্য করে চলছে।

নিতু কাউন্টার থেকে বের হয়। সামনে একটা যাত্রী ছাউনি। দুটো চায়ের দোকান। নানান মতলবে নানান মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে।

নিতুর একটু একটু ভয় হয়। এর আগে সে এত রাতে কখনো বাসা থেকে বের হয়নি। সে অবশ্য টেবিলের উপর একটা চিঠি রেখে এসেছে। বাবাকে সম্মোধন করে লেখা পাঁচ শব্দের চিঠি, ‘আমাকে খোঁজার চেষ্টা করো না’।

লোকটা এখান পর্যন্ত চলে এসেছে। যাত্রী ছাউনিতে একজন পাঞ্জাবি পরিহিত বয়স্ক লোক অর্ধেকটা জায়গা দখল করে পা মেলে বসে আছেন। তার পাশেই কম বয়সি এক যুবক বসে বসে সিগারেট টানছে।

নিতু ছেলেটার কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করে, “লাইটার হবে?”

ছেলেটা পকেট থেকে লাইটার বের করে দিলো।

“সিগারেট? সিগারেট হবে?”

ছেলেটা কথার জবাব না দিয়ে উঠে চলে গেল।

নিতুর একটু একটু করে মন ভালো হতে শুরু করে। এই বিদ্যা সে আয়ত্ত করেছে বাবার কাছ থেকে। কেউ যদি উত্যক্ত করতে আসে তখন ভয় দিয়ে

ভয়কে জয় করতে হয়।

কিছুক্ষণ পরই ছেলেটা একটা সিগারেট নিয়ে হাজির হয়। নিতু সিগারেট জ্বালিয়ে বললো, “কক্সবাজারের বাস কখন পাবো জানেন?”

“জানি না।”

“আমি জানি। সকালের আগে আর কোনো বাস ছেড়ে যাবে না।“

“তাহলে আমাকে জিজ্ঞাসা করছেন কেন?”

“একটা কুৎসিত মানুষ অনেকক্ষণ ধরে আমার পিছু নিয়েছে। তাই আপনার কাছ থেকে সিগারেট চাইলাম। লোকটি এখন মনে করবে আমরা পূর্বপরিচিত।”

ছেলেটা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। নিতু বললো, “এই দেখেন লোকটা কেমন করে তাকিয়ে আছে। আসেন এক কাজ করি। আমরা দুজন একসাথে তার দিকে তাকিয়ে থাকি।”

“তারপর?”

“আমরা তাকে অনুসরণ করবো।”

“এটা কেমন খেলা?”

“এই খেলার নাম হলো, ভয় দেখিয়ে ভয়কে জয় করা। কেউ আপনাকে ভেংচি দিলে আপনি কী করবেন জানেন?”

“কী?”

“তাকেও ভেংচি দিবেন।” বলেই নিতু ভেংচি দিয়ে লোকটির দিকে তাকালো। ছেলেটা মুগ্ধ হয়ে নিতুর কথা শুনছে। তার হাতে যে একটা সিগারেট জ্বলছে, এইদিকে তার খেয়াল নেই।

“কী ব্যাপার, আপনাকে যেটা বলেছি করছেন না কেন?”

“কী করব?”

“ভেংচি দিবেন। আমার সাথে ঐ লোকটাকে ভেংচি দিবেন। আচ্ছা, আপনার নাম কী?”

“রুদ্র।”

তারা দুজন ভেংচি দিয়ে লোকটার দিকে তাকিয়ে আছে। লোকটা পিছু হটে গিয়ে একটা রিকশা নেয়।

নিতু বললো, “চলেন আমরাও একটা রিকশা নেই।”

আশেপাশের দোকানপাট বন্ধ। রাত তখন বারোটা। একটা বিশাল আকৃতির সুটকেস নিয়ে তারা হাঁটছে।

রুদ্র বললো, “আপনি কোথায় যাবেন?”

“জানি না।”

“কী সাংঘাতিক!”

“কেন? রাস্তায় বের হলেই কোথাও যেতে হয় নাকি?”

“সারারাত এই সুটকেস নিয়ে রাস্তায় থাকবেন?”

“হ্যাঁ, এত রাতে আর কার কোথায় যাবো?”

খানিকটা বিরতি নিয়ে নিতু বললো, “আপনার মোবাইলটা একটু দিন আমার ফোন বন্ধ হয়ে আছে।”

রুদ্র পকেট থেকে ফোন বের করে দিলো। নিতু মুখস্থ নাম্বার ডায়াল করে কথা বলছে, “হ্যালো তিশা…”

নিয়ন আলোর সাথে হেড লাইটের আলো মিশে গিয়ে একটা দারুণ কেমিস্ট্রি হয়েছে। সাথে গোলক ধাঁধার মতো রাস্তা।

অল্প আলোতে রুদ্র প্রথমবারের মতো নিতুর দিকে তাকায়। ধনুকের মতো বাঁকানো ভ্রু, চোখের চাহনিতে কীরকম একটা মাদক মেশানো সম্মোহন। গায়ের রং শ্যামলা। হলদে হলদে।

“আপাতত কিছু খাওয়া দরকার। এত রাতে কোথায় খাবার পেতে পারি?” বললো নিতু।

“সেটা তো একটু দূরে। মোহাম্মদপুর বাস স্টেন্ডের সামনে। সারারাত তেহেরি পাবেন।”

“চলেন তেহেরি খাই।

রুদ্র একটা সিএনজি ডেকে দরদাম করছে। এমন সময় চাদর গায়ে জড়ানো লোকটা এসে হাজির।

“লাইটার হবে?”

“খবরদার লাইটার দিবেন না। সে কাউন্টার থেকে আমার পিছু নিয়েছে”

লোকটি বললো, “আমি কেন আপনার পিছু নিবো?”

রুদ্র কথা না বাড়িয়ে নিতুকে সিএনজিতে উঠতে বলে। তারপর লোকটার কাছে গিয়ে লাইটার দিয়ে বললো, “এই নিন।“

লোকটি লাইটার নিয়ে একটু পেছনের দিকে এসে গলার স্বর নামিয়ে বললো, “কোথায় যাচ্ছেন?”

“কোথায় যাচ্ছি সেটা আপনাকে কেন বলব?”

“দেখি আমাকে ভেংচি দিন, কাছ থেকে দেখি।”

মানুষ হিসেবে রুদ্র একটু ভীতু স্বভাবের। তাই এই লোকটাকে সে ভেংচি দিতে পারছে না। নিতু সিএনজি থেকে ডাকছে রুদ্রকে। রুদ্র লাইটার ফেরত না নিয়ে নিতুর পাশে এসে বসল।

.

রাত একটায় মোহাম্মদপুর বাস স্ট্যান্ডে, তারা দুজন তেহেরি খেতে বসে। রুদ্র বললো, “আপনি কোথায় যাবেন?”

“কোথাও না। এত রাতে আর কোথায় যাবো?”

“সারারাত বাইরে থাকবেন?”

“ভালোই তো লাগছে। আগে কখনো রাতে বের হইনি।“

“বের হয়ে ভালো কিছু তো দেখলেন না। উটকো এক লোক ঘুরঘুর করছে।”

তারা হাঁটতে লাগলো বড়ো রাস্তা ধরে। রুদ্র জিজ্ঞাসা করে, “কক্সবাজার কেন যাচ্ছেন?”

“সমুদ্র দেখব।”

“সমুদ্র দেখার জন্য একা একা কক্সবাজার যাচ্ছেন?”

“সমুদ্র দেখার জন্য একা একা কোথাও যাচ্ছি না। আমি একা তাই সমুদ্রে যাচ্ছি।”

“আপনি কিন্তু ভারি অদ্ভুত।

নিতু বললো,” কোথাও চা খেতে পারলে ভালো হয়।”

“সামনেই পাবেন। একটা রিকশা নিবো?”

অন্ধকার রাত। একটু একটু কুয়াশা। শীত মাত্র নামতে শুরু করলো। এর ভেতরে রুদ্রের মোবাইলে একটা ফোন আসে।

“হ্যালো, কে বলছেন?”

“আপনি কাকে চাচ্ছেন?”

“একটু আগে এই নাম্বার থেকে একটা ফোন এসেছিল। আমি তার ছোটো বোন, তিশা বলছি।”

“ও আচ্ছা।”

“নিতু আপু কী আপনার সাথে আছে?”

“হ্যাঁ দিবো?”

রুদ্র নিতুকে ফোনটা এগিয়ে দিলো। “ছেলেটা কে?”

“রুদ্র। আজই পরিচয়।“

“এত রাতে তুমি সুটকেস নিয়ে একটা ছেলের সাথে বাইরে, আর বলছো আজই পরিচয়?”

.

কুয়াশায় আচ্ছন্ন অন্ধকার রাস্তা। একটা পুলিশের গাড়ি তাদের কাছে এসে মুখের উপর টর্চ লাইটের আলো দিয়ে সামনে আসার সংকেত দিলো।

গাড়ি থেকে নেমে একজন পুলিশ পানের পিক ফেলতে ফেলতে জিজ্ঞাসা করলেন, “কোথায় যান?”

রুদ্র জবাব দিলো, “আসাদ গেট।”

নিতু ফোনে কথা বলছে, “আমার জন্য চিন্তা করতে মানা করবে।“

যে পুলিশটা জিজ্ঞাসা করেছিলেন তিনি নিতুর দিকে তাকিয়ে রইলেন। সম্ভবত তিনি অপেক্ষা করছেন, ফোনে কথা শেষ হলে তারপর জিজ্ঞাসা করবেন।

নিতু ফোনের লাইন না কেটে পুলিশ কর্মকর্তার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলো, “কিছু বলবেন?”

বিকট শব্দে পুলিশের ওয়াকিটকি বাজছে। মোবাইলের ওপাশ থেকে তিশা বলছে, “আপু কোনো সমস্যা? পুলিশ কেন?”

“না কোনো সমস্যা না। পরে ফোন করছি।”

ইতোমধ্যে পুলিশের গাড়ি থেকে আরও দুজন নামলেন। তাদের একজন রাস্তার অন্য পাশে একটা অন্ধকার ড্রেনের উপর দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করছে।

ওয়াকিটকি হাতে নেয়া পুলিশ কর্মকর্তা দ্বিতীয় দফায় পানের পিক ফেলে নিতুকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করলেন, “কোথায় যান?”

“আসাদ গেট।”

“কেন?”

“চা খেতে।”

রুদ্র ভীতু প্রকৃতির। তার মাথা কাজ করছে না। প্রশ্ন এবার রুদ্রের দিকে।

“এত রাতে সুটকেস নিয়ে চা খেতে আসাদ গেটে যাচ্ছেন?”

নিতু জবাব দিলো, “চা খাওয়ার সাথে সুটকেসের সম্পর্ক কোথায়?”

“প্রশ্ন উনাকে করছি। উনাকে উত্তর দিতে দিন।”

“এখানে কোথায় এসেছেন?”

“তেহেরি খেতে।” রুদ্র জবাব দিলো।

“রাত দুইটা ত্রিশ মিনিটে তেহেরি খেতে মোহাম্মদপুর, চা খেতে আসাদ গেট, হাতে আবার সুটকেস।”

নিতু বললো, “সুটকেসে সমস্যা কোথায়?”

“তেহেরি খেতে কেউ নিশ্চয় রাত আড়াইটায় সুটকেস নিয়ে বের হয় না।”

“সুটকেস কারণ আমি বাস মিস করেছি। সকালে আমার কক্সবাজারের বাস।”

“আর আপনি?” প্রশ্ন এবার রুদ্র বরাবর।

এমন সময় রুদ্রের ফোন বেজে উঠলো। রিসিভ করতেই তিশা বললো, “নিতু আপু কি এখনো আপনার সাথে?”

“জি, আমার সাথে।”

“ওয়াকিটকির শব্দ কেন?”

“পুলিশ এসে জিজ্ঞাসাবাদ করছে।“

এই পর্যায়ে পুলিশ কর্মকর্তা ভ্রু কুচকে রুদ্রের দিকে তাকালেন।

“পুলিশ কেন?”

“এমনিতেই।”

“আপনি আপুকে আগে থেকে চিনতেন?”

“না। আজই পরিচয়, কাউন্টারে।”

“তাহলে এত রাতে সে আপনার সাথে কেন? বাসায় সবাই চিন্তা করছে।”

“সেটা তো আমি বলতে পারব না। “

“আপনি তাকে আগে থেকে চিনতেন?”

“বলেছি তো, না।”

“কখন থেকে পরিচয়?”

“আচ্ছা আপনার সাথে পরে কথা বলছি। একটু ঝামেলায় আছি।”

রুদ্র ফোন রাখতেই পুলিশ কর্মকর্তা জিজ্ঞাসা করলেন, “কাউন্টারে পরিচয় মানে? বুঝলাম না।

নিতু বিরক্ত সুরে বললো, “আমি তো বললামই, আমি বাস মিস করেছি। সেখানেই উনার সাথে পরিচয়।’

“সেখানে পরিচয় হবার পর তেহেরি খেতে মোহাম্মদপুর এলেন?”

“রাতে খিদে পেলে তেহেরি খেতে সমস্যা?”

মাত্র প্রস্রাব করে আসা পুলিশটা ঢিলা-কুলুখ করবার পর সুটকেস তল্লাশি করতে শুরু করলেন। তারপর বললেন, “আপনি কক্সবাজার কেন যাচ্ছেন?’

এমন সময় আবার রুদ্রের ফোন বেজে উঠলো। ফোনের ওপাশ থেকে অন্য একটি কণ্ঠ।

“হ্যালো, আমি নিতুর মা বলছি।”

“জি আন্টি বলেন।

“তুমি কে?”

“আমি রুদ্র।”

“নিতু তোমার সাথে এখন কোথায়?”

রুদ্র ফোনটি নিতুর দিকে এগিয়ে দিলো। নিতু অস্থির উত্তেজনা নিয়ে কথা বলছে, “মা এখন একটু ঝামেলায় আছি। তোমাকে একটু পর ফোন করছি।”

“শুনলাম তোমাদের পুলিশে ধরেছে, কার সাথে তুমি? কোথায়?”

নিতু ফোন রেখে দিলো। পুলিশ কর্মকর্তার এই দিকটা লক্ষণীয়। ফোনে কথা বলার সময় তিনি তার জিজ্ঞাসা-পর্ব স্থগিত রাখেন। তারপর যেখান থেকে থেমেছিলেন আবার শুরু করেন, “আপনি একা কক্সবাজার কেন যাচ্ছেন?”

“সমুদ্র দেখতে।”

“বাসা থেকে পালিয়ে?”

নিতুর মনে হলো, পালিয়ে কেন হবে? সে তো চিঠি লিখে এসেছে। এসে আবার তিশাকে ফোন করে জানিয়েছে, দুশ্চিন্তা না করতে। সে জবাব দিলো, “না, পালিয়ে আসিনি।“

পুলিশ কর্মকর্তা আরেক দফা পান মুখে নিয়ে বললেন, “আপনাদের কথায় সামঞ্জস্যের অভাব আছে। থানায় আসতে হবে।”

নিতু বললো, “কোথায় অসামঞ্জস্যতা, সেটা দয়া করে বলুন?”

“আপনি বলেছেন এই যুবকের সাথে আপনার আজ রাতে কাউন্টারে পরিচয়। কিন্তু ইতোমধ্যেই তার মোবাইলে আপনার কাছে ফোন আসে। তার মানে হলো, যিনি ফোন করেছেন তিনি আপনাদের দুজনের পরিচিত।”

“দেখুন আমার মোবাইল বন্ধ হয়ে আছে। তাই, উনার নাম্বার থেকে বাসায় ফোন করে কথা বলি। আমাকে ফোন করে পাচ্ছে না বলেই উনার নাম্বারে ফোন করছে।”

“গাড়িতে উঠেন।”

“কেন?”

“আসাদ গেট নামিয়ে দেই।”

.

রাত তিনটা বাজে আসাদ গেটের সামনে রুদ্র জিজ্ঞাসা করে, “আপনার নাম নিতু?”

“কী করে জানলেন?”

“তিশা বলেছে।”

“ও আচ্ছা, আমার ছোটো বোন।”

“আপনার আম্মুও ফোন করেছেন। কথা বলবেন?”

“এখন না।”

“একা কেন সমুদ্রে যাচ্ছেন?”

“আমি একা তাই সমুদ্রে যাচ্ছি।”

রুদ্র চুপ করে রইলো। তার জানতে ইচ্ছে করছে সে একা কেন? কিন্তু এটা জিজ্ঞাসা করা যায় না।

বাইরে শীত বাড়তে শুরু করে। রুদ্রের কেমন যেন একটু একটু মন খারাপ হতে শুরু করলো। মন খারাপের কারণ অস্পষ্ট।

“কক্সবাজারে কদিন থাকবেন?”

“জানি না।

“বাসা থেকে পালিয়ে এসেছেন?”

“ঠিক তা না।”

“এভাবে কতদিন ঘুরে বেড়াবেন?”

নিতু হেসে বললো, “আমার কাছে অনেক টাকা আছে।”

বলেই নিতুর মনে হলো, হঠাৎ কাউন্টারে পরিচিত এক যুবককে এই তথ্য দেওয়া কি ঠিক হয়েছে? কিন্তু নিতুর বলতে ভালো লাগছে।

নিতু চায়ে চুমুক দিয়ে বললো, “আমার কাছে দারুণ এডভেঞ্চার এডভেঞ্চার লাগছে। জীবনে প্রথম রাতে বের হয়ে তেহেরি খেয়েছি। এমনকি পুলিশের ঝামেলাটাও এখন সুন্দর মনে হচ্ছে। একটা জিনিস খেয়াল করেছেন?”

“কী?”

“পুলিশ কিন্তু তাদের জায়গা থেকে ঠিক ছিল। এত রাতে সুটকেস নিয়ে কেউ চা খেতে আসাদ গেট যাবে কেন?”

রুদ্র হাসতে লাগলো। সে এভাবে ভেবে দেখেনি।

নিতু বললো, “কারণ আমরা ভিন্ন জায়গা থেকে একই ঘটনা দেখছি। এই যে আমি এখানে চায়ের কাপ নিয়ে বসে আছি, সকালের বাসে কক্সবাজার যাবো। তারপর? জানি না। আপনিও কিন্তু আরেকটা চায়ের কাপ নিয়ে বসে আছেন। আপনার জায়গা থেকে গল্পটা ভিন্ন। কাউন্টারের সামনে থেকে এক অচেনা মেয়ে এসে বললো, লাইটার হবে? তারপর মেয়েটিকে নিয়ে সারারাত ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আচ্ছা, কী করেন আপনি?”

“একটা প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করি।“

“সকালে অফিস আছে?”

“বেলা করে গেলেও চলবে।”

তারা দুজন বড়ো রাস্তা ধরে এগোতে থাকে। রুদ্র একবার আকাশের দিকে তাকালো। কত গুলো নক্ষত্র কেমন সাংকেতিক প্রশ্নের (?) চিহ্নের মতো দাঁড়িয়ে আছে। রুদ্রের জানতে ইচ্ছে করছে, এই মেয়েটা কেন একা সমুদ্রে যেতে চায়।

.

অন্ধকার নির্জন রাত, শুধু মাঝেমধ্যে একেকটা গাড়ি শাঁ শাঁ করে চলে যায়। একটু সামনে এগোতেই দেখা গেল রাস্তার ধারে এক জরাজীর্ণ যুবক, আকাশের দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হাসছে।

রুদ্র ছেলেটার কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করে, “আপনি একা একা হাসছেন কেন?”

“আপনাকে নিষেধ করা হইছে?”

রুদ্র অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। তার চোখে মুখে কেমন একটা ব্যাকুলতা।

“ঘুড়ি উড়াইতেছি। ঐ দেখেন।”

নিতু এবং রুদ্র দুজন মাথা উঁচিয়ে আকাশের দিকে তাকায়। এত বড়ো একটা চাঁদ মধ্য আকাশে স্থির হয়ে আছে। ছেলেটা শূন্য হাতে নাটাই ধরে সুতা টানছে, আবার ছাড়ছে। তার হাতে কোনো নাটাই নেই। আকাশে কোনো ঘুড়ি নেই। সে মনের অজান্তে চাঁদটাকে ঘুড়ি বানিয়ে বিচিত্র এক খেলায় মেতেছে।

রুদ্র ছেলেটাকে উদ্দেশ্য করে বললো, “আপনার ঘুড়ি কোথায়?”

সে আঙ্গুল দিয়ে চাঁদ দেখিয়ে দিয়ে আবার সুতা টানতে থাকে। মুহূর্তেই তাকে বেশ উদ্বিগ্ন মনে হলো। রাগে রীতিমতো কাঁপছে।

কিছুক্ষণ পর এটিএম বুথ থেকে একজন সিকিউরিটি গার্ড এসে বললেন, “এর মাথায় সমস্যা আছে।”

রুদ্র জিজ্ঞাসা করে, “পাগল নাকি?”

ছেলেটি পাগল শুনে নিতুর মন খারাপ হয়। জিবরানের ‘পাগল’ গল্পটি মনে পড়ে তার। এক শহরে সব মানুষ মুখোশ পরে ঘুরে বেড়ায়। এর ভেতরে একজন মুখোশ খুলে ফেললে, সবাই তাকে পাগল বলতে শুরু করে।

অস্কার ওয়াইল্ডের একটা উক্তি আছে, Man is least himself when he talks in his own person. Give him a mask, and he will tell you the truth.

ছেলেটা হাঁপাতে হাঁপাতে বললো, “ঘুড়ি কাটা পড়ছে।”

নিতু জানতে চাইলো, “কীভাবে?”

“ওসমানের সুতা ধারালো। কাইটা দিছে।”

“ওসমান কে?”

ছেলেটা রাস্তার ওপারে হাত ইশারা করে দেখিয়ে বললো, “ঐ যে।“

শাটার লাগানো দেয়ালে হেলান দিয়ে ওপাশ থেকে আরেকটা ছেলে নাটাই নাড়ছে।

সিকিউরিটি গার্ড বিড়বিড় করে বললেন, “দুইটাই পাগল। বদ্ধ উন্মাদ।“ বলেই তিনি শুকনা একটা লাকড়ি জ্বালাবার চেষ্টা করছেন। আগুন পোহাবেন। নিতুর মন খারাপ হলো। দুটো বদ্ধ উন্মাদ যখন একসাথে কথা বলে তখন তাদের বোঝাপড়াটা কেমন হয়?

“ওসমানের সুতা ধারালো কেন?” বললো নিতু

“মাঞ্জা বানায়া সুতলি ধার করাইছে।”

অর্ধেক রাত আর অর্ধেক ভোরের মাঝামাঝি একটা সময়ে, তারা দুজন ক্লান্ত পায়ে হাঁটছে। কোথায় যাচ্ছে জানা নেই।

নিতু বললো, “বাসা থেকে আর ফোন এসেছে?”

রুদ্র পকেট থেকে মোবাইল বের করে দেখলো ফোন বন্ধ হয়ে আছে। নিতু বললো, “একটা সিএনজি ঠিক করে দিন।”

“বাস স্টেশনে? “

“না, আমি বাসায় যাবো, বনানী।”

কী রকম একটা কোথাও কেউ নেই টাইপ অনুভূতি। রুদ্র ক্লান্ত শরীরে সুটকেস নিয়ে হাঁটতে লাগলো।

নিতু বললো, “আমার বাসায় দম বন্ধ হয়ে আসে। মনে হয় সব ছেড়েছুড়ে কোথাও চলে যাই।”

“এভাবে সম্ভব না।“

“তাহলে কীভাবে বেঁচে থাকতে হয়? আপনি জানেন?”

“সবকিছু নিয়ে।”

“আমার বাবা-মার মাস তিনেক আগে ডিভোর্স হয়েছে। কিন্তু তারা একসাথে থাকছে।“

“ডিভোর্স হলে একসাথে থাকছে কেন?”

নিতু চুপ করে থাকে।

“ডিভোর্স হওয়াটা সমস্যা নাকি একসাথে থাকা?”

“থাক সেসব কথা।”

রুদ্র হাত ইশারা করে একটা সিএনজি থামালো।

“দেখেন আকাশটা কেমন লাল হয়ে আছে?”

রুদ্র আকাশের দিকে তাকায়। এই চিরচেনা আকাশ কি এখন কৈশোরে নাকি যৌবনে পা দিয়েছে? নাকি বৃদ্ধ হয়ে গেছে? প্রদীপের দিপ্ত শিখা নিভে যাবার আগে অপেক্ষা করছে, এই বুঝি নিভে গেল সব!

সেদিন সকাল ছয়টা। স্থান বনানী। নিতু সিএনজি থেকে নেমে একবার পেছনে বড়ো রাস্তার দিকে তাকালো। আগুন পোহানো শীতের রাত, কোথায় যেন দূরের এক টুকরো মেঘের মতো আরও দূরে মিলিয়ে গেল। হঠাৎই তার মনে হলো, ছেলেটা অফিস ধরতে পারবে তো?

গেটের সামনে দাঁড়াতেই সিকিউরিটি গার্ড নিতুর হাত থেকে সুটকেসটি নিয়ে বললো, “আফা কি রাতে থানায় ছিলেন? বাসায় তো কেয়ামত।”

ডিভোর্সের পর থেকে নিতুর বাবা আজগর হোসেন আর মা আবিদা সুলতানা আলাদা রুমে থাকতে শুরু করলেন। আজগর হোসেন বাসায় ফেরেন অনেক রাত করে। বেশিরভাগ সময় বাইরে থেকেই খেয়ে আসেন। যতক্ষণ বাসায় থাকেন পারতপক্ষে নিজের রুম থেকে বের হন না। এর ভেতরে একদিন বেলা গড়িয়ে ঘুম থেকে উঠলেন। বাইরে থেকে বাজার করে দুপুরে রান্নাঘরে গিয়ে রান্না করতে শুরু করলেন। তিশা অবাক হয়ে বললো, “রান্না তো করাই আছে। ফ্রিজে…”

প্রথমে আলাদা ঘর, তারপর আলাদা রান্না। এই দীর্ঘ সময়ে তাদের দুজনের মাঝে কোনো বাক্য বিনিময় হয়নি। শুধু একবার মাঝরাতে আজগর হোসেন বিছানা থেকে উঠে ডাইনিং টেবিলে ওষুধের ডিব্বা খুঁজতে লাগলেন। তার প্রেসার বেড়ে গিয়েছে। এমন সময় আবিদা সুলতানা ওষুধের ডিব্বা এনে টেবিলের উপর রেখে জিজ্ঞাসা করলেন, “প্রেসার কত?”

আজগর হোসেন তাকিয়ে রইলেন। তার প্রেসার বেড়ে গেলে আবিদা সুলতানার এখনো আকস্মিক উৎকণ্ঠা হয়; এই ব্যাকুলতা তাকে ভাবায়। তিনি কোনো জবাব দিলেন না। গত তিন মাসে ডিভোর্সের পর থেকে আর কোনো কথা হয়নি তাদের।

এরকম একটা বাসায় থাকতে থাকতে একসময় নিতুর দম বন্ধ হয়ে আসে। সে ঠিক করে এখান থেকে দূরে কোথাও চলে যাবে। প্রথমে সমুদ্র। তারপর কোথায় যাবে সেটা সেখানে গিয়ে চিন্তা করা যাবে। সপ্তাহখানেক পর একদিন বিকেলে তিশা মোবাইল এগিয়ে দিয়ে বলে, “তোমার ফোন।”

“হ্যালো”

“আমি রুদ্র। “আপনি? হঠাৎ?”

“আপনার বাসার সামনেই আছি।”

নিতু অপ্রস্তুত হয়ে বললো, “বাসার সামনে মানে? কোথায়?”

‘এই তো গেটের সামনে।”

নিতু দোতলা বারন্দা থেকে দেখলো, রুদ্র দাঁড়িয়ে আছে। তার এক হাতে মোবাইল, অন্য হাতে একটি প্যাকেট। তার হাত নাড়িয়ে কথা বলার স্বভাব। যেকোন মুহূর্তে প্যাকেটটা হাত থেকে পড়ে যাবার জোগাড়। নিতু তাকে ভেতরে আসতে বলে।

বসার ঘরে বসে রুদ্র বললো, “লাইটার হবে?”

নিতু হেসে বলে, “রসিকতা করছেন?”

“রসিকতা কেন হবে? আজ আমার জন্মদিন।” বলেই রুদ্র প্যাকেট থেকে কেক আর মোমবাতি বের করে টেবিলের উপর রাখলো।

“ঠিকানা পেয়েছেন কোথায়?”

“ঐ যে সিএনজি ওয়ালাকে বলেছিলেন।”

“আপনি সেটা মুখস্থ করে রেখেছেন?”

রুদ্র বোকার মতো হাসে। সে তার অনুভূতি আড়াল করতে পারে না। সে আপ্রাণ চেষ্টা করছে, তার হঠাৎ আগমনের উপলক্ষ্য যেন অস্বাভাবিক মনে না হয়। ভেতর থেকে আবিদা সুলতানা এসে জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি তাহলে রুদ্র?”

রুদ্র ভীত চোখে তাকায়। আবিদা সুলতানা পাশের সোফায় এসে বসলেন। রুদ্রের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, “সেদিন তোমাদের পুলিশ ধরেছিল কেন?”

নিতু বললো, “তোমাকে তো বলেছি, পুলিশ এমনিতেই জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। রুটিন ওয়ার্ক। পরে আমাদের গাড়ি করে আসাদ গেট পর্যন্ত নামিয়ে দেয়।”

টেবিলে কেকের উপর মোম জ্বলছে। আবিদা সুলতানা ভ্রু কুচকে বললেন, “কেক কেন?” 

নিতু বললো, “ওর আজ জন্মদিন।” 

হঠাৎ কলিং বেল বেজে উঠলে সবার মনোযোগ শব্দের উৎসে গিয়ে পৌছায়। আজগর হোসেন চিন্তিত মুখে ঘরে প্রবেশ করলেন। তিনি সচরাচর এই সময়ে বাসায় ফেরেন না। রুদ্র উঠে দাঁড়িয়ে অর্ধেক সালাম দিলো। অর্ধেক সালাম কারণ, পুরো বাক্য শেষ হবার আগেই আজগর হোসেন কোনোদিকে না তাকিয়ে সোজা হেঁটে ভেতরে চলে গেলেন। রুদ্রের কেমন অস্বস্তি লাগতে শুরু করলো। 

.

এরপর নিতুর সাথে রুদ্রের আরও একবার তারপর আরও, তারপর কারণে তারপর অকারণে দেখা হতে লাগলো। কখনো রাস্তায়, কখনো লেকের ধারে, রিকশায়, সিএনজিতে কিংবা নিতুর গাড়িতে। তারপর সময় গড়িয়ে তাদের নোঙর ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’তে এসে থামে। 

তেমনি একদিন গাড়ি করে তারা দুজন শহর থেকে দূরে লিওনার্দো কোহেনের গান নিয়ে ছুটে চলে যাচ্ছে হঠাৎ রুদ্র বললো, “তোমাকে একটা কথা প্রায় জিজ্ঞাসা করবো ভেবেও আর করা হয় না। নিতু জানতে চায়, “কী?” 

“আংকেল আন্টির ডিভোর্স হলে একসাথে থাকছেন কেন?” 

নিতু চুপ করে থাকে । আকাশ রং বদলাতে শুরু করলো। এই গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি, এই রোদ। 

“The ponies run, the girls are young 
The odds are there to beat 
You win a while and then it’s done
Your little winning streak 
And summoned now to deal 
With your invincible defeat 
You live your life as if it’s real 
A thousand kisses deep” 

রুদ্র বললো, “ডিভোর্স হওয়া সমস্যা নাকি একসাথে থাকা?”

“দুটোই সমস্যা। ছাব্বিশ বছর সংসার করার পর একসাথে থাকতে না পারা যেমন সমস্যা, তারচেয়েও বড়ো সমস্যা হলো ডিভোর্স হবার পর একসাথে থাকা।“

“কিন্তু ডিভোর্স হলে একসাথে থাকছে কেন?”

“বাবা মায়ের ডিভোর্স হয়ে গেছে। এটা তো আমাদের সোসাইটিতে প্রভাব ফেলে।”

রুদ্র জানতে চায়, “কিন্তু এর সাথে একসাথে থাকার সম্পর্ক কোথায়?”

“তারা মনে করছে তাদের দুমেয়ে বিয়ের উপযুক্ত হয়েছে। খামোখা এসব জানাজানি হলে বিয়ে দিতে অসুবিধা না?” বলেই নিতু খিলখিল করে হাসতে থাকে।

রুদ্র কিছুতেই ব্যাপারটা মেলাতে পারছে না। “তাই বলে একসাথে থাকা?”

“সেটাকে একসাথে থাকা বলে নাকি?”

রুদ্র চুপ করে থাকে।

নিতু বললো, “সোসাইটির এই প্রাচীন গোয়ার্তুমি সহজে যাবে না। শরৎ চন্দ্রের ‘গৃহদাহ’ পড়েছো?”

রুদ্র না সূচক মাথা নাড়ে।

নিতু বলে, “ সেখানে সুরেশ আর মহিম দুই বন্ধু। একদিন সুরেশ জানতে পারে তার বন্ধু মহিমের সাথে অপলা নামে এক ব্রাহ্মণ মেয়ের বিয়ের কথা চলছে। মহিম নিচু বংশের, তাই সুরেশ মহিমকে বোঝাতে থাকে, সে যেন ব্রাহ্মণের মেয়েকে বিয়ে না করে। এটা ব্রাহ্মণদের জন্য লজ্জার।

মহিম অপলাকে চায়, সে বুঝে পায় না কেন তার বন্ধু ধর্ম নিয়ে এত কথা বলছে, সে নিজেই তো ধর্মে বিশ্বাস করে না। মহিম জিজ্ঞাসা করে, তুমি কেন ধর্ম নিয়ে এত নীতি শোনাচ্ছো? তুমি তো ভগবানে মানো না।

সুরেশ জবাব দেয়, “ভগবানকে মানি না কারণ ভগবানকে চোখে দেখি না। কিন্তু সমাজ? সমাজ তো আছে। এটাকে তো আর অস্বীকার করতে পারি না!”

বাইরে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি। গাড়িতে বেজে চলেছে কোহেনের অক্লান্ত আকুতি। হেড লাইটের আলোয় প্রতিটা বৃষ্টির ফোঁটাকে আলাদা করা যায়।

নিতু বললো, “এটা ১৯২০ সালের গল্প। অথচ এখনো আমরা সোসাইটির এই প্রলয় থেকে বের হতে পারিনি। দুজন মানুষ আলাদা থাকতে চাইছে সেখানেও সোসাইটি……”

রুদ্র জিজ্ঞাসা করে, “এই অবস্থা আর কতদিন চলবে?”

“বেশিদিন মনে হয় না। ঘটক মারফত একের পর এক পাত্র খোঁজা হচ্ছে।”

রুদ্র হেসে বলে, “তোমার কোনো পছন্দ আছে?”

তাদের গাড়ি আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে এগোতে থাকে। সন্ধ্যা নামলে দু’ধারে অন্ধকার পাহাড়ের দৃশ্যকে মনে হয় ব্ল্যাক হোলের মতো কেবলই শূন্যতা আর অন্ধকার।

নিতু বললো,”তোমার সাথে আমার যখন কাউন্টারে পরিচয়, তখন আমি এরকম কোথাও হারিয়ে যেতে চেয়েছিলাম।”

রুদ্র চুপ করে থাকে। মানুষ কি আসলেই হারাতে পারে? হারিয়ে সে যাবে কোথায়? সব চাইতে বড়ো কারাগার হলো আকাশ। এত বড়ো আকাশ যে পালানো যায় না। আর সব চাইতে ছোটো কারাগার মানুষের মন। এত ছোটো যে প্রবেশ করা যায় না।

.

অন্ধকার আঁকাবাঁকা রাস্তা হঠাৎ লোকালয়ে এসে চোখ মেলে তাকায়। দুয়েকটা দোকানপাট, চায়ের দোকানে গুটি কয়েক মানুষের টিভি দেখা। তারপরের রাস্তাটা এমন যে, বাঁ দিকে ঘন পাহাড় আর ডান দিকে ধুলোবালি মিশ্রিত জমি, একটা দুটো ঘরবাড়ি, উঠোনে শুকোতে দেয়া সকালের কাপড়, কিছুদূর সামনে একটা পুলিশের গাড়ি। গানের ভলিউম কমিয়ে নিতু জিজ্ঞাসা করে, “বাংলোটা কোনদিকে?”

পুলিশ বললেন, “পেছনে ফেলে এসেছেন।”

তারপর আবার ইউটার্ন করে সেই চায়ের দোকান। কতগুলো কুকুর রাস্তা

দখল করে শুয়ে আছে। রুদ্র চোখ বন্ধ করে কথা বলছে। চোখ বন্ধ করে কথা বলছে কারণ পাহাড়ের হিসেবটা সে কিছুতেই মেলাতে পারছে না। নিতু কথা বলছে সামনের দিকে তাকিয়ে। তার হাতে গাড়ির স্টিয়ারিং।

রুদ্র বললো, “একটা জিনিস কিছুতেই আমার মাথায় আসছে না।“

“কী?”

“এই ধরো একটু আগে পাহাড়টা বাঁ দিকে ছিল। আর ডান দিকে একটা দুটো ঘর-বাড়ি।”

“এতে সমস্যা কোথায়?”

“হঠাৎ করে পাহাড়টা ডান পাশে চলে এলো কী করে?”

“তাই তো স্বাভাবিক”

“স্বাভাবিক কেন হবে? এর জন্য নিউটনের সূত্রকে ভুল হতে হবে।’ “তোমাকে না মানা করেছি গাড়িতে মদ খেতে।”

“এতদূর ঘুরতে এলাম, একটু নিজেকে ছেড়ে দেয়া আর কী।“

“নিজেকে ছেড়ে দিতে হবে কেন? ধরে রাখতে হবে।“

“আচ্ছা না হয় ধরে রাখব। এখন বলো, বাঁ দিক থেকে পাহাড় ডান দিকে চলে এলো কি করে?”

“যেখানে পাহাড় থাকার কথা সেখানেই আছে।”

“তোমার কি ধারণা আমি মাতাল হয়ে গেছি?”

“ধারণা কেন হবে? আমি সেটা দেখতে পাচ্ছি।’

রুদ্র আবার চোখ বন্ধ করে রইলো। তার হিসেব কিছুতেই মিলছে না। এরকম একটা রাস্তা ভুল করা রাতে নানান বিষয় নিয়ে তার চিন্তা করতে ভালো লাগছে। জার্মানের এক দার্শনিক একটা দারুণ কথা বলেছেন, “এই চিন্তামূলক সময়ে সবচেয়ে চিন্তার উদ্দীপক বিষয় হলো আমরা এখনো চিন্তা করছি না।”

রুদ্র জিজ্ঞাসা করে, “আচ্ছা আংকেল আন্টির ডিভোর্স হয়েছে কেন?”

“আমার বাবার অন্য আরেকটা সম্পর্ক আছে।’

“এখনো আছে?”

নিতু মাথা নেড়ে বলে, “হ্যাঁ, এখনো আছে।“

“তিনি এখন কোথায়?”

“স্পেনে থাকেন। ব্যবসার কাজে বাবা একবার থাইল্যান্ড গিয়েছিলেন। সেখানেই এই ভদ্র মহিলার সাথে পরিচয়।”

“বাঙালি নাকি?”

“হ্যাঁ, গত বছর দেশে এসেছিলেন। তখন বাবা প্রায়ই বাসায় ফিরতেন না। একদিন মা চুলায় চা বসিয়ে কাজ করছিলেন। বাবা টেবিলে বসে পত্রিকা হাতে নিয়ে শান্ত গলায় বললেন, তিনি আর একসাথে থাকতে চান না।”

মা ভাবলেন বাবা রসিকতা করছেন। তিনি হেসে বললেন, “তাহলে তো বাঁচি।”

বাবা বললেন, “আগামীকাল থেকে আমি আলাদা রুমে থাকব।”

মা চুলা থেকে চা নামিয়ে টেবিলে রাখলেন। দুটা কাপে চা দিয়ে বললেন, তোমাকে না বললাম, “বাথরুমের লাইট দুদিন ধরে নষ্ট।”

বাবা ড্রাইভারকে ফোন দিয়ে বাথরুমের লাইট এনে লাগালেন। তারপর গেস্ট রুমটি নিজের মতো করে গোছাতে গিয়ে বললেন, “আমি কিন্তু ঠাট্টা করছি না।”

.

পাহাড়ের চূড়ায় পাখির বাসার আদলে নড়বড়ে এক বাংলো। রুদ্রের এক পুরানো বন্ধু সেখানে থাকে। হালকা একটু ফ্রেশ হয়ে চা-টা খেয়ে আধঘণ্টা জিরিয়ে আবার শহরে ফিরে যাওয়া।

রাত তখন আটটা। নিতু গ্লাস নামিয়ে দিয়ে গাড়ির স্পিড বাড়ালো।

রুদ্র বললো, “আচ্ছা তখন এরকম কেন মনে হয়েছিল?”

“কীরকম?”

“বাঁ দিকের পাহাড়টা হঠাৎ ডান দিকে চলে এলো কেন?”

“কারণ আমরা রাস্তা ভুল করে ইউটার্ন করেছিলাম।”

রুদ্র শব্দ করে হাসে। তারপর কথার খেই হারিয়ে এই কথা থেকে সেই কথায়, ঘুরে ঘুরে শহরের কাছাকাছি ডিভোর্সের প্রসঙ্গে এসে গাড়ি থামে।

নিতু বলে, “ভদ্র মহিলার নাম রুবা হক। সেখানে একটা ব্যাংকে চাকরি

করেন। তার একটি মেয়ে আছে, নাম আনিকা।”

“উনার হাজবেন্ড?” জিজ্ঞাসা করে রুদ্র। “ডিভোর্সড।”

“ও…”

“একদিন আনিকা ফোন করে আমাকে।“

“আনিকা তোমার নাম্বার কোথা থেকে পায়?”

“ওর মার কাছ থেকে।”

“রুবা আন্টির সাথে তোমার কথা হয়েছে?”

“দেখাও হয়েছে।”

“কীভাবে?”

“তার বাসায়, গতবছর।”

“একা গিয়েছিলে?”

নিতু বিরক্ত হয়ে বলে, “কথার মাঝখানে এত প্রশ্ন করলে প্রসঙ্গ বদলে যায়। আর তুমি এরকম চোখ বন্ধ করে কথা বলছো কেন?”

“চোখ বন্ধ করলে কল্পনা করতে সুবিধা হয়। “

নিতু ভ্রু কুচকে বললো, “কী কল্পনা?”

“এই যেমন একদিন তুমি রুবা আন্টির বাসায় গিয়েছো সেটা দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু সেখানে তুমি একা গিয়েছো কি না বুঝতে পারছি না।”

“সেটা বুঝতে হলে পরের লাইন শোনার জন্য অপেক্ষা করতে হয়।“

“যদি পরের লাইনে সেটা না থাকে?”

“সেটা জানতে হলেও পরের লাইন শুনতে হয়।”

.

রুদ্রের মন খারাপ হলো। সে যা বোঝাতে চাইছে তা পারছে না। বেশিরভাগ সময়ই তার এরকম হয়। ইদানীং তার আরও একটা সমস্যা যোগ হয়েছে। প্রত্যেকটি চিন্তার সাথে অনুভূতি আর ইচ্ছের একটা অদ্ভুত সম্পর্ক আছে, এই ব্যাপারটা একদিন সে জানতে পারে। তারপর থেকে মাঝেমধ্যে অযথা চিন্তা করার এক কঠিন সমস্যা তাকে পেয়ে বসে।

এই যেমন, “রাস্তা হারিয়ে ফেলা রাতে রুদ্র জঙ্গলে ঘুরছে।“

এখানে এই চিন্তার সাথে একটা অনুভূতি আছে; সেটা হলো ঘুরতে তার ভালো লাগছে। একটা ইচ্ছে আছে; সে চাইছে আর কখনো ফিরে না যেতে।

রুদ্র যখন এই সমস্যায় পড়ে তখন খুব তীব্রভাবে পড়ে। সব চিন্তার যেমন অনুভূতি আর ইচ্ছে আছে। তেমনি সব ইচ্ছেরও চিন্তা আর অনুভূতি আছে। এই যেমন, তার ইচ্ছে করছিল না, জঙ্গলে থেকে ফিরে আসতে। তার ইচ্ছে করছিল তাঁবু টানিয়ে নিতুকে নিয়ে বসে থাকতে।

এই ইচ্ছের একটা চিন্তা আছে। চিন্তার একটা অনুভূতি আছে। অনুভূতি ক্ষেত্র বিশেষ। একই ঘটনার দুই রকম অনুভূতি হতে পারে। ঠিক তেমনি প্রত্যেকটি অনুভূতির ইচ্ছে এবং চিন্তা আছে।

রুদ্র বললো, “তোমাকে নিয়ে আমার একটা চিন্তা হচ্ছে। সেই চিন্তার একটা অনুভূতি আছে। অনুভূতির একটা ইচ্ছে আছে।”

নিতু চোখ সরু করে তাকিয়ে রইলো।

রুদ্র বললো, “প্রত্যেকটি চিন্তার একটা অনুভূতি আর একটা ইচ্ছে থাকে।“

“যেমন?”

“মনে করো, এখন আমি চিন্তা করছি আমাদের প্রথম যেদিন দেখা হয়েছিল, কুয়াশায় আচ্ছন্ন শীতের সকাল। আমি তোমাকে সিএনজি ঠিক করে দিচ্ছি। এখন এই চিন্তার একটা অনুভূতি আছে। সেট হলো— ভয়।”

“ভয়?”

“তোমাকে হারিয়ে ফেলার ভয়। আরেকটা ইচ্ছে আছে, সিএনজিতে গিয়ে বসি।”

“তাই বাসার ঠিকানা মুখস্ত করে রেখেছিলে?”

রুদ্র সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে।

নিতু বললো, “কিন্তু এই চিন্তা শাখা-প্রশাখা ছেড়ে অন্য কোথাও ঘাঁটি বাঁধে।”

“কীরকম?”

“আমরা কথা বলছিলাম, গত বছর কীভাবে আমার সাথে রুবা আন্টির দেখা হয়েছিল, তুমি জিজ্ঞাসা করলে, একা গিয়েছিলাম কি না। তারপর চিন্তার শাখা প্রশাখা ছাড়িয়ে আমরা ফিরলাম, একদিন শীতের রাতে যেভাবে আমাদের দেখা হয়েছিল, বিদায় নেবার সময় তুমি সিএনজি ঠিক করে দিলে।”

.

রুদ্র চুপ করে থাকে। চুপ করে থাকার মানে এই না যে সে কথা বলছে না। সে এখন মনে মনে কথা বলছে।

নিতুকে জিজ্ঞাসা করছে, “তোমার সমুদ্র পছন্দ নাকি পাহাড়?”

নিতু হয়ে সে জবাব দেয়, “সমুদ্র।”

তারপর সে বলে, “তুমি তো কখনো সমুদ্রে যাওনি।”

নিতু হয়ে সে নিজেকে জিজ্ঞাসা করে, “জানলে কী করে?”

সে জবাব দেয়, “তুমি বলেছিলে।”

রুদ্রের এই সব জটপাকানো চিন্তা এখানে এসে থামলেও কথা ছিল। তার স্বভাব হলো, সে তার কল্পনাকে রিয়্যালিটির কাছে এনে দাঁড় করায়। তার এবং নিতুর এই কথোপকথন যদি কাল্পনিক না হয়, তাহলে কেমন হতো সেটা তার যাচাই করার ইচ্ছা জাগে।

সে নিতুকে জিজ্ঞাসা করে, “তোমার পছন্দ কী? সমুদ্র নাকি পাহাড়?”

নিতু সামনের দিকে তাকিয়ে বলে, “সমুদ্রের অল্টারনেটিভ সবসময় পাহাড়কেই কেন হতে হবে? ধূসর মরুভূমি কিংবা বরফের দ্বীপ কেন না?”

রাত এগারোটার কাছাকাছি বনানীর একটা রাস্তায় তাদের গাড়ি থামে। নিতু চা খাবার কথা বললে, রুদ্র জানায়, রাত হয়েছে।

“রাত হলে কী হয়েছে?”

“আন্টি টেনশান করবেন।”

নিতু গাড়ি থেকে নেমে দু’কাপ কড়া লিকারের চা অর্ডার করে। নিতুর এই স্বভাবের সাথে রুদ্র পরিচিত। যা করতে বারণ করা হয়, আরও বেশি করে করবে। একে বলে রিভার্স সাইকোলজি।

“পৃথিবীতে যেখানে সুখ আছে, ঠিক সেখানেই নিষেধ আছে। একটা সুখ মানেই একটা নিষেধ অমান্য করার ফল।”

রুদ্র বললো,” কিন্তু সব নিষেধ তো খারাপ না। এরকম হলে তো সুখের জন্য একে অন্যকে ঠকাতে শুরু করবে।”

“বাট্রান্ড রাসেল পড়েছো?”

রুদ্র না সূচক মাথা নাড়ে।

নিতু বললো, “সুখের কারণেই মানুষ সৎ হবে। নীতির কারণে না।“

ব্যাপারটা রুদ্রের মাথায় ঠিক কাজ করছে না। সুখের কারণে মানুষ সৎ হবে কেন? চিন্তা করতে করতেই সে দারুণ এক জিনিস শিখে ফেললো; কাউকে ঠকানোটা সুখের না। তাই সুখের কারণেই মানুষকে ভালো হতে হবে।

রুদ্র বললো, “তাহলে আংকেলের প্রতি তোমার এত রাগ কেন? তিনি তার ভালো থাকাকে প্রায়োরিটি দিয়েছেন, ব্যস।”

নিতু বললো, “নিজে নিজে ভালো থাকার কনসেপ্টটা ভুল। আমার মা পালিয়ে বিয়ে করেছিল। ঠিক দুবছর পর একদিন সকাল সকাল ফোন করে খবর দেয় খালা, নানা মারা গেছেন। মা কাঁদতে কাঁদতে গাড়িতে উঠলেন। ড্রাইভার ছিল না বলে, বাবা পৌঁছে দিলেন। বাবা সেদিনই প্রথম গেলেন নানা বাড়ি। মাকে নামিয়ে দিয়ে চলে এলেন।“

রুদ্র চুপ করে শুনছে।

নিতু বলতে থাকে, “সেই মানুষটার সাথে ছাব্বিশ বছর সংসার করার পর একদিন চা খেতে খেতে লোকটা নির্বিকার ভাবে বললো, ডিভোর্স দিতে চান। আমার কী হবে? তিশার কী হবে? আমাদের বিয়ের পর মায়ের কী হবে? চিন্তা করলেন না।”

রুদ্র বললো, “রুবা আন্টির সাথে তোমার দেখা হয়েছিল কীভাবে?”

“একদিন ফোন করে তার বাসায় আসতে বললেন। আমি মাকে না জানিয়ে গেলাম তার বাসায়। তাকে দেখে মনে হলো, আমার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। চোখে চশমা। পরনে সবুজ শাড়ি। বললেন, “ঠিকানা খুঁজে পেতে সমস্যা হয়নি তো?” আমি মাথা নাড়লাম ‘না’।

“তোমার বাবার কাছ থেকে তোমার অনেক কথা শুনেছি।”

আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “কী শুনেছেন?”

রুবা আন্টি প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বললেন, “তুমি কি আমাকে ঘৃণা কর?”

“হ্যাঁ।”

“ঘৃণা করলে আত্মার ক্ষয় হয়, ভালোবাসলে বাড়ে।”

“আমি আপনাকে ঘৃণা করতে ভালোবাসি।“

“তুমি এরকম কঠিন করে কথা বলছো কেন?”

রাগে আমার শরীর কাঁপছিল। আমি চলে যাবার জন্য উঠে দাঁড়ালাম। রুবা আন্টি বললেন, “তোমাকে একটা কথা বলার জন্য ডেকেছি। ছাব্বিশ বছর আগে তোমার বাবার সাথে আমার বিয়ে হবার কথা হয়েছিল। এই গল্প কি তুমি জানো?

“জি না।”

“তোমার মার কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করবে।”

রুদ্র জিজ্ঞাসা করে, “তারপর?”

“আমি কথা না বাড়িয়ে উঠে চলে এলাম। তিনি বললেন, তার সাথে বাবার দশ বছরের সম্পর্ক ছিল। বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করা। বট পাতায় হাতে লিখে নিমন্ত্রণ পত্র পাঠালেন। এরকম একটা সময় বাবা হঠাৎই লাপাত্তা। খোঁজখবর নিয়ে জানলেন, বিয়ে করেছেন তারই এক বান্ধবীকে।”

রুদ্র ভ্রু কুচকে বললো, “তোমার মা কি রুবা আন্টির বান্ধবী ছিলেন?”

“হ্যাঁ।”

“তিনি কেন এরকম একটা কাজ করলেন?”

“সেটা মা’কে জিজ্ঞাসা করিনি।”

“কেন?”

“আমি বাবাকে ঘৃণা করি, মাকে ঘৃণা করতে চাই না। “

এরপর আরও অনেক দিন কেটে গেলো। মাঝে একবার নিতু এসে জানালো, বাসা থেকে কোনো একটা ছেলের সাথে নাকি কথা চালাচালি হচ্ছে। মাহবুব নাম। ব্যাংকে চাকরি করে।

রুদ্র বুঝতে পারে না তার কী বলা উচিত। তাদের দু’বোনকে বিয়ে দেবার জন্য দুটো মানুষ ডিভোর্স দিয়েও একসাথে থাকছে। বিয়ের কথাবার্তা চলবে, এই তো স্বাভাবিক। রুদ্র মন খারাপ করে কথার তালে মাথা নাড়ে। মন খারাপের কারণ অস্পষ্ট।

মাঝেমাঝে সন্ধ্যায় তারা দু’জন আকাশ দেখে চিলেকোঠার ছাদে। মেঘের দিকে তাকিয়ে থাকলে হঠাৎই একেকটা মেঘকে নিজের মনে হয়। শিমুল তুলার মতো ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের টুকরো; চোখে চোখে না রাখলে কোথায় যেন মিলিয়ে যায়।

রুদ্র মৃদু শব্দে আক্ষেপ করে, “আকাশের মেঘ আকাশেই আছে। যাবে আর কোথায়!”

নিতান্ত ছেলেমানুষি ইচ্ছে আর স্বপ্ন ভঙ্গের কথা হতো তাদের। এদিকে মাহবুবের ব্যাপারটা এগোতে লাগলো। দু’পক্ষের ফ্যামিলি থেকেই এগোতে থাকে।

রুদ্র জানতে চায়, “তুমি কী চাচ্ছো?”

নিতু অবাক হয়ে বলে, “সেটাই তুমি জানো না?”

প্রাত্যহিক জীবনের নিত্য নতুন ঘটনা নিয়ে তাদের কথা হতো। নিতু একদিন রুবা আন্টির মেয়ে আনিকার কথা বলে। আনিকার সাথে তার একবার ফোনে কথা হয়। সেদিন সে জানতে পারে আনিকা তার আরেকটা বোন।

রুদ্র অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে, “সেটা কীভাবে সম্ভব?”

নিতু বললো, “ছাব্বিশ বছর আগে একদিন রুবা আন্টি অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়লে, তাড়াহুড়া করে বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করা হয়। এমন সময় বাবা লাপাত্তা হয়ে আমার মাকে বিয়ে করলেন।

কীরকম একটা অস্বস্তিকর কৌতূহল রুদ্রকে চুপ করে রাখে।

নিতু বলতে থাকে, “ভদ্রমহিলা অ্যাবরশন করে বাচ্চা নষ্ট করলেন না। স্পেনে চলে গেলেন। আনিকা জন্ম নেবার দুবছর পর বিয়ে করেন। পরে অবশ্য লোকটির সাথে ডিভোর্স হয়ে যায়। শুনলাম তিনি এখন দেশেই থাকেন।”

তাদের কথা হতো জীবন নিয়ে, প্রেম অথবা প্রেম না জাতীয় এক অনুভূতি নিয়ে কথা হতো তাদের। মাহবুবের ব্যাপারটা অবশ্য বেশিদূর এগোয়নি। তবে ঘটক মারফত একের পর এক মাহবুবের উদয় হতে লাগলো।

যবে থেকে রুদ্রের সাথে নিতুর আলাপ তখন আগুন পোহানো শীতের রাত, এরপর আরও তিনটা শীত গেল। তেমনি একদিন সকালে রুদ্র কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছে।

ঘুমের ঘোরে চোখ মিটমিট করে দেখে নিতু মুখে পানি ছিটিয়ে বলছে, এই যে বার্থডে বয়, আমার চিঠি কোথায়?

রুদ্র ঘুম ঘুম চোখ নিয়ে তাকিয়ে দেখে নিতু একটা শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে আছো। তাকে বললো, তোমাকে চমকে দিতে এসেছি।

রুদ্র ভেবে পায় না চমকাবার কী আছে! গত তিন বছর ধরেই তো এই কাজটা সে নিষ্ঠার সাথে করে যাচ্ছে। কিন্তু প্যাকেট খুলে তামাটে পাগড়ি আর অফ হোয়াইট কালারের শেরওয়ানি দেখে তার চোখ কপালে উঠে গেলো।

রুদ্র চোখ ভর্তি বিস্ময় নিয়ে বালিশের নিচে থেকে চিঠি বের করে দিলো। কোথায় যেন একটা টেলিপ্যাথি কাজ করেছে বলে তার ধারণা। কোনো প্রকার সম্বোধন ছাড়া দুশব্দের চিঠিতে রুদ্রকে লিখেছিল, “বিয়ে করবে?”

ঘন্টাখানেক পর একজন ডেলিভারি ম্যান এসে কেক দিয়ে যায়। মানুষের জীবনে কিছু কিছু সময় আসে, যখন প্রত্যেকটা মুহূর্তের আলাদা করে গল্প থাকে। কোথায় যেন স্মৃতির আদলে একটা কম্পন তৈরী হয়। তারপর শব্দ। বিদ্যুৎ চমকালে যেরকম হয়।

নিতুর হাতে স্টিয়ারিং। গাড়িতে বেজে চলেছে লিওনার্দো কোহেনের গান। তারা যাচ্ছে মগবাজার। সেখানেই কাজী অফিসে তাদের বিয়ে হয়।

নিতু বললো, “আজকের দিনটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমি এই সময়টাকে ধরে রাখতে চাই।”

“সময় ধরে রাখা যায় নাকি?”

“পুরো একটা জীবনে দুর্দান্ত রকমের ভালো মুহূর্ত আঙ্গুল দিয়ে গোনা যায়। আমাদের কাজ হবে মুহূর্তটাকে টেনে বড়ো করা।”

“মুহূর্তকে টেনে বড়ো করে কী হবে? একটা আর্টিফিশিয়াল ব্যাপার চলে আসে।’

রুদ্র চোখ বন্ধ করে। চোখ বন্ধ করে কল্পনা করতে তার ভালো লাগে। যত সহজে একটা দুঃখ শেষ হয়ে গেলে অন্য একটা দুঃখের জন্ম হয়। তত সহজে একটা সুখ শেষ হবার পর অন্য একটা সুখ ফিরে আসে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *