শেষ – ১

ভাদ্র মাসের সকালে হঠাৎ শিহাব একটি কঠিন সমস্যায় পড়েছে। সমস্যাটা এই যে, সে হাসানকে আত্মহত্যা করবার জন্য একটা দড়ি কিনতে পাঠিয়েছে। হাসান শার্ট গায়ে দিয়ে বাসা থেকে বের হলো। তারপর বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যার পর হাতে করে একটা অ্যাকুরিয়াম নিয়ে ফিরলো ঘরে। পলিথিনে মোড়ানো প্যাকেট থেকে দুটো গোল্ডফিশ রেখে বললো, “এই মাছগুলোকে প্রতিদিন খাবার দিলে একটা সময় পর তারা তাদের মালিককে আলাদা করে চিনতে পারে।”

শিহাব বললো, “সেটা ঠিক আছে, তোমাকে সকালে দড়ি কিনতে পাঠিয়েছি। আজ বিকেলে পৃথিবী বরাবর তিন পৃষ্ঠার চিঠি লিখে তোমার আত্মহত্যা করবার কথা।”

হাসান শীতল গলায় বললো, “আমি আত্মহত্যা করব না।”

“তাহলে আমাকে দিয়ে খামোখা চিঠি লেখালে কেন?”

কথার কোনো প্রত্যুত্তর না দিয়ে হাসান অ্যাকুরিয়ামে পানি ঢালতে থাকে। শিহাব বললো, “পৃথিবীতে যারা আত্মহত্যা করে তারা কারো সাহায্য ছাড়াই করে কিন্তু তোমাকে সাহায্য করার জন্য আমি আছি।”

“আপনি আমাকে এই উপকারটি না করলেই বরং আমার জন্য উপকার হয়।”

“তাহলে চিঠিতে এসব লেখালে কেন?”

“যেন আমার কথা লিখতে গিয়ে আপনি নিজেকে আমার জায়গায় রেখে চিন্তা করতে পারেন।”

“তোমার কি ধারণা আমি তোমার জায়গা থেকে চিন্তা করতে পারছি না?”

হাসান অবাক হয়ে বললো, “আপনি মনে করছেন আমার নিজেকে মেরে ফেলা উচিত?”

“আমি তো তোমাকে এর কারণগুলো বলেছি।”

হাসান চুপ করে থাকে।

শিহাব ক্লান্ত গলায় বললো, “গলায় ফাঁস নিতে ভয় পেলে বিকল্প একটা চিন্তা আছে। সুন্দর একটা গল্পের বই পড়তে পড়তে মারা যেতে চাও?”

হাসান না সূচক মাথা নাড়ে।

“বইয়ের পাতায় পটাসিয়াম সায়ানাইড মিশিয়ে রাখবে। পৃষ্ঠা উল্টানোর সময় আঙুল থেকে জিহ্বায় মিশে গেলেই শেষ।”

হাসান বললো, “পটাসিয়াম সায়ানাইডের এই উদ্ভট আইডিয়া আপনি কোথা থেকে পেলেন?”

“ডিটেক্টিভ বই পড়ে।

“কিন্তু আমার আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত আপনি কেন নিবেন?”

“মানুষ কি তার সব সিদ্ধান্ত নিজে নেয়?”

“আপনি আমাকে মেরে ফেলতে চান, কিন্তু সেটা আমাকে দিয়ে।”

“আমি কেন তোমাকে মেরে ফেলতে চাইবো? এতে আমার কী স্বার্থ?”

“কিন্তু আপনি তো তাই করছেন।’

“পৃথিবীতে সবাই মরার জন্য আত্মহত্যা করে না। কেউ কেউ বাঁচার জন্য করে। আমি তোমাকে বাঁচাতে চাই।”

হাসান ভ্রু কুচকে জিজ্ঞাসা করে, “বাঁচার জন্য আত্মহত্যা করে?”

“কারণ মানুষ মরতে পারে কিন্তু ভুলতে পারে না।”

হাসান চুপ করে থাকে।

শিহাব বললো, “পটাসিয়াম সায়ানাইডে ভয় পেলে বিকল্প আরেকটা চিন্তা আছে। ঘুমের ভেতরে মারা যেতে চাও? স্বপ্ন দেখতে দেখতে স্বপ্নের ভেতরেই অন্য একটা স্বপ্নে চলে গেলে। তারপর আর ফিরে এলে না।“

শিহাবের কথা শুনে হাসান হেসে ফেলল। বললো, “গুগলে আত্মহত্যা করার সবচেয়ে সহজ উপায় লিখে সার্চ দিলে কী আসে জানেন?”

“কী?”

“যতগুলো সার্চ রেজাল্ট পাওয়া যায়, প্রায় সবগুলোতে কাউন্সেলিং সেন্টারের ফোন নাম্বার দেয়া থাকে। আর আপনি আমাকে বলছেন, মানুষ বাঁচার জন্য আত্মহত্যা করে?”

শিহাব খানিকক্ষণ চিন্তা করে বললো, “শব্দটা আত্মহত্যা শোনালেও এর অর্থ হবে আত্মবিসর্জন।”

“আত্মহত্যাকে বলছেন আত্মবিসর্জন?”

“আমি বলিনি। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন। কাদম্বরী দেবী সুইসাইড করার পর লিখেছেন, যে আত্মবিসর্জন করতে পারে, আত্মার উপর শ্রেষ্ঠ অধিকার শুধু তারই জন্মাতে পারে।”

.

শিহাবের সাথে হাসানের পরিচয় বছর দুয়েক আগে। রাস্তার দেয়ালে রুমমেট আবশ্যকের বিজ্ঞাপন দেখে ফোন করে হাসান। দু’ঘরের একটা বাসা। একটা কিচেন, একটা বাথরুম। তারপর সবকিছু চলছিল যেভাবে চলার কথা। শিহাব অবিবাহিত মানুষ। হাসানকে জিজ্ঞাসা করে, “বিয়ে করেছো?”

হাসান জবাব না দিয়ে বলে, “আমরা বরং ব্যক্তিগত আলাপ না করি।”

তবু নিতান্ত কথার প্রসঙ্গ ধরে একদিন জানা গেল হাসান বিবাহিত। তার স্ত্রী বছর দুয়েক আগে তাকে ফেলে চলে গেছে। শিহাব জিজ্ঞাসা করে, “ডিভোর্স?”

হাসান বলে, “আমরা বরং ব্যক্তিগত আলাপ না করি।”

শিহাব রাত জেগে লেখে। একদিন হাসানকে জিজ্ঞাসা করে, টেবিল ল্যাম্পের আলোয় তার অসুবিধা হয় কি না।

হাসান জবাব দেয়, “সমস্যা হলে কি আর লিখবেন না?”

শিহাব অবাক হয়ে বললো, “লিখব।”

“তাহলে প্রশ্ন করলেন কেন?”

“সেক্ষেত্রে আমি বসার ঘরে গিয়ে লিখব।“

“মানুষের তুচ্ছ সমস্যাকে এত গুরুত্ব দেন কেন?”

“মানুষকে না, আমি আমাকে গুরুত্ব দেই। কারো সমস্যা হলে লিখতে অসুবিধা হয়।”

“কিন্তু আপনি বসার ঘরে গিয়ে লিখলেও আমার সমস্যা হবে।”

শিহাব জানতে চায়, “কীরকম?”

“একটা মানুষ আমার জন্য নিজের বিছানায় চিত হয়ে লিখতে পারছে না, এই ব্যাপারটা মাথায় নিয়ে ঘুম আসবে না।”

“তাহলে কী করতে পারি?” বললো শিহাব।

“কিছু করার কথা আসছে কেন? আমি তো বলিনি, আলোতে আমার সমস্যা আছে। তবে নিতুর সমস্যা হতো। সে যখন ঘুমাতো, কবরের মতো অন্ধকার করে ঘুমাতো, যেন শরীরের আলোই একমাত্র আলো।’

“নিতু কে?”

“আমার স্ত্রী।”

শিহাব চুপ করে থাকে। ‘তার স্ত্রী এখন কোথায়’ জানতে চাওয়া সমীচীন হবে কি না ভাবে। হাসান বিছানা থেকে উঠে একটা সিগারেট জ্বালিয়ে হাত দিয়ে ধোঁয়া তাড়ালো কিছুক্ষণ। বোধহয় সে খুব আয়োজন করে কিছু বলতে চাইছে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছিলেন, যেখান থেকে গল্প শুরু হয়, তার আগে গল্প থাকে। আর, যেখানে শেষ হয় তার পরও গল্প থাকে।

.

হাসান কোথা থেকে শুরু করবে সেটা চিন্তা করার জন্য একটু সময় নিলো। তারপর বিছানা থেকে উঠে বসে শিহাবের চোখে চোখ রেখে তাকালো। কেউ চোখে চোখ রাখলে শিহাবের তাকে বুঝতে খুব সুবিধা হয়। চোখের দিকে তাকিয়ে মানুষ মিথ্যে বলতে পারে না, কথাটা আসলে ঠিক না। মিথ্যে বলতে পারে, তবে সেটা তার চোখে ধরা দেয়।

শিহাব জিজ্ঞাসা করলো, “নিতু কোথায়?”

হাসান দেয়ালে হেলান দিয়ে বলতে শুরু করে, “অনেক বছর আগে আমরা দুজন ট্রেন থেকে একটা ভুল স্টেশনে নেমে গিয়েছিলাম। তখন শ্রাবণ মাস। থেমে থেমে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। নিতু হাতে করে বিশাল আকৃতির সুটকেস নিয়ে প্ল্যাটফর্ম থেকে বের হয়ে রাস্তায় নেমে এলো।

একে তো বৃষ্টি, তার উপর ভোর। কাছাকাছি কোনো মসজিদের মাইক থেকে আজানের শব্দ। যে কয়টা অটো রিকশা দেখা যাচ্ছে, চালক গায়ে পলিথিন পেঁচিয়ে ঘুমোচ্ছে। ট্রেনে পরিচয়ের সুবাদে ভদ্রতা করে বললাম, একটু অপেক্ষা করুন, আলো ফুটুক।

নিতু বললো, “আলো ফুটলে কী হবে?”

“এখন কোনো রিকশা-সিএনজি কিছু পাবেন না।”

মফস্বলের প্ল্যাটফর্ম। অন্ধকার রেললাইন। অপরিচিত দুটো মানুষ একটা বৃষ্টিকে কেন্দ্র করে বসে আছি। তখনো দুএকটা হকার দিকবিদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। নিতু ব্যাগ থেকে একটা বই বের করলো। কবি শেলির কবিতার বই।

“কেন জন্ম ও মৃত্যু, স্বপ্ন এবং ভয়
ফিরে ফিরে আসে এই পৃথিবীর আলোয়
এমন অন্ধকার, মানুষ কেন এমন করে পায়?
প্রেম আর ঘৃণা, হতাশা আর আশায়?”

নিতুর হাতে কবি শেলির বই দেখে আমি বললাম, “মারা যাবার সময় কবির জ্যাকেটের পকেটে পাওয়া গিয়েছিল সফোক্লিসের বিখ্যাত গ্রন্থ ইডিপাস।”

সম্ভবত ট্রেনে অচেনা এক আগন্তুকের কাছ থেকে এরকম একটা কথা সে আশা করেনি। এই প্রথম নিতু আমার দিকে ভালো করে তাকালো। তারপর বিস্মিত হয়ে বললো, “কী নাম আপনার?”

বললাম, “হাসান।’

“আমার তো এখন ইডিপাস পড়তে ইচ্ছে করছে। জানি না কবি শেলি বইটা পড়ে শেষ করতে পেরেছিল কি না।“

আমি তাকে ইডিপাসের গল্প বলতে শুরু করলাম। থিবস নগরের রাজা ইডিপাস। তিনি একদিন প্রচণ্ড অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও দেবতার অভিশাপে পিতার হত্যাকারী এবং মায়ের শয্যাসঙ্গী হন।

নিতু মন খারাপ করে থিবস নগরের রাজা ইডিপাসের গল্প শুনছে। “দেবতার এই বাণীর কথা ইডিপাসের পিতা রাজা লাসও জানতেন। তাই তিনি ইডিপাসকে হত্যা করার জন্য এক মেষপালককে দায়িত্ব দেন কিন্তু সেই মেষপালক তাকে হত্যা না করে অন্য এক মেষপালকের হাতে তুলে দেন। ঘটনা চক্রে ইডিপাসের ঠাঁই হয় অন্য এক দেশের নিঃসন্তান রাজা পলিবাসের হাতে। একটু একটু করে বড়ো হতে শুরু করে ইডিপাস। তারপর একদিন সেও শুনলো সেই দেবতার কথা, তুমিই হবে পিতার হত্যাকারী এবং মায়ের শয্যাসঙ্গী!”

আমাকে থামিয়ে দিয়ে নিতু জিজ্ঞাসা করলো, “দেবতার অভিশাপ এরকম কেন হবে?”

প্ল্যাটফর্মে বৃষ্টি বেড়ে চলেছে। আমরা দুজন অপরিচিত মানুষ আলো ফোটার জন্য অপেক্ষা করছি। এর ভেতরে ইডিপাসের গল্প আমাদের কোথায় যেন নিয়ে গেল। এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো, আমি বোধহয় এই মানুষটাকে খুঁজেছি। নিতু দেখতে শ্যামলা। কেমন যেন হলদে হলদে গায়ের রং।

.

আলো ফোটার পর আবিষ্কার করি, আমরা দুজন ভুল স্টেশনে নেমে পড়েছি। বিশাল আকৃতির সুটকেস নিয়ে নিতু বেশ অস্থির হয়ে উঠলো। আমার দারুণ লাগছিল।

কিছু কিছু মুহূর্ত আসে, যখন ঘটে তখনই বুঝতে পারা যায়, এই মুহূর্ত গুলো জীবনে থেকে যাবার জন্য এসেছে। যদি স্টেশন ভুল না হতো? যদি রিকশাওয়ালা পলিথিন প্যাঁচিয়ে না ঘুমোতো! যদি ঠিক সেই সময় কবি শেলির উপস্থিতি না ঘটতো? ‘এতগুলো ভুল’, ‘এতগুলো যদি’ একটার পর একটা সিকোয়েন্স মিলিয়ে কেন সামনে এলো?

সেদিনের সকালটাকে মনে হয়েছিল; এর নির্দিষ্ট কোনো সময় নেই। গন্তব্য নেই। জীবন ও জগতের এ এক আশ্চর্য রকমের মোহ।

নিতুকে বললাম, “সকাল আটটায় একটা লোকাল ট্রেন থামবে। সেখানে উঠে পরের স্টেশনে নেমে যাবো আমরা।”

মাঝের সময়টা বসে ছিলাম প্ল্যাটফর্মে। জিজ্ঞাসা করলাম, “খিদে পেয়েছে?”

নিতু না সূচক মাথা নাড়ে।

“এদিকে আগে আসা হয়নি বুঝি?”

নিতু চুপ করে থাকে। কোথায় কীরকম একটা বিভীষিকার ছাপ তার চোখে-মুখে।

বললাম, “আমি অফিসের একটি কাজে এসেছি। সপ্তাহখানেক থাকবো।” নিতু বললো, “আমি পালিয়ে এসেছি। কতদিন থাকবো জানি না।” বলেই ব্যাগ থেকে কবি শেলির বইটি বের করে পড়তে শুরু করে।

“তুমি বছরের শেষ গীত,
তার শব-মিছিলের শোকার্ত সঙ্গীত
এই শেষ অন্ধকার রাত
বছরের কবর গৃহের অর্ধ-গোলাকার ছাদ”

[পৃথিবীতে সবাই মরার জন্য আত্মহত্যা করে না। কেউ কেউ বাঁচার জন্য করে। কারণ মানুষ মরতে পারে কিন্তু ভুলতে পারে না। (সংগৃহীত)]

নেহাত কথার প্রসঙ্গ ধরে ব্যক্তিগত আলাপের যে গল্প, সেই গল্পের হাত ধরে একদিন শিহাব সিদ্ধান্ত নেয়, হাসানকে সে আত্মহত্যা করতে বলবে। তারপর দিনের পর দিন হাসানের সাথে এই নিয়ে আলাপ আলোচনা কম হয়নি। এমতাবস্থায় একদিন এক সমঝোতা হয় তাদের মাঝে। হাসান সম্মতি জানিয়ে বলে, চলে যাবার আগে পৃথিবী বরাবর কিছু লিখে যেতে চায়। সেই চিঠি শেষ করে হাসান আত্মহত্যা করবার জন্য দড়ি কিনতে ঘর থেকে বের হয়। বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যায় সে ফেরে একটা অ্যাকুরিয়াম নিয়ে। সে আত্মহত্যা করবে না।

.

শিহাব সাদাসিধে একা মানুষ। রাত জেগে লেখে। তার লেখার বিষয়বস্তু ইলিউশন, ডিলিউশন ও হ্যালুসিনেশনকে ফিকশনে রূপান্তরিত করা। সে কেন তার রুমমেটকে বলছে আত্মহত্যা করতে?

এই ঘটনার প্রভাব থেকে বের হবার চেষ্টা কিংবা এই ঘটনাকে নিছক পাগলামির তালিকায় ফেলে দীর্ঘ একটা দম নিয়ে বলা ‘অনেক হয়েছে আর না’, এর কোনোটাই না করে শিহাব আরও নতুন উদ্যমে খুঁজে বেড়ায় আত্মহত্যা করার সবচেয়ে সহজ উপায় কী!

চিন্তার তিনটা স্তরে পৃথক পৃথক দ্বন্দ্ব নিয়ে শিহাব প্রায় সময় কাগজ কলম নিয়ে বসে। চিন্তার প্রথম স্তর, সে কেন মনে করছে হাসানের আত্মহত্যা করা উচিত? যেহেতু এই সিদ্ধান্তের সাথে একটা মানুষের বেঁচে থাকার সম্পর্ক, কাজেই সে পুনরায় চিন্তা করে।

দ্বিতীয় স্তরে তাকে চিন্তা করতে হয়, কীভাবে সে হাসানকে এরকম একটা কাজে প্রলুব্ধ করবে? প্রকৃতির প্রতি একটা মানুষের প্রায়শ্চিত্ত করার যে দায়বদ্ধতা থাকে, সেটা নিয়ে বিস্তর আলাপ করে সে হাসানকে বোঝাতে চায়, তার আত্মবিসর্জন দেয়া উচিত।

তারপর তৃতীয় স্তরে গিয়ে ভাবতে হয় আত্মহত্যা করার সবচেয়ে সহজ উপায় কী! একজন মানুষ যদি স্বপ্ন দেখতে দেখতে মারা যায় তাহলে সেই স্বপ্নটা কি থেমে যায়?

শিহাব কোনো ভুল করতে চায় না। সে পুনরায় চিন্তা করে। সে কেন মনে করছে হাসানের আত্মহত্যা করা উচিত? এই কৌতূহল ভাঙতে হলে অতীত হাতড়ে আসতে হবে।

একটু যদি পেছনে ফিরে যাই, শিহাব একদিন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কবিতার মতো হরেক রাস্তা ঘুরতে ঘুরতে ভরদুপুরে পুড়তে পুড়তে কোথা থেকে কোথায় যেন হাঁটছিল। হঠাৎই পথিমধ্যে রফিক সাহেবের সাথে দেখা।

.

রফিক সাহেব তার কাছে একজন অপ্রত্যাশিত মানুষ। বয়স পঞ্চাশের উপরে। কথা বলার সময় ঘনঘন চোখের দৃষ্টি পরিবর্তন করেন। এই টাইপ মানুষ অস্থির প্রকৃতির হয়ে থাকেন, কিন্তু রফিক সাহেব বেশ স্থির। কোনো একটা কিছু বলতে শুরু করলে, প্রসঙ্গ বদলে অনেক দূরে চলে যাবেন। যে মুহূর্তে আপনার মনে হবে, তিনি প্রসঙ্গ বদলে ফেলেছেন ঠিক সেই মুহূর্তে প্রসঙ্গে ফিরে আসে।

কড়া লিকারের চা অর্ডার করে রফিক সাহেব বললেন, “গত দুমাস ধরে তন্ন তন্ন করে খুঁজছি তোমাকে। ফোন করে পাই না। পান্থপথের বাসায় গিয়ে শুনলাম বাসা বদলেছো।”

শিহাব শুকনো মুখ করে তাকিয়ে রইলো। যারা মিথ্যে বলতে পারে আর যারা চোখের দিকে তাকিয়ে সত্য বলতে পারে, এই দুই দল মানুষের কোনো সমস্যা হয় না। শিহাব মাঝামাঝি দলের। মিথ্যাও বলতে পারে না, আবার চোখের দিকে তাকিয়ে সত্যটাও বলতে পারে না।

সক্রেটিস বলেছেন, সত্যপ্রীতি বিজ্ঞতার লক্ষণ, আবার চৈনিক দার্শনিক কনফুসিয়াস বলেছেন, সত্যের অনুসন্ধান করার চাইতে সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করা জরুরি। অর্থাৎ শুধু সত্যপ্রীতি থাকলে হবে না, সেটাকে মুখ খুলে বলতে হবে। কিন্তু শিহাব বলতে পারছে না। রফিক সাহেবকে সে বলতে পারছে না, লেখা এগোচ্ছে না।

রফিক সাহেব একজন প্রকাশক। শিহাবের একটা বই বেরুবে বলে কিছু টাকা অগ্রিমও দিয়েছেন। তিনি চায়ে চুমক দিয়ে বললেন, “লেখকদের মাঝে মাঝে এরকম হয়, লেখা আসে না। তখন স্থান পরিবর্তন করতে হয়।”

শিহাব বললো, “আমি সারাক্ষণই লেখি। পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা এক বসায় লিখে ফেলি।”

“তাহলে লেখা এগোচ্ছে না কেন?” রফিক সাহেব চিন্তিত হয়ে তার প্রশ্নের উত্তরের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন।

শিহাব বললো, “আমি সারাক্ষণই লিখছি কিন্তু লেখা এগোচ্ছে না।“

রফিক সাহেব কিছুটা ঝুঁকে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, “সেটা কীরকম?”

“আমার গল্পের চরিত্র একদিন বাসা থেকে বের হয়ে চৌরাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়ালো। তার সামনে চারটা রাস্তা। সে জানে না কোথায় যাবে। একটা ভুল গন্তব্য যত দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে আসতে হয়, ততখানিই আবার পেছনে যেতে হয়।“

রফিক সাহেব দ্বিতীয় দফা চা অর্ডার করে বললেন, “তুমি জিনিসটা বেশ জটিল করে ভাবছো।

“সহজটা কী?”

“দুর্গম পথ পাড়ি দেবার আগে গন্তব্য নিয়ে ভাবতে হয়।”

“আপনি কি ভাবছেন সে চিন্তা করেনি?”

“তাহলে সমস্যা কোথায়?”

“সমস্যা হলো, যে রাস্তা ধরে সে এগোতে থাকে, একটা সময় সেই রাস্তাকে ভুল মনে হয়।“

“তারপর?”

“সঠিক রাস্তা খুঁজে বেড়ায়।’

রফিক সাহেব চুপ করে শুনছেন। তিনি কি শিহাবকে ছিটগ্রস্ত মানুষ মনে করছেন? তাতে অবশ্য শিহাবের কিছু আসে যায় না। সত্য তো এই, সে লিখছে সারাক্ষণ কিন্তু লেখা এগোচ্ছে না।

আলোচনার এই পর্যায়ে হঠাৎ শিহাবের মাথায় একটা চিন্তার উদয় হলো। চৌরাস্তার মোড়ে কোন পথ সঠিক আর কোন পথ বেঠিক, সেটা কে নির্ধারণ করবে? পথ তো নিজে থেকে জন্ম নেয় না। মানুষই পথ তৈরি করে। আবার মানুষই পথ বন্ধ করে।

বিস্তীর্ণ মাঠে সবুজ ঘাসে কীভাবে পথ তৈরি হয় তার একটি সুন্দর বর্ণনা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় করেছিলেন, “ভারি আশ্চর্য লাগে যে মানুষের পায়ে পায়ে এমন সরু সুন্দর নির্দিষ্ট পথ কী করে গড়ে ওঠে। কে সকলকে বলে দেয় কোন আধহাত পরিসরের মধ্যে পা ফেলতে হবে?”

রফিক সাহেব মোবাইল থেকে ছবি বের করে বইয়ের প্রচ্ছদ দেখালেন। ডানায় আগুন নিয়ে একটা দলছুট পাখি আকাশে উড়ার চেষ্টা করছে। একজন ক্লান্ত চাষি উদাম গায়ে ঘাড় বাঁকা করে পাখিটির দিকে তাকিয়ে আছে।

মাস দুয়েক আগে প্রচ্ছদ নিয়ে কথা হয় শিহাবের সাথে। শিহাব বলেছিল, গহীন এক জঙ্গলে আগুন লেগেছে। শত শত গাছ, জীবজন্তু পুড়ে ছাই। এর ভেতরে একটা দলছুট পাখি ডানায় আগুন নিয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। এরকম একটা ছবি পোর্ট্রে করতে চায়, প্রচ্ছদে।

রফিক সাহেব বললেন, “ডানায় আগুন নিয়ে পাখিটার বেশিদূর যাবার কথা না। আপনি বলেছেন, একজন চাষি উদাম গাঁয়ে পাখিটা দেখছে। তাহলে তো পাখিটাকে লোকালয়ে আসতে হবে। ডানায় আগুন নিয়ে গহীন বন থেকে এতদূর আসা সম্ভব?”

শিহাব বললো, “ফিকশনের মজাটাই তো এখানে। আপনি এখানে স্বাধীন। যা ইচ্ছে করতে পারবেন। এজন্যই আমি নন-ফিকশন বই লিখি না।”

রফিক সাহেবকে ফিকশন এবং নন-ফিকশন নিয়ে খুব একটা চিন্তিত বলে মনে হলো না। এখানে প্রকৃতির একটা ভারসাম্য রক্ষা হলো। প্রকৃতি একটা বড়ো পরিকল্পনা অনেকগুলো মানুষকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কাজ দিয়ে করিয়ে নেয়।

.

শিহাব একা মানুষ। একা মানুষের কোনো পিছুটান থাকে না, কথাটা আসলে সঠিক না। জীবনের প্রতি ভালোবাসা হলো সব চাইতে বড়ো পিছুটান। ফরাসি নাট্যকার মলিয়ের মনে করতেন, সকল মানসিক দুর্বলতার মধ্যে জীবনের প্রতি ভালোবাসা সবচেয়ে শক্তিশালী।

বাড়ির সামনে একটা টিন সেডের ঘর আছে। বৃষ্টি এলে টিনের চালা চুইয়ে পানি পড়ে। অনেক দিন আগে হাসানকে দেখা গেল উদগ্রীব হয়ে বৃষ্টির ফোঁটা গুনছে। শিহাব বেশ অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো, “কী করছো?

“বৃষ্টির ফোঁটা গুনছি।

“বৃষ্টির ফোঁটা গুনে কী হবে?”

“কিছু হবে না। মনের শান্তি।”

“মনের শান্তির জন্য তুমি আর কী কর?”

হাসান কথার জবাব না দিয়ে বৃষ্টির ফোঁটা গুনতে শুরু করলো। টিনের চালা থেকে টুপটুপ করে একটা প্লাস্টিকের বালতিতে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে।

শিহাব বললো, “তোমাকে বুঝতে আমার অসুবিধা হয়।”

“কারণ আমরা দুজন আলাদা সত্তা।”

“আর আমরা যখন নিজেকে বোঝার চেষ্টা করি?”

“নিজেকে বোঝার কিছু নেই, নিজেকে তৈরি করতে হয়।”

“মানুষ কি নিজেকে তৈরি করতে পারে?“

“কেন না?”

‘আমি কীভাবে ভালোবাসব সেটা শুধুমাত্র আমি নির্ধারণ করি না, আমি যাকে ভালোবাসি সেও নির্ধারণ করে।

হাসান ভীত গলায় বললো, “আমি চাই না কেউ আমাকে নিয়ন্ত্ৰণ করুক।”

শিহাব হেসে বলে, “সম্ভব না। এর জন্য বিদ্রোহ করতে হয়।”

“কার সাথে?”

“প্রথমে নিজের সাথে, তারপর সবার সাথে। সবার সাথে বিদ্রোহ করা সহজ, শুধু তেজ লাগে। নিজের সাথে বিদ্রোহ করা কঠিন, নিজেকে জানা লাগে।”

হঠাৎই হাসান বালতির সব পানি ফেলে দিলো।

শিহাব বললো, “কী করছো?”

“প্রত্যেকবার ভুল করছি। কোথাও না কোথাও সংখ্যা হারিয়ে ফেলি।”

“আচ্ছা নিতুর বিশাল আকৃতির সুটকেসটা কী রঙের ছিল?”

“কোন সুটকেস?”

“ঐ যে, তোমরা দুজন ট্রেন থেকে একটা ভুল স্টেশনে নেমে গিয়েছিলে। তার হাতে একটা বিশাল আকৃতির সুটকেস ছিল।”

“এত কিছু থাকতে সুটকেসের রং কেন?”

“তুমি যখন বলছিলে, আমি তখন গল্পটা চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিলাম। বৃষ্টি ভেজা প্ল্যাটফর্ম। অন্ধকার রেললাইন। কাছেই মসজিদের মাইক থেকে আজানের শব্দ। দুজন মানুষ বসে আছে। একটা বিশাল আকৃতির সুটকেস। পুরো ছবিটা চোখের সামনে দেখছি। হঠাৎ মনে হলো, আচ্ছা সুটকেসের রং কী!”

একটুখানি জিরিয়ে শিহাব বলতে শুরু করে, “লেখকদের কল্পনা শক্তি খুব প্রবল থাকে। মনে কর একজন মানুষ রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। লেখকের ইচ্ছে হলো, রাস্তাটাকে লিখবে। তখন সে রাস্তার দিকে তাকায়। ঘাস উঠে গেছে এরকম কোনো মেঠো পথ নাকি পিচ ঢালা রাস্তা?

এবার লেখকের ইচ্ছে করলো, আকাশটা লিখবে। ফিকে হয়ে গেছে এরকম কোনো আকাশ নাকি থমথমে মেঘলা?

তার পোশাকের দিকে তাকাতে পারে। এক প্যাঁচে শাড়ি পরে হেঁটে যাচ্ছে। তার পায়ে কোনো স্যান্ডেল নেই। রাস্তার সামনে একটি ডাস্টবিন। ডাস্টবিন বরাবর পাশের দেয়ালে লেখা ‘এখানে প্রস্রাব করবেন না’, সেখানে একটা বাজারের ব্যাগ থেকে ফুটফুটে এক বাচ্চার মাথা বের হয়ে আছে। ছোটো ছোটো চোখ দিয়ে মিটমিট করে দেখছে, এক প্যাঁচে শাড়ি পরিহিত এক নারী পরম মমতায় তার দিকে তাকিয়ে আছে।

যে মানুষটা হেঁটে যাচ্ছে তার দিকে তাকানো যেতে পারে। তার মুখের অবয়ব কেমন, তাকে কি চিন্তিত মনে হচ্ছে? চিন্তার কারণ কী? লেখক ইচ্ছে করলে সেই চিন্তার কারণ থেকে একটা গল্পে ঢুকে যেতে পারে।

.

হাসান গণনায় ভুল করে। বৃষ্টি বেড়ে যাওয়াতে তাকে খুব দ্রুত কাউন্ট করতে হচ্ছে। কথার তালে খেই হারিয়ে বলতে শুরু করে, “সকাল আটটার লোকাল ট্রেনে করে আমরা তখন খুলনা জংশন রেলওয়ে স্টেশনে। নিতু সেদিন পালিয়ে এসেছিল বাসা থেকে। রাতের ধকলে ক্লান্ত ছিল খুব। একটা সিএনজি করে আমি তাকে বাসা অবধি নামিয়ে দিলাম।”

“নিতু বাসা থেকে পালিয়ে এসেছিল কেন?”

“তার একটা জায়গায় বিয়ের কথা চলছিল। ছেলেটাকে তার পছন্দ না।”

“ছেলেটাকে তার পছন্দ না, বলেছে?”

“হুম, বলেছে।’

“তারপর?”

“একদিন বিকেলে নিতুকে যে বাসায় নামিয়ে দিয়েছিলাম, সেখানে যাই। বাড়ির উঠোনে মহুয়া গাছ। দরজা ধরে দাঁড়াতেই দেখি, নিতু একটা সাদা বিড়াল নিয়ে খেলছে। আমাকে দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে, ‘আপনি!”

শিহাব বললো, “আপনি নিশ্চয়ই কবি শেলির বইটা ধার চেয়েছেন।

“ঠিক তা না। আমি সত্যটা বলেছি। বলেছি, আপনাকে দেখতে এলাম। সে ভেতরে বসতে দিলো। আমাকে বোঝার চেষ্টা করছিল কেন এসেছি। ভেতরে গিয়ে আমার জন্য চা-টা কিছু দিতে বললো। তার বান্ধবী চা নিয়ে এলে পরিচয় করিয়ে দিলো- ট্রেনের সেই আগন্তুক।

তার মানে আমার কথা সে আগে তার বান্ধবীর সাথে আলাপ করেছিল। চুপ করে বসে ছিলাম। মানুষ দুটো সময়ে চুপ করে থাকে যখন তার কথা বলার কিছু থাকে না আর যখন অনেক কথা থাকে কিন্তু সে বলতে পারে না। “

শিহাব জিজ্ঞাসা করলো, “তুমি কোন দলের?”

“আমি দ্বিতীয় দলের। আমার অনেক কথা ছিল কিন্তু আমি বলতে পারছিলাম না। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, যতটা না যাওয়া, তারচেয়ে বেশি যেতে চাওয়া।“

“তারপর?”

“বললাম, আমি অফিসের কাজে এসেছি। চলে যাবো পরশু। আপনি থাকবেন আর কতদিন?”

নিতু মাথা নাড়িয়ে বলে, ‘জানি না।’

“আজগুবি কারণে আমার তাকে জানতে ইচ্ছে করছিল। কেন পালিয়ে এসেছে, কোথায় যাবে তারপর…এসব আর কী।”

শিহাব চুপ করে থাকে।

হাসান বলতে শুরু করে, “আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলাম তাকে। বিস্মিত

হলে কেমন করে ভ্রু উপরে তোলে, কথা বলার সময় কেমন থেমে থেমে কথা বলে। আমি রসিকতা করে বললাম, আপনি এত থেমে থেমে কথা বলেন, মাঝেমধ্যে কিন্তু এর কারণে ভাষার অর্থ পরিবর্তন হয়।

আমার কথা শুনে নিতু অবাক হয়ে বলে, ‘সেটা কীরকম?’

হেসে বললাম, “এই ধরুন আপনি বললেন, এটা সত্য গল্প না। ‘এটা সত্য’ বলে যদি আপনি একটা বিরতি নেন, তারপর যদি বলেন ‘গল্প না’ তাহলে কিন্তু ভাষার অর্থ পরিবর্তন হয়।

.

শিহাব বোঝার চেষ্টা করে হাসানকে। নিজের ভেতরের ইচ্ছেগুলো কথার অবাধ্য হয়ে দীপ্ত পদচারণে দাপিয়ে বেড়ায়? নাকি প্রতিবাদ করা খরগোশের মতো, বাহানা দেয়- ঘুম তার জৈবিক ছিল।

হাসান বলতে শুরু করে, “খুলনার চুইঝাল মাংসের রেসিপি থেকে কথার খেই হারিয়ে আমরা চলে গিয়েছি প্যারিসের কফি শপে। তারপর শহরের অলিগলি যেন একসাথে হেঁটে ক্লান্ত হয়ে দাঁড়ালাম আইফেল টাওয়ারের সামনে। বললাম, “রাতে যখন আইফেল টাওয়ারে কয়েক লাখ রঙিন বাতি একসাথে রং বদলাতে শুরু করে তখন যে কী অপূর্ব আলোর কেমিস্ট্রি তৈরি হয়, সেটা না দেখে জীবন সার্থক হয় কী করে?”

নিতু মলিন হেসে বলে, “সৌন্দর্য আইফেল টাওয়ারে না, সৌন্দর্য মানুষের মনে।”

কথায় কথায় দুপুর হয়ে এলে সে একবার উঠে ভেতরের ঘরে যায়। কিছু সময় পর এসে বললো, ‘টেবিলে খাবার দেয়া হয়েছে।’

এমনভাবে সে বলেছে, তার বলার ভেতরে কোনো জিজ্ঞাসা ছিল না। ট্রেনের অচেনা আগন্তুক একদিন কোনো কারণ ছাড়া উপস্থিত হওয়া যেমন অস্বাভাবিক, তেমনি তাকে জিজ্ঞাসা না করে টেবিলে খাবার দেয়া হয়েছে বলাটাও অস্বাভাবিক।”

শিহাব জানতে চায়, “তারপর?”

হাসান বিছানার দেয়ালে হেলান দিয়ে বলতে থাকে, “টেবিলে দুপদের খাবার। আলু দিয়ে বেগুন ভাজি আর কাঁচকলা দিয়ে শিং মাছের ঝোল। খেতে বসে লক্ষ্য করলাম, নিতু তেমন কোনো কথা বলছে না। বান্ধবীকে উদ্দেশ্য করে বললো, এই ভদ্রলোক না থাকলে সেদিন কী বিপদেই না পড়তে হতো!

আমিও সৌজন্য রক্ষার্থে মুখ নাড়ছি এ আর এমন কী!

কে বলবে কিছুক্ষণ আগে এই মেয়েটি আমার সাথে প্যারিসের অলিগলি হেঁটে ক্লান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল আইফেল টাওয়ারের সামনে। চলে যাওয়ার সময় কবি শেলির বইটা চেয়ে নিলাম। নিতু বইটা দিয়ে বললো, ‘ফেরত দিতে হবে না।‘

আমি মন খারাপ করে উঠোনের মহুয়া গাছ অতিক্রম করে বের হলাম রাস্তায়। দুদিন পর খুলনা ছেড়ে ঢাকায় ফিরে আসি। তার কিছুদিন যেতেই একদিন কবি শেলির বইটি পড়তে শুরু করলাম।

“কেন জন্ম ও মৃত্যু, স্বপ্ন এবং ভয়
ফিরে ফিরে আসে এই পৃথিবীর আলোয়
এমন অন্ধকার, মানুষ কেন এমন করে পায়?
প্রেম আর ঘৃণা, হতাশা আর আশায়?”

এর ভেতরে অফিস চলছে। বাবা মা মারা গেছে ছেলেবেলায়। আমি বড়ো হয়েছি মেজো মামার বাসায়। মেজো মামার কোনো সন্তান ছিল না। একটু একটু করে যখন বড়ো হতে শুরু করি, প্রায় সময় দেখতে পেতাম মামা-মামি ঝগড়া করছেন।

মামি একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। সেখানে এক কলিগের সাথে মামির সম্পর্ক আছে বলে মামার ধারণা। তারপর একদিন স্বীকারও করলেন মামি। কী যে একটা সময় ছিল। হঠাৎ মস্তিষ্কজনিত আঘাতের কারণে মেজো মামা প্যারালাইজড হয়ে বিছানায় পড়ে গেলেন। শরীরের বাঁ দিক সম্পূর্ণ অকেজো। জমানো যা টাকা ছিল, এর ওর কাছ থেকে ধার দেনা করে চলছে সংসার।

একদিন ঘুম থেকে উঠে শুনি মামি চলে গেছেন। কিছুদিন পর ডিভোর্সের কাগজ আসে। পরে জানতে পারি, সেই ভদ্রলোকের সাথে মামির বিয়ে হয়েছে।

তখন মেজো মামার বাসায় থেকেই অফিস করছি। চাকরিটাও ভালো ছিল, সবেমাত্র প্রমোশন পেয়েছি। এর ভেতরে একদিন অফিসের কাজে খুলনায় যাবার পথে দেখা নিতুর সাথে। আপনি কি আমার গল্পটা বুঝতে পারছেন?”

.

শিহাব মন খারাপ করে শুনছে হাসানের কথা। কোথায় যেন একটা কীরকম

অন্তঃসারশূন্য।

“তেমনি একদিন অফিস থেকে ফিরে এসে কবি শেলির বইটি হাতে নিয়ে মনে হলো, জীবনটা খুব একটা খারাপ না। অদ্ভুত এক কারণে তার সাথে কাটানো প্রত্যেকটি মুহূর্ত বারবার পুনরাবৃত্তি হতে লাগলো।”

“মুহূর্ত পুনরাবৃত্তি?”

“হ্যাঁ, মুহূর্ত পুনরাবৃত্তি। এই যেমন রান্না ঘরে কাজ করছি হঠাৎ করে চোখের সামনে একটা বৃষ্টিস্নাত প্ল্যাটফর্ম আশে পাশের সব জীবন্ত ছবি নিয়ে চোখের সামনে ভেসে আসে। তারপর মুহূর্তটা এখানেই শেষ হয় না। সেই ভোর থেকে সকাল আটটার ট্রেন আসার আগ অবধি যতগুলো মুহূর্ত একের পর এক ঘটেছিল সব ক্রমিক স্বাভাবিক সংখ্যার মতো আসতে থাকে।

.

তারপর ধরুন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁত ব্রাশ করছি কিংবা রিমোট নিয়ে অকারণে চ্যানেল বদলাচ্ছি হঠাৎ অন্য আরেকটি মুহূর্ত এসে হাজির। বাড়ির উঠোনে মহুয়া গাছ। দরজা ধরে দাঁড়াতেই দেখি, নিতু একটি সাদা বিড়াল নিয়ে খেলছে। আমাকে দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে, ‘আপনি!’

এসব কল্পনা নতুন নতুন তুচ্ছ থেকে তুচ্ছতর চিন্তার জন্ম দেয়। নিতু কেন বইটি দিয়ে বললো, ফেরত দিতে হবে না? সে কি চায় না আমি আর কোনো ছুতো ধরে তার কাছে আসি?”

“এরপর নিতুর সাথে দেখা হয়েছিল কীভাবে?” প্রশ্ন করে শিহাব।

“অফিস থেকে ছুটি নিয়ে ট্রেনে করে চলে যাই খুলনায়। প্রথমদিন হোটেলেই কাটলো। নিতুর সাথে দেখা হয়েছিল পরদিন। গেটের ভেতরে ঢুকতেই দেখি নিতু উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখে হঠাৎ উদ্বিগ্ন।

নিতুর স্বভাব হয়েছে আমার মতো। মনের অভিব্যক্তি আড়াল থাকে না, মুখে লেগে থাকে। তার তাকানোর ভেতরে কেমন একটা উটকো সন্দেহ। বললাম, আবার আসতে হয়েছে অফিসের কাজে। নিতু বললো, আমার কাছে কেন?”

[“নিজেকে বোঝার কিছু নেই, নিজেকে তৈরি করতে হয়।”(সংগৃহীত)]

একদিন ভরদুপুরে ভ্যাপসা গরমে নিউমার্কেটের সামনে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে শিহাব, পথিমধ্যে দেখা রফিক সাহেবের সাথে। একটা চায়ের দোকানে বসে চা অর্ডার করে একে অন্যের দিকে মুখ করে তাকিয়ে রইলো। রফিক সাহেবের হাতে একটা ছাতা। গরমে ঘেমে ক্লান্ত উষ্কখুষ্ক চুল নিয়ে বললেন, “লেখা কতদূর?”

শিহাব বললো, “লিখছি। কিন্তু…”

“কিন্তু কী?”

“ লেখা এগোচ্ছে না।”

রফিক সাহেব বললেন, “কতদূর লিখেছো?”

“আমি তো সারাক্ষণই লেখি। সমস্যা হলো…’

রফিক সাহেব শিহাবকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “আগের সমস্যাটাই?”

শিহাব হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ে।

“কত পৃষ্ঠা লিখেছো?”

“পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা আবার শূন্য।“

“কীরকম?”

“একটা ভুল গন্তব্য যত দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে আসতে হয়, ততটুকুই আবার পেছনে যেতে হয়।”

রফিক সাহেবকে চিন্তিত মনে হলো।

শিহাব এডভান্সের টাকা ফেরত দিয়ে বললো, “বাদ দিন ভাই। আমাকে দিয়ে এই কম্প্রোমাইজটা হবে না।”

“কীসের কম্প্রোমাইজ?”

“আমি আমার চরিত্রগুলোকে ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না।”

রফিক সাহেব মন খারাপ করে শুনলেন। তারপর আশ্বস্ত করে বললেন, “আপনি লিখতে থাকুন। পাণ্ডুলিপি যখন শেষ হবে তখন দিলেই হবে।“

বাসায় ফেরার পথে শিহাব দোকান থেকে নতুন কাগজ আর কলম কিনলো। সব মানুষের যেরকম সব মানুষের সাথে বনিবনা হয় না, তেমনি সব কলমের সাথেও লেখকের বনিবনা হয় না।

.

শিহাবের জন্ম হয়েছিল শীতের সময়। কত প্রেম-অশান্তি, কত মানুষের যোগ বিয়োগ গুণ ভাগে আজ এখানটায় এসে দাঁড়িয়ে।

একটা সময় খুব বদলে দেবার হিড়িক ছিল মনের ভেতরে। চোখ বন্ধ করলেই স্বপ্ন দেখতো। স্বপ্নগুলোর ডালপালা ছিল। অন্তহীন এই যাত্রায় কীভাবে যেন ভুলে গিয়েছে ষোল সতেরো বছর বালকের অসাধ্য সাধন করবার জেদগুলো!

এরকম সংসার ছাড়া ছিল না কখনো। ঘর ভর্তি মানুষ ছিল। শিহাবের বাবা সরকারি অফিসে চাকরি করতেন। মা সামলে রাখতেন ঘর। ছোটো বোনের নাম মানহা। মানহা নামের অর্থ আল্লাহ্র দান। বাবা খুব শখ করে ওর নাম রেখেছিল।

শিহাবের আর বিয়ে করা হলো না। বাবা মারা গেছে বছর পাঁচেক আগে। আর মা? খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে আরও দুবছর বেঁচে ছিলেন। মস্ত বড়ো এক ডাইনোসরের গর্ভে মিশে গেছে আস্ত একটা অতীত।

বাবা মারা যাবার পর ডাইনিং টেবিলে একটা চেয়ার খালি থাকত। মা মারা যাবার পর দুইটা। যেদিন মানহার বিয়ে হলো সেদিন থেকে ধ্বংসস্তূপের শেষ চিহ্ন তাকে মনে করিয়ে দিলো, এতগুলো ঘর আর আসবাবপত্রের আর দরকার নেই। খামোখা স্মৃতি হাতড়ে কষ্ট পেতে হয়।

একটা সাজানো গোছানো বহুবছরের সংসার, যেন ঠেলাগাড়িতে করে নিয়ে যাওয়া হয় পুরাতন আসবাবপত্রের দোকানে। কত আয়োজন করে এক একটা সংসারের জন্ম হয় অথচ শেষটা এমন হয়, কখন শেষ হয় জানতেও পারা যায় না।

একেবারেই একা একা বেঁচে থাকা খুব কষ্টের। তাই আগের বাসাটা বদলে রুমমেট নিয়ে একসাথে থাকা। একটা উত্তাল সাগরে স্রোত যেরকম ক্ষণে ক্ষণে দিক পরিবর্তন করে অন্য কোথাও নিয়ে যায়, তেমনি আবির্ভাব হাসানের।

হাসানের কাছ থেকে তার গল্পের সূত্র ধরে সে হেঁটে বেড়ায় খুলনা জংশন স্টেশন রোডে। সেখানে আলাদা কিছু মানুষের আলাদা রকমের অতীত, আলাদা রকমের কষ্ট কিন্তু কোথাও না কোথাও তারা দুজন একই রকমের শূন্যতা নিয়ে একসাথে থাকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *